নীল হাতি
পৃষ্ঠা ১ থেকে ৫
পৃষ্ঠা-১
নীল হাতী
নীলুর যে মামা আমেরিকা থাকেন তাকে সে কখনও দেখেনি। নীলুর জন্মের আগেই তিনি চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। নীলুর এই মামার কথা বাসার সবাই বলাবলি করে। মা প্রায়ই বলেন, আহ্ সঞ্জুটা একবার যদি দেশে আসত!কিন্তু নীলুর সেই মামা নাকি আর দেশে ফিরবেন না। কোনো দিন না। একবার নানিজানের খুব অসুখ হলো। টেলিগ্রাম করা হলো সঞ্জু মামাকে। সবাই ভাবল এবার বুঝি আসবে। তাও এলো না। নীলুর বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, মেমসাহেব বিয়ে করে ফেলেছে এখন কি আর আসবে?নীলুর খুব ইচ্ছে করে সেই মামাকে আর তার মেমসাহেব বৌকে দেখতে। কিন্তু তার ইচ্ছে হলেই তো হবে না। মামা তো আর ফিরবেই না দেশে। কাজেই অনেক ভেবেটেবে নীলু এক কাণ্ড করল। চিঠি লিখে ফেলল মামাকে। চিঠিতে বড় বড় করে। লিখল-মামা,আপনি কেমন নাম নীলু। আপনাকে আছেন? আমার আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আর মেমসাহেব মামীকে দেখতে ইচ্ছে করে।
ইতি
নীলু।
সেই চিঠির উল্টোপিঠে সে আঁকল পাখি আর সূর্যের ছবি। আর আঁকল মস্ত বড় নদী। সেই নদীতে পাল তুলে নৌকা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ভারি সুন্দর হলো ছবিটা! নীলু ভাবল, এইবার মামা নিশ্চয়ই আসবে।মামা কিন্তু এলো না। একদিন দুদিন হয়ে গেল, তবু না। মামা চিঠির জবাবও পর্যন্ত দিল না। অপেক্ষা করতে করতে নীলু ভুলেই গেল যে, সে মামাকে চিঠি লিখেছিল। তারপরই এক কাণ্ড।সেদিন নীলুর খুব। দাঁতব্যথা। সে স্কুলে যায়নি। গলায় মাফলার জড়িয়ে একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। এমন সময় ভিজতে ভিজতে পিয়ন এসে হাজির। এই বাড়িতে নীলু নামে কেউ থাকে? নীল আশ্চর্য হয়ে বলল-হ্যাঁ। আমার নাম নীলু।পিয়নটি গম্ভীর হয়ে বলল, নীচে নেমে এসো খুকি। তোমার জন্যে আমেরিকা থেকে কে একজন একটা উপহার পাঠিয়েছে। নাম সই করে নিয়ে যাও। নাম লিখতে পার খুকি?হ্যাঁ, পারি।নীলু উপহারের প্যাকেটটি খুব সাবধানে খুলল। পিয়ন তখনও ate যায়নি, পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। প্যাকেটের ভেতর থেকে Sett
পৃষ্ঠা-২
বেরুল নীল রঙের একটা হাতী। গলায় রুপোর ঘণ্টা বাজছে, টুন টুন করে। হাতীর গুঁড় আপনা থেকেই দুলছে। মাঝে মাঝে আবার কান নাড়াচ্ছে।এত সুন্দর হাতী নীলু এর আগে আর কখনও দেখেনি। শুধু নীলু নয়, তার আব্বাও এত সুন্দর হাতী দেখেনি। অফিস থেকে ফিরেই তিনি দেখলেন তাঁর টেবিলে নীল হাতী গুঁড় দোলাচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আরে, কে আনল এটা? বড় সুন্দর তো!নীলু বলল, সঞ্জু মামা পাঠিয়েছেন। দেখেন আব্বা আপনা- আপনি ঘণ্টা বাজে।তাই তো তাই তো।নীলুর মা নিজেও এত সুন্দর হাতী দেখেননি। তিনি কতবার যে বললেন-চাবি ছাড়াই গুঁড় দোলায় কী করে? ভারি অদ্ভুত তো? নিশ্চয়ই খুব দামি জিনিস।সন্ধ্যাবেলা নীলুর স্যার এলেন পড়াতে। মা বললেন- পড়তে যাও নীলু আর হাতী শোকেসে তালাবদ্ধ করে রাখো। নয় তো আবার ভেঙে ফেলবে।মার যে কথা, এত সুন্দর জিনিস বুঝি শোকেসে ভুলে রাখবে? হাতী থাকবে তার নিজের কাছে। রাতে নীলুর পাশের বালিশে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে। অনেক রাতে যদি তার ঘুম ভাঙে, তাহলে সে খেলবে হাতীর সঙ্গে।মা কিন্তু সত্যি সত্যি শোকেসে হাতী তালাবদ্ধ করে রাখলেন। নীলুকে বললেন, সব সময় এটা হাতে করে রাখবার দরকার কী? যখন বন্ধুবান্ধব আসবে তখন বের করে দেখাবে। এখন যাও স্যারের কাছে পড়তে।নীলু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, স্যারকে দেখাতে নিয়ে যাই মা? উই, পড়া শেষ করে স্যারকে দেখাবে। এখন যাও বই নিয়ে।
পৃষ্ঠা-৩
হাতীকে রেখে যেতে নীলুর যে কী খারাপ লাগছিল। তার চোখ ছলছল করতে লাগল। একবার ইচ্ছে করল কেঁদে ফেলবে। কিন্তু বড় মেয়েদের তো কাঁদতে নেই, তাই কাঁদল না।অনেকক্ষণ স্যার পড়ালেন নীলুকে। যখন তার যাবার সময় হলো তখন নীলু বলল স্যার, একটা জিনিস দেখবেন?কী জিনিস?একটা নীল হাতী। আমার মামা পাঠিয়েছেন আমেরিকা থেকে।কোথায়, দেখি।নীলু স্যারকে বসবার ঘরে নিয়ে এলো। তিনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। শেষে বললেন-এত সুন্দর।জি স্যার, খুব সুন্দর। গলার ঘণ্টাটা রুপোর তৈরি।তাই নাকি?জি।স্যার চলে যাবার পরও নীলু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শোকেসের সামনে। মা যখন ভাত খেতে ডাকলেন, তখন আবার বলল দাও না মা শুধু আজ রাতের জন্যে।না নীলু। শুধু বিরক্ত করো তুমি।নীলুর এত মন খারাপ হলো যে, ঘুমুতে গিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল একা একা। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখল।যেন একটা বিরাট বড় বন। সেই বনে অসংখ্য পশুপাখি। নীলু তাদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটুও ভয় করছে না। তার নীল হাতীও আছে তার সঙ্গে। টুন টুন ঝুন ঝুন করে তার গলায় রুপোর ঘন্টা বাজছে। বনের সব পশুপাখি অবাক হয়ে দেখছে তাদের। একটি সিংহ জিজ্ঞেস করল, তুমি কে ভাই?নীলু বলল, আমি এই বনের রানী। আমার নাম নীলাঞ্জনা। আর এই নীল হাতী আমার বন্ধু।
পৃষ্ঠা-৪
পরদিন স্কুল থেকে নীলুর বন্ধুরা এলো হাতী দেখতে। শায়লা, বীনু, আভা সবাই শুধু হাতীর গায়ে হাত বুলোতে চায়বীনু বলল, এত সুন্দর হাতী শুধু আমেরিকায় পাওয়া যায়, তাই না নীলু?নীলু গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ।শায়লার বড় ভাই থাকেন জাপানে। সে বলল, জাপানে পাওয়া গেলে আমার বড় ভাই নিশ্চয়ই পাঠাত।
আভা বলল, হাতীটাকে একটু কোলে নেব নীলু, তোমার মা বকবে না তো?না বকবে না, নাও।সবাই তারা অনেকক্ষণ করে কোলে রাখল হাতী। আর হাতীটাও খুব গুঁড় দোলাতে লাগল, কান নাড়াতে লাগল। ঝুন ঝুন। টুন টুন করে ঘণ্টা বাজাতে লাগল।হাতী দেখতে শুধু যে নীলুর বন্ধুরাই এলো, তা-ই নয়। নীলুর বড় খালা এলেন, চাচারা এলেন। আম্মার এক বান্ধবীও এসে হাতী দেখে গেলেন। নীলু স্কুলে গেলে অন্য ক্লাসের মেয়েরা এসে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাকি ভাই খুব চমৎকার একটা নীল হাতী আছে?কিন্তু ঠিক দুদিনের দিন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। সেদিন নীলুর মার এক বান্ধবী এসেছে বেড়াতে। তার সঙ্গে এসেছে তার ছোট ছেলে টিটো। এসেই ছেলেটার ট্যা ট্যা করে কান্না। কিছুতেই কান্না থামে না। নীলুর মা বললেন, যাও তো নীলু, টিটোকে তোমার ছবির বই দেখাও। নীলু ছবির বই আনতেই সে একটানে ছবির বইয়ের পাতা ছিড়ে ফেলল। এমন পাজি ছেলে।নীলুর মা বললেন, মিষ্টি খাবে টিটো। চমচম খাবে?না।শরবত খাবে?
পৃষ্ঠা-৫
উই।এমন কাঁদুনে ছেলে নীলু জীবনেও দেখেনি। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে আবার গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে। শেষে নীলুর মা বললেন, হাতী দেখবে টিটো? দেখো, কী সুন্দর একটা হাতী।ওমা, কী কাণ্ডা হাতী দেখেই কান্না থেমে গেল বাবুর। তখন তার সেকী হাসির ঘটা। নীলুর ভয় ভয় করতে লাগল, যদি হাত থেকে ফেলে ভেঙে দেয়। একবার ইচ্ছে হলো বলে, এত শক্ত করে ধরে না টিটো। টেবিলের উপর রেখে দেখো। এত শক্ত করে চেপে ধরলে ভেঙে যাবে যে।কিন্তু নীলু কিছু বলল না।মেহমানরা অনেকক্ষণ থাকলেন। চা খেলেন, টিভি দেখলেন। আর টিটো সারাক্ষণ হাতী নিয়ে খেলতে লাগল। যখন তাদের যাবার সময় হলো, তখন টিটো গম্ভীর হয়ে বলল, এই হাতীটা আমি নেব।ধড়াস করে উঠল নীলুর বুক। টিটোর মা বললেন, ছিঃ টিটো, এটা তো নীলুর!হোক নীলুর, আমি নেব। এই বলেই সে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করল। কিছুতেই কান্না থামানো যায় না। নীলুর মা বললেন, টিটো, হাতীটা নীলুর খুব আদরের। তুমি এই জিরাফটা নাও। দেখো কী চমৎকার লম্বা গলা জিরাফের।টিটো জিরাফের দিকে ফিরেও তাকাল না। হাতীটাকে দু হাতে আঁকড়ে ধরে আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল।নীলুর মনে হলো তার গলার কাছে শক্ত একটা কী যেন জমাট বেধে আছে। সে যেন কেঁদে ফেলবে তক্ষুনি। নীলু দৌড়ে চলে গেল ছাদে। ছাদে একা একা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি আমার নীল হাতী কিছুতেই দেব না, কিছুতেই দেব না।
পৃষ্ঠা ৬ থেকে ১০
পৃষ্ঠা-৬
এক পরে মা এসে নীলুকে ছাদ থেকে নামিয়ে নিয়ে । শান্ত স্বরে বললেন, এত সামান্য জিনিস নিয়ে এত আছে নীলু, ছিঃ! খেলনা কি কোনো বড় জিনিস নাকি?এ বলল, টিটো কি আমার হাতী নিয়ে গেছে?লুর মা চুপ করে রইলেন। নীলু বসবার ঘরে এসে দেখে সের যে জায়গায় দাঁড়িয়ে নীল হাতী গুঁড় দোলাত সেখানে নই।ালু বলল, টিটো আমার হাতী নিয়ে গেছে মা?নীলুর মা বললেন, তোমার মামাকে চিঠি লিখব, দেখবে এর এনেক সুন্দর আরেকটা হাতী পাঠাবে।নীলু কথা বলল না।রাতের বেলা অল্প চারটা ভাত মুখে দিয়েই উঠে পড়ল নীলু। । বললেন, ভাত খেলে না যে মা?খিদে নেই বাবা।সিনেমা দেখবে মা? চলো একটা সিনেমা দেখে আসি। না।গল্পের বই কিনবে। চলো বই কিনে দিই।চাই না গল্পের বই।লাল জুতো কিনতে চেয়েছিলে, চলো কিনে দেব। আমার কিচ্ছু চাই না বাবা। নীলু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সেই রাতে খুব জ্যোৎস্না হয়েছে। ছোট কাকু ছাদে মাদুর পেতে শুয়েছেন। নীলুও তার ছোট্ট বালিশ এনে শুয়েছে তার কাকুর পাশে। কাকু নীলুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, হাতীটার জন্যে তোমার খুব খারাপ লাগছে মা? হ্যা লাগছে। টিটোর শখ মিটে গেলে আমরা ঐ হাতী
পৃষ্ঠা-৭
নীলু চুপ করে রইল।ছোট কাকু বললেন, গল্প শুনবে মা?বলো।কিসের গল্প শুনবে?নীলু মৃদু স্বরে বলল, হাতীর গল্প।ছোট কাকু বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে গল্প শুরু করলেন।আমাদের গ্রামের বাড়ি হিরণপুরে রহিম শেখ নামে খুব ধনী এক লোক ছিলেন। তার একটি মাদি হাতী ছিল।সত্যিকারের হাতী কাকু?হ্যাঁ মা। প্রকাণ্ড হাতী। রহিম শেখ খুব ভালোবাসত হাতীটাকে। ঠিক তোমার মতো ভালোবাসত।সেই হাতীটার গায়ের রঙ কি নীল?না মা, মেটে রঙের হাতী ছিল সেটি। তারপর একদিন হঠাৎ করে হাতীটা পালিয়ে গেল গারো পাহাড়ে। চার বছর আর কোনো খবর পাওয়া গেল না। রহিম শেখ কত জায়গায় যে খোঁজ করল। কোনো খবর নেই। হাতীর শোকে অস্থির হয়ে গিয়েছিল সে। রাতে ঘুমুতো না। শুধু বলত, আমার হাতী যদি রাতে ফিরে আসে?তারপর এক রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হলো। বাতাসের গর্জনে কান পাতা দায়। এমন সময় রহিম শেখ শুনল, কে যেন তার ঘরের দরজা ঠেলছে। রহিম শেখ চেঁচিয়ে বলল, কে? অমনি ঝড়ের গর্জন ছাপিয়ে হাতী ডেকে উঠল। রহিম শেখ হতভম্ব হয়ে দেখল, চার বছর পর হাতী ফিরে এসেছে। তার সঙ্গে ছোট্ট একটা বাচ্চা। আশপাশের গ্রামের কত লোক যে সেই হাতী দেখতে এলো। তুমি গিয়েছিলে?হ্যাঁ মা, গিয়েছিলাম। হাতীর বাচ্চাটা ভীষণ দুষ্টু ছিল। পুকুরে আই মামাষের ঘরে
পৃষ্ঠা-৮
ঢুকে চাল-ডাল ফেলে একাকার করত। কিন্তু কেউ কিছু বলত না। সবাই তার নাম দিয়েছিল ‘পাগলা মিয়া’। গল্প শুনে নীলুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সে ফিসফিস করে বলল, সত্যিকার হাতী হলে আমারটাও ফিরে আসত, তাই না চাটাহ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসত। অনেক রাত হয়েয়ছে, ঘুমুতে যাও মা। নীলুর কিন্তু ঘুম এলো না। বাইরে জ্যোৎজ্জার ফিনিক ফুটেছে। বাগানে হাসনুহানার গাছ থেকে ভেসে আসছে ফুলের গন্ধ। নীলুর মন কেমন করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে অনেক রাত হলো। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে সারা বাড়ি নিশ্চুপ হয়ে গেল। নীলু কিন্তু জেগেই রইল। তারপর সেই আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটল। নীলু শুনতে পেল নীচের বাগানে টুন টুন ঝুন ঝুন শব্দ হচ্ছে। রহিম শেখের হাতীর মতো তার হাতীটাও ফিরে এসেছে নাকি? হাতীর গলার ঘণ্টার শব্দ বলেই তো মনে হয়। জানালা দিয়ে কিছু দেখা যায় না। নীলু কি তার মাকে ডেকে তুলবে? কিন্তু মা যদি রাগ করেন, নীলু হয়তো ভুল শুনছে কানে। হয়তো এটা ঘন্টার শব্দ নয়। তুল হবার কথাও তো নয়। চারদিক চুপচাপ, এর মধ্যে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে টুন টুন ঝুন ঝুন শব্দ।নীলু পা টিপে টিপে নীচে নেমে এলো। দরজার উপরের ছিটকিনি লাগানো। সে চেয়ার এনে তার উপর দাঁড়িয়ে খুলে ফেলল দরজা। তার ভয় করছিল। তবু সে নেমে গেল বাগানে। আর নেমেই হতভম্ব হয়ে দেখল, তার নীল হাতী গুঁড় দিয়ে টুন টুন করে ঘণ্টা বাজিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। হাতীটি নীলুকে দেখেই পরিষ্কার মানুষের মতো গলায় বলে উঠল, আমি এসেছি নীলু।অনেকক্ষণ নীলুর মুখে কোনো কথা ফুটল না। হাতী বলল, আরো আগেই আসতাম। পথঘাট চিনি না, তাই দেরি হলো। তুমি খুশি হয়েছ তো বন্ধু।
পৃষ্ঠা-৯
নীলু গাঢ় স্বরে বলল, হ্যাঁ।আমিও খুশি হয়েছি। টিটো যখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি কেঁদেছি।নীলু হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে চুমু খেল তার বন্ধুকে। আনন্দে হাতী টুন টুন ঝুন ঝুন করে অনবরত তার ঘণ্টা বাজাতে লাগল। নীলু গলা ফাটিয়ে ডাকল, মা আমার নীল হাতী এসেছে।দুপুররাতে জেগে উঠল বাড়ির লোকজন। বাবা বললেন, মনে হয় হাতীটা ঐ ছেলেটির হাত থেকে বাগানে পড়ে গিয়েছিল।মা বললেন, আচ্ছা সাহস তো মেয়ের। এত রাতে একা বাগানে এসেছে।নীলু মার কোলে মুখ গুঁজে বলল, মা আমার হাতী একা একা টিটোদের বাসা থেকে হেঁটে চলে এসেছে। আমাকে সে নিজে বলেছে।বাসার সবাই হেসে উঠল। বাবা বললেন, ছি মা, আবার মিথ্যে কথা বলছ?কিন্তু বাবা তো জানেন না, নীলু একটুও মিথ্যা বলেনি।
একটি মামদো ভূতের গল্প
আজ নীলুর জন্মদিন।জন্মদিনে খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে হয়। তাই নীলু সারা দিন খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকল। ছোট কাকু তাকে রাগ্যবার জন্যে কতবার বললেন নীলু বড় বোকা খায় শুধু পোকাতবু নীলু একটুও রাগ করল না। শুধু হাসল। বাবা বললেন নীলু মা টেবিল থেকে আমার চশমাটা এনে দাও তো। নীলু দৌড়ে চশমা এনে দিল। হাত থেকে ফেলে দিল না। কুলপি মালাইওয়ালা বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে হেঁকে ডাকল, চাই কুলপি মালাই। কিন্তু নীলু অন্য দিনের মতো বলল না, বাবা আমি কুলপি মালাই খাব জন্মদিনে নিজ থেকে কিছু চাইতে নেই তো, তাই।কিন্তু সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। তখন নীলুর অঙ্ক স্যার এসেছেন, নীলু বইখাতা নিয়ে বসেছে মাত্র। পড়া
পৃষ্ঠা-১০
শুরু হয়নি। নীলুর ছোট কাকু এসে বললেন, আজ তোমার পড়তে হবে না নীলু।কেন কাকুঃতোমার মার খুব অসুখ। তুমি দোতলায় যাও।নীলু দোতলায় উঠে দেখে চারদিক কেমন চুপচাপ। কালো ব্যাগ হাতে একজন ডাক্তার বসে আছেন বারান্দায়। নীলুর বাবা গম্ভীর হয়ে শুধু সিগারেট টানছেন। কিছুক্ষণ পর মস্ত গাড়ি করে একজন বুড়ো ডাক্তার এলেন। খুব রাগী চেহারা তাঁর। এইসব দেখে নীলুর ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। সে এখন বড় হয়েছে। বড় মেয়েদের কাঁদতে নেই, তবু সে কেঁদে ফেলল। বাবা বললেন, নীলু, নীচে যাও তো মা। কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে? কিন্তু নীলুর এত খারাপ লাগছে যে না কেঁদে কী করবে? আজ ভোরবেলায়ও সে দেখেছে মার কিছু হয়নি। তাকে হাসতে হাসতে বলেছেন, জন্মদিনে এবার নীলুর কোনো উপহার কেনা হয়নি। কী মজা। কিন্তু নীলু জানে মা মিথ্যে বলছেন। সে দেখেছে বাবা সোনালি কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট এনে শেলফের উপর রেখেছেন। লাল ফিতে দিয়ে প্যাকেটটা খাঁধা। নীলু ছুঁয়ে দেখতে গেছে। বাবা চেঁচিয়ে বলেছেন এখন নয়, এখন নয়। রাত্রিবেলা দেখবে।এর মধ্যে কী আছে বাবা। বলবে না, কার জন্যে এনেছ,আমার জন্যোতাও বলব না।এই বলেই বাবা হাসতে শুরু করেছেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে মাও। নীলু বুঝতে পেরেছে এখানেই লুকোনো তার জন্মদিনের উপহার। মা যদি ভালো থাকতেন তাহলে এতক্ষণে কী মজাটাই না হতো। ছাদে চেয়ার পেতে সবাই গোল হয়ে বসত। সবাই মিলে চা খেত, নীলু এমনিতে চা খায় না। কিন্তু জন্মদিন এলে মা তাকেও চা দিতেন। তারপর মা একটি গান করতেন। (মা যা সুন্দর গান
পৃষ্ঠা ১১ থেকে ১৫
পৃষ্ঠা-১১
করেন।), নীলু একটা ছড়া বলত। সবশেষে বাবা বলতেন, ‘আমাদের আদরের মা, মৌটুসকী মা, টুনটুনি মার জন্মদিনে এই উপহার।’ এই বলে চুমু খেতেন নীলুর কপালে। আর নীলু হয়তো তখন আনন্দে কেঁদেই ফেলত। সোনালি কাগজে মোড়া প্যাকেটটি খুলত ধীরে ধীরে। সেই প্যাকেটে দেখত ভারি চমৎকার কোনো জিনিস!কিন্তু মার হঠাৎ এমন অসুখ করল। নীলুর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ছোট কাকু বললেন, এসো মা, আমরা ছাদে বসে গল্প করি।উই। লাল কমল নীল কমলের গল্প শুনবে না? উই।নীলু ফ্রকের হাতায় চোখ মুছতে লাগল।একটু পরে এলেন বড় ফুফু। নীলু যে একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছে তা দেখেও দেখলেন না। তরতর করে উঠে গেলেন দোতলায়। তখনই নীলু শুনল তার মা কাঁদছেন। খুব কাঁদছেন। মাকে এর আগে নীলু কখনো কাঁদতে শোনেনি। একবার মার হাত কেটে গেল বঁটিতে। কী রক্তা’কিন্তু মা একটুও কাঁদেননি। নীলুকে বলেছেন, আমার হাত কেটেছে তুমি কেন কাঁদছ? বোকা মেয়ে।আজ হঠাৎ করে তার কান্না শুনে ভীষণ ভয় করতে লাগল তার। ছোট কাকু বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন, নীলু তার কাছে যেতেই নীলুকে তিনি কোলে তুলে নিলেন। নীলু ফোঁপাতে ফোঁপাতে ‘বলল, মার কী হয়েছে ছোট কাকু?কিচ্ছু হয়নি।তবে মা কাঁদছে কেন?অসুখ করেছে। সেরে যাবে।অসুখ করলে সবাই কাঁদে, তাই না?হ্যাঁ।
পৃষ্ঠা-১২
হাসাতে পারেন। একসময় নীলু বলল, এবার একটা ভূতের গল্প বলো না, ভূতের গল্প শুনে তুমি ভয়ে কেঁদে ফেলবে। ইস্, আমি বুঝি ছোট মেয়ে? বলো কাকু। মামদো ভূতের গল্প বলব নাকি তবে? মামদো ভূত কি মানুষ খায় কাকু। খায় নাঃআবার। সুবিধামতো পেলেই কোঁৎ করে গিলে ফেলে। ধড়াস করে উঠল নীলুর বুকটা। ছোট কাকু বললেন, তবে যে বলেছিলে ত্যা পাবে না? এখন দেখি নীল হয়ে গেছ ভয়ে। কী সাহসী মেয়ে আমাদের নীলু!একটুও ভয় পাইনি আমি, সত্যি বলছি।নীলুর অবশ্য খুব ভয় লাগছিল। তবু সে এমন ভান করল, যেন একটুও ভয় পায়নি।ছোট কাকু, দেখবে, আমি এক্য একা বারান্দায় যাব?ছোট কাকু কিছু বলার আগেই ঝন্ ঝন্ করে টেলিফোন বেজে উঠল। হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করেছে। ছোট কাকু নীলুকে কিছুই বললেন না। তবুন নীলু বুঝল মায়ের অসুম ভয়ে ভয়ে বলল, গল্পটা বলবে না কাকুঃ কোন গল্প? হার বেড়েছে সেঐ যে, মামদো ভূতের গড়া ছোট কাকু হাত নেড়ে বললেন, আরে পাগলি, ভূত বলে আবার কিছু আছে নাকি। সব বাজে কথা। বাজে রূণাঃহ্যাঁ, খুব বকালে কথা। ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই। সব মানুষের বালানো গই।তুমি ভূত ভয় করো না কাকু? আরে দূর। ভূত থাকলে তো ভয় করব।
পৃষ্ঠা-১৩
এই বলেই ছোট কাকু আবার গম্ভীর হয়ে পড়লেন।নীলুকে সবাই বলে ‘ছোট মেয়ে ছোট মেয়ে’। কিন্তু সে সব বুঝতে পারে। ছোট কাকুর হঠাৎ গম্ভীর হওয়া দেখেই সে বুঝতে পারছে মায়ের খুব বেশি অসুখ। নীলুর খুব খারাপ লাগতে লাগল। এত খারাপ যে, চোখে পানি এসে গেল। ছোট কাকু অবিশ্যি দেখতে পেলেন না কারণ তার কাছে আবার টেলিফোন এসেছে। নীলু শুনতে পেল ছোট কাকু বললেন-হ্যালো। হ্যাঁ হ্যাঁ।এ তো দারুণ ভয়ের ব্যাপার।হ্যাঁ, নীলু ভাত খেয়েছে। দিচ্ছি, এক্ষুনি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। আচ্ছা, আচ্ছা।টেলিফোন নামিয়ে রেখেই ছোট কাকু বললেন, ঘুমুতে যাও নীলু।নীলু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, মার কী হয়েছে কাকু? কিছু হয়নি রে বোট।মা কখন আসবে?কাল ভোরে এসে যাবে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুম ভাঙতেই দেখবে মা এসে গেছেন।নীলুর ঘরটি মার ঘরের মধ্যেই। শুধু পারটেক্সের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা। নীলু এখন বড় হয়েছে, তাই একা শ্যেয়। তার একটুও ভ্যায় করে না। তা ছাড়া সারা রাত মা কতবার এসে খোঁজ নিয়ে যান। নীলুর গায়ের কম্বল টেনে দেন। কপালে চুমু খান। কিন্তু আজ নীলু একা। ছোট কাকু বললেন, ভয় লাগবে না তো মা? মাথার কাছের জানালা বন্ধ করে দেব? দাও।
পৃষ্ঠা-১৪
আমি টেলিফোনের কাছে বসি, কেমন? তোমার মার কোনো খবর আসে যদি, সে জন্যে। আচ্ছা?আচ্ছা।তুমি পুতুল নিয়ে ঘুমুচ্ছ বুঝি নীলু?হ্যাঁ কাকু।ভয় পেলে আমাকে ডাকবে, কেমন? ডাকব।ছোট কাকু ঘরের পর্দা ফেলে চলে গেলেন। নীলুর কিন্তু ঘুম। এলো না। সে জেগে জেগে ঘড়ির শব্দ শুনতে লাগল। টিক টিক টিক টিক। কিছুক্ষণ পর শুনল ছোট কাকু রেডিও চালু করে কী যেন শুনছেন। বক্তৃতাটভূতা হবে। তারপর আবার রেডিও বন্ধ হয়ে গেল। বারান্দার বাতি জ্বলল একবার। আবার নিভে গেল। রাত বাড়তে লাগল। নীলুর একফোঁটাও ঘুম এলো না। একসময় খুব পানির পিপাসা হলো তার। বিছানায় উঠে বসে ডাকল, ছোট কাকু, ছোট কাকু?কেউ সাড়া দিল না। ছোট কাকুও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। নীলুর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আর ঠিক সেই সময় নীলুর মাথার জানালায় ঠক ঠক করে কে যেন শব্দ করল। আবার শব্দ হলো। সে সঙ্গে কে যেন ডাকল।নীলু নী নীলুর ভীষণ ভয় লাগলেও সে বলল, কে?আমি। জানালা খোলো।নীলু দারুণ অবাক হয়ে গেল। জানালার ওপাশে কে থাকবেঃ দেখানে তো দাঁড়াবার জায়গা নেই। নীলু বলল,কে আপনি?আমি ভূত। জানালা খোলো মেয়ে।
পৃষ্ঠা-১৫
নীলুর একটু একটু ভয় করছিল। তবু সে জানালাটা খুলে ফেলল। বাইরে ফুটফুটে জ্যোষা। গাছের পাতা চিকমিক করছে। নীলু অবাক হয়ে দেখল ফুটফুটে জ্যোস্নায় লম্বা মিশমিশে কালো কী একটা জিনিস যেন বাতাসে ভাসছে। ওমা, ভূতের মতোই তো লাগছে। ভূতটি বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি মা?নীলু কোনোমতে বলল, না, পাচ্ছি না তো।বেশ বেশ। বড় মানুষেরা ভূত দেখলে যা ভয় পায়? এতক্ষণে হয়তো ফিট হয়ে উল্টে পড়ত। তুমি তো বাচ্চামেয়ে। তাই ভয় পাওনি। নীলু গম্ভীর হয়ে বলল, কে বলল আমি বাচ্চামেয়ে? আমি অনেক বড় হয়েছি।ভূতটি খলবল করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না। একসময় হাসি থামিয়ে বলল, অনেক বড় হয়েছ তুমি, হা হা।নীলু বলল, ভেতরে আসো তুমি। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? নীলুর এই কথায় ভূতটি রেগে গিয়ে বলল, তুমি করে বলছ কেন আমাকে? বড়দের আপনি করে বলতে হয় না?নীলু লজ্জা পেয়ে বলল, ভেতরে আসুন আপনি।ভূতটি সুট করে ঢুকে পড়ল ঘরে। ওমা কী লম্বা, আর কী মিশমিশে কালো রঙ! এত বড় বড় চোখ। দাঁত বের করে খুব খানিকক্ষণ হেসে সে বলল, আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ না তো মা নীলুর তখন একটুও ভয় লাগছে না। ভূতটি অবিশ্যি দেখতে খুব বাজে। গল্পের বইয়ে যেসব ভূত-প্রেতের ছবি থাকে, তার চেয়েও বাজে। তবু ভূতটা এমন আদর করে কথা বলতে লাগল যে নীলুর ভয়ের বদলে খুব মজা লাগল। নীলু বলল, আমি ভয় পাইনি, সত্যি বলছি, একটুও না। আপনি ওই চেয়ারটায় বসুন।ভূতটা আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। পকেট থেকে কলাপাতার রুমাল বের করে ঘাড় মুছতে মুছতে বলল, খুব
পৃষ্ঠা ১৬ থেকে ২০
পৃষ্ঠা-১৬
পরিশ্রম হয়েছে। বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম কিনা, তাই।তোমার ঘরে কোনো ফ্যান নেই মা? যা গরম।জ্বি না, আমার ঘরে নেই। মার ঘরে আছে।ভূতটা রুমাল দুলিয়ে হাওয়া খেতে লাগল। একটু ঠান্ডা হয়ে বলল, তোমার কাছে একটা জরুরি কাজে এসেছি গো মেয়ে।কী কাজ?আর বোলো না মা। আমার একটি বাচ্চামেয়ে আছে, ঠিক তোমার বয়সী। কিন্তু তোমার মতো লক্ষ্মী মেয়ে নয় সে। ভীষণ দুষ্ট। দুদিন ধরে সে শুধু কান্নাকাটি করছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। নীলু অবাক হয়ে বলল, ওমা, কী জন্যে?সে চায় মানুষের মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে। এমন কথা শুনেছ কখনো? মেয়েটার মাথাই খারাপ হয়ে গেছে বোধ হয়। ভূতটা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে লাগল। নীলু বলল,আহা, তাকে নিয়ে এলেন না কেন? আমার সঙ্গে ভাব করতে পারত।ভূতটা বিরক্ত হয়ে বলল, এনেছি তাকে। তার আবার ভীষণ লজ্জা। ভেতরে আসবে না। কোথায় আছে সে?জানালার ওপাশে বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই তখন থেকে।ভূতটা গলা উঁচিয়ে ডাকল, হইয়ু, হ-ই-য়ু।জানালার ওপাশ থেকে কে একজন চিকন সুরে বলল, কী বাবা?ভেতরে আয় মা।না, আমার লজ্জা লাগছে।নীলু বলল, লজ্জা কী, এসো। আমার সঙ্গে ভাব করবে।জানালার ওপাশ থেকে ভূতের মেয়ে বলল,
পৃষ্ঠা-১৭
তুমি এসে নিয়ে যাও।নীলু জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে ভূতের ছোট্ট মেয়েটি একা একা বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার এমন লজ্জা যে নীলুকে দেখেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। নীলু হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে এসে মিষ্টি করে বলল, তোমার নাম কী ভাই ভূতের মেয়ে?হইয়ু আমার নাম। তোমার নাম নীলু, তাই না? উই, আমার নাম নীলাঞ্জনা। বাবা আদর করে ডাকেন নীলু। হইয়ুর বাবা বললেন, কী রে পাগলি, ভাব হলো নীলুর সঙ্গে?হ্যাঁ।মানুষের মেয়েকে কেমন লাগল রে বেটি? খুব ভালো। বাবা একটা কথা শোনো? বল।নীলুকে আমাদের বাসায় নিয়ে চলো বাবা। বলিস কী। কী আজগুবি কথাবার্তা। না বাবা, নিয়ে চলো। আমাদের সঙ্গে তেঁতুলগাছে থাকবে। কী রকম পাগলের মতো কথা বলে।হইয়ু ফিচফিচ করে কাঁদতে শুরু করল। হইয়ুর বাবা রেগে গিয়ে বলল,আরে পাগলি মেয়ে, মানুষের মেয়ে বুঝি আমাদের মতো তেঁতুলগাছে থাকতে পারে? বৃষ্টি হলেই তো ভিজে সর্দি লেগে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।হোক নিউমোনিয়া, ওকে নিতে হবে।হইয়ুর কাঁদা আরও বেড়ে গেল। নীলু খুব মিষ্টি করে বলল, আমি চলে গেলে আমার মা যে কাঁদবে ভাই।
পৃষ্ঠা-১৮
এই কথায় মনে হলো হইয়ুর মন ভিজেছে। সে পিটপিট করে তাকাল নীলুর দিকে। হইয়ুর বাবা বলল, আহ্লাদি করিস না হইয়ু। নীলুর সঙ্গে খেলা কর।নীলু বলল, কী খেলবে ভাই ভূতের মেয়ে? পুতুল খেলবে?নীলু তার জন্মদিনের পুতুল বের করে আনল। হইয়ুকে বলল, এর নাম সোনামণি, তুমি সোনামণিকে কোলে নেবে হইয়ু?হইয়ু হাত বাড়িয়ে পুতুল নিল। হইয়ু নেজে কখনও এত সুন্দর পুতুল দেখেনি। সে হা করে পুতুলের দিকে তাকিয়ে রইল। হইয়ুর বাবাও মাথা নেড়ে বারবার বলল, বড় সুন্দর। বড় সুন্দর। দেখিস হইয়ু, ভাঙিস না আবার।এই কথায় হইয়ু জিভ বের করে তার বাবাকে ভেংচি কাটল। হইয়ুর বাবা বলল, দেখলে নীলু, কেমন বেয়াদব হয়েছে? এই হইয়ু, থাপ্পড় খাবি। পাজি মেয়ে।হইয়ু তার বাবার দিকে ফিরেও তাকাল না। পুতুল নিয়ে তার কী আনন্দ! অন্যদিকে মন দেয়ার ফুরসত নেই। হইয়ুর বাবা বলল, নীলু মা, তোমরা গল্পগুজব করো। আমি পাশের ঘরে একটু বসি।দারুণ ঘুম পাচ্ছে।নীলু চমকে উঠে বলল, ওমা, ওই ঘরে ছোট কাকু বসে আছে যে। আপনাকে দেখে ছোট কাকু ভয় পাবে।ভয় পাবে নাকি?নীলু মাথা নেড়ে বলল, হুঁ, পাবে। ছোট কাকু অবশ্য বলে, ভূত-টুত কিছু নেই। মানুষের বানানো সব। তবু আমি জানি আপনাকে দেখে সে ভয় পাবে।ভূত এ কথা শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল।শেষে বলল, তোমার ছোট কাকু ভূত বিশ্বাস করে না?জিনা।একটুও না?
পৃষ্ঠা-১৯
উই।আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা।নীলু ভয়ে পেয়ে বসল, না না, ছোট কাকু খুব ভালো। সত্যি বলছি।ভূতটা হাসিমুখে বলল, বেশি ভয় দেখাব না নীলু। অল্প, খুব অল্প। দেখবে কেমন মজা হয়।নীলু কী আর করে। খানিকক্ষণ ভেবেটেবে রাজি হয়ে গেল। ভূতটা হইয়ুকে বলল, হইয়ু মা, নীলুর খাটের নীচে বসে থাক। নীলুর কাকা যদি ভয় পেয়ে এ ঘরে আসেন তবে তোকে দেখে আরও ভয় পাবেন।এই বলে ভূত পর্দা সরিয়ে চলে গেল পাশের ঘরে। আর হইয়ু বলল, নীলু, তোমার পুতুলটা নিয়ে যাই সঙ্গে?আচ্ছা যাও।নীলুর কথা শেষ হবার আগেই ও-ঘর থেকে একটা চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ হলো। তারপর শোনা গেল ছোট কাকু চেঁচিয়ে বললেন,এটা কী আরে এটা কী।ধড়মড় করে শব্দ হলো একটা। আর ছোট কাকু হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এলেন নীলুর ঘরে। চেঁচিয়ে ডাকলেন, নীলু, ও নীলু।কী হয়েছে কাকা?না, কিছু না। কিছু না।ছোট কাকু রুমাল দিয়ে ঘন ঘন ঘাড় মুছতে লাগলেন। তারপর পানির জগটা দিয়ে ঢকঢক করে এক জগ পানি খেয়ে ফেললেন। নীলু খুব কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, ভয় পেয়েছ কাকু?
পৃষ্ঠা-২০
ছোট কাকু থতমত খেয়ে বললেন, ভয়ং হ্যাঁ তা…। না না, ভয় পাব কেন?নীলু খিলখিল করে হেসে ফেলল। ছোট কাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, হাসছ কেন নীলু।নীলু হাসি থামিয়ে বলল, কাকু তুমি কখনো ভূত দেখেছ? কাকু দারুণ চমকে বললেন, ভূতের কথা এখন থাক নীলু।এই বলেই তিনি ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন।আর তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। কাকু বললেন, হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এসেছে রে নীলু। আমি যাই। নীলু শুনল কাকু বলছেন, হ্যালো, কী বললেন। অবস্থা ভালো না? তারপর? ও আচ্ছা। এ-গ্রুপের রক্ত পাচ্ছেন না? হ্যালোহ্যালো! এতক্ষণ নীলুর মার কথা মনেই পড়েনি নীলুর। এখন মনে পড়ে গেল। আর এমন কান্না পেল তার। হইয়ুর বাবা ঘরে ঢুকে দেখে নীলু বালিশে মুখ গুঁজে খুব কাঁদছে। হইয়ুর বাবা খুব নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?নীলু কথা বলল না আরো বেশি কাঁদতে লাগল। কী হয়েছে লক্ষ্মী মা? হইয়ু তোমাকে খামছি দিয়েছে? নীলু ফোঁফাতে ফোযণতে বলল, নূনা।পেটব্যথা করছে।তবে কী হয়েছে মা? বলো লক্ষ্মী মা। C নীলু ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল, মার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।কোথায় তোমার মা। হাসপাতালে।
পৃষ্ঠা ২১ থেকে ২৫
পৃষ্ঠা-২১
নীলু তার মার অসুখের কথা বলল। ভূতটি নীলুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বারবার বলতে লাগল, আহা, বড় মুশকিল তো। কী করা যায়।সে রুমাল দিয়ে নীলুর চোখ মুছিয়ে দিল।ব্যাপার দেখে হইয়ু খুব ভয় পেয়ে গেল। সে আর খাটের নীচ • থেকে বেরুলই না। একবার মাথা বের করে নীলুকে কাঁদতে দেখে সুড়ৎ করে মাথা নামিয়ে ফেলল নীচে। পুতুল নিয়ে খেলতে লাগল আপন মনে।হইয়ুর বাবা কিছুতেই নীলুর কান্না থামাতে না পেরে বলল, এক কাজ করা যাক, আমি দেখে আসি তোমার মাকে, কেমন?আপনাকে দেখে যদি মা ভয় পায়?ভয় পাবে না। আমি বাতাস হয়ে থাকব কিনা। দেখতে পাবে না আমাকে। বলতে বলতেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নীলু চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, হইয়ু, আমার একা একা একটুও ভালো লাগছে না। তুমি আসো।হইয়ু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নীচ থেকে বেরুল। নীলু অবাক হয়ে দেখে তার সুন্দর পুতুলটা হইয়ুর হাতে। কিন্তু পুতুলটার মাথা নেই। শুধু শরীর আছে। নীলু ভীষণ অবাক হয়ে বলল, হইয়ু ভাই, আমার পুতুলের মাথাটা কোথায়?হইয়ু কোনো কথা বলে না। এদিক-ওদিক চায়। নীলু বলল, উলো হইমু। ভেঙে ফেলেছ?না।তবে কী হয়েছে?হইয়ু লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলল। কোনোমতে ফিসফিস করে বলল, খুব খিদে লেগেছিল, তাই খেয়ে ফেলেছি। তুমি রাগ করেছ নীলু?
পৃষ্ঠা-২২
নীলুর অবিশ্যি খুব রাগ লাগছিল। কিন্তু হইয়ুর মতো ভালো ভূতের মেয়ের উপর কতক্ষণ রাগ থাকে। তার উপর নীলু দেখল, হইয়ুর চোখ ছলছল করছে। তাই বলল, বেশি রাগ করিনি, একটু করেছি।ওমা, এই কথাতেই হইয়ুর সে কী কান্না। নীলু তার হাত ধরে তাকে এনে বসাল পাশে। তারপর বলল, কী কাণ্ড হইয়ু। বোকা মেয়ের মতো কাঁদে।এ কথাতেই হেসে উঠল হইয়ু।খুব ভাব হয়ে গেল তাদের, সেকী হাসাহাসি দুজনের। আর হইয়ুর ডিগবাজি খাওয়ার ঘটা যদি তোমরা দেখতে। নীলুকে খুশি করার জন্যে সে বাতাসের মধ্যে হেঁটে বেড়ালো খানিকক্ষণ। তারপর দুজন দুটি কোলবালিশ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলল। কিন্তু নীলুর হলো মুশকিল। সে কোলবালিশ দিয়ে হইয়ুকে মারতে যায় আর সে বাতাস হয়ে মিলিয়ে যায়। নীলু রাগ করে বলল, উর্দু, বাতাস হওয়া চলবে না।নীলু তাকে দেখাল তার ছবির বই। ফুফু তাকে যে রঙপেন্সিল দিয়েছেন তা দিয়ে সে হইয়ুর চমৎকার একটি ছবি আঁকল। লাল কমল আর নীল কমলের গল্প বলল। তারপর বলল- ভাব ভাব ভাব ভাব ভাব ভাব নীল রঙের সিন্ধু আমি তুমি বন্ধু অর্থাৎ দুজন সারা জীবনের বন্ধু হয়ে গেল।হইয়ুর বাবা যখন এলো তখন দুজনে হাত-ধরাধরি করে বসে আছে। হইয়ুর বাবা খুব খুশি হয়ে বলল, নীলু, আমার লক্ষ্মী মা কোথায়?
পৃষ্ঠা-২৩
এই তো, এখানে।খুব ভালো খবর এনেছি তোমার জন্যে। তোমার মা ভালো হয়ে গেছেন। এখন ঘুমুচ্ছেন দেখে এসেছি।নীলুর মনে হলো আনন্দে সে কেঁদে ফেলবে। হইয়ুর বাবা আপন মনে খানিকক্ষণ হেসে বলল, তোমার একটা ফুটফুটে ভাই হয়েছে নীলু। সেও শুয়ে আছে তোমার মার পাশে।নীলুর কী যে ফুর্তি লাগল। এখন সে একা থাকবে না। এখন তার একটা ভাই হয়েছে। ভাইকে নিয়ে নীলু শুধু খেলবে।দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো। গাছে কাক ডাকতে শুরু করেছে।হইয়ুর বাবা বলল, ও হইয়ু, লক্ষ্মী মনা, ভোর হয়ে আসছে। চল আমরা যাই।কিন্তু হইয়ু কিছুতেই যাবে না। সে ঘাড় বাঁকিয়ে বলতে লাগল, আমি যাব না। আমি মানুষের সঙ্গে থাকব। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।।হইয়ুর বাবা দিল এক ধমক।হইয়ু কাঁদতে কাঁদতে বলল, তেঁতুলগাছে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব, আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।কিন্তু সকাল হয়ে আসছে। হইয়ুর বাবাকে চলে যেতেই হবে। সে হইয়ুকে কোলে করে নিয়ে গেল আর হইয়ুর সেকী হাত পা ছোড়াছুড়ি, সেকী কান্না।আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।নীলুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। কান্না পেতে লাগল।তারপর কী হয়েছে শোনো। নীলুর মা কয়েক দিন পর একটি ছোটমতো খোকা কোলে করে বাসায় এসেছেন। মা হাসি মুখে বললেন, ভাইকে পছন্দ হয়েছে নীলু?
পৃষ্ঠা-২৪
হয়েছে।বেশ, এবার ছোট ভাইকে দেখাও, জন্মদিনে কী উপহার পেয়েছ। যাও নিয়ে এসো।নীলু কী আর করে, নিয়ে এলো তার ‘মাথা নেই পুতুল’। মা ভাঙা পুতুল দেখে খুব রাগ করলেন। নীলুকে খুব কড়া গলায় বললেন, নতুন পুতুলটির এই অবস্থা। দুদিনেই ভেঙে ফেলেছ? ছি ছি বলো নীলু, কী করে ভেঙেছ বলো?নীলু কিছুতেই বলল না, চুপ করে রইল। কারণ সে জানে হইয়ু আর হইয়ুর বাবার কথা বললে মা একটুও বিশ্বাস করবেন না। শুধু বলবেন, এইটুকু মেয়ে কেমন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছে।বড়রা তো কখনো ছোটদের কোনো কথা বিশ্বাস করেন না।
আকাশপরী
নীলুদের বাসায় মাঝে মাঝে একজন হেডমাস্টার সাহেব বেড়াতে আসেন। তিনি নীলুর বাবার বন্ধু আজীজ সাহেব। হেডমাস্টাররা সাধারণত যে রকম হন, উনি কিন্তু মোটেই সে রকম নন। খুব হাসিখুশি স্বভাব। আর এমন মজার মজার ধাঁধা জিজ্ঞেস করেন নীলুকে, যে নীলু হেসেই বাঁচে না। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, বলো দেখি মা, তিন আর এক যোগ করলে কখন পাঁচ হয়?নীলু ভেবেই পায় না। তিন আর এক যোগ করলে সব সময় চার হয়। পাঁচ আবার হবে কী করে?কি পারলে না? ভেবে দেখো, কখন তিন আর এক যোগ করলে পাঁচ হয়।নীলু বলতে পারে না, শুধু মাথা চুলকায়। শেষে আজীজ চাচা হেসে বললেন, যখন অঙ্কে ভুল হয় তখনই তিন আর একে পাঁচ হয়। এই সহজ জিনিসও পারলে না বোকা মেয়ে। ছি ছি। আরেক দিন বললেন, বলো দেখি মা কে ‘ফর ফর করে ওড়ে কুট কুট করে কামড়ায়?
পৃষ্ঠা-২৫
নীলু বলতে পারে না। আজীজ চাচা হা হা করে হেসে বলেন, পিপীলিকা। পিপীলিকা!!নীলু অবাক হয়ে বলে,পিঁপড়ের বুঝি পাখা থাকে?খুব থাকে। পড়োনি কবিতায়, ‘পিপীলিকার পাখা হয় মরিবার তরে। তখন তারা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেন?আজীজ চাচা গম্ভীর হয়ে বলেন, আগুন তখন তাদের ডেকে বলে, ‘আমি কী সুন্দর। আসো তোমরা আমার কাছে। ভয় কী ভাই।’আজীজ চাচাকে নীলুদের বাসার সবাই খুব ভালোবাসেন। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন নীলুর বাবা। আজীজ সাহেব এসেছেন শুনলেই তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন-হেতু এসেছে, হেডু এসেছে, ও নীলু, তোর আজীজ চাচা এসেছে। বাসায় একটি হুলস্থুল পড়ে যায়। মা একটা কেটলি চাপিয়ে দেন চুলায়। আজীজ চাচার আবার মিনিটে মিনিটে চা চাই কিনা।চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আজীজ চাচা পা তুলে আরাম করে বসেন সোফায়। দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে শুরু করেন গল্প। নীলু তো ছোট, কাজেই তাকে ভূতের গল্প শুনতে দেয়া হয় না।নীলু শুনতে চাইলেই মা বলেন,উহু উহু, তুমি যাও নীলু। অল্প বয়সে এসব গল্প শুনলে ছেলেমেয়ে ভীতু হয়।আজীজ চাচা তখন তর্ক করেন, ভীতু হবে কেন ভাবি? আমি যে ছেলেবেলায় এত ভূতের গল্প শুনেছি, আমি কি ভীতু?মা তবু রাজি হন না। ঘাড় বাঁকিয়ে বলেন, না না, নীলুর এসব গল্প শুনে কাজ নেই।
পৃষ্ঠা ২৬ থেকে ৩০
পৃষ্ঠা-২৬
নীলু মুখ কালো করে বলল, আমার শুনতে ইচ্ছে করছে মা। না, ভয়ের গল্প ছোটদের শুনতে নেই। তুমি ঘুমুতে যাও।সেই গল্প শুনতে না পেয়ে নীলুর যে কী মন খারাপ হলো বলবার নয়। প্রায় কান্না পেয়ে গেল। সে অবশ্যি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে, যদি কিছু শোনা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে মায়ের গলার আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা গেল না। মা বলছেন, বলেন কী, সত্যি নাকি?ওমা গো।কী সর্বনাশ। আপনি কী করলেন?সেদিন থেকে নীলু কতবার যে ভেবেছে, যেন আজীজ চাচা বেড়াতে এসেছেন। ঘরে আর কেউ নেই, শুধু সে একা। আর আজীজ চাচা এসেই শুরু করেছেন গল্প। কী দারুণ ভূতের গল্প।ওমা, নীলুর কী ভাগ্য। সত্যি সত্যি একদিন এ রকম হলো। সেদিন ছিল সোমবার। সন্ধ্যাবেলা নীলুর বাবা আর মা গেলেন বেড়াতে, কোনো বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ফিরতে তাদের রাত হবে। নীলুর ছোট কাকু মাথাব্যথার জন্যে শুয়ে আছেন তাঁর নিজের ঘরে। আর কী আশ্চর্য, নীলুর স্যারও আসেননি তাকে পড়াতে। নীলুর কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। ভেবেই পাচ্ছিল না একা একা কী করবে। তখনই এলেন আজীজ চাচা। দরজার ওপাশ এলে’হাউ মাঁউ খাঁউনীলুর গন্ধ পাঁউ।’নীলু আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তার সেকী চিৎকার, আজীজ চাচা এসেছেন, আজীজ চাচা এসেছেন।না।কী রে নীলু বেটি, বাবা-মা কোথায়? বাবা নেই, মা নেই, কেউ নেই। কিন্তু আপনি যেতে পারবেন
পৃষ্ঠা-২৭
নীলু ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলল।আজীজ চাচা হেসে বললেন, আমাকে বন্দি করে ফেললে যে নীলু মা? এখন বলো বন্দির প্রতি কী আদেশ?নীলু আজীজ চাচার হাত ধরে চেঁচাতে লাগল, গল্প বলুন। গল্প।কিসের গল্প মা?সব রকম গল্প। ভূতের গল্প, পরীর গল্প, ডাকাতের গল্প, শিকারের গল্প।কী সর্বনাশ, এত গল্প।নীলু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, বাবার সঙ্গে যেমন গল্প করেন, সেই সব গল্প।আজীজ চাচা হাসতে লাগলেন। নীলু বলল, তার আগে আপনার জন্যে চা বানিয়ে আনি।ওমা, নীলু বেটি আবার চা বানাতে পারে নাকি?হ্যাঁ, খুব পারি।নীলু দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। তার চা অবিশ্যি বেশি ভালো হলো না। দুধ হয়ে গেল খুব বেশি। মিষ্টি হলো তার চেয়ে বেশি। তবু আজীজ চাচা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, চমৎকার। এত ভালো চা আমি সারা জীবনেও খাইনি।এই বলেই তিনি গম্ভীর হয়ে দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। নীলু জানে এখন গল্প শুরু হবে। কারণ, আজীজ চাচা গল্প বলার আগে সব সময় গঞ্জর হয়ে দাড়িতে হাত বোলান।বাংলাদেশের একজন অতি বড় লেখকের গল্প বলি, শোনো। তাঁর নাম বিভূতিভূষণ।সত্যি গল্প চাচা?হ্যাঁ মা, সত্যি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল খুব ঘুরে বেড়ানোর শখ। একদিন ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন এক পুরনো রাজবাড়িতে। ভাঙা বাড়ি, দরজাজানালা ভেঙে পড়েছে। জনশূন্য
পৃষ্ঠা-২৮
পুরী। বাড়ির সামনের বাগানে আগাছা আর কাঁটা ঝোপের জঙ্গল। অবিশ্যি বাড়ির ডানপাশের পুকুরটি ভারি সুন্দর, টলটল করছে পানি। শ্বেতপাথরের বাঁধানো ঘাট। সব মিলিয়ে অপূর্ব। তিনি সেই বাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসলেন। খুব জ্যোৎস্না হয়েছে-আলো হয়ে গেছে চারদিক। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। ক্রমেক্রমে রাত বাড়তে লাগল। তিনি বসেই রইলেন। একসময় তাঁর তন্দ্রার মতো হলো। আর ঠিক তক্ষুনি তাঁর মনে হলো কে একটি মেয়ে যেন খিলখিল করে হেসে উঠেছে। তিনি চমকে চেয়ে দেখেন রাজবাড়ির বাগানে যে মার্বেল পাথরের পরীমূর্তিটি আছে, সেটি নড়তে শুরু করছে। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন। মূর্তিটি সত্যি সত্যি ডানা ঝাপটে খিলখিল করে হেসে উঠল। তিনি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, কে, কে ওখানে? অমনি ডানা ঝাপটানো বন্ধ করে পরীটি আবার মার্বেলপাথরের মূর্তি হয়ে গেল। তাঁর আর একা থাকার সাহস হলো না।তিনি চলে এলেন গ্রামে। গ্রামের লোক সবকিছু শুনে বলল, এ তো আমরা সবাই জানি বাবু। প্রতি পূর্ণিমা রাতে ঐ পরীটি প্রাণ পায়। নাচে গান করে। তার সঙ্গে নাচবার জন্যে আকাশ থেকেনেমে আসে আকাশপরীরা। আপনি আর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলে ওদের দেখতে পেতেন।গল্প শেষ করে আজীজ চাচা বললেন, ভয় লাগছে নীলু?হ্যাঁ। অল্প অল্প লাগছে।তবে থাঁক আজ।নীলু বলল, আমার খুব আকাশপরী দেখতে ইচ্ছে করছে। কী করলে আকাশপরী দেখা যায় চাচা?আজীজ চাচা হাসিমুখে বললেন, খুব সহজ মা। পূর্ণিমা রাতে গলায় একটা ফুলের মালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় চাঁদের দিকে। আর মনে মনে বলতে হয়-
পৃষ্ঠা-২৯
‘আকাশগরী আকাশপরী কাঁদছে আমার মন। এসো তুমি আমার ঘরে রইল নিমন্ত্রণ।’শুধু এই? আর কিছু না?না, শুধু এই।আকাশপরীরা এসে কী করে চাচা?ফুলের বাগানে হাতধরাধরি করে নাচে আর গান গায়। সেই গান শুনে বাগানের সব গাছে ফুল ফুটাতে থাকে।নীলু অবাক হয়ে বলল, চাচা, ওরা যদি আমার বাগানে আসে তাহলে আমার বাগানেও ফুল ফুটবে।নিশ্চয়ই ফুটবে মা।আর চাচা, আপনি যে গাছটি দিয়েছেন, একশ বছর পর ফুল ফুটে সে গাছেও বেগুনি ফুল ফুটবে?আজীজ চাচা ইতস্তত করে বললেন, ফোটাই তো উচিত।নীলু আনন্দে হাততালি দিয়ে ফেলল।এর পর থেকে বাড়ির মানুষ অস্থির। নীলু সবাইকে জ্বালিয়ে মারছে, করে পূর্ণিমা হবে। কবে পূর্ণিমা হবে? এত দেরি কেন পূর্ণিমার।মা রেগেমেগে অস্থির। নীলুকে বললেন, কী মাথামুণ্ডু বলেছে। তোমার আজীজ চাচা, তাই বিশ্বাস করে বসে আছ। পরী আবার। আছে নাকি পৃথিবীতে?বাবারও একই কথা, ভূত, প্রেত, রাক্ষস, খোক্কস-এইসব মানুষের বানানো জিনিস। বুঝলে নীলু? শুধু বোকারাই এসব বিশ্বাস করে।নীলু বলল, আজীজ চাচা কি বোকা?না, সে বোকা নয়, সে একটা পাগল।
পৃষ্ঠা-৩০
নীলু কিন্তু কারো কথাই বিশ্বাস করল না। পূর্ণিমার রাতে সত্যি সত্যি একটি ফুলের মালা গলায় দিয়ে বসল জানালার পাশে আর আপন মনে বলতে লাগল,’আকাশপরী আকাশপরী কাঁদছে আমার মন এসো তুমি আমার ঘরে রইল নিমন্ত্রণ।নীলুর কাণ্ড দেখে বাসার সবার সেকী হাসাহাসি! মা ঠাট্টা করে বললেন, ডিমের পুডিং আছে ফ্রিজে। পরীরা আসলে খেতে দিস মনে করে।কিন্তু নীলুর ভাগ্যটাই খারাপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই এমন ঘুম পেতে লাগল তার যে বলার নয়। ঘুম ভাঙল ভোরবেলায়। রোদের আলোয় চিকমিক করছে চারদিক। এত মন খারাপ হলো নীলুর যে বলবার নয়। মা এসে বললেন, কিরে নীলু, কী কথাবার্তা হলো পরীদের সঙ্গে?নীলু চুপ করে রইল।নাশতা খাওয়ার সময় বারা বললেন, তারপর নীলু মা, তোমারপরীবন্ধুদের সঙ্গে কী আলাপ করলে, তা তো বললে না?ছোট কাকু বললেন, সম্ভবত নীলুর সঙ্গে তাদের ঝগড়া হয়েছে। দেখছেন না, নীলুর মন ভালো নেই।সবাই হেসে উঠল হা হা করে। নীলুর কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। সে চুপি চুপি চলে এলো তার বাগানে। আর বাগানে পা দিয়েই সে অবাক। কত যে ফুল ফুটেছে বাগানে। তাহলে কি সত্যি আকাশপরীরা এসেছিল? সে দৌড়ে গেল আজীজ চাচা যে গাছটি দিয়েছিলেন সেখানে। কী কাণ্ড। সেই গাছে বেগুনি আর নীল রঙে মেশানো অদ্ভুত একটি ফুল ফুটে রয়েছে। কী অপূর্ব তার গন্ধ। নীলুর নিমন্ত্রণে তাহলে এসেছিল তার আকাশপরী বন্ধুরা। আনন্দে। নীলুর চোখে জল এসে গেল