মোহিনী মায়া
পৃষ্ঠা ১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা-১
রকেটের যুগে যুগও রকেটের বেগে দৌড়চ্ছে বৈ কি।সমাজের চেহারা এবেলা-ওবেলা পাল্টাচ্ছে। কাল যা’ ভয়ঙ্কর অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে, আজ তা’ অনায়াসে ঘটে যাচ্ছে। লোকে সেই অবিশ্বাসের দিকে পরম ঔদাসীন্যে তাকিয়ে দেখছে। তাল ঠুকে ছি ধিক্কার করবার উৎসাহ কারো নেই।যেখানে যা কিছু পুরানো চিন্তা ভাবনা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ছিল, সব যেন পুরনো ঘুনে ধরা কাঠের মত অলক্ষ্যে ঝুরো ঝুরো হয়ে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে সে খেয়ালই হচ্ছে না কারো। আর এ খেয়ালও হচ্ছে না-কেমন করে আর কোন কোন সূত্রে ‘ভয়’ জিনিসটাও চলে যাচ্ছে। পাচ্ছে না। কিন্তু যাচ্ছে। কেউ আর কোনো কিছুতেই ভয়-যে মেয়েদের মায়েরা একদা গলাভোর ঘোমটা দিতো আরএখনো মাথা তুলে কিছু বসতে শেখেনি-‘কর্তার ইচ্ছে’ বহন ক’রেক’রে ঢিকিয়ে ডিকিয়ে এগিয়ে চলেছে যেন ছোট লাইনের রেলগাড়ীর মতো, সেই সব মেয়েরাই মায়েদের হাতের দইয়ের ফোঁটা আর আশীর্বাদের ফুল নিয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর এপিঠ থেকে ওপিঠ।এযুগে মেয়েদের সম্পর্কে ‘কর্তাদের ইচ্ছার আলাদা’ রূপ। যাঁরা স্ত্রীকে এখনো নিজের বন্ধুদের সামনে বার করেন না, তাঁরাই মেয়েদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ সংস্কারমুক্ত হয়ে তাদের জন্তে স্কলারশিপ সংগ্রহের চেষ্টায় আর পাস্পোর্টের তদ্বিরে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল এক করেছেন এবং সেটা ঘটিয়ে তুলতে পারলেই বিনা দ্বিধায় রূপসী, স্বাস্থ্যবতী, তরুণী কন্ঠাকে একাকিনী আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছেন, সমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। আর তা নিয়ে গর্ববোধ করছেন। বর্তমান সমাজের সত্যিকার চেহারা কি, সেটা এযুগে সঠিক বলা শক্ত।
পৃষ্ঠা-২
কিন্তু কলকাতা এক আজব শহর।সেখানে যেমন যুগের এই দ্রুত পরিবর্তনের রূপ সবচেয়ে প্রখর, প্রবল, স্পষ্ট, তেমনি আবার সেইখানেই খানাখন্দে বর্ষার জল জমে থাকার মতো জায়গায় জায়গায় স্থির হয়ে আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর আবহাওয়া।হয়তো বিংশ শতাব্দীর যে ভূমিতে একবিংশ এখুনি উ’কি মারতে চাইছে, ঠিক তার পাশের ভূখণ্ডেই ওই ঊনবিংশ শতাব্দী শিকড় গেড়ে বসে আছে। দক্ষিণে-বাতাস এদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। ‘উত্তরে যে হিমাচল’ সেটা এই আশ্চর্য শহর কলকাতাতেই প্রমাণিত। কলকাতার উত্তরভাগে এযুগেও অনেক বাড়িতে মেয়েরা ‘ভাস্কর’ দেখে মাথায় ঘোমটা দেয়, ফিসফিস করে কথা কয়, আর পুরুষের ভয়ে তটস্থ থাকে।শহরের এপ্রান্তে এখনো পুরুষেরা মেয়েদের উপর হম্বিতম্বি করতে পিছপা হয় না, এবং লঘুজনেরা ‘গুরুজন’দের ভয় করে। ‘গুরুজন’ শব্দটা বাতিল হয়ে যায়নি সেখানে।…এসব বাড়িতে এখনো গিন্নীরা সারাদিন তসর পরে শুচিতা বাঁচিয়ে চলেন, এবং তাদের শুচিতার দাপটে বৌদের প্রাণান্ত হয়। ঝিয়েদের মাজা বাসন বৌ-মেয়েরা আবার মেজে ঘরে তুলবে, এটাকে গিন্নীরা স্যায্য এবং অবশ্য করণীয় বলে মনে করে থাকেন। সেখানে এখনো গোবর এবং গঙ্গাজল সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, রান্নাঘরে মুরগীর প্রবেশাধিকার অকল্পনীয় কল্পনার মধ্যে ধূসরিত।এই সস বাড়ির মেয়েরাও কলেজ যাচ্ছে বটে, কিন্তু তারা স্কুলের মেয়েদের চেয়ে বেশী স্বাধীনতা পাচ্ছে না।এক কথায় কলকাতার উত্তর অঞ্চলের বেশ কিছু অংশে এখনো বনেদী আইন কানুন ও সাবেকী চালচলন পুরোমাত্রায় বলবৎ।এই সব পুরানো যুগে আটকে থাকা খানা-খন্দের কল্যাণে এখনো এখানকার রঙ্গমঞ্চে অঙ্কে-গর্ভান্তে সমৃদ্ধ পঞ্চমাঙ্কে পরিসমাপ্ত নাটক-
পৃষ্ঠা-৩
‘না, বলবে না। কারণ ছারপোকা হচ্ছে মানবজাতির শত্রু, এবং শত্রুকে ছলে বলে কৌশলে, অস্ত্রে অগ্নিতে জলে, যেভাবে হোক মেরে শেষ করাই হচ্ছে মানবিক ধর্ম।”চমৎকার। মানবিক ধর্মটা ভালোই শিখেছেন।’ নয়নবাবু আবার শুয়ে পড়ে বলেন, ‘ম্যানেজারকে বলে ঘরটা বদলের ব্যবস্থা না করি তো-বইয়ে মনোযোগ দেন।না করেন তো কি করবেন সেটা আর বলেন না।বলেন না বোধ করি এই জন্যেই, গত সাত বছর ধরে ওই একই কথা বলে আসছেন বলে। গোড়ায় গোড়ায় বলে ফেলতেন-‘না করি তো আমার নাম নয়ন গাঙ্গুলী নয়।’ বলে ফেলতেন- ‘না করি তো আমি শিশির গাঙ্গুলীর ছেলেই নই।’কিন্তু ঘর বদল করা হয়ে উঠতো না।বিনোদবাবু পরে ওই প্রতিজ্ঞার ভাষা নিয়ে হাসাহাসি করতেন। ডেকে ডেকে বলতেন, ‘ও মশাই কি বলে তা’হলে এবার থেকে ডাকবো আপনাকে? নয়নবাবু তো বলা চলবে না। বলতেন, ও মশাই খামোকা বাপের নাম ধরে প্রতিজ্ঞা করতে বসবেন না, কথার ওজন রাখতে শিখুন।’বিশ্রী ক্যাটকেটে আর বিধানো বিধানো কথা বিনোদবাবুর। আর সেই জন্মেই নয়নবাবুর ঘর বদলানোর উপায় নেই। কারণ মেসের আর কেউই বিনোদবাবুর ‘রুমমেট’ হতে রাজী না।অতএব নয়নবাবু এই সাত বছর ধরে ক্রুদ্ধ ঘোষণা করে চলেছেন আমি যদি ঘর বদলানোর ব্যবস্থা না করি তো’বিনোদবাবু আর নয়নবাবুর এই কলহ সারা মেসে একটি হাস্য- পরিহাসের ব্যাপার। অন্তেরা বলে থাকেন, ‘প্রেম কলহ’। কারণ মাঝে মাঝে আবার দু’জনের দাবার ছক নিয়ে বসতেও দেখা যায়।
পৃষ্ঠা-৪
অবশ্য সে খেলাও পরিণামে কলহেই পর্যবসতি হয়। দু’জনে দু’জনকে ‘জোচ্চর’ বলেন, ‘এ’ড়ে’ বলেন, ‘ফেরেববাজ’ বলেন। জীবনে যদি আর আপনার সঙ্গে ফেলি তো-বলে একটা কটু শপথ করে সেদিনের মতো সভা ভঙ্গ হয়।কিন্তু এই দুই মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বাদে কি মেসে আর সকলের সঙ্গেই সকলের সম্প্রীতি।সকালবেলার দৃশ্যটি দেখলে তো তা মনে হয় না।সকালবেলা শেওলা পড়া একটুকরো উঠোনে ততোধিক শেওলা পড়া একটা চৌবাচ্চাকে ঘিরে যে তুমুল বাকবিতণ্ডা চলে, সেটা আর যাই হোক সম্প্রীতির পরিচয় বহন করে না।ওই উঠোনের টুকবোটুকুরই একপাশে ডাঁই করে এঁটে বাসন জড়ো করা থাকে, কাকেরা তার উচ্ছিষ্টা-শিষ্ট নিয়ে গুড়াজড়ি করে, মাঝে মাঝে চিংড়ি মাছের খোলা, ডিমের খোলা বা কাঁকড়ার খোলা ছিটকে এসে চৌবাচ্চার জলে পড়ে। কিন্তু সেটাকে কেউই মারাত্মক কিছু মনে করে না, মগ ডুবিয়ে জিনিসটাকে ফেলে দিয়ে সেই জ্বলেই স্নান সারে।কলতলা বা স্নানের ঘর মাত্র একটি, কাজেই ভোর থেকে লাইন দিলেও অফিসের আগে সকলের হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।হ্যা, ‘অফিসের বাবু, প্রায় সকলেই। তা নইলে কি জঞ্জেই বা স্ত্রী- পুত্র ফেলে এখানে পড়ে থাকবে।অবশ্য সকলের জীবনই ঠিক এক নয়। কারো কারো অন্ত্য ধরণের কাজও আছে।বসন্তবাবুর মেসে পড়ে থাকবার কথা নয়। রিষড়ায়ে তার বাড়ি আছে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার আছে। অবস্থা খারাপ নয়, অনায়াসেই ডেলি প্যাসেঞ্জারী করতে পারেন, কিন্তু তা’ তিনি করেন না।তিনি বলেন, ‘এ বেশ আছি মশাই, কোনো ঝামেলায় থাকতে হয় না। শনিবার শনিবার বাড়ি যাই, মনে বেশ নবযুবক-নবযুবক
পৃষ্ঠা-৫
ভাব আসে, বাড়ীতে জামাই আদর জোটে, পাড়ার সবাই সমীহ করে, মন্দ কী?নীলরতন বাবুর অন্য ব্যাপার। বিপত্নীক ভদ্রলোক। মধ্য বয়সে স্ত্রী-বিয়োগের পর হঠাৎ মা-ভাইয়ের সংসার থেকে কেটে পড়ে চলে এসেছেন এই পটলডাঙার মেসে।এখানে এসে প্রতিনিয়ত ‘বাড়ির’ খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে এখানকার খাওয়া দাওয়ার তুলনা করে আক্ষেপ করেন, নিজেকেই নিজে, ‘ঘর থাকতে বাবুই ভিজে’ বলে বিঝার দেন, অথচ অন্ধকূপের মতো একটা ঘর আঁকড়ে পড়েও থাকেন।যখনই উনি আক্ষেপ করেন বা আত্মধিকার শুরু করেন, এরা ও’রা তাঁরা বলেন, চোরের ওপর রাগ করে, আর কতদিন মাটিতে ভাত খাবেন মশাই? ঘরের ছেলে ঘরে যান। আপনার যখন এতো খারাপ থাকা খাওয়ার অভ্যেস নেই।’নীলরতন বাবু তখন বলেন, নাঃ একবার যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি, সেখানে আর নয়।”কিন্তু আপনার মা রয়েছেন-‘আমার মা নয়, ভায়েদের মা! নীলরতনবাবু কঠোর গলায় বাসন, যার স্ত্রী নেই, তার কেউ নেই বুঝলেন? তার মাও ‘সৎমা।”এটা আপনি ঠিক বলেছেন না নীলুবাবু। মায়েদের বরং বিপত্নীক দ ব্যাচিলার ছেলের ওপরই টান বেশী হয়।”না হয় না।’ নীলরতনবাবু আরো রুক্ষ গলায় বলেন, ‘ওসব হচ্ছে সেকালের কথা। সেকালে শ্বাশুড়ীরা গিন্নী ছিল। একালে শ্বাশুড়ীরা বৌ-দের ভয়ে জুজু। একটা অসহায় ছেলেকে বেশী টানতে গেলে বৌদের মুখনাড়া খেতে হবে না? পায়ের তলার মাটি হারাতে হবে না।’তা’ আপনার মেয়েও তো আছে বলছেন।’ ‘মেয়ে’। নীলরতনবাবু স-তাচ্ছিল্যে বলেন, ‘মেয়ের কথা বাদ
পৃষ্ঠা-৬
দিন। বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে আবার কী ছাতা দিয়ে মাথা রাখতে আসবে। ‘বাপ’ বলে আলাদা করে একটু মিষ্টি হাতে করে আনবার হিম্মত নেই। এই কাকা-খুড়ির কাছে ‘সুয়ো’ থাকবেন বলে এক মাজারি খাবার এনে ওদের হাতেই ধরে দেন। নাঃ, যৌ-মরা লোকের মেসই হচ্ছে বেস্ট জায়গা।একজন কুটুস কামড় দেন, ‘না’ মানে আপনার থাকা-খাওয়ার কর হয় বলেন, তাই’মলি। কী করবো, রক্তমাংসের মানুষতো? না ব’লে পারি না মা’লেই ব’লে ফেলি। আর বলবো না।ব’লে জোবে জোবে গায়ে তেল মাখতে থাকেন নীলরতনবাবু।এইটি ৩’র একটি বিলাস। গানছা পরে এক ঘণ্টা ধরে তেলটি ওবা চাই।গামছা অবশ্য প্রায় সকলেই পরেন।সকালবেলা উঠোনে যেন গামছার বাজার বসে যায়।সায়। ব্লাউজ পরা সি-টা এসে বাবুদের দিকে পিখন ফিরে বাসন সাজতে বলে।নয়নবাবু চিরকালই মেনবাসী। এই পটল ভারারই ধারে কাছে পরিবার দেশে থাকে।অনেক মেস বদল করেছেন জীবনে, তবে কোনোখানেই পাঁচ- সাত বছরের কম থাকেন নি। পুরো ঘরের ভাড়া দিতে চাইলেও পুরো একটা খব ছেড়ে দিতে কোনো মেস রাজী হয় না, কাজেই কম- ঢেউ সঙ্গ করতেই হয়। রুমমেটের সঙ্গে বনিয়ে চলা সম্ভব নয় পাঁচ-সাত বছর ধরে সেই অমানুষিক কইট। নয়নবাবু সম্ব করেন। দ’রপর একদিন ফাটাফাটি কাণ্ড করে চলে যান।এর আগে বাহুড়বাগানের এক মেসে ছিলেন। ৩’র রুমমেট
পৃষ্ঠা-৭
বেহালা বাজানো শিখতে শুরু করায় তাঁর বেহালা আছড়ে ভেঙে দিয়ে, এবং তার খেসারৎ দিয়ে চলে এসেছেন।নয়নবাবুকে দেখলে এমনিতে অমন রাগী বা দুর্দান্ত বলে মনে হয় না, কিন্তু লোকটা হচ্ছে হঠাৎ-রাগী-রগচটা। একবার যদি মনে করে তাকে কেউ অপমান করেছে, তা’হলেই হয়ে গেল। মাথার রক্ত আগুন হয়ে উঠলো তার।অথচ কলকাতায় বাসা করে বৌ-ছেলে আনবার ক্ষমতা জীবনেও হল না।বিনোদবাবুর ইতিহাস আলাদা।তিনি হচ্ছেন মেস-প্রেমিক এবং একনিষ্ঠ প্রেমিক। পটল- ডাঙার এই মেসটিতেই তাঁর আটাশ বছর কাটলো। পটলডাঙার মেস আছে, অথচ বিনোদবাবু নেই, এটা যেন অবিশ্বাস্য ঘটনা।বিনোদবাবুর সংসারে কে আছে তা কেউ জানে না। ছুটিতেও কখনো বাড়ি যান না, এবং ছুটিও বড় একটা নেন না। কাজ করেন প্রেসে, কাজেই ছুটির বহরও খুব বেশী নয়। বাড়ির কথা কেউ জিগ্যেস করলে দারুণ চটে ওঠেন।কেউ বলে, ওঁ’র বৌ কুলত্যাগ করে চলে গেছে, তদবধি উনি সংসারছাড়া। কেউ বলে লোকটা আদৌ বিয়েই করেনি। কেউ কেষ্ট বলে, ‘হতাশ প্রেমিক’।বিনোদবাবুকে দেখলে অবশ্য ওই শেষের কথাটার সামঞ্জস্য বিধান করা শক্ত, কিন্তু কার যে ভিতরে কী আছে কে বলতে পারে।আরো অনেক রকম ‘বাবু’ই আছেন এ মেসে-কলকাতায় বাসা করে থাকবার সঙ্গতির অভাবে, জায়া-জননীর খোলামেলা গ্রামের বাড়ি ত্যাগ করে কলকাতার পায়রার কোটরে এসে ঢোকবার ইচ্ছের অভাবে, ডেলি প্যাসেঞ্জারী করবার ক্ষমতার অভাবে।
পৃষ্ঠা-৮
তবে সরুদেই প্রায় সংসারে পোড়-খাওয়া জীবনে বীতশ্রদ্ধ মধ্যবয়সী।’যৌবন’ বলতে এক দীতেশ বোস আছে, টিউশ্যনীই যার একমাত্র পেশা। প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে করতে পেরে ওঠেনি নিতান্তই অবস্থার প্রতিকূলতায়। অবক্ষ আশা এখনো পোষণ করে, কারণ চল্লিশ পার হয় নি তার এখনো। অন্তঃ নিজে এই মেলে হতা। একদিন এক আশ্চর্য আবির্ভাব ঘটলো। এ সাতিজাব এখানে শুধু আশ্চর্যই নয়, যেন অস্বস্তিকরও।শিশুর মতো সরস মুখশ্রী, কিশোরীর মতো ভীরু চীজ চাহনি, কনককান্তি এই ছেলেটা এখানে কোথা থেকে এলোসতেরো-অাঠারো বন্ডর বয়ল হওয়া সত্ত্বেও চোখে মুখে কোথাও এর ‘এয়েস লাগার’ ছাল পড়ে নি কেন? চিল কোথায় ও মায়ের কোনে?তা সত্যিই ভাই।মায়ের কোলেও নয়, ঠাকুদার কোলে।।অল্প বয়সে মা-বাপ-মরা নাড়িটাকে বুড়ি বুকে দিয়ে মাগলে নায়ল করেছে, যেয়ে খেলিয়ে বেড়াতে দেয় নি, বাড়ি থেকে তিন আইল খুদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে আর কড়া নজর রেখেছে ছেনে পড়ছে কিনা।ভিন তিন দু’ মাইল হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা করছে ছেলেটা বঙ্গার দিনে কারা ভেঙে। সন্ধোবেলা পায়ে গরম তেল মালিশ কংর দিয়েছে বুড়ি নাতির, ভয় কোনদিন বলে নি’ বাগে কাল আর গিয়ে কাজ নেই।’বরং মাঝে মাঝেই বলেছে, তুই হয়ত্যে ভাবিস্ ঠাকুমা বুড়িন প্রাণে মায়াদয়া নেই। তা’ ভাব, কিন্তু লোকে যেন না বলে, ‘মা বাপ
পৃষ্ঠা-৯
নেই বলে ছেলেটা মানুষ হলো না।’ আর তুইও দাদা ভবিঘ্নাক্ত না ভাবিস, ‘ঠাকুমা আমায় শুধু আদরই দিয়েছে। আমার হিত দেখেনি।’ছেলেটাও তাই শৈশব থেকে কানতে। তাকে মানুষ হতে হবে।বর্ষায় একহাঁটু কাদা ঠেলে, গ্রীষ্মে একবাটু খুলে। উড়িয়ে, আর শীতে কনকনে উকুরে হাওয়ায় বুক কাঁপিয়ে, দিনে দু’মাইল বেঁটেছে আর ভেবেছে, মানুষ হবার পথে এগোচ্ছি।’র্যার হারিকেন লণ্ঠনের গলতে উসকে উসকে চোখের ঘুষ ছাড়িয়ে পড়া মুখস্থ করতে করছে ভেবেছে, ‘মানুষ গুবার সিঁড়ি গাঁখছি।’ঝড় বৃষ্টির রাত্রে যখন পুরনো ঘরের দেয়ালগুলো থরথরিয়ে উঠেছে, জানালা-দরজাগুলো ধাতা খাওয়ার মতো ঠকঠক শব্দ স্কুলেছে, ঠাকুমার কাছে ঘেঁসে শুয়ে মনে মনে ভেবেছে, মানুষ হায় সবার আগে এই বাড়িটা সুন্দর কার সারাবো। ভেবেচে, বাড়িটা ঠাকুমার জয়ে উঁচু দালানে আলাদা করে একট। ঠাকুরঘর বানিয়ে দেব, ঠাকুমা সেই ঘরে সত্যনারায়ণ পুজোর ঘটা করবে, গ্রামত্মদ্ধ সবাইকে শিল্পি বিলোধে আর আইলাদে ঠাকুমার মুখটা বদর কনবে। কারণ ওরী আক্ষেপটাই বারবার ঠাকুমার মুণ থেকে শুনতে পেতো ছেলেটা, ‘নারায়ণের হরির লুট দিবো য়াখানা বাড়ালা পেসাদও এখন আর দিয়ে উ পাবিনা কাউকে, অষত এই বাড়ির এই উঠোনেই তোর ঠাকুন্দার আমাল মানুষের মেলা বসে যেতো। তারা ‘সত্যনারায়ণের কথা’ শুনতো আর ছুতাক্ষ দরে পেসাদ নিয়ে যেতো। কী দিনই গেছে, আর কী দিনই লড়েছে।’মুখ্যচারা ছেলেটা বেশী কথা বলস্কো না, শুধু আস্তে বলতো, আবার তেমনি করে পূজো হবে ঠাকুমা’মনে মনে বলছেঃ দেখো হয় কিনা। মানুষ হয়ে উঠে প্রথম
পৃষ্ঠা-১০
কাজই হবে আমার, তোমার এই আক্ষেপ দূর করা। শুধু পূজো কেন, গ্রামের সকলের বাড়িতে মুখে-ভাত, পৈতে, বিয়েতে ভাল করে কিন্তু দিতে পারে না বলে কতো দ্বাদু করে ঠাকুমা। বলে মনের মতন ক’রে লৌকিকতা করতে না পারলে মানুষের বাড়িতে বাবো কোন মুখে। আগে এ বাড়ি থেকেই গ্রামের সেরা লৌকিকতা যেতো।ছেলেটা বলতো, ‘আবার সব হবে, তুমি দেখো ঠাকুমা।ঠাকুমা মনে মনে হাসতো, হয়তো বা ভাবতো ছেলেটার বাইরেটাও যেমন শিশুর মতো, ভেতরটাও তেমনি। আনেনা তো পৃথিবীতে কত ধানে কত চাল।ভাবতো, কিন্তু মুখে সে কথা বলতো না। মুখে উৎসাহ দিয়ে বলতো, সেই আশায় তো বুক বেঁখে পড়ে আছি দাদা।’ছেলেটা তখন রাত জেগে ভাবতে বসতো, আর কিসে কিসে ঠাকুমার মুখ উদ্দস করা যায়। অনেক চিন্তা অনেক পরিকল্পনা।মোটকথা ঠাকুমার মুখটা উজ্জ্বল করতে হবে।কিন্তু ঠাকুমার মুখ উজ্জ্বল করার সময় আর পেল না বেচারা। জায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিয়েছে, করে মরে গেলে বুড়ী। রেজাল্ট বেবোরনি, ফুট,ছেলেটার মনে হলো, ইহজীবনের সব কাজ তার শেষ হয়ে গেছে, রেজাল্ট অ্যার না বেরোলেও ক্ষতি নেই। কার অক্ষে কী।পাড়ার পাঁচজনে ছেলেটাকে ঘরে তার বুড়ীর শ্রাদ্ধশাস্তি ঢুকিয়ে দিল নমোনমো করে, এবং সংপরামর্শ দিতে লাগলো ‘জমিজমা যা আছে বেচে দিয়ে কলকাতায় গিয়ে লেখা পড়া করগে। বুড়ির বড় সাধ ছিল তুই লেখাপড়া শিখবি, মানুষ হবি।একজন জ্ঞাতি জ্যাঠা এ পরামর্শটা বেশী দিতে লাগলো, কারণ ওই ছেলেটার জমি তাঁরই জমির লাগোয়া।পাড়ার এক পিসি ছ’বেলা রে’ধে রেখে এনে, মুখ গুজে পড়ে
পৃষ্ঠা-১১
খাকা ছেলেটাকে তুলে তুলে খাওয়াচ্ছিল, সে চুপি চুপি বললে।, ‘শুনিসনি ওর কথা। নিজের স্বার্থে তোকে হিত উপদেশ দিতে এসেছে। বাপ-ঠাকুর্দার জমি বেচবি কেন। দরকার কি? ওই জমি চাষ আবাদ কর, ওতেই সোনা ফলবে। নতুন খুড়ী তো স্বামীপুজুর মরেহেঙ্গে যাওয়ার পর ওই জমি থেকেই এ যাবৎকাল খরচ চালিয়েছে, তোর পড়া চালিয়েছে। ও জমি লক্ষ্মী।’ ةতারপর চুপি চুপি এ পরামর্শও দিয়েছে, ‘তু’ চারটে বছর কন্ঠ করে চালিয়ে একটা ভালা দেখে মেয়ে বিয়ে ওই জ্যেঠার নাকের ওপর নতুন দালান কর। কিন্তু পিসির কথা বাড়াল না। করে ঘর গেরস্থী হ।’ মেয়ে আমি দেখবো।’দাঁড়াবার মতো কথাও নয়।ঠাকুমার হাতে হাড়িকুড়ি নেড়ে নিজে বেঁধে খেয়ে, জমিতে সোনা ফলাবার এবং বিয়ে করে সংসায় করবার স্বপ্নটা ছেলেটার হাস্বপ্ন মনে হলো।অতিষ্ঠ হচ্ছিল প্রাণ, এখান থেকে ছুটে কোথাও চলে যাবার কন্তে মন ছটফট করছিল।অতএব জ্যেঠার উপদেশই গ্রাহ্য হলো। জমিজমা হন্মান্তরের ব্যাপারে জ্যেঠা ভাইপোকে এতটুকুও আঁচ পেতে দিলেন না, সব হাঙ্গামা নিজে পোহালেন বাকি শুধু সইটা করা।কোর্টে গিয়ে দুটো সই করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ছেলেটা। কলকাতায় গিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্নটা দেখতে লাগলো আবার। এখন মনে হলো, এভাবে হেলায় ফেলায় দিন কাটালে চলবে না। তাকে দাঁড়াতে হবে, মানুষ হতে হবে।ঠাকুমা স্বর্গ থেকেও তা দেখবে।জমি বেচার টাকার অঙ্কটা দেখে জ্যাঠার বাড়ির লোক বাদে অন্ত সবাই ছি ছি করতে লাগলো। মা-বাপমরা অসহায়
পৃষ্ঠা-১২
ছেলেটাকে এভাবে ঠকিয়ে যে শেষ ভালো হবে অভিশাপও দিলো-যদিও জ্যেঠার অ্যাড়ালে। তখন ওই হাজার আড়াই টাকাই রাজৈশ্বর্য। যেতে পারলে হয়। না লোকটার, এমন ছেলেটার কাছে কিন্তু কলকাতায় একবার’কিন্তু কেমন করে সম্ভব সেই যেতে পারাটা’।একজন কেউ হাত ধরে নিয়ে না গেলে যেতে পারছে, এমন ভাবে তো তৈরী হয়নি সে।বাড়ি থেকে স্কুল, স্কুল থেকে বাড়ি, এই তো তার পৃথিবীর পরিধি।পরীক্ষার ফল বেরোলো।যদিও ছেলেটা উপন্তাসেন নায়কদের মতো একেবারে ফাস্ট হয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিল না, তবে প্রথম বিভাগটা পেল। অতএব কলকাতার কলেজ আর আকাশকুহুম রইল না।শুধু যাওয়ার উপায় আবিষ্কার।টকিট কেটে রেলে চড়ে বসলেইতো কলকাতায় যাওয়া নয়, গিয়ে উঠবে কোথায়? ভরসা কে? কলেজে ভর্তি হবার উপায় বাৎলে দেবে কে?পরিক্ষা দখ বিষয়ের জ্যেঠা অকূলে কান্ডারী হলেন। তিনিই বললেন, ‘কিন্তু ভাবনা নেই তোর নিম্ন, সব ব্যবস্থা করেছি আমি। কলকাতায় একটা ভাল মেসে আমার শুভবুতো শালা থাকে, মাস্টারী করেই খায়, সে অবশ্বই কলেজে ভদির সব তাকবাক জানে, সে জোর ভার নেবে। বে-খা করেনি, আইবুড়ো কান্ডিক, সময় অগাধ। তাকে সবিস্তারে জোর কথা লিখে জানিয়েছি। রাজী হয়েছে নিয়ে যেতে। সেই মেসেই থাকবি তুই। সে তোর লেখাপড়ার ভার নেবে।’নিমাই বিরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। জ্যেঠাকে তার দেবতা মনে হলো। আশ্চর্য। এই লোকের নামে নিন্দে করছে লোকে।
পৃষ্ঠা-১৩
নিমুর লঞ্চে তলে তলে কত ভেবেছেন জ্যেঠা। কত ব্যবস্থ। করেছেন। ঠাকুমা বেঁচে থাকতে ঐ জ্যেঠা যে তাঁর ‘নতুন পুড়িকে জ্বালিয়ে গেয়েছেন, সে কথা মনে পড়ল না নিদাইয়ের। হয়তো ভাল মতো জানতোও না। ঠাকুমা নাতির সঙ্গে উচ্চ আদর্শ, আর তার রক্ত মা-বাপের গুণগণা ছাড়া, আর বিশেষ কোন গল্প করতোও না।অতএব জোঠা দেবতা।কলকাতার স্কুলেও তরে হাতের মুঠোয় চলে এলো।জীবনে কলকাতা দেখেনি নিমাই, শুধু অয় দেখেছে তার। সে স্বপ্ন ঠাকুমাই দেখিয়েছে। ঠাকুমা-নাতিতে কল্পনা কল্পনা করেছে, ‘লাশ’ দিয়ে নিমাই যখন কলকাতা যাবে, কোথায় থাকবে, কেমন করে যাবে, ঠাকুমা তখন কী করবে।ঠাকুমা বলেছে, ‘আমার কক্ষে চিন্তা করিসনে দাদা, আমি এখান থেকে তোকে টাকাকড়ি পাঠাবো, তুই সেখানে মন ঠান্ডা করে পড়বি।’নিমাই বলেছে, তোমার কাছ থেকে অতো দূরে চলে যাবো ঠাকুমা? তার চেয়ে বোলপুরে গিয়ে পড়লে হয় না?ঠাকুমা বলেছে, ‘না’ ধন। সেই যখন বাড়ি ছাড়া হয়ে থাকতে হবে, তখন আর যেখানে-সেখানে কেন। কলকাতাই ভাল। কলকাতার কলেজের হোটেলে থাকবি। তার একটা মাই আলাদা।নিমাই হেসে উঠেছে। ‘হোটেল নয় ঠাকুমা, হোস্টেল।’ওই হলো দাদা, একই কথা। পয়লা নিয়ে থাকতে দেয়, খেতে দেয়, তাকে আমরা হোটেলই বলি।’কিন্তু কী রঃকারা নিমাই বলতো, তোমায় ছেড়ে থাকতে হবে? তোমায় ফেলে চলে যেতে হবে।’ ঠাকুমা ছি ছি করে উঠতো।’বেটাছেলে’ ঠাকুমার জন্তে মন কেমন করবে বলে জীবনের উন্নতি করবে না?
পৃষ্ঠা-১৪
তা’ ঠাকুমা তো সেই ঠাকুমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্ত করে দিয়ে গেলো নিমাইকে। নিজেই ডাকে ফেলে চলে গেলো। সেই শোকে নিমাই ভবিয়াতের সমস্ত স্বপ্নের সমাধি রচনা করে নদীর ধারে খেয়াই মাঠে, ফাঁকা হাটতলায় ঘুরে বেড়িয়ে বেড়িয়ে আর চোখর জল চোখে শুকিয়ে শুকিয়ে বেড়াচ্ছিল। আবার নিমাই পুরোনো চিন্তায় এলো, আবার নিমাই লেখাপড়ার স্বত্ত দেখলো।আর সে ‘দেখা’র চোখটা পেলো এই জোটারই ময়ায়। তার ওপর আবার এই সুযোগ, নিজের আত্মীয়কে দিয়ে সাহায্যের নিমাইয়ের চোখে জল এলো।ঠাকুমা মরা থেকে পরীক্ষার ফল বেরানো পর্যন্ত কেঁদে কেঁদে চোখ তো পাস্তা হয়েই রয়েছে।অতএব এই নতুন আবেগে ভিগুলো আবার।সুখ দুঃখ দুইই তো আবেগের জনক।জ্যেঠা মাখায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আমার পালা’ মানে তোর জ্যেটির ভাই। তাসে তোর মামা-ই হলো। মা মার জ্যেঠিকে ভিন্ন নয়। অতি সজ্জন ছেলে, এলে দেখবি। মামা বলেই ডাকবি তাকে। আর আসা-যাওয়ার খরচা তোকে আর দিতে হবে না। আমিই দেব।’বার্তা শুনে পাড়ার লোক পাবার কান ভাঙাতে এলো নিমাই নামের ছেলেটার।বললো, ‘উকিয়ে সর্বস্ব লিখিয়ে নিয়ে শান্তি হল না, নিজের খরচায় লোক আনিয়ে তাকে ভিটেছাড়া করছে। ভগবান জানেন সে লোক সত্যি তার জ্যেঠার শালা, না কোনো গুণ্ডা শালা।অমন আভাসও দিল কেউ কেউ-‘পয়সা দিয়ে গুণ্ডা আনাচ্ছে জ্যেঠা, নিমুকে ভুলিয়ে রেলে তুলে টাকাকড়ি সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে
পৃষ্ঠা-১৫
মেরে কেটে কোথাও পাচার করে দিতে। ওর ঘরের টাকা ওরই ধরে ফিরে আসবে, মাঝ থেকে তুই ভিটে ছাড়া হয়ে যাবি।’কিন্তু নিমাইয়ের কলকাত। অভিমুখী মন এসব কুট-কচালে কথায় বিচলিত হয় না। নিমাই তার জ্যেঠার পালার আসার আশায় দিন গোনে।সীদেশ বোসের অবশু ছুটির দিনের প্রশ্ন নেই, ছুটি নিলেই ছুটি। ছাত্রদের একবার জানানো ‘কাল আর আসতে পারবো তার বদলে একটা রবিবার পড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতি রেখেছে সীতেশ যোস। কাজেই ছাত্র খুৎ খুৎ করলেও ছাত্রের বাধা গু’কথা শোনানোর সুবিধে পান না।রবিবারের সঙ্গে একটা শনিবার ‘ইচ্ছে ছুটি’ যোগ করে, সীতেশ বোস আগের রাত্রে জানান দিলো যেসে, ‘কাল আমি যাচ্ছি তাহলে ম্যানেজারবাবু। পরশু বিকেলে ভাগ্নেকে নিয়ে ফিরবো।’বললো, খেতে বসে। যাতে অনেকের কানে যায়।ভিজে স্যাৎসেঁতে, সীমেন্টের চটা উঠে উঠে খত-হয়ে-যাওয়া খাবার ঘরের মেঝেয় টানা করে চ্যাটাইয়ের আসন পাতা, তাঁর সামনে সারি সারি পেতলের খালা, এ্যালুমিনিয়মের বাটি।তবে জলের গ্লাসট অনেকেরই নিজস্ব। কেউ একটা পলকাটা মোটা কাঁচের গ্লাস, কেউ কলাইকরা গ্লাস হাতে করে নিয়ে এসে বসেন। কেউ কেউ ‘নির্মল’ জলও ভরে আনেন তাতে।এরই মধ্যে হয়তো কারো দিনের খাওয়ার একছিটে দই, রাতের খাওয়ায় একটি রসমুন্ডি। হয়তো বা একা খাওয়ার লজ্জা ঢাকছে অথবা অক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, ডেকে ডেকে সবাইকে বলবেন তিনি, ‘যাই বলুন তাই বলুন, ‘হেলথ’টা হচ্ছে সকলের আগে। ‘হেল্থ’ রক্ষার জন্তে খরচা কিছু করতেই হবে।’
পৃষ্ঠা-১৬
মেসের যা চার্জ, তা’তে ভোজন পাত্রে ‘বিশেষ, বস্তুর আবির্ভাব ঘটার আশা করা যায় না। তবু সেদিন হঠাৎ মাংসের আয়োজন চয়েছিল।তাই অধীর আগ্রহে সকলে ‘রুটি’ আসার আশায় রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, সেই সময় সীতেশ যোস ওই অশনিপাতটি করে বসলো-‘কাল আমি যাচ্ছি তা’হলে ম্যানেজারবাবু, পরন্ত একেবারে ভায়েকে নিয়ে ফিরবো।”নীতেশ বোসের যে কোনো ভাস্ত্রে আছে, একথা কেউ কোনদিন শোনেনি। তার ওপর আবার সেই ভাইেকে এনে এই মেসে তোলবার ভাল। তাল কেন, ব্যবস্থা একেবারে পাকা।অথচ মেসবাসী ভদ্রলোকেরা কেউ জানেন না সে খতত্ব। কেবলমাত্র সীতেশ বোস আর ম্যানেজার বখীন মিত্তিরে আনাজানি।তার মানে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।তার মানে কায়েদে কায়েতে গলাগলি।সীতেশকে স্রেফ ধাপ্পাবাজ মনে হয় সকলের। যেন সকলকে বাচ্চা দিয়ে ভয়ানক একটা সুযোগসুবিধে করে নিয়েছে সীতেশ বোস। তা সুবিধেও বটে। সীতেশ বোস একলা একটা ঘরে। থাকে। যদিও তিনতলায় হাতের সিঁড়ির গর, তবু একা তো বটে। কাজেই ‘ডবল সিটেড’ রুমের আসবানার থেকে কিক্ষিণ বেশী ভাড়া তাকে দিতে হয়।সেই বেশীটার জন্মে সীতেশ বোস স্কুল হলেও অক্তাক্ষরা ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখে থাকেন তাকে। পুরো একটা নিজস্ব ঘর তো বটে।সে ঘরের ছাদ দিয়ে জল পড়ে। তা পড়ুক না।
পৃষ্ঠা-১৭
দোতালায় কার ঘরেই বা বর্ষায় ছাদ দিয়ে জল না পড়ে? সীতেশের না হয় একটু বেশী পড়ে।সায়া বছর তো আর বর্ষা নয়।জলের দরের ঘরে জল একটু লম্ব করে নিতে হয়।কিন্তু এটা কী?সেই জলের বরের ঘরে আবার পার্টনার জোটাকে লোকটা। তার মানে ওই জলের দরেরও অর্ধেক। অথচ আত্মীয় পার্টনার।ভায়ে বলে কি ছেড়ে কইরে সীতেশ বোস? কানা কড়াটি অবধি শুনে নেবে না?যাক্, তাও না হয় হলো।সীতেশ যে কাউকে না জানিয়ে, শুধু ম্যানেজারের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে এতোবড়ো একটা ঘটনা ঘটাতে সাহস করেছে, এইটাই বড় বেশী দাগাদায়ক।আজকের রাত্মাগরের রাজকীয় ‘মেন্দ্র’ ও যেন নিগ্রস্ত হয়ে যায় এই অপমানে।এটা কাস্ট’ ব্যাচ।আর বিনোদবাবু বরাবরই ফার্স্ট’ ব্যাচের খদ্দের।বিনোদবাবুই শুধু মেসের পেতলের গ্লাসে জল খান। বলেন, জন্ম গেল খতেই, কই কখনো কোন জাম এসে শরীরে ঢুকছে? কলঙ্ক পেতলে থাকে না, থাকে মনে।’নিষ্কলঙ্ক মনের গৌরবে চেয়ে চেয়ে তিন গ্লাশ জল খান বিনোদবাবু সেই কলঙ্কপড়া পেতলের গ্লাসে।সেই বিনোদবাবু ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘ব্যাপারটা কী সীতেশবাবু 1, সীতেশ বোস তাচ্ছিলোর গলায় বলে, ‘ব্যাপারের তো কিছু নেই। ভাঙে পাশ করেছে, কলকাতায় এসে পড়বে, তাই তাকে আনতে।
পৃষ্ঠা-১৮
বিনোদবাবু তাচ্ছিল্য গায়ে মাখেন না, আরো কুঞ্চিত ললাটে বলেন, ‘ভায়ে মানে?”ভায়ে মানে জানেন না? মানে বোনের ছেলে।”সে মানে আপনার কাছে জানতে চাইনি সীতেশবাবু। মাস্টারী করে খান বলে ধরাকে সরা দেখবেন না। বলছি ভাগ্নে এলো কোথা থেকে? শুনিনি তো কখনো।”আমার কে কোথায় আছে, সমস্ত শুনেছেন আপনি?’তবু বিনোদবাবু হেলেন দোলেন না, বলেন-তা’ বেশ, না হয় আপনার অনেক আত্মীয় আছে, আমাদের মতো অভাগা আপনি নন, কিন্তু একেবারে এনে ফেলবার আগে আমাদের তো কই জানালেনও না।’সীতেশ বোস ত্রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে, প্রত্যেকটি ব্যাপার প্রত্যেককে জানাতে হবে, এমন আইন আছে সেটা তো জানা ছিল না।’তা হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে এই মেসে নিয়ে আসবেন বাচ্চা ছেলেই বলবো, সবে ম্যাস্ট্রিক পাশ করেছে বলেছেন-‘ম্যাট্রিক নয়, হায়ার সেকেন্ডারী”ও একই কথা। মোট কথা ছেলে, বাচ্চা মাওর। তাকে আপনি এখানে-”তাতে আপনাদের অসুবিধে কি?আমাদের অপুবিধের কথা হচ্ছে না- বিনোদবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, তার অসুবিবেটাই চিন্তা করছি। এখানে সর্বদাই মনোমালিন্ত, অসম্প্রীতি, রাগাভাগি, চেঁচামেডি- নয়নবাবুর প্রতি কটাক্ষ করে কথা শেষ করেন।’ও নিয়ে আর আপনি মাথা বোস খাওয়া সেরে জলের গ্লাসটা হাতে যাহাবেন না, বলে সীতেশ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।সীতেশ বোস গেটরোগা বাতের। অতএব খেতে তার সময় কম লাগে। তিনখানার বেশী কটি খায় না,
পৃষ্ঠা-১৯
সীতেশ বোস উঠে যেতে সমালোচনার স্রোত উদ্দাম হয়। বিনোদবাবুর মতো সবাই আত্মসম্মানজ্ঞানহীন নয়, তাই এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে নি, এখন বলতে থাকে।এই পরিবেশে একটা সম্ভ স্কুল থেকে ছাড়া পাওয়া ছেলেকে আনা কেউই অনুমোদন করে না।এমন কি নীলরতনবাবু মেসের বাসনমাজা কি-টার বয়সের উল্লেখ করেও মাখা নাড়েন।আসল কথা, সকলেই বিরুদ্ধ ভাব নিয়ে কথা বলেন।।সীতেশ বোস যে বেশ একটা ‘দাঁও’ ব্যগিয়েছে, এইরকম একটা সন্দেহেই বিরূপতাটা এতো বেশী।নির্ধাত নিদ্দের বোনের কাছ থেকে প্রাইভেট টিউটারের মাইনেষ্টা মারবে, ভাহাড়া ওই ঘরের ভাড়াও।ভাগ্নে যখন, তখন একটু পৃষ্ঠবলও বাড়বে।এই মেসে কারুরই আত্মীয় বলতে কেউ নেই।একেই তো সীতেশবাবুর ‘বয়েস’টাই অনেকের গাত্রদাহের কারণ ছিল, এখন আরো বাড়লো সে দাহ।তবু কেউ ভাবতেও পারেনি এমন একটা ভায়ে সম্পদের অধিকারী ছিল সীতেশবাবু।এ ছেন আবির্ভাবের জন্ম কেট প্রস্তুত ছিল না।এ আবির্ভাব আশ্চর্য তো বটেই, রীতিমতো অস্বস্তিকর।শিশুর মতো সরল মুখী, কিশোরীর মতো ভীরু ভীরু চাহনি, কনককান্তি এই ছেলেটা সীতেশ বোসের কোন দাঁড়াবে ছিল?নিমাইয়ের বাবাও ছিল এমনি রূপবান। তাই নাম ছিল ফটিক- চাঁদ। নিমাইয়ের সে গোরাচাঁদ নাম রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু ঠাকুরমার নাম গৌরীবালা, নিমায়ের মা বলেছিলেন, ‘ছেলের ওই নাম রাখলে আমি ডাকবো কি করে? যার নাম এসে যাবে না।
পৃষ্ঠা-২০
তা মায়ের ডাকাডাকির প্রশ্ন শৈশবেই খতম হয়ে গেল। নিমাইয়ের নামটাই শুধু গোরাটাদ না হয়েই নিমাইচাঁদ হলো।পাড়ার লোক বলতো, ‘সোনার গৌরাঙ্গ’।মেলে সবাই বললো, ‘সোনার কাজিক’।’এই সোনার কাত্তিকটি, ওই শীতেশ বোসের ভাগ্নে।”নয়নবাৰু অনেক ডিটেকটিভ গল্প পড়েন, তাঁর চট করে ‘স্বল্পবেশ’ শব্দটা মাখায় এসে যায়। তাই গলা নামিয়ে বলেন, ‘দেখুন আসলে ভাটে না আর কিছু। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে।”ক্যা সন্দেহ কান্ত।”কেন বলুন তো?’কেন আবার। ভাবভঙ্গী দেখেছেন 1.’কিন্তু গোঁফের রেখা রয়েছে।”সে অমন অনেক মেয়েরও থাকে।”নয়নবাবু গলা আরও নামিয়ে বলেন, ‘ফলস রেখা’ কিনা তাই বা কে বলতে পারে? আজকাল নকল ভুক্ত, নকল দোনা অনেক কিছুই মেলে, নকল গোঁফের রেখাই বা না মিলবে কেন? দিব্যি তো তিন- তলায় নিজের ঘরে পুরে ফেললেন।’অনেকেই অবন্ধু এওটা অবিশ্বাস বা এতটা সন্দেহ করলেন না,কিন্তু কেউ কেউ রীতিমত মাথা থামাতে লাগলেন পরীক্ষার উপায়টা কী ভাই ভেবে।থাকে নিয়ে এতটা মাখা থামানো, সে এসবের কিছুই জানে না।সাতসকালে জ্ঞাতি পিসির বাড়ী থেকে ভাঙ খেয়ে অজানা অচেনা এক পাতানো মামার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল চিরচেনা জগৎ থেকে ঘেন আাচ্ছন্নের মতো।’এই গ্রামে তার যা কিছু ছিল, তার কিছুই আর রইল না।
পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৪০
পৃষ্ঠা-২১
আবার কোনদিন এসেলফাড়াতে ইচ্ছে হলে, অস্ত্রের উঠোনে এসে দাঁড়াতে ভবে,-পিসির বুঝিয়ে দেওয়া এসব কথা ভাবছিল না নিমাই, তাম্ব শুধু মনে হচ্ছিল, ঠাকুমা এখানে ছিল। মরে খিয়েও কোথায় যেন ছিল, নিমাই তাকে ফেলে রেখে চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছে।গ্রামের চেনা পথটি যখন চোখ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, তখন হঠাৎ নিমাইয়ের মনে হলো, জোঠামশাই আর বন্ধু না শত্রু?এতগুলো সোফ এতদিন ধরে তো ভাই বুঝিয়েছিলেন নিমাইকে। নিমাই কেন বোঝেনি।সত্যিই যদি এই লোকটা জোঠার পালা না হয়ে প্রণ্ডা হয়? সত্যি আমি মেরে কেটে-আবার মনকে সামলে নিল নিমাই। তাই কি সম্ভব?সীতেশ আমা কতো লেখাপড়া জানেন, নিমাইকে কতো প্রশ্ন করলেন পড়ালেখার ব্যাপারে, গুণ্ডা কি পাত্রে এসব?তবু বারেবায়েই চোখের সামনেটা যেন শুধু অন্ধকার লাগছে। কে জানে কেমন সেই কলকাতা।কলকাতায় যখন এসে নামলো, তখন হাওড়া স্টেশন আলোর মালা পরে সেজে বলেছে।জীবনে নিমাই এত আলো কখনো দেখেনি।নিমাইয়ের চোখ ধে’ বৌ গেল। সে অজ্ঞাত সারে সীতেশের হাত চেপে ধরলো।তা সীতেশ বোল সেটাকে অস্বস্তিকর মনে করে ঝেড়ে ফেলে দিল না, বরং যেন পরম হয়ে আরো মুটিয়ে ধরলো। বললো, ‘ভয় কি? এসো আমার সঙ্গে।নিমাই অতএব আলসার পেলো।হাওড়া থেকে পটলডাঙ্গায় মেসে আসতে, আগে বাস তারপর রিকশা।
পৃষ্ঠা-২২
নিমাইয়ের ছোট ট্রাঙ্ক আর ক্ষীণকায় বিছানাটা বাসড্রাইভার কিছুতেই নিতে চাইছিল না। অনেক খোসামদ করে, অনেক বকাবকি করে ডবল ভাড়া দিয়ে রাজী করালো তাকে সীতেশ মামা। নিমাই বিয়েলবৃষ্টিতে দেখলো সেই বাহাহুরি।তারপর কোথা দিয়ে না কোথা দিয়ে ঘুরিয়ে তিন চারটে পাক খেয়ে কোন একটা গলিতে ঢুকে পড়লো রিকশাটা। তারপর সেও বকাবকি শুরু করলো আর যাবে না।আর ঢুকবে না রিকশা।
‘তবে চলো নিমাই, এখান থেকে হেঁটেই যাওয়া যাক।’বলে সীতেশমামা নিজেই নিমাইয়ের ট্রাকটা বাগিয়ে ঘরে বিছানাটা নিমাইয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এগোতে লাগলো গাইড হয়ে।গলির বাঁকের মুখে একটা লাইট পোস্ট। তেরছাভাবে খানিকটা আলো পড়েছে কোণের দিকে, বাকি সবটাই ছায়া ছায়া অন্ধকার। তবু পায়ের নীচেষ্টায় যা দেখতে পাচ্ছিল নিমাই, তাতে তার সমস্তঅণু-পরমাণু সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল। গ্রামের ছেলে সে, চড়োকরা শুল্লাল দেখার অভ্যেস তার নেই তা’ নয়, কিন্তু সে তো ‘৩’চলা-ফেলা পগার’। তার ধারে কাছে খাওয়ার আইন ছিল না। গিন্নীরা দেখতে পেলেই চান করিয়ে ছাড়তেন।কিন্তু এই সংকীর্ণ গলির মধ্যে দেই কদর্য জঞ্জাল এমনভাবে ছড়ানো যে, মাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।নিমাই তো যতদূর সম্ভব সাবধানে চলবার চেষ্টা করছে। কিন্তু সীতেশ মামা তো ওইগুলো দিব্যি মাড়িয়ে মাড়িয়ে চলেছেন।কলকাতার প্রথম অনুভূতির অভিজ্ঞতা হাওড়া ট্রেশনের তীর প্রখর আলো, দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা পটলভাণ্ডার গলি-ভাস্টবীন ওল্টানো।
পৃষ্ঠা-২৩
সেই গলি পার হয়ে যে বাড়ির মধ্যে তাকে ঢুকিয়ে আনলো সীতেশমামা, তাকে ঠিক ‘খাড়ি’ বলে বুঝতেই পারেনি নিমাই।ফোনখান দিয়ে ঢুকলো, কোন দৃপ্ত অতিক্রম করে ভাঙা নড়বড়ে সিড়ি বেয়ে একেবারে তিনতলায় গিয়ে পৌঁছালো, তা টেরই পেল না। বোধকরি সেই যে আচ্ছন্ন হওয়াটা, সেটার ঘোর তখনো কাটেনি নিমাইয়ের।পিসি সঙ্গে কিছু খাবার দিয়েছিল, সেটাই রাত্রির আহারে লাগলো। কারণ আজ আর মেষ-এ নিমাইয়ের খাবার ব্যবস্থা হয়নি। লীতেশ বোস ম্যানেজারের সঙ্গে কিছুটা বন্ধাবকি করে এলে বললো ‘ঠিক আছে, তুমি আজকের মতো ওই খাবার টাবার খেয়েই কাটাও কাল থেকে দেখছি।”নিমাই তার কৌটো খুলে সসঙ্কোচে বলে, ‘অনেক তো রয়েছে, আপনি কিন্তু নিন-‘শীতেশ একটু লুব্ধ বৃষ্টিপাত করেই পেটে হাত বুলিয়ে বলে, ‘নাঃ। ওই চালের গুঁড়ির মালপোয়া আমার পেটে সন্ধ হবে না। তুমি ছেলেমানুষ, তুমিই খাও।’তারপর নিজের চৌকীর সামনে মাটিতে নিমাইয়ের বিছানাটা পাড়িয়ে আদরের সঙ্গে তার হাত ধরে শুইয়ে বলে, ‘শোও’ এইখানে শোও। গায়ের জামা খুলে ফেলো। এই জানালা খুলে দিচ্ছি, গরম হবে না। আমি যেয়ে আসি। জয় করবে না তো?’ভয় করবে’ একথা বলার মতো লজ্জা আর নেই, বিশেহ করে এই বয়সের ছেলেরা। নিমাই বললো, ‘বোৎ।’সীতেশ আর একবার তার গায়ে-মাখায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দরজাটি ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল।নিমাইয়ের ডাক ছেড়ে কান্না পচ্ছিল, তবু নিমাই এই নিতান্ত পর সম্ভপরিচিত মানুষটার স্নেহপূর্ণে আশ্বাস পেল।
পৃষ্ঠা-২৪
অস্বস্তিকর পরিবেশ, কেমন একটা গুমোট গুমোট গন্ধ, ঘুমআসতে চায় না, তবু কখন একসময় ঘুমিয়েও পড়লো।কখন যে নীতেশ মামা এলো, টেরও পেল না নিমাই।সীতেশ বোসের নির্দিষ্ট কোন চাকরী নেই, টিউশানিই সম্বল। তাই অন্ধকার থাকতে উঠে গরু চরাতে বেরোতে হয় তাকে।একটা ছেলে আটটায় স্কুলে যায়। তাকে ছটার সময় পড়াতে যেতে হয়। অতএব এই রাজপুত্তর কুণ্য ভাগ্নেটকে অনাথের মতো ভূমিশয্যায় ফেলে রেখেই চলে যেতে হয়েছে নীতেশ বোসকে। তাকে কোন নির্দেশ দিয়ে যাবার সময় পায়নি।হয়তো ভেবেছে ওখান থেকে মানিকতলার ছেলেটার কাছে ন। গিয়ে আবার ফিরে মেসেই ফিরে আসবে। ততক্ষণ হয়তো ঘুমোবেই ছেলেটা।কিন্তু ততক্ষণ ঘুমোয়নি নিমাই।খানিক পরে ঘুম ভেঙে গেছে তার।প্রথমটা হকচকিয়ে তাকিয়ে ছিস। তারপর আস্তে আস্তে সব মনে পড়লো। উঠে পড়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো।নেমে এলে হোতাপার বারান্দা।অধব্য সি’ক্ষি থেকে ঘরে পরে পৌঁছবার প্যাসেজ।তার-বাঁধা নড়বড়ে রেলিং, দেই রেলিংয়ের বারেই এসে দাঁড়াল নিমাই। মীচের দিকে আকালো। আর যেন দিশেহারা হয়ে খেল।এ কোন ধরনের জায়গা।ঠিক নীচেটায় খানিকটা জায়গা (গ্রামের ছেলে ওই শানিবাঁধানো চাতালটুকুকে উঠোন’ বলে ভাবতে পারে না), সেইখানে একদল ফার্তা কর্তা লোক গামছা পরে ভীড় করে দাড়িয়ে আছে। কেউ বা শুধু দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বা গায়ে তেল অসন্ধে।
পৃষ্ঠা-২৫
গামছার মাপ কারো ব্য আজানুলম্বিত, কারো বা জানুর অনেক ঊর্দ্ধে। যেন নিতান্তই লজ্জা নিবারণের দাঁতর্ষি চুনি।অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিমাই।কোথায় ছিল এতগুলো লোক।কই, কাল তো কাউকে দেখতে পায়নি। না কি কোনোখান থেকে এসেছে সকালে। কিন্তু এসেছে যদি তো গামছা পরে এসেছে কেন?আর এতো কথাই বা কইছে কেন?নিমাই ওদের কথাগুলো শুনতে পায়, কিন্তু হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। শুধু তার কানে কথার এক-একটা টুকরো এসে ঢোকে।’চৌবাচ্চা আপনার কেনা নয় মশাই। প্রতিদিনই বা আপনি আগে এসে হানা দেবেন কেন?”কেন? রাত চারটের উঠি বলে। একটু শান্তি করে চান করবে। বলেই উঠি।”ভা’হলে রাতেই একেবারে চান করে নিয়ে গিয়ে শোবেন। এভাবে ইয়ে করলে-”মুখুয্যে মশাই, গামছাটা একটু বড় দেখে কিনবেন। এখানে একটা মেয়ে ছেলে ভাজ করে সেটা মনে রাখবেন।”নিজের চরকায় তেল দিন নীলুবাবু। আপনি কিভাবে তেল মাখেন সেটা ভেবে দেখেছেন?’সকালবেলা থেকে খুদ্ধ কথা নিয়ে ফাটাফাটি করবেন না দাদা, একেই তো দেশে সমস্তার অন্ত নেই।’৪: দেশ নিয়ে কতো-চিন্তা।”‘আপনার না থাকতে পারে। মানুষ মাত্রেরই আছে। এই যে ইলেক্লান। আসছেইলেকশান। রাবিশ। ভেতরে শুধু ভোদুরীর লীলা খেলা। আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরে।’
পৃষ্ঠা-২৬
‘হবে শেষ পর্যন্ত একটা গণবিপ্লব।”এদেশে? প্র’।”কালকের মাছটা কি রকম ছিল দেখেছিলেন নয়নবাবু। মুখে করা গেল না। স্রেফ পচা।”এবারের চার্জ কার হাতে তা’ জানেন তো?”নাঃ, এখানে আর বেশীদিন বাস করা চলছে না।”চলছে না চলছে না বলেই তো পাঁচ বছর কাটালেন।”নিজের দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন বসন্তবাবু। নেহাৎ নিরুপায় বলেই’হায়জে হয়েছে, আর দল ঢালবেন না। সবাই পয়সা দিয়ে থাকি, কেউ অমনি নয়।’লোকগুলিকে পুরু সাবানের ফেনায় কেমন সাদা লোনওয়ালা জানোয়ারের মত দেখায়।বিষ্ট একটা শ্যাওলা-শ্যাওলা আর টকটক গন্ধ পাচ্ছিল নিমাই। নীচের ঐ চাতালটা থেকে উঠে এসে যেন নিমাইয়ের গলার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।কিসের গন্ধ?নিমাই ওই কুদৃষ্ণ আর কটু গন্ধ থেকে ঈষৎ সরে এসেছিল। হঠাৎ ভাঙ্গা খনখনে একটা মেয়েগলা শুনতে পেলো-একটু গা মেরে হাটুন না বাবু। একটা মেয়েছেলে রয়েছে দেখতে পাচ্ছেন না? আমারও যেমন মরণ, তাই এই রাবণের গগুরির বাসদ মাজকে আাবি। ফুরোয় আর না। ভদ্দরলোক আপনারা একটু জ্ঞান নেই।’নিমাই আবার সরে আসে।নিমাই অবাক হয়ে দেখে একটা মেয়েমানুষ ওই শাওলাধরা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে যেন নাচছে। চেহারাটা ঠিক আগুনের মতো। নিমাই ওই বিরাট গামছা বাহিনীর মধ্যে সতীশ মামাকে দেখতে পায় না। নিযাই ভাবে, ছিঃ উনি কেন ওরকম হবেন?
পৃষ্ঠা-২৭
ওরা নিশ্চয় আলাদা লোক।কিন্তু ওরা কে?নিমাই হতাশ হয়ে সিঁড়ির খাপে বসে পড়ে। যে সিঁড়িটা জীবনে কখনো ঝাঁটা খেয়েছে বলে মনে হয় না।ওরা যে কে, তা একটু পরেই টের পেল নিমাই। একে একে উঠে আসতে থাকেন ওই গামছা বাহিনী দোতালায়।হাতে সাবানদানী, মাজনের কৌটা।তার মানে ও’রা এখানকারই বাসিন্দা।ছ একজন নিম্নমনে চলে গেলেন, একজন দাঁড়িয়ে পড়েন।অবাক গলায় বলেন, ‘কে?’নিমাই কি বলবে ভেবে পায় না। শুধু দাঁড়িয়ে ওঠে। ভদ্রলোক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলেন, ‘কি হে তুমিই কি সীতেশ বাবুর ভাগ্নে নাকি?’সীতেশবাবু।নিমাই যেন এতক্ষণে পায়ের তলায় মাটি পায়। তাহলে কালকের ঘটনাটা সব ভৌতিক নয়। সীতেশবাবু নামের লোকটা এখানেই বাস করে।নিমাই আস্তে বলে ‘হ্যা।’কি রকম ভাঙে?’নিমাই চুপ করে থাকে।ভেবে পায় না কি রকম ভাগ্নে বলবে।বাক্তিটি মুহু।তাই নিদেয়ে বলেন, ও গ্রাম সম্পর্কে পাতানো মামানিমাই তথাপি চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়।এ প্রশ্নেরই বা উত্তর কী দেবে?ভদ্রলোক গামছা আগে শুকিয়েই প্রশ্ন করে। চলেন, ‘মা-বাপ আছে?
পৃষ্ঠা-২৮
নেই? কোথায় ছিলে? অ। সেখানেই পাশ করেছ? হাইস্কুল ছিল? তা কোন কলেজে ভর্তি হবে?’ইত্যবসরে একজন-দু’জন করে জমে যান অনেকেই। কেউ শুকনো লুংগি পরে ঘর থেকে বেরোন, কেউ বা সেই স্নানের পোশাকেই।কে?কে?সীতেশবাবুর ভাগ্নে। একেবারে যা দেখছি।এখানে থাকা ঠিক বলে মনে হয় না। হোস্টেলই ভালো। পড়ারখরচ বাড়ি থেকে পাঠাবে। না নীতেশবাবুই?শত প্রশ্ন।অস্ফুটে আরো কথাশুনতে পায় নিমাই।মা বোধ হয় রূপসী ছিল।’দেখো ভায়ে না ভারী।নিমাইয়ের কান লাল হয়ে ওঠে।জল না দেওয়া বাসি মুখের ভিতরটা আয়ো বিশ্বাদ হতে ওঠে দিনাইতের।নিমাইয়ের আবার তার জ্যেঠাকে শত্রু বলে মনে হল। সন্দেহ হয় সীতেশ নায়ের লোকটাকে।তবু টের পায় না’সে সত্যি ছেলে না মেয়ে’ এই নিয়ে তখন হুমুল আলোচনা চলছে ঘরে ঘরে।নিমাই চারিদিক তাকিয়ে দেখে।কী শ্রীহীন, কি বিশ্রী, কি বিষর্ণ।এ-ই কলকাতার ডাল মেস।খানিক পরে সীতেশ আসে।অবাক হয়ে বলে, ‘এ কী তুমি এখানে বলে আছো। মুখটুখ
পৃষ্ঠা-২৯
যোওনি? কী আশ্চর্য। ওই তো কলতলা দেখা যাচ্ছে নেমে যাবে তারপর আরো জিজ্ঞাসাবাদের পর যখন জানতে পারে নিমাইয়ের সঙ্গে না আছে সাবান, না আছে মাজন, একখানি গামছাই মাত্র প্লানসমুদ্রের ভেলা তখন হতাশ গলায় বলে ‘নাঃ, আলই তোমায় নিয়ে দোকানে বেরোতে হবে। কলকাতায় ওসব দু’টের ছাই দিয়ে দাঁত মাজেনা কেউ, তেল মেখে স্নান করে না। এহলো সত্য জায়গা। টাকা তোমায় কিন্তু বসাতে হবে বাপু।’নিমাই নীচের ওই উঠোনটার দিকে তাকিয়ে বোধকরি ‘সভ্য’ শব্দটার অর্থ খুঁজতে চেষ্টা করে। কারণ তখন সেখানেও এক গা সাবান মেখে কোন একজন উচ্চস্বরে স্তোত্র পাঠ করতে করতে মগ মগ জল ঢালছেন মাখায়, আর ফিটা প্রবল স্রোতে ছাইমাট দিয়ে পোড়া কড়া বাজছে।কিন্তু সীতেশ মাষ্টার সার নিয়েছে গ্রামের এই অসদ্য ছেলেটাকে সভ্য করবার। তাই সীতেশ মাষ্টার বলে, ‘টাকা কোথায় তোমার?’সর্বনাশ।’ দীতেশ নিজের মুখটাতেই হাত ছাপা দিয়ে বলে- ‘চুপ চুপ, খবরদার। কেউ যেন না টের পায়। আজই পোস্ট অফিসে কিছু জমা দিয়ে আসি। তবে কিছু লেগে যাবে কলেজে ভর্তিতে, কিন্তু তোমার জামাকাপড় জিনিসপত্রে। কলকাতায় অমন হাভাতে ভাবে থাকলে তো চলে না। তা’ছাড়া তুমি ভাল কলেজে পড়বে।’নিমাই আবার কৃষ্ণজ্ঞতা অনুভব করে।তবু নিমাই আস্তে বলে, ‘কলেজ হোস্টেলে থাকার খরচ কি খুব
পৃষ্ঠা-৩০
সাঁতেশ মাস্টার চোখ কপালে তোলে। ‘তা’ আবার বলতে।বড়লোক ছাড়া আর পারে না। তাছাড়া দেখো এখন কলেজেই সিই পাও কি না, তা আবার হোস্টেলে।নিমাই জানতে পারে, কলেজের সিট্ হুলর্ভ।নিমাই জানতে পারে হোস্টেলে বড়লোকদের ছেলেরা ব্যতীত থাকতে পারে না।কিন্তু নিমাই আরো অনেক কিছুও খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারে সাকি?নিমাইয়ের জিনিসের সঙ্গে সীতেশ মাস্টারেরও নানাবিধ জিনিস কেনা হয়ে যায়। অধঃ সীতেশ মাস্টার নিজের প্যাকেটে হাত দেয় না।গত কালকের বাসভাড়া এবং রিকশাভাড়াটাও যে নিমাইয়েরই সেরা ভিস, সেটাও জানতে পারে নিমাই আম।কিন্তু জানার পরিধি কি ওই খানেই থেমে যাবে নিমাইয়ের?নিমাই কি জানছে না, কলেজে ভর্তি হওয়া মানে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বেড়ানো?’শেষপর্য্যন্ত ঘুষ ছাড়া গতি নেই। জ্ঞান যেন সীতেশ মামা।’এ যে কী রানক জায়গা।’ঘুষ বাবদ টাকা চেয়ে নেন সীতেশ মামা তাঁর আদরের ভাষ্ট্রের কাছে। যে ভান্তের মামা আদএটা মাঝে মাঝে বেশ বিসমুখ লাগে।ঘুষটা আসলে কোন পকেটে ওঠে জানতে পারে না নিমাই। শুধু একদিন যক্ষ হয়ে দেখতে পায় যে নিমাইচাদ মিত্র নামের ছেলেটা কলেজের ছাত্র হয়ে গেছে।’নিমাইচাদ।’সীতেশ মাস্টার বলেছিল, ওসব চাঁদ ফাঁদ চলবে না বাপু এখানে, কলকাতার লোক নামের ল্যাজাট্য। বাদ দিয়ে ফেলে।
পৃষ্ঠা-৩১
কিন্তু সুবিধে হল না।পরীক্ষার সার্টিফিকেটে যে ‘চাঁদ’ জ্বলজ্বল করছে।অতএং নিমাইচাদ।’তা’ বলে কেউ নাম জিগ্যেস করেলে যেন ওই চাঁদটা বোলোনা,রীক্ষা দেয় সীতেশ মাষ্টার।কলকাতার মন্ত্রে দীক্ষা।সীতেশ মারায়ের প্রতি কেউ সদয় নয়।কিন্তু সীতেশ মাষ্টারের ভাষ্ট্রের প্রতি সবয়তার শেষ নেই কাহোর।সবাই ডাক দেন ‘এই বে নিমাই’ এসোনা এঘরে।’নিমাই সঙ্কুচিত ভাবে ঢোকে। এবং তাদের কৌতুহল প্রশ্নের উত্তরগুলোও যথাসম্ভব সঙ্কুচিত হয়েই দেয়।ভেবে পায় না, নিমাইয়ের অতীত জীবনের খবরে ভাদের কী স্বরকার। সীতেশ মারার নিমাইয়ের সঙ্গে সত্যি মামাজনোচিত ব্যবহার করে কি না, তা জেনে কী দরকার। নিমাইয়ের টাকার ভাঁড়ার ফুরিয়ে ছেলে কি করে চলবে, তা জেনে কি দরকার।কিন্তু মনে হয় জানাটা ওদের ভয়ংকর দরকার।নিমাই তো জানাতে জানাতে হাঁপিয়ে উঠছে।আর জানতে জানতেও।পটলডাঙার মেসে-এর বাইরের ঝকঝকে কলকাতাকে যেখে আসছে, দেখে আসছে আসোর মালা পরা রাস্তা, আলো- লিছলে পড়া গাড়ীর সমারোহ, দোকানের হরিলুঠ, জিনিসের হরিলুট।তারপর আনছে নিমাইয়ের অন্তে বরাদ্দ একটা চাবকালে ভাঁজ করা অন্ধকার গলি, আর এই সীহীন বিবর্ণ মেসবাড়ির জাতের ওপরকার হাত পাঁচ-ছয় একটা ঘরের অর্থাংশ।
পৃষ্ঠা-৩২
কিন্তু সেই অর্ধাংশটুকুই কি নিশ্চিন্ত শান্তির।নিমাই জানে না।নিমাই বুঝতে পারে না।নিমাই জীবনে কখনো মামার বাড়ি দেখেনি। ‘মামার আদর’ কাকে বলে জানে না, তাই নিমাইয়ের রাত্রি আসবার উদ্দেশেই কেমন গা ছমছম করে।ধীরে ধীরে আলাপও হচ্ছে সকলের সঙ্গে।নাম জেনে ফেলেছে অনেকেরই।বিনোদবাবু, বসন্তবাবু, নয়নবার, নীলরতনবাবু, মুখুধ্যে মশাই, ঘোষ মশাই-এক-এক জন এক-এক রকম।বিনোদবাবু বললেন, ‘তোমাদের স্বরে ছারপোকার গন্ধ নেই? চলো না ধ্বংস করে দিয়ে আসি। ভয় নেই তোমাদের দেশলাই কাঠি খরচ করবো না। দেশলাই নিয়েই যাবো।’নয়নবার বললেন ‘ডিটেকটিভ গল্প পড় না। বল কি তে। ইয়ংম্যান তুমি, কি পড়ে তবে রোমাক অনুভব করবে?বসন্তবাবু বলেন, ‘টাকাপত্তর বুঝি তোমার ওই সীতেশ মামার কাছেই রাখতে দাও? তা দিও ভাল কথা। সরল শিশুর মত ছেলে, তবে ভিসেষটা একটু রেখো।’নীলরতনবাবু মাঝে মাঝেই উপদেশ দেন, ‘বেশ জবজবে করে তেল মাখবে, বুঝলে? নিয়মিত তেল মাখলে স্বাস্থ্য কখনো খারাপ কর মুহূয্যে মশাই কিন্তু সম্পূর্ণ অঙ্গ কথা বলেন। তিনি আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বলেন, ‘ওই কি মাগী টোপরে যায় নাকি? যায় না তো? দেয়? দেয় না? নিজেই কাচো? কাজ নিজে করে নেবে সেটাই ঠিক। তোমার ঘর যুদ্ধকে ওপরে ভাল। কাপড়চোপড় কেচে ভাল ভাল। ইরম্যোন, নিজের বলছি কেন জানো? মাই বড় গায়ে পড়া তোমার মতন এমন সোনার কান্তি তরুণ যুরা
পৃষ্ঠা-৩৩
পুরুবাটি দেখলেই গায়ে পড়তে আসবে। নিজে খুব শক্ত হবে, বুঝলে? খুব শত্রু।’নিমাই আড়ষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে।নিমাই চোখের সামনে শুধু ছায়া কি যেন দেখতে পায়। জেগে জেগে বুন্দেধ?তবু নিমাই কি সেই বৃষ্টির রাতের অভিজ্ঞতার কথা হুঃস্বপ্নেও ভেবেছিল?বৃষ্টি পড়ছিল সন্ধ্যা থেকে।আর ছাদ দিয়ে জলও পড়তে শুরু করেছিল আস্তে আছে।সেই জল গড়িয়ে এসে মেদের বিছানা ভিলিয়ে দিয়েছিল। শুতে গিয়ে হতজ্ঞপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল নিমাই।কিন্তু মামার স্নেহকণ্ঠ অভয় দিল তাকে।১৩ বিছানাতে শুতে পারবে না নিমাই, এলো আমার চৌকিতেই এসো। এদিকটায় ফল পড়ে না।’নিমাই সঙ্কুচিত গলায় বলে, ‘আপনার সরু চৌকিতো হোক, তা হোক। হয়ে যাবে একরকম করে। নয়তো সারারাত টুলে বসে থাকবে নাকি?নিমাই হরির। গল্পে গলে, ‘আমি বরং বাঁয়ে কারো ঘরে -বড় গর আছে’নীচে আবার কার ঘর? ৫। কেউ শুতে দিতে চাইবে না। সব কটা হচ্ছে একের নম্বর স্বার্থপর। চিনি তো। লাবে আমি কারুর সঙ্গে মিশতে চাই না। না না, তুমি এখানেই শুয়ে পড়ো।’নিজেকে আধখানা করে ফেলে জায়গা বার করে দিয়েছিল সীতেশ মামা।তারপর বৃষ্টি-আরো বৃষ্টি।তারপর মেঘের ডাক।তারপর সেই ভয়ংকর বজ্রপাত।
পৃষ্ঠা-৩৪
সেই ভন্তের অভিজ্ঞতা।কেমন করে যে দরজার ছিটকিনি খুলে ছুটে বেরিয়ে পড়েছিল নিমাই জানে না।কেমন করে সিড়ি দিয়ে নেমে এসেছিল তাও জানে না। জানে না কার ঘরের দরজায় সজোরে করাঘাত করেছিল, মেঘবুরি গ ছাপিয়ে।তার শুধু মনে হয়েছিল, ওই ভরন্তর বাজটা একটা বাঘের হাঁ নিয়ে নিমাইয়ের পিছু পিছু তেড়ে আসছে।কোনো রকমে কারো খবে ঢুকে আত্মরক্ষা করতে শুবে নিমাইকে।প্রথমটা নয়নবাবু ভেবেছিলেন বাভাসের শব্দ। কিন্তু মুজমুহ এই বাকা বাতাসের? চোর-টোর নয় তো?পার্টনার বিনোদবাবুর ঘুম বেশী গাড়, তবু তিনিও জেগে গেলেন।বললেন, ‘কী ব্যাপার?”কে যেন দোর ঠেলছে।”কে?”ভা জানি না।”খুলে দেখবেন তো?”সাহস পাচ্ছি না।’সাহস হয়তো বিনোদবাবুও নিজে একা হলে পেতেন না, কিন্তু নয়নবাবুর কর্মের প্রতিবাদকল্পে বিনোদবার সাহস পান।তাচ্ছিল্যের গলায় বলেন, ‘ভয়টা কিসের?’তারপর ছিটকিনিটা খুলে ফেলে, দরজাটা চেপে ধরে আধখানা চোখ বাইরে ফেলে বলেন, ‘কে?’অস্বাভাবিক একটা ভাঙা গলা বলে উঠে- ‘আমি’।’আরে আমাদের সীতেশ মাষ্টারের ভায়ে না?’
পৃষ্ঠা-৩৫
স্বরজাটা খুলে ফেলেন বিনোদবাবু।ভূতাহতের মত আছড়ে এসে ঢুকে পড়ে ছেলেটা।’ময়নবাবু, আমি এ ঘরে শোবো।অনেকক্ষণ হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে অবশেষে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো লেটা।ঘুমিয়ে পড়ার পর এই দুই পরম শত্রু অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো ক্লাখোচোখি করে বলেন, ‘ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।”ছ’। পারছি বৈ কি।”এই সব লোক শিক্ষকতা করে। জাতির ভবিঘ্নত্যের শিক্ষার ভার এদের হাতে। মিঃ।’পটলডাঙ্গার মেষ ছাড়লো নিমাই।ঠিক সেই বৃষ্টির পরদিন না হলেও, ক’দিন পরেই।সীতেশ মারার তো পরদিন সকালেই বাড়ী থেকে হঠাৎ শক্ত অসুখের খবর পেয়ে বৃষ্টি বাদল মাখায় করে চলে গেছে প্রড়মুড়িয়ে।নিমাই দু’দিন মলিন মুখে কলেজ গেল-এলো, এবং বিনোদ বাবুদের ঘরেই বাস করলো।কুটিল বিনোদবাবুই কথাটা পাড়লেন, ‘তোমার টাকা পয়সা। গুলোখ কি মেরে নিয়ে গেছে নাকি?মেরে যে আমেকেই নিয়েছে তলে তলে, সে কথা বলতে পারলো না নিমাই। মাথা নীচু করে বললো, ‘না পোস্ট অফিসে আছে।’তবু রক্ষে। তা’ দেখো বাপু, তোমার মত ছেলের এই পরিবেশে থাকা ঠিক নয়। আর কিছু নয়-সকলেই হচ্ছি বয়স্ক, আর তুমি ছেলে মানুষ। ভাল লাগবে কেন? তা’ আমি বলছিলাম কোনো খানে গৃহশিক্ষক হিসেবে থেকে লেখাপড়া কর।’
পৃষ্ঠা-৩৬
আগের থেকে অবক্স কিছু কথাবার্তা শিখেছে নিমাই। সে শুধু বলে, আমার কে মাষ্টারী দেবে?”দেবে। দেবে না কেন? বি, এ, ক্লাসের ছেলেকে কি আর পড়াতে যাবে? নীচু ক্লাসের একটা ছেলেকে পড়াবে, বাড়ীর ছেলের মতো থাকবে-‘নিমাই এখন বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েছে, তাই নিমাই আর আকাশ কুম্বন দেখে না।অতএব নিমাই আবারও হাসে। সবই তো বুঝলাম, কিন্তু সেই বাড়িটা পাচ্ছেন কোথায়?’পাচ্ছেন কোথায়’ সে কথা বিনোদ বাবু ভাতেন, তাঁর এক পরিচিত ভদ্রলোক খোঁজ করছেন ওই রকম একটি ছেলে।
বি. এ. এম. এ. পাশ করা মাষ্টারদের ডাঁট বেশী, মাইনে বেশী। তাই অত্মবিতে মারীর চাইছেন। যাতে মাইনেও বেশী নেবে না, ডাঁট বেশী করবে না।’তবে একটা কথা- ‘নয়নবাবু কথ্য জুড়েছিলেন, ‘তোমার ওই রূপটিই হয়েছে সর্বনাশে।’নিমাই চনকে তাকায়।নয়নবাবু বিনোদবাবুর দিকে তাকিয়ে একটু অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলেন, ‘দাড়িতে আর কোন্ কোন্ মেম্বার আছে জানেন?”আরে দূর অশাই, রাতদিন নাটক নভেল পড়ে পড়ে আপনার’নাটক তো দেখলেনও-‘তা’ বটে।’নিমাই এসব কথার কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না।কিন্তু নিমাই এই গলির বন্ধন থেকে মুক্তির আশায় উৎ শুরু হয়। কলেজে একটি মাত্র ছেলের সঙ্গে ভাব হয়েছে। আর সকলেই যেন কেমন বাঙ্গের সৃষ্টিতে তাকায়।
পৃষ্ঠা-৩৭
নিমাই যে ধুতি আর ছিটের শার্ট’ পরে কলেজে আসে এটা হাসির, নিমাই যে কোন একটা গন্দগ্রাম থেকে এসেছে এবং তার গায়ে যে গ্রামের সোঁদা মাটির গন্ধ এখনো লেগে আছে, এটা হাসির। এই কলকাতার যে কিছুই জানে না ছেলেটা এটা হাসির, পলিটিকসের ‘প’ বোঝে না, এট। হাসির, এবং বেটাছেলে হয়েও যে ওর তরুণী মেয়ের মতো রূপলাবণ্য- এটাও হাসির।এতগুলো হাসির খোরাক যে যোগায়, তাঁকে দেখে ব্যঙ্গের চোখে তাকাবে না ওরা? শুনিয়ে শুনিয়ে বসবে না, ‘গোলাপ গুচ্ছ’, ‘ডালিম ফুল’, ‘পাকা টমেটো’, ‘খুকুমণি’।নিমাই শুনতে পেয়েও শুনতে না পাওয়ার ভান করে, বউয়ের পাতায় চোখ রাখে, আর ওর সেই ফেলে আসা গ্রামের নদীর ধারটায় লঞ্চে হাহাকার করে ওঠে মনের মধ্যে।পিসি বলেছিল, ‘কী দরকার বেশী লেখাপড়ার? গরের ছেলেপিসির করাটা হাঙ্গর ঠেকেছিল, এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যি-কী দরকার? বেশী লেখাপড়া শিখে কি সাতাই খুব উঁচুদরের মানুষ হওয়া যায়?সীতেশ মাষ্টার তো এম, এ, পাশ।এই কলেজের অধ্যাপকরাও তো, মস্ত মস্ত বিয়ান। কই, কাউকে দেখেই তো শ্রদ্ধায় মন ভরে উঠে না।আর এই সব স্টুডেন্টরা?খাও ইয়ারের-ফোর্থ ইয়ারের।এদের মধ্যেই বা কোথায় সে নম্রতা, ভব্যতা, সভ্যতা-যা দেখলে মনে হতে পারে, এই-এই হচ্ছে বিজ্ঞের মূর্তি। 1এক কথায় অধ্যাপকদের মুখের উপর ভোটপাট, বন্ধুদের সঙ্গে তর্জ করতে গিয়ে ফাতাহাতি, পলিটিকস্ নিয়ে মাথা ভাঙাভাঙ্গি-এসব দেখে, আর হতাশ হয় নিমাই।
পৃষ্ঠা-৩৮
নিমাইর যেন প্রতিমুহূর্তে স্বর্গচুত্যি ঘটেছে। কলেজে যার সঙ্গে ভাষ হয়েছে নিমাইয়ের, তার নাম মুগান্ত। যুগান্ত খাস কলকাতারই ছেলে। ‘দেশের বাড়ি’ বলে কোন শব্দ ওয়ের পরিবারের অভিধানে নেই। কলকাতাই দেশ।।কলকাতা যখন হিজলগাছের ছায়ার ঘুমোতো, আর তার বাদাবনে লাপেরা সুখে সংসার করতো, তখন মুগাঙ্কের কোন উদ্ধ’জন পুরুষ কোথা থেকে যেন এসে সেই কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর ভগবান জানেন কেমন করে যেন দাঁড়িয়েও পড়েছিলেন।কালক্রমে কলকাতার অতি গভীরে শিকড় চালিয়ে তিনি নাকি একটি মহীরুহে পরিণত হয়েছিলেন, এবং অনেকের আভয়ৰাতা ও অনেকের ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠেছিলেন। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’-র লালমুখো সাহেবরা নাকি তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল। সে যাই হোক- মোট কথা যা তিনি সঞ্চয় করে রেখে গিয়েছিলেন তার তলানি ভাঙিয়েই এখনো চলছে যুগাঙ্ক মল্লিকদেয়। বড়বাজারের বানিয়া মহল এখনো ওদের নামে হাত জোড় করে কপালে ঠেকায়। কারণ এখনো পর্যন্ত ওদের জীবিকার বাড়া ওই বড়বাজারের গোলক ধাঁদীর মধ্যেই আবর্তিত। বংশের মধ্যে কেউ কেউ কখনো জাঁকিয়ে উঠে পুরনো নামকে উজ্জ্বল করেছে। কেউ কেউ সে উজ্জলে। কালি লেগেছে, এখন প্রায় মুংযু’ দশা।তবু এখনো মুগাস্কদের সেই দেড়কাত চৎড়া কার্নিশ আর দণয়াত উঁচু দরজা সম্বলিত বাড়িটা উত্তরকলকাতার একটা সঙ্কীর্ণ গলির সব আলো আড়াল করে উদ্ধত দুঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। এমনই পাকা মাল-মশলা দিয়ে গড়া হয়েছিল যে, জরা তাকে জীর্ণ করে ফেললেও ফেলে দিতে পারেনি।মুগান্তদের সেই বাড়ির মেজে আগাগোড়া মার্বেল মোড়া, দালান থেকে ছ’বার প্রসারিত করে উঠে যাওয়া চওড়া কাঠের সিঁড়িতে এখনো কার্পেট পাতা, ঘরে ঘরে উঁচু উঁচু মেহগিনির পালয়, বিশাল
পৃষ্ঠা-৩৯
বিশাল ড্রেসিং আয়না, বড় বড় গোল টেবিল, আর হলঘরের সিলিং থেকে ছ’হটো ঝাড়লণ্ঠন দোদুল্যমান।নিমাই প্রথম দিন বেড়াতে এসে হাঁ হয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘তোমরা কাহলে রাজা ছিলে।’হতভম্ব হয়েই বলেছিল।নিমাইয়ের অনভিজ্ঞ গ্রাম্য চোখে ধরা পড়েনি, ওই মার্কেলগুলো পালিশ হারানো হলদেটে, কার্পেটগুলো জীর্ণ বিবর্ণ শতদ্ধিত্র। আসবাব- গুলো হাঞ্চকর রকমের সেকেলে, আয়নার কাঁচ বয়সের দাগে কলঙ্কিত, আর ঝাড় লণ্ঠনের কংকালটাই শুধু অতীত গৌরবের সাক্ষ্য দিতে ঝুলে সরয়ে।নিমাই তাই বলেছিল, ‘তোমার বাড়ি দেখে তোমার সঙ্গে মিশতে জয় করছে।যুগান্ত হো হো করে হেসে উঠে বংলছিল, আরে দূর দূর। রাজানা গান্ধী। সেফ, বেনে। একেবারে বেনের বংশ। শুধু লোক ঠকিয়ে কিছু পয়সা করে ফেলে কদ্ধারা খুব লপচপানি দেখিয়েছিল। এখন তো ভাঁড়ে মা ভবানী। তাল পুকুরে ঘটি ডোবে না।’ নিমাই কোনদিন ওই প্রয়াসবচনটা শোনেনি, তাই অবাক হয়ে বলেছিল, ‘পুকুরও আছে তোমাদের?মুগাঙ্ক প্রথমটা বুরুতে পারে নি প্রান্তটা, তারপর প্রবল ভাবে হেসে উঠেছিল, বলেছিল, ‘নাঃ। তুই একেবারে মুগ্ধপোর। তোকে মাহব করতে সময় লাগবে। হবি কিনা ভাই বা কে জানে। তালপুকুরে ঘটি ডোবেনা মানে কি তাও জানিস না?অতঃপর মানেটা বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘এই বাড়ি তিন দফা মর্টগেজ করা আছে বুঝলি? আর সোনা বলতে বাড়িতে কিছু নেই। নেমন্তন্ন যেতে হলে মা কাকিমাদের সেই আফ্রিকালের জড়োয়া গহনা গুলো ছাড়া গতি নেই। খগুলো তো বিক্রী করলে দাম ওঠে না। বাড়ির পিছন দিকে একটা মন্দির আছে দেখেছিস?
পৃষ্ঠা-৪০
দেখিসনি? আছে, ঠাকুরদার বাবার প্রতিষ্ঠিত শিৎ আছে সেখানে। স্নবেলা পুরুত এসে গণ্টা আর টিকি বেড়েও যায় বাধা নিয়মে। কিন্তু কি ভোগ হয় জানিস বিগ্রহের? পোকা ধরা ছোলা ভিজে। কড়ে আঙুলা কলা আর গুণে গুণে পাঁচখানা বাতাসা। ঘেন্না ধরে খেছে বুঝলি? এই রাজগিরির নড়্য আগলে পড়ে থাকায় ঘেন্না বরে গেছে।’নিমাই নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘কি জানি ভাই, আমি তো এলবের একটা কণাও কখনো চোক্ষে দেখিনি। আমার দেখে শুনে রাজাই মনে হঞ্চে তোমাদের।যুগান্ত নিমাইকে ‘তুই’ করে কথা বলে, কিন্তু নিমাই, কিছুতেই পারে না। নিমাইয়ের জিভে বাঁধে।নিমাই এমনিতেই ভীরু, কুঠিত। তার উপর আবার এই ঐশ্বর্যের অভিব্যক্তি দেখে মাথা টাতা ঘুরেই গিয়েছিল তার। ওর ঝাড় লণ্ঠনের একটা নোলকও যদি নিমাই ছেলেবেলার খেলতে পেতো, তাহলে বোধহয় পরীরাজের স্বপ্ন দেখতো।এদের বাড়ির রাস্তাটা প্রায় পটলডাঙ্গার মেদের মতই সলিল গলি। কিন্তু গেটের মধ্যে ঢুকে পড়লে অগাৎ জায়গা। অনেক শরীকের জিনিস বলেই বোধকরি অভোখানি জমি হেলায় ফেলায় পড়ে আছে কলকাতার মতো জায়গায়। টুকরো করে বেচে খেচে টাকা ঘরে তোলবার অধিকার কারো নেই। তাই ‘বাগান’ নামধারী বিরাট অংশটায় শুধু কিছু বড় বড় বিলেতী পান গাছ আর কয়েকটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফুলগাছ ছাড়া মার কিছুই প্রায় নেই। শুকনো খাসের 20 বনের মধ্যে একটি অলশূক্ত ফোয়ারার যে লান্তময়ী, একটি প্রস্তর প্রতিমা শিখিল ভঙ্গীতে বিরাজিত তাকে দেখলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।’ফোয়ারাটায় জল উঠছে না? ছেলেমানুষের বেহদ্দ এই প্রশ্নটি করে। বলেছিল নিমাই,
পৃষ্ঠা ৪১ থেকে ৬০
পৃষ্ঠা-৪১
ফোয়ারায় জলের উৎস মুখটাই যে ভাড়া মরচে গড়া, তা বুঝতে পারেনি।যুগান্ত দার্শনিকের হাসি হেসে বলেছিল, নাঃ, জল আর ভতে জীবে না কোনদিন। সব জল জমে পাথর হয়ে গিয়েছে।নিমাই আর কোন প্রশ্ন করেনি।নিমাই বুঝেছিল এখানে যা কিছু দেখেই প্রশ্ন করবে সে, সেটা বোকার মতই হবে। ও শুধু মুগ্ধ কৌতূহলের সৃষ্টি নিয়ে দেখে বেড়িয়েছিল বাগানটা। বাগানে জল দেবার জন্যে মাঝে মাঝেই জলের কল আছে। সেই কলগুলোর মুখ কি অদ্ভুত বিচিত্র। কোনটায় বাখের মুখ, কোনটায় মাছের মুখ। আশ্চর্য, ফোয়ারার মত সেগুলোও সব জল হারিয়ে শুকনো হয়ে পড়ে আছে।কয়তো ভিতরের নল ক্ষয়ে ক্ষয়ে পঞ্চস্ব পেয়েছে, হয়তো বা নলের মধ্যে হয়য়ের বয়চের জং ধরে গেছে?নিমাইয়ের মনটা হায় হায় করে উঠেছিল। নিমাইয়ের মুখের আমায় আসছিল, এমন সুন্দর জিনিসগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে? সারিয়ে নেওয়া হয় না কেন।কিন্তু নিমাই ওইটুকুর মধ্যেই একটু চালাক হয়ে গিয়েছিল, তাই মুখের কথা মুখের মধ্যেই বন্দী করে রেখেছিল।শূক্ত গোলা, তবু বড় গোলা।মরা হাতি, ত্য লাখ টাকা।কলেজ ফেরৎ ছেলের বৈকালিক জলখাবারের সময় ছেলের বন্ধুরও খাবার এসে হাজির হয়েছিল প্লেটে করে। ধবধবে ময়দার স্কুলকো লুচি, আলুর দম, বেগুনভাজা রসগোল্লা।কুষ্টিত নিমাই আরো কুষ্টিত হয়ে গিয়েছিল তু’গ্রন্থের আবির্ভাবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো, যুগান্ত রেকাবী-বাহী চাকরটিকে নিচু গলায় তীক্ষ্ণ ভৎসনা করলো, সেট পড়া মার্কা এক ঘেয়ে মাল? নতুন
পৃষ্ঠা-৪২
কিছু জোটেনা একদিন। যা, বাড়ির মধ্যে বলগে যা, মিষ্টি-ফিরি যদি থাকে আরো দিতে।মুগাঙ্ক ছেলেমানুষ। তবু মাকে বলগে’, কি ‘ঠাকুরমাকে বলখে’, হালনি, বলেছিল ‘বাড়িতে বলগে’। কিন্তু যুগাঙ্কর অভিযোগ শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিন নিমাই। এই যদি পচামার্কা হয় তবে ভাল বাবার কাকে বলে?চাকরটা বাড়ির মধ্যে গিয়ে আবার একটা বেকারীতে হাটা বস্তু লন্দেণ আর দুটো মর্তমান কলা নিয়ে এসে ধরে দিয়েছিল। পাশে স্বফালি আমের মোরব্বা।’এই তো ছিল তো আরো কিছু-যুগান্ত একটা রেকারী টেনে নিয়ে অপরট। নিমাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘এই নে খা। আমার ঠাকুমাটি বুঝলি ‘কোন নম্বর ওয়ান’।নিমাইয়ের বুকটা গড়াল করে উঠেছিল। নিমাই অবাক হয়ে খিয়েছিল-ঠাকুমাকে’ এভাবে বলা খায়। নিমাই এ সময় কথা না বলে পারেনি। বলেছিল, ‘ঠাকুমাকে তুমি এরকম বলয়ো? ফি।মুগান্ধ অপ্রতিভ হয়নি, শুধু একটু হেসে বলেছিল, ‘তোর সামনে বলাটা উচিত হয়নি বটে। তুই যে একেবারে সোঁদা’।নিমাই জানতো মাটি সোঁফা হয়, মানুষ কোন অর্থে সৌধা হয় তা জানা ছিল না নিমাইয়ের।নিমাই তখন বলেছিস, এতো খেতে পারবো না।’মুগান্ত বলেছিল, ‘অতো অতো বলে লজ্জা দিসনা বাবা, এমনিতেই দেখে রাগ ধরে গেছে আমার। কাটলেট ছাড়া আপ্যায়ণ করা আগে বাইরে কেউ এলে কখনো চণ হতো না। আমার ছেলে-বেলাতেই জেগেছি, লুচি বিলো তো তার সঙ্গে অন্ততঃ কথা মাংস।নিমাই হেসে ফেলে বলেছিল, ‘বা, ও সব জিনিষ তক্ষুণি তজুগি হয় নাকি?’
পৃষ্ঠা-৪৩
‘তক্ষুণি তক্ষুণি হবে কেন? মজুতই থাকতো। নিজেদের যে তর্ক-ঢোচ্চু-লেহ্য-পেয় সবই অবন্ধু প্রয়োজনীয় ছিল। তা ওই খেয়ে খেয়েই ফাঁক করলো লব। এখন কর্তাদের আর খাবারও হিম্মত নেই, কারো ডায়াবিটিস্, কারো ডিস্পেপাসিয়া, কারো হাইপ্রেসার। ইতিহাসের লেখা। প্রকৃতির প্রতিশোধ।এই ধরণেরই কথা মুগান্তর। কখনো ছ্যাবলা গলায়, কখনো দার্শনিকের গলায়। নিমাইয়ে একটা তীব্র আকর্ষণ জন্মে দিয়েছে। নিমাই-এর আগে এরকম কথাই কখনো শোনে নি।তা নিমাইয়ে কথা যেন বোঝা গেল। মৃগাঙ্ককে দেখে ওর অপরিণত অজ্ঞ চোখে মায়ার ঘোর লেগেছে। কিন্তু মুদা মুগাস্ক কেন এই নিরীহ আর শিশুর মতো সরল ছেলেটার সঙ্গে ভাব করতে এলো?ঠাঁই, ভাব করতে যুগান্তই এসেছিল।কেন এসেছিল তা সে নিজেও জানে না। নিমাইয়ের রূপে আড়ই হয়ে। নাকি ওর ওই নিরীহ ভঙ্গী দেখে ক্ষ্যাপাবার ইচ্ছেয়?হয়তো তা নয়।হয়তো মমতাতেই।জবে অল্প ছেলেরা বলে ‘স্মৃতিতে দুতিতে গাঁটছড়া।ক্লাপে একমাত্র মুগাঙ্কই খুতি পরে আসতো।লম্বা কোঁচা, শান্তিপুরে বুদ্ধি, ডিকনের কাজ করা মিহি আন্দির পাঞ্জাবী, সেপ্টের গন্ধে অমোদিত রুমাল-এই সব হচ্ছে মুগাঙ্কর যাজ। ছেলেরা ওর সম্পর্কে বলতো, ‘জামইবাবু’, ‘পুষ্টি পুজুর’ ইআদি।আর সকলেই হাওয়াই শার্ট, ট্রাউজার, নচেৎ শার্ট-পায়জামা পরে আসে।নিমাইও এলো ধুতি পরে। যদিও সে ধূতি মুগান্তর ধুতির সমগোত্র নয়, তবু নামটা তো
পৃষ্ঠা-৪৪
এক। অতএব খাটো বহরের মিলের দুতির সঙ্গে ছিটের শাট পরে এসে অন্ত সবাইয়ের কাজে স্বান্তকর হলেও, হয়তো সত্যিই যুগান্ত ওই জয়েই তাকে ডেকে কথা করেছিল। অথবা হয়তো সেসব কিছুই নয়, এমনিই।মোট কথা, প্রথমেই মুগান্তই বলেছিল, তুমি এতোদিন পরে এলে? ক্লাশ আরম্ভ হয়ে গেছে।”আপনি’ বলেনি, ‘তুমি’ বলেছিল।নিমাই আস্তে বালছিল, ‘আমি গ্রামে ছিলাম।উত্তরটা অবন্ত প্রাঞ্জল নয়। গ্রামে থাকলে যে যথাসময়ে আসা যায় না, এর কোনো যুক্তি নেই। তবে সে প্রশ্ন করেনি। মুগাঙ্ক মুচকি হেসে বলেছিল, ‘গ্রাম থেকে এসেছো’ সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তা’ কোন জেলা? আর উত্তর শুনে বলেছিল, ‘শান্তিনিকেতনে পড়লে না কেন?’নিমাই মাথা হেঁট করে বলেছিল, ‘কলকাতার আসবার ইচ্ছে হলো।”ছ। সেটা আগেই বুঝেছি ‘দুগান্ত আবার হেসে বলেছিল, কলকাতাই হতভাগ্য গ্রাম গুলোর যাগ্য খেয়েছে। তা অমন ক’নেবৌয়ের হতো লজ্জা কেন? কলেজে পড়তে এসেছো, লজ্জা করলে লোকে হাসবে না।’ব্যঙ্গ, তবু তার মধ্যে যেন কোথায় একটু সহৃদয়তার আধ জড়িত ছিল, নিমাই কুতর্থমন্ডের দৃষ্টিতে তাকিরে একটু হেসেছিল।ঘৃণাঙ্ক বলেছিল, ‘ও বাবা’ এ যে আরো বেশী হলো। একেবারে শুভদৃষ্টির চাউনি। ছেলেগুলো তোমায় গেয়ে ফেলবে। বেটাছেলের এতো লজ্জা কিসের? নাঃ তোমায় মান্নষ করতে হবে।সেই হয়ে গেল বস্তুস্ব। নিমাইয়ের মনে হলো, একটা, অভিজ্ঞ মাহব, একটা সবল হাত, তার দায়িত্ব নিলো।
পৃষ্ঠা-৪৫
নিমাই যুগান্তর বীভূত হ’য়ে গেল।মৃগাঙ্কও কেন কে জানে, ওই বোঝা লাজুক ছেলেটাকে একটু নেতৃনজরে দেখতে শুরু করলো। ক’দিনেয় আলাপেই ওকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেল।নিমাই তো বশীভূত হয়েই গিয়েছিল, আরো মোয়িত হলো যুগান্তর বাড়ি দেখে। এটা তার কল্পনার বাইরে ছিল।শুধু যে বৃহতের মহিমায় মোহিত হয়েছিল নিমাই, তা নয়। ওই জরাগ্রস্ত বৃহৎ প্রাসাদের মধ্যে থেকে কোথায় যেন নিমাই তার সেই ফেলে আসা আমের আত্মার হাহাকার শুনতে পেয়েছিল।কথাটা বলতে গেলে হয়তো হান্ডকর রকমের অদ্ভুত লাগতে পারে, তবু ওটা মনে হতো নিমায়ের।নিমাই মাঝে মাঝেই যেতে থাকলো মুগাত্মর বাড়ি। কিন্তু মুগান্ধর কথাবার্তা কি সর্বদাই খুব ভালো লাগতো নিম্নাইয়ের। বৃথাক্ষর এই গুরুজন সম্পর্কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাগ, জগতের সব কিছুতেই অঙ্গন্ধের উক্তি, জগবানকে নস্তাৎ করা, ইত্যাদি নিমাইকে লীড়িত করতো, উত্তেজিত করতো, ভর্ত করতো, তবু যুগাঙ্ককে ডালে। না বেসেও যেন পারতো না নিমাই। হয়তো নিজে সহ বলেই ওই প্রাবলোর প্রতি আকর্ষণ ওর।কিন্তু খুব বেশীদিন মুগান্তর সঙ্গে খনিষ্ঠতা রইল না। প্রথমে তার বাড়ি যাওয়াটা বন্ধ করতে হলো, তারপর তার সঙ্গে মেশাটা।কারণ অবশ্বই ছিল একটা, কিন্তু সেটা নিমাইরের কাছে যতটা ‘ভয়ঙ্করী যুক্তিতে’ দেখা দিয়েছিল, (আর পাঁচটা সাধারণ-বুদ্ধি ছেলের কাছে হয়তো ততোটা হতো না।প্রথমটা হচ্ছে মান অপমানের প্রশ্ন।মুগান্তর বাড়িটা যেন নিমাইকে অনবরত অদৃক্ষ আকর্ষণে টানতো, তাই গ্রাই প্রায়ই ওদের বাড়িতে দিয়ে হাজির হতো নিমাই কলেজের শেষে। যুগান্তও পরম আগ্রহে ডেকে নিয়ে যেতো। কথাও বলতে।
পৃষ্ঠা-৪৬
খুব। মৃগাঙ্কের সে সব কথার মধ্যে রাজনীতি টিতি ছিল না, ছিল শুধু ওর নিজের বাড়ী সম্পর্কে অপরিসীম একটা ঘৃণা আর পৃথিবীর অন্ত সব দেশের সমাজের কথা। যখন তখনই তাই বলতো ও, ‘দূর’ সব ছেড়ে মুড়ে দিয়ে চলে যাবো এক দিন।এই বাড়িটা ছেড়ে যে কেউ চলে যেতে চাইতে পারে এটা নিমাই। ভাবতেই পারতো না, তাই বলতো, ‘যেৎ।’দুগান্ত বলতো, দেখিস। জন্মাবধি শুধু নোংরামী নীচতা আর স্বরতা দেখে দেখে হাড় জ্বলে গেল। অথচ আবার কি জানিস, রক্তের ঋণ দাবী জানায়, বনে হয় এক এক সময় ভায় যাতেই আত্ম-সমর্পণ করে বসতে হবে বুঝি। হাঁ করে চেয়ে রইলি যে? মানে বুঝতে পারলি না বুঝি? শোন তবে, এই আমাদের বংশে সাত পুরুষ হয়ে একটি ট্রাডিশান চলে আসছে বুঝলি? সেটি হচ্ছে মদ খাওায়ার ট্রাডিশান। সাভাড়া মারো আছে। টাকা থাকার অভিশাপ আর কি। দেখে দেখে ঘৃণা আসে, কিন্তু গায়ের মধ্যে তো নেই বংশের রক্ত? তা’কে আমি দাবাবো, না সে আমায় দাবাবে, এখন বুঝে উঠতে পারি না। মাঝে মাঝেই ভয় হয় এই পরিবেশটা থেকে চলে যেতে পারলে-”তা’ ররুটা তো ফেলে যেতে পারবে না।’ বলে হাসতো নিমাই। মুগান্ত বলতো, সেই তো নিরুপায়তা। এক এক সময় মনে হয় ভাক্তারী প্রক্রিয়ায় বদি সব রক্ত পাম্প করে বাদ দিয়ে ফেলে নতুন কোন রক্ত, কেনা রক্ত দেহে ভরতে পারতাম, হয়তো বেঁচে যেতাম।”‘তোমার যত উদ্ভট কল্পনা।’হাসতো নিমাই।যুগান্ত বলতো, ‘মরে পড়ে আছি যে, তাই বাঁচার কল্পনা।’ তা নিমাইও একদিন ওই বাড়ির ক্ষুদ্রতার পরিচয় পেয়ে মরমে
পৃষ্ঠা-৪৭
কলেজ ফেরৎ আসতো নিমাই, এবং যথারীতি হু’জনেরই জল খাবার আসতো বাইরের ঘরে, এবং নিমাই যতোই ‘না না, করুক খেতেই হতো মুগাল্পর অনুরোধে।সহসা একদিন ঘটলো বিপর্যয়।মুগাঙ্ক বললো, ‘তুই বোস আমি একটু চান করে আসি, বড় গরম লাগছে।চলে গেল মুগান্ত, নিমাই হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগল স্বরের সীলিংটা কী উচু, আর সেই উচুতে রঙ্গিন বর্ডারে কতো কারুকার্য।এই সময় কানের পাশে বাজ পড়লো।কর্তণ একটা কণ্ঠ দরজার ওপাশে কোথায় যেন বেজে উঠলো ‘ছোড়াটা কে বে গোকুল। নিত্য নিত্য আসে ঠিক খাবার সমরটিতে। খাওয়া দেখে তো মনে হয় সাতজন্মে এসং চোখেও দেখেনি। যুগল্পটাও যেমন, যতো রাজ্যের হা-থরের ছেলের সঙ্গে ভাব গাফ্ থাক্, ওকে আর দুটো রাজজোগ দিতে হবে না, স্কুলে মে বাজ থেমে গেল।।কিন্তু নিমাইয়ের মনে হলো, সেটা যেন লক্ষ লক্ষ হয়ে বেজেই চলেছে তার কানের পর্দা দুটো ফুটো করে ফেলার উদ্দেচ্ছে।নিমাই কি ছুটে পালিয়ে যাবে?মুখাঙ্ক এসে পড়বার আগেই।কিন্তু কি করে যাবে?নিম্নাইয়ের কী নড়বার ক্ষমতা আছে? নিমাইয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। লবস্ত রোমকূপ বিয়ে যেন একটা দাহ বেরোতে থাকে। চোখের সামনের দৃশ্যগুলো সব একাকার হয়ে ঝাপসা হয়ে যায়। নিমাই সেই অবস্থায় বসে থাকে।একটু পরে যুগান্ত ফেরে, ছেলে ছেলে বলে, ‘খুব দেরি করে
পৃষ্ঠা-৪৮
ফেললাম না? যা গরম, জল ঢালছি তো ঢালছিই। কী রাগ হয়ে গেছে না কি।নিমাই যেন মানুষের গলার সাড়া পেয়ে তবে দাঁড়াবার পক্তি খুঁজে পায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি যাই।”ওকী। যাবি মানে?’ যুগান্ত অবাক হয়। সত্যি রাগ নাকি?’রাগ কিসের?’ বলে নিমাই গুলে যেতে উদ্যত হয়।মুখাঙ্ক বলে ওঠে, ‘কিসের তা জানিনা, তরু করেছে তাতে সন্দেহ নাস্তি। বল বাব্য কী করেছি, প্রায়শ্চিত্ত করি। শুধু ওইটুকু দেবীর ‘আমার শরীর খারাপ লাগছে।”শরীর খারাপ লাগছে।’ তাই বল। ডা লাগতেই পাবে।আমার তো মনে হচ্ছিল চান না কর, তুই ও একটু চান করে নে। গেস্টরুম আছে, এটাচড বাথ আছে- করে মারা যাবো। এক কাজ এই পাশেই আমাদের একটা ‘না আমি যাবো”সেয়েছে। হলো কি তোর? তা অন্ততঃ একটু কিছু খাবি দো? কলেজ থেকে এলি?নিমাইয়ের গলা বৃদ্ধে আসছিল, আর চোখে জল আসছিল, তবু নিমাই মুখ ফিরিয়ে বললো, ‘আমি তোমাদের বাড়ি খেতে আসি না যুগান্ত। আমি গরীব বটে। তবে।আর কিছু বলতে পারেনি।চলে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি।মুখ্যঙ্ক কিছুক্ষণ গুম হয়ে বলেছিল। আর যখন গোকুল খাবারের রেকাবী হটো নিয়ে ঘরে ঢুকছিল, তখন ছিটকে উঠে বলেছিল, ‘খাবো না। নিয়ে যা, বা বলছি।’বলা বাহুল্য গোকুল আজ্ঞাপালন করেনি, দাঁড়িয়েই থেকেছে
পৃষ্ঠা-৪৯
এবং মৃগাঙ্ক যখন তেড়ে উঠে বলেছে, ‘তরু দাঁড়িয়ে বইল? যা বলছি -‘তখন বিনীত নিবেদনে জানিয়েছে দাদাবাবু অনর্থক তার ওপর রাগ করে কি করবে, স্বয়ং ঠাকুমা নিজে ছটো রাজভোগ থেকে একটা ভুলিয়ে দিয়েছেন।গোকুল হয়তো ভেবেছিল মিল্লাতের আউজিই মুগান্তর ক্রোধেরমৃগায় কিন্তু এ কথায় চমকে ওঠে। রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ‘কি করেছে ঠাকুমা।গোকুল বড়লোকের বাড়ীর চাকর, এর কথা এর কাছে লাগিয়ে দেওয়াই তার পেশা। আর এর থেকেই সে লাসারে বিশেষ প্রতিষ্ঠিত, এর থেকেই তার উপরি আয়। তাই সে গলা নামিয়ে বলে, ‘এই তো যা বললাম। যা প্রকৃতি তাই করেছে। খালা থেকে রাজভোগ ভুলিয়ে রাখায় হুকুম দিয়ে বললো, ‘কোথা থেকে একটা হা-ঘরের ছেলে এসে ফুটেছে, রোজ এসে খাচ্ছে খোকার যতো ভিখিরির সঙ্গে ডাব, এই সং আর স্কি।”না-তো কি বলছি দাদাবাবু।’যুগান্ত আর একবার ছিটকে উঠে হলে, ‘কখন বসলো। কোথায় বললো।”এই তো এখন। এই দরজার আড়ালে’চেঁচিয়ে বলেছিল?”তা আর বলতে। আপনার বন্ধুর কান ফুটো হয়ে বাকি শুধু।একতণ্ডা ছবিতে বহুবর্ণ লেপন করতে পারে গোকুল, এক টাকাকে আঠারো আনা করতে পারে।যুগান্ত বললো, বুঝেছি।তারপর স্বণাক্ষ ওর হাত থেকে খাবারের বেকারী হুটো এক
পৃষ্ঠা-৫০
এক করে নিয়ে সবসুদ্ধ ছুঁড়ে বারান্দা পার ক’রে রাগানে ফেলে দিল।হ্যাঁ, এ সাহস তার আছে।কারণ সে পুরুষ।এই মানী ধাড়ির বংশধর।এদের এলব দেখার অহরহ অভ্যাস আছে। এদের বাড়ীতে ছেলে যেই ঘোল পার হয়, সেই তাকে কর্তারা পর্যন্ত সমীহ করে চলেন। অতএব গিন্নীরা এবং চাকর বাকররা। বেটাছেলে মেজাজ দেখাবে এ তো স্বাভাবিক।’একদিন নিমাই পাশ কাটালো। যুগাঙ্কও উদাসীন থাকলো। কিন্তু মুগাল্পর মুখ বিবদ্ধ। নিমাইয়ের ভাখ হয়, অথচ নিমাই এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারে না। অবশেরে একদিন মুগান্তই এগিয়ে এলো। বললো, ‘আমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করবি ঠিক করেছিস্?”বাঃ তা কেন? সেদিন শরীরটা খারাপ ছিল তাই-”বাজে কথা থামা’! মুগার ক্রুদ্ধ গলার বলে, তুই ছেলেটা খাঁটি বলেই তোকে ভালবাসি, মিথ্যেকথা বলিসনি। মোটেই সেদিন তোর শরীর খারাপ হয়নি, হয়েছিল মন খারাপ। আমি সব শুনেছি। যাক দেখলি তো, কেন আমার গুরুজনে শ্রদ্ধা নেই, বাড়ির প্রতি ভালবাসা নেই। ওই ওরাই হচ্ছেন আমার নিমাই জাগা হেঁট করে।যুগান্ত বলে, ‘আমার নিজের প্রতি ঘৃণায় কারো সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করে না, শুধু তুই গ্রামের ছেলে, সরল ছেলে বলেই নাঃ গ্রাম থেকে চলে এসে তুই ভালো করিসনি।’নিমাই এযায় মুখ স্কুলে একটু হেসে বলে, ‘তোমার বুঝি ধারণা গ্রামের লোক সবাই দেবতা?’
পৃষ্ঠা-৫১
‘কি জানি। হয়তো নয়’ যুগাঙ্ক অজননক্ষের মতো বলে, পল্লীসমাজও তো পড়েছি। তবু মনে হয় মাঠে ঘাটে খোলা হাওয়ায় পাপের কাদা কিছুটা ধুয়ে যায়, ঝরে যায়।’আবার চললো মেশামেশি। কিন্তু যুগান্তর বাড়িতে নয়। মুগাঙ্ক নিজেই বললো, ‘নাঃ বাড়িতে আর যেতে বলবো না তোকে।’যেতো এখানে সেখানে, ষয়তো রেস্টুরেন্টে।কিন্তু একদিন আবার ঘটলো আর এক দুঃখবহ ঘটনা।স্বণাঙ্ক একদিন ওকে টেনে নিয়ে গেল বোটানিক্যাল গার্ডেনে। আর যুদ্ধ বিমোহিত নিমাই যখন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বলে ফেলেছে, একটু বসলে হয় না।’তখন দ্বথাত হেসে বলেছে, ‘কি, টায়ার্ড’ লাগছে? আয় ভার ওযুন দিই।’ব্যাগ থেকে বার করেছিল ফ্রাঙ্ক।’বুঝতে পারছিব না?’ মৃগাঙ্ক হেসে উঠেছিল, ‘সোমরস।”তার মানে?”তার মানেও জানিস না? উঃ। এখনো কাঁথার গুরে চুষি খেলেই ভালো হতো তোর। বিশুদ্ধ বাংলায় বলা যায় পুরা।’এ।’ তার মানে মদ। মদ খাবে তুমি?”আমি একা কেন, আমরা। একে মদ বলে না বাবা, স্রেফ এনাজির ওষুধ।’বলে ফ্লাস্কের মুখ খুলতে থাকে যুগান্ত।নিমাই একটু সরে বসে অগ্নিবৃষ্টিতে বলে, ‘তুমি না মদকে খুব ঘৃণা করতে?’করতাম। এখনো করি। তবু রক্তের ঋণ শোধ না দিয়ে উপায় নেই রে। ঘৃণা করি তবু প্রতি নিয়ত মনে হয় একটু খেয়ে
পৃষ্ঠা-৫২
যেখি। তা না আমার সহায় হয়েছে, যাবার আলমারি থেকে একটু’তোমার মা? নিজের মা।”তাই তো জানি।’ মুগাঙ্ক মৃদু হাসে, ‘ছেলেটাকে হাতের মুঠোয় ধররার জন্ত এই শোচনীয় চেষ্টা। বোধহয় ভাষে এড করে আমি লম্বত যাঃ অনুগত থাকবো। আমাদের বাড়িতে ছেলেরা বড় হলে তো আর মাকে পৌঁছে না।’নিমাই দাঁড়িয়ে উঠে বলে, ‘তুমি খাও, আমি চলে যাবো’।’আহা সে তো যাবিই। একদিন মজা করে একটু খাৰি বৈতো নয়? এতে কিন্তু আর তুই মাতাল হয়ে যাবি না। তোর কিনকুলে কেউ নেই যে স্থাগ পাবে। আর তোর রক্তেও বিষ নেই সে সেই বিব তোকে রোজ ঠেলা মারবে। স্রেফ মজা।”আমার এসব মজ্য ভালো লাগে না।”খেয়েই দেখ। দেখবি খুব স্মৃতি লাগবে।”তুমি আমায় খারাপ করবার চেষ্টাতেই মিশেছো।’ক্রুদ্ধ গলায় বলে বলেছিল নিমাই।যুগান্তও হঠাৎ চড়ে উঠেছিল।কড়া গলায় বলেছিল, ‘খঃ তাই নাকি? তাই ভেবে বসে আছিস।তোর মত একাটা মশা মাছিকে খারাপ করেই বা আমার কী গৌরব বাড়বে রে? জন্মে একবার একটু খাঁটি বিলিতি চোখে দেখডিস, তা কপালে নেই। যা চলে যা, নিজে নিজেই চলে যা। খোকা তো নয়? আমি এখানে থাকবো, মদ খাবো, বাগানের মধ্যে মাতলামী করবো, দেখবো মজাটা কি। ব্যাস বা চলে যা।বিহাই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল।এখান থেকে বেরিয়ে নিজে চেষ্টা করে ফেরার করা অসল্পন মনে হয়েছিল, তবু চলে এসেছিল।পরদিন দেখলো মুখান্ত কলেজে এলো না। পরদিনও না। হুদিত
পৃষ্ঠা-৫৩
ছুটি গেল মাঝে, তারপর যখন কলেজে এলো, ওর ভাবভঙ্গী দেখে বনে হলো জীবনেও চেনে না নিমাইকে। নিমাইয়ের এমন সাহস হল না যে এগিয়ে যায়।তা ছাড়া দিয়ে করবেই বা কী?ক্ষমা চাইবে?সহপদেশ দিতে বাবে?না কি তার দলে ভিষ্কৃতে বসবে?নাঃ কিছুই করা যায় না।কলেজের মধ্যে একেবারে একা হয়ে গেল নিমাই।কতকগুলো দিনের কন্দ্রে যে স্বর্গলাভ হয়েছিল তার, তার আম্মার থেকে আবার এই কস সে।আবার সেই বিছানা, আবার সেই ট্রাস্ক, আবার সেই গলির মোড়ে রিকশা।এবার দেশের ঠাকুর বয়ে দিয়ে গেল।সঙ্গে চললেন বিনোদবাবু।মেসের সকলেই একত্রার জ’রে বিনোদবাবুজে ঘোষারোপ করতে লাগলেন সীতেশবাবুর অনুপস্থিতে জাঁর ডান্তেকে মেস থেকে ভাঙ্গিয়ে নিয়ে যাওয়ায়, বাদে নয়নবাবু, আর ম্যানেজার।কার কাছে বিনোদবাবু কী কলকাঠি নাড়লেন কে জানে, আর নয়নবাবুর সঙ্গে তো বন্ধুত্ব চলছে।দেখা গেল মেস এর সবাই নিমাইকে ভালবেসে ফেলেছেন। তাই বাবার নামে কনে ঋনে দেখা করেন এবং সঙ্গপদেশ দেন।এমন কি কাংসকী সুখদা বরধী গলায় বলে, ‘আহা মা-বাপ হারা ছেলেটা ছিল। আবার কোথায় ভাসতে গেল। ছেলে তো নয়, সোনার চাষ।অতঃপর এই হলো-
পৃষ্ঠা-৫৪
যে গলির গণ্ডী থেকে বেরিয়ে পড়বার জন্ডে ছটফট করছিল নিমাই সেই গলি পার হবার সময় বারবার তার চোখটা ভিজে উঠতে নিমাইয়ের মনের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে দিয়েছে, পটল- ভাঙ্গার মেন এই ক’মাসেই তাকে অনেক পরিণত করে স্কুলেছে, মুখের এই নিতান্ত কমনীয় এটুকুর অনেকধানিকটাই হয়তো কেড়ে নিয়েছে, তবু গৃহকর্তা নিমাইকে যেখে অবাক হয়ে বলেন, ‘এই মাষ্টার? এ যে নেয়াত ছেলেমানুষ।’বিনোদবাবু সশব্দ ঘোষণায় প্রতিবাদ জানান, ‘কেন আমি তো বলেই ছিলাম ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। তার বয়েস কি তিরিশ হবে?”তা নয়-কার্তা মলয়বাবু বলেন, ‘ভেবেছিলাম গ্রামের ছেলে, হয়তো একটা পাশ করতেই বিশ বছর বয়েস হয়ে গেছে।চমৎকার। যে ছেলের একটা পাশ করতে বিশবন্ধুর লাগে, তাকে আপনি ছেলের শিক্ষক রাখতে চান মলয়বাবু।’চোস্ত কথা শুনিয়ে দেবার চমৎকার একটি ক্ষমতা বিনোদবায়ুর আছে।মলয়বাবু লজ্জিত গলায় বলেন, ‘তা, ঠিক নয়, মানে-‘বিনোদবাবু মনে মনে বলেন, মানে আমি খুব বুঝেছি। ভেবেছিলেন কালোকোলো গাঁঠা গোঁট্টা একটা গাঁইয়া ছেলেপাবো, মাষ্টারকে মাষ্টার -চাকরকে চাকর হবে, পয়সা উসুল হয়ে যাবে। এই সোনার কাক্তি- চিগুঁকে দেখে মনটা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। চাকরের কাজটা করাতে সমীহ আসবে ভেবে ভাল লাগছে না।মুখে বলেন, ‘মাদের আর কিছু নয়। ছেলে তো আপনার বললেন ক্লাস খির। তাও যদি পড়াতে না পারে, রাখবেন কেন? তবে আমার মনে হয় রেখে দেখলে ঠকছেন না।’মলয়বাবু আরও কি বলতেন কে জানে, সহসা মলয়বাবুর কর্তার পোষ্টটা খতম হয়ে গেল। মঞ্চে প্রবেশ করলেন গৃহিনী।
পৃষ্ঠা-৫৫
খয়ের ভিতর থেকে নয়-বাড়ির বাইরে থেকে।সকক্ষা মার্কেটিতে দিয়েছিলেন।প্রবেশপথের মুখেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখলেন কোন একটি নাটক সুরু হয়ে গেছে।বলে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার? বিনোদবাবু যে।”এই যে এই সেই ছেলেই- ‘মলয়বাবু ভাড়াতাড়ি বলেন, বিনোদ বাবু যার কথা বলেছিলেন খোকাকে পড়ানোর লক্ষে।’আই সি।’মায়ের আগে মেয়ে হেসে ওঠে, ‘মাষ্টার মশাই, ভরে বাবা। দেখেনিমাই তাকিয়ে দেখে।কলকাতায় এলে বাঙালী মেয়েদের অঙ্গে এই পোষাক দেখছে সে। পাঞ্জাবী মেয়েদের সাজ। সালোয়ার পাঞ্জাবী ওড়না। নামটা শিখেছে নিমাই জামার দোকানের বিজ্ঞাপনে, বাক্সের গায়ের ছবিতে।মেয়েটার গায়ে সেই সাজ, তার সঙ্গে বাচালের মত হি ফি হাসি।মেস-এর তিন ভাঁজ গলি পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়লেই যেখানে সেখানে এই দৃপ্ত দেখেছে নিমাই। গলায় ঝোলানো ওই ওড়নাটাকে আর মাম্বার বেনীছুটোকে লটপটিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হি হি করছে বুড়োবাড়ী মেয়েরা। হাসছে, ঘুগনি-যুক্তকা কিনে খাচ্ছে, মনেও হয় না মেয়েমানুষকিন্তু এই মেয়েটা?কম করেও পনেরো গোলেই বয়েল হবে যার, সে তায় যাবা মার সামনে, বাইবের হটো ভদ্রলোকের সামনে এই রকম বাচালতা করছে।
পৃষ্ঠা-৫৬
কলকাতার অনেক বৃক্তই তার অদ্ভুত লাগে। কিন্তু ঠিক এ রকম। বিরক্তিকর লাগে না। আজ লাগলো।আজ নিমাইয়ের মনে হলো, এই বাড়িতে থাকলে তো এই মেয়ে টাকে সর্বদা দেখতে হবে?মলয়বাবুর গৃহিনী মেয়েকে একটু শৌখিন বমন্ত দিয়ে বলেন, মাষ্টার মশাই বলে এতো হাসির কি আছে, উনি তো আর তোমায় পড়াতে আসছেন না। খোকাকে।”ও মাই গড়। মেয়েটা জুতোর গোড়ালিতে ভর দিয়ে এক পাক নেচে নিয়ে বলে, ‘তবু ভাল। আমি ভাবলাম বুঝি আমার জন্তেই। মা আমাকে কেবলই ভয় দেখায় কিনা বাপী বাঘা একটা সাধার এনে দেবে তোর করে।’একে দেখে কি তোমার খুব যামা মনে হলো মা লক্ষী।’বিনোদবাবু বলে ওঠেন, তোমার সঙ্গে কোনো সম্পর্কী থাকবে না। তোমার ছোট ভাই পড়বে। ‘ভাল ভাল।’মেয়েটা চলে যায় হাসির লভর স্কুলে।গিরী গিন্নীর গলায় বলেন, ‘ইনি আজ থেকেই থাকবেন বিনোদবাবু, এর জিনিসপত্র ঘরে ভুলিয়ে নিচ্ছি।চাকরকে ডেকে আদেশ দেন।চাকর এসে মালপত্রের নমুনা দর্শনে মুচকি একটু হেসে বলে,গৃহিণীরও অবশ্য সে দিকে তাকাতেই লজ্জা করছিল, তবু কড়া গলায় বলেন, ‘সে কথাটা বলে দিতে হবে? একটু বৃদ্ধি খরচ করতে পার না? যাও স্টোররুদের এক পাশে রাখোগে।’বিনোদবাবু নিশ্চিন্ত চিত্তে চলে যান। সীতেপবাবু চলে যাওয়ায় পর থেকে ছেলেটার দায়িত্ব নেওয়ার ফলে মায়া পড়ে গেছে।
পৃষ্ঠা-৫৭
আশ্চর্য। নিজের মায়ার জিনিসগুলোর গোজ রাখিনা, অযথা পরের জিনিসে মায়া।বিনোদবাবু দ্রুতগতিতে এগিয়ে যান।নিমাই এ বাড়িতে থেকে যায় ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’-এর মতো।কিন্তু এবাড়িতেই কি থাকতে পারবে নিমাই। নিমাইয়ের যেন গা জম জম করছে।মেস থেকে অব্য চারদিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, চকচকে রকঝকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিজের সব কিছু বেমানান লাগছে।যেটা বিনোদবাবুদের মেসে কোনদিন হয়নি।এদের ধরে নিজের ট্রাঙ্কটা কী শ্রীহীন বিবর্ণ লাগছে। এদের স্বরে নিজের পুরাণো শতরঞ্চ জড়ানো বিছানাটা কী কুদৃপ্ত মনে হচ্ছে।নিজের জুতোটা কোনখানে লুকিয়ে রাখবে ভেবে পাচ্ছে না।এখানেও সেই বোকার মতই বসে থাকে নিমাই বিনোদবাবু চলে ভাষার পর।এই স্কারের ট্রাষ্ম? ছিতিছিঃসেই কাড় এগানো মেয়েটা এসে দাঁড়ায় বেণী লটলট করতে করতে।কবে কিনেছিলেন। লর্ড ক্লাইভের আমলে?নিদাইয়ের আপাদমস্তক ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।নিমাই ঠিক করে-ও বাড়িতে কখনই নয়। এই বাচালমেয়েটাকে সহ্য করা অসম্ভব।তাই নিমাই আর রেখে ঢেকে কথা কয় না। আরক্ত মুখে বলে, আমি আপনাদের মতো বড়লোক নই।বড়লোক হায় ভাগ্য। মেয়েটা অদ্ভুত একটা জঙ্গী করে বলে, ‘আমরা বড়লোক ? দেনার দায়ে বাবার ‘মাখা বারাল। মা জামা
পৃষ্ঠা-৫৮
সেলাই করে দোকানে বেচে আসে। আর পয়সার অভাবে আমার একটা মারারই রাখা হয় না।মেয়েটা হাত তুটো উল্টোয় হতাশার ভঙ্গীতে।নিমাইয়ের অবস্ত কথাগুলো আদৌ বিশ্বাস হয় না। এই বাচাল মেয়েটা নিশ্চয়ই সব বানিয়ে বসছে। এমন স্বকপ্তকে ঘরবাড়ি, এমন ভাল খাট-বিছানা আলমারি, জানালা-দরজায় এখন সুন্দর সুন্দর পর্দা, আর এরা বড়লোক নয়?মেয়েটা বলে, ‘যাই বলুন, ট্রাকটা আপনাকে ববসাতে হবে। আর আপনার সাজটাও। এঘুমে এই ধুতি শার্ট। অচল।নিমাই এই বয়সের একটা মেয়ের কাছে অপদস্থ হয়ে ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘ভয় নেই, আমি আপনাদের এই শৌখিন বাড়িতে থাকছি না। আমার কিছু বদলাবার দরকার নেই।’এমা। আপনি চটে যাচ্ছেন’।মেয়েটি হি হি করে হেসে বলে, ‘পালাই বাবা। ভয় করছে।’ দিমাই অবাক হয়ে ভাবে, মেয়েটা কি পাগল?নিমাই দেখলো একা মেয়েটাই নয়, মেয়ের সাও পাগল।নইলে তৎক্ষণাৎই তিনি ছেলের মাষ্টারকে ‘সভ্য করার অন্তে উঠে পড়ে লাগেন।দেখুন কিছু মনে করবেন না, আপনার ওই ট্রাঙ্কটা বাতিগ করতে হবে। এই সুটকেসটা নিন, এতেই আপনার কাপড়-জামা রাখবেন।এটা ঘরে ছিল, এখন কাজ চলুক। পরে নতুন কিনলেই কবে। শুনুন, কিন্তু মনে করবেন না-আপনার ওই বিছানাটা আর খুলবেন না। কিছু মনে করবেন না-ওটা দেখে আমার চাকর হাসছিস। কলকাতার চাকর ভয়ানক সব ‘বাবু’ তো। আপনার ঘর, বিছানা সবই আমি ঠিক করে দিচ্ছি-লজ্জার নিমাইয়ের কান বা স্বা করে ওঠে। নিমাইয়ের মনের সামনে ভেসে ওঠে তার বিছানাটা। ঠাকুমার হাতে সেলাই করা
পৃষ্ঠা-৫৯
ফুল-লতা কাটা বড় কাঁথা, ঠাকুমার হাতে তৈরী পদ্মফুল আঁকা বালিশ ঢাকা। নিজে হাতে কেচে ফরসা করে আনা চাদর-মশারি।এক্ষুনি চলে যেতে ইচ্ছে হলো নিমাইয়ের, কিন্তু যাওয়া মানেই তো সেই বিনোদবাবুর মেস। আর ইতিমধ্যে সীতেশ মামাও এসে গেছে কি না কে জানে। তাছাড়া টাকার ঘরও তো শূক্ত হয়ে এসেছে।নিমাই তাই শুধু যাবা নীচু করে বলে, ‘আমায়’ ‘আপনি’ বলছেন কেন? আপনি কতো বাড়া।”তা হোক ‘আপনি’ না বললে, ‘মাষ্টারমশাই মাষ্টারমশাই’ ভাষ আসে না।’নিমাই ওই মহিলার কণ্ঠে তাঁর মেয়ের চাপল্যের আভাস পায়।নিবাই তাই সাহস করে বলে ফেলে, বাঃ আমি তো আপনার মাষ্টারমশাই নই।মহিলাটি ললিত ভঙ্গীতে হেসে ওঠেন, ‘ভবিঘ্নতে হতেও পারেন।’কিন্তু আমার আসল ছাত্রটি কই?”সে তার পিসির বাড়ি গেছে। কাল আসবে। ভালই হয়েছে ইতিমধ্যে আপনি একটু ঢোক গিলে আবার বলেন, ‘মানে ইতিমধ্যে আপনি বেশ ‘মাষ্টারমশাই মাষ্টারমশাই’ বনে যান। কাল সকালে আমার সঙ্গে দোকানে চলুন। উপযুক্ত কিন্তু পোষাক দরকার তো? এযুগে আপনার বয়সের ইয়া ছেলে কখনো বৃষ্টি টুইলশার্ট পরে? পায়জামা আর পাঞ্জাবী পরবেন।সেই একই কথা।নিমাইকে তাহলে এদের দৃপ্তশূল লাগছে।নিমাই আর কত চুপ করে থাকবে?নিমাই ফস্ করে বলে বসে, ‘এটা আপনায় দেয়ে বলেছেন বুঝি?
পৃষ্ঠা-৬০
‘আমার মেয়ে?’মহিলাটি ভুরু কুচকে বলেন, ‘কী বলেছে আমায় মেয়ে।”বলেছিলেন যে এই পোষাক বা ট্রাঙ্ক চলবে না-মহিলা হঠাৎ গুম হয়ে যান।’এই সব বলেছে সে? আর কি কি বলেছে।’নিমাই ভয় পায়।ভয়ে ভয়েই বলে আর কিছু না। শুধু ওই কথাই।’আচ্ছা ঠিক আছে। বাড়ির মানে আমার মেয়েই আমার কথা শুনে বলেছে। কাছে। আমি বলছিলাম কি না আমার মারনিজের ঘর দেখতে পায় নিমাই।আধখানা সিঁড়ি উঠে নীচু ছাদের ছোট একটি ঘর। নিমাই দেখেছে গ্যারেজের উপর এরকম ঘর থাকে।এ ঘরেও জানলায় পর্দা।ছোট একটা বেতের টেবিল, একটা বেতের চেয়ার, আর রঙিন চাদর ঢাকা নীচু চৌকির বিছানা। এপাশে আলনা, দেওয়ালে গাঁথা আলমারি।নিমাইকে এই ঘরটা দিল এরা।তার মানে নিমাই জানালা দিয়ে বড় রাস্তা দেখতে পাবে, কার মানে নিমাই এখানে নির্জনে পড়তে পাবে।একটা বাচ্চা ছেলেকে পড়িয়ে কুড়ি টাকা মাইনের উপর এইভাবে থাকতে আর ইবেলা পেতে দেবে। এও যদি বড়লোকের ব্যাপার না কয় তো বড়লোক মানে কি?নিমাই তাহলে এখন কলকাতা শহরের একটি বড়লোকের আশ্রয় পেলো।নিমাই ভাই মনে করলো।নিমাইয়ের কাছে বড়লোকের চেহারা এর থেকে বেশী এগোয়নি।
পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৮০
পৃষ্ঠা-৬১
এই তিনতলা বাড়িটার যে এরা মাত্র একটা ভলারই ভাড়াটে, তা খেয়াল করে না নিমাই। ভাবে সবী এদের। হয়তো আরো অনেক লোক আছে কোথায় না কোথায়। এই তো মহিলাটি বললেন, ‘খামার মাকে বলছিলাম।’সবই তো ভালো, শুরু যদি এই পাগল মেয়েটা না থাকতো। আর নিমাইকে সন্ধ্যা করবার জরে এতোটা কাগ্রতা নাথাকতো।ছেলেকে পড়াবে বৈ তো নয়।খুতি পরে পড়ালে জাত যাবে?কর্তা একটা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বেড়াচ্ছেন দেখলাম বটে ভা বলে ধুতি কি মানুষ পবে না? বাড়ালী বাংলা দেশের সাকে লজ্জা পাবে। আশ্চর্য।তারপর নিমাই ভাবে আমার ভাগাটাও আশ্চর্য। বেশ স্বস্তিজনক একটা জায়গা পার না। এলাম তো ওই কম্বর মেস। আবার এনাম তো সাহের বাজি।নিমাই ভাবছিল।বহিলাটি প্লেটে করে রসগোল্লা আর কাঁচের মাসে জল নিয়েআমাদের খাওয়া দাওয়া একটু দেরি হয়।নিমাই কুষ্টিত গলায় বলে, ‘ঘরকার ছিল না। আমি তো খেয়েইএসেছি ‘তা হোক। নতুন এলেন, একটু মিষ্টিমুখ করবেন।’আপনি নিজে নিমাই তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, চাকরকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই তো হতো।’চাকর।’মহিলাটির মুধটি একটু বিবর্ণ দেখায়। মানে সেই যাকে দেখলেন। পেরে ও আবার আজই দেশে হঠাৎ দেশ থেকে চিঠি
পৃষ্ঠা-৬২
তাড়াতাড়ি চলে যান ভজনহিলা।খোলা জানলা দিয়ে বড় রাস্তা দেখতে দেখতে রসগোল্লা মুখে দিয়ে ভাবে নিমাই-তা’হলে বড়লোকের বাড়ীর জীবনযাত্রা শুরু গুলো আমার।শুধু আম্বরযন্তটা বদি একটু কম হতো। তা প্রথম দিনে অভটা করছে, ততটা বোধহয় থাকবে না। না থাকলেই বাঁচি।আচ্ছা, মেয়েটা কি সত্যি পাগল।না বড়লোকের আছলাদী মেয়ে?বেয়াড়া বাচাল?কলকাতার এসে অনেক শিখেছে নিমাই। অনেক কথাও।ছাত্র আসে।গেছো বাঁদর সমতুল্য বছর আট-নয়ের একটা ছেলে। ঘরে ঢুকেই। সবকিছু যেন ৩চ নচ করে দেয়। কথাবার্তাও তেমনি’বা-বে, আমাদের আলমারিতে বেশ নিজের বইচই সাজানো হয়েছে! খুব চালাক।’তারপর বলে, ‘তুমিই নতুন মাষ্টার মশাই। তা তোমাকে পছন্দ। কয়েছে। আনেবে ছিল, সে এমন কেলে বিচ্ছিরী-দেখলে বাগ হতো। আর দিদিমা যদি বলতো, ‘কাঁচা কাপড়ে আমার পুজার মিষ্টি এনে দাও, ও বলতো- ‘ওসব আমার কাজ নয়।’-মা যদি বলতো, ‘বান্ডারটা করে আসুন তো ও বলতো ছেলে পড়াবার কথা ছিল, বাজার করবার কলা তো ছিল না।’ভাই-বোন দুটোই তবে সমান বাচাল।নিমাই এই বাচালতার মধ্য থেকে নিজের কর্মব্যকর্মের পরিধিটা খানিকটা দেখতে পায়।কিন্তু এই আদর যত্নের সঙ্গে ওই কথাগুলোর সামঞ্জস্ত খুঁজে পায় না। এ তো বাবা কুটুম্বের মতো আদর। ঠিক আছে দেখাই যাক।
পৃষ্ঠা-৬৩
নিমাই ভেবেছিল দেখ্য থাক।কিন্তু এমন অদ্ভুত একটা দেখা যে দেখতে হবে তা’ জানতো না।নিমাইয়ের ভাগ্যের কি তাকে এত দেখাচ্ছে? না কি কলকাতার ভিতরের দৃশ্মই এই?কতা-গিন্নী, ছেলে-মেয়ে, গিন্নীর মা সবাই যেন আলাদা জগতেরএকে অপরের প্রতিপক্ষ।তবে ছেলেটা মাষ্টারমশায়কে খুব ভাজ ফেলেছে। ছোট ছেলেটা যতই বেশী কথা বলুক, তবু রাথ ওয় না। কিন্তু মেয়েটার কথায় যেন সর্বাঙ্গে আগুন ধরে যায়।হয় ভোরে, নয় ও সন্ধ্যার পর থোকাকে পড়িয়ে-পিটিয়ে সবে যখন নিজে পড়তে বসেছে নিমাই তখন।গুটিগুটি এসে পর্দা ঠেলে ঢুকবে।প্রথমেই খানিক হিহি করে।নিয়ে বলবে, ‘সুব পড়া হচ্ছে? কী নিমাই বোঝে, হয়ে গেল।হতাশ গলায় বলে, আপনারও তো পড়া আছে’আমারা হুঁ। আমি কি আপনাদের মতো ভাল ছেলে? আমরা গদি ওঠা মেয়ে।’পড়ছেন তো ক্লান নাইনে।ভীরতার জোরে। টুকে মেরে ক্লাশে উঠেছি।’সামার টোকবার ক্ষমতা নেই। আমায় পড়তে দিন।’মাথা খারাপ। আমি বলে কত কৌশল করে শ্রীমতী পারুলবালা দেবী এবং শ্রীমতী বেলারানী দেবীর চোখ এড়িয়ে চলে এলাম একই আনা দিতে।’নিমাই কঠিন গলায় বলে, ‘এরকম করলে কেন? আমার খারাপ
পৃষ্ঠা-৬৪
বাটি বোস করে উঠে বলে, আর যখন বেলাতানী গায়ে পড়ে গল্প করতে আসেন। তখন তো খুব-নিমাই বিরক্ত বিরক্ত অবাক গলায় বলে, বেলারাণী কে?বেলারান্ট কে জানেন না? বান্টি হেসে গড়িয়ে পড়ে আছেন কোথায়। এ বাড়ির গুরিণী আমাদের মাড়দেবীগাঁইয়া নিমাই এই অসভ্যতায় বিচলিত হয় ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘মার নাম ধরছেন।নাকে নাম করে ঢাকেন হয়’। বাড়ি অবলীলায় বলে, দিদিমা বলে বেলারাণী আমারা। বলি বেলায় ‘গী।আপনার মা বকেন না।বকবে কেন? হি হি ভি- ওড়নাটায় একটা ঝাপট মেরেতাকে পিঠে পাঠিয়ে দিয়ে বলে ওঠে ব্যান্টি, বরং ‘মা’ বলাটাই পশুন্দ করে না। পশুনন্দ করবে কেন? ‘মা’ বলে ডাকলেই তো সবাই বৃতে ফেলবে এতোবড় মেয়ের মা।-হি হি হি আপনি একবার মাসীমা’ ডেকে দেখুন না। চাকরী যাবে। বি-৬ঃকরয়া দিদিমাকে মা বলে মাকে দিদিমণিঠিক আছে। যার যা ইচ্ছে সে তা করবে- নিমাই স্বচ্ছন গলায় বসে, ‘এবার আপনি যান, আমায় পড়তে দিন দেখুন কেউ বই নিয়ে বসে আছে দেখলেই আমার মেজা খারাপ হয়ে যায়। আপনি বলেছেন, যার যা ইচ্ছে করবে- আমার ইচ্ছে এখন গল্প করা নিমাই হতাশ গলায় বলে, আচ্ছা আপনি কি চান যে আমি এখান থেকে চলে লাই
পৃষ্ঠা-৬৫
এবার বাটি একটু অনুতপ্ত হয়। বলে, ‘আপনি সত্যিই রেগে যাচ্ছেন তবে যাই তখনকার মতো চলে যায়, আবার কোনো সময় আসে। টুক করে পর্দা ঠেলে ঢুকে ব্য চাইছি ডিসটার্ব করবার গল্পে মাপ তারপর জাঁকিয়ে বলে বলে, ‘বাবা আজ আপনাকে সঙ্গে করে বাজার করছে নিয়ে দেন, তাই না?’মাঞ্চ ছুটি ভি ভি রি-রোজ তুষ্টি হয়ে থাকবে না নিশ্চয়। কিন্তু রাজার যাওয়াটা চলবে’তা বলিষ্ট চলে নিমাই বলে দোষ কি চাকর দেশে গেছে বাড়ির লোক করে না কাজ।চাকর দেশে গেছে হি হি তি-ন্তি চাই বুঝিয়েছে বুঝি আপনাকে। আগে থেকে তো চাকরকে জবাব দিয়েই রেখেছিল।বলেছিল, রটো লোককে পোষা বাবে না। মাষ্টারই রাজার মোকান করবে তা মজা হয়েছে কি বাল্টি চোখে মুখে ভয়ঙ্কর কৌতুকের গাসি দৃষ্টিয়ে বলে, শাপনাকে দেখে মার গিয়েছে মন ঘুরে মানে গাঁইয়া কলে কি হবে, চেহারাখানা তো আপনার। যেন রাজপুঞ্জুর বাজপুচুর। সড়া করে নিলেই হয়ে গেল তা করে এনেছে দিবিং করে এনেছে, এখন আর সেই গাঁত্যা। ছেলেটি কলে চেনাই যায় না-এঘরে তো একটা আশিও নেই ভাই। কী চাই ঘড় করছে মা আপনার।’তথ্য বলে, যেন মেল গাড়ী চালায় চমকে আর রামতে পায়না নিমাই, বারে বারেই চমকাতে গর নেলগাড়ী চলতেই থাকে, ‘তা এখন আমার মার বাবার সঙ্গে রোজ ভূযুল কলর ‘ও কেন পড়ার ক্ষতি করে বাজার করবে, ও ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, এভাবে সময়ের অপচয় করলে অধ্য আবার
পৃষ্ঠা-৬৬
বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, ‘কেন? এসব কথা কি ছিল না? অনন্তকে তবে দ্বাড়ানো হলো কেন আমি বাজার করবো বলে?’মা বলে, ‘কর না ক্ষতি কি? বলেই তো আছো। তখন ফি ছি তখন বাধা রেগে টেগে বলে, ‘কেন নিয়ম চিত্তম উল্টে যাবে কেন? নাষ্টারের চেহারাখানি সোনার গৌরাঙ্গর মত বলে?’ বাস। লেগে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ।’আপনাদের বাড়ির ভিতরকার গল্প শোনবার দরকার নেই আমার। এসব আর বলবেন না।’বেশ বলবো না তবে বড় আরশি নিয়ে দেখবেন একবার নিজেকে পায়জামা-পাঞ্জাবিতে, চুলের কায়দায়, চটির বাহারে কেমনই লাগছে আপনাকে।’এই রকম কথার মধ্যে হঠাৎ এক-এক দিন বেলারাশী এমে ঢোকেন’তুই এখানে কী করছিস?”কী আর করবো আজ্ঞা দিচ্ছি।’এইটা জমা দেবার সময়। লেখা পড়া নেই তোমার? তোমারও আছে, মাষ্টার মশায়েরও আছে’আমি, আমি শুধু বলছিলাম, মাষ্টার মশায় আপনার আরশি নেই। আরশিতে বেশ ধরা পড়তো একমন দেখতে আপনি কী মার্সেসাস চাইনি। দাড়ানো চেহারা দেখবেন। দেখবেন পায়জামা- পাঞ্জাবি পরে কেমন দেখাচ্ছে।’বেলারাণী যে মেয়েকে এ’টে উঠতে পারেন না, ‘তা’ বোঝা যায়। তাই বেলারাণী হালকা গলায় বলেন, অল্প পোষাক পরলে সকলকেই অক্ত রকম দেখায়। যাও বাজে এখায় মাছা না ঘামিয়ে স্থ’পাতা পড়গে তো। রামকাচা!’ইংরেজীতে তো রামকান্তা। বুঝিনা পুতিনা ভাল লাগেনা।’
পৃষ্ঠা-৬৭
বেলারাণী বলেন, ‘তা বাপের কাছে একটু বুঝে নেওয়া যায় না? মাষ্টারমশাইয়ের কাছে একটু বুঝে নিলেও তো পারিস।”বাবা। বাবা আমায় পড়াবে? তা, হলেই হয়েছে। অন্তক্ষণ বাবার ক্রসওয়ার্ড পাজল করলে কান্ড দেবে।’নিজে বোঝবার চেষ্টাও তো কর না? এই তো হায়ার মশাই। পড়ছেন তো? ৩র পড়া কে যেখাচ্ছে? বরং উনিই ঘোতাকে-তাই সবাই যদি মাষ্টারমশাইষের মতো মহাপুরুষ না হয় কাল চলে যায় বান্টি।তখন বেলাতাগী নিমাইকে নিয়ে পড়েন।নিমায়ের এখানে কোন অসুবিধে হচ্ছে কি না, বাওয়া দাওয়ার কোনো টয়ে হচ্ছে কিনা। মানে অনেকে তো ঝাল-মশলা যেতে পারে না. বেলারাদীর বাড়ির রাস্তা ‘রিচ, অতএব ইত্যাদি প্রস্তুতি!নিমাই সব কথাতেই ‘কী যে বলেন, কী আশ্চর্য। এখানে অসুবিধে। ইত্যাদি উত্তর দিতে থাকে, এব মনে মনে ভাবে মেয়ের চেয়ে মাও কম যাবে না। পড়ার সময়টাই যদি এভাবে নষ্ট হয়, তবে আমার এখানে থেকে লাভ?অদও ‘এখানের আরাম আয়েস সুখ সুবিধেগুলো প্রায় করায় এনে ফেলেছে নিমাইকে ক্রমশঃ যেন আর ভাবতেও পারছে না নিমাই এখানটা ফোড় কিন্তু সমস্ত সুখের মধ্যে এ কী অশান্তি।’আপনি আমায় ‘মাস্টার মশাই বলবেন না, ভীষণ লজ্জা করে।’বাঃ লজ্জা কিসের? আমার বলতে বেশ ভাল লাগে। ‘তা যোত। আপনি আমার নাম ধরেই বলবেন।’ দেখি। একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।’পরের দৃক্ষে বান্টি এসে বলে, ‘কেন মিথ্যে ওসব বলেন।
পৃষ্ঠা-৬৮
বেলারানী আপনাকে নিমাই বলে ডাকবে না। ডাকলে পাছে আপনার ছোল ভেলে ভাব এসে যায়। ফ্রেন্ড ফ্রেন্ড ভাব করুন, মার্কেটের সঙ্গী হোন, সিনেমায় নিয়ে টিয়ে যান, তা’ নয়-আমায় নাম হরে ডাকুন। বেজায় বোকা আপনি। বৃদ্ধি থাকলে, এবাড়িতে অনেক প্রতিলব্ধি করে নিতে পারতেন।’হি কি করে পালায়।নিমাই অবাক হয়ে ভাবে এসব কোন ধরণের করা? যেন ভিতরে কিসের একটা ইশারা।সর্বাঙ্গে কাটা দিয়ে করে নিমাইয়ের জোর করে ভাবতে চেষ্টা করে-মেয়েটা পাগল।কিন্তু মা-টি?তাঁকেও তাহলে তাই বলতে কবে?ক্রমশঃ যেন মেয়ের থেকে মাকেই বেশী অস্বস্তিকর মনে হয়।যেন কোথায় অপেক্ষা করছে ভরঙ্কর সেই ঝড় বৃষ্টির রাতটা ঝাঁপিয়ে এসে পড়বে নিদায়ের উপর এদিকে খাবার সময় দিদিমা চুপিচুপি বলেন, সকালে চানের পর আমার ঠাকুরের একটু মিষ্টি এনে দেরে নামা? মকরলজ কুরিয়ে গেছে, জামাইকে বলে বলে হতো হয়ে গেলাম, এলোনা এনে দেবে দাদা? বোনকিকে এই চিঠিখানা লিখেছি, মেয়ে এলে স্বাম নেই, একটা গাম কিনে ডাকবাক্সে ফেলে দেবে জামা।দাদা দাদা দাদা।অসংখ্য অনুরোধ। চুপি চুপি টিপে টিপে। ‘দাদা শব্দটায় প্রথম প্রযন মনের মধ্যে ভয়ানক একটা আলোড়ন উঠতো নিমাইয়ের, ঠাকুমার কণ্ঠস্বরটা কানে বাজতো। ব্যস্ত হয়ে অনুরোধগুলো পালন করতো। কিন্তু ক্রমশাই অন্তরোবের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অথচ এদিকে পকেট শূক্ত।
পৃষ্ঠা-৬৯
মলয়বাবুও যে বলেন, ‘বাজারটা এখন করে খাবো নিমাই বাবু, পরে দিয়ে দেব।’বেলায়ান্টী টের পেলে রসাতল করেন। বলেন, ‘খবরদার, তুমি মায়ার মশাইকে দিয়ে বেগার খাটাবে না। পয়সা না ঠেকিয়ে বাজারের মলয়বাবু তখন মিনমিনিয়ে যান। বলেন, আর এই যে জামা প্যান্ট-জুতো নাজসজ্জা, নারান পাউডার, এলর সংসার থেকে চলে তবেই তো। ছেলের মাষ্টার হয়ে, ভূত হয়ে বেড়াবে?”‘ভূত হওয়া আর বাবু হওয়া এক নয়।’অবশ্যই এসব কথা নিমাইয়ের আড়ালে হয়। তবু নিমাইয়ের কানে এসে পৌঁছায়।খোকা এসে খবর সরবরাহ করে।জানো। বাবা বলে মারাতকে তুমি বাবু করে স্কুলছে। গরীবের ছেলেকে যায় করে তুললে তার ক্ষতিই করা হয়। আয়ার মশাই, তুমি গরীবের ছেলে?নিমাই স্বাস্তে বলে জাঁ। গরীবের ছেলে। ভাই ভাবছি আর বাবু এবার চাল যাবো।”মা। তুমি চলে যাবে না।’যেতেই হবে ভাই।’যেতেই হবে।এই চমৎকার ছোট্ট সাম্রাজ্যটুকুর মাধিপত্য ছেড়ে যেতেই হবে চলে। স্বস্তি শান্তি নিশ্চিয়তা বোধকরি নিমাইয়ের করনিমাই এদের গৃহবিবাদের কারণ হতে চায় না। তাছাড়া মাইনেটা কই? নিয়মিত নেই। বিলাসিতার উপাদান হাতে পাচ্ছে বটে, কিন্তু কলেজের মাইনে দিতে চিন্তায় পড়ছে।
পৃষ্ঠা-৭০
এই গোলমেলে জীবনের মধ্যে খাপ খাওয়াবার ক্ষমক্ষা নিমাইয়ের নেই।নিমাই তাই প্রাণপণে কর্মখালির বিজ্ঞাপণ দেখে।যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত, শুধু পড়াটা নাতে হয়।অবশেষে ডাক আসে একটা।একটি বুদ্ধলোককে বই পড়ে শোনাতে হবে নষ্টি হারিয়েছেন তিনি। কারণ চোখের বিনিময়ে থাকা-খাওয়া ও কিন্তু হাত খরচ।সেই কাজটা কেমন তাই জানতে যায় নিমাই।নিমাই ঢুকতে গিয়ে থতমত খায়।এওতো বড়লোকের বাড়ী।নিমাইয়ের বিধাতা কি নিমাইয়ের সঙ্গে কেবল ব্যঙ্গই করে চলবেন? গৃহস্ব বাড়িতে খুব সাধারণ একটা কাজ হয় না ভার।নিমাই ভুল করে।নিমাই খেয়াল করে না, বড়লোক ভিন্ন এমন খেয়াল কার হয়-এস শুধু বই পড়ে শোনাবার জয়ে এতো পরসা খরচ করতে চায় কিন্তু এই বাড়ি, যে বাড়ির সমস্ত মেচ্ছে আগাগোড়া ফুল কাটা, সার সেই মেজেতেও জুতো দিয়ে রাউধার করে কার্পেট পাতা, যার ঘরে ঘরে ডানলোপিলোর সোফা পাড়া, সে বাড়িতে নিমাই ঘুবে ‘কাল কথা দেব।’কাল কথা দেবে?বৃদ্ধ যেন অসহায় ভাবে বলেন, ‘এতে আর ভাববার কি আছে বাপু? ঘরের ছেলের মতো থাকবে, নিজের পড়াগুনো করবে, আর সকাল সন্ধে ঘু’বেলা আমার পড়ে উড়ে শোনাবে।’না, ভাবনার কিছু নেই সত্যি, কিন্তু ওই ঘরের ছেলের মতো শম্বটাই যেন ভয়ের।
পৃষ্ঠা-৭১
বৃদ্ধ চোখে ভাল দেখেন না-তবু মোটা চশমার মধ্যে থেকে চোখ স্কুলে স্কুলে বলেন, ‘তুমি তো বাপু নেহাৎ ছেলে মানুষ। বাড়িতে কেউ নেইও বললে, তবে ভাবনা কিসের?নিমাই মরীয়া হয়ে বলে ওঠে, মানে আমি লেখাপড়ার জন্তে একটু নির্জনতা চাই-‘কী আশ্চর্য। সেটা পারে না কে বললো। ইচ্ছে করলে তুমি এই বাইরের দিকেরই কোনো একটা ঘরে থাকতে পারো। বাড়িতে আর আমার কে আছে? ছেলে-বৌ নিক্ষের নিয়েই বাজ। তাদের ছেলেমেয়েরা তো এই বৃড়োর দিকও মাড়ায় না।’ গলা খাটো করে বলেন, যবন এই বৃদ্ধোর ক্ষমতা ছিল, তখন নাতি- নাতনিরা কাছে আসতো। এখন অন্ত খঞ্জ হয়ে এক পাশে পড়ে আছি। কার আর ভাল লাগে বল একটা দূর সম্পর্কের নাতনী ছিল। মানে ভাষ্ঠীর মেয়ে, সেই মেয়েটাই মায়া-শ্রদ্ধা করতো। বই-কাগত পড়ে শোনাতো, ডিকটেশান দিলে লিখেও দিতো। আমার আবার একটু লেখ্য টেখারগ বাতিক আছে কি না। তা মুস্কিল হংদা কিন্তু মেয়েটা ইংরাজী টিংরাজী ভালো জানতে। না। অসুবিধে হতো। মানে, বুঝতেই তো পারছো, মা-বাপ মরা গতীবের মেয়ে, কেই বা পড়িয়েছে নহাৎ নিধালয় বলে এখানে আত্মায় নিতে তা আমার ছেলে-কে তো ডাকে মাজুষ বলেই গণ্য করতো না। চোখে না দেখতে গেলেও, মনের একটা চোখ তো আছে? কই দেখে মেয়েটার একটা বিয়ে দিয়ে দিলাম। সত্যি তো আর আমার নার্সগিরি করবার জঙ্গে তাকে চিরকাল আটকে রাখতে পরি না। ভারও মান সম্মানের ওপর রাখবার রাত আমার নেই।’নিমাই দারুণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে এই সব পারিবারিক অথচ এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে তো বলে উঠতে পারে না, আপনার ঘরের কথা আমায় বলতে এসেছেন কেন?’পারা সম্ভব নয়। তাই বেচারী বসে বসে থামতে থাকে।
পৃষ্ঠা-৭২
বৃদ্ধ তেমনি গাটো গলায় বলতে থাকেন, বিয়ে দিয়ে দিলাম ধরচা পত্র করে। তাতে আমার ছেলে বৌয়ের কি গোঁসা বুঝবে এতো আছে তবু এতোটুকু দ্বাড়তে ইচ্ছে হয় না। আমি অবস্ত এই সব অনিচ্ছে টনিচ্ছে গ্রাছ করি না। এ সমস্তই আমার স্বোপার্জিত হাইকোর্টে প্র্যাকটিশ করতাম, বুঝলে আঁকার ওজনে রোজগার করেছি, পয়সাকে পয়লা জান করি নি, রাজার হালে রেখেছি ছেলে মেয়েদের। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা করে খরচা করে। সে সব কথা যেন ভুলেই গেছে সব ব্যাটা ব্যাটি রাশটা চিরকালই এই রকম অন্ড স্বল্প ছিল। বাড়ির পিত্রী চলে গেলেন বৌমার আমল গড়লো। সংসার অল্প রকম হয়ে গেল। পুরনো চাকর- বাকরগুলো বিনা দোষে বিতাড়িত হলো সব নতুন প্রজা। নতুন মহারাণীর আমলেনিমাইয়ের বৃকতে বাকী থাকে না কাজটা তার গৌণই হয়ে দাঁড়াবে মুখ্য হবে এবং পত্নী জীন বৃদ্ধের আক্ষেপোক্তি শোনা। পড়ে-উড়ে শোনানোর শোনা। এই বৃষ্টিহীন কী অস্বস্তিকর।কিন্তু আশ্চস। ইনি একজন শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি জীবনে রীতিমড প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, কিন্তু এ কী অদ্ভুত মানসিক দৈর। নিমাই একটা তুচ্ছ ছেলে একেবারে রাস্তার লোক বললেই। হয়, মাত্র এই মিনিট কয়েকের পরিচয়, এমন কি ভরলোক ভালো দেখতেও পাচ্ছেন না নিমাইকে। অথচ উজাড় করে এই ঘরের কথা বলে চলেছেন ওর কাছে। কারণ মাত্রও নেই। নিমাই এর আশ্বীর নয় যে, তার সামনে অকৃতজ্ঞ পুত্রের স্বরূপ প্রকাশ করে দিয়ে ঋণ করবেন পুত্রকে নেই। তবু- নিমাইয়ের কাছে প্রতিকারের কোনো প্রত্যাশা নিমাই অবাক হয়, অন্তমনস্ক হয়।ভদ্রলোক কিন্তু বলেই চলেছেন। ‘ফ্যাঁ সেই বিয়ের খরচা নিয়ে
পৃষ্ঠা-৭৩
কী রাগারাগি। আমিও শুনিয়ে দিলাম, কারুর কাছ থেকে হেজে নিয়ে করতে যাই নি আমি আমার টাকা আমি যা খুশী করবো। কেন করবো না বল? ওরা কি আমার সুখ স্নাথ দেখেচে যে, আমি ওদের অবিয়াতের সুখ দুঃখের কথা ভাবতে যাবো? কই পায় বয়ে গেল। অতে কষ্ট পেতেই বা যাবে কেন? কম সম্পত্তি কি করেছি আমি! চের আছে। তবু এই যা বললাম- এক আসলে মান্তব হলেন্দ্র কুমীরের জাত। লোভই লোভ শেষ করেছে মানুষকে পয়সাও ভাড়তে রাজী নয়। সর্বদ গ্রাস করাত চায়। এই যে দেখো না, তোমার মালে মাসে একশোটা করে টাকা দেব শুনে বৌমার আমার কি হটফটানি। বলে কি না, ‘ও বাধা, আপনি বরা আমায় ওই মাইনেটা দিয়ে রাখুন, আমিই দু’বেলা আপনাকে কাগজ পড়ে শোনাবো। ৩. আমি ওই কথায় গলবো এমন কাঁচা ছেলে নই। পড়ে শোনাবো তো কতো। মাখের খোর আমার একটা পুব্যবস্থার পথ বাতিদ হয়ে যাবে।আচ্ছা আজ আমি উট।বললো নিমাই।’আহা আজ তো উঠবেই। কিন্তু কথাটা দিয়ে যাও। তোমার মত কম বয়সী একটি ছেলেই আমার সরকার, যার অর সংখার নেই। মাসখানেক এক স্কুলমাস্টার চিলেন, একমাসের মধ্যে ঘোলাদিন কামাই। কী না আজ ছেলের অসুখ, কাল মেয়ের পরীক্ষা, পরশু শান্তীয়। বিয়োগ,-অনন্ত। অধচ মাষ্টার বলে একশোর ওপর আরো পঁচিশ। বলছি, না সংসারী লোক নয়, স্টুডেন্টই ভালো থার টাকার দরকার, খ্যকার দরকার। তা তুমি আর দ্বিধা করো না, বুঝলে? কাল থেকে লেগে যাও। শোনো তাহলে খুলেই বলি, একটা বড় জিনিস নিয়ে কাজ করছি মানে রিসার্চ। ব্যাপারট। হচ্ছে মকাভারতের যুগের ‘ল’, সংহিতকারদের ‘ল’, বর্তমান যুগের ‘ল’- এই তিনটের একটা তুলনামূলক আলোচনা! অনেকখানি
পৃষ্ঠা-৭৪
এগিয়েছিলাম। ভগবান চোখের আলোটা কুেড়ে নিয়ে মারলেন। যাক পরের আলো ধার করেই ৩টা শেষ করে যাবো। দেখিয়ে নিয়ে যাবে। সমাজ-বিজ্ঞানে ভারতবর্ষ-হটাৎ থামলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। গলা ঝেড়ে বললেন, ‘কে নিমাই অবাক হলো।নিম্নাই তো টের পায়নি ভিতর দিকের দরজায় একটা চাকর এসে দাড়িয়েছে। অথচ উনি পিয়ন দিক থেকেই বুঝে ফেললেন। বাইরের ইন্দ্রিয় লুপ্ত হলেই যে ভিতরের ইন্দ্রিয় তীব্র হয়ে ওঠে এ সত্যি।চাকরটা বললো, ‘আপনার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে।’বৃদ্ধ প্রায় খিঁচিয়ে উঠে বললেন, হয়েছে তো হয়েছে। থাক্ এখন। ওষুধ খাওয়া না হাতি। পাহারা দিতেএসেছে বাবু এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা কইছে। যা’ বলগে যা বৌমাকে পরে খাবো।নিমাই এই অবসরে উঠে দাড়াচ্ছিল। উনি আবার বলেন, দেখলে তো? সধবা পাকারা। ওদের বারণা কানা অন্তটাকে ঠকিয়ে কে কখন সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তোমায় বলবো কি, একদিন কেপুড়ের এক স্বামীজী এসেছিলেন। মানে আগে যেতাম টেতাম এখন আর যেতে পারি না, তাই স্নেহ বশতঃ এসেছেন শুনলে বিশ্বাস করবে? আমার ছেলে-যৌ সেখান থেকে এক মিনিটের জন্ডে। নড়লো না। যেন কতই ভক্তি। আসলে কি জানো? পাহারা। পায়ে স্বামীজী আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে যথা সর্বস্ব মিশনের নামে লিখিয়ে নেন’ নিজেরা যে আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না আমি যে বাগের মাথায় কিছু একটা করে বসতেও পারি, এ জ্ঞান তো টনটনে আছে। স্বামীজী চলে যেতে, বৌমার আমার সেগে সেধে কতো কথা বলা, ‘আহা কি চমৎকার কথা বলেন। উঠতে ইচ্ছে করেনা। ‘আমি কচি খোকা?’
পৃষ্ঠা-৭৫
নিমাই ভেবে পায়না, যে মানুষ তিন যুগের আইন নিয়ে তুলনা- মূলক আলোচনায় বিয়াট গ্রন্থ লেখার পরিকল্পনায় মসগুল থাকতে। পারেন, সেই মানুষই কেমন করে পারেন এই সব অতি তুচ্ছ, অতি ক্ষুর কথায় নেমে আসতে। আসলে মানুষের মনটা কী? কে জানে হয়তো যুগামর ঠাকুমাও উচ্চ চিন্তা করেন, হয়তো বৈষ্ণব ধর্মের রসে অদ্ভূত হয়ে ‘জীবে প্রেম’-এর কথা কেন।মানুহের মাপকাটি কোথায় কে জানে?এবার নিমাই না বলে পারে না ‘এসব কথা আমি কি বুঝবো? আমি তো কাউকেই চিনি না।’বৃদ্ধ ঈবৎ লজ্জিত গলায় বলেন, ‘তা ঠিক। আজই তোমায় এসব তবে চিনতে। হুদিন থাকলেই চিনতে পারবে কে কেমন উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন তুলে আবার কথা জোড়েন তিনি, ‘আসল কথা, এখনো যে এই বুড়ো বেঁচে থেকে খরচ করছে, এটা বাবুদের পছন্দ হচ্ছে না। মনে ভাবছে কলসীও জল গড়াতে গড়াতে কমে যাবে। আরে বাবা কলসীটা ভবলো কে? তা সেটা ভাবে না। বাবা সব উড়িয়ে পুড়িয়ে নিয়ে যাবে এই চিন্তা। এখন বসে বসে বুড়োর মরণ টাঁকছে, বুঝলে?নিমাই প্রতিবাদের গলায় বলে, ‘এসব আপনি কী বলছেন।”ঠিকই বলছি তায়া, ঠিকই বলছি। ডায়াই বলি। নাতির বয়সী যখন। আমার বড় মেয়ের ছেলে কথায় আবার ছেদ পড়ে।দরজায় আর এক আবির্ভাব।চাকর নয় কত্রী। হাতে জলের গ্লাস।’মহারাণী’ বিশেষণের যোগ্য এটে।দীর্জাঙ্গী, বয়েস চল্লিশ মতো। তিনি নিমাই নামের মানুষটাকে সম্পূর্ণ অগ্রগ্রস্থ করেই ঘরে এসে বলে ওঠেন, ‘বাবা, আজ কিন্তু
পৃষ্ঠা-৭৬
আপনি ভারী হইমী করছেন। ওষুধ খেতে কতো দেরী করছেন বলুন তো? খেয়ে ফেলুন।একটি বড়ি ও জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেন।নিমাই অবাক হয়।এই মহিমমন্ত্রী ও স্নেহময়ী সম্পর্কে এতক্ষণে এতো কটূক্তি জানিয়ে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। পাগল নাকি?কিন্তু পাগলই বা বলা যায় কি করে?পাগল কি মুহূর্তে সুর ফিরিয়ে নিতে পারে?বৃদ্ধ তো পারলেন।ওই স্নেহ আদর আর আবদার মিশ্রিত কণ্ঠের উপযুক্ত সুরেই উত্তর দেন, কেন গুইনী করবো? মা নিজে না এলে কি ছেলে খায়?’বলে বড়িটা উপ করে গিলে ফেলেন নিমাই কি স্বয় দেখছে?না মতে অভিনয়?এ বাড়িতে টিকতে পারবে নিমাই। পারা সঞ্চন?আসলে কে দোষী?এই অসহায় মুখ বুদ্ধ? না এই মর্যাদাময়ী মভিলাটি।রদ্ধ এবার আরো বিগলিত গলায় বলেন, ‘এই দেখো বৌমা, আমার নতুন কর্ণধার।”বলুন আপনার কর্ণের জন্ম ধারা-বিবরণী-কার। বলে যুদ্ধ বৃদ্ধ বলেন যা বলো। সেই মাস্টারের মতো নিত্য কামাই করবে না, এখানেই থাকবে। নিজের পড়াশুনো করবে আর অবকাশ মতো এই বুস্তোটাও পাগলামীর ভার নেবে। বলে হাসতে থাকেন বুদ্ধ টেনে টেনে।মহিলাটি এখনো নিমাইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত মাত্র না করে ঠাণ্ডা ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে-‘আজ থেকেই থাকবেন।
পৃষ্ঠা-৭৭
‘না না, আজ থেকে নয়- ‘বৃদ্ধ ব্যস্ত গলায় বলেন, ‘কাল থেকে কাল থেকে। ইনি আবার বলেছেন ‘ভেবে দেখি’। আমি বলি আরে বাবা ভেবে দেখবার কি আছে? খরের ছেলের মতো থাকবে, আমার বৌমার কাছে আপন পর নেই। সবাইয়ের অন্তে সমান ব্যবস্থা। সবাইয়ের প্রতি সমান যন্ত্র। কাল থেকেই চলে আসবে ভূমি বুঝলে।যৌমা রেজাল্টটা না শুনেই গেলাশটা নিয়ে চলে যান।নিমাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।বৃদ্ধ আবার গুল। নামান, বলেন, ‘দেখলে তো কারণা, ‘যেন বুড়ো শ্বশুরের জতে মরে যাচ্ছেন।’নিমাই মনে মনে বলে, কারদা আপনারও কম দেখলাম না। কে যে বড় অভিনয় শিল্পী তা বোরা কঠিন। অথবা আসলে তুমিই। ওেবৃদ্ধ কিন্তু নিজেও ব্যবহারের হাঞ্চকর দিকটা দেখতে পান না, তাই বলেন প্রথম দিনেই একটু ইয়ে করে দিলাম, যাতে তোমার খাওয়া- দাওয়ার দিকে একটু নজর দেন।’নিমাই আর দাড়ায় না।’আচ্ছা আজ তবে আসি বলে চলেই যায়।বাইরে বেরিয়ে আর এক বিপত্তি।বৃদ্ধের পুত্র কোথা থেকে যেন ফিরলেন। গাড়ি থেকে নেমেই গট গট করে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি?’ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ ছুই ছুই, তবু আপনি করেই বলেন নিমাইকে।নিমাই শান্ত গলায় সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দেয়। পুত্র দুরুটা কুঁড়কে বলেন, ও বাবার ডাক্তার।ডাক্তার।নিমাই অষাঙ্গ হয়ে তাকায়।
পৃষ্ঠা-৭৮
‘তা’ ডাক্তারই। ম্যানিয়াগ্রস্ত লোকের পক্ষে তার ইচ্ছাপূরণই ডাক্তারী। তা কতো মাইনে ধার্য হলো?’নিমাইয়ের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সৌম্যকান্তি চেহারা অথচ কি রকম গুড়। কাকে তবে বলে? এমন বাড়িঘর, এমন অমাজিত অশালীনতা নিমাই গম্ভীরভাবে বলে, ‘একশো।”একশো। জবক্ষই গ্লাস খাওয়া দাওয়া থাকা। মানে পেপারে তাই দেওয়া হয়েছিল মনে হচ্ছে।নিমাই চুপ করে থাকে।ভঙ্গলোক যেন অনুকম্পার গলায় বলেন, ‘ঠিক আছে। লাক্ যখন আসে। তবে আপনি কি মনে করেন একশো টাকার মতো কাজ আপনি করতে পারবেন?নিমাই এখন খায় সম্ভ গ্রাম থেকে আসা নয়। নিমাইয়ের মনের সেই অনিন্দ্য শুভ্রতায় মালিন্যের স্পর্শ লেগেছে এখন, তাই নিমাইয়ের মনের মুখ কথা কয়ে ওঠে, মাসে একশো টাকা, তার মানে দৈনিক তিন টাকা চার আনা। একটা মজুর মিন্ত্রীর রোজের থেকেও কম। অথচ বললেন, বাবার ডাক্তার। তা ওর বাবার দানটাও কি এতো কম যে মনে হচ্ছে উসুল হবে না?কিন্তু মুখে তো বলা যায় না ওকথা।তাই শান্তভাবেই বলে, ‘কাজটা তো দেখিনি এখনো। আর বাধ্য তো আগে থেকেই করা ছিল বিজ্ঞাপনে।”ছ’, টিকতে পারলেই ভালো। দেখবেন অনেক রকম বাতিক। শুধু বই পড়িয়ে শুনবেন না, বই লিখিয়ে ছাড়বেন। দেখবেন।’নিমাইয়ের বুঝতে বাকী থাকে না নিমাইকে ভয় পাইয়ে দেওয়াই উদ্দেপ্ত ভদ্রলোকের। একটু আগেও নিমাই ভাবছিল কাজটা নেবে। কিনা। কিন্তু হঠাৎ এই মুহূর্তে জেদ চাপে ওর। ভাবে, তা তুমি ভাবছো আমি ভয় পেয়ে পালাবো? তোমার উদেক্ষ সিদ্ধ হতে
পৃষ্ঠা-৭৯
দিচ্ছি না। নাঃ, বুঝতে পারছি আসল পাপী তোমরাই। আচ্ছা ওই বৃদ্ধ তত্রলোককে আমিই দেখবো। আমিই ও’র সহায় কবো।তাই বলে, ‘দেখি।’হ্যাঁ দেখুন। যদি বণ্ডে সই করে না থাকেন। উনি আবার তাও করাতে চান কি না।ধাকেন কোথায়?নিমাই আস্তে অথচ দৃঢ় গলায় বলে দরখাস্তর আমার নাম ঠিকানা সব লেখা আছে।’ওঃ। ভদ্রলোক মুখ কালি করে গাড়ি গ্যারেজে তুলতে যান।নিমাই কি ইতিপূর্বে আর কাউকে এমন কোনো কথা বলেছে, বাতে তার মুখ কালি হয়ে যায়। বলেনি। অখত আজ বললো। তার মানে এই গোলমেলে বাড়িটায় ঢোকবার আেেগই নিমাইয়ের মাথাটা গোলমেলে হয়ে খেল। নিমাই নিজের প্রকৃতির বিপরীত কাজ করে বসলো।আর তাকে যেন আনন্দই পেল নিমাই।আশ্চর্য বৈ কি। নিমাই কি বদলে যাচ্ছে? ভেবে ভেবে কুল পায় না।এখানে তো তবু মানুষগুলোকে জানা হয়ে গেছে কিন্তু নতুন সেই জায়গাটা?যেখানে একটি দৃষ্টিশক্তি হারানো বৃদ্ধ মুহূর্তে নিজেকে পালটে বিয়ে:কুটিল চেহারাকে সরল চেহারা করে ফেলতে পারে, যেখানে তার বয়স্ক, সন্ত্রাঞ্জ পুত্র বাপের আড়ালে বিষ উদগীরণ করতে পারে, আর কার মহিমময়ী মূতি পুত্রবধূ কি করতে পারে ভগবান জানেন।এখানে যে কেবলই একের আড়ালে আর একজনের বিরূপ সমালোচনা গুনতে হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত। যে জিনিসটার ভয়ে
পৃষ্ঠা-৮০
এখান থেকে চলে যেতে চাইছে নিমাই। আছে বৈ কি. এখানেও তো ওই ফিসফিসানি আছে। দার আড়ালে বাল্টি মার যে সব সমালোচনা করে সেটা কেনে হলেও গলা নামিয়ে। বান্টির মা তাঁর স্বামীর সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন সেগুলি মধুরও নয় উচ্চও নয়। আর বান্টির বাবা তাঁর স্বাশুড়ী সম্পর্কে যে কটূকাটব্য করে থাকেন সেটাও গলা নামিয়ে। কেন কে জানে নিমাইকেই সবাই ‘আদালত’ মনে করে।অথবা সংসাবে একজন তৃতীয় ব্যাক্তি থাকলেই সে সংসার সদাদের ‘আদালত হয়ে দাঁড়ায়, সব নালিশ তার কাছেই এসে হাজির হয়। মানে তার জীবন মহানিশা।নিমাই তবে কী করবে?নিমাই কি এই কলকাতাকে সেলাম ঠুকে ফিরে যাবে সেই ভার গ্রামে?সেখানেই কি আকাশ বাতাস নন নিমল?হয়তো তা নয়, দেখানেও আছে মানুষের পিছনে মানুষের ক্ষুদ্রতা বঙ্কীর্ণতা আর নীচতার নির্লজ্জ প্রকাশ। তবু যেন সেখানে ভয় ভয় করে না।চিন্তা নিয়ে কলেকে যাবার অক্ত প্রস্তুত হয় পরদিন, সাবধানে বান্টির চোখ এদিয়ে। কারণ ওর এখন পরীক্ষা অন্তের দুটি চলছে, ওৎ পেতে বসে তাকে যাওয়া-আসার পথে। দেই খাওয়া হয়ে যায় নিমাইয়ের, সেই বাটি টুক করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে। হয়ত নিছিমিছি ওই সামনের দোকানটায় ঢুকে পথের দিকে শূণ্য বৃষ্টি ফেলে তুটো উকি কিনতে থাকে, কি এক ডজন সেফটিপিন।নিমাইকে বেরোতে দেখলেই সঙ্গ ধরে, আর বাসের রাস্তা পর্যন্ত ব্য করতে করতে যায়।বড় অস্বস্তিকর।
পৃষ্ঠা ৮১ থেকে ৯১
পৃষ্ঠা-৮১
আজ সেই অস্বস্তিটা ঘটলো না; টুক করে বেরিয়ে পড়তে পারলো বলে মনটা খুশী ছিল নিমাইয়ের। কিন্তু কলেজে গিয়ে একটা কথা শুনে মনটা ধ্বসে গেল।গতকাল থেকে না কি কলেজে এরা কলেজের বন্ধু ছাত্রের বাড়ি বাড়ি খোঁজ চলছে মুথাঙ্ক কোথাও গিয়ে লুকিয়ে বসে আছে কিনা।কেন?মুগায় নাকি পরস্ত রাত্রে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে এক কন্দ্রে বিছানার ওপরে পড়ে ছিল একটা খোলা চিঠি, ‘আমি চললাম, আমায় খোঁজরার চেষ্টা করো না। এচীবন অসম্ভ হয়ে উঠেছে। ভয়ও নেই, মরবো না। অল্প জীবনের সন্ধান করতে চাই।’তবু অধীর হয়ে ছুটে এসেছে বাপ-জোঠ। যদি ছেলেমানুষী খেয়াল গয়, যদি কোন বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ থাকে, যদি এখনো কলকাতা ছেড়ে না বেরিয়ে গিয়ে থাকে’আপনার সঙ্গে তো খুব ভাব ছিল’ বললো একটা ছেলে, আপনি বলতে পারবেন না?নিমাই মাথা নাড়লো।প্রফেসর প্রশ্ন করলেন, শুনলাম তুমি ওদের বাড়ি টাড়ি যেতে, কোন রকম হিন্টস পাওনি?নিমাই বললো না। বেতাম, এখন আর যাই না।কেন?এমনি।সাধু-সন্ত হয়ে বেরিয়ে যাবে, এমন কোন ইসারা দিতো।কোনো পলিটিকস পার্টটাটিতে যোগ দিতে দেখেছো?
পৃষ্ঠা-৮২
না।আশ্চর্য। অখচ ক্লাশে নাকি তোমার সঙ্গেই এর বেশী বস্তুব ছিল।নিমাইয়ের ইচ্ছে হলে। চেঁচিয়ে বলে, ছিল, এখন আর নেই। ও মদ যাচ্ছে দেখে বিতৃষ্ণায় সবে এসেছি আমি। কিন্তু বলা তো সম্ভব নয়। তাই শুধু বলতে হয়- আলাপ ছিল এই মাত্র।তুমি ওদের বাড়ি বেজে নাযেতাম। তার মানে এ নর যে, ও আমায় ওর মনের কথা সব খুলে বলবে।কিন্তু এডেই কি বেহাই পেলো।যুগান্তর বাবার সঙ্গে গোকুল এসেছিল, সে ছুটে এসে চেঁচিয়ে উঠলো, এই যে বায়ু, এই সেই দাদাবাবু।অতএব আবার দেয়া।বেশ কয়েকদিন মুগান্ধর বাড়িতে গেলেও কর্তাদের দ্বেষা কোনো দিন পায়নি নিমাই। আজ গেলো। দেখলো জেরায় এরা উকিলের উপর যান। এবং রীতিমত সন্দেহই রয়েছে নিনাইয়ের উপর।অনেক বিরক্তির বৃত্ত পার হয়ে যখন ফেরামুক্ত হতে পারলো নিমাই, দখন কেবলি মুগান্তর সেই টকং উদাস, উবং ক্ষত্র অথচ বিশ্বন্যাৎ করা চেহারাটা মনে পড়তে থাকেঈশ্বর মানতো না মুগান্ধ, বলতো দূৰ দূর সব ফাঁকি সব বাজে। প্রেষ, ভণ্ড পুরুতদের চালাকি অথচ নিমাই বারবার কলঙ্ক থাকে মনে মনে, ঈশ্বর তোমায় রক্ষা করেছেন, ঈশ্বর তোমায় রক্ষা। করেছেন।কে জানে হয়ত মুগান্ধ যাকে নক্ষাৎ করতো, মানতে চাইত না, তাঁর অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। ওই ছেলে যদি পথ খুজে পায় তো সে পথে প্রবল বেগে দৌড়বে, যদি পথ খুজে না পায়
পৃষ্ঠা-৮৩
ঋলিয়ে যাবে, স্রেফ অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাবে। কারণ ৩র প্রকৃতিতে আছে প্রাবল্য, আছে বেপরোয়া-বেগ।নিমাই পারে এর মতো বেরিয়ে পড়তে।নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে নিমাই। উত্তর পেয়ে মাখা হেঁট করে। অথচ নিমাইয়ের মা নেই বাপ নেই, নিজস্ব বলতে কিছুই নেই। নিমাই স্রোতের মুখে একটা কুটো মাত্র।না, নিমাইয়ের কিছুই নেই, শুধু একটা জিনিস আছে। আছে জীবনের প্রতি তীব্র লোক। এই ফেনিল উজ্জল নাগরিক জীবনের রাতি লোভ। নিমাই সুন্দর হরের স্বপ্ন দেখে, শুনার বাগানের স্বপ্ন দেখে, সুন্দর সায় সজ্জার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে, কলকাতার মঞ্চত্র নাগরিকের মতো নিজের গাড়ি চড়ে ঝা করে বেরিয়ে যাচ্ছে, স্বপ্ন দেখে ভীম গর্জনের রথে চড়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে।নিমাইয়ের ঠাকুমা খুদ ভাড়া জলপান খাইয়ে নিমাইকে মানুষ করেছিল, নিমাইয়ের ঠাকুমা ছেড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে নিমাইকে ‘বঙ’ গৰাব সাধনা করবার মন্ত্র দিয়েছিল। নিমাই সেই বড় হওয়াটার মানে আবিষ্কার করেছে ওই স্বপ্নগুলোর মধ্যে।নিমাউ তাই প্রাণপণে লেখাপড়া করছে।প্রাণ গেলেও লেখাপড়াটা ছাড়তে পারবে না নিমাই।নিমাই অতএব ওই দৃষ্টিহীন বুড়ো ভদ্রলোকের দৃষ্টির আলো প্রয়াত যাবে। সেখানে সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকবার চেষ্টা করবে। আর যাই হোক, সেখানে বান্টির মস্কো মেয়ে ত নেই? আর বান্টির মায়ের মত মহিলা?যাঁকে দেখে এসেছে, তিনি আর যাই করুন, বয় ফেও খুঁজবেন না-এটা ঠিক। হয়তো যুগান্ধর ঠাকুমার মতো বলবেন, ‘কী রকম করে খায় দেখো। দেখেই বোঝা যায় জীবনে কখনো খায়নি এসব হয়তো বলবেন, ‘ঠাকুর, বুড়োবাবুর চাকরের জন্তে দু’বানা মায় রাখবার দরকার নেই, ‘একখানা দেবে।’
পৃষ্ঠা-৮৪
বলুন।নিমাই আর অভিমানে খানখান হবে না। নিমাই শুধু দেখবে পরিবেশটা তার পড়াশুনোর উপযুক্ত হচ্ছে কি না।মুগান্ত অনেক পেয়েছিল, তাই অনেকটা ছেড়ে যেজে পেয়েছে।ডোগের মধ্যে কী আছে তা মুথাপ্পর দেখা হয়ে গেছে, তাই অনায়াসেই ত্যাগের স্বাদ এগ্রহণ করতে পেরেছে।নিমাই করে কী পেয়েছে? নিমাই সেই পাওয়ার ঘরের দরজায় মোহদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।কলেজ থেকে ফিরে ভারাক্রান্ত মনে নিজের বইপত্র গোছাচ্ছিল নিমাই।চলে যেতে হবে।আর চলেই যখন যেতে হবে, আস্তেসুস্থে সব কিছু গুছিয়ে রাখা ভালো। চলে দাওয়াটা তাহলে বেশ স্পষ্ট আর বেশী প্রখর দেখায় না।পুরনো খাতাগুলো বাঁধছিল একত্র করে বান্টি ঘরে এসে বসে নিমাই চোৰ তুলে তাকায় মাত্র।বান্টি উঠে দাঁড়িয়ে দুই কোনরে ভাত দিয়ে বলে, ‘মুখ কেন হাড়ি?নিমাই গম্ভীর ভাবে বলে’ ‘ছাড়ি মুখের কিছু নেই। অন্ত জায়গায় চলে যাবে। তাই বইটই প্রদিয়ে নিচ্ছি।অল্প জায়গায় চলে যাবেন। তার মানে?নিমাই হাতের কাজ করতে করতেই বলে, ‘মানে তো অতি সোকা। চলে যাবো।’ঈস। চলে অমনি গেলেই হলো? বান্টি থাত বাঁকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘মা বৃত্তি কিছু বলেছে?’
পৃষ্ঠা-৮৫
নিমাই মাথা তুলে স্পষ্ট গলায় বলে, ‘বলবেন আবার কি? বলবার আছেই বা কি?’বলবার কিছু না থাকলে বুঝি বলা যায় না?’বাকি মিটি মিটি ছেনে বলে, ইচ্ছে পূরণ না হলে মানুষ ক্ষেপে গিয়ে অনেক কিছু বলতে পারে।”এসব কথা আপনি এরপর অন্ত মাস্টার মশাইদের বলবেন। আমার খারাপ লাগে।”খারাপ লাগে কেন শুনি? আমি দেখতে খারাপ।’বলে বাটি নিমাইয়ের বিছানায় বসে পা দোলাতে থাকে।নিমাই কথা বলে না।সুটকেস থেকে জামা কাপড়গুলো টেনে ‘টেনে বের করে যেগুলো নিতান্ত নিজস্ব সেইগুলোই শুধু নিয়ে যাবে, যেগুলো এ দিয়েছে, সেগুলো রেখে যাবে ফুটভেশ সৃদ্ধ।বান্টি আড়ে আড়ে তাকিয়ে দেখে।দেখে সব জামাকাপড় হুটকেসেই রইল। মাত্র ভু’চারটি জিনিস একটা তোয়ালেয় দাড়িয়ে একধারে রাখলো নিমাই।এ তার মানে ‘এক দিনের জন্মে কোথাও যাওয়া হবে বাবুর। ডা করে বলা হচ্ছে ‘অঞ্চ জায়গায় চলে বাবো’ তার মানে ইয়াকি নিয়াকি শেখা হচ্ছে।বান্টি উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়ে দুই কোমরে হাত দিবে একটা পাক যেয়ে হেসে ছেলে বলে ‘কোথার বাওয়। রবে বন্ধুদের সঙ্গে’বেড়াতে? গরীবরা আবার বেড়াতে যায় না কি? বললাম তো চলে যাব।”বাজে বকতেন না।’বাজে বলেন বাজে। আপনার বাবার কাছে বলতে যাচ্ছি। এইবার।’
পৃষ্ঠা-৮৬
‘বাবা ছাড়বে। ওই আনেন্দই থাকুন।’নিমাই ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘ছাড়বেন না মানে? কিনে রেখেছেন নাকি আমার।”কিনে না রাখুন, কেনা চাকর তো পেয়েছেন একটা?’বলে হি হি করে হেসে গড়ায় বান্টি।’আপনার জন্তেই আমাকে চলে যেতে হচ্ছে।’নিমাই কড়া গলায় বলে।’আমার শুঙ্গে? আমার অন্তে আপনাকে চলে যেতে হচ্ছে?বান্টি চোখ কপালে তুলে বলে, ‘এই কথা বললেন আপনি।”ঠিক কথাই বলছি। নিমাই সামনে গিয়ে বলে, ‘আপনার বন্ধু- বকানির আলায় আমার কিছু পড়া হয় না। কি ভক্তে তবে আমি পরের বাড়ী পড়ে আছি।’আচ্ছা আমি আর বন্ধুবক করবো না।’মাঃ, আমি বাবস্থা করে ফেলেছি। কালই চলে যাবো।”অন্ত চাকরী জোগাড় হয়ে গেছে?”আপনি যেছে পাবেন না।’আমি যাবোই।’হঠাৎ বান্টি একটা হাসাহসিক কাণ্ড করে বসে। প্রায় কাঁপিয়ে পড়ে নিমাইকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার গায়ে মুখ মাখা যবক্ষে ঘহতে বলে’কক্ষনো না। কিছুতেই না। যান দিকিনি কেমন যাবেন আমাকে ছেড়ে। আমি আর একটু বড় হয়ে আপনাকে বিয়ে করবো।”‘স্বাড়ুন।ছাড়ুন বলছি’না ছাড়বো না’।নিমাই চেঁচিয়ে বলে ‘বলে দেব আপনার মাকে।”বেশ ছাড়ছি। কথা দিন, যাবেন না।’
পৃষ্ঠা-৮৭
‘কথা দেব কেন? যাবোই নিশ্চয়।”তা’হলে আমি মরে যাবো। আমি মরে যাবোবান্টি মরে যাবে শুনে নিমাই কী বলতো কে জানে, কঠাৎ গরের মধ্যে বজ্রপাত হয়।বেলারাণী এসে দাঁড়ান হাতে কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে।তার মানে দোকানে গিয়েছিলেন।বেগারাণী এই দ্য দেখেন।বেলারাণীর শুধু সর্বশরীরই নয়, চুল গুলোতেও পুন্ড যেন আগুন জ্বলে ওঠে।বেলারাণী চিৎকার করে ওঠেন, ‘শুনছো? গুনছো? একবার এদিকে এসো দেখে হাও।’বেলারার্থী দরজায়।অতএব তাঁর এময়ের পালাবার পথ নেইকিন্তু সে বেচারা কী করবে? মাষ্টার মশাই যদি ডাকে একলা পেয়ে তার কি ও’র থেকে গায়ের জোর বেশী?কেদে ভাসিয়ে সেই কথাই বলে বান্টিবেলারাণী মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি কেনে মাষ্টারের উদ্দেঞ্জে বলেন, ‘আশাকরি আর এ বাড়িতে থাকতে পাবার আশা করবেন না।মলয়বাবু বারবার চুনকলা আর কাল সাপের কথা তোলেন, আর পৃথিবী যে কি ভয়ানক জায়গা তাই নিয়ে আক্ষেপ করেন।নিমাই নিজের স্বপক্ষে একটিও কথা বলে না। নিমাই বলে না ‘এবাড়ি ছাড়তেই চেয়েছিলাম আমি, তাই এই বিপত্তি।নিমাই শুনু নিজের বইগুলো গুছিয়ে বেঁধে নেয়, চৌকির তল থেকে তার সেই পুরনো শতরঞ্চ জড়ানো বিছানাটা টেনে বার করে, আর শুধু, তার নিজের কেনা দু’একটা জামা কাপড় খবরের কাগজে মুড়ে নেয় সে।
পৃষ্ঠা-৮৮
নিমাইয়ের সেই ট্রাঙ্কটা বেলংরাগী কবে যেন ফেলে দিয়েছেন।কিন্তু থাকলেই কি সেটা নিতে পারতো নিমাই। তার গ্রাম জীবনের সেই হাগ্যকর চিহ্নটা নিয়ে ঢুকতে পারতো সেই গেট ঠেলে নিয়ে গিয়ে বসতে পারতো সেই ফুলকাটা মেজের উপর ৭ পারতো না।।পুরণে। জীবনের চিহ্নকে ফেলতে ফেলতেই তো নতুন জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।কে জানে সামনের সেই জীবনে কী আছে?কে জানে ওইী ফুলটার অন্তরালে ভয়ানক কিছু লুকিয়ে আছে, না সে ফুল নিমাইয়ের কাছে শুধু কূল হয়েই থাকবে!কে জানে কতদিনের এই চাকরী।মনিব তো তার অশীতিপর।কতদিন তিনি বই পড়া শুনবেন।হতো তু’দিন বাদেই আবার পথে নামতে হবে নিমাইকে। হয়তো তখন ওর সঙ্গে এর ঠাকুমার হাতের কাঁথাটাও আর দেখতে পাওয়া যাবে না। করতো অধিকতর কোনো সভ্যতার পায়ে তাকে বলি দিয়ে চলে যেতে হবে নিমাইকে।হয়তো বার বার ঘর আর পথ করতে করতে নিম্নাইয়ের গাঁয়ের ৩০ শিশুর মতো সুকুমাৰ মুখটা পাকাটে হয়ে যাবে, হয়তো ওর চোখের ওই দীপ্তিটা খুলর হয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে সেখানে একটা সুযোগ সন্ধানীর চোখ উকি দেবে।আর হয়তো তখন সেই চোখের থেকে ‘চক্ষুলজ্য’ নামের জিনিসটা ঘুচে যাবে। টাকাটা যে টাকা সেটা বুকতে শিখবে নিমাই।হয়তো বা নিমাই তার কলেজে দল পাকানোর পাণ্ডা হয়ে যাবে, হয়তো পলিটিকস্ নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করবে। নতুন আসা
পৃষ্ঠা-৮৯
ফাস্ট ইয়ারের ছেলেদের টিকিরি দেবে, উৎখাত করবে, অধ্যাপকদের মুখের উপর চোটপাট করবে, এক কথায় তাঁদের ‘ঘেরাও’ করতে বসবে, ‘এ্যাপলজি’ চাওয়াবে।তখন হয়তো নিমাই ধুতি পরতে লজ্জা পাবে। ট্রাউজার ছাতা কাজকর চালানো যায় কি করে ভেবে পাবে না।নিমাই তখন বন্ধুর মাখায় হাত বুলিয়ে বে’স্তোরায় যেতে শিখবে, বান্ধবী বাগিয়ে শৌখিন প্রেম করে বেড়াবে।কলকাতার রাঙরে মলাউটা নিমাইকে উজ্জ্বল হাতছানি দিয়ে। ঢাকবে। নিমাই সেইটুকুকেই ‘কলকাত)’ ভেবে হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করবে।কলকাতার ওই চকচকে মলাটের নীচে যে জীর্ণ পুথিখানা অনেক ইতিহাস বহন করে বলে আছে, তাকে উল্টে দেখবার চেষ্টাre করবে না।নিমাই নিজেকেই ভুলিয়ে ফেলবে, কোনোদিন সে কলকাতায়। ছিল না।অথবা হয়তো তা নয়।হয়তো কলকাতা নিমাইকে জীর্ণ করে ফেলবে, চূর্ণ করে ফেলবে, নিমাই নামের ঝকঝকে তারাটি মুত্র উত্তাপিণ্ডে পরিণত হয়ে হাবে।জীবনযুদ্ধে পরাজিত সেই অকালবুদ্ধ ছেলেটা আবার কোনো সময় ওই পটলডাঙ্গায় মেসের দরদায় এসে দাঁড়াবে।তিনডায় গালির প্রথম ভাঁজের মুখে রিকশা রেখে চলে এলে বলবে, ‘আচ্ছা এখানে বিনোদবাবু বলে কেউ থাকেন। নয়নবাবু? বসন্তবাবু?কোনো কেউ হয়তো গলা শুনে বেরিয়ে আসবেন, বলবেন, ‘আরে তুমি-ইয়ে-আপনি নিমাই বাবু না? কী চেহরা হয়েছে। তা কি ব্যাপার?’
পৃষ্ঠা-৯০
নিমাই বলবে ‘কোনো সিট খালি আছে? পাওয়া যাবে?’হয়তো তখন ওই উঠোনটায় আর একটু শ্যাওলার স্তর জমবে। হয়তো চৌবাচ্চাটায় ফাটল ধরার জন্তে জল বেরিয়ে বেরিয়ে খালি হয়ে থাকবে।হয়তো নিমাই সেই চৌবাচ্চার ধারে গামন্ধা পরে উবু হয়ে বলে সাবান অসয়ে।তবু নিমাই তার বীরভূমের সেই গ্রামটার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াবে না। সেই তার ভাতা ফিটের দরজায়এসে বলবে না, ‘ভিটেটা তো বেচে খাইনি আমি, এখানে কি জায়গা হবে না। আমার ?’খাবে না।গ্রামকে পিছনে ফেলে একবার যে কলকাতার টিকিট কিনে রেল গাড়ীতে চড়ে বসেছে, আর তার ফেরৎ টিকিট কেনবার উপায় নেই।কলকাতা তার অরোপাশ বাহু দিয়ে চিরতরে বন্দী করে ফেলবে প্রাণীটাকে।সে বাহু আলোর সমারোগে অলমলে ঝকঝকে চৌরঙ্গী, সে বাজ দোকানের হরিবলুঠ দেওয়া কলেজ স্ট্রীট, সে বাহু ফুলকাটা মোজয় কার্পেট পাশে বালিগঞ্জ, সে বাহু ভ্যাপসা গন্ধ বড়বাজার, সে বাহু অঙ্কে গড়ায়ে সম্পূর্ণ পঞ্চমাস্ক নাটক, সে বাহ্ রহস্যের বাজনা ভরা একাপ্তিঙ্গা, সে বাড় এয়ার কন্ডিশাগুহেয়ার কাটিং সেলুন, সে বান্ধ পটলডাতার মেস।আকর্ষণের তাঁরতায় কেউ কম যায় না। ওই আকর্ষণের জাল ভেদ করে দৃষ্টি প্রসারিত হবে না স্কুলের মাঠে, নদীর ধারে, জ্যোৎস্না ঢালা উঠোনে।যদি কোথাও গিয়ে পড়ে সে দৃষ্টি, তা হয়তো পড়বে তার কাদায় হাঁটু বসা হাম্মায়। তার সাপ ব্যাং বিশ্বের।
পৃষ্ঠা-৯১
শহর কলকাতা যে এর সমস্ত ঐশ্বর্যই আত্মসাৎ করে রেখে দিয়েছে, তা মনে পড়বে না।না, মনে পড়বে না। কলকাতা যাকে একবার গ্রাস করে, তাকে আর ফেরৎ দেয় না।কিন্তু নিমাইয়ের ভবিষ্যৎটা কী তা কে বলতে পারে এখন?এখন তো নিমাই শুধু এক আশ্রয় থেকে চ্যুত হয়ে অক্ষ এক আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে। যার সামনেটা সম্পূর্ণ অজানা।অজানা-তাই জেনে যাওয়া পিছনটাই এখনো যেন টানতে চাইছে।তাই বিষন্ন একটি পরিমণ্ডলের মধ্যে চিন্তাটা পাক খাচ্ছে নিমাইয়ের।দিদিমা যে কাল বলে রেখেছিলেন, পাঁজিটা একটু দেখো দাদা, কাল বোধ হয় একাদশী, সেই ইঙ্গিতময় করাটা মনে পড়ছে। অনে পড়ছে-বোকা হলে রেখেছিল, ‘সামনের শনিবার তুমি আমায় খেলা দেখাতে নিয়ে যাবে, বুঝলে? আমায় কেউ নিয়ে যায় না।অবচ একাও যেতে দেয় না। নিয়ে যায়ে তো?’ সেই কথাটা হনে পড়ছে।আসবার সময় যে বেলারাণী মুখ অল্প দিকে ফিরিয়ে বলেছিলেন, ‘সুটকেসটা নিয়ে যাবে না কেন? ওটা তোতোমারই ছিল।’ সেটা মনে পড়ছে। হয়তো এই ঋক্সে বেশী করে মনে পড়ছে, এই প্রথম বেলারাণী নিমাইকে ‘তুমি, বললেন বলে।যেগুলো মনে পড়াতে ইচ্ছে হয় না, সেইগুলোই ক্ষর। কর খার সঞ্চর, এই নিয়েই তো এগিয়ে চলা। এর মধ্যে থেকেই কেউ বা অনুতকুঞ্জের সন্ধান পায়, কেউ বা স্বর্গ হারায়।