কন্যাহরণ
পৃষ্ঠা ০১ থেকে ০৫
পৃষ্ঠা:০১
আচ্ছা মশাই, এই কম্পার্টমেন্টে এতক্ষণ আর কেউ ছিল না। আমি নিযয্যি একা। বাইরে ঝড়-বাদল চলছে। ট্রেন দুটো স্টেশনে থামল না, অথচ হঠাৎ দেখছি আপনি আমার দু’ফুট দূরত্বে বসে আছেন। ব্যাপারটা কি বলুন তো! আপনি ভূত-টুত নাকি মশাই? ভূত! তা ভূত বললেও তেমন ভুল হয় না। তবে কিনা ভূতের চেয়ে আমাকে বরং ভূতপূর্বই বলা যায়। আমি যা ছিলুম এখন আর তা নেই কিনা। কেন মশাই, আপনার তো দেখছি কাঁচা বয়স, চেহারাখানাও ভালো, তা এই বয়সে ভূতপূর্ব হওয়ার শখ কেন? বর্তমানটা কি কিছু খারাপ? দিব্যি তো বেঁচেবর্তে আছেন। একে আর বেঁচেবর্তে থাকা বলবেন না। পরেশ ঘোষ গতকালই আমার চাকরিটা খেয়ে নিয়েছে। বেঁচে থাকা যদি বলেন তাহলে বলব, শ্বাসটুকুই যা চলছে, আমি আর সত্যিকারের বেঁচে নেই। তা পরেশ ঘোষ লোকটা কে? বড কারবারী নাকি? পরেশ ঘোষের কীর্তির কথা আর কবেন না। তার হাজারো কারবার। কয়েকশো কর্মচারী। কোটি কোটি টাকা। তা চাকরিটা গেল কেন মশাই? চুরি-টুরির ব্যাপার নেই তো! চুরি। তা একরকম চুরিও বলতে পারেন। তবে টাকা-পয়সা বা সোনা- দানা নয়। তাহলে? পরেশ ঘোষের ছোটো মেয়ে কমলিকা চুরি হয়ে গেল কিনা। মেয়ে চুরি? সে তো খুব খারাপ ব্যাপার। এ কাজটা আপনি ঠিক করেননি মশাই। মালিকের মেয়ে বলে কথা, তার ওপর তাকে জবরদস্তি হরণ করা-না মশাই, এটা খুব খারাপ কাজ হয়েছে। তার ওপর যদি নাবালিকা হয়ে থাকে তাহলে তো পুলিশ কেস।
পৃষ্ঠা:০২
না মশাই, জবরদস্তিও নয়, নাবালিকাও নয়। কমলিকার বয়স আঠারো পার হয়েছে। আর চুরি আমি করিওনি, করেছে নবকৃষ্ণ। আমি শুধু একটু সাহায্য করেছিলুম আর কি। নবকৃষ্ণটা আবার কে? নীলপুরের নবকৃষ্ণর নাম শোনেননি? সে হল গিয়ে নীলপুরের ডন। রোগাপটকা খেকুড়ে ডন নয়, রীতিমতো ডন-বৈঠক করা লম্বা-চওড়া, রাজপুত্রের মতো ডন। টাকাও মেলা, তবে কিনা তা মোটেই ভালো টাকা নয়, কালো টাকাই বলতে পারেন। তোলাবাজি, গুন্ডামানি, ব্যাংক ডাকাতির রোজগার। তা রোজগারের পন্থাটা ভালো না হলেও খরচের দিকটা কিন্তু খুব ভালো। কানা-খোঁড়া, উপোসী-কাপাসী, দীন-দুঃখী, অনাথ- নিরাশ্রয় সকলকেই কিন্তু দেয়-থোয় খুব। মানুষ হিসেবে ভারী ভালো, কিন্তু পরেশ ঘোষকে সেই কথাটা আজ অবধি কেউ বোঝাতে পারল না। নবকৃষ্ণের নাম শুনলেই পরেশ তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। আর সেই নবকেই কিনা পছন্দ করে বসল কমলিকা। একেই বলে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। ওই চক্করে পড়েই আমার সাড়ে সাত হাজার টাকার চাকরিটা গেল। বৃত্তান্তটা খুলে বললে হয় না? খুলেই বলছি মশাই। নবকৃষ্ণ নীলপুরের ডন হলেও পরেশ ঘোষের এলাকা আঁটপুরে সে কখনও দন্তস্ফুট করতে পারেনি। আঁটপুরে পরেশের পেয়ারের গুন্ডো হল সনাতন। সেও ছ’ফুট লম্বা, দশাসই মানুষ। দলবলও বিরাট। পরেশ ঘোষের কাছে নিয়মিত নজরানা পায়। তাই কমলিকার পক্ষে পালিয়ে গিয়ে নবর সঙ্গে জোটা খুব কঠিন ছিল। রক্তারক্তি, লাশ পড়া, বোমাবাজি কী যে হবে তা আর কহতব্য নয়। আমি আবার বেজায় ভীতু মানুষ। মনিবের মেয়ে গুন্ডার প্রেমে পড়ায় আমারই যেন শিরঃপীড়া।
পৃষ্ঠা:০৩
তা আপনি পিকচারে এলেন কি করে? নাঃ, আমি মোটেই পিকচারে ছিলাম না। এখনও নেই। পিকচারে থাকার কোনও ইচ্ছেই নেই আমার। পিকচারে থাকা খুব খারাপ জিনিস মশাই। আর যাই করুন, ভুলেও কখনও পিকচারে থাকবেন না। সে কথা তো আমিও বলি। পিকচারে থাকতে চাই না বলেই তো আমি কখনও নিজের ফটো পর্যন্ত তোলাই না। তা আপনার পিকচারে আসার দরকারটা কি পড়ল মশাই? সেটাই তো দুঃখের কথা দাদা। খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে। কেন হলটা কি? মশাই কেন? তারপর শুনবেন? তাহলে বলেই ফেলি। কথা বেশিক্ষণ চেপে রাখলে পেটে বায়ু হয় বুঝলেন। যা বলেছেন। তাহলে বলেই ফেলি। আমি আমার চাকরিটার কথা বোধহয় আপনাকে বলিনি! বলেছেন বৈকি। বলেছেন, আপনার চাকরিটা গেছে। সেটা পরেশ ঘোষ খেয়ে ফেলেছে। তা বলেছি। কিন্তু তার আগে জানা দরকার চাকরিটা কি ছিল। তা বটে। তা আপনি চাকরিটা কি করতেন মশাই? আপনি কখনও রোগন জুস খেয়েছেন? কিংবা দম পুখ। কখনও হ্যান্ডি কাবাব চেখে দেখেছেন কি? দূর মশাই। নামই শুনিনি। পাতে চুনো মাছ জোটাতে পকেট ফর্দাফাঁই হয়ে যাচ্ছে, তার ওপর রোগন জুস! তা ওসব বিটকেল জিনিসের কথা উঠছে কেন? ওখানেই তো প্যাঁচটা রয়েছে মশাই। আমি হলুম গে পরেশ ঘোষের শেফ। শেফ মানে বোঝেন? কথাটা যেন শুনেছি বাপু।
পৃষ্ঠা:০৪
শেফ মানে বড় বড় হোটেলের রাঁধুনি না? যে আজ্ঞে। এদের রন্ধনশিল্পী বলতে পারেন, শুধু রাঁধুনি বললে এদের অপমান করা হয়। তা আপনি কি মশাই, রাঁধুনি? তাও বলতে পারেন। রন্ধনশিল্পী। ওই একই কথা হল মশাই। আসল কথা হল, আপনি রান্না-বান্না জানেন। যে আজ্ঞে। তবে সেটা রীতিমতো শিখতে হয়েছে। তা তো শিখতেই হবে, নইলে হবে কি করে? আচ্ছা মশাই, পরেশ ঘোষ কি খুব খাউস্তি লোক নাকি? পরেশবাবু নিজে আর কত খাবেন। তবে নিত্যি তাঁর বাড়িতে পার্টি-টার্টি থাকে, মেলা ভারিক্কি লোকজনের নেমন্তন্ন হয়, দারোগা, মন্ত্রী, ম্যাজিস্ট্রেট, নেতা। সুন্দরী মেয়েছেলেরাও সব আসে। ফলে রোজই নানারকম রান্নার ফরমাশ হয়। আমার আন্ডারে আরও চারজন কুক আর জনা পাঁচেক জোগালি আছে। এলাহি ব্যাপার মশাই। রান্নার সঙ্গে কমলিকা হরণের সম্পর্ক কি? আছে মশাই আছে। সেদিন ছিল পরেশ ঘোষের জন্মদিন। তা বাবু সেদিনটা পুজো-আর্চা নিয়েই থাকেন। আর রাত্রে পেয়ারের লোক যারা তাদের ভোজে ডাকেন। এই পেয়ারের লোকেরা হল সনাতন আর তার দলবল, আর বাবুর যত যণ্ডা-গুন্ডা স্যাঙাৎ আছে, তারা। সেদিন বিরিয়ানি, কালিয়া, তন্দুরি আর রাবড়ির হুকুম হয়েছে। আমরা সকাল থেকেই ব্যস্ত। এমন সময়ে কমলিকা এসে রান্নাঘরে হাজির। ভারী মাখো মাখো আবদারের গলায় বলল, বাবলুদা, আজ তো বাবার জন্মদিন, আজ আমিও তোমার সঙ্গে হাত লাগিয়ে একটু রান্নাবান্না করব। মালিকের মেয়ে বলে কথা, না তো আর করতে পারি না। ঘাড়ে একটা বৈ তো দুটো মাথা নেই।
পৃষ্ঠা:০৫
তা তো বটেই। তারপর কি হল? মনে হয় হাতছিগ্ধ করে কোনও ওষুধ-বিসুদ নিয়ে এসেছিল। কোন ফাঁকে রান্নায় ওষুধ মিশিয়ে দেয়। বলেন কি মশাই। তবে আর বলছি কি। ভোজের মাঝপথেই বেশির ভাগ লোকের হাই উঠতে লাগল। শুধু ভোজনই নয়, পানের ব্যবস্থাও ছিল। তার ওপর কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ। ভোজ ভালো করে শেষ হওয়ার আগেই গোটা চত্বরে কেবল নাকের ডাক শোনা যাচ্ছিল। আমি ভীতু মানুষ, সাবধানীও। বাবুর বাড়ির ভালো-মন্দ কখনও খাই না। নিজের আলাদা ঝোল-ভাত রান্না করে নিই। তাই আমি হাঁ করে ব্যাপারটা বুঝ- বার চেষ্টা করছিলুম। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। আর সেই সময়েই দেখলুম রাত বারোটা নাগাদ কমলিকা তার ছোট্ট গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে বলল, গাড়িতে উঠে পড়ো তো বাবলুদা। আমাকে এগিয়ে দাও। উঠলেন? উঠলুম। ঘাড়ে কটা মাথা বলুন। কমলিকা গাড়ি চালাচ্ছে, আমি পাশে বসে জিগ্যেস করলুম, নবকৃষ্ণের ঠেক- এ যাবে তো! শুনে ফিক করে হেসে বলল, কে নবকৃষ্ণ? আমি অবাক হয়ে বলি, কেন, সেই যে নীলপুরের ডন নবকৃষ্ণ। কমলিকা ঠোঁট উল্টে বলল, নবকৃষ্ণ কি তোমার মতো রোগন জুস আর দম পুত্ রাঁধতে পারে? আমি বললুম, নবকৃষ্ণ কোন দুঃখে রাঁধতে যাবে। সে তো ডন। কমলিকা গম্ভীর হয়ে বলল, আমি তোমার সঙ্গেই পালাচ্ছি। অ্যাঁ। বলেন কি মশাই? বলল ওকথা? যে আজ্ঞে। শুনে আমারও মাথায় বজ্রাঘাত। তা আপনি কি করলেন? ঘাড়ে তো একটা বৈ দুটো মাথা নেই মশাই। তবে খুব বিনয়ের
পৃষ্ঠা:০৬
সঙ্গেই একটু বোঝানোর চেষ্টা করলুম। কি বোঝালেন? বললুম, একজন রাঁধুনির সঙ্গে- তা হোক না কেন পাশ করা রন্ধনশিল্পী, তার সঙ্গে তার পালানো ঠিক হচ্ছে না। তখন কি বলল? একটা ধমক দিয়ে বলল, চুপ করে বসে থাকো। মুখে মুখে কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না। তোমাকে আমি অনেকদিন ধরেই ইশারা ইঙ্গিত করেছি। তুমি হাঁদারাম বলে বুঝতে পারোনি। এঃ হেঃ, আপনি কি সত্যিই হাঁদারাম? তা বোধহয় আছি একটু। নইলে পরেশ ঘোষ আমার চাকরিটা কি খেতে পারত? পরেশ ঘোষ আপনাকে কত মাইনে দিত যেন! মাত্র সাড়ে সাত হাজার। সেটা কি কম না বেশি? খুবই কম। আমার এলেমের লোকেরা মাসে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা বেতন পায়। তা আপনি এত কমে রাজি হলেন কেন? সেটা বড় গুহ্য কথা। মোটেই গুহ্য নয়। আমি বেশ বুঝতে পারছি, কমলিকার জন্য আপনারও একটু টনটনানি ছিল। ঠিক কিনা ম বলুন। তা কমলিকা এখন কোথায়? আমাদের বাড়িতে ঢুকে রাজ্যপাট দখল করে বসে আছে। আর আমাকে দেখুন, ঝড়-বাদলা মাথায় করে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি। পেলেন কিছু? ওই রয়াল বেঙ্গল-এ একটা জুটেছে কোনওক্রমে। বেতন কত? সত্তর হাজার। আর বোনাস। দিন মশাই, বয়সে ছোটো হলেও, পায়ের ধুলো দিন।