কালেমা
পৃ্ষ্ঠা ০১ থেকে ০৫
পৃষ্ঠা:০১
কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এর মর্মার্থ
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এই বাক্যটি ধর্মের মূলমন্ত্র এবং ইসলামী মিল্লাতের ভিত্তি। এই কালেমার দ্বার আল্লাহ পাক মুসলিম ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করেন। এরই প্রতি সমস্ত নবী-রাসূলের আহবান ছিল কেন্দ্রীভূত। এরই বাস্তবায়নে নাজেল হয় পবিত্র গ্রন্থাবলী, সৃষ্টি করা হয় সমগ্র জ্বিন ও মানবকুল। আমাদের পিতা হযরত আদম (আঃ) সর্বপ্রথম এই কালেমার প্রতি আহবান জানান তাঁর সন্তান-সন্ততিদের। তিনি ও তাঁর বংশধর হযরত নূহ (আঃ) পর্যন্ত এই কালেমার উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। অতঃপর নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ে এবাদতের ক্ষেত্রে শিরক দেখা দিলে আল্লাহ পাক নূহ (আঃ)-কে তাদের প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন। তিনি তাদেরকে আল্লাহর একত্ববাদের (তাওহীদ) প্রতি আহবান জানান এবং বলেন: হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহরই এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের আর কোন উপাস্য নেই।” হযরত নূহ (আঃ)-এর পর এইভাবে হযরত হুদ, ছালেহ, ইব্রাহীম, লুত, শুআইব ও অন্যান্য সকল
পৃষ্ঠা:০২
রাসূলগণও তাঁদের স্ব স্ব জাতিকে এই কালেমা অর্থাৎ “লা ইলাহা ইল্লাহ”-এর প্রতি, আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি এবং তিনি ভিন্ন অন্যের এবাদত বাদ দিয়ে কেবল তাঁরই জন্য তা “খালেছ” করার আহবান জানান। সর্বশেষ এই কালেমার বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি এসে প্রথমে তাঁর সম্প্রদায়কে তাওহীদের প্রতি আহবান করে বলেনঃ “হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা বল- আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই, তোমাদের জীবন সফল হয়ে যাবে”। তিনি তাদেরকে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য এবাদত খালেছ করার আহবান জানান এবং তাদের বাপ-দাদা পূর্বপুরুষগণ পরম্পরায় আল্লাহর সাথে যে শিরক, প্রতিমাপূজা, পাথর, বৃক্ষ ও অন্যান্য বস্তুর এবাদত চলে আসছে, তা বর্জন করতে বলেন। মুশরিকরা তাঁর এই আহবান সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলে উঠলোঃ أجَعَلَ الْآلِهَةً إِلَيْهَا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْ عُجَابٌ “তিনিতো অনেক মা’ বুদের বদলে এক মাবুদ স্থির করে নিলেন। এটাত অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়।” (সূরা ছোয়াদ-৫)
পৃষ্ঠা:০৩
কারণ, মুশরিকরা মূর্তি-প্রতিমা, ওলী-দরবেশ, গাছ বৃক্ষ ইত্যাদির এবাদতে অভ্যস্থ ছিল। তারা এই সবের নামে জবাই করত, মানত করত এবং তাদের প্রতি আপন আপন প্রয়োজন পূরণ ও দুঃখ-কষ্ট দূর করার আবেদন জানাত। ফলে, তারা এই তাওহীদি কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, এই কালেমা আল্লাহ ব্যতীত তাদের অন্য সব মাবুদ বা উপাস্যকে বাতিল প্রতিপন্ন করে। আল্লাহ তা’আলা সূরা ছাফাতের ৩৫ ও ৩৬ নম্বর আয়াতে বলেন:إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ وَيَقُولُونَ أَبِنَّا لَتَارِكُواءَ الهَتِنَا لِشَاعِرِ مَجْنُونِ “তাদের নিকট ‘আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই’ তারা বললে অহঙ্কার করত এবং বলত আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের মা’ বুদগণ বর্জন করব।” মূলতঃ মুশরিকরা তাদের অজ্ঞতা, ভ্রান্তি ও একগুয়েমী বশতঃ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাগল কবি বলে আখ্যায়িত করত। যদিও তারা সম্যকভাবে জানত যে, তিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি কোন কবি ছিলেন না। বস্তুতঃ অজ্ঞতা, অত্যাচারী স্বভাব, আগ্রাসী চরিত্র এবং সমাজে ভ্রান্তি, মিথ্যা ও অবাস্তব তথ্য প্রচারের ঐকান্তিক আগ্রহই ছিল তাদের
পৃষ্ঠা:০৪
সত্য গ্রহণের পথে প্রধান অন্তরায় সুতরাং যে ব্যক্তি এই কালেমার অর্থ অনুধাবন করবে না এবং কাজের মাধ্যমে নিজের জীবনে এর বাস্তবায়ন করবে না, সে মুসলিম হতে পারেনা। মুসলিম সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ পাকের একত্ববাদে বিশ্বাস রাখে এবং যাবতীয় এবাদত অন্য কারো পরিবর্তে একমাত্র আল্লাহর জন্যই খাছ করে, তাঁরই জন্য ছালাত (নামাজ) প্রতিষ্ঠা করে, ছিয়াম (রোজা) পালন করে, তাঁকেই ডাকে, তাঁরই সাহায্য কামনা করে, তাঁরই উদ্দেশ্যে সে মানত করে, জবাই করে। এইভাবে সকল প্রকার এবাদত সে কেবল আল্লাহ পাকের প্রতিই নিবেদন করে। একজন মুসলিম ব্যক্তির স্থির বিশ্বাস এই হয় যে, আল্লাহ পাকই কেবল এবাদতের যোগ্য। তিনি ব্যতিরেকে আর কেউ এর হকদার নয়। চাই সে হোক নবী, ফেরেশতা, ওলী, প্রতিমা, বৃক্ষ, জ্বিন বা অন্য কিছু; এরা কেউ এবাদতের যোগ্য হতে পারেনা। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ وقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ম”তোমার প্রভু প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারো এবাদত তোমরা করবেনা।” -(সূরা ইসরা-২৩)
পৃষ্ঠা:০৫
এটাই হলো কালেমায়ে لا إله إلا الله এর মর্মার্থ। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার উপাস্য আর কেউ নেই। কালেমা এর মধ্যে অস্বীকারসূচক ও স্বীকৃতিসূচক উভয় দিক রয়েছে। এই কালেমায়, একদিকে যেমন আল্লাহ বতীত অন্য কারো উপাস্য হওয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করা হচ্ছে, তেমনি অপর দিকে এর দ্বারা একমাত্র আল্লাহ পাকেরই উপাস্য হওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। তাই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্যগুণে বিশেষিত করলে তা হবে বাতিল। কারণ, এই গুণ আল্লাহ পাকেরই প্রতিষ্ঠিত অধিকার। আল্লাহ তা’আলা বলেন: ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ “তা এই জন্য যে, আল্লাহ তিনিই সত্য এবং ওরা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে তা বাতিল।” (সূরা হাজ্জ-৬২) সুতরাং এবাদত একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য, অন্য কারো নয়। কাফেররা যে এই এবাদত অন্যের প্রতি নিবেদন করে, তা সম্পূর্ণ বাতিল কাজ এবং এটা অপাত্রে রাখার শামিল। আল্লাহ তা’আলা বলেন: يَتَأَيُّهَا خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
পৃ্ষ্ঠা ০৬ থেকে ১০
পৃষ্ঠা:০৬
“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের এবাদত কর, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে, তোমরা মুত্তাকী হতে পার।” -(সূরা বাকারা-২১) কুরআন শরীফের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা ফাতেহার একটি আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন:إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ “আমরা শুধু তোমারই এবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য কামনা করি।” আল্লাহ পাক মুমিনগণকে এইভাবে বলতে নির্দেশ করেছেন: “হে আল্লাহ! আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং একমাত্র তোমারই নিকট সাহায্য কামনা করি। আল্লাহ পাক আরও বলেন:وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا “তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং এতে তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করোনা।” (সূরা নিসা-৩৬) আল্লাহ পাক – অন্যত্র বলেন:وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর এবাদত করতে।” (সূরা বায়্যিনা-৫) আল্লাহ পাক আরও বলেনঃ
পৃষ্ঠা:০৭
فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ “আল্লাহর এবাদত কর, তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে। জেনে রাখ, খালেছ আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য।” -(সূরা যুমার-২-৩) এইভাবে আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা একথাই প্রমাণ করে যে, এবাদতের যোগ্য একমাত্র আল্লাহ তা’ আলাই। এতে সৃষ্টির কোন অংশ নেই। এ-ই হচ্ছে কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এর মর্মার্থ। এর হাকীকত ও দাবী হলো, আপনি আল্লাহ পাকের তরেই সমূহ এবাদত খাছ ও খালেছে করবেন এবং তিনি ব্যতীত অন্য সবার ক্ষেত্রে এর অস্বীকৃতি জানাবেন। জানা কথা, এই বিশ্বজগতে আল্লাহ ব্যতীত তাঁর অনেক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবাদত চলছে। অতীতেও আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তি-প্রতিমা, ফেরাউন ও ফেরেশতাদের এবাদত হয়েছে, আল্লাহকে ছেড়ে কোন কোন নবী রাসূল ও নেক লোকদেরও এবাদত করা হয়েছে। এসবই ঘটেছে। তবে তা হয়েছে বাতিল ও সত্যের পরিপন্থী। সত্যিকার মাবুদ তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’ আলা। তিনিইতো হলেন এবাদতের একমাত্র যোগ্য ও অধিকারী। আল্লাহ পাক বলেন:
পৃষ্ঠা:০৮
“তা এজন্য যে, আল্লাহই সত্য এবং ওরা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে তা মিথ্যা। আল্লাহ, তিনি তো সুউচ্চ- মহান। (সূরা লুকমান-৩০) [এই হলো ইসলামের প্রথম ভিত্তি কালেমা তাইয়্যেবার প্রথম অংশ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সার কথা।]
পৃষ্ঠা:০৯
আল্লাহর সাথে শিরক-এর বিশ্লেষণ
ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করার নাম শিরক। যেমন, প্রতিমা-মূর্তি বা অন্য কাউকে ডেকে তার নিকট সাহায্য কামনা, তার জন্য মানত, বা তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়া বা রোজা পালন করা বা যবেহ করা, এইভাবে বাদাভীর উদ্দেশ্যে বা ইদরুসের উদ্দেশ্যে যবেহ করা বা কোন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে নামাজ পড়া অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বা ইরাকস্থ শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী, ইয়ামনস্থ ইদরুস, মিশরস্থ বাদাভী বা অন্যান্য মৃত বা যারা গায়েব তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা, এইসব কাজের নাম শিরক। এইভাবে কেউ যদি নক্ষত্ররাজি বা জ্বিনদের ডেকে তাদের কাছে ফরিয়াদ করে বা সাহায্য কামনা করে বা এ জাতীয় এবাদত কর্মের কোন একটি যখন কোন জড় সৃষ্টি, মৃত বা অনুপস্থিত কারো জন্য নিবেদন করে তখন তা আল্লাহর সাথে শিরক নামে আখ্যায়িত হবে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেনঃ ولو أشْرَكُوا الحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ
পৃষ্ঠা:১০
“তারা যদি শির্ক করত তাহলে তাদের সব কৃতকর্ম নিষ্ফল হয়ে যেত”। (সূরা আনআম-৮৮) আল্লাহ তা’আলা আরও এরশাদ করেন:وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَمِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنْ عَمَلَكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الخَاسِرِينَ “তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্বে অতীত সমস্ত রাসূলগণের প্রতি অবশ্যই এ বার্তা পাঠানো হয়েছে, তুমি যদি আল্লাহর সাথে শিরক করতাহলে তোমার সমস্ত নেক আমল অবশ্যই বৃথা যাবে। আর, তুমি নিঃসন্দেহে বিষম ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” শিরকের মধ্যে একটি হল পূর্ণভাবে গায়রুল্লাহর ইবাদত করা। এটাকে শিরক ও বলা হয়, কুফুরীও বলা হয়। যে আল্লাহ তা’আলা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে অন্যের উদ্দেশ্যে ইবাদত নির্দিষ্ট করে যেমন বৃক্ষ, প্রস্তর, মূর্তি জ্বিন বা কোন মৃত ব্যক্তি যাদেরকে তারা আওলিয়া নাম দিয়ে থাকে, তাদের ইবাদত করে, তাদের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ে রোজা রাখে এবং আল্লাহকে পুরোপুরি ভুলে যায়, এটা হবে সবচেয়ে বড় কুফুরী ও জঘন্যতম শির্ক। (আল্লাহর নিরাপত্তা কামনা করি।) এইভাবে যারা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং বলে: মা’বুদ বা উপাস্য বলতে কেউ নেই এবং এই
পৃ্ষ্ঠা ১১ থেকে ১৮
পৃষ্ঠা:১১
পার্থিব জীবন একটি বস্তুগত ব্যাপার মাত্র। সমাজতন্ত্রী ও নাস্তিকরা যেমন বলে থাকে, এরা হলো চরম পর্যায়ের কাফের, মুশরিক ও পথভ্রষ্ট। (আল্লাহ তাআলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি।) মোট কথা, এ জাতীয় সব আক্বিদাহ বিশ্বাসকে আল্লাহর সাথে শিরক ও কুফুরী বলা হয়ে থাকে। কোন কোন লোক স্বীয় অজ্ঞতা বশতঃ মৃত ব্যক্তিকে ডাকা এবং তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করাকে ওসিলা (মাধ্যম) নামে আখ্যায়িত করে এবং তা জায়েজ মনে করে। এটা মারাত্মক ভুল, কেননা, একাজ আল্লাহর সাথে শিরক হিসেবে পরিগণিত যদিও অজ্ঞ লোকেরা বা মুশরিকরা এটাকে “ওসিলা” নাম দিয়ে থাকে। এটাই হলো মুশরিকদের ধর্ম আল্লাহ তাআলা যার নিন্দা ও দোষারূপ করেছেন। এটাকে অস্বীকার এবং এথেকে সতর্ক করার জন্য আল্লাহ তা’ আলা রাসূলগণ প্রেরণ করেছেন এবং কিতাবসমূহ নাজিল করেছেন। আল্লাহ তাআলার বাণীঃ يأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় কর, এবং তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উপায় তালাশ কর।” (সূরা মায়েদা-৩৫)
পৃষ্ঠা:১২
এই আয়াতে যে ওসিলার কথা বলা হয়েছে তা হলো আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের দ্বারা তাঁর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা”। সমস্ত ওলামায়ে কেরামের নিকট এটাই ওসিলার অর্থ। সুতরাং আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করা একটি ওসিলা, আল্লাহর জন্য যবেহ করা একটি ওসিলা, যেমন- কোরবানী দেওয়া হজ্জের হাদী দেওয়া এইভাবে সিয়াম পালন করা ও একটি ওসিলা। ছাক্বাহ প্রদান একটি ওসিলা আল্লাহ পাকের জিকির, কুরআন তেলাওয়াতও ওসিলা এটাই হলো আল্লাহ তাআলার বাণী: وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَة এর মর্মার্থ অর্থাৎ আল্লাহ পাকের আনুগত্যের দ্বারা তাঁর নৈকট্য লাভের চেষ্টা কর। ইবনে কাসির, ইবনে জরীর, ও বাগাভী প্রমুখ মফাস্সিরগণ একবাক্যে বলেছেন এর প্রকৃত অর্থ হলো: আল্লাহর আনুগত্য দ্বারা তাঁর নৈকট্য তালাশ কর এবং তোমরা যেখানেই থাক তাঁর প্রবর্তিত বিষয়াদি যথা- সালাত, সিয়াম, ছাদকা ইত্যাদি দ্বারা তা কামনা কর। এইভাবে আল্লাহ তা’আলা অন্য একটি আয়াতে এই অর্থ ব্যক্ত করেছেন, আর তা হলো : أَوْنَتَبِكَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ
পৃষ্ঠা:১৩
“তারা যাদেরকে আহবান করে তারা নিজেরাই তো নিজেদের রবের নৈকট্য লাভের জন্য ওসিলা তালাশ করে যে তাদের মধ্যে কে অধিক নিকটবর্তী তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার আযাবকে ভয় করে।” (সূরা ইসরা-৫৭) এভাবে রাসূলবর্গ ও তাঁদের অনুসারীগণ আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ঐসব বিষয়কে ওসিলা হিসেবে গ্রহণ করেছেন যা তিনি প্রবর্তিত ও রেখেছেন। যেমন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, রোজা, নামাজ, জিকির, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি। আর কোন কোন লোকের ধারণা যে ওসিলা মানে মৃত ব্যক্তিদের ডাকা ও আওলিয়াদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা তা একটি বাতেল ধারণা, এটা মুশরিকদেরই আক্বিদাহ যাদের সম্পর্কে আল্লাহ এরশাদ করেন : ويعبدون اللَّهِ ينفعهم “তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুর ইবাদত করছে যা তাদের ক্ষতিও করতে পারেনা, উপকারও করতে পারেনা। তদুপরি তারা বলে যে এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” আল্লাহ তাদের এই বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে বলেন: قُلْ أَتُنبِعُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ
পৃষ্ঠা:১৪
سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ “(হে রাসূল) তাদেরকে বল তোমরা কি আল্লাহকে আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দিচ্ছ যা তিনি জানেন না? তিনি পূত ও পবিত্র, তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি বহু উর্ধ্বে।” (সূরা ইউনুস-১৮) আল্লাহ পাক আমাকে ও সকল মুসলমানকে সঠিকভাবে তাঁর দ্বীন অনুধাবনের এবং এর উপর অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন। আর আমাদের সকল কুপ্রবৃত্তি ও পাপাচারের অমঙ্গল থেকে তিনি আশ্রয় প্রদান করুন। তিনি সর্বশ্রোতা, অতি সন্নিকটে। আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবগণ এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর সঠিক অনুসারীদের উপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন।
পৃষ্ঠা:১৫
প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন-১: এবাদতের অর্থ কি?
উত্তর: এবাদতের অর্থ অত্যন্ত বিনীত ও নম হয়ে একমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করা এবং সকল বিধি-নিষেধ পালনের মাধ্যমে তাঁরই সম্পূর্ণ অনুগত হয়ে চলা। ওলামাগ- ণের ভাষায় ব্যাপক অর্থে: প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য যেসব কথা ও কাজে আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হন এবং যা তিনি পছন্দ করেন তারই নাম এবাদত, যেমন- ঈমান, ইসলাম, দো’আ, আশা, ভয়, আশ্রয় প্রার্থনা, সাহায্য কামনা, জবেহ করা, মানত করা ইত্যাদি।
প্রশ্ন-২: তাওহীদের অর্থ কি?
উত্তর: তাওহীদ অর্থ আল্লাহ তা’আলাকে তার বৈশিষ্ট্যে একক ও অদ্বিতীয় বলে স্বীকার করা। অর্থাৎ এই বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ পাক তাঁর প্রভুত্বে, তাঁর সর্বসুন্দর নাম ও গুণাবলীতে এবং তাঁর এবাদতে একক, এতে তাঁর কোন শরীক নেই। একেই আল্লাহর একত্ববাদ বলা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন-৩: তাওহীদ কত প্রকার ও কি কি?
উত্তর: তাওহীদ তিন প্রকার। যথা: (১) আল্লাহর
পৃষ্ঠা:১৬
প্রভুত্বে তাওহীদ; (২) তাঁর নাম ও গুণাবলীতে তাওহীদ: এবং (৩) তাঁর এবাদতে তাওহীদ। ১। প্রভুত্বে তাওহীদ: এই প্রকার তাওহীদকে তাওহীদে রুবুবিয়্যাত বলা হয়ে থাকে। এর অর্থ-হলো এই কথা স্বীকার করা যে, আল্লাহ পাক সৃষ্টিকর্ম, রেযেক প্রদান, জীবন-মৃত্যু দান এবং আকাশ-জমীন তথা নিখিল বিশ্বজগতের সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় একক ও অদ্বিতীয়। আরো স্বীকার করা যে, কিতাবসমূহ নাজেল ও নবী-রাসূলগণ প্রেরণের মাধ্যমে শাসন ও বিধি- বিধান প্রবর্তনে আল্লাহ তা’আলা একক এইসব ক্ষেত্রে তাঁর কোন শরীক নেই। আল্লাহ পাক বলেন: الا لهُ الخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ “জেনে রাখ, সৃজন ও নির্দেশ তাঁরই, বরকতময় আল্লাহ, নিখিল বিশ্বজগতের প্রভু প্রতিপালক।” (সূরা-আরাফ-৫৪) ২। নাম ও গুণাবলীতে তাওহীদ: এর অর্থ হলো, আল্লাহ পাককে ঐসব নাম ও গুণাবলীর দ্বারা বিশেষিত করা, যদ্বারা কুরআন শরীফে তিনি নিজেকে এবং বিশুদ্ধ হাদীসসমূহে তাঁর রাসূল তাঁকে বিশেষিত করেছেন। আর, এগুলোকে আল্লাহ পাকের শানের উপযোগী পর্যায়ে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সাদৃশ্য, উপমা, অপব্যখ্যা বা
পৃষ্ঠা:১৭
নিষ্ক্রিয়তার কোন লেশ না থাকে। আল্লাহ পাক আরো বলেনঃ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السميع البصير “তাঁর মত কিছুই নেই এবং তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা শুরা-১১) ৩। এবাদতে তাওহীদ: এই প্রকার তাওহীদকে তাওহীদে উলুহিয়্যাহ বলা হয়ে থাকে। এর অথ হলো, এককভাবে আল্লাহ তা’আলারই এবাদত করা। তিনি ব্যতীত অন্য কারো এবাদত না করা, অন্য কারো কাছে দো’আ বা আশ্রয় প্রার্থনা না করা, একমাত্র তাঁরই সাহায্য কামনা করা। তাঁরই উদ্দেশ্যে মানত, জবাই ও কুরবানী ইত্যাদি সর্বপ্রকার ইবাদত নিবেদন করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন: قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ “(হে রাসূল) বল, আমার ছালাত (নামাজ), আমার যাবতীয় এবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এতে তাঁর কোন শরীক নেই, আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং মুসলমানদের মধ্যে আমিই প্রথম।” (সূরা আল-আনআম-১৬২)
পৃষ্ঠা:১৮
আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন: فَصَلِّ لِرَبِّكَ والحر “সুতরাং তোমার প্রভু প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত (নামাজ) আদায় এবং কুরবানী কর।” (সূরা কাওছার-২) আল্লাহই আমাদের তাওফীকদাতা।