Skip to content

ইরাক যুদ্ধ মানবতার কান্না

পৃষ্ঠা ১ থেকে ১৫

পৃষ্ঠা:০১

ইঙ্গ-মার্কিন পরিকল্পনা এবং ইরাক যুদ্ধ

হঠাৎ করেই একদিন কাক ডাকা ভোরে তখনও ভোরের আকাশ পরিষ্কার হয়নি, দজলা, ফোরাত, টাইগ্রিস নদীর পানি মিসাইল রকেট আর বিরামহীনভাবে বোমার বিস্ফোরণে ফুলে ফেঁপে উঠলো। দিনটি ছিল ২০ মার্চ ‘০৩। প্রকম্পিত হলো নাজাফ, মসুল, তিরকিত, বাগদাদ, কিরকুক- মর্টার আর ট্যাংকের গোলাবারুদের বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল ইরাকবাসীর। আগে এদেশে একটা প্রবাদ ছিলো ‘সাত সাগর পাড়ি দিয়ে।’-এখন অবশ্য আর সাত সাগর পাড়ি দিতে হয়না। আকাশ পথে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরাকের নিরীহ জনসাধারণের বুক ঝাঝরা করে ফেললো আমেরিকা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ইরাকে মারণাস্ত্র আছে-এই ছুঁতোয় দেশটির সবুজ বনানী আর শ্যামল কৃষি ক্ষেতে লোকালয়ে সর্বত্র যুদ্ধের আগুণ জ্বেলে দিল। এক ভয়ংকর যুদ্ধে রক্ত মাখা মাটি, গোধূলীর লাল আভায় রঞ্জিত হলো। সমতল ভূমির গম, ভূট্টা, ফসলের ক্ষেত পুড়ামাটিতে রূপ নিল। ইরাকের মাটি, মানুষ, প্রকৃতি এবং সমাজ জীবন যুদ্ধের ডামাডোলে হলো তছনছ। জলপাই রং এর ট্যাংকের বহরে ইরাকের মাঠ, ঘাট, প্রান্তর রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। ঘন ঘন বোমার বিস্ফোরণে ইরাকের বাতাস বিষাক্ত। মূহুর্তের মধ্যে ইরাকীদের সমস্ত স্বপ্ন এবং আশা ধূলিস্যাত হয়ে গেল। টিভির পর্দায় রক্তস্নাত ইরাকে বিপুল নারী-পুরুষ-শিশুর মৃত্যু যন্ত্রণার করুণ কাহিনীর ছবি দেখে বিষাদে মন কেঁদে উঠলো বিশ্ববাসীর। প্রেসিডেন্ট বুশ বর্তমান বিশ্বের মানব সম্পদকে সুন্দর সাজানো বাগানের প্রস্ফুটিত ফুল হিসাবে হয়তো দেখতে ভালবাসেন, তাই ইরাকের বাগানে বাগানে তিনি গ্রেনেডের ফুল ফোটালেন। কবির ভাষায় বলতে বলতে হয়- ‘ফুলের বাগান সবার মনেই আছে ফুল ফোটাতে সবাই নাহি পারে।’ ইরাকে বসরার গোলাপ বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হলো। বুশ-ব্লেয়ার, রামস্কেল্ড ও কলিন পাওয়েলের দল পৃথিবীতে সাজানো ফুলের বাগান দেখতে চান না- মানব সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে ধবংস করতে চান। আর ‘যে কথাটি বলা হলো না’ আমার কথা নায় তা বুশের অর্ন্তদাহের কথা। আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে বড় বুশ অর্থাৎ তার বাবা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকার সময় যে মারণাস্ত্রের সম্ভার ইরাককে দিয়েছিলো-সেগুলো

পৃষ্ঠা:০২

গেলো কোথায়? বুশের অর্ন্তদাহের কারণ সেখানেই। তাইতো বুশ-ব্লেয়ারের রাতের ঘুম হারাম। মারণাস্ত্র বা জীবাণু অস্ত্র অর্থাৎ Weapon for much destruction পাওয়া যাক আর না যাক-যে কোন অবস্থাতে ইরাকেই তা পেতে হবে। অন্ধকার যুগে মানুষের আদিম বাসনা ছিল- জোর প্রয়োগ করে ক্ষমতা দখল করা। আর বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক সভ্যতার নামে মানুষ যখন শিক্ষা, সংস্কৃতি-শিল্প, সাহিত্য বিকাশ এবং উৎকর্ষতা সাধনে বিজ্ঞান তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে ব্যতিব্যস্ত; তখন আন্তর্জাতিক সমাঝোতা ছাড়া কোন যুদ্ধ হলে-সে যুদ্ধ যে কত ভয়ংকর এবং ভয়াবহ হতে পারে তা যুদ্ধের ধবংসস্তুপ, আর গলিত পচা লাশ না দেখলে বোঝা যাবে না। পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর মধ্যেকার প্রবল ইচ্ছা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর খবরদারী করা, মোড়লগিরি করা। তাই বড় বড় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরাজ করছে আদিম প্রবৃত্তি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন নীতি। মারণাস্ত্র খোঁজার নামে শুরু হলো ইরাক যুদ্ধ। সভ্যতার প্রথম আলোতে উদ্ভাসিত মেসোপটেমিয়ার আদি সংস্কৃতি দখলদার বাহিনীর হাতে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। নিগৃহীত ও নির্যাতিত হলো সাধারণ নিরীহ মানুষ। যুদ্ধের নামে ইরাকে নিধন আর ধ্বংস যজ্ঞ চলতে থাকলো দিনের পর দিন। ইংরেজ কবি হ্যারোল্ড পিনটার বললেন ‘The US really beyond reasons now. There is only one comparison i.e. Nazi-Germany.’ মজার ব্যাপার হলো ইরাকীদের ওপর বর্বরতা, নৃশংসতা এবং ফ্যাসিবাদী এই যুদ্ধের মিত্র শক্তির অন্যতম হলো ইংরেজ অর্থাৎ ব্রিটেন আর এ যুদ্ধের চরম বিরোধিতা করেছে জার্মানী। বুশ-ব্লেয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যাচার, ভিত্তিহীন তথ্য একের পর এক প্রচার করলেন যা বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার আধুনিকায়নে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং তথ্য প্রযুক্তি বিজ্ঞানের মিলন মেলায় এক অভিনব প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না। সমগ্র পৃথিবীকে বোকা বানিয়ে পৃথিবীর সালিশদার জাতিসংঘকে অবিশ্বাসের নিগড়ে বন্দী করে ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সাদ্দামকে হটানোর যে পরিকল্পনা বুশ-ব্লেয়ার করলেন, তা শুধু অযৌক্তিক, অমানবিক নয় বরং চরম বর্বরতাও। নির্মম, নিষ্ঠুর, নির্লজ্জ যে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলো তাতে করে ইরাকীদের আনন্দ-উচ্ছ্বলতা ঘেরা প্রাণবস্তু দিনগুলি বিষাদে ভরে গেল-যুদ্ধোত্তর ইরাকে এখন বিউগলে বিষাদের করুণ সুর পৃথিবীর বাতাসে ভেসে বেড়ায়।

পৃষ্ঠা:০৩

জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক হ্যান্স রিক্স অকপটে স্বীকার করলেন- যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সনদ লংঘন করেছে। আরও বললেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদকে যুক্তরাষ্ট্র হেয় করেছে।’ অস্ত্র পরিদর্শক হিসাবে তিনি ও তার দল ইরাকে কোন মারণাস্ত্র খুঁজে পাননি। ফ্রান্স ও জার্মানীর ঘোর বিরোধিতার কারণে-জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র শক্তিগুলি সামরিক যুদ্ধ করেছে-এটা জাতিসংঘ পরিদর্শকদের প্রতি আস্থা নাই বুঝায়- যা জাতিসংঘের প্রতিও অবমাননাকর। বুশ-ব্লেয়ার ইরাকের হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, সংস্কৃতি শিক্ষার আলোক রশ্মিকে নিঃশেষ করতে চায়। কবির অমোঘ বাণী চিরন্তন সত্য তাই- ‘হাত বাড়াইলে বন্ধু সবাই হয় না পা বাড়ালেই পথিক হওয়া যায় না।’ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ইরাকের বন্ধু হতে চাইলেই বন্ধু হওয়া যায় কি? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ এবং সাদ্দামের বিকল্প এরকম অন্যায় যুদ্ধ হতে পারে না। এই যুদ্ধে নিরীহ জনগণের হৃদয়ে মিশে থাকা দুঃখ মুর্ছনায় কাতর ও শোকাহত অনুভূতি-আজ বিশ্ববাসীর হৃদয়ে মানবতার কান্না। ইরাকীদের নির্মল বিশ্বাসের ওপর বুশ-ব্লেয়ারের চপেটাঘাত-ক্বাবার বুকে লাগে যেন। ২০ মার্চ ‘০৩ গণ বিধবংসী মারণাস্ত্র খোঁজার অজুহাতে সর্বকালের যে  অসম যুদ্ধ ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী অপ্রত্যাশিতভাবে ইরাকে সংঘঠিত করলো-বলা হলো সাদ্দাম ছিলেন নির্দয়, নিষ্ঠুর, স্বৈরাচারী, জুলমবাজ গণহত্যাকারী শাসক। তাঁকে সরিয়ে গণতন্ত্র দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ইরাকে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করলো তা ছিল ইরাকে নিষিদ্ধ অস্ত্রভান্ডার খোঁজার নামে ছলনা, প্রতারণা এবং ভাওতাবাজী ইহা কেবল ইরাকে তেল সম্পদ লুট করার একটি কৌশলগত পরিকল্পনা এবং শঠ নাট্যাভিনয়। এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও পৃথিবীর মানুষকে বোকা বানানোর এক ষড়যন্ত্র এবং অনভিপ্রেত বর্বরতা যা কেবল মানব সভ্যতার গতিকে থামিয়ে দিতে পারে, লাঞ্ছনা করতে পারে এবং ধবংস করতে পারে। তেল সম্পদের প্রাচুর্য-ইরাককে বিশ্বাসনে অন্যতম ধনী দেশ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় ইরাকের তেল সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বুশ-ব্লেয়ার ইরাক আক্রমন করে দেশটিকে ক্ষত-বিক্ষত করলো। গত ১৯৯০ সনে ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলের পরপরই পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর সিদ্ধান্তের

পৃষ্ঠা:০৪

ফলে জাতিসংঘ ইরাকে অবরোধ আরোপ এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিল। জাতিসংঘের তদারকীতে ইরাকের তেল বিক্রি হবে তাও ৬০% এর বেশী নয়। আর তেল বিক্রির টাকা দিয়ে ইরাক খাদ্য, ঔষধ ও অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহারিক পণ্য সামগ্রী কিনতে পারবে-খাদ্য কর্মসূচীর আওতায়। ইরাক যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে ঐ খাদ্য কর্মসূচীও বন্ধ হয়ে গেল। নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের ওপর ইরাকের নিরস্ত্রীকরণ দায়িত্ব অর্পন করে। ইরাকে গণবিধবংসী কোন অস্ত্র নাই ঘোষণা দেওয়ার পরই কেবল এই বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ইরাক থেকে তুলে নেওয়া হবে বলে জানানো হলো। জাতিসংঘের প্রধান অস্ত্র পরিদর্শক তার দল নিয়ে ইরাকে মারণাস্ত্র এবং জীবাণু অস্ত্র তল্লাসী করে কোথাও কোন গণবিধবংসী অস্ত্রের সন্ধান পেলেন না- তথাপিও বুশ-ব্লেয়ার ইরাকের তেল সম্পদের লোভ সংবরণ করতে পারেন নাই- চাপিয়ে দেওয়া হলো ইরাকে অন্যায়ভাবে, বেআইনীভাবে অযৌক্তিক এবং মানবতা বিরোধী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-এই যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা শুনলে প্রাণ কেঁপে উঠে। বুশ-ব্লেয়ারের এ ধরনের সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন-আগ্রাসনে ভীত হয়ে পড়লো পৃথিবীর সকল গণতন্ত্রকামী দেশ। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বিস্মিত, নির্বাক এবং হতবাক হয়ে গেল। প্রবল অশ্রু জোয়ারে এ যুদ্ধ কাঁদিয়েছে বিশ্ব বিবেককে। পৃথিবীর জ্ঞানীগুণী বিবেকবান লোক আমেরিকার এ যুদ্ধকে নিন্দা করলো, প্রতিবাদের ঝড় তুললো সারা বিশ্বে। অথচ দুষ্ট চক্রের মধ্যমণি বুশ যে কত বড় ফ্যাসিবাদী যুদ্ধবাজ হতে পারে যা ইতিহাস খ্যাত যুদ্ধবাজ হিটলারকেও হার মানিয়েছে। ইরাকের তেল লুট করার বুশ-ব্লেয়ারের এই পৈচাশিক আগ্রাসন পরিকল্পনা ও যুদ্ধ, চরম মানবতা বিরোধী এবং শুধু মানবাধিকার লংঘনই নয় বরং ইহা ইতিহাসের ঘৃন্য, জঘন্য, বর্বরতম অপরাধ যা কোন সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারেনা-কোন বিবেকবান মানুষ এ যুদ্ধ মেনে নিতে পারে না। প্রশ্ন থেকে গেল-কোথায় গেল সাদ্দামের জীবাণু অস্ত্র, মারণাস্ত্র এবং পারমাণবিক মিসাইল যা নাকি মানব সভ্যতাকে এক নিমিষে শেষ করে দিতে পারতো। যে মিথা মারণাস্ত্রের তথ্য দিয়ে বুশ-ব্লেয়ার বিশ্ববাসীকে বোকা বানিয়েছে, জীবাণু অস্ত্র এবং মারণাস্ত্র তল্লাসীর নামে এক মিথ্যা দমকা হাওয়া সমগ্র ইরাকবাসীকে আতংকিত করেছে। মিথ্যাবুলি দিয়ে বুশ-ব্লেয়ার ইরাকের সুরভিত গোলাপের সৌরভ লুণ্ঠন করেছে। প্রশ্ন থেকে গেল-কেন বুশের ডাকে নিরস্ত্র ইরাকের নিরীহ জনসাধারণের ওপর এত বড় অভিশাপের ছায়া ফালুজা থেকে তিরকুক বাগদাদে নেমে এলো। জাতিসংঘ কেনই বা আজ নীরব-

পৃষ্ঠা:০৫

পরাশক্তিগুলোর তাবেদার ভূমিকায় অবতীর্ণ। এক সময় যে ইরাকী সভ্যতা রোম এবং পারস্যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলো-তা আজ বুশ-ব্লেয়ারের মিত্র শক্তির চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। শিশু-নারীসহ ইরাকের বিপুল জনগোষ্ঠী নিহত ও আহত অবস্থায় পড়ে রইলো ইরাকের হাসপাতালগুলিতে। তাদের পঙ্গুত্বের অভিশপ্ত ভবিষ্যত জীবন চিন্তা করলে দিশেহারা হতে হয়। মৃত্যুপথযাত্রী এ সকল নর-নারীর চিকিৎসার সুব্যবস্থা ইরাকে ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে; পর্যাপ্ত ডাক্তার, ঔষধ এবং সেবাযত্নের এখন বড়ই অভাব-পত্রিকার পাতা এবং বিভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেল খুললে; যুদ্ধাহত মানুষের রক্তাক্ত শরীর দেখে আতঙ্কিত হতে হয়। কি বিভৎস চেহারা। এখন ইরাকের শহরগুলি বোমার আঘাতে ধবংসস্তুপ-জনমানব শূন্য হয়ে পড়েছে। বড়পীর আবদুল কাদির জিলানীর ইরাক এখন জৌলুসহীন, কর্মবিহীন জনপদ আর যুদ্ধের ধবংসাবশেষ সর্বত্র ছিটিয়ে ছড়িয়ে আছে এবং যেখানে সেখানে পড়ে আছে নর-নারী শিশুর লাশ। এই হচ্ছে বুশ-ব্লেয়ারের দেওয়া গণতন্ত্র; ইরাকবাসী হতবিহ্বল চিত্তে হারানো লাশের সন্ধানে ছুটছে দিক-বিদিক। ভেসে আসছে স্বজন হারানোর আহাজারি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে ইরাকি জনগণের সঙ্গে সমগ্র বিশ্ববাসী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে যুদ্ধের বর্ণনার যে রূপ চিত্রায়িত আছে এ যেন তাই ‘ফ্যাসিষ্ট শক্তি রণউন্মত্ততা ও মানবতার চরম অবমাননা একটি উদ্বিগ্ন ও পীড়িত মন পীড়ার কারণ।’ তাই মানবতার ডাকে পৃথিবীর বিবেক ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদ করলো। প্রতিবাদের ভাষা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ ধর্মঘট পৃথিবীর আনাচে কানাচে প্রতিবাদের ঝড়। এমন কি স্বয়ং আমেরিকায় শতশত নারী ষোড়শী থেকে আশি বছর বয়সী পর্যন্ত নগ্ন শরীরে আমেরিকার রাজপথে মৌন মিছিল করলো-আমেরিকার নগ্ন আগ্রাসনে নারীর নগ্ন শরীর প্রদর্শন এও এক ধরনের প্রতিবাদের ভাষা- এর পরও বুশের হুশ হলো না। ইরাকের আকাশ এখন মিসাইলের বোমার বর্ষণে বৃষ্টি ভেজা। এই যুদ্ধ কিসের সংকেত? রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুশিয়ারী করে বললেন- ‘বিশ্বে কোন দেশের একক আধিপত্য কেবল নৈরাজ্য আর বিপর্যয় সৃষ্টি করে।’ টাইমস পত্রিকার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাতকারে ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আক্রমন পরিকল্পনার ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে পুতিন এ মন্তব্য করেন। জাতিসংঘ ইরাক যুদ্ধে শান্তি রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের বক্তব্য হলো সারা বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার দাবী করলেও মার্কিনীরা নিজ নিজ বিবেকের কাছে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে চিহ্নিত হয়ে রইলো মানবতা বিরোধী বলে।

পৃষ্ঠা:০৬

ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর পরিচলানায় ইরাকে এমন একটি যুদ্ধ হয়েছে তার সংবাদ বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছানোর দায়িত্বে নিয়োজিত সাংবাদিকরা পর্যন্ত আমেরিকান কমান্ডারদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। প্রতিদিন ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের ব্রিফিং শোনার জন্য সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট হোটেলে যেতে হতো। তথ্য পরিবেশন সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় কমান্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। যুদ্ধে কি ঘটছে তা জানার জন্য সাংবাদিকদের মন ছটফট করলেও খুব কম সময়ই তাদের বাইরে যেতে অনুমতি দেওয়া হতো। সবসময়ই সাংবাদিকদের চোখে চোখে রাখা হতো। প্রধান তথ্য কেন্দ্রের মধ্যে বিবিসি, সিএনএন এবং আল- জাজিরা চ্যানেল ছিল অন্যতম। বিবিসিসহ পাশ্চাত্য মিডিয়াগুলো যে নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচার করতে পারে এ যুদ্ধে এটাও প্রমাণিত হলো। বাগদাদে প্যালেষ্টাইন হোটেল ছিল সংবাদ পরিবেশন এবং সাংবাদিকদের প্রধান কেন্দ্র। ইরাক যুদ্ধে ইতোমধ্যেই মার্কিন বোমার আঘাতে আবাসিক এলাকায় নিহত হয়েছে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক। মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে অনেক বিদেশী সাংবাদিকদেরও। এক অভাবনীয় বিপদের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকরা ইরাক যুদ্ধের ঝুঁকিপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করে বিশ্বে নন্দিত হয়েছেন। ইরাকের তথ্য মন্ত্রী সাহাফ ইরাকীদের পক্ষে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে বিশেষভাবে খ্যাত হয়েছেন, আন্তর্জাতিকভাবে প্রসংশিত হয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে পেয়েছেন, অফুরন্ত ভালবাসা এবং জনপ্রিয়তা যা ইতিহাসের সাংস্কৃতিক বন্ধন হিসাবে যুগ যুগ ধরে খ্যাত হয়ে থাকবে।ইরাক যুদ্ধের খবর সংগ্রহের সময় বিবিসির প্রখ্যাত সংবাদদাতা জোনাথন মার্কাস যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তারই অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ‘কাতারে মার্কিন কেন্দ্রীয় কমান্ডের দফতরে সাংবাদিকদের দেখাশোনা করার বিষয়টি ছিল লক্ষণীয় রকম সুবিন্যাস্ত। কারণ দোহায় দুইটি প্রেস অপারেশন কাজ করেছিল-একটি আমেরিকান আর একটি ব্রিটিশ। অতি উৎসাহী আমেরিকান প্রেস অপারেশন ছিল বলতে গেলে খুব বেশী জনসংযোগমূলক, আলাপচারিতায় ভরা। আর অপেক্ষাকৃত ছোট ব্রিটিশ প্রেস অপারেশন ছিল একেবারেই ভিন্ন ধরনের। এর কারণ হচ্ছে গোটা বিষয়টির উপর আমেরিকানদের মোড়লীপনা। বাগদাদে আমাদের সহকর্মীদের কাছ থেকে এই যে তথ্য প্রাপ্তি এটি ছিল ইরাক যুদ্ধের আকর্ষণীয় বিষয়। যদিও তা ছিল যুদ্ধের একেবারেই সামান্যতম অংশ মাত্র। আর আমরা সবচেয়ে সমস্যায় পড়তাম তখন যখন লোকজন আমাদের প্রশ্ন করে বলতো ‘এসবের অর্থ কি? কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে।’ ‘সমস্যাটি কোথায়? এ ধরনের বিশেষ ব্যবস্থার মানে কি? এসব কিছু মিলিয়ে একটা নাটকীয় সমস্যার মধ্যে ছিলাম আমরা। আর আমার ধারণা

পৃষ্ঠা:০৭

পেন্টাগণ ও অন্যরা ঠিক এটাই চেয়েছিল। তারা তৃণমূল পর্যায়ে আধুনিক যুদ্ধের বিস্ময়কর চিত্র দিতে চেয়েছিল। গোটা ইরাকে হামলা চালানো হচ্ছে এই বিস্ময়কর চিত্র তুলে ধরার এই প্রচেষ্টা আরও বিস্ময়কর। ইরাকের সর্বত্র যুদ্ধ হচ্ছে। অথচ তার অধিকাংশ আমরা দেখার সুযোগ পাইনি। পশ্চিম, উত্তরের বেশীর ভাগ অংশে এবং আরও অনেক জায়গায় রণাঙ্গনে এমবডেড সাংবাদিক ছিলেন না। তারা (হানাদার বাহিনী) হয়ত এই ভেবে আত্মতুষ্টি লাভ করে থাকবে যে, থাক লোকজন অন্তত সবকিছু একসঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারবে না আর রণাঙ্গন থেকে সেনাবাহিনীও অবশ্যই এই ব্যবস্থাকে বেশ ভাল বলেই মনে করেছে। কিন্তু একদিক থেকে আমি মনে করি যেখানে যুদ্ধ চলেছে, সেখানে যুদ্ধের খবর সংগ্রহে এ ধরনের ব্যবস্থা আসল পরীক্ষা নয়। আসল পরীক্ষা হচ্ছে তখন যখন যুদ্ধের অবস্থাও খুব খারাপ থাকে। আমেরিকান ও ব্রিটিশদের জন্য বেশ ভালই যুদ্ধ হয়েছে। আর সাংবাদিকদের জন্য বিধিনিষেধ এই ব্যবস্থা তাদের বেশ কাজেই এসেছে। কারণ গণমাধ্যমের জন্য যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তাকে বেশীর ভাগ সময়ই তাদের সাফল্যের নাটকীয় চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তার পরিস্থিতি যদি ভিন্ন হতো। সম্ভবত হোয়াইট হাউস ও পেন্টাগণ এই ব্যবস্থায় এতটা মুগ্ধ করতে পারতো না। আমার কথা হলো- আমেরিকা ও ইউরোপের সংবাদপত্র এবং ইলেট্রনিক চ্যানেলে সংবাদ প্রচারের চেয়ে আরব দেশগুলির টিভি চ্যালেনগুলো ছিল সংবাদ প্রচারণায় অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য। আরব দেশগুলির চ্যানেল ইরাক যুদ্ধক্ষেত্রের প্রকৃত তথ্যবহুল সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে ও চিত্র তুলতে গিয়ে অনেক সাংবাদিককেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ১৩ এপ্রিল ‘০৩ মিশরীয় বিখ্যাত পত্রিকা দৈনিক আল-আহরামের সালমা আহমেদ লিখেছেন ‘যুদ্ধ শুরুর প্রায় দু’মাস আগেই পেন্টাগণ বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহে ও প্রকাশ করার ব্যাপারে বিধি নিষেধ কড়াকড়ি করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।’ বিশ্বের বড় বড় সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের সংবাদ সংগ্রহে নিয়ন্ত্রণসহ নিরাপত্তা প্রদান করারও পরিকল্পনা পূর্ব থেকে ইঙ্গ-মার্কিন প্রশাসন নিয়েছিলেন। তাই ইঙ্গ-মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীনেই ইরাক যুদ্ধের সংবাদ প্রচার করা হয়েছে।

পৃষ্ঠা:০৮

ইরাক যুদ্ধ: বিপন্ন মানবতা এবং কে সন্ত্রাসী?

ইরাক শুধু একটি দেশের নাম নয়-ইরাক হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস- একটি স্বনামধন্য নাম এবং যুগ শ্রেষ্ঠ একটি সংস্কৃতির দলিল-সেখানে রয়েছে হজরত নূহ (আঃ) থেকে একবিংশ শতাব্দীর সাদ্দামের শাসনামল পর্যন্ত হাজার বছরের বর্ণাঢ্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তন যা ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। মানব সভ্যতার এই পাদপীঠ এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তির যুদ্ধ তান্ডবে ক্ষত-বিক্ষত এবং বিবস্ত্র। তাই পৃথিবীর মানবতা অস্তিত্ব বিহীন হয়ে পড়েছে, বুশ-ব্লেয়ার চক্রের পৈচাশিক বর্বরোচিত ইরাক যুদ্ধের কারণে। বুশের প্রতিকৃতি বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাটে যত্রতত্র গলায় রশি দিয়ে লাইটপোষ্ট কিংবা গাছে বাঁধা দেখে অবশ্যই প্রত্যেকের চেতনায় একটি প্রশ্ন দেখা দেয়-ইরাক যুদ্ধ কি কারণে? মনে করিয়ে দেয় আমেরিকার সেই কুখ্যাত ‘অভিযান রেইজ হ্যান্ড’-লাখ লাখ ভিয়েতনামী আজও যে অভিশাপের পঙ্গুত্বে জর্জরিত। এই কি তবে মানবতা? ভিয়েতনামে কারা রাসায়নিক অস্ত্র ফেলেছিল? কে ইরাকে সাত সমুদ্র সীমানা পেরিয়ে হেলিকপ্টার থেকে রকেট বোমা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে? ‘মাইলাই মেসাকার’ করে কে পৃথিবীর মানব সভ্যতাকে ধবংস করতে চেয়েছিল। সে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটালো ইরাক আক্রমন করে। ব্যাপক প্রাণনাশক রাসায়নিক অস্ত্র লুকিয়ে রাখার মিথ্যা অজুহাত দেখানো যুদ্ধে মানবতা চরমভাবে বিপন্ন হলো, নির্বিচারে হত্যা করা হলো সাধারণ ইরাকী জনগণকে। রকেট বোমা আর মিসাইলের আঘাতে গুড়িয়ে যাওয়া একটি দেশ, বুশ-ব্লেয়ারের এই নগ্ন যুদ্ধবাজ মানসিকতায় পৃথিবীর বাতাস অশান্ত হয়ে উঠলো।কোন এক লেখকের নিম্নোক্ত কথাগুলি মানবতার কান্না আমার হৃদয়কে তোলপাড় করেছে-কথাগুলি এত মানবিক যে মানুষের ভিতরের মানবতাকে জাগ্রত করে। তিনি লিখেছেন- ‘যুদ্ধ আসে বারবার মানুষকে ত্রস্ত বিপন্ন, স্বজনহীন করে তোলে। একদিকে যখন বোমার আঘাতে ছিন্ন বিছিন্ন হচ্ছে শত শত নিরীহ শিশুর শরীর, নর-নারী যখন মৃত্যুর সাথে লড়ছে-অন্যদিকে তখনও জীবন বহমান’-অবশ্যই এই কথাগুলি ইরাকের যুদ্ধকালীন জনগণের জীবনের প্রতিচ্ছবি যেন মানুষের হৃদয়কে বিষন্নতায় কাঁদায়। মানবতাবর্জিত যুদ্ধের বিভীষিকাময় লোমহর্ষক কাহিনী শুনলে চমকে উঠতে হয়। যেমনটি এখন আমরা দেখছি টিভির পর্দায় ইরাক যুদ্ধে এবং আর দেখেছি বিগত দিনে ভিয়েতনাম

পৃষ্ঠা:০৯

যুদ্ধে। যেখানে লাখ লাখ মানুষের শারীরিক বিপর্যয়, অঙ্গ বিকৃতি, ক্যান্সার রোগের শিকার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। সর্বোপরি লাখ লাখ ভিয়েতনামবাসীর মৃত্যু ঘটেছে-এই হচ্ছে আমেরিকার মানবতার চিত্র। যা সমগ্র বিশ্ব বিবেককে ক্ষুব্ধ করেছে যাতনা দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে; যার বহিপ্রকাশ ঘটেছে মানবতার চেতনায়-বিশ্ববাসীর প্রতিবাদের মিছিলে, শান্তি মিছিলে আর সভ্য ও সুশীল সমাজের কান্নার স্রোতে প্লাবিত মানুষের হৃদয়ে। বিশ্বের বিবেক তাই ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সোচ্চার কন্ঠের শ্লোগানে শ্লোগান ‘আর যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।’ আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধে ইরাকী জনগণ, সাদ্দাম হোসেনের নিয়মিত সামরিক বাহিনী, মিলিশিয়া, ফেদাইন বাহিনী, রিপাবলিকান গার্ড মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আপ্রাণ যুদ্ধ করলো রাবেয়া বসরীর বসরা নগরের গোলাপকে রক্ষার জন্য। ইরাকী জনগণ যুদ্ধ করলো পৃথিবীর দৃষ্টি নন্দিত মনোমুগ্ধকর লাল গোলাপকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কারবালার পবিত্র মাটি রক্ষার্থে ইরাকবাসী সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলো দখলদার বাহিনীর সাথে। যে যতটুকু পেরেছে-যেভাবে পেরেছে যুদ্ধ করেছে পরাক্রমশালী-বিশ্ব পরাশক্তি ইঙ্গ- মার্কিনী অত্যাধুনিক সামরিক শক্তির সাথে। বড়পীর সাহেব হযরত আবদুল কাদের জিলানীর ঈমানী শক্তি নিয়ে প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঈমানী শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করেছে মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য-যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাতীয়তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লড়াকু ইরাকীরা যুদ্ধ করেছে নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচাবে বলে। মানবতাকে পদাঘাত করে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা নির্মম হত্যাযজ্ঞে রক্তের প্লাবন ফোরাত, টাইগ্রিস ও দজলা নদীকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিলো- যেমনটি আমাদের প্রিয় নবীজীর কলিজার টুকরা হোসেনকে হত্যা করে কারবালার ময়দানকে রক্তের স্রোতে প্লাবিত করে ছিল সীমার। ইরাক যুদ্ধের রক্ত প্লাবন সভ্যতার ইতিহাসে একটি কালিমা হয়ে থাকবে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন-ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান (পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য) ইরাকীদের ইচ্ছার বিরদ্ধে জোর করে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ইরাকীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে দখল করে নিলো বাগদাদ-ধর্ষিত হলো ব্যাবিলনের প্রাচীনতম সভ্যতা এবং সংস্কৃতির শৈলীচর্চা। কোথায় গেলা আমেরিকানদের মানবতাবোধ?

পৃষ্ঠা:১০

জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকরা ইরাকে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েও মারণাস্ত্র বা জীবাণুস্ত্রের এর কোনটির হদিস পেলেন না-তারপরও যুদ্ধ কিভাবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন হামলা তাদের স্বাধীনতাকে লন্ডভন্ড করতে পারে? বুশ-ব্লেয়ার চক্র এক তরফা এবং নির্লজ্জভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গেল গণবিধবংসী অস্ত্রের খোঁজে। এই যদি হয় আমেরিকার সভ্যতা এবং গণতন্ত্রের রূপ এবং মানবতার চর্চা তাহলে মানবতার ভাষা আমার জানা নাই। ইরাকের সাহসী বীর যোদ্ধারা ২২ দিন ইঙ্গ-মার্কিন মিত্র বাহিনীর সাথে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করেছে-অসম্ভবকে সম্ভব করেছে-বিশ্ববাসীর ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে সমগ্র পৃথিবীতে এযাবৎ কালের সর্ববৃহৎ অসম যুদ্ধে ইরাকীরা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে-তা আগামী দিনে মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রেরণা হয়ে থাকবে। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালবাসার প্রেরণা, শান্তি এবং মানবতার একমাত্র ঠিকানা জাতিসংঘ এখন সাম্রাজ্যবাদের সমরাগ্রাসনে বিপদগ্রস্থ। মানবতা আজ দারুণভাবে বিপন্ন। সাদ্দাম, বুশ-ব্লেয়ার কে জবাব দেবে? কেউ জবাব দেবে না। শুধু চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, হিটলার, মুসোলিনী বুশ-ব্লেয়ার নামের দানবকুল পৃথিবীর সভ্যতাকে ধবংস করার জন্য বারবার যুদ্ধ করেছে; মানবতাকে পদদলিত করেছে-তারা ইতিহাসের পাতায় ঘৃন্য খলনায়ক হয়ে পৃথিবীর শেষ দিনটি পর্যন্ত মানুষের ঘৃণা কুড়াবে। রচিত হবে মানবতার বই ‘War and peace’ লিও টলস্টয়ের ভুবন মাতানো সুন্দরী নায়িকা নাতাশার স্বজন হারানো আহাজারী, কিংবা ইরাকের গৃহবধূ নাদিরার স্বামী হারানো বিয়োগ ব্যথার কান্না-যে কান্নার ধ্বনি মানবতাবোধ স্পর্শ করে; নাড়া দেয়। ইরাক যুদ্ধে মানুষের পচাগলিত লাশের দুর্গন্ধ পৃথিবীর নির্মল বাতাসকে বিষাক্ত করেছে। এ কেমন সভ্যতার নমুনা-মহা বিজ্ঞানীদের এ কেমন আশীর্বাদ? বিজ্ঞান কি তবে ধ্বংসের জন্য সৃষ্ট? জানতে ইচ্ছে করে বিজ্ঞানের এ কেমন ব্যবহার? যা মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করে; মানবতাকে বিনষ্ট করে। কে তা হলে সন্ত্রাসী? মানবতার শরীরে ছুরিকাঘাত করলো, কামান আর বোমা বর্ষণে রক্তাক্ত করলো। গণতন্ত্রের দেহে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুড়িয়ে দিলো, মিসাইলের আঘাতে মানবতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করলো-দারিদ্র বিমোচনের নামে পুঁজিবাদের সমরাভিযানে যুদ্ধের আঘাতে নিরস্ত্র লক্ষ লক্ষ মানুষের কবর রচনা হলো-অর্থনৈতিক অবরো আরোপ করে দরিদ্র দেশগুলির কোটি কোটি ক্ষুধা-পীড়িত মানুষের কবর আরকংকালের কলংকের ইতিহাস রচনা করলো-মানবতার চেতনায় যারা কুঠারাঘাত করলো-তারা তাহলে কি? সন্ত্রাসীকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে

পৃষ্ঠা:১১

হবে। সভ্যতা এবং মানবতা কত বড় তা কেবল যুক্তি দিয়ে বুঝানো যাবে না- হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যাবে। মার্কিন-ব্রিটেনের ইরাক আগ্রাসন শেষ পর্যন্ত বাগদাদ দখলের মধ্যদিয়ে জাতিসংঘ চিরদিনের জন্য পরাভূত হলো-মানবতার পায়ে শৃংখল পরিয়ে দেওয়া হলো নতুন উপনিবেশবাদের। জন্ম হলো-পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার। অর্থনৈতিক ভারসাম্য হারিয়ে গেল। পৃথিবীর ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো নির্যাতনের শিকার হতে বাধ্য। মানবাধিকার আর মানবতা চিরদিনের জন্য বন্দী হয়ে পড়লো সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে। এখনও ভিয়েতনামে জন্ম নিচ্ছে হাজার হাজার পঙ্গু শিশু-হিরোশিমা নাগাসাকিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বোমা বিস্ফোরণের তেজষ্ক্রিতায় জন্ম নিয়েছে নতুন এক বিকলাঙ্গ প্রজন্ম। ‘৭১ এ বাংলাদেশে পাক-হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছে এদেশের মা-বোনেরা-এদেশের মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা বলতেই পারে -যদি তাদের জন্মদাত্রী মায়ের শরীরের রক্ত অপবিত্র হয়ে থাকে-তবে বাংলাদেশের শরীরে এবং ধমনীতেও সেই একই অপবিত্র রক্ত বহমান। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জাপানী কমফোর্ট গার্ল যাদের নিয়ে যুদ্ধবাদ খলনায়করা যৌন বিলাস করেছিল-আজও তাদের আত্মা বিলাপ করে। কৈ ঐ সব নারীদের পুনর্বাসন কেন হয় না-কেন কোন রাষ্ট্র প্রধান তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেন না? এ কেমন মানবতার গোলক ধাঁধাঁ? তাহলে কে সন্ত্রাসী? মানবতার বন্ধু সেজে মানব সভ্যতাকে গণবিধ্বংসী বোমার আঘাতে বিনষ্ট করলো-সংস্কৃতিকে ধবংস করলো যে, সে কেন সন্ত্রাসী হবে না? যুদ্ধকালীন বিভীষিকাময় রাতের কথা স্মরণ করলে এখনও ইরাকের মানুষের গা শিহরিয়ে উঠে-অবচেতনে মানুষ দেখলে ভুত দেখার মত ভীত সন্ত্রস্ত হয়-এই কি মানব সভ্যতা-মানবতাবোধ? এর জন্যে দায়ী ব্যক্তিদেরকে সন্ত্রাসী কেন বলা হবে না? আমি বিশ্ব বিবেকের কাছে বারবার সেই প্রশ্ন রাখবো। পাক-ভারত যুদ্ধে রক্তক্ষরণ হয়েছে কাশ্মীরে, ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনে প্যলেষ্টাইনের নিরীহ জনসাধারণ মার খাচ্ছে, মৃত্যুবরণ করছে। তামিলনাড়ু-লাইবেরিয়াতে যুদ্ধে জনগণ প্রাণ দিচ্ছে- ইরাক-ইরান যুদ্ধে রক্তের স্রোত বয়েছে, কুয়েত-ইরাক যুদ্ধের ক্ষত এখনও শুকায়নি, যুদ্ধ হয়েছে লেবাননে, কসোভোতে নারী নির্যাতনের এসব বিভীষিকা ভৌতিক চিহ্নগুলি এখনও বিদ্যমান। কসোভোতে সার্বিয়ানদের হত্যাযজ্ঞ এবং নারী ধর্ষণ সভ্যতা আর মানবতার ওপর যে কলংকের কালিমা লেপন করলো তা ইতিহাসের ঘৃন্যতম অধ্যায় রচনা করেছে। এর পরও কি মানবতার শত্রু যুদ্ধবাজ

পৃষ্ঠা:১২

দানবদেরকে সন্ত্রাসী বলা যাবে না? যুদ্ধাহত পৃথিবীর পঙ্গু নিরস্ত্র মানুষদের কথা মনে হলে কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘না যায় পরান কাকুতি সার।’ এ কেমন মানবতা? ইরাক যুদ্ধের প্রাসঙ্গিক বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতের সেমন্তি ঘোষ বলেন “যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে তিন মাস হয়ে গেল-এখনও ইরাকে খাবার নেই, আলো নেই, পরিকল্পনা নেই, এক ফোঁটা তেল এখনও দেশের বাইরে যায়নি। যে ছুঁতোয় সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ছুটে এসেছিলো বুশের দলবল সেই গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত-কেবল হতাশ মুখে অপেক্ষমান মার্কিন সেনারা। এই কি সুপার পাওয়ারের যোগ্য কৃতিত্ব? লজ্জায়- আত্মধিক্কারে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এখনও কেন মাথা ফেটে চৌচির হচ্ছে না। এটাই আশ্চার্য। মার্কিন অধিকৃত ইরাকে আপতত হানাহানির অন্ধকার। গত মে মাস থেকে শতশত মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে প্রকাশ্যে কিংবা গোপন আক্রমনে। ইরাকের হামিদ কারজাই দেশের নতুন মার্কিন স্নেহধন্য নেতা। আমেরিকার গ্রহণযোগ্যতা এভাবে পড়তে থাকলে রক্তপাত আর কেবল সুন্নী ত্রিভুজে আটকে থাকবে না; দক্ষিণ ইরাকে অর্থাৎ শিয়া প্রভাবান্বিত অঞ্চল ক্ষত- বিক্ষত হতে শুরু করেছে। শিয়া নেতা সিস্তানী ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, মার্কিন ভাইসরয় বুশ-ব্লেয়ার যে ইরাক কাউন্সিলের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি তার ঘোরবিরোধী। কায়মন বাক্যে যাঁরা যুদ্ধের বিরোধী, একবার গায়ের জোরে যুদ্ধ শুরু করে দিলে তারাও বলে ‘যে করে হোক যুদ্ধ শেষ করে দে বাবা’ এই বলে অনুরোধ উপরোধ করবে, ফ্রান্স-জার্মানী এবার সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। এক মেরু বিশ্বের সুপার পাওয়ারের আনন্দ এখানে। সেমস্তি ঘোষের কথাগুলি অস্বীকার করি কিভাবে। এটাইতো যুদ্ধোত্তর ইরাক পুনর্গঠনের প্রতিচ্ছবি আর এ নিয়ে তো ইরাকে আমেরিকার প্রতিনিধি ব্লেমারের কর্মব্যস্ততা হচ্ছে মানবতা আর গণতন্ত্র নির্মাণে। যার প্রকাশ ঘটেছে নিরাপরাধ ইরাকী জনগণকে হত্যা করার মধ্যে। এই কি তবে মানবতা? সেদিন পত্রিকায় পড়লাম-নাজাফের এক চেকপোষ্ট থেকে এলোপাথাড়ী গুলি করে মার্কিন বাহিনী হত্যা করলো একটি বাড়ীর নিরাপরাধ মানুষগুলিকে? এই হচ্ছে মার্কিনীদের মানবতা। এই মানবতাবোধ নিয়ে আমেরিকা বিশ্ব জয় করতে চায়। চমৎকার আমেরিকার মানবতার অভিপ্রায়। যুদ্ধ যদি হয় গণতন্ত্রের শিক্ষা-(আমেরিকার ভাষায়) আহা মরি-যাই কোথায়? পৃথিবীতে এখনও ফাটল ধরে না কেন? কবে মানবতা মুক্তি পাবে? এই প্রশ্ন রয়েই গেল।

পৃষ্ঠা:১৩

ইরাক প্রশ্নে বুশের গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান

ইরাকের অস্থির জনগোষ্ঠি এবং প্রকৃতি এখন ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ বাহিনী কর্তৃক বোতলবন্দি। প্রকৃতির সবুজ পল্লবিত বনভূমি, ফুল-ফলে ভরা গোলাপ আপেলের বাগান এবং নীল আকাশ সীমানা পেরিয়ে মিশে গেছে দূরে পারস্য উপ-সাগরের বিশালতায়। মৃদু-মন্দ মরু সমীরণ এখন মিসাইল রকেট বোমার গোলাবারুদের গন্ধে উত্তপ্ত ঝড়ো হাওয়া। ইরাকীদের আনন্দঘন প্রাণবস্তু উচ্ছলতাপূর্ণ বহমান জীবন এখন ক্ষত-বিক্ষত; ইরাকের সারা শরীরে প্রবাহিত মার্কিন বাহিনীর দানবীয় মানব নিধনের রক্তস্রোত। ইরাকের এই অবস্থা এবং পরিস্থিতি বিশ্ববাসীকে মর্মাহত করেছে, উদ্বিগ্ন করেছে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আজ বিক্ষুদ্ধ হয়ে বিক্ষোভে মিছিল করছে পৃথিবীর নগরগুলির রাজপথে। বুশের এ অনৈতিক যুদ্ধ অবসানের দাবীতে তারা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করেছে বিশ্বের সকল শহর। বিশ্বের সুশীল সমাজের দাবী যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির কথা আর যেন শুনতে না হয়। ইরাকের সরকারী-বেসরকারী বাহিনী এবং জনগণ দখলদার আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। পত্র-পত্রিকা থেকে মিডিয়ার মাধ্যমে বর্তমানে ইরাকের অবস্থা আমরা প্রতিদিন জানতে পারছি, দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত মার্কিন সৈন্যরা মরুভূমির উত্তপ্ত চত্ত্বরে ইরাকী বাহিনীর মোকাবেলা করছে। ইরাকী জনগণের অতীত সংগ্রামের বিরল ইতিহাস আছে, যে কোন অবস্থায় যে কোন মূহুর্তে ইরাকী বাহিনী ও সংগ্রামী জনগোষ্ঠী যে কোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে -আজও তারা মাতৃভূমি রক্ষার্থে পিছপা হয়নি। যুদ্ধ চলেছে প্রবল বিক্রমে ইঙ্গ- মার্কিন যৌথ বাহিনীর সাথে। মর্টার, রকেট বোমা, মিসাইল এ সকল অন্ত্রের আক্রমন মোকাবেলা করছে ইরাকবাসী বীর বিক্রমে। অন্য দিকে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর নিপীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইরাকী জনগণ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে তাদের এক বিন্দু রক্ত থাকতে ইঙ্গ-মার্কিন সমরাগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবে। বিশ্ব জনমত এই অনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ তাই। খোদ আমেরিকাতেই শুরু হয়েছে প্রতিবাদ, মার্কিন যুদ্ধনীতি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমলোচনা। বিশেষ করে মারণাস্ত্রের মিথ্যা অজুহাতে এবং কাল্পনিক কিছু ঘটানোর কথা প্রচার করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বুশ-ব্লেয়ার যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠেছে-শান্তিকামী মার্কিন জনগণ মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে তার সমালোচনা করছে।

পৃষ্ঠা:১৪

ইরাকে মার্কিন সেনারা সাধারণ নাগরিককে গুলি করে হত্যা করছে, নারী ধর্ষণ করছে নির্দ্বিধায়। ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া এবং স্বয়ং আমেরিকায় মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি এবং সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ, মিছিল অব্যাহত রয়েছে।ইরাকের অস্ত্র ঘোষণার তালিকাকে, অস্ত্রের দলিল পত্রকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কলিন পাওয়েল মিথ্যা, বানোয়াট, ভূয়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ এতবড় অসম যুদ্ধ ইঙ্গ-মার্কিন সৈন্যরা পরিচালনার পর ইরাকে যখন কোন মারণাস্ত্র বা জীবাণু অস্ত্রের খোঁজ পেলেন না-তখন কে মিথ্যাবাদী, ইরাক না কলিন পাওয়েল? আমি এ বিচারের ভার পাঠকদের জন্য রেখে দিলাম। বিশ্বের বহু দেশই ইরাক যুদ্ধের বিপক্ষে। আমেরিকার ইরাক আগ্রাসন উৎপীড়িনের বিষাদ-সিন্ধু হয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। বিস্ফোরণ আর গোলাগুলিতে বাগদাদ, কারবালা, নাজাফ, নাসিরাবাদ, বসরা, মসুল, তিকরিত এবং ক্ষুতে এখন রণক্ষেত্র। ইরাকে এখন শুধু পাওয়া যাচ্ছে সুপ্রাচীন সভ্যতা এবং সাংস্কৃতিক পীঠস্থানের ধ্বংসাবশেষ। দৃশ্যপটে সবুজ সমারোহ আর নয়নাভিরাম প্রকৃতি দোলা দেয় না। ইরাকে যুদ্ধ হচ্ছে, হত্যাযজ্ঞ, দালানকোঠা প্রাসাদের ধ্বংসযজ্ঞ ইট বালু কণায় ভরপুর, পচা গলিত লাশের গন্ধে জনজীবন এখন দুঃসহনীয়। দখলদার বাহিনী যে নারকীয় হত্যাকান্ড ইরাকে ঘটিয়েছে- সমগ্র ইরাকে তার পচাগলা দুর্গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মুক্তিকামী ইরাকীরা প্রাণপণ লড়ছে, গেরিলা হামলা, গাড়ি বোমা হামলা, রকেট গ্রেনেডসহ আত্মঘাতী হামলা করছে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর উপর। ইরাকী জনগণ আতংকিত। মার্কিন সেনারা মাঝে মাঝে বাড়ীঘর তল্লাসীর নামে ইরাকীদের ওপর চালাচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন, অত্যাচার ও নরহত্যা। ভারতের হিন্দু ধর্মের একটি আকর্ষণীয় আনন্দ উৎসব হচ্ছে সকল বয়সের নারী-পুরুষ, শিশু মিলে হোলি খেলা আর এখন দেখছি বুশ- ব্লেয়ারের যমদূতরা ইরাকে রক্ত দিয়ে হোলি খেলছে। আদি সভ্যতার পাদপিঠ ইরাক এখন বধ্যভূমি। ইরাকের শহরগুলিতে এখন ছিটে-ছিটকে পড়ে রয়েছে মানব দেহের কংকাল, মাথার খুলি। এখানে সেখানে জমাট রক্তের চিহ্ন। ইরাকী জনগণের অত্যাচারী জীবন কথা শুনলে হৃদয় কেঁপে উঠে। যুদ্ধ সমগ্র ইরাককে তছনচ করে দিয়েছে। জনজীবন পাল্টে দিয়েছে। স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রী নেই; অফিস, আদালত ফাঁকা। নরখেকো মার্কিন যমদূতের তান্ডবে পাল্টে যাওয়া ইরাকের চেহারা দেখলে আতকে উঠতে হয়-এই যদি হয় ইরাকে বুশের দেওয়া গণতন্ত্রের ছবি-তাহলে জাতিসংঘের মুরব্বিয়ানার কি দরকার ছিল? জাতিসংঘ

পৃষ্ঠা:১৫

থেকেই বা কি লাভ? পৃথিবীর অসহায় দুর্বল-নিরীহ মানুষগুলির নিরাপত্তা দিতে যে জাতিসংঘ ব্যর্থ। পৃথিবীর মানুষের তাতে আস্থা নাই বললেই চলে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশ্ব জনমত ইরাকের পক্ষে অবস্থান নিলেও শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও ব্রিটেনের চাপে টিকতে পারে নাই। ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া, সিরিয়া, ইরান, জর্দান, মালয়েশিয়া, উত্তর কোরিয়া এ যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। তার কারণ হচ্ছে আমেরিকা এখন বিশ্বে একমাত্র সুপার পাওয়ার যার কোন জুড়ি নাই। আজ বিশ্বের সকল রাষ্ট্র তাকে সমীহ করে ভয় পায়। এখন আমেরিকাকে ব্যালেন্স করার মত আর কোন সুপার পাওয়ার নাই। তাই আমেরিকাকে কে মানলো, না মানলো তাতে আমেরিকার কিছু আসে যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পৃথিবী অচল হয়ে পড়বে। পৃথিবীর ভারসাম্য হারিয়ে যাবে-ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে বলে বিশ্ববাসীর ধারণা। তা না হলে আমেরিকা জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাতে পারতো না-ইরাকে এক তরফা যুদ্ধ করতে পারতো না। পৃথিবীতে আদিম প্রবৃত্তি ‘জোর যার মুলুক তার’ পুরাতন্ত্রের নতুন আবির্ভাব ঘটেছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো হয় আমেরিকার তাবেদার হচ্ছে, নইলে আমেরিকার হিংস্র থাবায় আক্রান্ত হচ্ছে যেমনটি ইরাককে হতে হয়েছে। ইতোমধ্যেই আমেরিকা ইরান, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়াকে হুমকি দিতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গোলযোগ শুরু হলে, মধ্যস্থতা করার আর কেউ রইলো না। জাতিসংঘ নিজেই এখন অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। আমেরিকার চাপের মুখে নতি স্বীকার করেছে। ছোট ছোট রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এখন চরমভাবে বিপন্ন, সার্বভৌমত্ব আগ্রাসন নীতির হুমকির সম্মুখীন। প্রশ্ন উঠেছে জাতিসংঘ তাহলে রয়েছে কেন? সারা বিশ্বের পত্র-পত্রিকার খবরে প্রকাশ মার্কিন প্রশাসন পৃথিবীতে শান্তি রক্ষার্থে এবং বিশ্বের হুমকি হিসেবে উত্তর কোরিয়াকে চিহ্নিত করেছে। উত্তর কোরিয়াকে টার্গেট করার কারণ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া এখন পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। এটাই আমেরিকার মাথা ব্যথা। উত্তর কোরিয়া নিজের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে নিরাপত্তার জন্য যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরী করেই থাকে, তাতে অন্যায়টা কি? উত্তর কোরিয়া পারমানবিক শক্তি হওয়াতে পৃথিবীতে ন্যূনতম হলেও ভারসাম্য রক্ষা হবে। বুশ-ব্লেয়ারের দল ইরাকে যুদ্ধ করার পরও কোথাও মানব বিধ্বংসী মারণাস্ত্র উদ্ধার করতে পারে নাই। মারণাস্ত্র না পেয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে ইরাক মারণাস্ত্র সিরিয়ার পাচার করেছে। সিরিয়ার কাছেও রাসায়নিক অস্ত্র আছে। সিরিয়া একটা দূবৃত্ত। এসবই হচ্ছে বুশের মিথ্যা প্রচার, প্রতারণা এবং ছলনা।

পৃষ্ঠা ১৬ থেকে ৩০

পৃষ্ঠা:১৬

বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই এই অযৌক্তিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধ শুরু করার পর মার্কিন প্রশাসনের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চরিত্রের স্বরূপ ক্রমেই বিশ্ববাসীর নিকট স্পষ্ট হয়ে আসছে। ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী নানা ধরনের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ইরাকে ব্যবহার করেছে এবং রাজধানী বাগদাদ পতনের পর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি নিয়ন্ত্রণ করছে তা এখন দূর্বল রাষ্ট্রগুলিতে ছড়াবে কি-না কে জানে? আমেরিকার আধিপত্যবাদ ও দস্যুতার ইতিহাস নজীরবিহীন, কেবল নিরীহ জনগণই নয়, বিদেশী সাংবাদিকরাও মার্কিন বাহিনীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সাংবাদিকরা সংবাদপত্রের অফিস ছেড়েছেন জীবনের ভয়ে। রাজনৈতিক কলামিষ্টদের মতে এই যুদ্ধ হচ্ছে আমেরিকানদের আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে-এ যুদ্ধ হচ্ছে ইরাকের তেল লুট করে ইঙ্গ-মার্কিনীদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য। এ যুদ্ধ গণতন্ত্রের নামে আমেরিকার সাম্রাজ্য বিস্তারের এক নগ্ন হামলা-যা নতুন সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছে। এ যুদ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের উপর আমেরিকার প্রভুত্ব সৃষ্টি করা-এ যুদ্ধ হচ্ছে ইরাকের প্রাচীনতম তথা পৃথিবীর সংস্কৃতি, শিক্ষা, সভ্যতা ধবংস করার একটি অপপ্রয়াস-এ যুদ্ধ হচ্ছে বিশ্ব মানবতার বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদের ধর্ষণনীতি। অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষত সকল মুক্তিকামী জ্ঞানী, গুণী, চিন্তাবিদ শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ না করতে পারলেও ঘৃণা করছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পৃথিবীর ছোট বড়, দেশগুলিতে বুশ-ব্লেয়ারের কুশপুত্তলিকা পুড়ানোর মধ্য দিয়ে। খোদ আমেরিকাতেই এ যুদ্ধের প্রতিবাদে নারী, বৃদ্ধ, যুবতী, কিশোর একযোগে প্রকাশ্য রাজপথে নগ্ন শরীরে মিছিল করেছে ঘৃনার প্রকাশভঙ্গি কত গভীর হতে পারে তারই প্রতিবাদ ছিল নারীদের এই নগ্ন মিছিল-তারপরও বুশের হুশ হয় নাই-সে ইরাকে অসম যুদ্ধ পরিচালনা করে ইতিহাসের সর্বকালের কলংকজনক অধ্যায় রচনা করলো। সবশেষে বলা যায় এ যুদ্ধ হচ্ছে ইসলাম ধর্মকে বিলীন করার এক ঘৃন্য ষড়যন্ত্র। বিশ্ব শান্তি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা। শুনেছি বগুড়া জেলায় মহাস্থানগড়ের পশ্চিমে যে চেঙ্গিসপুর গ্রামটি দুর্ধর্ষ মোঙ্গল সেনাপতি চেঙ্গিস খাঁর নামানুসারে নাম রাখা হয়েছে চেঙ্গিসপুর, সেই মোঙ্গল শাসক চেঙ্গিস খাঁর নাতি হালাকু খান ত্রয়োদশ শতকে হামলা করেছিলো বাগদাদ। জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, বহু নগরী পুড়িয়ে দিয়েছিল বইপত্র, লাইব্রেরী ও জ্ঞানের ভান্ডারকে। একবিংশ শতাব্দীতে সেই হালাকু খানের প্রেতাত্মা বুশ- ব্লেয়ার-রামসফেল্ড ধবংস করলো ইরাকী সভ্যতা, ডাকাতি করলো তেল সম্পদ। বাগদাদের বুকে যে হিংসাত্মক চিহ্নটি ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী রেখেছে তা দেখলে

পৃষ্ঠা:১৭

আগামী দিনের প্রজন্ম চমকে উঠবে। এটাই কি তাহলে সভ্যতার বিকাশ সাধন, জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা? হামলার শিকার হয়েছে বহু শিশু তারই একজন ১২ বছরের আলী ইসমাইল আব্বাস-ইরাক যুদ্ধের হিংস্রতম জঘন্য চিত্র-সেদিন টিভির পর্দায় দেখলাম। যা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে বিশ্ব বিবেক। এ যুদ্ধে তার বাবা, গর্ভবর্তী মা, ৬ ভাইবোন সবাই মারা গিয়েছে-মারাত্মক যুদ্ধাহত অবস্থায় আলীকে হাসপাতালে দেখে ডাক্তার কেঁদে ফেললেন। ডাক্তার তার এত কষ্টে ভোগের চেয়ে মৃত্যু কামনা করেছিলেন। কিন্তু তারপরও বিধাতার ইচ্ছায় আলী বেঁচে আছে কুয়েতের একটি হাসপাতালে। সাংবাদিকদেরকে হাসপাতালে আলী প্রশ্ন রেখেছে ‘কবে সে তার হাত ফেরৎ পাবে।’ বুশ-ব্লেয়ার-রামসফেল্ডের যুদ্ধ জয়ের আনন্দকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে আলীর এই প্রশ্ন। আলী মরেনি সত্য। তবে এমনি হাজার হাজার আলী মারা গিয়েছে। পঙ্গু হয়েছে হাজার হাজার তাদের কাকুতিতে ইরাকের বাতাস ভারাক্রান্ত। তাই পৃথিবীর সভ্য মানুষগুলি আলীকে প্রতীক রেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। অর্থ যোগান দিয়েছে যুদ্ধাহত পঙ্গু ইরাকীদের জন্য। তবু কি মানবতার কান্না থামাতে পেরেছে। শান্তি ও ভালবাসার অমোঘ শক্তিতে বলিয়ান ইসলাম ধর্ম-আর এই ইরাক যুদ্ধে ইরাকীদের ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য, চিত্রকলা, শিল্পশৈলী, রাজনীতি, অর্থনীতি সকলক্ষেত্রেই এখন চলেছে নগ্ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনাচার আর অত্যাচার। তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্ব যখন সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন মারণাস্ত্র তালাসের নামে নিউক্লিয়ার ওয়ার যে কত ভয়ংকর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এবং এনেছে-তার নমুনা ইরাকের বিধ্বস্ত জনপদ আর প্রকৃতি জুড়ে। বিশ্ব বিবেকের নৈতিক মানবিক এবং সামাজিক একটা দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু এসব দায়বদ্ধতাকে অবশ্যই জাতিসংঘকে উপলব্ধি করতে হবে। গুটি কয়েক সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের খামখেয়ালীপনা কখনও ভিয়েনামে, হিরোশিমা- নাগাসাকিতে, লিবিয়া কিংবা কিউবায় কখনো আফগানিস্তান, লেবানন, প্যালেষ্টাইন এবং সাম্প্রতিককালে ইরাকে যুদ্ধ লক্ষ লক্ষ মানুষ সম্পদকে (নর- নারী ও শিশু) মরণ কামড় দিয়েছে বা দিচ্ছে- তাহলে জাতিসংঘ থেকেই বা কি লাভ? জাতিসংঘের উদ্দেশ্য যদি হয় পৃথিবীতে মানবাধিকার রক্ষা করা, আর্থ সামাজিক বৈষম্য দূর করা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করা, নিরস্ত্র মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা, শিক্ষা ও চিকিৎসার উন্নয়ন করা, তাহলে অবশ্যই জাতিসংঘকে ছোট ছোট রাষ্ট্রের ওপর সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন বা হুমকিকে রুখতে হবে-নইলে বিশ্ব অশান্তি আর বিশৃংখলায় ভরে যাবে। পৃথিবীর সকল

পৃষ্ঠা:১৮

সভ্যতাকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিবে। তাই জাতিসংঘের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা তার ওপর দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর বিশ্বাস যেন ভেঙ্গে না যায়। স্বপ্ন ভঙ্গ হলে আবার নূতন করে স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু বিশ্বাস ভঙ্গ হলে জীবন স্রোত থেমে যায়, বালু চরে আষ্টে-পৃষ্ঠে আটকে যায়। তাহলে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক যা বলেন না কেন পৃথিবীতে সকল স্থানে সন্ত্রাস বেড়ে যাবে। দূর্বৃত্তরা প্রভুত্ব করবে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর এই আস্থাহীনতার কারণে লীগ অব নেসনস ভেঙ্গে গিয়েছিল-এখন আবার জাতিসংঘ ভেঙ্গে যাওয়ার অশনী সংকেত পাচ্ছি। পৃথিবীর মানুষের দুর্ভাগ্যকে জয় করার যে দুর্বার বাসনা সামনে রেখে জাতিসংঘ কাজ করে যাচ্ছে আর মানুষের সেই দুর্ভাগ্যই যদি জাতিসংঘকে ধাওয়া করে বড় রাষ্ট্রগুলির সাম্রাজ্যবাদ আগ্রাসন রোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বিশ্ব শান্তি চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যাবে, মানব সভ্যতা নিদারুনভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বে। পত্রিকায় পড়লাম ইরাক যুদ্ধে কোন এক নিহত ব্রিটিশ সৈনিকের বাবা-মা ইরাকের শিশুদের সাহায্যের জন্য বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানিয়েছে। এতেই বোঝা যায় ইরাকের যুদ্ধ পরিস্থিতি কত ভয়াবহ। ইরাকী যোদ্ধাদের এক সংঘর্ষে ব্রিটিশ বাহিনীর কিলান ফুরিটের ১৮ বছরের ছেলে নিহত হয়। ছেলের মৃত্যুর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য টুরিংটনের অন্তেষ্ট্যিক্রিয়া অনুষ্ঠানে তার পিতামাতা দুর্দশাগ্রস্ত ইরাকী শিশুদের জন্য অর্থ দানের সিদ্ধান্ত নেন এবং কিলান পরিবারের বন্ধু মিরর পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন-‘কিলান ইরাক যুদ্ধে নিহত হয়েছে তার জন্য ফুল কেনার চেয়ে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অর্থ দান করা আমাদের জন্য বেশী সুখকর’ বললেন কিলানের বাবা-মা। এটাই হচ্ছে মানবতা বোধ, মানবতার কান্না। আর এখানেই মহত্ব লুকায়িত। কিলানের বাবা-মাকে আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করছি শতবার, হাজার বার, লাখ বার। ইরাকে এখন জনজীবন অনিশ্চয়তার মুখে, আয় রোজগার নাই, অফিস-আদালত বন্ধ, স্কুল- কলেজ কবে খুলবে কেউ বলতে পারে না; যুদ্ধের আতংকে যেন তাদেরকে গ্রাস করেছে। গোলাবারুদের গন্ধ এবং পচাগলা লাশের দুর্গন্ধে বিদীর্ণ শোকাহত নগর জীবন-বাগদাদ কিংবা ফালুজা সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজ করছে। যে আমেরিকা ত্রাণকর্তা হিসাবে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, দারিদ্র দূরীকরণের জন্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্য চিকিৎসার সুব্যবস্থা কারার জন্য দিনের পর দিন নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে-সেই আমেরিকা যদি এভাবে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে মিসাইল বোমা মারতে পারে, নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করতে পারে, ধবংস করতে পারে সভ্যতা-

পৃষ্ঠা:১৯

সংস্কৃতিকে ভাবতেও কষ্ট হয়। নিরস্ত্র মানুষ তাদের আক্রমনের ভয়ে আতংকিত হয়, ভীত সন্ত্রস্থ হয়-তাহলে আগামী দিনগুলিতে যে অন্ধকার যুগের সূচনা হবে-নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে, সন্ত্রাস বাড়বে, মানুষ নামের দানবকুল পৃথিবীতে ধবংস ক্রিয়ায় মত্ত থাকবে। বিজ্ঞান-তথ্য প্রযুক্তির বিপুল সম্ভাবনাময় আয়োজন বৃথা যাবে-ধবংস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না। তাই ইরাক যুদ্ধ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে নতুন সভ্যতার ইতিহাস রচনার জন্য সকল ধর্ম যুদ্ধ পরিহার করতে হবে, সকল আধিপত্যবাদকে ঘৃণা ভরে দূরে ঠেলে দিতে হবে। আর না হলে লাদেন বা সাদ্দামকে দোষ দিয়ে কি হবে? ‘ধর্ম যুদ্ধ নয়, চলছে তেল রাজনীতি’ মিসেল বললেন, বর্তমান বিশ্বে নানামুখী সংকটের কারণে দেশে দেশে ধর্ম নিয়ে সংঘাত চলছে। এই অস্থির-পরিস্থিতিকে ধর্ম যুদ্ধের সূচনা হিসাবে আখ্যায়িত করা যাবে না।’ ১৮/৮/০৩ সকালে ভাটিক্যান ইন্সিটিটিউট অব অ্যারাবিক এন্ড ইসলাসিক স্টাডিজ এর অধ্যাপক ফেডারেশন অব এশিয়ান বিসপ কনফারেন্সের মহা-সচিব ড. টমাস মিসেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইসলাম ইন কন্টেপরারী ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তৃতাকালে একথা বলেন। তিনি বলেন ‘পৃথিবীতে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতা থাকতে পারবে কিনা? বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম দু’টি পাশাপাশি চলবে এবং সভ্যতা এগিয়ে যাবে আদান-প্রদানের ভিত্তিতে।’ তিনি বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর বিদেশী শক্তির সামরিক হামলা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘নানা ধরনের রাজনৈতিক সংকট ও আর্থ-সামাজিক অস্থিরতার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে এই পরিস্থিতি।’ ড. মিসেল আরও বলেন, ‘১১ সেপ্টেম্বর ঘটনার পর মুসলিম দেশগুলোতে যে আক্রমন হানা হয়েছে তা কোন ধর্ম-যুদ্ধের সূচনা নয়। তেল নিয়ে রাজনীতি এ ধরনের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মূল কারণ। সারা বিশ্বে মুসলমান এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে সম্পর্কের দ্রুত উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বোঝাতে হবে-এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তি চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতেও পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের জন্যে দেশে দেশে ধর্ম নিয়ে সংঘাত বন্ধ করতে হবে। আর এ জন্য মানুষের মধ্যে সচেনতা বৃদ্ধি করতে হবে।’ বিশ্ব শান্তি স্থাপনের পক্ষে যে যুক্তি ড. মিসেল দিয়েছেন এবং যে মন্তব্য তিনি করেছেন- তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। তার যুক্তিকে স্বাগত জানাতে হয়। ১৩ মে ‘০৩ ভারতের যুদ্ধ বিরোধী ও শান্তিকামী লেখিকা অরুন্ধতী রায়। নিউইয়র্কে হারলেসের রিভার সাইট ও চার্চে ‘ঝটকা তৈয়ারী সম্রাজ্যবাদের

পৃষ্ঠা:২০

গণতন্ত্র শিরোনামে’ এক দীর্ঘ ভাষণ দেন। তারই কিছু অংশ সম্মানিত পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম- ‘যুদ্ধের ধবংসস্তুপের মধ্য দিয়ে আমরা ইতিহাসে প্রবেশ করছি। বর্তমানে আমাদের যাদুঘর আর আরকাইভগুলি পূর্ণ হয়ে গেছে-‘ধ্বংসস্থ নগরী; তপ্ত শুদ্ধ চৌচির মাঠ, বিলুপ্ত বন এবং মৃত নদনদীতে; ঘাস ফুল কর্তনকারীরা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ খুলে দিয়েছে। জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে আমাদের গ্রন্থাগার। মানবাধিকার, আইনের শাসন এখন শুধু একটি বাক্য-যা কেবল সভ্যতার বুলি হিসাবে পৃথিবীতে মানব সভ্যতাকে করেছে রুগ্ন-গণতন্ত্রকে করেছে পদলিত। কারণ আমেরিকা প্রেসক্রিপশন দিবে কোন দেশে কিরূপ শাসন ব্যবস্থা হবে-যেমনটি সে আফগানিস্তানে, প্যালেষ্টাইনে আর ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের উত্তরামলে দিয়েছে এ থেকে বুঝতে হবে আমরা কোন সভ্য জগতে বাস করছি। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীটাকে আমরা ধর্মের নামে বিভাজন করতে পারি না-বিশ্ব সংস্কৃতি-সভ্যতাকে জলাঞ্জলী দিতে পারি না গুটিকয় যুদ্ধবাজ নেতার জন্যে-যারা যুদ্ধ করেছে তেল সম্পদের জন্যে এভাবে নিজেদের স্বার্থের জন্যে মানবতাকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করছে। পৃথিবী এখনও অনেক সুন্দর; আর পৃথিবীর মানব সম্পদ আবশ্যই আরও সুন্দর। তাইতো তারা পৃথিবীকে গভীর প্রজ্ঞার মন ও মানসিকতা নিয়ে বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে আজও উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করছে; প্রগতি এবং উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে অব্যাহত রাখতে স্বচেষ্ট আছেন। তাদেরকে মূল্যায়ন করতেই হবে। যাতে করে এই বিশ্বে কোন বিশৃংখলা না হয়, হানাহানি না হয়। শান্তি আর অনাবিল প্রশান্তি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নতুন জীবন স্রোতকে অর্থবহ করতে পারে-এই প্রত্যাশায় বিশ্ববাসী আগামী দিনে স্বপ্নিল পৃথিবীর অপেক্ষায় রইলো। এই মূহুর্তে কবি শামসুর রাহমানের একটি কবিতা ‘রাতের তৃতীয় প্রহরে’র কয়েকটি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি না দিয়ে পারলাম না- ‘স্বপ্ন দেখি, রাতের তৃতীয় প্রহরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অমবস্যার দিকে তাকিয়ে রয়েছি, সেই কবে থেকে আমি কি ঘুট ঘুটে অন্ধকারের বুকে উজ্জ্বল কিছু দেখার প্রত্যাশায় এতক্ষণ প্রতিক্ষাতে অনড়।’ সেই উজ্জ্বল দিনের অপেক্ষায় বিশ্ববাসী বিজ্ঞান, প্রযুক্তি তথ্যকে ভয়াবহ যুদ্ধের অন্ধকারের মধ্য দিয়েও এগিয়ে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা রইলো বিশ্ববাসীর।

পৃষ্ঠা:২১

ইরাকে মারণাস্ত্র নেই-তাহলে যুদ্ধ কেন?

ইরাকে জীবাণু অস্ত্র বা মারণাস্ত্র কোন কিছুই পাওয়া গেল না। জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক দল ইরাকে মারণাস্ত্র নেই বলে রিপোর্ট পেশ করলেন। তারপরও ইরাকে যুদ্ধ হলো। জোট বাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধ অস্ত্রের মুখে ইরাক কেবল বিধ্বস্থই নয়- এখন ধবংস প্রাপ্ত। মিসাইলের পর মিসাইল আর রকেট গ্রেনেড হামলায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বাগদাদের পতন হল। ইরাক এখন ইঙ্গ-মার্কিনী বাহিনীর দখলে। চারিদিকে লুটপাট আর নৈরাজ্য চলছে-এখনও শেষ হয়নি, আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী চরমভাবে ব্যর্থ। ইরাক যুদ্ধে নজির বিহীন ধবংসলীলা আর নারকীয় মানব নিধন ইঙ্গ- মার্কিন বাহিনীর বর্বরতার স্বাক্ষর। বাগদাদের পতন হয়েছে ঠিকই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-ইরাকে যুদ্ধ হলো কেন? এবং ইরাকসহ আরব দেশগুলির ভবিষ্যৎ কি? সাম্প্রতিক আরব ও মিশরীয় পত্রিকাগুলোতে ইরাক সংকট আরব দেশগুলিতে গণতন্ত্রায়নের প্রতিবন্ধকতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কুয়েতের ওপর আমেরিকার আধিপত্যবাদ, সৌদি আরব এবং কুয়েতে আমেরিকান সামরিক উপস্থিতি, মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য হুমকি। মার্কিন নিয়ন্ত্রণে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে কি? আর এর ভবিষ্যৎই বা কি? এ নিয়ে নানা প্রশ্ন বিশ্ব বিবেককে এবং বিশেষজ্ঞদের মনে দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞাসা ধর্ম যুদ্ধ না মার্কিনীদের ক্রুশেড! ইরাক যুদ্ধ কি তেলের জন্য যুদ্ধ, না ধর্ম যুদ্ধ বা মার্কিনীদের ক্রুশেড? কিংবা দুটোই। অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহলেও ঐ একই প্রশ্ন? আরব দেশগুলো মনে করে এটা কেবলমাত্র তেলের জন্য যুদ্ধ নয়-এর পিছনে মুসলিম ঐতিহ্য কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ধবংস করতে ইঙ্গ-মার্কিনীদের একটি আগ্রাসী মনোভাব এবং তার সাথে তেল- সম্পদ লুট করার এক অভিনব কৌশল। এখন এটা স্পষ্ট হচ্ছে মধ্য প্রাচ্যে (আরব দেশগুলিতে) ইসলামিক ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক দর্শন এবং চিন্তা-চেতনা বিদেশী সামরিক আগ্রাসনে বিপন্ন-যা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে এবং আগামী দিনগুলিতেও করবে। এ যুদ্ধে যেভাবে ইরাকের সুপ্রাচীন ব্যবিলন সভ্যতা নষ্ট হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে ইসলামিক আধ্যাত্মিক চেতনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে-তা অবশ্যই পারিপার্শ্বিক দেশগুলিতে বিশেষত ইরান, সিরিয়া, জর্দানসহ

পৃষ্ঠা:২২

অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন এবং ইসলামিক সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে-বা দাঁড়াবে। বাগদাদের পতন হয়েছে বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে মধ্য প্রাচ্যের মানুষের চিন্তা-চেতনা, ইসলামিক দর্শন ও মূল্যবোধ সর্বোপরি গণতন্ত্র এ অঞ্চলে দারুণভাবে বিঘ্নিত হতে চলেছে-এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নেতিবাচক ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ ব্যবস্থায় এবং জীবন যাত্রায় সুদূর প্রসারিত প্রভাব ফেলবে-ইসলামিক সংস্কৃতির অগ্রগতিতে যে বড় ধরনের বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সঙ্গতভাবেই তা মনে করেন। ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিশেষজ্ঞরা মিশর এবং আবর দেশগুলির পত্র-পত্রিকায় আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন- ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর এ যুদ্ধ হচ্ছে ইরাকের তেল সম্পদ লুট করা, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের আসনকে পাকাপোক্ত করা এবং আরব দেশগুলির অর্থনীতিকে ভেঙ্গে চুরমার করা। আরব দেশগুলির অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তেল সম্পদকে অন্যায়ভাবে নিজেদের কবলে নেওয়া। ইরাক অবরোধ পূর্বে ইরাকের সাথে ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশের তেল কোম্পানীগুলোর বাণিজ্যিক চুক্তি ছিল। ইরাক অবরোধের কারণে ঐ চুক্তিগুলো বাতিল হয়ে গেছে। এ যুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন তেল কোম্পানীগুলো এক চেটিয়া লাভবান হবে-সমালোচকরা তাই মনে করেন। সমালোচকরা ইরাক যুদ্ধের কারণ খুঁজতে গিয়ে বলেছেন-আমেরিকা, ব্রিটেন ও আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলো ইরাকের বিশাল তেল সম্পদকে অতি সন্তায় রপ্তানী করে বিশ্ব অর্থনীতি চাঙ্গা করবে (বিশেষত মিত্র দেশগুলির) এবং সেই সাথে আমেরিকা তার নিজস্ব জ্বালানী চাহিদা পূরণ করবে। স্বৈরাচারী সাদ্দামকে উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে ইরাকে তেল সম্পদ দখল করাই হচ্ছে আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট নিরসনে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে ইরাকের তেলের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই আমেরিকার ইরাক যুদ্ধের প্রধান কারণ। একই সাথে এক এক করে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের তেল সম্পদের উপর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে তাদের আগামী দিনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুদূর প্রসারি এক পরিকল্পনা। ইতোমধ্যেই পত্র- পত্রিকায় শিরোনামে এসেছে ‘ইরাকের তেল যাবে ইসরাইলে।’ মারণাস্ত্র খোঁজার অজুহাতে ইরাকের জনগণের তাজা রক্তে হোলি খেলে আমেরিকা-ব্রিটেন- ইসরাইলের অর্থনীতিকে তাজা করবে। মসুল (ইরাক) থেকে তেল পাইপ

পৃষ্ঠা:২৩

লাইনযোগে হাইফায় (ইসরাইল) নেওয়া হবে-ফলে ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইল হবে পৃথিবীর তেল সম্রাট। এ যুদ্ধ প্রসঙ্গে ভারতের সেমন্তি ঘোষের ‘দেশ’ ম্যাগাজিনে আগষ্ট ‘০৩ সনে লেখা প্রতিবেদন ‘যুদ্ধটা তা হলে হল কেন’ দেশ ম্যাগাজিন পৃষ্ঠা-২৭ এর উদ্ধৃতি না দিয়ে পারলাম না। তিনি লিখেছেন-‘ইতিহাস (নাকি) ওদের ক্ষমা করে দেবে। ওরা যদি নির্ভুল হন, তবে তো সারা দুনিয়াই জানাবে প্রণতি। সুতরাং ফলাফল যাই হোক; ক্ষমা পাচ্ছেনই।’ ওদের আত্মদর্শনের উচ্চতা বা ইতিহাস। পাঠের নিশ্চিতি দিয়ে নতুন করে আলোচনার কিছুই নেই। লক্ষণীয় চিরপরিচিত গগনচুম্বিতার ভেতরকার ফাটলগুলো-যা ওদের বাক্য সমষ্টির মধ্যে যতোই প্রকাশিত শেষ অবধি তাহলে ‘ক্ষমা’ শব্দে পৌছে গেলেন ব্লেয়ার-যে শব্দের পিঠেই থাকে অপরাধ শব্দটির মারণাস্ত্রের চিহ্ন ইরাকে হয়ত শেষ অবধি না-ও মিলতে পারে-এই আশঙ্কা তাহলে ওদের মনেও গিয়ে সাবধানী এই মন্তব্য। এগুলো তো গেল একেবারে গোপনতম অপ্রকাশ্যতম আশঙ্কার কথা। প্রকাশ্যে এখনও গলাবাজির শেষ নেই। ‘পাওয়া যাবেই; দেখে নেবেন।’ মুশকিল হলো-এখন পাওয়া গেলেও সকলেই ধরে নেবে গোটা ব্যাপারটাই চক্রান্ত; ইরাকী মাটিতে অস্ত্র-শস্ত্র পুঁতে রেখে নিজেদের মান বাঁচানোর ফন্দি। WMD র খোঁজে হন্যে হয়ে যাওয়া বুশ- ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে খোদ ওয়াশিংটন আর লন্ডনে এখন ছিছিক্কার। মার্কিন দেশে ডেমোক্র্যাটরা উদ্ভাসিত বুশকে কোণঠাসা করতে পেরে। ব্রিটিশ কনজারভেটিভ শিবিরও উৎফুল্ল ব্যাপারটা এভাবে গড়াতে থাকলে আগামী নির্বাচনে ব্লেয়ার এক কোপেই কুপোকাত হবেন। নাকি রুদ্ধশ্বাস, মঞ্চে অগুনতি তারকা অভিনেতা আছেন। বিবিসি এ্যান্ড্রু মিসিগ্যান যিনি ব্লেয়ার সরকারের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র সম্পর্কিত তথ্যে রং ছড়ানোর অভিযোগ এনে হুলুস্থলু খেলেছেন। আছেন ব্লেয়ারের সম্প্রচার পরিষদ অ্যালেষ্টারের ক্যাম্পাবেল যিনি নাকি ইরাক ইন্টেলিজেন্স তথ্যে কারচুপি ঘটিয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন অস্ত্র পরিদর্শক বৈজ্ঞানিক ডেভিড কেলি, ব্রিটিশ ডিফেন্স অস্ত্রকের এক্সপার্ট বায়োলজিষ্ট, পার্লামেন্টে তার তীব্র জেরার দিকে সকলের চোখ যখন নিবন্ধ, তখন অক্সফোর্ড ক্যান্ট্রিসাইডে মিলল কেলির মৃতদেহ। আত্মহত্যা না হত্যা। হলিউড থ্রিলার যে হার মানছে। বৃথাই আশায় বুক বাঁধছিলেন ব্লেয়ার; পার্লামেন্টের সামার সেসনে জুড়োবার আগেই WMD

পৃষ্ঠা:২৪

বিতর্ক ধামাচাপা পড়ার কোন সম্ভাবনাতো নেই-ই বরং তাকে গদি ছাড়া করা হয় কিনা, সেটাই এখন দেখার। এমতাবস্থায় কী ভাবছেন দুই বিপন্ন অধিনায়ক ব্লেয়ার ও বুশ হাত কামড়াচ্ছে না আসসোস করছে এই ভেবে যে WMD নিয়ে যে অবিরত অভিযোগের তর্জনী তাদের দিকে, তার ভাগিদারতো হওয়া উচিত ছিল স্বয়ং রাষ্ট্রপুঞ্জেরও। সাদ্দামের অস্ত্রভান্ডার নিয়ে গত বারো বছরে কত আলোচনা, গবেষণা, যত পদক্ষেপ সবচেয়ে বড় দায়তো রাষ্ট্রপুঞ্জেরই। নিজের দেশের বিদ্রোহীদের ওপরে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপুঞ্জের চোখেই তিনি বিপদজনক সাব্যস্থ হন। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জেরই সিদ্ধান্ত ছিল যে, নিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রস্তুতির যোগাড় করেছিল সাদ্দাম। ১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের স্পেসাল কমিশনের (UNS CUM) রিপোর্ট বলে যে ইরাকের রাসায়নিক (জৈব নয়) পারমাণবিক অস্ত্রের হদিস পেয়েছে তারা। এই কমিশনের সঙ্গেই পরবর্তী অস্ত্র পরীক্ষক দফতর (UNMO VIC) এর শীর্ষ নেতা হ্যান্স ব্লিক্স বলেন যে তথ্য প্রমাণ এখনও সন্তোষজনক নয়-যদিও সম্ভাবনা যথেষ্ট। সুতরাং এ প্রশ্ন উঠতেই পারে-এক দশকের বেশী সময় ধরে কী তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কাজ করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন বিভাগ।প্রশ্ন উঠতে পারে কি? উঠছে না-কেননা সব প্রশ্নের অভিমুখ আজ বুশ ও ব্লেয়ারের দিকে। কেননা রাষ্ট্রপুঞ্জকে কলা দেখিয়ে নিরাপদ দূরত্বে ঠেলে দিয়েছে বুশ এবং ব্লেয়ারই। সাদ্দাম হোসেনকে অসামান্য গোলমেলে ব্যক্তি হতে কোন সংশয়ের জায়গা ছিল না। কিন্তু তার মারণাস্ত্র বিষয়ক অপরাধের গুরুত্ব কী এবং কতটা এবং তার যোগ্য দাম্ভিকী এবং কীভাবে এসব ঠিক করার ভারতো ছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের ওপরেই। মারণাস্ত্রের সন্ধান মিললেও যুদ্ধ এভাবে যত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাহায্যেই-যেমন হয়ে থাকছে উত্তর কোরিয়ার মতো ক্ষেত্রে। সুতরাং বুঝুন, এখন বুশ-ব্লেয়ার কত ধানে কত চাল।’ ইতিহাস মোটেই ওদের ক্ষমা করবে না, ভুল প্রমাণিত হলে তো নয়ই নির্ভুল প্রমাণিত হলেও না। ক্ষমা করবে না-একটি প্রশ্নের উত্তর ওরা কিছুতেই দিতে পারবে না। যুদ্ধটা হলো কেন?” আমি আগেই বলেছি যুদ্ধ হয়েছে তেলের জন্য অর্থনৈতিক কারণে। আমেরিকা বিশ্ব অর্থনীতিতে একচ্ছত্র অধিপতি হতে চেয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে একমাত্র মোড়ল হতে চেয়েছে-তাইতো ইতোপূর্বে আমেরিকা সিআইএকে দিয়ে রাশিয়াকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেছে। সমাজতন্ত্রের পৃথিবীতে ধস নামাতে

পৃষ্ঠা:২৫

সক্ষম হয়েছে। এখন একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো। আর এই দেশগুলোতে রয়েছে প্রচুর তেল সম্পদ এবং সম্ভাবনা যা দিয়ে বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তিতে উন্নত হলে পারমাণবিক অস্ত্র তথা মারণাস্ত্র তৈয়ার করতে এ রাষ্ট্রগুলো সক্ষম হলে একদিন না একদিন অবশ্যই তারাই আমেরিকার সম প্রতিপক্ষ হবে-এ ভাবনা ইঙ্গ-মার্কিনীদের হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তাই বলে সামরিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে মারণাস্ত্র আছে মিথ্যা প্রচার করে; একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে যুদ্ধে আক্রমন করে সেদেশের নিরস্ত্র নর-নারী, শিশুকে হত্যা করার যে অদম্য বাসনা কিংবা যুদ্ধ করার দাম্ভিকতা ইঙ্গ-মার্কিন প্রশাসন অর্থাৎ বুশ-ব্লেয়ার দেখালেন তা যে অবশ্যই ক্ষমার যোগ্য কিনা পাঠকরা বিবেচনা করবে। এ প্রসঙ্গে আরও বলতে হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মিডিয়া প্রধান মিস্টার ক্যাম্পবেল বেশ কয়েকদিন হলো পদত্যাগ করেছেন। ইরাকে পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় এবং অস্ত্র বিজ্ঞানী ড. ডেভিড কেলির রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে দারুন স্নায়ু চাপ সহ্য করতে না পেরে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের দপ্তর হতে তিনি পদত্যাগ করেন-আজ প্রশ্ন উঠেছে এই লোকটি যিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিশ্বস্ততা স্থাপন করতে গিয়ে যে মিথ্যা তথ্য পরিবেশনে ইরাকে যুদ্ধ সংঘটিত করলো-হাজার হাজার নিরীহ ইরাকী জনগণ আহত হলো, পঙ্গু হলো, মৃত্যুবরণ করলো, ধবংসযজ্ঞের তান্ডব ঘটালো, গণতন্ত্রের নামে প্রহসন হলো, ইরাকে লুটপাট আর নৈরাজ্যের স্বর্গবাসের জন্ দিলো, তাই সততার সাথে বলতে হয় -বুশ-ব্লেয়ার চক্রকে দুই একটি তাবেদার রাষ্ট্র ক্ষমা করলেও ইতিহাস ক্ষমা করতে পারে না-করবেও না। এ বিশ্বাস বিশ্ববাসীর হৃদয়ে গাঁথা।

পৃষ্ঠা:২৬

নগ্ন করলো আপন নির্লজ্জ অমানুষ

‘নগ্ন করলো আপন নির্লজ্জ অমানুষ’-কথাটা আমার না হায়দার খান রনোরও না, বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমগ্র বিশ্ব-মানবতার ওপর গত ২০ মার্চ ‘০৩ ইঙ্গ-মার্কিন মেরিন সৈন্য বাহিনী জলপাই রঙা এর বিশাল ট্যাংক বাহিনী নিয়ে ইরাকে যুদ্ধ যাত্রা করলো। ইরাকের আকাশ মার্কিন জঙ্গী বিমানগুলি টহল দিতে থাকলো। একসময় প্রকম্পিত হলো ইরাকের আকাশ- বাতাস বোমা আর রকেট মিসাইলের আঘাতে গোটা দেশটাকে যেন বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা। পৃথিবী ব্যাপি প্রতিবাদ উঠলো-এ যুদ্ধ অন্যায়-মানবতাবিরোধী। ইঙ্গ-মার্কিন জোট বাহিনী অবিরাম বোমা হামলা করে নারী-পুরুষ শিশু হত্যা করলো-যা বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিলো, ঘৃণা আর নিন্দা জানালো বিশ্ববাসী। হাজার হাজার শিশু বোমার আঘাতে হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে গেল। মৃত্যু যন্ত্রণায় ইরাকের জনগণের অসহনীয় তড়পানী। তারই একটি প্রতিচ্ছবি মর্টারের আঘাতে পা দুটি কেটে ফেলে বসরা নগরীর ২২ বছরের যুবতী ফাতেমা এখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। তার বাড়ীর অপর ৬ জন সদস্য মা ভাই-বোন বোমা বিস্ফোরণে মারা গিয়েছে-এর পরেও নির্লজ্জের মত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ (ছোট) পৃথিবীর মানুষকে জানালেন যে, আমরা ইরাকের জনগণকে মুক্ত করবো বলে যুদ্ধ করছি। বসরার হাসপাতালে শুয়ে ফাতেমা তখনও চিৎকার করে বলছে ‘আমার আয়ু নিয়ে সাদ্দাম বেঁচে থাকুন’। তারপরও কি বুশ-ব্লেয়ার বলবেন সাদ্দাম অমানুষ ছিলেন-ইরাকি জনগণ সাদ্দামের স্বৈরশাসনে নির্যাতিত হয়েছিলো। কি দোষ করেছিলো ফাতেমা? ১১ বছরের শিশু আলী চিৎকার করে বিশ্ববাসিকে প্রশ্ন করেছে ‘কবে সে তার হাত ফেরৎ পাবে’? এই কি তবে সভ্যতা?-যার জন্য আমরা গর্ব করে নিজেদেরকে সভ্য বলি। যে মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ নাই, ভালবাসা নাই-সে কি করে নিজেকে সভ্য বলে দাবী করে? সভ্যতার আড়ালে বুশের যে বর্বর হিংস্র মনোভাব লুকায়িত তা ঘৃণ্য। দাম্ভিক বুশ-ব্লেয়ার একথা কি বোঝেন না? বা বুঝতে চান না। ৭ আগষ্ট ‘০৩ দৈনিক যুগান্তরের বাতায়ন পাতায় হায়দার আকবর খান রনো ইরাক যুদ্ধ প্রসঙ্গে যথার্থই লিখেছেন ‘সভ্যের বর্বর লোভ’ শিরোনামে। তিনি লিখেছেন ‘এবার ইরাক যুদ্ধের সময় ও এখনও যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন যা করে চলেছে, তা চরম অসভ্যতা ও বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যাপক বিধবংসী অস্ত্রের অজুহাতে ইরাক দখল করলো দু’টি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র; তারা ইরাকের বিজয়ের পর এখন পর্যন্ত অস্ত্রের সন্ধান দিতে পারেনি। বুশ ও

পৃষ্ঠা:২৭

ব্লেয়ার দুনিয়ার কাছে ইতোমধ্যে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে দুই দুইটি প্রলয়ঙ্করী মহাযুদ্ধের পর যে সব আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার, নিয়মকানুন, গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। পৃথিবীর পরাশক্তির ঔদ্ধত্য আচরণে তা মূহুর্তেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। হায়দার খান রনো তার ভাষায় আরও বলেন ‘অর্থ সম্পদ, সামরিক শক্তি ও প্রযুক্তির বিকাশ দিয়ে সভ্যতার মান নির্ণয় করা যায় না। সভ্যতা হলো মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উচ্চতর স্তর যা পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র নায়কদের মধ্যে দারুণভাবে অনুপস্থিত রয়েছে। মানব সভ্যতাই আজ ভয়ঙ্করভাবে বিপদের মুখে। বুশ-ব্লেয়ারের দল আরও কবছর রাজত্ব করলে মানব সভ্যতা এবং ‘মানব জাতির অস্তিত্বই ধবংস হয়ে যাবে’। আমিও তাই বলি, মাথার খুলি আর কংকালই যদি হয়, সভ্যতার উপকরণ বুশ-ব্লেয়ারের কাছে তাহলে বিশ্ব সভ্যতা অবশ্যই ধ্বংসের মুখে পড়বে। বিশাল বিশাল অট্টালিকা মিসাইল বোমার আঘাতে নিমেষেই যখন বালু, ইটের টুকুরো বিশেষ হয়ে গেল, পড়ে থাকলো ধ্বংসাবশেষ, তাহলে আধুনিক সভ্যতা কিভাবে বিস্তার লাভ করবে। নিঃস্তব্ধ এবং নিঃশব্দ ভূতড়ে রাত বা বিভীষিকাময় রাতের শংকা কখনও মানব সভ্যতা হতে পারে না-সেখানে অবশ্যই আবারও বলবো ‘নগ্ন করলো আপন নিলজ্জ অমানুষ’।ইরাকে নগ্ন আক্রমনের যথার্থ কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রিটেনে ১৫ ফেব্রুয়ারী ‘০৩ যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগ মূহুর্তে সর্বকালের সর্ববৃহৎ যুদ্ধ বিরোধী জমায়েত হতে দেখেছি আমরা টিভির পর্দায় এবং পত্র-পত্রিকায়। প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে- শান্তি চাই যুদ্ধ চাই না। নিজের দেশেই এত বড় প্রতিবাদের ঝড় বইয়ে গেল, তারপরও ব্লেয়ার সাহেব নির্লজ্জের মত বুশের হাতে হাত মিলালেন। অবশ্যই এটা তেল সম্পদের ওপর বর্বর লোভ ছাড়া আর কিছুই না। এমনকি ব্লেয়ারের ক্ষমতাসীন দলের নেতা রবিন কুক ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন ব্রিটিশ মন্ত্রীরা ও ব্রিটিশ এম.পি-রা। তারা যুদ্ধাপরাধে ব্লেয়ারের বিচার দাবী করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও একই। এ যুদ্ধে জোট বাহিনীর গণহত্যা এবং মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপ একাধিক বার যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এত কিছুর পরও বুশ অত্যন্ত নির্লজ্জের মত বললেন ‘ইরাক থেকে কোন অবস্থায়ই পিছু হটবো না’। সেন্ট লুইসে প্রাক্তন সৈনিক সমাবেশে এক ভাষণে তিনি একথা বললেন। সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চায় যা অমানুষত্বের নামান্তর মাত্র। ইরাক সম্পর্কিত ভিত্তিহীন গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহারের দায়িত্বও বুশ সাহেব নিলেন। মানবিক সব মাত্রাজ্ঞান পরিহার করে সংস্কৃতির বাধন ভেঙ্গে অসভ্য যে উক্তি বুশ করলেন তাতে আমেরিকাবাসীর লজ্জা পাওয়া উচিত। সভ্য সমাজের পুরোহিত হয়ে

পৃষ্ঠা:২৮

কিভাবে একজন রাষ্ট্রনায়ক অমানুষত্বের মনোভাব প্রকাশ করে আনন্দ পান, যা কেবল রুচিহীনতার পরিচায়ক মাত্র। যুদ্ধাক্রান্ত ইরাকে নারীর সতীত্ব হরণ করে জোট বাহিনী যখন উল্লসিত তখনও বুশ-ব্লেয়ারের রুচিতে বাঁধে না। ইরাকের নীল আকাশে এখন সোনালী আলো নির্মল বাতাস নেই- আছে শুধু নররক্তের দূর্গন্ধময় বিষাক্ত বাতাস। বুশ-ব্লেয়ারের শাসন ব্যবস্থার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির স্বাদ পাওয়ার নেশায় ইরাকিরা এখন ব্যাকুল। ইঙ্গ-মার্কিন দখলদার বাহিনীর নগ্ন আগ্রাসন রুখতে বেছে নিয়েছে গেরিলা কায়দায় মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিদিন শত্রু বাহিনীর সৈন্যরা ইরাকিদের গেরিলা হামলায় মারা যাচ্ছে অথচ বুশ-ব্লেয়ার এখনও ইরাকে অবিচলভাবে ফ্যাসিষ্ট বা মধ্য যুগীয় কায়দায় বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। একইভাবে মিথ্যাচার করছেন। তারা ইরাকি জনগণকে মুক্ত করবে আর গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পদ্ধতি চালু করবে। ইরাকে এখন নৈরাজ্য চলছে, আর আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মার্কিন সেনাদের কোন আগ্রহও নেই। তারা বরং লুটতরাজকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। এই লুটতরাজ ও নৈরাজ্যের ভয়ে ইরাকি জনগণ যাতে করে দখলদার বাহিনীকে আরও অনেকদিন ইরাকে রাখার পক্ষে সমর্থন দেয় এই আশায়। তাহলেই আমেরিকার লাভ। গত ১৬ এপ্রিল ২০০৩ জনকণ্ঠ পত্রিকার চতুরঙ্গে ১৩ পাতায় পড়লাম কোন এক অস্ট্রিয়ান বিমান ফ্লাইটের সময় পরিবর্তনে মন্তব্য করেছে ‘বিনা কারণে, বিনা ঘোষণায় যদি দুটি পরাক্রান্ত দেশ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দুর্বল দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বছরের পর বছর যুদ্ধ চালাতে পারে-তাহলে বিনা ঘোষণায় একটি ফ্লাইটের বদল সঙ্গত বলেই ধরে নিতে হবে।’ একজন ইউরোপীয় সাধারণ নাগরিকের মন্তব্য যদি হয় এরূপ এরপরেও কি বুশ-ব্লেয়ার মনে করেন না যে এ যুদ্ধে তাদের নাক কাটা যায় নাই। তবে নাক থাকলেতো নাক কাটা যাবে। বছরের পর বছর ইরাকিদের ওপর যারা বোমাবর্ষণ করতে পারে তারাতো প্রকৃতই বর্বর। সভ্য মানুষের নাক আর বর্বর মানুষের নাক-তো এক হতে পারে না। তাই বুশ-ব্লেয়ারের নাক কাটা যাবার বালাই নাই। নাক কাটা যাবার কথা ভাববে সভ্য মানুষ। যারা নিজেরা অমানুষ তাদের এসব ভাবনা নাই। বিদেশী পত্র-পত্রিকায় বুশ-ব্লেয়ারের এই অন্যায় যুদ্ধের দারুণ সমালোচনা শুরু হয়েছে। গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ডেইলী মিরর প্রত্যেকটি পত্রিকা বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক যুদ্ধকে নগ্ন আগ্রাসন বলে আখ্যায়িত করেছে। পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত সকল দেশই যুক্তরাষ্ট্রের এই নগ্ন হামলার নিন্দা জ্ঞাপন করেছে, প্রতিবাদ করেছে, মিছিল করেছে, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তারপরও বুশ-ব্লেয়ার ইরাক যুদ্ধকে বৈধ কি করে বলতে পারেন? এটাই পৃথিবীর সভ্য সমাজের কাছে আশ্চার্য মনে হয়। ওদের আচরণে পৃথিবীর সাধারণ মানুষগুলি নিদারুণ ক্ষুব্ধ। ইরাক যুদ্ধের লজ্জা ঢাকার জন্য বুশ-ব্লেয়ার

পৃষ্ঠা:২৯

এক চমৎকার কৌশল অবলম্বন করেছেন। যাতে করে সত্য সংবাদ পরিবেশিত না হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হরণ করে সংবাদ পরিবেশনের ওপর কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করেছেন। ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর কমান্ডারের দপ্তর থেকে যতটুকু প্রেস ব্রিফিং দেওয়া হবে ততটাই সংবাদ পত্রে প্রকাশ করা হবে- সংবাদ পরিবেশনে এটা নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। ৮ এপ্রিল ‘০৩ ছিল বর্তমান বিশ্বে সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় সাংবাদিক হত্যার একটি কালো দিন। নিন্দা, প্রতিবাদ, ঘৃণা এবং ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বিশ্বের সাংবাদিক মহল আর শান্তিপ্রিয় জনগণ। পরিকল্পিতভাবে এ যুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন সৈন্যরা ট্যাংকের গোলায় হত্যা করেছে সাংবাদিকদেরকে টিভি চ্যালেনগুলির অফিস বোমার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে বুলেটের আঘাতে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই নিন্দনীয় ঘটনা কালো অধ্যায় হিসাবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। বিশ্ব জনমত সাংবাদিক হত্যাকে জেনেভা কনভেনশন এবং মানবাধিকার লংঘনের জন্য এর সুষ্ঠু বিচার দাবী করেছে। আল-জাজিরার রিপোর্টার তারেক আইয়ুবের স্ত্রী তাহবুব প্রশ্ন করলেন-সত্যকে তুলে ধরাই কি অপরাধ? এ কেমন সভ্যতা? এরপরে বুশ-ব্লেয়ার নিজেদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? সেটা আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেল। ভারতের একজন লেখক নিত্যপ্রিয় ঘোষ লিখলেন ‘নেই, সুতরাং আছে’। বুশ তার জাতির উদ্দেশ্যে প্রচারিত ভাষণে বলেছিলেন ইরাক নাইজার থেকে ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছে পরামাণু অস্ত্র বানানোর জন্য। এখন দেখা যাচ্ছে, সিআইএ দুটো মেমো পাঠিয়েছিল যে নাইজার সংক্রান্ত ইউরেনিয়াম তথ্যটি বড়ই দুর্বল। মার্কিন সিনেট প্যানেলে এখন জেরা চলছে; বুশ সাহেব তাহলে কেন সেই অসমর্থিত তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা করে ইরাক আক্রমন করলেন। সিআইএ-র ডিরেক্টর জর্জ টেনেট জেরার সময় বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রপতির ভাষণটি দেখে দেননি, দোষ তার। আর টেনেটের সহকারী জানিয়েছেন। ‘মেমো দুটো এসেছিল ঠিকই; কিন্তু ভাষণ লেখার সময় সে দুটোর কথা তার খেয়াল ছিল না’। ব্লেয়ার সাহেবের বিপত্তি আরও পেকেছে ডেভিড কেলির আত্মহত্যায়। ব্লেয়ার সাহেব যে তথ্যপঞ্জির ভিত্তিতে বলেছিলেন-ইরাক ৪৫ মিনিটের মধ্যে তার মারণাস্ত্র ক্ষেপণ করার ক্ষমতা রাখে; সেই তথ্য পঞ্জিতে এমন কোন তথ্য ছিল না। এই তথ্য দিয়ে ব্লেয়ার সাহেবের ভাষণকে বীর্যবান (Sexed up) করা হয়েছিল। কে করেছিলেন? ব্রিটিশ সরকারের ডিফেন্স মন্ত্রকের কর্তার ইশারায় ইঙ্গিতে সাংবাদিকদের জানান ডেভিড কেলিই। হাউস অফ কমনসের ফরেন অফিস কমিটিতে কেলির জেরা চলে; ওই কমিটিতে বিবিসির রিপোর্টার অ্যান্ড্রু গিলিগান কী বলেছেন, সেটা গোপন রাখা হয়েছে। আপতত বিচার বিভাগীয়

পৃষ্ঠা:৩০

তদন্ত চলেছে কেলির মৃত্যুর। কেলির মৃত্যুর পর বিবিসি বলেছে কেলিই তার সূত্র। রাষ্ট্রসংঘের অনুসন্ধানী দলের প্রধান হ্যান্স রিক্স যিনি ইরাকে রাষ্ট্রসংঘের তরফে দীর্ঘকাল অনুসন্ধান করে জানিয়েছিলেন ইরাকে মারনাস্ত্রের সন্ধান পাননি। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছেন- ‘নেই সুতরাং আছে।’ বুশ-ব্লেয়ার বলছেন ‘এখন না পাওয়া গেলেও পরে পাওয়া যাবে।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারনন্যাশনালের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হচ্ছে। ‘এখন আমেরিকান সৈন্যরা ইরাকে যথেষ্ট অত্যাচার চালাচ্ছে; যাকে ইচ্ছে গ্রেফতার করছে। ইরাকিদের চলাফেরায় বাধা দিচ্ছে; যেখানে খুশি ঢুকে পড়ে ধর পাকড় করছে।’ আমার বক্তব্য হলো, এই যদি হয় অত্যাচারের নমুনা এ নির্লজ্জ মনুষ্যত্যের জন্য বুশ-ব্লেয়ারের হুস তো হলোই না বরং দাম্ভিকতা বেড়ে গেল। কিন্তু বিশ্বের সকল বুদ্ধিজীবী মহল লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমেরিকার সকল প্রকার প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও কোন দেশই ইরাক পুনর্গঠনে সৈন্য দিতে প্রস্তুত নয়। সবাই বলে দিয়েছে রাষ্ট্রসংঘের দায়িত্বে ইরাক পুনর্গঠন হলে তারা ইরাকে সৈন্য পাঠাবে, নইলে নয়। জামানী, ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারত বাংলাদেশ ইরাকে সৈন্য পাঠাতে নারাজী হয়েছে। তাই নিত্যপ্রিয় ঘোষ বলেছেন ‘ইরাক আক্রমন করে আমেরিকা এখন ছুচো গেলার অবস্থা।’ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে-ইরাকে গণতন্ত্র উদ্ধার করতে আমেরিকা সফল হবে-তো? এখন ইরাকে গেরিলা হামলায় প্রতিদিন যেভাবে ইঙ্গ-মার্কিন সৈন্য মারা যাচ্ছে তাতে বিশ্ববাসী সংশয় প্রকাশ করেছে। ইরাক যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত ভিয়েতনাম যুদ্ধের মত বুমেরাং-এর রূপ নেবে নাতো। ১৩ বছর পর হলেও আমেরিকাকে নিঃশর্তভাবে ভিয়েতনাম ত্যাগ করতে হয়েছিল। এখন আমেরিকান যে সকল সৈন্যরা ইরাকে গেরিলা যুদ্ধে মারা যাচ্ছে, তাদের আত্মীয়-স্বজন ইতোমধ্যেই বুশ প্রশাসনকে তাদের ক্ষোত এবং অসন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন আর যে সকল ইঙ্গ-আমেরিকান সৈন্য এখন পর্যন্ত ইরাকে আছেন তাদের আত্মীয় স্বজন বুশ-ব্লেয়ার প্রশাসনকে ওদের দেশে ফেরৎ আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। ইরাক যুদ্ধ যে কত ভয়াবহ তা প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে। নাসিরিয়ায় রক্ত করছে, কারবালায় প্রচন্ড যুদ্ধ, কিরকুকে অবিরাম গোলাবর্ষণ বা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে আমেরিকা। এতে করে বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক যুদ্ধে লজ্জা পাওয়ার আর কি বাকি রইলো? আমি জানি না- বুশ-ব্লেয়ারের গায়ে কিসের চামড়া। একটি কৌতুক শুনেছিলাম। একবার একটা গন্ডার এক চিড়িয়াখানায় শুয়ে ছিল। এক ভদ্রলোক ঐ গন্ডারের সামনে দিয়ে যাবার সময় ওর শরীরে একটু কাতুকুতু দিলেন। কিন্তু গন্ডারের কোন অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া তিনি লক্ষ্য করলেন না। পরের দিন ভদ্রলোক পথ দিয়ে ফেরার পথে ঐ গন্ডারের

পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪৫

পৃষ্ঠা:৩১

সামনে পড়তেই গন্ডারটি হেসে ফেললো। গন্ডারের চামড়া এত মোটা যে কাতুকুতুর সুড়সুড়ি অনুভব করতে গন্ডারের দু’দিন সময় লেগেছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয় বুশ-ব্লেয়ারের শরীরে গন্ডারের চামড়া নেই। তবে এ যুদ্ধ যে অযৌক্তিক, অবৈধ এবং লজ্জাসকর এটা বুঝতে তাদের এত সময় লাগছে? মার্কিন ক্ষমতার দম্ভ আর শক্তির বেপরোয়া প্রয়োগ যে ইরাক যুদ্ধের সামরিক বিস্তৃতি এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার একটি নগ্ন অভিপ্রায় বুশ-ব্লেয়ার দেখালেন আর নব্য সাম্রাজ্যবাদের অভিলাস যে কারণে আজ সমগ্র বিশ্ব নতুন বাস্তবতার সম্মুখিন হয়েছে। সন্ত্রাস দমন নীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হাজার হাজার নিরীহ জনগণের মৃত্যু ঘটিয়েছে। তারা সাদ্দামকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাকে হটানোর জন্য ইরাকে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। এসব নগ্ন হামলার পরিকল্পনা এবং নীল নকশা বহু পূর্ব থেকেই তারা করেছিল। তাই ইরাক যুদ্ধ ছিল অবশ্যম্ভাবী। ইরাকে মারণাস্ত্রর অনুসন্ধান ছিল একটা অজুহাত মাত্র। যা ছিল সম্পূর্ণ প্রবঞ্চনা আর প্রতারণা। এটা কি লজ্জাকর নয়? এখন ইসরাইলকে দিয়ে প্যালেস্টাইনের জনপ্রিয় জননেতা ইয়াসির আরাফাতকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করেছে। আজ তাই রাষ্ট্রসংঘে এর বিপক্ষে যে সকল রাষ্ট্র প্রস্তাব এনেছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে। তারপরও আমেরিকা বলতে চায় তারা গণতন্ত্রের রক্ষক ইসরাইলে অবিরাম যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে এখনও ইসরাইলের সৈন্যরা গাজা দখল করে রেখেছে, হত্যা করছে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি জনগণকে বিনা দোষে। ইসরাইলের জঙ্গী বিমান ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। নাবলুস এখন ইসরাইলীদের দখলে। এসব কার ইঙ্গিতে হচ্ছে? আজকের বিশ্বে একজন নাবালকও তা ভাল বুঝে। অথচ আমেরিকা একটি বারের জন্যেও এসব হত্যাকান্ডের নিন্দা করে না। ইসরাইলে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে জেনেও তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে না। এই নির্লজ্জ এক চোখানীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে মোড়ল সেজেছেন। মাঝে মাঝেই যুক্তরাষ্ট্র ইরান, সিরিয়া এবং উত্তর কোরিয়াকে হুমকি দিয়ে আসছেন তাদের পারমাণবিক অস্ত্র বিনষ্ট করতে হবে নইলে ইরাকের পরিনতি তাদেকেও ভোগ করতে হবে। এই দানবিক নীতি নিয়ে যারা দম্ভ করেন, সমর অভিযান চালান তাদের হাতে বিশ্বনেতৃত্ব নিরাপদ নায়, বিশ্ব মানবতা ও সভ্যতা আজ তাই বিপন্ন।

পৃষ্ঠা:৩২

ইরাকে নৈরাজ্যের স্বর্গরাজ্য এবং যাদুঘর লুট

আমেরিকার ভাষায় ইরাকে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু কিভাবে শেষ হয়েছে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। যখন সমগ্র ইরাকে চলছে গেরিলা যুদ্ধ আর নৈরাজ্য। যুদ্ধ শেষ হওয়ার একশত দিন পরও; ইরাকের সাধারণ নাগরিকরা বিভীষিকার মধ্যে রাত কাটাচ্ছে। বাড়ী বাড়ী তল্লাসীর নামে শুরু হয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন সৈন্যের অত্যাচারের তান্ডবলীলা। দিনের আলোতে প্রিয়জনের সামনে মার্কিন সেনা কর্তৃক ধর্ষিত হচ্ছে নারী। যুদ্ধের ইতিহাস বড়ই নির্মম; বিশেষত নারীদের ওপর চলে পাশবিক অত্যাচার আর সেটাকে যদি জায়েজ বলা হয় প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ, লেবানন যুদ্ধ, প্যালেষ্টাইনের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সবক্ষেত্রেই বিশ্ববাসী যে নৈরাজ্য এবং ধর্ষণের চিত্র দেখেছে তাতে পৃথিবীতে সভ্যতা আছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। এসব যুদ্ধে নারীদের এ ধরনের অবমানবা বিশ্ব বিবেককে দংশিত করেছে, শংকিত করেছে। আধিপত্যের আগ্রাসনে বিশ্ব সভ্যতা টিকবে কিনা? ইরাক যুদ্ধের নৈরাজ্য, বিভীষিকাময় ধবংসাত্মক দিনগুলির কথা মনে হলে-নারী জাতির ধর্ষণের কাহিনী শুনলে-নারীর অনাবৃত স্তন এবং নগ্নদেহে ধর্ষণের ক্ষতের হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখলে বিশ্ব বিবেক বিচলিত হয়। -মনে হয় এ যেন মানবতার রুদ্ধদ্বারে বসে। সভ্যতার স্বপ্নে বিভোর মানব সম্পদে পরিপূর্ণ- এক কথায় ইরাক এখন ছিনতাই, রাহাজানি, দস্যুতা, ধর্ষণ এবং অব্যাহত আইন শৃংখলার অবনতির স্বর্গরাজ্য। চারিদিকে বিদ্রোহ, অরাজকতা, কর্মহীন দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষগুলির দুর্দশা, যুদ্ধাহত পঙ্গু নারী পুরুষ, শিশুর চিকিৎসার অভাব’-হাসপাতালে অপ্রতুল জায়গা এবং চরম অব্যবস্থা সব মিলে এক ভয়াবহ নৈরাজ্যের যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, পত্র- পত্রিকায় তা পড়লে গা শিহরিয়া উঠে। এই কি তবে বুশের গণতন্ত্র এবং জাতিসংঘে মানব উন্নয়ন ও সভ্যতা বিকাশের কার্যক্রম। ইরাক এখন খুন- খারাবি, লুটপাট-ডাকাতি, অপহরণের দেশ। বুশের দখলদার প্রশাসনের এই সাংঘাতিক চিত্র দেখছে সাধারণ ইরাকীরা আর নিরাপত্তহীনতার আতংকে দিন কাটাচ্ছে। বুশ-ব্লেয়ারের এই ধরনের কাজে মানব সভ্যতা এবং গণতন্ত্রের ইতিহাস নর্দমায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে-এ লজ্জা আমেরিকাবাসীর, এ লজ্জা ইংরেজদের পূর্ব-পুরুষের সন্ধানে আগামী দিনের জন্য যে ইতিহাস বুশ-ব্লেয়ার রচনা করলো নতুন প্রজন্ম ঘৃণাভরে তা পড়বে। বাগদাদে এখন কারো পৌষ মাস এবং কারো সর্বনাশ। কেউ লুষ্ঠিত হচ্ছে, আবার কেই লুটের মালে ধনী হচ্ছে।

পৃষ্ঠা:৩৩

লুটপাট হচ্ছে বাড়ীঘর, হোটেল-রেস্তোরা, অফিস-আদালত, দূতাবাস সমগ্র ইরাক এখন লুটপাটের দেশ-নগরে নগরে, এখানে সেখানে, সব জায়গাতেই লুটপাটের নৈরাজ্য চলছে। ইরাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে গেছে। নৈঃশব্দ আর নির্জনতায় বসে ভাবলে, চেতন-অবচেতনে ইরাকের অফুরন্ত গম, ভূট্টাক্ষেত গভীর বিষাদে কাঁদছে মনে হবে। প্রবাদ আছে ‘কাজ নেই তো গেট বানাই’ ইরাকের জনগণ কাজবিহীন অবস্থায়, নজিরবিহীন নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে সমগ্র দেশজুড়ে। ইরাকে রাতের রজনীগন্ধাও এখন দুর্গন্ধ ছড়ায়। সভ্যতার ভাবনা আজ-কাল বিপন্ন। যুদ্ধোত্তর ইরাকের সমস্যার শেষ নাই। লাঞ্ছিত, নিষ্পেশিত হচ্ছে ইরাকী জনগণ। কোন একসময় যে ইরাক, রোম এবং পারস্য পর্যন্ত তার সভ্যতা বিস্তারে, জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় সম্রোজ্যের বিশালতায় পৃথিবীতে শীর্ষে ছিল-সেই ইরাকের জীবনযাত্রা, কৃষ্টি, মুসলিম সভ্যতা নৈরাজ্যের রসাতলে। স্বৈরাচার সাদ্দামকে উৎখাত করার পর গণতন্ত্রের মূল্য এখনও ইরাকের জনগণকে দেয়া হয়নি। এখন দখলদার বাহিনী কর্তৃক ইরাকে চলেছে ব্যাপক লুটতরাজ। মানব সভ্যতার হাজার হাজার বছরের পুরানো প্রত্নতত্বের নিদর্শনসমূহ হচ্ছে লুটপাট। এমনকি মুসলমানদের পবিত্র মসজিদকে অবলীলায় ধবংস করতে দ্বিধাবোধ করছে না দখলদার বাহিনী। ইরাকের লুটপাট এখন কত ব্যাপক তা পত্রিকার একটি ভাষ্য পড়লেই বিশ্ববাসী বুঝতে পারবে-‘জোট বাহিনী নিয়েছে ডলার, ইরাকীরা দিনার’-এই ছিল পত্রিকার শিরোনাম। এখন সাদ্দাম হোসেনের সকল রাজ প্রাসাদ ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধের তান্ডব লীলায় ধবংসপ্রায়। রাতারাতি লুট হয়ে গেছে প্রাসাদসমূহের সকল মূল্যবান জিনিষ, আসবাবপত্র এবং বিভিন্ন ব্যবহারিক সামগ্রী। প্রাসাদগুলি এখন সব ছাদবিহীন, যেখানে এখন ঘুঘু চরে। বাগদাদের সরকারী ট্রেজারী ও ব্যাংকগুলি লুট হয়ে গেছে। মিসাইলের আঘ্যতে প্রাসাদগুলি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। চারিদিকে শুধু ধবংসযজ্ঞের বিকৃত চেহারা। দূর্ভেদ্য দুর্গ বিশেষ এই প্রাসাদগুলি এখন লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে রয়েছে। প্রাসাদের সব সম্পদ এখন লুষ্ঠিত হয়েছে মার্কিন মেরিন সেনা পাহারাদারদের চোখের সামনে ইঙ্গ-মার্কিন সৈন্যরা ধনসম্পদ লুটপুটে নিচ্ছে। প্রাসাদের ধবংসাবশেষ থেকে অবশিষ্ট পিতলের মালামালও লুট করেছে। ইরাকীদের ভাষায় লাটেরারা লুট করছে প্রাসাদের ভিতরের সামগ্র-এন্টিক্স এবং পিতলের জিনিষপত্রগুলি-যা দেশ-বিদেশের ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরায় বন্দী করে টিভির পর্দায় দেখা গেছে। পরিকল্পিতভাবে সাদ্দামের প্রাসাদগুলি এবং বাগদাদের যাদুঘর লুট হয়ে গেল। বিধ্বস্ত প্রাসাদের হল রুমগুলি যেন আমাদের

পৃষ্ঠা:৩৪

দেশে এক একটি ফুটবলের মাঠ যেমনটি সাংবাদিকরা পত্রিকায় রিপোর্ট করেছেন। একটি বিকশিত সভ্যতার সংস্কৃতির ন্যূনতম অবশিষ্টও রইলো না। প্রসাদের মধ্য থেকে লুটেরারা লুট করে নিয়ে গেল সব। এক কথায় হরিলুট। নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং লুটপাটের আড়ালে ঢাকা পড়ে পেল ইরাকের প্রাচীন সভ্যতা। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুনসুরের আমলে নির্মিত বাগদাদ আর বাগদাদের গৌরব আল-রশিদ সড়কের হোটেল এবং বিখ্যাত দোকানপাটের মূল্যবান সব জিনিষপত্র নিমেষেই অদৃশ্য হয়ে গেল। উল্লেখ্য যে, আব্বাসীয় আমলে বাগদাদে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য থেকে বহু জ্ঞান পিপাসু ভাষা জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে বাগদাদে গিয়েছেন জ্ঞানের মশাল জ্বালাতে। সে জ্ঞানের মশালে আলোকিত হয়েছিল গ্রীস, ভারত, মিশর, পারস্য, চীন, আরব, ইউরোপ এবং আজকের আমেরিকা। সোর্য্য বীর্য্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে বাগদাদ ছিল এক সময়ে সভ্যতার প্রধান পাদপীঠ। আর সেই বাগদাদ এখন ধ্বংস আর লুটের রাতের ভুতুড়ে নগরী আর অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি মরু দেশ। লুট হয়ে গেল ইতিহাসের বাইতুল হিকমা অর্থাৎ একাডেমী অব উইসডম, লুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থাগারের মূল্যবান বই সামগ্রী। আল-মামুনের শাসনামলে দর্শন এবং বিজ্ঞান বিশেষত গণিত শাস্ত্রে এবং জ্যোতিষ বিজ্ঞানে এতই উন্নতি লাভ করেছিল যে বিশ্ববিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এরিষ্টটল, প্লোটো টলেমী, ইউক্লিড ও আরো অনেক বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গণিতবিদগণ যারা বাগদাদ সভ্যতার জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চ্চাকে বিশ্বায়নে স্থান করে দিয়েছে। তাদের সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিদ্যামন্দির লুট হয়ে গেল বুশ-ব্লেয়ারের মিসাইলের আঘাতে রণ তামাশায়, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আর্কাইড বাগদাদের জ্ঞানের প্রদীপ নিভে গেল রকেট আর বোমা হামলায় লুট হয়ে গেল পৃথিবীর বিখ্যাত জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুস্তক। ধ্বংসের অগ্নিগর্ভে দাউ দাউ করে জ্বলছে এখন সাদ্দামের প্রাসাদগুলি আর সেই সাথে লুট হচ্ছে বাগদাদের যাদুঘর থেকে প্রত্নতত্বের বিশ্ববিখ্যাত নিদর্শনগুলি।ইরাকের অমূল্য রত্ন-সম্পদ প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহাসিক ফলক ৭০ হাজার নিদর্শনগুলি বাগদাদ যাদুঘর থেকে লুট হয়েছে। প্রখ্যাত আমেরিকার প্রত্নতত্ববিদ পল জিমানস্কি ইরাকের যাদুঘর লুন্ঠনকে প্রাচীনকালে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ভস্মিভূত হওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভ্যাটিক্যান এসোসিয়েশন ফর দি চার্য ইন বাগদাদের প্রেসিডেন্ট ম্যাকগায়ার গিবসন বলেছেন সবচেয়ে মূল্যবান নিদর্শনগুলো ভল্টে রাখা হয়েছিল। চাবি হাতে নিয়ে লুট করতে আসে। আমার ধারণা এর পরিকল্পনা হয়েছে বিদেশে। তিনি আরও

পৃষ্ঠা:৩৫

বলেন, ‘এমন কি যুদ্ধের সময় সীমান্ত বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এসব জিনিষ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় দেশের বাইরে চলে যেতে পারে?’কেম্ব্রিজের প্রত্ন সম্পদ সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ ড. নিল ব্রোডি বলেন, ‘প্রত্নতাত্তিক এবং সাংস্কৃতিক সংস্থাসমূহ কয়েকমাস আগেই এখানকার সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সাদ্দাম হোসেন তার ৩০ বছরের স্বৈরশাসনে যদি কোন ভাল কাজের জন্য গর্ব করতে পারেন- তা হচ্ছে ইরাকের অমূল্য সম্পদ প্রত্ন সম্পদের সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করা। ১৯৬৭ সালে সাদ্দামের বাথ পার্টি ক্ষমতা এসেই প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শন রপ্তানী নিষিদ্ধ করে কঠোর আইন পাশ করে।’ পেনসিলভানিয়া ইউনিভাসিটি মেসোপটি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ভোটার সাদ্দামের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব সম্পদের পাচাররোধে তার আমলে যে আইন পাশ করা হয় তা বেশ কার্যকর হয়। এই আইন পাশের পর প্রকৃত পক্ষে কোন প্রত্ন নিদর্শনই পাচার করা যেত না। যাদুঘরগুলো সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। আমরা সবাই প্রশংসা করেছি এবং এই অঞ্চলের জন্য এক এক মডেল বলে গণ্য করেছি। বাগদাদের মানব সভ্যতার আদি নিদর্শনগুলো তিলতিল করে গড়ে তোলা বাগদাদের শূন্য যাদুঘর এখন দেখলে যে কোন সভ্য মানুষের কান্নাই পাবে। তাই আমাকে বলতে হচ্ছে যে প্রত্ন সম্পদ তিলতিল করে সাদ্দাম হোসেন সংরক্ষণ করেছিল বাগদাদের যাদুঘরে সেগুলো কোন অধিকার বলে ইরাকের অনাভিপ্রেত যুদ্ধে যারা লুট করে নিলেন তাদেরকে কি বলা হবে? কার অভিশাপে বাগদাদ যাদুঘর থেকে সভ্যতার মূল্যবান প্রাচীন নিদর্শনগুলি লুট হয়ে গেল? প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ ও প্রামাণ্য দলিলের বিশাল ভান্ডার ন্যাশনাল আর্কাইভ লজিক্যাল মিউজিয়াম এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরী এন্ড আর্কাইভে যেভাবে হামলা হলো মেসোপটেমিয়ার সংস্কৃতিকে যেভাবে লুটপাট করা হলো বিশ্বের সকল মেধাবী জ্ঞানীগুণী পন্ডিত ব্যক্তিগণ এটাকে সভ্যতার ইতিহাসে একটি জঘন্য অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। সভ্যতা এবং ইতিহাসের এই অমূল্য প্রত্ন সম্পদ লুট হওয়াতে বিশ্বের যে কত বড় ক্ষতি হলো তা হিসাব করে বোঝানো যাবে না। এ সকল প্রত্ন নিদর্শন হারানো তাই কান্না হয়েই ইতিহাসের পাতায় রয়ে যাবে।

পৃষ্ঠা:৩৬

ইরাকে এখন গেরিলা কায়দায় মুক্তিযুদ্ধ

ইঙ্গ-মার্কিন রণহুঙ্কার এখন নিঃস্তেজ। ইরাক এখন যুদ্ধস্নাত ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এ যুদ্ধে নাকি আমেরিকার জয় হয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সেই ঘোষণা দিলেন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ২২ দিন প্রাণপণ যুদ্ধ করেছে ইরাকী সেনাদলের সাথে জনতাও এক হয়ে। আপাতত যুদ্ধ শেষ হলেও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বজন হারার আহাজারী আর যুদ্ধাহত পঙ্গু দেশ প্রেমিক যোদ্ধারা এখন ইরাকের হাসপাতালে মৃতশয্যায়। ইরাকের মরুভূমিতে নৃশংস হত্যাকান্ডের রক্তমাখা বালু লাল। মনে হচ্ছে মরিচা পড়েছে। ইরাকের শহরগুলিতে সাদ্দামের পতনের পর ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী জয় উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ইরাকীরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাগদাদে, মসুলে, ফালুজায়, তিকরিতে, কারবালায় দজলা নদীর দুই তীরে। কিন্তু জোট বাহিনীর বিমানের সমর্থনপুষ্ট পদাতিক ও ট্যাংক বাহিনী মর্টার ও মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তাই টিকতে পারে নাই। পিছিয়ে পড়েছে সেনাবাহিনীর পোশাক ছেড়ে সাধারণ নাগরিক বেশে গ্রেনেড রকেট নিক্ষেপ করে যৌথ বাহিনীর হেলিকপ্টার ভূপাতিত করছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র পরাভূত করেছে লড়াকু ইরাকী সেনাদের। বাগদাদে ফেদাইন ধরতে গিয়ে গুলির মুখে মার্কিন সেনা পতিত হয়েছে তারপরও যত সহজে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী রণাঙ্গনে জিতেছে তত সহজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে নাই। সাদ্দাম সরকারের পতনের পর ইঙ্গ- মার্কিন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ইরাক। যুদ্ধ শেষ হয়েছে কয়েকদিন। মার্কিন সৈন্যরা রাজধানী বাগদাদসহ ইরাকের সবকটি শহর দখল করে নিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা প্রহরী হিসাবে মার্কিন সৈনারা পাহারা দিচ্ছে। শহরগুলির রাজপথে টহল দিচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন সেনারা। ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর নাকের ডগায় যুদ্ধোত্তর ইরাকে বাজার-বিপনী, অফিস-আদালত, যাদুঘর, দূতাবাস, হোটেল- রেস্তোরা সব জায়গায় লুটপাট চলেছে অবাধে। ইরাকের রাজধানীসহ শহরগুলিতে স্বস্তি ফিরে আসে নাই। মার্কিন বাহিনী শহরগুলিতে কোথাও কোথাও এখন সাদ্দাম বাহিনী কর্তৃক প্রতিরোধের সম্মুখিন হচ্ছে। এখনও বিভিন্ন স্থানে প্রচন্ড গুলির শব্দ শুনা যাচ্ছে। ফেদাইন বাহিনী এবং সাদ্দামের রিপাবলিকান গার্ড বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে মোকাবেলা করছে, গুলি করছে, বোমার বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। ইরাকের একটি প্রদেশ কারবালা। মুসলমানদের পবিত্র তীর্থ

পৃষ্ঠা:৩৭

স্থান। দূরের জনপদ। পথে পথে নানা ধবংসাবশেষের ছবি। মার্কিন মেরিনদের ট্যাংক ধ্বংস হয়ে পড়ে রয়েছে। স্বজনহারা মানুষগুলি এখনও কাঁদছে। রাতের ইরাক ভূতুড়ে। সারা দেশে বিদ্যুৎ নেই, নগরগুলি ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। মরুদেশ ইরাকে তখনও কনকনে শীত। মাঝে মাঝে রাতের নগরীতে গুলির শব্দ; শিয়ালের ডাক আর কুকুরের কান্নার সুর ভেসে আসে। হতাশার আবর্তে ইরাকী জনগণ যেন সমুদ্রের মধ্যে অসহায় অবস্থায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এখন যুদ্ধোত্তর ইরাক যেন আরও ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করেছে মার্কিন বাহিনীর ওপরে। চারিদিকে নৈরাজ্য, শৃঙ্খলা সারা দেশে নাই বললেই চলে। বেকারত্ব, অর্থাভাব, খাদ্যাভাব, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই গোটা ইরাকে। চারিদিকে বিভীষিকাময় কালোরাত্রি। কোথায় গেল ইরাকের গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতা, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। একথা ঠিক-সাদ্দাম প্রশাসন ইরাকের ইতিহাসে স্বর্ণ যুগের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। তারপরও গরীব ইরাকী জনগণের জন্য দু’বেলা খাওয়া পরার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন তিনি। কথায় বলে না ‘যে গরু দুধ দেয় তার লাথিও ভাল’। তাই ইরাকী জনগণের কাছে সাদ্দামের শাসনামল এখনও মনে হয় অনেক ভাল ছিল। আমেরিকার দখলদার বাহিনী ইরাকে অভাব, অঘটন এবং নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে নাই। ইতোমধ্যেই ইরাকে ‘নব্য বড় লাট’ জেনারেল গার্ণার প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন। নব্য ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা ইরাকে দেবার জন্য আমেরিকা গার্ণার সাহেবকে ইরাকে পাঠিয়েছেন। শাসন-শোষন পাকাপোক্ত হচ্ছে তারই শাসনকর্তা গার্ণার। ইরাকীরা এখন গার্ণার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছেন। শিয়া সম্প্রদায় গার্ণারের সাথে কোন প্রকার আলোচনায় বসতে রাজী নন। সালাবির ন্যাশনাল কংগ্রেসেও প্রকট দ্বন্দ্ব। সর্বস্তরের জনগণ এখন ইরাকে গার্ণারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে- বিরোধিতা করেছে- আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। আমেরিকার প্রশাসন ৫৫ জন শীর্ষ স্থানীয় বাথ পার্টির নেতাদের মোষ্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত করেছে অনেক মন্ত্রীকে ধরেছে, নাম প্রকাশ করেছে। আমেরিকা যুদ্ধকালীন সময়ে ইরাকের তথ্য মন্ত্রী সাহাফ ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ও প্রেস মিডিয়াগুলোতে তাঁর রসালো বক্তব্য উপস্থাপন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য পরিবেশ করার জন্য পৃথিবীর সকল মানুষের প্রিয়ভাজন হতে পেরেছিলেন। এমনকি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বুশ নিজেও বলেছেন সাহাফ তার নিকটও অত্যন্ত প্রিয়। ইরাকে সাদ্দাম সরকারের পতনের পূর্ব মূহুর্তে বাগদাদে প্যালেষ্টাইন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে এক

পৃষ্ঠা:৩৮

চমৎকার প্রেস ব্রিফিং দেন তিনি সেখানে তিনি বলেছেন ইরাকের মাটিতে ইঙ্গ- মার্কিন বাহিনীর অতি শীঘ্রই কবর রচিত হবে। এর খানিক পরেই আর তাকে কোথাও দেখা যায়নি। মাস দুয়েক পরে কোন এক সময়ে সাহাফ হঠাৎ করে পত্রিকায় আবির্ভাব হন যখন মার্কিন বাহিনী তাকে গ্রেফতার করেন-পর মুহুর্তেই জানা গেল ৫৫ জন নেতার তালিকায় সাহাফকে অন্তর্ভূক্ত করা হয় নাই সমগ্র বিশ্ববাসী অবশ্যই খুশী হয়েছেন-কারণ সাহাফ সকলের কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। যুদ্ধোত্তর ইরাকের বর্তমান আমেরিকান তত্ত্বাবধায়ক শাসন ব্যবস্থা ইরাকবাসী মেনে নিতে পারে নাই। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সবাই কারবালায় ইমাম হোসেনের মাজারে জড়ো হয়েছেন তাদের দাবী ইরাকী জনগণই ইরাকের শাসন ভার গ্রহণ করবেন-এ ব্যাপারে তারা আপোষহীন। যুদ্ধ শেষ হলেও প্রকৃত অর্থে যুদ্ধ শেষ হয় নাই- যুদ্ধ ক্রমে গেরিলাযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিনই গেরিলাযুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন সেনারা নিহত হচ্ছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু দেশ তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান, জর্দান, ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া এমনকি স্বয়ং জাতিসংঘও ইরাকে মার্কিন সেনাবাহিনীর যুদ্ধোত্তর উপস্থিতি এবং তাদের পরিচালনায় শাসন ব্যবস্থাকে বাঁকা চোখে দেখছেন। যুদ্ধোত্তর ইরাকের পরিস্থিতি এতটা প্রতিকূল হবে বুশ প্রশাসন চিন্তাও করতে পারেন নাই। যুদ্ধোত্তর ইরাকে বেকারত্ব বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, চাকুরীর ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা, সর্বোপরি আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি; অব্যাহত গেরিলা যুদ্ধে প্রতিদিন মার্কিন সৈন্যের মৃত্যু ইত্যাদি ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতিকে এতই নাজুক করেছে যে, এখন ইরাকে একজন মহিলা বা কিশোরী বাড়ির বাইরে আসতে শংকিত, ভীত সন্ত্রস্থ। কারণ মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা ইরাকে তাদের জন্য এখন কঠিন এক সমস্যা। আফগানিস্তানে লাদেনকে হটাতে আমেরিকানরা যে যুদ্ধ করেছিল, সে ধরনের যুদ্ধ অর্থাৎ শুরুতেই শেষ, কিন্তু আমেরিকানরা ইরাকে সে জাতীয় যুদ্ধ জয়ের স্বাদ পাচ্ছে না। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের লেবানন আক্রমন, নিক্সনের ভিয়েতনাম দখল এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট বুশের ইরাক যুদ্ধ একই গতিতে চলমান অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যদের দিশেহারা অবস্থা এখনও ইরাকের মাটি ও মানুষ সাদ্দামকে ভালবেসে গেরিলা যুদ্ধ করছে। পরিস্থিতি এখন কেবলই নৈরাজ্য, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি। গেরিলা যুদ্ধ দিন দিন বেড়েই চলছে। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। দিনের পর দিন গেরিলা যুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন সেনারা অধিক

পৃষ্ঠা:৩৯

সংখ্যায় নিহত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় মার্কিন কমান্ডার হিমশিম খাচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে অধিক সৈন্য ইরাকে প্রেরণের অনুরোধ করছে- অনবরত রক্তক্ষরণে ইরাকের মাটি লাল। ইরাকের শরীরে বুশ-ব্লেয়ার আমেরিকান শাসন ব্যবস্থার আশ্চর্য মলম লাগিয়ে ওয়াশিংটনে বসে ‘লিবার্টি অব ষ্ট্যাচু’র সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন অথবা লন্ডনের হাইড পার্কে বসে আরামে শেষ বিকালের রোদ পোয়াচ্ছেন। এই যদি হয় যুদ্ধোত্তর ইরাকে গণতন্ত্রের নমুনা। আমার বলার কিছুই নাই। এখন ইরাকে জোট বাহিনীর সৈন্যদের উপর গেরিলা হামলা ক্রমেই জোরদার হচ্ছে, সাধারণ ইরাকি জনগণ আকস্মিকভাবে মার্কিন যৌথ বাহিনীর উপর আত্মঘাতী গাড়ি বোমার আক্রমনে তাদেরকে নিহত কিংবা আহত করছে। গেরিলা যুদ্ধে ইরাকে মার্কিন গভর্ণর পল ব্লেমার দিশেহারা হয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। সেদিন পত্রিকায় পড়লাম-ইরাকে ইরানি হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না। মার্কিন শাসনকর্তা পল ব্লেমার বাগদাদের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধে নিক্ষিপ্ত রকেট চালিত গ্রেনেডের বিস্ফোরণে কয়েকদিন আগে এক মার্কিন সৈন্য নিহত এবং বহু আহত হওয়ায় ইরাকের জোট বাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা অব্যাহত থাকায় ব্লেমার হুশিয়ারী করে বলেন- ‘তিনি কখনই যৌথ বাহিনীর ইরাক পুনর্গঠন ও গণতন্ত্রায়ন কার্যক্রমে ইরানের হস্তক্ষেপ মেনে নেবেন না।’ আসলে ব্লেমার সাহেব সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে ইরাকে মোড়লগিরি করতে এসেছেন আর প্রতিবেশী ইরান এ ব্যাপারে নাক গলাবে-তাতে ব্লেমার সাহেবের মাথা খারাপ হবারই কথা। আর মাথা খারাপ হবেই না কেন? ইরাকে তেল সম্পদতো আর কম না। এ লোভ আমেরিকা কিভাবে সামলাবে? সাম্রাজ্যবাদের উগ্র নেশাই হচ্ছে দুর্বলের উপর সবলের আঘাত। আমেরিকা পৃথিবীর একক শক্তিধর রাষ্ট্র ইরাকের শাসনভার নিজের হাতে নিয়ে তেল লুট করাই হচ্ছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য-আজ একথা পৃথিবীর পাঁচ বছরের শিশুও বোঝে বোঝে না কেবল বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট বুশ ব্লেয়ারের উর্বর মস্তিষ্ক। এ যুদ্ধে কেউ খুশী হোক আর না হোক আমেরিকার তাতে কোন কিছু আসে যায় না কারণ ইরাকের তেল তাদের চাই। আর পৃথিবীতে কার কয়টি মাথা আছে- যে ইরাকের বন্ধু হবে। তাই ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া ইরাকের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় কোন হস্তক্ষেপ করতে নারাজ। এখন ঐসব রাষ্ট্র মুখ ঢেকে পথ চলে। পাছে কেই লেজ নাড়ে। এ ভয়তো তাদের আছেই। অন্য বড় রাষ্ট্রগুলোর এখন নৈতিকতা বা মানবতার দায়বদ্ধতা নাই। ভয়ে জড়সড়। এহেন বেহাল অবস্থায় ইরাকে গেরিলারা তাদের

পৃষ্ঠা:৪০

যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সাব্বাস ইরাকী, সাব্বাস। জাগ্রত জাতীয়তাবোধকে যে মূল্যায়ন করে না, সে কাপুরুষ দুর্বল চিত্ত। টমি ফ্রাংক্স নামীয় যৌথ বাহিনীর এক কমান্ডার স্বীকার করেছেন-মার্কিন সেনার ওপর দিনে ১০-২৫ বার গেরিলারা আক্রমন করছে। ‘আল্লাহ তাদের সহায়ক’ এই মূল মন্ত্রে বিশ্বাস রেখে ইরাকীরা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।যুদ্ধের আনুমানিক ২ মাস পর আকস্মিকভাবে ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের এক ভিডিও টেপ আল-জাজিরা টিভি থেকে প্রচার করা হলো ‘সাদ্দাম হোসেন মার্কিন-ব্রিটিশ সৈন্যদের ওপর গেরিলা হামলা এবং প্রতিরোধ সংগ্রাম জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন।’ প্রতিদিন পত্রিকায় মার্কিন সৈন্য নিহত হবার সংবাদে খোদ আমেরিকায় ইরাক ত্যাগের জোর আওয়াজ উঠেছে আমেরিকান জনগণের মধ্যে।দেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে সুন্নী ও শিয়া মুসলমানরা ইরাকে এক হয়ে জীবন বাজি রেখে আমেরিকান হঠাও আন্দোলনের ডাক দিয়েছে-গেরিলা তৎপরতা এখন ইরাকে আরও বেগবান। স্বাধীনতা যুদ্ধে ইরাকী গেরিলা যোদ্ধারা যেভাবে লড়ছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন সভ্যতার দ্বার উন্মোচন করবে। তা নির্যাতিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত মুক্তিকামী মানুষকে সর্বযুগে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা যোগাবে। ইরাকে এখন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে। এমনিভাবে একদিন ‘৭১ সনে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে-বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। পৃথিবীতে বহু দেশে যুগে যুগে অকুতোভয় সূর্য সন্তানেরা জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছে, আত্মাহুতি দিয়েছে শাহাদাৎ বরণ করেছে-লেবাননের যুদ্ধে কিংবা প্যালেষ্টাইনে, কিউবা কিংবা ভিয়েতনামে। যুদ্ধ করেছে পৃথিবীর বীরশ্রেষ্ঠ সন্তানেরা স্পার্টাকাস, লুমুম্বা, ভগবৎ সিংহ, জেনারেল জিয়া, কিউবার ফিদেল ক্যাষ্ট্র। দেশ জাতি ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মুক্তি সংগ্রামে এই সব বীর যোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, সংগ্রাম করেছেন শুধু নিজ নিজ জাতিকে রক্ষা করতে, ভিনদেশী হানাদারদের কাছ থেকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য, সভ্যতার মানবিক আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য যুদ্ধ করেছেন, ভিয়েতনামে, আফ্রিকায়, চেচেনে, প্যালেস্টাইনে অথবা কসোভোতে এবং এখন যুদ্ধ করছে ইরাকে-তাদের জন্য রইলো পৃথিবীর কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষের লাল সালাম।

পৃষ্ঠা:৪১

ইরাক এখন অন্য আলোয় উদ্ভাসিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয়তাবোধ এবং নিজস্ব সংস্কৃতি এই গেরিলা যুদ্ধকে তরান্বিত করছে। যুদ্ধোত্তর ইরাক পরিস্থিতি-হঠাৎ করে ২৩ জুন ‘০৩ সাদ্দাম পুত্রদ্বয় উদে ও কুদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে এবং গেরিরা যুদ্ধ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে থাকে। সাদ্দাম পুত্রদ্বয় এবং সাদ্দামের এক নাতি প্রবল প্রতিরোধ চালিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেন নাই। আমেরিকান প্রচার মাধ্যমে উদে এবং কুসের লাশের ছবি প্রদর্শন করেছে-তা নির্ভুল কিনা ইতিহাস তার বিচার করবে। বিক্ষুব্ধ ইরাকীরা এখন নতুন নতুন এলাকা তাদের গেরিলা যুদ্ধ আরও তীব্রতর করেছে, হত্যা করছে প্রতিদিনই মার্কিন সৈন্যদেরকে। তথাপিও ইরাকী গেরিলারা মাতৃভূমি রক্ষার্থে এবং মার্কিন বাহিনীকে দেশ থেকে হটানোর জন্য কৌশলগতভাবে গেরিলা যুদ্ধ বেছে নিয়েছে। ইরাকি জাতি যে গর্বিত যোদ্ধা তা তারা হাজার হাজার বছর পূর্ব থেকেই প্রমাণ করে আসছে। বুশ প্রশাসন এখনও কেন যে বিশ্বাস করে যে, যুদ্ধে কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফর্মুলা হতে পারে না-সেটাই হলো আশ্চর্য।আমার বক্তব্য হলো-সারা বিশ্বে বিশ্বায়নের কর্তৃত্ব দখলের নামে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আলো-আঁধারের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মত্ত। পৃথিবীর এই হাইটেকের যুগে বিশ্ববাসীর জীবনযাত্রা পালটাচ্ছে। রাষ্ট্রতন্ত্রে নতুন নতুন বিশেষণ যুক্ত হচ্ছে-সমাজ আর সভ্যতা বিবর্তনের সাথে সাথে মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হচ্ছে-জমাটবাধা দুর্নীতির স্তুপ এবং নৈতিক অবক্ষয়ের মহামিলন হচ্ছে সন্ত্রাসীদের কর্মকান্ড: আর যুগে যুগে এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ। আমেরিকার মদদেই লাদেনের সৃষ্টি হয়েছিলো-ইরান-ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা ইরাককে বহুল আলোচিত গণবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়েছিল। এসব কথা শুনতে যতই অবান্তর সংলাপ হোক না কেন-কিন্তু বাস্তবে এর জন্য শান্তিকামী মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। যেমনটি আজ ইরাক যুদ্ধে দিতে হচ্ছে। সমাজকে হতে হবে পরিশীলিত, মার্জিত, রুচিশীল এবং বিনয়ী। সন্ত্রাস পরিহার করে মানবতাবাদী জ্ঞান- বিজ্ঞানের চর্চা করতে হবে তাহলে আর কোন যুদ্ধেই জড়িত হতে হবে না, সভ্যতাকেও বিনষ্ট হতে হবে না। ইরাকে গেরিলা যুদ্ধের নেপথ্যে যে চিত্র তা হচ্ছে ক্লাষ্টার বোমার আঘাতে সমগ্র ইরাকে রক্তের বন্যা বহমান যখন দজলায়-ফোরাতে রক্তাক্ত

পৃষ্ঠা:৪২

জনপদে মৃত্যু ভয়ে আতংকিত ইরাকী জনগণ। হত্যার বীভৎসতার দুর্গন্ধে বিষাক্ত বাতাস। সন্তানের লাশ বুকে নিয়ে ইরাকী মাতারা পাথরের মতো নির্জীব হয়ে বসে আছেন, বাগদাদের রণাঙ্গন ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় বিধ্বস্ত জনমনে ভীতি সঞ্চার করেছে। ঠিক তখন ইরাক বেছে নিয়েছে আত্মগোপনের পথ আর গুপ্ত হত্যা। মুক্তিযুদ্ধে যে জাতির ইতিহাসে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল সাফলা যে জাতির রয়েছে সংগ্রামের অতীত জীবন গাঁথা যুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়ার পরম আনন্দ। বিক্ষোভকারী আত্মঘাতী মহিলা যোদ্ধারাও কালো পোষাকে আপদমস্তক কাপড়ে আবৃত করে বাগদাদের রাজপথে নেমে এসেছে, মাতৃভূমিকে বিদেশী শাসনমুক্ত করার জন্য আঘাত হানছে মার্কিন বাহিনীর ওপর। ইরাক শাসন করবে ইরাকীরা। দেশকে মুক্ত করতে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য তারা মনে-প্রাণে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটি পত্রিকায় পড়ছিলাম এমনি এক মহিলা মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠে চূড়ান্ত লড়াইয়ের অভিব্যক্তি-যিনি তার সদ্য প্রসূত শিশুর নাম রেখেছেন ‘হাবাস কিম’ যার শব্দার্থ হচ্ছে ‘চূড়ান্ত লড়াই’। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ইরাকীরা মুক্তিযুদ্ধ করছে, চূড়ান্ত লড়াই করছে সত্যিকার স্বাধীনতা রক্ষার্থে দেশকে বিদেশী আগ্রাসন মুক্ত রাখতে। ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছেন গেরিলারা। ইরাকের এই নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইরাকে মার্কিন কমান্ডার জেনারেল আবিজান ইরাকে আরও মার্কিন সৈন্য পাঠাবার জন্য বুশ প্রশাসনকে অনুরোধ করেছেন। ইরাকের গেরিলা যুদ্ধ করছে সাদ্দাম অনুসারীরা এবং ইরাকী জনগণ। জনগণ এক যোগে সুসংগঠিত হয়ে যুদ্ধ করছে এটা এখন সুস্পষ্ট। ইরাকের বিশাল জনগোষ্ঠি শিয়া-সুন্নি নিজেদের মধ্যেকার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সত্যিকার অর্থেই যদি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক মনে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তবে ইরাকীরা আবারও প্রমাণ করবে ইতিহাসের সেরা যোদ্ধা তারাই যাদের রয়েছে যুদ্ধের কালজয়ী অতীত সমৃদ্ধ ইতিহাস। বহু পুরানো সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস ইরাকের এ গেরিলা যুদ্ধে প্রেরণা হয়ে দেশকে মুক্ত করুক-বিশ্ববাসী তাই প্রত্যাশা করে।

পৃষ্ঠা:৪৩

ইরাক পুনর্গঠনে বিশ্ব জনমত

যখন যেখানে যেভাবে ইচ্ছে সেইভাবেই যুদ্ধনীতি পরিচলনা করবে-এটাই হচ্ছে বিশ্বের একচ্ছত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অভিলাষ। তাই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লংঘন করে এবং জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বুশ- ব্লেয়ার যে যুদ্ধ ইরাকে পরিচালনা করলেন তা অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়েছে। -এখন প্রশ্ন উঠেছে ইরাক পুনর্গঠনে ইঙ্গ-আমেরিকা এবং জাতিসংঘের কি ভূমিকা থাকবে? আমেরিকান বুশ প্রশাসন ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রন্থ ইরাক পুনর্গঠনে যে কর্মসূচী নেওয়া হবে তাতে ১০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হবে আর এই অর্থের যোগান পুরোটাই ইরাকের তেল বিক্রির টাকা হতে মিটানো হবে। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে-বুশ প্রশাসনের সরাসরি হস্তক্ষেপে আমেরিকান তেল কোম্পানীগুলিই ইরাকি অর্থনীতিতে শীর্ষস্থানে অবস্থান করবে এবং লাভবান হবে। এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে যুদ্ধত্তোর ইরাকে অর্থনৈতিক সামাজিক বুনিয়াদ বোমার আঘাতে কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ইতোমধ্যেই বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মন্তব্য করছেন ইরাকীরা সব কিছু হারিয়ে শুধু প্রাণে বেঁচে আছে। তাহলে অতি সহজেই অনুমেয় ইরাকের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা যুদ্ধ শেষে কতটা খারাপ? ইরাকি জনগণের মৃত্যু এবং আহত হওয়ার পাশাপাশি চরম ক্ষতি হয়েছে-তাদের কৃষি খামারের, বাড়ীঘরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, অফিস-আদালতের- এমনকি হাসপাতালগুলির। যুদ্ধের নারকীয় তান্ডবলীলায় আর ভয়ভীতির মধ্যে স্ত্রী-পুত্র পরিজন নিয়ে ইরাকি জনগণ এখন সহায়-সম্বলহীন জীবন থাকতেও মৃতপ্রায়। ইরাকের কোথাও বিদ্যুৎ নেই, কর্মবিহীন বিশাল বেকার জনগোষ্ঠি; খাদ্য খোরাক, চিকিৎসা এবং বন্ত্রের মত মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে ব্যর্থ জোট বাহিনী। ইরাকে গণতন্ত্র পুনঃ উদ্ধারের আশা এখন দূরাশা মাত্র। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সবকিছুই এখন ইরাকিদের ধারা ছোঁয়ার বাইরে- ইরাকিরা শুধু জীবনে বেঁচে আছে। পানির জন্য ইরাকিদের আকুতি-মিনতি দেখলে কারবালায় ইমাম হোসেনের মৃত্যুর বিষাদ-সিন্ধুর কথাই মনে করিয়ে দেয়। দৈনন্দিন মামুলি জিনিষপত্র যেমন হাড়ি-পাতিল, কড়াই, কাপড়-চোপড় এবং চাল-ডাল, আটা পুরোপুরি ধবংস হয়ে গেছে। নিঃস্ব- কপর্দকহীন ইরাকবাসীর দুঃখ দুর্দশা -দুর্ভোগ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আজ যে চরম

পৃষ্ঠা:৪৪

ঘনঘটা -যা পূরণ করতে অবশ্যই ইরাকর পুনর্গঠন অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। একথা অনস্বীকার্য। আর ইরাকের পুনর্গঠন প্রশ্নে ইঙ্গ-মার্কিন পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর কোন কমতি নাই। কিন্তু এ কাজে ইরাকি জনগণ ইঙ্গ-মার্কিন শাসনকর্তা গার্নারের প্রশাসনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইরাকের শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায়ের সকলেই বিশ্বাস করে ইরাক পুনর্গঠনে আগ্রাসী দেশের পরিবর্তে ইরাকি জনগণের প্রশাসনই হবে উত্তম। আজ তাই সাদ্দামের পতন ইরাক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। পাশাপাশি ইরাক পুনর্গঠন প্রশ্নও জটিল আবর্তে ঘূর্ণয়মান। শিয়াদের প্রচন্ড সাংগঠনিক শক্তি ও বিরোধিতায় যুক্তরাষ্ট্র হতাশাগ্রন্থ-ইরাক পুনর্গঠনের কর্ম পরিধি কিভাবে নিরূপন করবেন তা বুঝতে পারছেন না। ইরাকের তেল নিয়ন্ত্রণে এখন ওপেকের কোন কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা রইলো না-মার্কিন প্রশাসনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রাধীন এখন ইরাকের তেল অর্থনীতি। ইরাক পুনর্গঠনে প্রতি বছর দুইশত থেকে তিনশত কোটি ডলার লাগবে। ফরাসী সাময়িকী লা-ট্রিবিউনে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান জেমস উল ফেলসন একথা বলেছেন, যুদ্ধোত্তর ইরাক পুনর্গঠন প্রশ্নে ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ এবং মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে মত বিরোধ দেখা দিয়েছে। আমেরিকার দুই সরকারী মুখপাত্র কলিন পাওয়েল এবং কন্ডোলিসা রাইস বলেছেন, আমেরিকা যখন ইরাক দখল করেছে তখন আমেরিকাই ইরাক পুনর্গঠনের দায়িত্বে থাকবে এবং জেনারেল গার্ণারকে তারা ইরাকের নব্য বড়লাট হিসাবে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। মত বিরোধ দেখা দিয়েছে ব্লেয়ারের সাথে-তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মাধ্যমে ইরাক পুনর্গঠনের দায়িত্বে প্রশাসন দিতে হবে। জাতিসংঘ বলেছে, পুনর্গঠনের কাজে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে। ইরাকি জনগণের ওপর তথা সমগ্র বিশ্ব মানবতার ওপর গত ২০ মার্চ ২০০৩ তারিখে বিশ্ব সভ্যতার প্রতিভূ আমেরিকা যে অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ এ অন্যায় যুদ্ধের বিপক্ষে সোচ্চার ছিল। বিরোধিতা করেছিল ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া, চীন, মালায়েশিয়া, জর্দান, ইরান, ভারত, সিরিয়া প্রমুখ। তারপরও ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে যুদ্ধ শেষে ঐ সকল রাষ্ট্র এবং তাদের জনগণ শুধু মানবিক কারণে ইরাক পুনর্গঠনে একমত প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে ইরাক পুনর্গঠনে জাতিসংঘের সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে। জাতিসংঘের অধীনে তারাও বিধ্বস্থ ইরাক গঠনে

পৃষ্ঠা:৪৫

অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক-তবে তা কোনভাবেই ব্রিটিশ-আমেরিকান তাবেদারিতে নয়। মানবিক মূল্যবোধের মর্মজ্বালায়: বিবেকের তাড়নায় সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে বলেছে ইরাকের নিরপরাধ জনগণের জন্য তাদের ভালবাসা, সমর্থন এবং সাহায্য অব্যাহত থাকবে-তবে তা হতে হবে জাতিসংঘের নির্দেশ এবং পরিচালনায়। আমেরিকার প্রতি বিশ্ব জনমত এতটা ঘৃনা প্রকাশ করেছে যে, তারা যেন আমেরিকার অর্থনীতি সম্প্রাসরণে সহযোগী না হয় এবং আমেরিকার পণ্য সামগ্রী যেন বিশ্ব বাণিজ্যে বিস্তৃতি লাভ না করতে পারে। এমনকি খোদ আমেরিকাতে প্রতিবাদের ঝড় উঠছে- জনমনে প্রশ্ন জেগেছে আমেরিকার জনগণের মনে ‘দেশ-বিদেশে আমাদের শত্রুর অভাব নেই-এ যুদ্ধে আমরা বিশ্বে আরও শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়বো।’ আমেরিকা এবং ব্রিটেনের জনগণও ইরাক যুদ্ধে আহত পঙ্গু নিরপরাধ মানুষের জন্য অর্থ যোগান দিয়ে তাদের কিছু দায়িত্ব পালন করেছে। শুনেছি সেদিনও ঝোপ-জঙ্গলে রেড ইন্ডিয়ান নামে যে জতি পশু শিকার করে তার মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করতো-তারা সুপ্রাচীন হাজার বছরের সুমেরু সভ্যতা এবং সংস্কৃতির মূল্য কি করে দিতে জানবে? তারপরও বলবো-আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সংস্কৃতি এবং সভ্যতার দার্শনিক তথ্য জ্ঞানে বিকশিত হতে পেরেছে বলেই আজ আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে তারাও প্রতিবাদ করেছে, মিছিল করেছে এবং আজ যুদ্ধ শেষে অর্থ যোগান দিয়ে ইরাকি জনগণের পাশে থাকতে পেরেছে। এতে আমেরিকার জনগণ মানবতার কান্নায় বিগলিত হতে পেরেছে বলেই সভ্যতার প্রতিভূ হিসাবে তাদের দায়ভার কিছুটা লাঘব করতে চেয়েছে মাত্র-এতে আহামরি কিছু নেই। শান্তির অন্বেষণে আমেরিকা যুদ্ধ এড়িয়ে গেলে, অবশ্যই আমেরিকাকে প্রশংসা করা যেত। ইরাক পুনর্গঠনে বিশ্ব জনমত ইঙ্গ-মার্কিনী প্রশাসনের বিপক্ষে-একথা প্রমাণিত সত্য। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশ সংক্রান্ত ইরাকি জনগণের প্রতিক্রিয়া পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায় তাদের মতো করেই তাদের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তাই একদিকে চলেছে ইঙ্গ-মার্কিন প্রশাসনের ইরাকে পুনর্গঠন কৌশল আর একদিকে চলেছে ইরাকী জনগণের মার্কিন বিরোধী তীব্র ক্ষোভ। আব্বাসীয় খলিফা আমলে বিশেষত হারুন-অর-রশিদ এবং খলিফা আল- মামুনের আমলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিচর্চায় বাগদাদ ‘একাডেমি অফ

পৃষ্ঠা ৪৬ থেকে ৬০

পৃষ্ঠা:৪৬

উইসডম’ নামে বিশ্বে যার স্থান ছিল নিমেষে বুশ তার হিংস্র থাবায় সেসব নষ্ট করলেন, ধবংস করলেন। আর যুদ্ধ শেষে সেই ইরাকের পুনর্গঠনে আমেরিকার সহমর্মিতার এত আয়োজন এত পরিকল্পনা কিসের জন্য? তা তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্যেই, ইরাকের তেল সম্পদকে লুট করার এক কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘মার পুড়ে না মাসির পুড়ে।’ এই সাম্প্রতিক যুদ্ধে অস্ত্রের যোগান দিতে পেন্টাগন যে ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে কিসের জন্য? শুধুই কি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলতে? না তা নয় এর পিছনে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিকল্পনা নাই। মুখ্য হচ্ছে ইরাকের তেল বিক্রি করে অর্থ আত্মসাত করার এক অভিনব উপায়। আমেরিকা ইরাকে নর রক্তের প্রবাহ বইয়ে দিয়েছে আর সবল করেছে তাদের নিজস্ব অর্থনীতির রক্ত প্রবাহকে।যুদ্ধত্তোর একটা দেশে চাই-বেকারত্ব দূরীকরণ, মুদ্রাস্ফীতি রোধ, বিদ্যুতের যথারীতি সরবরাহ, চিকিৎসা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দ্রব্য মূল্য সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ফিরিয়ে আনা। ইরাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার চার মাস অতিবাহিত হতে চলেছে। ইরাকে আমেরিকার প্রশাসন এর কোনটাই ইরাকি জনগণকে দিতে পারে নাই। প্রকৃত অর্থে বাগদাদ এখন আগ্রাসী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ; এই হছে ইরাক পুনর্গঠনে আমেরিকান প্রশাসনের ভূমিকা। তাই বিশ্ব জনমনে প্রশ্ন রইয়েই গেল এ কেমন পুনর্গঠন। এ কেমন গণতন্ত্র? ইরাকিদের প্রশ্ন ‘মার্কিনীরা কেন আমাদের শাসন করবে?’ বাগদাদের পতন হয়েছে চার মাস আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইরাকে নৈরাজ্য আর বিশৃংখলা, লুটতারাজ এবং গেরিলা যুদ্ধ ছাড়া ইরাক পুনর্গঠনের কোন কর্মসূচী বাস্তবে ইরাকে পরিলক্ষিত হয় নাই। ইরাকিরা তাদের নিজেদের কর্তৃত্বাধীন নতুন শাসন ব্যবস্থার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। মার্কিন প্রশাসন জেনারেল গার্ণারকে ইরাকিদের তীব্র চাপের মুখে বুশ প্রশাসন দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। ইরাকিদের একটাই প্রশ্ন কেন আমেরিকান শাসক তাদের শাসন করবে? এই কি তবে বুশ প্রশাসনের গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করার প্রক্রিয়া। তাহলে সাদ্দামই তাদের জন্য ভাল ছিল। সাদ্দামের আমলে তারা খেতে পারতো, চাকুরী করতে পারতো, জানমালের নিরাপত্তার জন্য রাতে আতংকের প্রহর কাটাতে হতো না। ইরাকিদের এখন দৃঢ় বিশ্বাস যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজস্বার্থে ইরাককে দখল করে রাখতে চায়। এইতো ১৪ সেপ্টেম্বর আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন কলিন পাওয়েল

পৃষ্ঠা:৪৭

ইরাকে গিয়ে বক্তব্য দিলেন মার্কিন প্রশাসন এবং দখলদার বাহিনী ইরাকে শান্তি ফিরে না আসা পর্যন্ত অবস্থান করবে। এ ব্যাপারে তার বক্তব্যে যথেষ্ট দৃঢ়তাই প্রকাশ পেয়েছে। এটা অবশ্যই সত্য মার্কিন সামরিক বাহিনীর সমর অভিযানের কারণে ইরাকিরা তাদেরকে পছন্দ করে না। সাদ্দাম এবং তার ৫৫ জন মোষ্ট ওয়ান্টেড বাথ পার্টি নেতা কর্মী এবং সাদ্দাম অনুগত বাহিনী সেনা সদস্য ও সেনা নায়কদের খুঁজে বের করার জন্য তারা মধ্য যুগীয় বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে। ইরাকিদের মুক্ত করার এই হচ্ছে মার্কিন প্রশাসনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি। তাই ইরাকে মার্কিন বিরোধী মনোভাব দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। মার্কিন সেনারা হাসপাতালে ডাক্তারদের সাদ্দামের অনুগত সৈন্য মনে করে গুলি করে হত্যা করেছে। নিত্য চলেছে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, রাহাজানি। ইরাক যুদ্ধে স্বজন হারার আজাহারী এবং শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ একদিকে, আর একদিকে মার্কিন কর্তৃত্বাধীন শাসকের সরকার গঠন প্রক্রিয়া। ইরাকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হয়েছেন মার্কিনীদের সমর্থনপুষ্ট সাদ্দাম বিরোধী নেতা চালাবি। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্র। ইরাক পুনর্গঠনে আমেরিকান সমর্থনে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে তাতে ইরাকিদের কোন আস্থা নাই। তারা ছাফ বলে দিয়েছে; তারা এই সরকার মানে না আর এরই মধ্যে শিয়া সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতা আবদুল্লাহ হাকিম বোমার আঘাতে মারা গেলেন বসরায়। মার্কিন বিরোধী মিছিল এবং সমাবেশ হয়েছে-যা স্মরণকালের বিশাল সমাবেশ এখান থেকে তারা মার্কিনীদের হাত থেকে দেশ রক্ষা করার জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। হতাশাগ্রস্থ বাগদাদবাসীর প্রশ্ন- বাগদাদে নবগঠিত ন্যাশনাল কাউন্সিল কাদের, কি ধরনের গণতন্ত্র ইরাক পুনর্গঠনে কার্যকর করতে চায় ইরাকিরা তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে বুশ প্রশাসনকে; তাদের নেতা হবে এমন একজন যার সাথে ইরাকিরা নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে দেশ শাসন করবে। এজন্য মার্কিনীদের কর্মসূচী বহুলাংশে ভেস্তে যেতে বসেছে-তাদের দেওয়া গণতন্ত্র ইরাকে কত সময় টিকবে? এখন সেই প্রশ্নই বিশ্বজনমনে। আমেরিকার দেওয়া গণতন্ত্র তাইতো ইরাকিদের কাছে দূর্বোধ্য এবং কঠিন-যা ইরাকি জনগণের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ইরাকে এখন গণতন্ত্রায়নের যে সংকট দেখা দিয়েছে-তা ইরাক পুনর্গঠনে তীব্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সাধারণ ইরাকিরা এখন আশাহত এবং আতংকিত-কবে তারা সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরে পাবে, এজন্য তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে

পৃষ্ঠা:৪৮

পড়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানও ইরাক পুনর্গঠনের কর্মসূচী নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ প্রশ্নে জাতিসংঘকে দেওয়া ইঙ্গ-মার্কিন নতুন ফর্মুলা ফ্রান্স, জার্মানী কঠোর ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে-বলেছে এখানে জাতিসংঘকে কোন ক্ষমতা প্রদান করা হয় নাই। সম্পূর্ণ আমেরিকার কর্তৃত্বাধীন শাসন ব্যবস্থার যে প্রস্তাব আমেরিকা দিয়েছে তা কেবল ইরাকি জনগণই বিরোধিতা করেন নাই, সমগ্র বিশ্ব এই শাসন ব্যবস্থার বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছে। ইরাকের তেল বিক্রির অর্থ দিয়ে ইরাকে যে মানবিক সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সেটা নামমাত্র কাগজী কারবার। প্রকৃত অর্থে ইরাকের তেল বিক্রির টাকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল লাভবান হচ্ছে এবং হবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ইরাকী জনগণের জন্য তাদের দেশে উৎপাদিত গম এবং চাউল যে পরিমাণ প্রেরণ করেছে। তাতে অন্তত ইরাকের পুনর্গঠন হয় না, সাময়িক ক্ষুধা নিবারণ করা যায় বটে। ইরাক যুদ্ধের জন্য সংরক্ষিত বাজেটে যে অর্থ আমেরিকা ব্যয় করেছে সে অর্থে আমাদের মত গরীব দেশের আট বছরের বাজেট হতে পারে। তাহলে ইরাক পুনর্গঠনে আমেরিকার ভূমিকা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। ইতোমধ্যে শিয়ারা ইরাকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছে আর তাতে করে আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেন্ড হুশিয়ার করে দিয়েছে ইরাকে ধর্ম ভিত্তিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা চলবে না। ইরাক পুনর্গঠন প্রশ্নে পারস্পরিক সন্দেহ এবং সর্বোপরি আমেরিকা নিজেই ইরাক প্রশাসনে নিজেদের কর্তৃত্ব যে ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান- তাতে ইরাক পুনর্গঠন দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ইরাকে ৬০% ভাগ অধিবাসী হচ্ছে শিয়া মুসলমান। আর তাদের দাবী হচ্ছে ইরাক পুনর্গঠনের দায়িত্ব একটি জাতীয় এবং স্বাধীন সরকারের হাতে ন্যাস্ত করতে হবে। আর এ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ভীষণভাবে শংকিত এবং চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ইরাকের শিয়া সম্প্রদায় পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ইরাকে আমেরিকার দখলদার বাহিনীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোন প্রয়োজন নেই। এই প্রশ্নে ইরাকের সুন্নিসহ সকল জনগণই একমত পোষণ করে। তাই ইরাক পুনর্গঠনে বিশ্বজনমনে যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তা কেবল ইরাকিদের দ্বারা গঠিত স্বাধীন জাতীয় সরকারই তা সমাধান করতে পারবে। এর কোন বিকল্প হতে পারে না-সে যত বড় শক্তিশালী পরাশক্তি হোক না কেন?

পৃষ্ঠা:৪৯

সাদ্দাম একটি নাম: একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস

বাথ পার্টির বিপ্লব বার্ষিকীতে সাদ্দামের আহ্বান ‘মিথ্যাচারী বুশ-ব্লেয়ারকে উচিত শিক্ষা দিন’। ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ১৭ জুলাই ‘০৩ বাথ পার্টির বিপ্লব বার্ষিকীতে আল-জাজিরা এবং আল এ্যারাবিয়া টিভি নেটওয়ার্কে সম্প্রচারিত সাদ্দামের একটি নতুন অডিও টেপে এ আহ্বান জানান। ১৯৬৮ সনে বাথ পার্টির যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার ১১ বৎসর পর ক্ষমতায় আসেন ইরাকের লৌহমানব সাদ্দাম হোসেন। সেই থেকে সাদ্দাম হোসেন ইরাকের একজন বহুল আলোচিত শাসক।২০ মার্চ ‘০৩ বুশ-ব্লেয়ারের ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ইরাক আক্রমন করার পর মাস যেতে না যেতেই বাগদাদের পতন হয়েছে ৭ এপ্রিল ‘০৩। আর সেই সাথে সাদ্দাম হোসেনকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নাই। তবে সাদ্দামকে নিয়ে নানান কথা-নানান গুজব এবং নানান মন্তব্য পত্র-পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই আমরা পড়েছি। ২৯ এপ্রিল ‘০৩ দৈনিক যুগান্তরের এক শিরোনামে দেখলাম ‘জীবন থাকতে সাদ্দাম ধরা দেবেন না’-চালাবি। আমেরিকান সমর্থনপুষ্ট ইরাকের নেতা আহমেদ চালাবি পত্র-পত্রিকায় মন্তব্য করে জানালেন সাদ্দাম হোসেনকে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের মতো বিস্ফোরক জড়িত বিশেষ পোশাকে দেখা গিয়েছে। তার বিশ্বাস জীবন থাকতে সাদ্দাম ধরা দেবেন না। ধরা পড়ার আগেই সাদ্দাম নিজেকে উড়িয়ে দিবেন। তিনি আরও বলেন যে সাদ্দাম আত্মঘাতী বোমা হামলার পোশাক পরার ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যে যেভাবেই নেন, সাদ্দাম হোসেন একটি নাম-একটি অবিস্মণীয় ইতিহাস এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যদিও প্রেস ব্রিফিং এ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (ছোট) বলেছেন ‘সাদ্দাম এখন ইতিহাস মাত্র’। আমার মতে তিনি যথার্থই বলেছেন, তবে সাদ্দাম কেবল ইতিহাস নয়-একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস। একথাটি না বলে বুশ সাহেব ভুল করেছেন।  যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ঘটা করে ২৮ এপ্রিল ‘০৩ ইরাকের তিকরিত নগরী যেখানে সাদ্দাম জন্মেছিলেন সেখানে ইরাকবাসী সাদ্দামের জন্ম বার্ষিকী পালন করলেন। কোন জৌলুষের কমতি নেই। সেইদিন ইরাকীরা সাদ্দামের জন্মদিন পালনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেছেন, সাদ্দাম মরে নাই-‘বাপের বেটা সাদ্দাম বেঁচে থাকুক যুগ যুগ।’ যদিও এরই মধ্যে

পৃষ্ঠা:৫০

বাগদাদে সাদ্দামের সবচেয়ে উঁচু দামী স্ট্যাচুটি দখলদার বাহিনী ভেঙ্গে ফেলেছে, লুটপাট করেছে বিভিন্ন শহরে সাদ্দামের বিলাস বহুল প্রাসাদ এবং দামী আসবাবপত্র তৈজসপত্রও। এসব প্রাসাদের ভিতরের সাজানো আসবাবপত্র দেখলে যে কেউ বলবেন সাদ্দাম একজন উঁচু মানের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি অবশ্যই বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। আমি তার একটি প্রাসাদের খানিকটা বর্ণনা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। ‘সাদ্দামের প্রসাদগুলির এটি অন্যতম। ১৯৬০ সনে এই ভবনটি তৈয়ারী হয়েছিল। এটি একটি সাজানো বাড়ী। এ বাড়ীর শোবার ঘরের দেয়াল পুরোটাই আয়নায় ঢাকা। এ বাড়ীতে রয়েছে নারী মূর্তির অবিকল একটি ল্যাম্প এবং কুমীরের সাথে যুদ্ধরত গোঁফওয়ালা এক বীরের ছবি। ২০০২ সনে সাদ্দাম একবার এই বাড়ী থেকে পালিয়ে কয়েকদিনের জন্য লেবাননে গিয়েছিলেন। এই সাজানো বাড়ীটিকে আমরা ‘সাদ্দাম প্রাসাদ’ বলেই জানি। সেটি ইরাকের একটি অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। বাড়ীটির জানালাগুলো লোহার আচ্ছাদনে আবৃত। বাড়ীটিতে সাজানো হয়েছে প্লাষ্টিকের কৃত্রিম গাছের বাগান। বিশাল বিশাল বিলাস বহুল আকর্ষণীয় চেয়ার; কিছু দামী ব্রান্ডি এবং কাচের শোকেস। আর কিছু কাঁচের দামীতৈজসপত্র। সাদ্দাম সচরাচর চীনামাটির তৈয়ারী প্লেটেই খাবার খেতেন। তারই কয়েকটি প্লেট যাতে রয়েছে ইরাকের সরকারী প্রতীক চিহ্ন ঈগল এবং সে দেশের খোদাই করা পতাকা (২০ ব্যাসার্ধ প্লেট)। টিভি কক্ষে রয়েছে দামী দামী নীল, লাল, হলুদ রং এর বালিশ।’ এ বর্ণনা দিয়েছেন একজন সাংবাদিক যিনি ইরাক যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। সাদ্দামের বিলাস বহুল জীবন-যাপনের পাশাপাশি আমি যদি তাকে অন্য দৃষ্টি দিয়ে দেখি; তাহলে অবশ্যই তাকে রুচিসম্পন্ন সংস্কৃতিবান শাসক বলতেই হবে। সাদ্দাম আধুনিক ইরাকের স্থপতি এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন জীবিত কি মৃত এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় নাই। পূর্বেই বলেছি এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনারও শেষ নাই। যদিও বুশ-ব্লেয়ার বলেছেন ‘সাদ্দাম আছে কি নাই তাতে কিছু আসে যায় না।’ কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বিশেষত ইতিহাসবিদরা মনে করেন সাদ্দাম জীবিত থাকুন বা নাই থাকুন। তিনি যে একজন আরব বীর, যিনি অবশ্যই ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাদ্দাম জীবিত আছে কি নাই এ প্রশ্ন থেকেই গেছে তাই বলে ‘সাদ্দাম ভীতির ভূত বুশ-ব্লেয়ারের ঘাড় থেকে এখনও নামে নাই। সে কারণে বুশ সাহেব ঘোষণা দিলেন ‘যিনি সাদ্দামের খোঁজ দেবেন তাকে ৩ লক্ষ মার্কিন

পৃষ্ঠা:৫১

ডলার পুরস্কার আর উদে-কুসের খোঁজ খবর দিলে ২ লক্ষ মার্কিন ডলার পুরস্কার দিবেন। তারপরেও বুশ সাহেব বলে বেড়াচ্ছেন ‘সাদ্দাম এখন ইতিহাস মাত্র দুঃখ হয় যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে তথ্য প্রযুক্তিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, সে জাতির প্রেসিডেন্টের জ্ঞানের পরিধি এতটা নেমে গেল কি করে? মৃত সাদ্দামের ভূতের ভয় তাহলে তাদের পেয়ে বসেছে এ কেমন কথা। আর এ না হলে বীরত্ব। জলপাই রং এর মিলিটারী পোশাক পরে বুশ সাহেব যুদ্ধে নেমেছেন কি শুধু শুধু? কিন্তু ইরাক জাতি সাদ্দাম মারা গেছেন একথা মানতে রাজী নয়। তারা এবারও ঘটা করে ‘সাদ্দামের জন্মদিন’ আনন্দঘন এবং জাঁক-জমকের সাথে পালন করেছে। তাদের কথা হলো-সাদ্দাম দীর্ঘজীবী হউক। ইরাকিরা এখনও মনে করে সাদ্দামই তাদের ত্রাণকর্তা। সাদ্দাম স্বৈরাচার হোক বা অত্যাচারী হোক, তবু সাদ্দাম তাদের জাতীয় নেতা এবং বুশ-ব্লেয়ারের ও ইরাকের বর্তমান শাসনকর্তা ব্রেমার থেকে অনেক ভাল। সাদ্দাম ইরাকিদের খাওয়া পরার নিশ্চয়তা দিয়েছেন, বাড়ীঘর, শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন, চাকুরী দিয়েছেন। চলমান জীবনের গতি দিয়ে আধুনিক ইরাকে বিদ্যুৎ, হাসপাতালসহ অন্য সব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী ইরাকের শাসনকর্তা জে, গার্ণার এবং ব্রেমার তাদেরকে দিয়েছে নৈরাজ্য, লুটপাট, মৃত্যু, শঙ্কা, ঘরবাড়ী হারানো আর স্বজন হারানো বেদনার সাথে বেকারত্ব। বুশ-ব্লেয়ার দেশ-বিদেশে বলে বেড়াচ্ছেন, সাদ্দামের পতন হয়েছে। ইরাকিরা এখন মুক্ত। ইরাকীরা স্বাধীন। আমি জানি না স্বাধীনতার সংজ্ঞা নতুন করে লেখা হবে কিনা? এতদিন অবশ্য রাষ্ট্র বিজ্ঞানে জেনে এসেছি-স্বাধীনতা মানে একটি দেশের নিজস্ব ভূ-খন্ড রক্ষা করার অধিকার, একটি জাতির নিজের নেতা দ্বারা পরিচালিত একটি সরকার এবং একটা দেশের জনগণের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি রক্ষা করার সার্বভৌম অধিকার। সেনাবাহিনীর দ্বারা ইরাক আক্রান্ত হলো, দেশের মধ্যে লুটপাট হলো, সাধারণ নাগরিককে নির্মমভাবে বোমার আঘাতে আর মিসাইল নিক্ষেপ করে মারা হলো। তারপরেও কি বলতে হবে ইরাকিরা স্বাধীন হয়েছে? এই যদি হয় বুশ-ব্লেয়ারের গণতন্ত্র বা স্বাধীনতার রূপরেখা তাহলে অবশ্য সাদ্দাম আমলে ইরাকিরা স্বাধীন ছিল, যুক্ত ছিল। যে স্বাধীনতা বুশ-ব্লেয়ার হরণ করে নিয়েছে। তাই সাদ্দামের আমলে জনগণ সুচিকিৎসা পেয়েছে, তারা নির্বিঘ্নে শাস্তিতে বসবাস করেছে। ইরাকিদের কাছে এখন এটা স্পষ্ট যে, সাদ্দাম ছিলেন ইরাকি জনগণের স্বাধীনতার প্রতীক। সাদ্দাম ছিলেন ইরাকের জাতীয়তাবাদের প্রকৃত নেতা। সাদ্দাম ইরাকি জনগণের কাছে এখন আর নায়ক নন মহানায়ক, যার মধ্যে ছলনা বা প্রতারণা ছিল না। বুশ-ব্লেয়ার তথাকথিত মারণাস্ত্র ইরাকে আছে বলে

পৃষ্ঠা:৫২

মিথ্যাচার আর প্রতারণার যে কলঙ্ক লেপন করলেন তা বিশ্ববাসী কোন ভাষায় নিন্দা করবে খুঁজে পাচ্ছে না। বুশ-ব্লেয়ার সাদ্দাম প্রশাসনকে ইরাকে যে ভাবেই চিহ্নিত করুক না কেন ইরাকি জনগণের কাছে সাদ্দাম একজন বীর সন্তান। যিনি আরব জাতীয়তাবাদের আদর্শে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পেরেছেন। সাদ্দাম যুগ-যুগান্তরের একজন অবিস্মরণীয় নেতা-ইতিহাসের মহানায়ক। যার প্রয়োজন ইরাকীদের কাছে এখন অনেক বেশী। ইরাকিরা তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছেন। সাদ্দামকে বলা হলো স্বৈরাচারী। অথচ বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক যুদ্ধের শুরু থেকে ইরাক যুদ্ধ শেষাবধি ইরাকে সংবাদপত্রের কোন স্বাধীনতা নেই। বিনা কারণে সংবাদপত্রে যুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিককেই ইঙ্গ-মার্কিন সৈন্যদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এটাই বুশের গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি। বুশ-ব্লেয়ারের চাপিয়ে দেওয়া সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্বের জনগণ এ যুদ্ধের বিপক্ষে সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছে বুশের শাসন ব্যবস্থার গণতন্ত্রে ইরাকি জনগণ পুড়ে ছারখার হচ্ছে। তাই তারা মুক্তির জন্য গেরিলা যুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন দখলদার বাহিনীর সদস্যদের প্রতিদিনই হত্যা করছে। তাহলে পাঠক সমাজ আপনারাই বিচার করুন স্বৈরাচারী কে? যে আমেরিকা গর্ব করে বলতে পারতো আমরা জন্ম দিয়েছি বিখ্যাত গণতন্ত্রের মানসপুত্র জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন, রুজভেল্ট, জন.এফ. কেনেডি, জিমি কার্টার এবং সর্বশেষ ক্লিনটন প্রমুখ মানবতাবাদী এবং সংবেদনশীল নেতাকে। যাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ছিল হিমালয়ের মত উঁচু, আর যারা মানবিক কর্মকান্ডের জন্য পৃথিবীতে নন্দিত হয়েছেন, প্রশংসিত হয়েছেন। যারা সারা জীবন মানুষের সমৃদ্ধময় এক জীবনের জন্য গান গেয়ে গেলেন। বিশ্বের এ সকল বিরল ব্যক্তিত্ব ক্ষণজন্মা রাষ্ট্র নায়ক। তারাও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং আজ এই বুশও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তাদের অতীতের সকল মানসম্মান বুশ সাহেব ম্লান করে দিলেন ইরাকে এই অসম ও অন্যায় যুদ্ধ চালিয়ে; ভুলণ্ঠিত করলেন মানবতাকে। আমেরিকা এ লজ্জা কি দিয়ে ঢাকবে? মানুষের অধিকার আদায়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় দেশে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐ সকল রাষ্ট্র নায়করা নিবেদিত ছিলেন। আর যাঁদের আচার-আচরণ এবং শিষ্টাচারের জন্য আজও আমেরিকা গর্ব করে নিজেদের সভ্য জাতি বলতে পারে। অথচ তাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বুশ এতটা নির্দয়, বর্বর হতে পারলেন কি করে? এটা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। বুশ-ব্লেয়ার ইরাকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবেন বলে যে নাটক

পৃষ্ঠা:৫৩

করলেন তারা অবশ্যই পৃথিবীর মানুষের ভালবাসা পাবার যোগ্য নয়। মানবতা বর্জিত যে শাসন ব্যবস্থা বুশ প্রতিনিধি ব্রেমার ইরাকে দিয়েছেন, তা ইরাকি জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে এবং তাদেরকে আমেরিকায় ফিরে যেতে বলেছে। আজ তাই ইরাকের শিয়া-সুন্নি নিজেদের মধ্যকার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বলছে সাদ্দামই তাদের নেতা। বুশ-ব্লেয়ারের চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্র তাদের কাম্য নায়-এ ব্যাপারে শিয়া-সুন্নি একাত্মতা ঘোষণা করে এবং ইরাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষ সাদ্দামকে বাহবা দিচ্ছে আর ধিক্কার দিচ্ছে, বুশ-ব্লেয়ারকে একটা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে ইরাকের নিরীহ মানুষগুলিকে হত্যা করার জন্য। ইরাকে এখন দানবীয় সভ্যতার আর্বিভাব ঘটেছে। তাহলে পাঠককূল আপনারাই বিচার করবেন সাদ্দাম নায়ক না মহানায়ক। ইতোমধ্যেই ইতিহাসবিদগণ সাদ্দামকে আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরা মন্তব্য করেছেন যে ইরাকে ইঙ্গ- মার্কিন দখলদার বাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা হিটলারের নাৎসিদেরকেও হার মানায়। ইরাকি জনগণ তাই সাদ্দামের দীর্ঘ জীবন কামনা করেছে। বাগদাদ পতনের প্রথম দিকে আমেরিকা প্রচার করেছে সাদ্দাম এবং তার দুই পুত্র হামলায় নিহত হয়েছে কিংবা ইরান, সিরিয়া, নয়তো জর্ডানে পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের প্রশ্ন সাদ্দামের যদি মৃত্যুই হয়ে থাকবে তবে তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ৩ লাখ আমেরিকান ডলার পুরস্কার ঘোষণা কেন? আর কত দিন বুশ-ব্লেয়ার তথ্য কল্পনার ফানুস উড়িয়ে পৃথিবীর সভ্য মানুষগুলিকে ধোকা দিবেন। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’। বুশ-ব্লেয়ারের চোখ থাকতেও তারা এখন অন্ধ। এখনও বুশ-ব্লেয়ার চিৎকার করে বলছেন ইরাকে অবশ্যই মারণাস্ত্র পাওয়া যাবে। ড. কেলির রহস্যজনক মৃত্যু আরও স্মরণ করিয়ে দেয় বুশ-ব্লেয়ারের তথ্য ছিল মিথ্যা। সাদ্দাম ৪৫ মিনিটের মধ্যে মারণাস্ত্র দিয়ে গোটা পৃথিবী উড়িয়ে দিতে পারেন। এসব তথ্য নিছক মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। অন্ধ দৃষ্টি দিয়ে দেখলে অবশ্যই বুশ-ব্লেয়ারের দেখায় কোনও ভুল ছিল না। বুশ-ব্লেয়ার চাইলে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করতে পারতেন। যারা মানুষের জীবনের মূল্য দিতে জানে না তারা আবার তোতা পাখির মত গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়। যারা ইরাকে মানুষের বাঁচার অধিকার কেড়ে নিল। মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করলো। গণতন্ত্রকে বলি দিল। মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালো। সেই ইঙ্গ-মার্কিনীরা সভ্যতার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করে কিভাবে? সাদ্দাম জীবিত কি মৃত? সেটা আমাদের কাছে বড় নয়। বড় কথা হলো আজ সাদ্দাম পৃথিবীর সকল নির্যাতিত মানুষের প্রিয় নেতা। সাদ্দাম একটি

পৃষ্ঠা:৫৪

অবিস্মরণীয় নাম-একটি কণ্ঠ যুগ যুগ মুক্তি সংগ্রামে প্রেরণা যোগাবে সাদ্দাম এখন পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের আলোর দিশারী হয়ে যুগ-যুগান্তর বেঁচে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। সাদ্দাম সর্বকালের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক, জাগ্রত বিবেক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, কালজুয়ী বিপ্লবী নেতা। ইরাকি জনগণ সাদ্দামের শাসন থেকে মুক্তি চেয়ে ছিল কিনা জানিনা। তবে বুশ- ব্লেয়ারের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির জন্য জীবনকে বাঁজি রেখে প্রাণপণ গেরিলা যুদ্ধ করছে। তাইতো বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ সাদ্দাম দীর্ঘজীবী হোক-বেঁচে থাকুক বলে দোয়া করছে। সাদ্দাম কেবল ইরাকের লৌহ মানবই নয়। সাদ্দাম এখন বিশ্বের অন্যতম স্বীকৃত শ্রেষ্ঠ বীর। ১১ সেপ্টেম্বর ‘০২ নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে এবং ওয়াশিংটনে পেন্টাগণের ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলাকে করেছে তার প্রমাণ এখন পর্যন্ত আমেরিকা দিতে পারে নাই। তার কোন অকাট্য প্রমাণ মেলেনি অথচ তারই জন্যে দু-দুটো রাষ্ট্রের নিরীহ মানুষগুলিকে বোমার আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন করলেন জর্জ বুশ। এটার নাম কি গণতন্ত্র? পৈচাশিক, বর্বর হামলায় আফগানিস্তান এবং ইরাকে রক্তের হোলি খেলে বললেন পৃথিবী থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করতে হবে। কোন যৌক্তিকতায় আফগানিস্তান এবং ইরাক দখল করে নিলেন এর কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের ভাষায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হয়েছে। কে সন্ত্রাসী কাজ করেছে তার প্রমাণ থাক আর নাই থাক। হাজার হাজার মানুষের রক্তে ইরাকের মরু প্রকৃতি বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। আমেরিকার ভাষায় এটা কোন অন্যায় নয়-এটা কোন দোষের নয়; কারণ আমেরিকা পৃথিবীর প্রভু, তারা কোন অন্যায় করতে পারে না। তারা এই সকল মারণাস্ত্র পৃথিবীর যেখানে খুশি সেখানেই নিক্ষেপ করবে। এতে তাদের কোন অপরাধ হবে না? কারণ তারা দেবতা। তাদের কোন পাপ নাই।

সে যাই হোক সাদ্দামের সন্ধান এখনও মেলেনি। এই লেখা শেষ করার আগে ১৯ সেপ্টেম্বর ‘০৩ পত্রিকায় সংবাদ জানা গেল নতুন একটি ভিডিও টেপে সাদ্দাম ইরাকে গেরিলা যুদ্ধ আরও তীব্রতর করার জন্য ইরাকিদের বলেছেন। এদিন গেরিলা আক্রমনে ৮ জন মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে। এখন সাদ্দামের জীবনচরিত পড়লে এবং আজ পর্যন্ত তাকে মূল্যায়ন করলে এটাই চরম সত্য যে, সাদ্দাম একটি নাম এবং অবিস্মরণীয় ইতিহাস। যদিও ইরাক যুদ্ধের আগে এটা বলা কঠিন ছিল।

পৃষ্ঠা:৫৫

বুশ-ব্লেয়ারের যন্ত্রর মন্ত্রর

যখন ছোট ছিলাম তখন যাদু মন্ত্রের কত কল্প কাহিনী শুনেছি, আর মনে মনে অনেক আনন্দ উপভোগ করেছি। সেসব দিন এখন বিস্মৃতির অতলে বন্দী। বড় হয়ে জানতে পেরেছি ভারত উপমহাদেশই যাদু মন্ত্র ও রূপকথার উদ্ভাসিত দেশ। ভারতবর্ষের কামরূপ-কামাখ্যা যাদু মন্ত্রের চমকে ভরপুর। এ অঞ্চলে বসবাস করছে অর্ধ নগ্ন এবং নগ্নপ্রায় উলঙ্গ নর-নারী সন্নাসীদের দল। জটা লম্বা চুল, লম্বা লম্বা গোঁফ-দাড়ি, শ্মশ্রুমন্ডিত নানা গোত্রের নানা বর্ণের সাধু-সন্নাসী বৈরাগীদের আখড়া হচ্ছে এই কামরূপ-কামাখ্যা। সকল জাগতিক সুখ-চিন্তা, চেতনা, লোভ-লালসা, পার্থিব সংসার জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি পরিহার করে এক ঐশ্বরিক শক্তির স্পর্শ পাবার তৃষ্ণায় এইসব নর-নারী সাধুরা আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় নিজেদের জীবন- যৌবন সমার্পিত করেছে। আর নানা ধরনের যন্ত্রর- মন্ত্ররে যাদু বিদ্যার অলৌকিক কর্মকান্ড ঘটিয়ে এই সব সাধু-সন্ন্যাসীগণ খ্যাত হয়েছেন। যাদু মন্ত্রের এ অঞ্চল এতই প্রসিদ্ধ যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল এবং দেশ থেকে কেউ বা দেখতে কেউ তা শিখতে আসে, আবার কেউ বা ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে যুগে যুগে এই কামরূপ-কামাখ্যায় এসেছে। ভারতবর্ষের যন্ত্রর মন্ত্রর তাইতো খুবই খ্যাত এবং চমকপ্রদ। ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের অলৌকিক চমক আর গণবিধবংসী অস্ত্রের ম্যাজিক দেখলে মনে হবে যে বুশ-ব্লেয়ারের বিজ্ঞানের যন্ত্রর-মন্ত্ররের অসাধারণ ক্ষমতা তাতে বিস্মিত হতেই হয়। বুশ-ব্লেয়ারের তথ্য ইরাকে মারণাস্ত্র বা জীবাণু অস্ত্র আছে যার আঘাতে ৪৫ মিনিটে পৃথিবী ধবংস হয়ে যেতে পারে-এ বক্তব্য শুনলে বুশ-ব্লেয়ারের যন্ত্রর-মন্ত্ররের কথাই মনে হবে, সততা থাকুক আর না থাকুক। ব্রিটিশ ভারতে এদেশে ব্রিটেনের রাজত্বকালে ব্লেয়ারের কোন পূর্ব পুরুষ ভারতবর্ষে এসে ভেলকি বাজী বা যাদু মন্ত্র শিখেছিলেন কিনা জানি না। তবে ইরাকে মারণাস্ত্র আছে ইহা ভুল বা মিথ্যা তথ্য যাই বলি না কেন তাকে সত্য বানিয়ে জাতিপুঞ্জকে বশ করলেন কিভাবে বা বুশের তথা-কথিত ৩৪টি রাষ্ট্র বুশ- ব্লেয়ারের যন্ত্রর-মন্ত্রর সম্মোহনী শক্তি দিয়ে চমক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন বলেই তারা মিত্রশক্তি হিসাবে একিভূত হয়েছে। একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে ইঙ্গ-মার্কিন প্রশাসন ইরাকে এক অসম যুদ্ধের পরিকল্পনা করে ইরাক আক্রমন করেছে। যদিও পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বুশ-ব্লেয়ারের চাতুর্য বুঝতে পেরেছে। বুশ-

পৃষ্ঠা:৫৬

ব্লেয়ারের চমকে ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলো বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে নাই। তাইতো ঐ ৩৪টি রাষ্ট্র ব্যতিরেকে পৃথিবীর তামাম দেশগুলি ইরাকে মারণাস্ত্র আছে- বুশ-ব্লেয়ারের এই যন্ত্রর-মন্ত্ররের অলৌকিক দর্শনে কান না দিয়ে ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, প্রতিবাদ করেছে, মিছিল ও সভা করেছে। সাম্রাজ্যবাদের হায়নার নগ্ন থাবাকে পৃথিবীর জনগণ মেনে নিতে পারে নাই, নিন্দা করেছে। সমগ্র বিশ্ব তাই ইরাক যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কোথাও কোথাও এর প্রতিবাদ এতই তীব্র ছিল যে সেসব দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলি মানবতাবাদী শান্তি মিছিলে গুলি করে। তারপরও আমি বলবো বুশ-ব্লেয়ারের মারণাস্ত্রের তথ্যের যন্ত্রর-মন্ত্ররের ম্যাজিক শোতে বড় বেশী চমক ছিল। নইলে সমগ্র পৃথিবীকে একদিকে ঠেলে দিয়ে কোটি কোটি মানুষের বিবেকের দাবীকে উপেক্ষা করে জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে তারা এত বড় অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারলো কিভাবে? সমর বিশেষজ্ঞদের মতে বুশ- ব্লেয়ারের এ যুদ্ধের পিছনে রহস্য হচ্ছে তাদের বিশাল সমরাস্ত্র উৎপাদন এবং বিশ্ব বাজারে এই সমরাস্ত্র বিক্রি করা। সে কারণে ইরাকে এ যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। আর ইরাকের তেল সম্পদ-তো বুশ-ব্লেয়ারের বাড়তি সুবিধা; পাশাপাশি মিত্র শক্তিগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা করার মধু স্বপ্নতো বুশ-ব্লেয়ার দেখতেই পারে। যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করলে, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির কথা ভাবলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকার কথা স্মরণ করলে কোন মানবতাবাদী রাষ্ট্রই এ যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারে না। আর জাতিসংঘতো নৈতিকভাবে এ ধরনের যুদ্ধকে সমর্থন করতেই পারে না। তারপরও বুশ- ব্লেয়ারের সু-মন্ত্রর সু-যাদুর অলৌকিক ক্ষমতাবলে কোন কোন পরাশক্তিকে সত্য-মিথ্যা কথার চাতুরী দিয়ে কুটনীতির ছলনায় আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন বলেইতো নিরপরাধ ইরাকী জনগোষ্ঠিকে হত্যা করতে পেরেছে। এ যুদ্ধের চমকই হবে সমরাস্ত্রের বাজার খোঁজা আর ইরাকের তেল আহরণ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এ যুদ্ধে চরম বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া কিংবা লুক্সেমবার্গ এ যুদ্ধের বিপক্ষে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে চায়নি বলেই ইরাকে এতবড় অসম যুদ্ধ হয়ে গেল। ইরাক যুদ্ধের ধবংশ স্তুপের নীচে সুমেরুর প্রাচীনতম সভ্যতার কবর রচিত হলো। ১৯৯১ সনে জর্জ ডাব্লিউ বুশ (বড় বুশ) যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসেছিলেন আর বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছোট বুশকে সমরাস্ত্র উৎপাদনকারী

পৃষ্ঠা:৫৭

মহল-যারা ক্ষমতায় এনেছিলেন ভোট কারচুপির মাধ্যমে। উদ্দেশ্য একটাই নিজেদের তৈরী সামরাস্ত্র বিক্রি করা এবং ইরাকের তেল সম্পদ লুট করা। বুশ-ব্লেয়ারের যন্ত্রর-মন্ত্রর আপাতত সফল হলেও প্রশ্ন হচ্ছে বুশ-ব্লেয়ারের এ যাদু বিদ্যা টিকবেতো? ইতোমধ্যেই ইরাকের শিয়া-সুন্নি সাদ্দাম সমর্থক কিংবা সাদ্দাম বিরোধী জনগণ, সকল শ্রেণীর জনগোষ্ঠিই ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি পছন্দ করে নাই। বুশ-ব্লেয়ারের ইম্পেরিয়েলিস্টিক ডিজাইন, ইরাকের জনগণ বুঝতে পেরেছে। তাই তারা সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছে। ইরাকের জনগণই ইরাকের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবে। আমেরিকার চাইতে সাদ্দামই ভাল ইত্যাদি শ্লোগানে মুখরিত করছে বাগদাদ, কারবালা, নাজাফের রাজপথগুলি।মিশর, সৌদি আরব, কুয়েত, ইসরাইল, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং কানাডা, গ্রীস, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী অস্ত্রের বড় ক্রেতা। এদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্র আর্থিকভাবে লাভবান হতে পেরেছে। আর একথাও সত্য যে, ঐ রাষ্ট্রগুলি তাদের বাজেটের মোটা অংকের টাকা ব্যয় করেছে প্রতিরক্ষা খাতে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগা দিয়ে ইরাক অস্ত্রে সমৃদ্ধি লাভ করবে বিশেষত তেল বিক্রির টাকা দিয়ে মারণাস্ত্র বা জীবাণু অস্ত্র তৈয়ার করবে; পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত হবে এটা হতে দেওয়া যাবে না। তাহলে বুশ-ব্লেয়ারের যন্ত্রর-মন্ত্ররের সব চমক বা আকর্ষণ যাই বলি না কেন শেষ হয়ে যাবে। আমার মনে সারাক্ষণ একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ১৯৯৮ সালে বলেছিলেন, ইরাকের সব অস্ত্র ভান্ডার ধবংস করা হয়েছে। ইরাক এখন বিপদমুক্ত। তাহলে এ যুদ্ধ কিসের জন্য? যুদ্ধ চাপিয়ে না দিলে আমেরিকা কার কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে? ইরাক যুদ্ধ তাই অতি জরুরী হয়ে পড়েছিল। বুশ-ব্লেয়ার সকল সভ্যতা শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে ইরাকে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। বিশ্বের সেরা সেরা সমরবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন-অস্ত্র বিক্রি করা এ যুদ্ধের অন্যতম কারণ। কেননা ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ইরাক যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কিনেছে। এখন ইরাকের অস্ত্র ধবংস না করলে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র কার কাছে বিক্রি করবে? তাই ইরাকে মার্কিন যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। আর এটা হচ্ছে বুশ-ব্লেয়ারের যন্ত্রর-মন্ত্ররের কুটকৌশল। আমেরিকা স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য সকল যাদু বিদ্যাতেই পারদর্শী যেমন: সমরাস্ত্র তৈয়ারী এবং বিক্রির কৌশল ও ক্ষেত্র তৈরী করা। ভিন দেশের তেল সম্পদ লুট করে বিশ্ব বাণিজ্যে একাই অর্থ সম্পদে ধনী হওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; কিংবা প্রয়োজনে

পৃষ্ঠা:৫৮

মুসলমানদের নিধন করে মধ্যপ্রাচ্যে ধর্ম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে পৃথিবীর ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা। এসবই বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক যুদ্ধের কারণসমূহ এখন আমাদের নিকট স্পষ্ট। ইরাক যুদ্ধের পর বুশ-ব্লেয়ার তাদের এই যুদ্ধের যাদু বিদ্যা উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং সিরিয়ায় প্রয়োগ করার জন্য ইদানিং নতুনভাবে পাঁয়তারা করেছে। একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে- বিজ্ঞান তথ্য প্রযুক্তিতে বিশ্বব্যাপী আলো ছড়িয়েছে যে দেশটি, এ যুদ্ধ প্রমাণ করেছে তার কাছে সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য শিল্পের কোন মূল্য নাই। মানুষের জীবনের কোন দাম নাই। মানবতার কোন মূল্য নাই তাই-ই ইরাক যুদ্ধে বুশ-ব্লেয়ার প্রমাণ করলো। এর পরেও বলবো ইরাকে এখন যে ধরণের গেরিলা যুদ্ধ চলছে, তাতে করে শেষাবধি বুশ-ব্লেয়ারের যন্ত্রর-মন্ত্ররের যুদ্ধ যাদু বিদ্যার শেষ রক্ষা হবেতো? না ভিয়েতনামে যুদ্ধের মত পরাজয় বরণ করতে হবে? এ প্রশ্ন বিশ্ব জনমনে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব বিবেক এতই জাগ্রত যে বুশ-ব্লেয়ারের সকল যুদ্ধ বিদ্যা ভেস্তে যেতে বসেছে। ৯ এপ্রিল ‘০৩ মেক্সিকোর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আদিবাসী নেত্রী রিগোবার্তা মেঞ্চ বলেছেন, ‘ইরাক আক্রমনের জন্য ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ ট্রাইব্রন্যালে বিচার হওয়া উচিত; এই ট্রাইবুন্যালে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধোপরাধের জন্য যুদ্ধাপরাধী হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার করতে হবে’। তিনি আরও বলেন, তিনি আশা করছেন আন্তর্জাতিক আদালতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে। যেমনটি রুয়ান্ডা ও সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধপোরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালত বিচার হয়েছিল। অবশ্য বুশ-ব্লেয়ারের এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত যে অন্যায় যুদ্ধ করলে তার বিচার একদিন না একদিন এই পৃথিবীতেই হয় যেমনটি হিটলারের নাৎসীদের বিচার হয়েছে। বার্ণাডশ বলেছিলেন, মানুষের জীবনে দু’ধরনের ট্রাজেডি আছে। একটি হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত জিনিষ না পাওয়ার; আর একটি সেই জিনিষটি পাওয়ার। ভালবাসার ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় দেখে থাকি একজন ভাল প্রেমিক ভালবেসে তার প্রেমিকাকে না পাওয়ার বেদনায় শোকাচ্ছন্ন। আবার কখনও প্রেমিকাকে পাওয়ার পর জীবন যুদ্ধে যে জটিলতার সৃষ্টি হয় তাতে বেদনাহত হতে দেখেছি; কেউ আবার তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহনন করে-দারুণ বিষাদঘন পরিণতি ডেকে আনে। বার্ণাডশ তাকে ট্রাজেডি বলে আখ্যায়িত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র এখন কঠিন ট্রাজেডির মধ্যে বিরাজমান। এই পৃথিবীতে অর্থ- বিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তথ্য প্রযুক্তিতে, সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতায়,

পৃষ্ঠা:৫৯

আধুনিক ফ্যাশন ডিজাইনে সকল স্থানে গত বিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের পাওয়ার কোন শেষ নাই। আধুনিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের শিরমণি হতে পেরেছিল বলেই তো সে সমগ্র পৃথিবীতে অলিখিত রাজত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। আজ সেই পরাশক্তি নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তাকে পৃথিবীশুদ্ধ শান্তিকামী মানুষ ধিক্কার দিচ্ছে-এ যে কত বড় ট্রাজেডি তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। অযৌক্তিক ইরাক যুদ্ধ জয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাজেডি যেন বেড়েই চলেছে। তাইতো পৃথিবীতে তার অলিখিত রাজত্বের পরিধি কমে আসছে। শান্তিকামী-মুক্তিকামী মানুষ তাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলি তার হুমকিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অথচ পরাশক্তি হিসাবে তারই গুরু দায়িত্ব ছিল এসব ছোট ছোট রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ব্যবস্থায় কার্যকরী ভূমিকা পালন নিশ্চিত রাখা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যাকে ভেটো পাওয়ার দেওয়া হয়েছিল যে ছোট ছোট রাষ্ট্রকে রক্ষা করবে তাদের কল্যাণ সাধন করবে। আর আজ যখন এই যুক্তরাষ্ট্রই ছোট ছোট রাষ্ট্রে আগ্রাসন চালাচ্ছে যেমনটি সে করেছে আফগানিস্তান এবং ইরাকে, সিরিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়ার স্বাধীনতাও এখন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির সম্মুখে। মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসে সেই মানব সভ্যতাকে ধবংস করার জন্য সে আদাজল খেয়ে নেমেছে। দিন দিন ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলি শত্রু হয়ে যাচ্ছে- কমে যাচ্ছে তার প্রভুত্ব। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। বিশ্ব রাজনীতিতে শতাব্দীর প্রধানতম পরাশক্তি পৃথিবীতে ক্রমেই একা হয়ে যাচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর একমাত্র প্রভুত্ব ছিল যার সে এখন ইরাক যুদ্ধের পর বিপন্ন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে তার মোড়লীপনা আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া একযোগে তার সকল প্রস্তাবকে জোর বিরোধিতা করেছে এবং প্রত্যাখান করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলি কবে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হবে তারই প্রহর গুণছে, উত্তর কোরিয়া, মালায়েশিয়া সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, চীন ও ভারত ইরাক যুদ্ধ মেনে নিতে পারে নাই। এটা যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কত বড় ট্রাজেডি তা যুক্তরাষ্ট্র আজ তার অবস্থান ঘেটে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। তাই বলছিলাম যন্ত্রর-মন্ত্ররে বুশ-ব্লেয়ার যতই পারদর্শী হোক না কেন। পৃথিবীতে তাদের মুরুব্বিয়ানার দিন যে ছোট হয়ে আসছে এটা তারা কি বোঝেন? যুক্তরাষ্ট্রের মহান সব সাবেক প্রেসিডেন্টগণ জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, জন এফ, কেনেডি, জিমি কার্টার সর্বশেষ বিল ক্লিনটন বিশ্ব শান্তি স্থাপনে যে

পৃষ্ঠা:৬০

ভূমিকা রেখেছেন, বিশ্ব রাজনীতিকে যেভাবে স্থিতি অবস্থায় রেখেছেন- বুশ-ব্লেয়ার সেই বিশ্বকে যুদ্ধ বিগ্রহে অস্থির করে তুলেছেন, অশান্ত করে তুলেছেন।মানুষের কল্যাণ, প্রগতি উন্নতি, ধ্যান ধারণা, চিন্তা-চেতনার উন্নতি সাধন। সেই সবকিছুকে মিসাইলের আঘাতে আর গণবিধবংসী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে তছনছ করে বিশ্বজয়ের যে স্বপ্ন বুশ-ব্লেয়ার দেখেছেন আসলে কি তা তাদের জীবনের বড় ট্রাজেডি নয়? কেননা এই বিশ্বই একদিন চিৎকার করে বলবে যুদ্ধাপরাধে বুশ-ব্লেয়ারের বিচার হতেই হবে। ইতোমধ্যেই এ দাবী অনেক দেশে উঠেছে। দাবী উঠেছে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠন করে হোক যুদ্ধাপরাধের জন্য তাদের বিচার করা হোক। শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী মেঞ্চ এ দাবী তুলেছেন।বিশ্বব্যাপি দাবী উঠেছে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন দখলদারীত্বের অবসান চাই। আমাদেরকে বুঝতে হবে বল প্রয়োগে কোন সমাধান হতে পারে না। ভালবাসা দিয়ে কল্যাণকর কিছু দিয়ে বুঝিয়ে সব সমস্যার সমাধান যেখানে করা সম্ভব; সেখানে যুদ্ধ কোন বিকল্প হতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে বিজ্ঞানের বিশাল অগ্রগতি হয়েছে। সভ্যতাকে ধ্বংসের জন্য নিশ্চয়ই নয়। মানুষের কল্যাণকর কিছু উদ্ভাবনের জন্য। তাই বিজ্ঞানীরা তাদের কর্মের জন্য প্রশংসানিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। পরাশক্তিগুলির দৃষ্টিভঙ্গি হবে উদার,মানুষের কল্যাণ চিন্তাই হবে তাদের ধ্যান-ধারণা এবং কর্তব্য হবে সভ্যতার বিকাশ সাধন। তবেই না আধুনিক বিশ্বের প্রতিত্ব বলে তারা দাবী করতেপারবে। আর এ জন্যে অবশ্যই পরাশক্তিগুলির দায়-দায়িত্ব অনেক বেশী। তাদেরকে আইন, নিয়মনীতি এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করতে হবে। তাহলে তারা পরাশক্তি হিসাবে পৃথিবীময় নন্দিত হবে, প্রশংসা পাবে, শ্রদ্ধাভরে পৃথিবীর মানুষ তাদেরকে ভালবাসবে। ‘রক্ষক যদি ভক্ষক হয়’ তাহলে পৃথিবীর বায়ু বিষাদে ভারাক্রান্ত হবে। আর সেই অভিশাপে তাদের সিংহাসন অবশ্যই একদিন টুকরো টুকরো হতে বাধ্য। সেটিই প্রকৃতির ধর্ম। বুশ-ব্লেয়ার কি সেটা অনুধাবন করেন। কল্যাণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অকল্যাণের বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে আর যা-ই হোক পৃথিবী শাসন করার যোগ্যতা অর্জন করা যায় না। এক দেশের উপর অপর দেশের সামরিক হস্তক্ষেপ তখনই আইনসিদ্ধ হয়, যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তাতে অনুমোদন থাকে। আর আজকের ইরাক যুদ্ধে বুশ-ব্লেয়ার জাতিসংঘের অনুমোদন নেওয়ার কোন প্রয়োজনই মনে করলেন না। তাদের যন্ত্রর-মন্ত্রর কি এতই শক্তিশালী? কোন

পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৭৩

পৃষ্ঠা:৬১

কিছুই তোয়াক্কা তারা করেন না। দুর্বলের ওপর সবলের এই অন্যায় আঘাত যে কত বড় ট্রাজেডি যা কখনই সভ্যতার বিবর্তন হতে পারে না বরং তাকে অসভ্যতা বলা চলে। এইভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম লংঘন করে, মানবাধিকার বিনষ্ট করে, জাতিসংঘের সনদের ন্যায়নীতিকে বিসর্জন দিয়ে বুশ-ব্লেয়ার পৃথিবীতে যে বর্বরতার নজির স্থাপন করলেন আর ইরাক দখল করার পর জোর গলায় বললেন ‘সাদ্দাম এখন ইতিহাস মাত্র’-তাদের বোঝা উচিত ছিল ইতিহাসে ভাল কিছু যেমন স্থান পায় তেমনি খারাপ কাজও স্থান পায়। যে কলঙ্কজনক অধ্যায় বুশ-ব্লেয়ার সভ্যতার ইতিহাসে রচনা করলেন-এর বিচারও একদিন হবে বিশ্ববাসী সেই প্রত্যাশা করতেই পারে। জাতিসংঘ বুশ-ব্লেয়ারের যন্ত্রর-মন্ত্ররের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। এটা ভাবতেও আমরা সভ্য বলতে ঘৃণা হয়। সাদ্দাম মারণাস্ত্রের অধিকারী, সাদ্দাম গণহত্যাকারী, সাদ্দামের স্বৈরশাসনের হাত থেকে মুক্ত করে গণতন্ত্র উদ্ধার ও তার পুনঃ প্রতিষ্ঠার নামে যে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের জন্ম দিলেন বুশ-ব্লেয়ার। এ থেকে বিশ্ববাসী কবে মুক্তি পাবে। আজকের যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অর্থের মালিক। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যাদের জয়যাত্রা সমগ্র পৃথিবীকে বিস্মিত করেছে সম্পদ আর সম্ভাবনায় গর্বিত যে জাতি তাদের কাছে এমনটি বিশ্ববাসী আশা করে নাই। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য ট্রাজেডি। ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মারণাস্ত্রর ব্যবহার মনে করিয়ে দেয় কোন এক সময় যারা বর্বর রেড ইন্ডিয়ান ছিল। কালের স্রোতে প্রযুক্তির যুগে তারা আজ মানুষের মাংস। খাচ্ছে এতে আশ্চর্যের কিছু নাই। বর্তমান ইরাক পরিস্থিতি বা সংকটের অবশ্যই একদিন নিরসন হবে-ভিয়েতনামের দরজা থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে একদিন তাদের সৈন্য ফিরিয়ে নিবে। প্রশ্ন হলো যে ট্রাজেডির জন্ম বুশ-ব্লেয়ার বিশ্ব সভ্যতায় যুক্ত করলেন এর কি নিরসন হবে-কবে হবে? কবে পৃথিবীতে শান্তির নির্মল বাতাসের স্বাদ বিশ্ববাসী গ্রহণ করতে পারবে সেই প্রতিক্ষায় আমরা রইলাম। তবে একথা সত্য বুশ-ব্লেয়ারের যন্ত্রর-মন্ত্ররের স্বপ্ন ভঙ্গ অবশ্যই ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে-এটা একটি ইতিবাচক দিক।

পৃষ্ঠা:৬২

ঝলমলে রোদের প্রতীক্ষায় ইরাক

সাত ঘোড়া মোহরের সন্ধান ইরাকের তেল সম্পদের লোভ সামলাতে না পেরে ঘৃণ্য আগ্রাসী আমেরিকানরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ইরাকে। তারা বলছে ইরাক যুদ্ধে তারা জয়ী হয়েছে। আমরা বলবো জয়-পরাজয় সময় বিচার করবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধেও আমেরিকার দষ্টিতে তারাই জিতেছিল। তারপরও যুদ্ধের দশ বছরের মাথায় প্রায় ৫০,০০০ হাজার আমেরিকান সৈন্য নিহত হবার পর ভিয়েতনাম থেকে তারা তাদের সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল-এটাকে নিশ্চয়ই কেউ আমেরিকার জয় বলবেন না। একথা সত্য যে, ইরাকি সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং সর্বোপরি সভ্যতার অগ্রগতির চাকা আমেরিকার অত্যাধুনিক মিসাইল আর বোমা বর্ষণে প্রচন্ডভাবে বিনষ্ট হয়েছে। ইরাকে আমেরিকা ইরাকি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার হরণ করেছে- মারণাস্ত্র ইরাকে না পাওয়ায় আন্তর্জাতিক ফোরামে আমেরিকা তার বিশ্বস্ততা হ্যারিয়েছে। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বুলি এতদিন বুশ-ব্লেয়ার সাহেব আওড়ে এসেছেন, ইরাক যুদ্ধের ৫ মাস অতিবাহিত হবার পরও সেখানে চলেছে ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধ। ইরাক এখনও অশান্ত। দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধ। ইরাকিদের দুঃখ দুর্দশা এখন অনেক বেশী। প্রশাসক ব্রেমাররের প্রশাসনকে ইরাকিরা প্রত্যাখ্যান করেছে আর তাই তারা জীবন বাজি রেখে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাকে গণতন্ত্র আমেরিকার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নই রয়ে গেল। দখলদার বাহিনীর চলেছে অনিয়ম, সেচ্ছাচারিতা আর প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেবার নামে দেশটি দখল করে ইরাকের তেল লুট করছে। ইরাকী জনগণের ভোগান্তি এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। গণতন্ত্রের আলো ছড়াবেন একথা বলে ইরাক দখল করলেন-সেই ইরাক এখনও অন্ধকারে নিমজ্জিত। গেরিলা যুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন সৈন্যের মৃত্যুভীতি আমেরিকায় নতুনভাবে সংকটের সৃষ্টি করেছে। ইরাকে সৈন্য পাঠানো মানেই মৃত্যু পথের যাত্রী-এমনটি ধারণা করছেন যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। তাই বুশ-ব্লেয়ার প্রশাসন দারুণ বিপাকে পড়েছেন এখন। বাগদাদ টিভি চ্যানেলে অনবরত প্রচার করা হচ্ছে। ব্লেমার প্রশাসনের সুন্দর সুন্দর কথা-‘আমরা তোমাদের বন্ধু, গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে এসেছি। সমৃদ্ধ জীবনের পথ নির্মাণ করতে এসেছি। তোমাদেরকে মুক্ত করতে এসেছি।

পৃষ্ঠা:৬৩

স্বৈরাচারী সাদ্দামের পতন হয়েছে। ওদের অনেকেই এখন আমাদের কারাগারে বন্দী বাকীদের মৃত্যু হয়েছে। কারণ যে পাপ তারা করেছে গত তিন দশকে তার জন্য ঈশ্বর তাদের নিয়ে গেছেন। ওরা এখন দোজখের আগুনে পুড়ছে। আমরা এখন ক্ষমতা নিয়েছি। আমাদের সরকার তোমাদের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করবেন। তোমাদের জন্য গণতান্ত্রিক সরকার হবে। তোমাদের তেল সম্পদ নিয়ে তোমাদের চিন্তিত হবার কোন কারণ নাই। কারণ ঐ বিপুল সম্পদের তোমরাই মালিক। ৯ এপ্রিল ‘০৩ ইরাক যুদ্ধের শেষ ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে সাধারণ জনগণের মধ্যে এ সকল সুন্দর সুন্দর কথা প্রচার করছে আর বিক্ষুব্ধ ইরাকিরা এ অন্যায় অনৈতিক ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, বিক্ষোভ করছে, মুক্তি যুদ্ধ করছে, আত্ম প্রত্যয় ব্যক্ত করছে তারা তাদের মাটিকে বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্ত করবেই। অন্য দিকে ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এখন জনগণের কাঠগড়ায় অভিযুক্ত। যুদ্ধের পক্ষে তার সরকারের ডসিয়ারগুলো (তথ্য প্রমাণ) অতিরঞ্জিত করার অভিযোগ উঠেছে। যুদ্ধে তার দেওয়া তথ্য-প্রমাণ এখন মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ভাবে ব্রিটেনের কদর্য চেহারা সবার সামনে প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় বাণিজ্য-বাজারের দুই পরাশক্তি ফ্রান্স এবংজার্মানীর নিকট। তারই ফলশ্রুতিতে ব্লেয়ার সরকারের অন্যতম শক্তিশালী নেতা পররাষ্ট্র মন্ত্রী রবিন কুক সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন। এমনিতেই বিগতদিনে মার্গারেট থেচারের আমেরিকার পক্ষে অন্ধ সমর্থন এবং বর্তমানে ইরাক যুদ্ধে বুশের পক্ষে ব্লেয়ারের ভূমিকা এত বেশী অযৌক্তিক ছিল যে সে দেশের জনগণ ব্লেয়ারের নির্লজ্জপনার জন্য পৃথিবীতে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন বলে তাদের বিশ্বাস। এ যুদ্ধে ব্রিটেনের কি লাভ এ প্রশ্নও দেখা দিয়েছে? এ যুদ্ধে ব্রিটেনকে ব্লেয়ার জড়িত করে ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন বলে ব্রিটিশ জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ন্যাটো এবং জাতিসংঘের অনুমোদন ব্যতিরেকে ইরাকে এ যুদ্ধ যে বৈধ ছিল না এটা ব্রিটিশ জনগণ ভালভাবে বুঝতে পারছে। বুশ প্রশাসন কোন প্রকারের পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়াই জাতিসংঘকে কলা দেখিয়ে আমেরিকাকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার জন্য আমেরিকার শান্তিকামী মানুষ বুশকেই দায়ী করেছেন। ব্লেয়ার তো বেশ জোরের সাথে দাবী করেছিলেন ‘ইরাকে মারণাস্ত্র আছে এবং পাওয়া যাবে।’ ব্লেয়ারের এ জাতীয় উগ্র সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের দরুণ

পৃষ্ঠা:৬৪

ইউরোপের বাণিজ্য বাজার থেকে ব্রিটেনকে সরে দাঁড়াতে হচ্ছে-এতে করে ব্রিটেনের যে ক্ষতির কারণ হয়েছে তা ব্রিটিশ অর্থনীতিতে দারুন প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে সাংস্কৃতিকভাবে ব্রিটেন ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে একই বলয়ে অবস্থান করা সত্ত্বেও আমেরিকার সাথে মিত্রবাহিনী সেজে ইরাকে যুদ্ধ করে নিজেদের ভারসাম্য নিজেরাই নষ্ট করেছে। তারপরে সদ্য প্রকাশিত তথ্যে পাওয়া যায় ড. ডেভিড কেলি বলেছিলেন ‘ইরাক আক্রান্ত হলে আমাকে বনে মৃত পাওয়া যাবে। এসব তথ্য এখন বুমেরাং হয়ে ব্রিটেনেরই ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। ইরাক যুদ্ধের কোন যৌক্তিকতাই ব্রিটেন-আমেরিকা দেখাতে পারবে না। তারপরও এত বড় হত্যাযজ্ঞ ইরাকে হয়ে গেল এজন্যই বিশ্ববাসী বুশ-ব্লেয়ারকে নরঘাতক মনে করেন -মাননবতার শত্রু মনে করেন। তারা এও মনে করেন বুশ-ব্লেয়ার যে যুদ্ধ পরিচালনা ইরাকে করলেন ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। ইরাকের তেল সম্পদ দখল করার লালসা বুশ-ব্লেয়ারকে উন্মাদ করে দিয়েছিলো। এখন এটা দিবালোকের মত পরিষ্কার যে রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসননীতি দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তারই নগ্ন ও নির্লজ্জ বহিঃ প্রকাশ ইরাক আক্রমন। সাদ্দাম পৃথিবীর জন্য ভীষণ বিপদজনক- এই উক্তি বুশ-ব্লেয়ার একই সুরে করে বেড়ালেন এবং ইরাক যুদ্ধের যুক্তি খুঁজলেন। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে কতটুকু বিশ্বাস করাতে পেরেছেন এখন এ প্রশ্নই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। ইরাকের গভর্নিং কাউন্সিল ইরাকে কোনভাবেই আস্থাভাজন হতে পারে নাই। শিয়াদের শীর্ষতম নেতা আয়তুল্ল্যাহ হাকিমকে চক্রান্ত করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করে ঘোলা পানিতে মাছ ধরার যে স্বপ্ন বুশ প্রশাসন দেখেছিলেন তাও এখন বিফলে গেল। শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায় এক হয়ে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন দখলদার বাহিনীকে হটাও আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। তথ্য সন্ত্রাস যে কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে তা ইঙ্গ- মার্কিন প্রশাসন এখন ভালভাবে বুঝতে পেরেছেন বলেই ঘন ঘন হরিনাম জপছেন। অর্থাৎ জাতিসংঘকে বার বার ইরাক পুনর্গঠনে অংশগ্রহণসহ আলোচনার গুরুত্বের কথা বলছেন এবং অনুরোধ করছেন। গেরিলা যুদ্ধ মোকাবেলায় ইঙ্গ-মার্কিন দখলদার বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে বলেই জাতিসংঘের মাধ্যমে বহুজাতিক শান্তি বাহিনী প্রেরণের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন বুশ-ব্লেয়ার। মানুষের জীবন নিয়ে যারা অহেতুক

পৃষ্ঠা:৬৫

খেলেন তাদের ডাকে বিশ্ববাসী সাড়া দেন নাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বছরের পর বছর দখলদার বাহিনী ইরাকে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও বুশ-ব্লেয়ার কতটুকু সফলকাম হবেন? আদৌও হবেন কি? মইরাক যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই জুন ‘০৩ বাগদাদে জাতিসংঘের স্থানীয় হেড কোয়ার্টারে ভয়ানক বোমা বিস্ফোরণে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহতের সংখ্যা অনেক। বোমা হামলার জন্য আমেরিকা ইরাকী রক্ষী বাহিনীকে দায়ী করেছে। আর ইরাকি জনগণ এবং বিশ্বের বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন জাতিসংঘ দফতরে হামলায় সি.আই.এ জড়িত। মন্তব্য যেটাই সঠিক হোক না কেন-ইরাক এখন জলন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ যে কোন মুহুর্তেই ভীষণভাবে বিস্ফোরিত হতে পারে। জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ইরাকে অস্ত্র পরিদর্শন, মানবিক সাহায্য, উন্নয়ন এবং শরণার্থী কর্মসূচীসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে অনোনুমোদিতভাবে বুশ-ব্লেয়ার ইরাক যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। ইরাকি জনগণ এই আগ্রাসনকে রুখতে যুদ্ধ করছে; মানবতাকে রক্ষা করার জন্য। ইরাকিদের চোখে মুখে যে আগুন বিশ্ববাসী দেখে আসছে যে যুদ্ধ তারা মুক্তির জন্য চালিয়ে যাচ্ছে তার শেষ কোথায়? এভাবে বছরের পর বছর যুদ্ধ হতে থাকলে সভ্যতার বিকাশ চরমভাবে ব্যর্থ হবে। দূর্বৃত্তায়ন বিশ্বায়নকে গ্রাস করবে। কালের যাত্রা পথে পৃথিবীর সংস্কারবাদী মানুষগুলি সকল সময়েই সাম্রাজ্যবাদ আগ্রাসনকে নিন্দা, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করে আসছে শৃঙ্খল মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। এমনটি আমরা পত্রিকা খুললেই প্রতিদিন ইরাকে দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীতে সমাজ আর তার সাহিত্য কর্ম যুগে যুগে লেখনির মাধ্যমে এসব মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছে। যেমনটি এ্যালেন গ্লিনসবার্গ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কবিতা রচনা করেছেন পাক দখলদার বাহিনীর সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে-‘হার্ডল’ ‘নেকড়ের গর্জন’। লেনন রচনা করেছেন শান্তির গান। ইরাকে অন্যায় ও অনৈতিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে পৃথিবীতে যে বিক্ষোভের ঝড় উঠেছে তা এখন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। ইরাকি জনগণ ধর্ম-বর্ণ মত পার্থক্য এর সকল সংকীর্ণতা ভুলে গিয়ে শিকড়ের তলদেশ থেকে সংস্কৃতির স্রোতে জেগে উঠেছে জাতিসত্ত্বার জরায়ুর সন্ধানে। আজ তাই ইরাকিরা জাতীয়তাবাদের চেতনা আর স্বাধীনতা যুদ্ধে নতুন জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়ে বিদেশী দখলদার বাহিনীকে চোরাগুপ্তা আক্রমনে নাজেহাল করছে। ইতিহাস

পৃষ্ঠা:৬৬

কেবলই মানুষকে দূরে ঠেলে দেয় না, বরং দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে পৃথিবীতে বারবার বিভিন্ন দেশে দেশপ্রেম অনুভূতিতে সেতু তৈয়ার করে আক্রান্ত জনগোষ্ঠিকে ঐক্যবদ্ধ করে, সাহিত্য সংস্কৃতি ভালবাসা তখন প্রেরণা হয়ে মূল সত্যকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে; জাতি তাই বিজাতীয় সাংস্কৃতিকে প্রতিহত করে ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যেমনটি ‘৭১ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশী জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ করে যেমন বাংলাদেশ পেয়েছে। ঠিক তেমনি ট্রাজেডি অব ইরাক ওয়ার’ বিধ্বস্থ ইরাকি জনগণ বসরার সুবিশাল মাঠে মাঠে প্রস্ফুটিত গোলাপ, যখন নৃত্য করেছে ‘ছন্দে ছন্দে দুলি’ হৃদয়ের মাঝে সেই রিদম অব লাইফ (জীবনের স্পন্দন) অনুভূতি নিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা বিষাদে চলার পথে ভেসে বেড়াচ্ছে আর দেশের জন্য জীবন দিচ্ছে। বিতর্কের সব অবসান ঘটিয়ে ইরাকের শিয়া-সুন্নি ঐক্যতানের সুরে জীবনের যে জয়গান শুনতে পেয়েছে; তাকে জয় করার জন্য যুদ্ধ করছে। একজন বিশ্ববিখ্যাত মনীষী র‍্যালফ ওয়াল্ডো ইমার্সনের একটা বিখ্যাত উক্তি আমার মনে পড়ে গেল ‘Earth laughs in flowers’ ‘ধরণীর হাসি যেন ফুলের হাসিতে’ একথা ইরাকি জনগণও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বলেইতো জীবনের বিনিময়ে বসরার গোলাপ রক্ষা করছে অর্থাৎ পৃথিবীর হাসিকে সমুন্নত রাখার জন্য যুদ্ধ করছে। ইরাক যুদ্ধ যে কোন বৈধ যুদ্ধ ছিল না সে কথা অনেক দেরীতে হলেও জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান বুঝতে পেরেছেন। গত ৩/৯/০৩ ইরাক আক্রমনের জন্য প্রেসিডেন্ট বুশের তীব্র সমালোচনা করলেন। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে এখন ফেলেছে গভীর সংকটে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রচন্ড সমালোচনা বুশের বিপক্ষে। ১৯১টি জাতিসংঘভুক্ত রাষ্ট্রের অধিকাংশ বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক যুদ্ধকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ বুশের অযৌক্তিক গোয়ার্তুমি মেনে নিতে রাজী নয়। ফ্রান্স এবং জার্মানী স্পষ্টই বুশকে বলে দিলেন- ইরাকে স্বাধীন একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। বুশ এ প্রস্তাব মেনে নিতে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে বুশের গণতন্ত্রটা কি? ইরাকের শাসনকর্তা ব্লেমারের গভর্নিং কাউন্সিলই কি বুশের দেওয়া গণতন্ত্র যা ইরাকি জনগণের মনপুত নয়। ইতোমধ্যে বুশের দেওয়া প্রশাসন ইরাকের গভর্নিং কাউন্সিলের মহিলা উপদেষ্টা আখলিমা আল হাশেমীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গণতন্ত্র জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না।

পৃষ্ঠা:৬৭

গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের ভার্ডিক্ট যা কেবল স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণকে একটি গণতান্ত্রিক সরকার উপহার দেয়। তবে বুশ প্রশাসন তা মেনে নিতে রাজী নয়। এই হচ্ছে ইরাকি জনগণকে মুক্ত করার বুশ প্রশাসনের ঐকান্তিক ইচ্ছা। আর এর জন্যেই ইরাকে এত বড় অন্যায় যুদ্ধ সংঘটিত হলো- বিশ্বের জনমতকে উপেক্ষা করে জাতিসংঘকে তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র ইরাকে মারণাস্ত্র আছে এই অভিযোগের ভিত্তিতে। গত ৬/৯/০৩ খবরের কাগজে পড়লাম- আই.এস.পি অস্ত্র অনুসন্ধানকারী দল ইরাকে সার্ভে গ্রুপ আই.এস.পি-র নেতা সাবেক জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শক ও বর্তমানে সি.আই.এ-র বিশেষ উপদেষ্টা ডেভিড এবং তার দল ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তা সমন্বয়ে সার্ভে গ্রুপ আই.এস.পি পরিদর্শকরা ইরাকে গণবিধবংসী অস্ত্রতো পানই-নি, এমকি পারমাণবিক, রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্রের ক্ষুদ্রতম উপাদানও পাওয়া যায় নাই। তাহলে এতবড় অন্যায় যুদ্ধের কি প্রয়োজন ছিল? পৃথিবীর ছোট ছোট রাষ্ট্র রীতিমত এখন উদ্বীগ্ন কে কখন আক্রান্ত হবে? আমি পূর্বেই বলেছি সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া এইসব ছোট ছোট রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কোথায়? জাতিসংঘ নিজেই ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকাকে ইতোমধ্যে সমালোচনা করেছে। তাহলে জাতিসংঘের অস্থিত্ব কোথায়? জাতিসংঘের প্রধানতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ছোট ছোট রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান করা। আর এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমোদন লাভের কোন প্রয়োজনই মনে করলো না। রক্তক্ষয়ী ইরাক যুদ্ধ শেষ এই সরকারী ঘোষণা বুশ-ব্লেয়ার দিয়েছে। অথচ প্রকৃত অর্থে ইরাকে যুদ্ধ শেষ হয় নাই। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরাক পুনর্গঠন নিয়ে চরম বিপদে পড়েছে। ইরাক পুনর্গঠনে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার জন্য এখন নিরাপত্তা পরিষদে জোরালো আবেদন রাখলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ। ইরাক পুনর্গঠন ইস্যুতে রাশিয়া, চীন, ভারত এখন ঐক্যবদ্ধ। ইরাক সংক্রান্ত মার্কিন পুনর্গঠনের প্রস্তাব এবং জাতিসংঘের সংস্কারের ক্ষেত্রে তারা এক অভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন-যুদ্ধ বিধ্বস্থ ইরাকের মূল সমস্যা সৈন্য প্রেরণ নয় বরং রাজনৈতিক সমাধান; আর সেজন্যে ইরাকি জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং শাসন ক্ষমতা তাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। এটাই হচ্ছে ইরাক পুনর্গঠনের জন্য অতি উত্তম ব্যবস্থা। ইরাক পুনর্গঠনে ইরাকিদের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষা করার জন্য একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে

পৃষ্ঠা:৬৮

এবং দখলকার বাহিনীকে স্ব-স্ব দেশে ফেরৎ পাঠাবার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ আমরা পূর্বে বলেছি ইরাক যুদ্ধে জাতিসংঘের কোন অনুমোদন ছিল না। এটা একটি অনৈতিক অযৌক্তিক যুদ্ধ যা কখনই ইরাকে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে না। আমরা রাইজ এন্ড ফল অব হিটলার পড়েছি- কোন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন পৃথিবীতে চূড়ান্ত বিজয় এনে দিতে পারে নাই। তাই বুশ- ব্লেয়ারের জোর করে কোন দেশ দখল করাও কোন রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে না। আর যদি হয় সেই দখলদারিত্ব মিথ্যার ওপরে ভিত্তি করে। জাতিসংঘের প্রধান অস্ত্র পরিদর্শক হ্যান্স ব্লিক্স মন্তব্য করেছেন, মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে কোন বিশ্ব শান্তি বা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি আনায়ন করা সম্ভব নয়। তাই ইরাক পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বে সম্ভব নয়-এ ব্যাপারে বিশ্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মতামত, পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইরাকি জনগণকেই গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের নিজস্ব সরকার গঠন করতে দিতে হবে। জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীনে ইরাক পুনর্গঠনের যৌক্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। ইরাকিরা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে-সত্যের জয় হবেই। ইরাক তাই ঝলমলে রোদের প্রতিক্ষায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে-কবে তাদের রাজনৈতিক আকাশ রাহুমুক্ত হবে? গণতন্ত্রের আনন্দ-ঝিলিমিলি বাতাস ইরাকে বইবে-এই প্রত্যাশায় বিশ্ববাসী এখনও আশাবাদী। ইরাকিরা আমেরিকার হত্যা, হিংসা এবং হাহাকার ভরা গণতন্ত্র চায় না। বরং সহজ সরল নিজস্ব গণতন্ত্র তাদের কাম্য। ইরাক যুদ্ধে যারা মারা গিয়েছে তারাতো পরপারে গিয়েও কাঁদছে; কিন্তু যারা জীবিত আছে তাদের অব্যক্ত কান্না কবে শেষ হবে-আর ইরাকের আকাশে ঝলমলে আলো ভেসে বেড়াবে সেই প্রত্যাশায় পৃথিবীর মানুষ আজ মানবতার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।

পৃষ্ঠা:৬৯

দৃশ্যপটের অন্তরালে

‘সেই ভাল সেই ভাল আমারে না হয় না জানো।’

-কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন দু’টি অনেক আগে পড়েছিলাম। আজ মনে পড়ছে। তিনি কবে-কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, বলতে পারবো না। তবে এ কথা সত্য যে তিনি নিশ্চয়ই সাদ্দামকে উদ্দেশ্য করে লিখেন নাই। কিন্তু এই লাইন দু’টি যে, সাদ্দামের মনে জাগছে না তা বলা যায় না। কয়েকদিন আগে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ায় আমার কেবলই মনে হচ্ছে তিনি ঐ লাইন দুটোই আওড়াচ্ছেন। বৈচিত্রে ভরপুর সাদ্দামের জীবনাতিহাস। সাদ্দামকে চেনা বা জানা জটিল ব্যাপার। ইরাকের দরিদ্রতম কৃষক পরিবারে যাঁর জন্ম-কেবল নিজ মেধা, সাহস, মনোবল, উচ্চাকাঙ্খা, পরিশ্রম, দক্ষতা, কঠোরতা ও যোগ্যতা বেেল তিনি একদিন ইরাকের প্রধান কর্ণধার হতে পেরেছেন। বাথ পার্টির সাধারণ সদস্য থেকে প্রেসিডেন্ট তথা ইরাকের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন-এটা নিঃসন্দেহে কিংবদন্তি অবশেষে ইং ১৪ ডিসেম্বর ০৩ তারিখে আমেরিকার অপেক্ষা শেষ হয়েছে। ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ বাহিনীর হাতে সাদ্দাম হোসেন ধরা পড়েছেন। সারা পৃথিবীর টিভি পর্দায় ও ওয়েব সাইটে দেখা গেল সাদ্দামকে, এক মুখ অবিন্যস্ত দাঁড়ি সমেত পরিশান্ত চেহারায়। তখনও তাঁর মুখে দুঃসাহসের বুলি, ‘আমিই ইরাকের প্রেসিডেন্ট। আমি আলোচনা করতে চাই।’ চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে অদম্য সাহস আর মনোবলে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়-মধ্য প্রাচ্যর সবচেয়ে প্রতাপশালী ও প্রভাবশালী ইরাকের রাষ্ট্র প্রধান সাদ্দাম হোসেন তিকরিতের নিকট কোন এক অজো পাঁড়াগায়ে এক সাধারণ গৃহস্থ বাড়ীর শোবার ঘরের মেঝেতে চাঁদর ঢাকা ছোট্ট পর্ত থেকে বেরিয়ে এলেন। টিভির পর্দায় দেখা তাঁর মুখটা হাঁ হয়ে আছে, মুখের মধ্যে চিমটে ঢুকিয়ে ডি.এন.এ পরীক্ষা করার ব্যাপারটি আমেরিকান বিজ্ঞানীদের পরিহাসের একটি দৃশ্য বটে। গত জানুয়ারী ২০০৪, ‘দেশ’ ম্যাগাজিনে সুমিত মিত্রের সাদ্দামকে উদ্দেশ্য করে একনায়কের পতন শিরোনাম লেখা প্রতিবেদনের কয়েকটি পক্তি পড়লে পৃথিবীর নামকরা খলনায়ক এবং নায়কদের পরিচয় একসঙ্গে পাওয়া যায়। সাদ্দাম খলনায়ক কি মহানায়ক সে বিচারের ভার পাঠক সমাজের। তবে সুমিত মিত্র লিখেছেন, ‘ইতিহাসের বা পুরানের খলনায়কদের যে সব সময়ে দশেহরায় রাবন পড়ানের মত চিত্তাকর্ষক হবেই তার কোন নিশ্চয়তা নেই। হিটলার তার

পৃষ্ঠা:৭০

সমস্ত সৈন্য সামন্ত খুঁইয়ে সাদ্দামের গর্তের চাইতে কিছুটা বড়, তার নিজস্ব বাঙ্কারে স্বহস্তে নিজের ম্যাথায় গুলি চালিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্টালিন মারা যান হার্টটোকে। মাও সেতুং মারা যান বয়সের ভারে। রুমানিয়ার অত্যাচারী শাসক চসেস্ককে তাঁর স্ত্রীসমেত বিদ্রোহীরা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু সাদ্দামের পতনের মধ্যে বীররস অথবা করণারসের চেয়ে হাস্যরস অধিকটা প্রবল।’ আমি অবশ্য বলব হাস্যরসের চেয়ে পরিহাসটাই প্রবল। বিটিভির পর্দায় দেখলাম এবং পত্র-পত্রিকায় পড়লাম সাদ্দামের গর্তে পাওয়া গিয়েছে কয়েকটি বই। জানিনা, সাদ্দাম কি কখনও ভেবেছিলেন-দীপান্তর হলে সঙ্গে নেব কোন বই? সেই কারণে আগেভাগেই সঙ্গে বই নিয়ে রেখেছিলেন কিনা? কারো কারো মতে সাদ্দামের দার্শনিক ভাবের উদয় হয়েছে। আজ সাদ্দাম ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন। চিরতরে সাদ্দাম শাসনের পতন হয়েছে এটা নিরেট সত্য। তেমনি ইরাক যুদ্ধ দৃশ্যপটের অন্তরালে আমেরিকার যে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ছিল-এটা এখন পৃথিবীর সকল মানুষের নিকট দিবালোকের মত পরিষ্কার। ইরাক যুদ্ধ পরিকল্পনার প্রথম দৃশ্য মঞ্চায়িত হয় ১৯৯০ সালে উপ-সাগরীয় যুদ্ধে, যখন সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের জন্য আক্রমন করেন। আর বর্তমান এই যুদ্ধের ডিজাইন একেছেন তখনকার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিগানের ডেপুটি হিসাবে কর্মরত বড় বুশ, যিনি বর্তমানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছোট বুশের পিতা। সিনিয়র বুশ তখন থেকেই সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং পৃথিবীর বিশাল তেল সম্পদকে আমেরিকার অধীনে নেওয়ার বড় ধরণের পরিকল্পনা আটেন। আমেরিকার কর্তৃত্বাধীনে বিশ্ব ব্যবস্থা যাকে বলা হয় ‘ডকট্রিন অব বুশ’। টুইন টাওয়ার ধবংস পরিকল্পনা এবং ওসামা-বিন-লাদেনকে জড়িত করে আফগানিস্তান আক্রমণ এসবই বিশ্ব রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে নীলনক্সা ক্রমানুয়ায়ী আমেরিকান আধিপত্যবাদের এককেন্দ্রিক বিশ্ব-ব্যবস্থা। সেখানেথাকবে এক শাসন ব্যবস্থা, যা নিয়ন্ত্রণ করবে আমেরিকা অর্থাৎ বিশ্বের তাবৎ মানুষের আচার-আচরণ, জীবন-জীবিকা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সবই নিয়ন্ত্রণ করবে আমেরিকা। তাই শুরু হয় ইরাক আক্রমণের কূট-কৌশল।ইরাকের তেল সম্পদ মার্কিনীদের হাতের মুঠোয় নেবার নতুন চাল। প্রেসিডেন্ট বুশ তাই ইরাকে মারণাস্ত্র আছে এই বক্তব্যকে বিশ্ববাসীর নিকট বিশ্বাস করানোর জন্য জাতিসংঘের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে ইরাক আক্রমন করার সকল পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক হ্যান্স ব্রিক্স রিপোর্টে মারণাস্ত্র বা জীবাণু অস্ত্র নেই জেনেও, বুশ-ব্লেয়ার ইরাক আক্রমন করলেন। আমেরিকার

পৃষ্ঠা:৭১

আধিপত্যবাদের এক নগ্ন ও নির্লজ্জ অভিপ্রায়-পৃথিবী ব্যাপি তাদের সাম্রাজ্য বিস্ত ার করার এক অভিনব কৌশল মাত্র-যেটা শুধু প্রতারণাই নয়, মানবতার বিরুদ্ধে একটি ভয়ানক অপরাধ। আজ তা প্রমাণিত হয়েছে ইরাক যুদ্ধে যখন লক্ষ লক্ষ নিরীহ নর-নারী শিশু ইরাকের তপ্ত বালুতলে সমাধিস্ত হয়েছে। খাদ্যাভাবে, চিকিৎসাভাবে মারা গেছে অগণিত ইরাকি। কবি চন্ডী দাসের লেখা ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ গুণী বাক্যটি পদদলিত হয়েছে। অতি প্রাচীনতম মানব সভ্যতার স্বাক্ষ্য বহনকারী বাগদাদ নগরীর ধবংসস্তুপের মধ্যদিয়ে সাদ্দামের পতন ঘন্টা চিরতরে বাজলো। সাদ্দাম আত্মগোপন করেছিেেলন। আগ্রাসী বাহিনীর বুলেটে ঝাঝরা হয়েছে সাদ্দাম পুত্রদ্বয় উদে ও কুসের বুক। সাদ্দামকে ধরার মধ্য দিয়ে বুশের সব ছলাকলা মিথ্যাচার কুটকৌশল শেষ হলো। ইরাক যুদ্ধের পরিণতি যতই হিংস্রাত্মক ও ধবংসাত্মক হোক না-তা জেনেও বুশ বলেছেন, ‘সাদ্দাম পৃথিবীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’ তাই তাকে সরিয়ে ইরাকে শান্তির ফুয়ারা বয়ে দিবেন তিনি। কতটুকু শান্তি সাদ্দাম পতনের পর বুশ সাহেব ইরাকে দিতে পেরেছেন। এটা এখন পৃথিবীর সকলেই জানে। ইরাকে গেরিলা যুদ্ধের বিস্তার এবং রক্তাক্ত প্রান্তর ছাড়া এখন পর্যন্ত বুশ প্রশাসন কিছুই দিতে পারে নাই। সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে-নিয়ে যাওয়া হয়েছে আমেরিকান গোয়েন্দাদের দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সাদ্দামকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে। বুশ প্রশাসন বলেছে, সাদ্দামের বিচার করা হবে। বিচারে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এসব বক্তব্য বিচারের আগেই বুশ বলে বেড়াচ্ছেন। ইরাকে অন্যায় যুদ্ধ করেছে আগ্রাসী ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী। আর বিচার করা হবে সাদ্দামের। পৃথিবীশুদ্ধ লোক হতবাক দৃষ্টিতে দংশিত হৃদয়ে তাই প্রশ্ন করছে, ‘এ কেমন বিচার?’ বিশ্ব নিয়ন্ত্রক যদি আমেরিকা হয়েই থাকে, তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার দন্তই হবে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় বিচারের ন্যায়দণ্ড। এতে প্রশ্ন করা বা আশ্চর্য হবার কি আছে? আমেরিকার ইচ্ছা অনিচ্ছাই হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা। পৃথিবীর ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্রধানগণ আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে বাড়িতে বসে থাকলেতো আর ন্যায় বিচার বাড়ীর দুয়ারে আসবে না। তাই সাদ্দাম হোসেন এর বিচারের বুশের রায় মেনে নিতেই হবে-যতই আন্তর্জাতিক আদালত বা নিরপেক্ষ আদালতে সাদ্দামের বিচারের দাবী উঠুক না কেন।

পৃষ্ঠা:৭২

সাদ্দাম সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়। তার ক্ষমতার দম্ভ ‘আর নিষ্ঠুরতা ভূবনবিদিত। দীর্ঘ ৩০ বছরের শাসনামলে তার বাথ পার্টি অন্তত ৩ লক্ষ মানুষকে খুন ক্লরেছে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করে। লক্ষ লক্ষ কুর্দিকে হত্যা করেছে। ১৯৮০ সাল থেকে ৮ বৎসর পর্যন্ত ইরাক-ইরান যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ যুদ্ধ বন্দীদেরকে হত্যা করেছে রাসায়নিক বিষ প্রয়োগে। ইহুদি ষড়যন্ত্রকারীদেরকে হত্যা করে সপ্তাহব্যাপী বাগদাদের রাস্তায় জনগণকে দেখিয়েছেন; শিরচ্ছেদ করেছেন হাজার হাজার শিয়া নেতাসহ স্ত্রী-পুত্র পরিজনকে। এতসব কাহিনী শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে আমাদের। তারপরও সাদ্দামের পতনের পর ইরাকে সাদ্দামের সমর্থনে লক্ষ লক্ষ ইরাকি জনগণের বিক্ষোভ বলে দেয় না কি সাদ্দামই ইরাকের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন? আজকে যখন আমেরিকা সাদ্দামকে বিচারে দোষী সাব্যস্থ করে মৃত্যু দণ্ড দেয়ার পক্ষে গলাবাজী করেেছ-আমার তখন মনে পড়ে ১৯৮৩-৮৪ সনে রামসফেল্ড (আমেরিকার ডিফেন্স মিনিষ্টার) বাগদাদে গিয়ে সাদ্দামকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বন্ধুত্বের উষ্ণ আলিঙ্গনে। এখন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ বলেছে-খামো, থামো, মৃত্যুদন্ডের আগে একটু চিন্তা করতে দাও। কোথাও কোথাও দাবী উঠেছে সাদ্দামকে বিচার করা অযৌক্তিক, অনৈতিক। এর পর ও কি বলবো সাদ্দাম জনপ্রিয় ছিলেন না? প্রশ্ন হলো পৃথিবীর দুর্বল রাষ্ট্রগুলি আর পৃথিবীর কোটি কোটি উপেক্ষিত জনগোষ্ঠি কি-ই বা করতে পারে। কেবল কাঁদতে পারে সে জলে হৃদয় গলে বটে, মানবতার কোন সুরক্ষা হয় না। সেদিন গিয়েছিলাম ভারতের মুর্শিদাবাদে। উদ্দেশ্য ঘুরে ঘুরে নিজ চোখে দেখে আসবো বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার রাজপ্রাসাদ (হীরাঝিল); তাঁর কবরস্থান খোশবাগ এবং বাংলার স্বাধীনতা হরণের ষড়যন্ত্রের সেই সূতিকাগার কাশিম বাজারকুঠি যেখানে মীর জাফর, লর্ড ক্লাইভ, রাজা রাজবল্লব, উমিচাঁদ, জগৎশেট আরও অনেকে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রির ষড়যন্ত্র করেছিল। লালবাগে নবাব সিরাজদ্দৌলার বিশাল রাজপ্রসাদ এখন ভাগিরতী নদী গর্তে বিলীন। আছে শুধু মতিঝিলের জলাধারটি; সেখানে কেঁদেও পাওয়া যাবে না স্বাধীনতার জলরাশি, কারণ সে এখনও পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে। সিরাজদ্দৌলা কোন একদিন বাংলার নবাব ছিলেন-এটাও যেন মুর্শিদাবাদের লোকদের বুঝতে অসুবিধা হয় বা বুঝেও বুঝতে চান না তারা। জাঁকজমক পূর্ণ বিশাল অট্টালিকা হাজার দুয়ারী। সিরাজদ্দৌলার পতনের ৭২ বৎসর পর মীর জাফরের পুত্র নবাব হুমায়ুন ঝাঁ ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মিউজিয়াম

পৃষ্ঠা:৭৩

তৈরি করেন। সেখানে রয়েছে নানা ধরনের নবাবী আমলের বিরল অস্ত্র এবং অস্ত্রের নমুনাসহ প্রকৃতি, উটের গাড়ী; নামী দামী শিল্পকর্ম, দুষ্প্রাপ্য ভাস্করচিত্র: কাঠের তৈরী মূল্যবান সৌখিন আসবাবপত্র, এন্টিক জিনিস পত্র, হাতীর দাঁতের তৈরী দামী সোফা, বিলিয়ার্ড খেলার টেবিল, নবাব মীর জাফরসহ তদীর পুত্রদের সুন্দর সুন্দর তৈলচিত্র, আলোকচিত্র যা শোভাবর্ধন করছে মিউজিয়ামের-তারই মাঝে এক কোণে নবাব সিরাজদ্দৌলার ছবি, মলিন মদন, মোহন লাল এবং ফরাসী বীর ফ্যান্সিসের ছবি ক্ষুদ্রাকারে স্থান পেয়েছে, যেন কৃপা করে কর্তৃপক্ষ স্থান করে দিয়েছে, এ দৈন্যতা দেখলে বাংলার মানুষকে ভারাক্রান্ত করে তুলে নিদারুণ দুঃখের প্রাণ কেঁদে উঠে। অথচ কি আশ্চর্য্য! মুর্শিদাবাদের জনগণ নবাব সিরাজদ্দৌলাকে চেনে না, চেনে সিরাজকে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। এসবই ব্রিটিশ ভারতের ২৫০ বছরের গোলামীর ফসল। আড়াইশো বছর পরে টিভির পর্দায় ভাগ্যাহত সাদ্দামের করুণ পরিণতি তারই প্রতিকী যেন। আর এসবকে ঘিরে রয়েছে যুগে যুগে হাজারো অবিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা বিজড়িত স্মৃতির কথা। সাদ্দামের পতনও আমাদেরকে স্মরণ করে দেয় রাজনীতি বড়ই কুটিল, সংঘাতময় ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতা। নবাব সিরাজদ্দৌলাকে ধরিয়ে দিয়েছিল নিমকহারাম দানেশ ফকির ১০০১ যোহরের জন্যে আর সাদ্দামকে ৩ মিলিয়ন ডলারের লোভে ধরিয়ে দিয়েেেছ তারই বিশ্বস্ত সহচর ও জ্ঞাতি। আলেকজান্ডার দুমারের লেখা ‘দ্যা কাউন্ট অব মনটে ক্রিসটো’-সাগর পাড়ের জাহাজটিকে ঘিরে যে কাহিনী অবিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতার এক অবিকল রূপ। সর্বশেষে বলবো, জীবনের সব ভুলেরই শেষাবধি একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। সাদ্দাম কি তা পেয়েছেন? সাদ্দামের জন্য দুঃখ হয় এবং খারাপ লাগে।

Home
E-Show
Live TV
Namaz
Blood
Job