নবী (সঃ) এর অশ্বাচার্যর ঘটনা-২
পৃষ্ঠা ০১ থেকে ১০
পৃষ্ঠা:০১
লিখা আছে- আমি তাকে এক আল্লাহর আশ্রয়ে দিচ্ছি প্রত্যেক হিংসাপরায়ণের অনিষ্ট থেকে, প্রত্যেক বিচরণকারী সৃষ্টি থেকে, সরল পথে বাধা সৃষ্টিকারী ও ফাছাদের চেষ্টাকারী প্রত্যেক উপবিষ্ট ও দণ্ডায়মান থেকে, প্রত্যেক ফুৎকারকারী ও গ্রন্থি সংযোজনকারী থেকে এবং প্রত্যেক অবাধ্য সৃষ্টি থেকে, যে পথে জাল বিছিয়ে দেয়। আমি আল্লাহর নাম নিয়ে এদের সকলকে প্রতিরোধ করি এবং অদৃশ্য হাতের হেফাযতে দেই, যে হাত সর্বোচ্চ। আল্লাহর হাত সকল হাতের উপরে। এরা তার কোন ক্ষতি করতে পারে না নিদ্রা বা জাগরণে, চলাফিরায় রাতের প্রথম অংশে এবং দিনের শেষাংশে।” ইবনে সা’দ মোহাম্মদ ইবনে কা’ব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ)-এর পিতা সিরিয়ার বাণিজ্য থেকে প্রত্যাবর্তনকালে পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। তখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) মাতৃগর্ভে ছিলেন এবং আবদুল্লাহর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। ওয়াকেদী বলেন: ওফাত ও বয়স সম্পর্কে সকল উক্তি ও রেওয়ায়েতের মধ্যে এটি অধিকতর নির্ভুল। ওয়াকেদী আরও বলেন: আলেমগণের মধ্যে একথা সুবিদিত যে, নবী করীম (সাঃ) ছাড়া আমেনা ও আবদুল্লাহর কোন সন্তান হয়নি।
হস্তীবাহিনীর ঘটনা রসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর শহরের সম্মান
ইবনে সা’দ, ইবনে আবিন্দুনিয়া ও ইবনে আসাকির আবূ জা’ফর মোহাম্মদ ইবনে আলী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ইয়ামানের বাদশাহ আবরাহা হস্তিসজ্জিত বাহিনীসহ যখন মক্কা আক্রমণ করতে আসে, তখন সেটা ছিল মহররম মাসের মাঝামাঝি সময় এই স্মরণীয় ঘটনা ও নবী করীম (সাঃ)-এর জন্মের মাঝখানে পঞ্চাশ রাতের ব্যবধান ছিল। বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হস্তীবাহিনী মক্কার নিকটবর্তী হলে আবদুল মুত্তালিব অগ্রসর হন এবং তাদের বাদশাহকে বলেন: আপনি কষ্ট করলেন কেন, বলে পাঠালেই তো আমরা আপনার সকল ইন্সিত বস্তু নিয়ে হাযির হয়ে যেতাম। বাদশাহ বললেনঃ আমি জানতে পেরেছি যে, এই গৃহে যে প্রবেশ করে সে নিরাপদ হয়ে যায়। আমি এই গৃহের লোকজনকে ভীতি প্রদর্শন করতে এসেছি। আবদুল মুত্তালিব আবার বললেন: আপনি যা কিছু চান, আমরা সেসব নিয়ে আপনার কাছে হাযির হয়ে যাব। আপনি ফিরে যান। বাদশাহ অস্বীকার করলেন এবং বললেনঃ অবশ্যই এগৃহে প্রবেশ করব। এরপর তিনি বায়তুল্লাহর দিকে অগ্রসর হলেন। আবদুল মুত্তালিব পশ্চাতে রয়ে গেলেন এবং পাহাড়ের উপর দণ্ডায়মান হয়ে বললেনঃ আমি এই গৃহের এবং গৃহের লোকজনের ধ্বংস দেখতে চাই না। অতঃপর এই কবিতা পাঠ করলেন: হে আল্লাহ্! তুমি তোমার গৃহের হেফাযত কর। এর উপর কেউ যেন আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। হে আল্লাহ! ব্যাপারটি তোমার হাতে। যা চাও, কর। ঠিক সেই সময়ই সমুদ্রের দিক থেকে এক খণ্ড মেঘের মত উত্থিত হল এবং আবাবীল পাখী হস্তীবাহিনীকে আচ্ছন্ন করে নিল। শেষ পর্যন্ত গোটা হস্তিবাহিনী চর্বিত ভূষিতে পরিণত হল। সায়ীদ ইবনে মনজুর ও বায়হাকী ইকরামা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আল্লাহ طيرًا أَبابيل f 11 আসলে ছিল সমুদ্রের দিক থেকে আগত ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী। এদের মস্তক হিংস্র প্রাণীর ন্যায় ছিল। এই পাখী এর আগেও দেখা যায়নি এবং পরেও কখনও দৃষ্টিগোচর হয়নি। এরা মানুষের ত্বককে বসন্তগ্রস্ত করে দিয়েছিল। বসন্তও সে বছরই প্রথমবারের মত দেখা গিয়েছিল। সায়ীদ ইবনে মনছুর ওবায়দ ইবনে ওমর লায়ছী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আল্লাহ তায়ালা যখন হস্তীবাহিনীকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করলেন, তখন তাদের উপর খাত্তাফের মত সামুদ্রিক পাখী প্রেরণ করলেন। প্রত্যেক পাখী তিনটি করে কংকর বহন করছিল। একটি কংকর চক্ষুতে ছিল এবং দু’টি দু’খাবায়। এই পাখীরা মাথার উপরে আচ্ছন্ন হয়ে সজোরে চীৎকার করতঃ কংকর নিক্ষেপ করতে থাকে। যার উপর সে কংকর পতিত হত, তা এপার ওপার হয়ে যেত। এরপর আল্লাহ্ তায়ালা ভীষণ ঝঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করলেন। ফলে সবকিছু ধ্বংস স্তূপে পরিণত হল। বায়হাকী ও আবূ নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হস্তীবাহিনী ছাফাহ্ নামক স্থানে পৌছলে আবদুল মুত্তালিব এসে বললেন: এটা আল্লাহর ঘর। তিনি এর উপর কাউকে চড়াও হতে দেবেন না। তারা বললঃ আমরা একে ভূমিসাৎ করেই যাব। কিন্তু যে হাতীই সম্মুখে অগ্রসর হত, সে পিছনে সরে আসত। অতঃপর আল্লাহতায়ালা আবাবীল পাখীকে কালো কংকর দিয়ে পাঠালেন। তারা কংকর নিক্ষেপ করলে প্রত্যেকের শরীরে পাঁচড়া দেখা দেয়। পাঁচড়া চুলকালে শরীরের মাংস খসে পড়ত। আবু নয়ীম ওয়াহাব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তাদের সাথে যে সকল হাতী ছিল, সেগুলোর কোন একটি হাতী অগ্রসর হলে তার গায়ে কংকর লাগল। ফলে সকল হাতী পিছনে হটে গেল।
আবদুল মোত্তালিব কর্তৃক যমযম খননকালে
ইবনে ইসহাক ও বায়হাকী হযরত আলী ইবনে আবূ তালেব (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল মুত্তালিব বায়তুল্লায় নিদ্রিত ছিলেন। কোন আগন্তুক এল এবং বললঃ “বাররাহ” খনন কর। আবদুল মুত্তালিব বললেন: বাররাহ কি? এ
পৃষ্ঠা:০২
কথা শুনে আগন্তুক চলে গেল। পরের দিন যখন আবদুল মুত্তালিব বিছানায় শয়ন করলেন, তখন সে আবার এসে বললঃ “তাইবা” খনন কর। আবদুল মুত্তালিব বললেন: তাইবা কি? এরপর আগন্তুক চলে গেল। সে পরের দিন আবার এল এবং বললঃ “যমযম” খনন কর। আবদুল মুত্তালিব বললেন: যমযম কি? সে বলল: এটি এমন কূপ, যা শুষ্ক হবে না এবং পানিও হ্রাস পাবে না। এরপর সে যমযমের স্থান নির্দেশ করল। আবদুল মুত্তালিব খনন কাজ শুরু করলেন। কোরায়শরা বললঃ আবদুল মুত্তালিব, এ কি হচ্ছে। তিনি বললেনঃ আমাকে যমযম খনন করার আদেশ দেয়া হয়েছে। অতঃপর যখন পানি বের হয়ে এল, তখন কোরায়শরা বললঃ আমাদের পিতা ইসমাঈলের (আঃ) পানিতে আমাদেরও অংশ আছে। আবদুল মুত্তালিব বললেন: এতে তোমাদের কোন অংশ নেই। এটা একান্তভাবে আমার। কোরায়শরা বলল: আচ্ছা, কাউকে দিয়ে মীমাংসা করিয়ে নাও। আবদুল মুত্তালিব বললেনঃ ঠিক আছে, তাই করা হোক। কোরায়শরা বললঃ আচ্ছা, আমরা আমাদের ও তোমার মধ্যে বণী-সা’দ ইবনে হুযায়মের অতিন্দ্রীয় বাদিনীকে সালিস মেনে নিচ্ছি। সে যে মীমাংসাই করবে, আমরা উভয় পক্ষ তা মেনে নিব। আবদুল মুত্তালিব এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। সেমতে আবদুল মুত্তালিব তাঁর কয়েকজন পুত্রকে নিয়ে এবং কোরায়শদের প্রত্যেক পরিবার থেকে কয়েক ব্যক্তি সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল। • সিরিয়ার পথে বহুদূর বিস্তৃত ঘাসপানি হীন বিশাল মরুভূমি ছিল। সেখানে পৌছার পর আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীদের পানি খতম হয়ে গেল। জীবন বিপন্ন দেখে তারা কোরায়শ পক্ষের কাছে পানি চাইল। কোরায়শরা বলল: আমরা তোমাদেরকে পানি দিতে পারি না। কেননা, আমরাও এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারি। আবদুল মুত্তালিব সঙ্গীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন। এখন তোমাদের কি মত? তারা বলল: আমরা আপনার মতের অনুসরণ করব। আবদুল মুত্তালিব বললেন: প্রত্যেকেই নিজের কবর খনন করবে। কেউ মারা গেলে তার সঙ্গী তাকে কবরস্থ করবে। অবশেষে শেষ ব্যক্তি তার সঙ্গীকে কবরস্থ করবে। এক ব্যক্তির কবরবিহীন মৃত্যু সকলের কবরবিহীন মৃত্যুর চেয়ে অনেক উত্তম। সেমতে সকলেই কবর খনন করল। অতঃপর আবদুল মুত্তালিব বললেন: আল্লাহর কসম, আমরা তো নিজেদেরকে মৃত্যুর হাতে সোপর্দ করছি। এই অবস্থায়। আমরা পানির খোঁজে বের হই না কেন? হতে পারে আল্লাহ আমাদের দুর্দশা দেখে পানি সৃষ্টি করে দিতে পারেন। আবদুল মুত্তালিব সঙ্গীদেরকে বললেন: যাত্রা কর। সে মতে তারা রওয়ানা হল। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব তাঁর উষ্ট্রীর পিঠে বসতেই উষ্ট্রী ভুচট খেল এবং তার। পায়ের নিচ থেকে মিঠা পানির ঝরণা উথলে উঠল। এরপর সকলেই আপন আপন উষ্ট্রী বসিয়ে দিল। নিজেরাও পানি পান করল এবং জন্তুগুলোকেও পান করাল। এরপর কাফেলার অবশিষ্ট সকলকে ডেকে বললেন। তোমরাও এসে যাও। আল্লাহ্ আমাদের জন্যে পানি সৃষ্টি করেছেন। কোরায়শরা এল এবং নিজেরাও পান করল এবং জন্তুদেরকেও পান করাল। অতঃপর তারা বলতে লাগলঃ আবদুল মুত্তালিব। আল্লাহ তোমার পক্ষে ফয়ছালা দিয়েছেন। যে সত্তা তোমাদেরকে এই ঘাস পানি বিহীন ময়দানে পানি পান করিয়েছেন, তিনিই তোমাকে যমযমও দান করেছেন। ফিরে চল। যমযম একান্তভাবে তোমার। আমরা এতে অংশীদার নই। বায়হাকী যুহরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল মুত্তালিবকে বলা হল, কোরায়শরা হস্তী বাহিনীর ভয়ে হেরেম ত্যাগ করে চলে গেছে। এখন আপনি কি করবেন? আবদুল মুত্তালিব বললেন : আল্লাহর কসম, আমি ইজ্জতের তালাশে হেরেম ত্যাগ করে অন্য কোথাও যাব না। এরপর তিনি বায়তুল্লাহর কাছে বসে গেলেন এবং বললেনঃ হে আল্লাহ! আমি আমার উটের পাল রক্ষা করেছি। তুমি তোমার ঘর রক্ষা কর। তিনি এমনিভাবেই হেরেমে বসে রইলেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা হস্তীবাহিনীকে ধ্বংস করে দিলেন। কোরায়শরা ফিরে এসে তাঁর ছবর এবং আল্লাহর ঘরের সম্মানের কারণে তাঁকে অত্যন্ত মহান ব্যক্তি ভাবতে থাকে। আবদুল মুত্তালিব হেরেমেই নিদ্রিত ছিলেন, এমন সময় স্বপ্নে কেউ এসে তাঁকে বলল: যমযম খনন কর। তিনি জাগ্রত হয়ে গেলেন এবং বললেনঃ হে আল্লাহ। আমার দৃষ্টিতে এর আলামত স্পষ্ট করে দাও। সে মতে তিনি আবার স্বপ্নে কাউকে বলতে শুনলেন: যমযম সেই স্থানে খনন কর, যেখানে গোবর ও রক্ত পড়ে রয়েছে, যেখানে সাদা পাখাবিশিষ্ট কাক চঞ্চু মারছে-পিপীলিকার গর্তের কাছে। এই স্বপ্ন দেখে আবদুল মুত্তালিব রওয়ানা হয়ে গেলেন, এটা দেখার জন্যে যে, সেখানে কি কি আলামত প্রকাশ পেয়েছে। তিনি দেখলেন যে, ছাফা ও মারওয়ার মাঝখানে খারুরা নামক স্থানে একটি গরু যবেহ করা হয়েছে। গরুটি কসাইয়ের হাত ফসকে পালিয়েছে। অবশেষে যমযমের জায়গায় এসে মাটিতে পড়ে গেছে। সেখানেই তাকে যবেহ করে গোশত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটি কাক এসে পিপীলিকার গর্তের কাছে আবর্জনায় বসে পড়ল। এই আলামতগুলো দেখে আবদুল মুত্তালিব সেখানেই খননকার্য শুরু করে দিলেন। কোরায়শরা এসে বললঃ কি করছ? তিনি বললেনঃ কূপ খনন করছি। সঅনেক পরিশ্রমের পরও যখন পানি পাওয়া গেল না, তখন তিনি মান্নত করলেন যে, যদি পানি বের হয়ে আসে, তবে তিনি নিজের একটি পুত্রকে বলীদান করবেন। এরপর খনন শুরু করলে পানি বের হয়ে এল। আবদুল মুত্তালিব কূপের চতুর্দিকে
পৃষ্ঠা:০৩
দেয়াল তুলে দিলেন। হাজীরা এই কূপ থেকে পানি পান করত। কিন্তু কোরায়শদের কিছু দুষ্কৃতকারী রাতে এসে এই দেয়াল ভেঙ্গে দিত। আবদুল মুত্তালিব সকালে তা ঠিক করে দিতেন। বেশ কিছুদিন এরূপ চলার পর আবদুল মুত্তালিবকে স্বপ্নে এই দোয়া শিক্ষা দেয়া হলঃ হে আল্লাহ! আমি এই কুয়া গোসল করার জন্যে হালাল রাখি না। তবে পান করার জন্যে হালাল। আবদুল মুত্তালিব জাগ্রত হয়ে স্বপ্নের এই কথা ঘোষণা করে দিলেন। এই ঘোষণার পর কেউ কূপের দেয়াল ভাঙ্গলে সে গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়ে যেত। তাই দুর্বৃত্তরা কূপে আসা পরিত্যাগ করল। এরপর আবদুল মুত্তালিব বললেনঃ হে আল্লাহ। আমি আমার এক পুত্রকে বলী দেব বলে মান্নত করেছিলাম। এখন আমি কোন্ পুত্রকে বলী দেব, তা নির্ধারণ করার জন্যে লটারী দিচ্ছি। তুমি যাকে পছন্দ কর, তার নাম লটারীতে তুলে দাও। আবদুল মুত্তালিব লটারী দিলে আবদুল্লাহর নাম বের হল। পুত্রদের মধ্যে আবদুল্লাহ ছিলেন সর্বাধিক প্রিয়। আবদুল মুত্তালিব বললেনঃ হে আল্লাহ! তুমি আবদুল্লাহকে অধিক পছন্দ কর, না একশ’ উট? এরপর আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহ ও একশ’ উটের মধ্যে লটারী দিলেন। লটারীতে একশ’ উট বের হয়ে এল। সে মতে তিনি একশ’ উট যবেহ করলেন। ইবনে সা’দ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুল মুত্তালিব যমযম খননে কেউ তার সাহায্যকারী নেই দেখে মান্নত করলেন-যদি আল্লাহ তায়ালা আমার জীবদ্দশাতেই দশটি পুত্রকে যৌবনে পৌছে দেন, তবে আমি একজনকে বলী দান করব। এরপর যখন দশপুত্র পূর্ণ যুবকে পরিণত হয়ে গেল, তখন সবাইকে একত্রিত করে মান্নত সম্পর্কে বললেন। সকলেই বলল: ঠিক আছে। আপনি মান্নত পূর্ণ করুন। সেমতে লটারী দেয়া হলে আবদুল্লাহর নাম বের হয়ে এল। আবদুল মুত্তালিব ছুরি হাতে নিয়ে আবদুল্লাহর হাত ধরে যবেহ করার জন্যে রওয়ানা হলেন। এই দৃশ্য দেখে বোনেরা কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তারা বললঃ আব্বাজান। আপন, পুত্রের বদলে হেরেমে কিছু উট যবেহ করে দিন। আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহ ও দশ উটের মধ্যে লটারী দিলেন। কেননা, তখনকার দিনে “দিয়ত” (মুক্তিপণ) দশটি উট ছিল। লটারীতে আবদুল্লাহর নাম বের হল। এরপর আবদুল মুত্তালিব দশটি করে উট বৃদ্ধি করে লটারী দিতে থাকেন। কিন্তু প্রত্যেক বার আবদুল্লাহর নাম বের হল। কিন্তু যখন একশ’ উট পূর্ণ হয়ে গেল, তখন লটারীতে উট বের হল। এতে আবদুল মুত্তালিব “আল্লাহু আকবার” বলে উঠলেন এবং সকলের সামনে উট যবেহ করলেন। আবদুল মুত্তালিবই সর্বপ্রথম মুক্তিপণ একশ’ উট নির্ধারণ করেন। এ নিয়মই আরবে প্রচলিত হয়ে যায়। নবী করীম (সাঃ)ও এটা বহাল রাখেন। হাকেম, ইবনে জরীর ও উমভী সালেহী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত মোয়াবিয়া (রাঃ) বর্ণনা করেছেন-একবার আমরা শূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে উপবিষ্ট ছিলাম। এক বেদুঈন এসে আরয করলঃ ইয়া রসূলাল্লাহ! ঘাস শুকিয়ে গেছে। পানি ফুরিয়ে গেছে। পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে এবং পশুপাল বরবাদ হয়ে গেছে। হে দু’ যবীহের পুত্র! আল্লাহ আপনাকে যা দিয়েছেন, তা থেকে আমাকে কিছু দিন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) মুচকি হাসলেন এবং অস্বীকার করলেন না। হযরত মোয়াবিয়া (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হলঃ দুই যবীহ্ কে? (যাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়, তাকে যবীহ্ বলে।) তিনি বললেনঃ আবদুল মুত্তালিব যখন যমযম খনন করার আদেশ পান, তখন মান্নত করলেন, এ কাজটি সহজে সম্পন্ন হলে আমি আমার কোন পুত্রকে যবেহ করব। খনন সমাপ্ত হলে তিনি দশ পুত্রের মধ্যে লটারী দিলেন। এতে আবদুল্লাহর নাম বের হল। আবদুল মুত্তালিব তাকে যবেহ করতে চাইলে তার মাতুল গোষ্ঠি বনু মখযুম বাধা দিয়ে বলল: উটের ফেদিয়া দিয়ে পরওয়ারদেগারকে রাযী করে নাও। সেমতে তিনি একশ’ উট যবেহ করলেন। মোয়াবিয়া (রাঃ) বললেনঃ অতএব এক যবীহ্ আবদুল্লাহ এবং অপর যবীহ হযরত ইসমাঈল (আঃ)।
শবে-মীলাদের মোজেযা
বায়হাকী ও আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে হাসসান ইবনে ছাবেত (রাঃ) বর্ণনা করেন- আমি সাত-আট বছরের সচেতন বালক ছিলাম। একদিন এক ইহুদী একটি টিলায় আরোহণ করে মদীনার ইহুদী সম্প্রদায়কে ডাক দিল। তারা সমবেত হয়ে জিজ্ঞাসা করলঃ ব্যাপার কি? ইহুদী বললঃ আজ রাতে আহমদ জন্ম গ্রহণ করেছেন। তাঁর নক্ষত্র উদিত হয়ে গেছে। বায়হাকী, তিবরানী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির হযরত ওছমান ইবনে আবুল আস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন-আমার মা আমাকে বলেছেন যে, যখন আমেনার গৃহে রসূলুল্লাহ (সাঃ) জন্ম গ্রহণ করেন, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ঘরের চারদিক কোন নূরের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে গিয়েছিল। তারকারাজি এমনভাবে ঝুঁকে পড়ছিল, মনে হচ্ছিল যেন আমার উপরই আছড়ে পড়বে। তাঁর জন্মের সময় আমেনার শরীর থেকে একটি নূর উদিত হয়ে সমগ্র গৃহকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলে। আহমদ বাযযায, তিবরানী, হাকেম, বায়হাকী ও আবু নয়ীম ইরবায ইবনে সারিয়া (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন- আমি আল্লাহর বান্দা। আমি তখন থেকে খাতামুন্নাবীয়্যীন, যখন আদমের সত্তা মৃত্তিকায় লুটোপুটি খাচ্ছিল। আমার জন্যে হযরত ইবরাহীম (আঃ) দোয়া করেছেন, হযরত
পৃষ্ঠা:০৪
ঈসা (আঃ) সুসংবাদ দিয়েছেন এবং আমার মা স্বপ্ন দেখেছেন। পয়গাম্বরগণের জননীগণ এরূপ স্বপ্ন দেখে থাকেন। নবী করীম (সাঃ)-এর জননী তাঁর জন্মের সময় একটি নূর দেখেন, যদ্বারা সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ চমকে উঠে।হাকেম ও বায়হাকী খালেদ ইবনে মে’দান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ। নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি বললেন: আমি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দোয়া এবং হযরত ঈসা (আঃ)-এর সুসংবাদ। আমার মা আমি গর্ভে থাকা অবস্থায় স্বপ্ন দেখেছেন যেন তাঁর শরীর থেকে একটি নূর উদিত হয়েছে, যার ফলে শামদেশের বুহুরা ভূখণ্ড আলোকময় হয়ে গেছে। খালেদ বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জননী গর্ভাবস্থায় যে নূর দেখেছিলেন, সেটা ছিল স্বপ্ন; কিন্তু জন্মের সময় যে নূর দেখেছিলেন, সেটা ছিল জাগ্রত অবস্থায় বাস্তব ঘটনা। ইবনে ইসহাকের রেওয়ায়েতে হযরত আমেনা বর্ণনা করেন যে, গর্ভ সঞ্চার হওয়ার পর কেউ তাঁকে বলল: তোমার গর্ভে এই উম্মতের সরদার রয়েছেন। এর নিদর্শন এই যে, যখন তিনি ভূমিষ্ঠ হবেন, তখন একটি নূর উদিত হবে, যার ফলে শামদেশের বুহুরার রাজপ্রাসাদ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। এই শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাঁর নাম রাখবে মোহাম্মদ। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত কারেন যে, হযরত আমেনা বলেছেন-নবী করীম (সাঃ)-কে গর্ভে ধারণ করার পর তাঁর জন্ম পর্যন্ত আমার কোন কষ্ট হয়নি। তিনি যখন ভূমিষ্ট হলেন, তখন তাঁর সাথে একটি নূর উদিত হল, যার ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী সমস্ত ভূপৃষ্ঠ আলোকময় হয়ে গেল। জন্মের সময় তিনি হাত দিয়ে মাটিতে ভর দেন। এক মুষ্টি মাটি নিয়ে হাত বন্ধ করে নেন এবং আকাশ পানে তাকিয়ে থাকেন।”ইবনে সা’দ ছওর ইবনে এয়াযিদ থেকে, তিনি আবুল আত্মফা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন- আমি যখন ভূমিষ্ঠ হলাম, তখন আমার জননী আপন শরীর থেকে একটি নূর উদিত হতে দেখলেন, যার ফলে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ে। আবু নয়ীম আতা ইবনে ইয়াসার থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত উম্মে সালামাহ্ (রাঃ) হযরত আমেনার এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেন-যে রাতে নবী করীম (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন, আমি একটি নূর উদিত হতে দেখি, যে কারণে সিরিয়ার প্রাসাদ এতটুকু উজ্জ্বল হয়ে যায় যে, আমি তা দেখতে পাই। ইবনে সা’দ আমর ইবনে আছেম থেকে, তিনি হুমাম ইবনে এয়াহইয়া থেকে, তিনি ইসহাক ইবনে আবদুল্লাহ থেকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জননীর এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করলে আমার শরীর থেকে একটি নূর উদিত হয়, যার ফলে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ আলোকময় হয়ে যায়। তিনি সম্পূর্ণ পাক পবিত্র অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন- কোন মালিন্য ছিল না। ভূমিষ্ঠ হয়েই তিনি মাটিতে হাত রাখেন। ইবনে সা’দ মুয়ায আম্বরী থেকে, তিনি ইবনে আওন থেকে, তিনি ইবনুল কিবতিয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আমেনা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য প্রসঙ্গে বলেছেন-আমি আমার শরীর থেকে একটি আলোকপিও উদিত হতে দেখি, যার ফলে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ আলোকোজ্বাসিত হয়ে উঠে। ইবনে সা’দ হাসসান ইবনে আতিয়্যা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) ভূমিষ্ঠ হয়ে হাতের তালু ও হাঁটু দিয়ে মাটিতে ভর দেন। তাঁর দৃষ্টি আকাশ পানে নিবন্ধ ছিল। ইবনে সা’দ মুসা ইবনে ওবায়দা থেকে, তিনি আপন ভাই থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) ভূমিষ্ঠ হয়ে হাত দিয়ে মাটিতে ভর দেন। মাথা আকাশ পানে উত্তোলন করেন এবং হাতে এক মুষ্টি মাটি তুলে নেন। বন্ধু-লাহাবের এক ব্যক্তি এই খবর পেয়ে মন্তব্য করল। একথা সত্য হলে এই শিশু সমগ্র বিশ্ব করতলগত করে নিবে। আবু নয়ীম আবদুর রহমান ইবনে আওফ থেকে, তিনি তাঁর জননী আশশিফা বিনতে আমর ইবনে আওফের এমর্মের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, রসুলে করীম (সাঃ)-এর জন্ম আমার হাতে হয়েছে। তাঁর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল ছিল। আমি কাউকে বলতে শুনলাম-তোমার প্রতি আল্লাহর রহমত, তোমার প্রতি তোমার রবের রহমত। এরপর আমার সামনে পূর্ব ও পশ্চিম আলোকিত হয়ে গেল এবং আমি রোমের কিছু রাজপ্রাসাদ দেখতে পেলাম। এরপর আমি নবজাত শিশুকে। কাপড় পরিয়ে শুইয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার উপর তমসা ও ভীতির একটা পর্দা যেন পড়ে গেল এবং শরীরে কম্পন এসে গেল। আমি কাউকে বলতে শুনলাম-তুমি একে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? জওয়াব দেয়া হল-পশ্চিম দিকে। এরপর আমার এই অবস্থা কেটে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পুনরায় সেই অবস্থা আমাকে আচ্ছন্ন করে নিল-ভীতি, অন্ধকার ও কম্পন। আবার কাউকে বলতে শুনলাম-একে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? জওয়াব এল-পূর্ব দিকে। শিফা বিনতে আমর ইবনে আওফ বলেন: রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুয়তপ্রাপ্তি পর্যন্ত এই কথাগুলো আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। তিনি যখন নবুওত প্রাপ্ত হলেন, তখন আমি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করলাম। আবু নয়ীম আমর ইবনে তোতায়বা থেকে, তিনি আপন পিতার কাছ থেকে শুনেছেন যে, হযরত আমেনার সন্তান প্রসবের সময় উপস্থিত হলে আল্লাহ তায়ালা
পৃষ্ঠা:০৫
ফেরেশতাগণকে আদেশ করলেন: সমস্ত আকাশ ও জান্নাতের দরজা খুলে দাও। সকল ফেরেশতা আমার সামনে উপস্থিত হোক। সে মতে ফেরেশতাগণ একে অপরকে সুসংবাদ দিতে দিতে হাযির হতে লাগল। পৃথিবীর পাহাড়সমূহ উঁচু হয়ে গেল এবং সমুদ্র স্ফীত হয়ে গেল। এসবের অধিবাসীরা একে অপরকে সুসংবাদ দিল। সকল ফেরেশতা হাযির হয়ে গেল। শয়তানকে সত্তরটি শিকল পরানো হল এবং তাকে কাস্পিয়ান সাগরে উপুড় করে ঝুলিয়ে দেয়া হল। সকল দুষ্ট ও অবাধ্য মখলুককেও শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেয়া হল। সূর্যকে সেদিন অসাধারণ আলো প্রদান করা হল এবং তার প্রান্তে শূন্য পরিমণ্ডলে সত্তর হাজার হরকে দাঁড় করানো হল, যারা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মের অপেক্ষায় ছিল। নবী করীম (সাঃ)-এর সম্মানার্থে আল্লাহ তায়ালা সে বছর পৃথিবীর সকল নারীর জন্যে পুত্র সন্তান নির্ধারণ করে দিলেন। এটাও ঠিক করলেন যে, কোন বৃক্ষ ফলবিহীন থাকবে না এবং যেখানে অশান্তি সেখানে শাস্তি স্থাপিত হয়ে যাবে। অতঃপর যখন প্রতীক্ষিত জন্ম হল, তখন সমস্ত পৃথিবী নূরে ভরে গেল। ফেরেশতারা একে অপরকে মোবারকবাদ দিল। প্রত্যেক আকাশে পদ্মরাগ মণি ও চুনির রুষ্ণ নির্মিত হল। ফলে আকাশ আলোকোজ্জ্বল হয়ে গেল। রসূলুল্লাহ (সাঃ) শবে মে’রাজে এসব স্তম্ভ দেখতে পেলে তাঁকে বলা হয় যে, এগুলো আপনার জন্মের সুসংবাদের কারণে নির্মিত হয়েছিল। যে রাতে রসূলে করীম (সাঃ)-এর জন্য হয়, আল্লাহ তায়ালা হাওযে-কাওসারের কিনারে সত্তর হাজার মেশক-আম্বরের বৃক্ষ সৃষ্টি করেন এবং এসবের ফলকে জান্নাতীদের সুগন্ধি সাব্যস্ত করেন। সে রাতে সকল আকাশের অধিবাসীরা নিরাপত্তার জন্য দোয়া করেন। সকল প্রতিমা উপুড় হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। লাত ও ওযযা আপন আপন ধনভাণ্ডার উদ্গীরণ করে দেয়। তারা বলাবলি করতে থাকে-কোরায়শদের মধ্যে আল-আমীন এসেছেন, ছিদ্দীক এসেছেন; অথচ কোরায়শরা জানেই না যে, কি হয়ে গেল। বায়তুল্লাহ থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত এই আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে- এখন পূর্ণচন্দ্র ফিরে এসেছে। এখন আমার যিয়ারতকারীরা আগমণ করবে। এখন আমি মূর্খতার আবর্জনা থেকে পাক পবিত্র হয়ে যাব। হে ওয্যা। তোর ফাংস এসে গেছে। বায়তুল্লাহর ভূকম্পন তিনদিন ও তিন রাতে খতম হল। এটা ছিল পরির জন্মের প্রথম নিদর্শন, যা কোরায়শরা অবলোকন করল। আবু নয়ীম রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন- গর্ভধারণের নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি এই যে, সে রাতে কোরায়শদের প্রত্যেকটি জন্তু বলল: কা’বার প্রতিপালকের কসম, গর্ত হয়ে গেছে। তিনিই দুনিয়ার শান্তি এবং দুনিয়াবাসীদের প্রদীপ। সে রাতে কোরায়শদের এবং আরবের সকল গোত্রের অতিন্দ্রীয়বাদী নারীদের সঙ্গিনী জিন আত্মগোপন করে এবং তাদের অতিন্দ্রীয়বাদ বিদ্যা খতা হয়ে যায়। দুনিয়ার সকল বাদশাহের সিংহাসন ভেঙ্গে যায়। সেদিন বাদশাহরা সকলেই বোবা হয়ে যায়। পূর্বের জন্তু-জানোয়াররা পশ্চিমের জন্তু জানোয়ারদের কাছে সুসংবাদ নিয়ে যায়। এভাবে সমুদ্রের প্রাণীরা একে অপরকে সুসংবাদ দেয়। গর্ভের প্রত্যেক মাস অতিবাহিত। হওয়ার পর আকাশে এবং পৃথিবীতে ঘোষণা করা হত- সুসংবাদ হোক। এখন আবুল কাসেম (সাঃ) কল্যাণ ও বরকত নিয়ে দুনিয়াতে এসে গেছেন। রসুলুল্লাহ (সাঃ) জননীর উদরে পূর্ণ নয়মাস অবস্থান করেন। কিন্তু তাঁর জননী পেটে কোন ব্যথা বা অস্থিরতা অনুভব করেননি। এমন কোন বিষয়ও হয়নি, যা সাধারনত: গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকে। মাতৃগর্ভে থাকাকালেই পিতা আবদুল্লাহর ইন্তেকাল হয়ে যায়। এতে ফেরেশতারা বললঃ পরওয়ারদেগার! আপনার এই নবী এতীম হয়ে গেছেন। পরওয়ারদেগার এরশাদ করলেনঃ আমি তাঁর অভিভাবক, রক্ষক ও মন্দগার। তোমরা তাঁর জন্ম থেকে বরকত হাসিল কর। তাঁর জন্ম বরকতময়। আল্লাহ তায়ালা তাঁর জন্মের সময় আকাশ ও জান্নাতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। হযরত আমেনা নিজের সম্পর্কে বলতেন। গর্ভের ছয়মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আমার কাছে জনৈক আগন্তুক এসে নিদ্রায় আমার পায়ে টোকা দিয়ে বললঃ হে আমেনা। তুমি সরাবিশ্বের মনোনীত ব্যক্তিকে গর্ভে ধারণ করেছ। সে জন্মগ্রহণ করলে তাঁর নাম রাখবে মোহাম্মদ। আমেনা নিজের নেফাস সম্পর্কে বলেন। আমারও তাই হয়েছে যা মহিলাদের হয়। কিন্তু কেউ জানতে পারেনি। এরপর আমি ভীষণ গড়গড় শব্দ শুনতে পাই এবং ভীত হয়ে পড়ি। দেখি কি, যেন কোন সাদা পাখীর পাখা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। ফলে সমস্ত ভয় ও কষ্ট দূর হয়ে গেল। এরপর দেখি, সাদা দুধে পূর্ণ একটি পিয়ালা রাখা আছে। আমি পিপাসার্ত ছিলাম। ভাই পাত্র তুলে পান করে নিলাম। এরপর আমার শরীর থেকে একটি নূর উদিত হল। তাতে কয়েকজন মহিলা দৃষ্টি গোচর হল। তাঁরা খেজুর গাছের মত দীর্ঘ ছিলেন। মনে হচ্ছিল তাঁরা আবদে মানাফ পরিবারের কন্যা। তাঁরা আমাকে গভীরভাবে দেখতে লাগলেন। আমি হতভম্বই ছিলাম, এমন সমম্ন একটি কিংখাব (ফুলকাটা জরিদার রেশমী বস্তু) আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থলে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ বললঃ তাঁকে মানুষের দৃষ্টি থেকে উধাও করে নাও। এরপর কিছু লোক দেখলাম, তারা শূন্য মণ্ডলে রূপার লোটা হাতে দায়মান ছিল। এরপর পাখীদের একটি ঝাঁক এল এবং আমার কোল আবৃত করে নিল। তাদের চক্ষু পান্নার এবং পাখা চুনীর ছিল। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আমার সামনে পূর্ব ও পশ্চিম উন্মুক্ত করে দিলেন। আমি তিনটি ঝাণ্ডা উড্ডীয়মান দেখলাম। একটি পূর্বে, একটি পশ্চিমে ও একটি
পৃষ্ঠা:০৬
থেকে একপুত্র জন্মগ্রহণ করবে। পূর্ব ও পশ্চিমের অধিবাসীরা তাঁর অনুসারী হয়ে যাবে। কা’বা গৃহের ছাদে। এরপর আমার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হল এবং নবী, করীম (সাঃ) জন্ম গ্রহণ করলেন। তিনি যখন বাইরে এলেন, তখন আমি তাঁকে সেজদারত দেখলাম। তিনি অনুনয় সহকারে অঙ্গুলি উত্তোলিত রেখেছিলেন। এরপর আকাশে একটি সাদা মেঘ এসে আকাশকে আচ্ছন্ন করে নিল। অতঃপর অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি একজনকে বলতে শুনলাম: মোহাম্মদকে পূর্ব ও পশ্চিমে নিয়ে যাও এবং সমুদ্রে নিয়ে যাও। যাতে মানুষ তাঁর নাম, আকৃতি ও গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিফ হয়ে যায় এবং তারা জানতে পারে যে, তাঁর নাম “মাহী”। তাঁর আমলে শিরক মিটে যাবে। এর পরক্ষণেই আমি তাঁকে একটি সাদা পশমী কাপড়ে জড়িত দেখলাম। নীচে ছিল সবুজ রেশম। তিনি যেন বহু মূল্যবান ধাতু নির্মিত তিনটি চাবি হাতের মুঠিতে ধারণ করে রেখেছেন। আওয়াজ এলঃ মোহাম্মদ নবুওয়তের চাবি গ্রহণ করেছেন। এরপর একটি মেঘখণ্ড এল, যার মধ্য থেকে অশ্বের হ্রেষারব এবং পাখা নাড়ানোর শব্দ ভেসে আসছিল। অবশেষে সেটি আচ্ছন্ন হয়ে গেল। অতঃপর অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর কেউ ডেকে বললঃ মোহাম্মদকে পূর্ব ও পশ্চিমে নিয়ে যাও, পয়গাম্বরগণের জন্মভূমিতে নিয়ে যাও। জিন, মানব, পশুপক্ষী এবং হিংস্র প্রাণীদের কাছে নিয়ে যাও। তাঁকে আদম (আঃ)-এর পরিচ্ছন্নতা, নূহ (আঃ)-এর নম্রতা, ইবরাহীম (আঃ)-এর বন্ধুত্ব, ইসমাঈল (আঃ)-এর ভাষা, ইয়াকুব (আঃ)-এর মুখমণ্ডল, ইউসুফ (আঃ)-এর রূপ, দাউদ (আঃ)-এর কন্ঠস্বর, আইউব (আঃ)-এর ছবর, এয়াহইয়া (আঃ)-এর বৈরাগ্য এবং ঈসা (আঃ)-এর কৃপা দান কর। তাঁকে সকল পয়গাম্বরের চরিত্রের নমুনা করে দাও। এরপর এই অবস্থাও দূর হয়ে গেল। এরপর আমি আমার শিশুর হাতে সবুজ রেশমী বস্তু জড়িত দেখলাম। কেউ বলল: মোহাম্মদ সারা বিশ্ব দখল করে নিয়েছে। সৃষ্টির প্রতিটি বস্তু তাঁর মুঠিতে চলে গেছে। এরপর তিন ব্যক্তি এল। তাদের একজনের হাতে রূপার লোটা, অপর জনের হাতে সবুজ পান্নার ক্ষুদ্র প্লেট এবং তৃতীয় জনের হাতে সাদা রেশম রয়েছে। সেটি খুলে সে একটি মনোমুগ্ধকর আংটি বের করল। লোটার পানি দিয়ে আংটিটি সাতবার ধৌত করতঃ সেটি দিয়ে নবী করীম (সাঃ)-এর দুই কাঁধের মধ্যস্থলে মোহর করে দিল। অতঃপর কিছুক্ষণ আপন পাখায় আবৃত্ত রেখে আমাকে ফিরিয়ে দিল। আবু নয়ীম দুর্বল সনদে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেছেন-আমাদের ছোটভাই আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করলে তাঁর মুখমণ্ডলে নূর সুর্যের মত ঝলমল করত। আমাদের পিতা বললেন: এই শিশুর অদ্ভুত অবস্থা। আমি স্বপ্নে দেখলাম তাঁর নাসিকা থেকে একটি সাদা পাখী বের হয়ে উড়ে গেল এবং পূর্ব ও পশ্চিম ঘুরে কা’বাগৃহের উপর পতিত হল। সমগ্র কোরায়শ গোষ্ঠি তাঁকে সিজদা করল। অতঃপর পাখীটি আবার আকাশে উড়ে গেল। আমি বনী-মখযূমের অতিন্দ্রীয়বাদিনীর কাছে গেলে সে বলল: তোমার এ স্বপ্ন সত্য হলে তোমার ঔরস অতঃপর আমেনা সন্তান প্রসব করলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম: তুমি কি দেখেছ? সে বলল: আমার প্রসব ব্যথা শুরু হলে আমি গড় গড় আওয়াজ এবং কিছু মানুষের কথা বলার শব্দ শুনতে পেলাম। এরপর আমি ইয়াকুতের খুঁটিতে কিংখাবের ঝাণ্ডা আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে স্থাপিত দেখলাম। আমি শিশুর মাথা থেকে একটি নূর উদিত হতে দেখলাম, যা আকাশ পর্যন্ত পৌছে গেল। এর আলোকে আমি সিরিয়ার প্রাসাদকে স্ফুলিঙ্গের মত জ্বলতে দেখলাম। এরপর আমি নিকটেই কাতা পাখীর একটি ঝাঁক নবী করীম (সাঃ)-কে পাখা বিস্তার করে সিজদা করতে দেখলাম। আমি সায়ীরা আসাদীর জিনকে বলতে শুনলাম-তোমার এই পুত্রের জন্মের কারণে প্রতিমা ও অতিন্দ্রীয়বাদীদের বিলয় হয়ে গেছে। সায়ীরা ধ্বংস হয়ে গেছে। এরপর আমি একজন দীর্ঘদেহী সুশ্রী যুবককে দেখলাম। সে নবী করীম (সাঃ)-কে আমার কোল থেকে নিয়ে গেল এবং তাঁর মুখে থুথু দিল। তার কাছে স্বর্ণের একটি প্লেট ছিল। সে নবী করীম (সাঃ)-এর বুক চিরে হৃদপিণ্ড বের করল। অতঃপর হৃদপিণ্ডটি চিরে একটি কাল বিন্দু বের করে দূরে নিক্ষেপ করল। প্লেটে সাদা রঙের সুগন্ধি ছিল। তা হৃদপিণ্ডে ভরে দেয়া হল। এরপর একটি সাদা রেশমী থলে থেকে একটি আংটি বের করল এবং তার সাহায্যে নবী করীম (সাঃ)-এর দুই কাঁধের মধ্যভাগে মোহর এঁটে দিল। অতঃপর তাঁকে জামা পরিয়ে দিল।* হাফেয আবূ যাকারিয়া এয়াহইয়া ইবনে মায়েয মীলাদ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আমেনা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম দিবসের আশ্চর্য ঘটনাবলী বর্ণনায় বলেন: আমি সেদিনের ঘটনাবলীতে বিশ্বয়াবিষ্ট ছিলাম, এমন সময় তিন ব্যক্তি আগমন করল। তাদের সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল সূর্য যেন তাদের মুখমণ্ডল থেকে উদিত হচ্ছে। একজনের হাতে রূপার লোটা ছিল, যা থেকে মেশকের খোশবু ভেসে আসছিল। দ্বিতীয় জনের হাতে পান্নার চতুষ্কোণ প্লেট ছিল। প্রত্যেক কোণে একটি সাদা মোতি জড়ানো ছিল। কেউ বললঃ এটা সারা বিশ্ব-পূর্ব পশ্চিম, জল ও স্থল। হে আল্লাহর হাবীব। এটি ধারণ করুন যেদিক দিয়ে ইচ্ছা, একথা শুনে আমিও ঘুরে গেলাম এটা দেখার জন্যে যে, তিনি কোন্ দিকে ধরেন। তিনি মাঝখানে ধরলেন। আওয়াজ এল: কা’বার কসম, মোহাম্মদ কা’বা ধারণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর জন্যে
পৃষ্ঠা:০৭
কা’বাকে কেবলা ও বাসস্থান করে দিয়েছেন। আমি দেখলাম তৃতীয় জনের হাতে খুব উত্তমরূপে ভাঁজ করা একটি সাদা রেশমী বস্তু রয়েছে। সে কাপড়টি খুলল এবং তার ভিতর থেকে একটি সুশ্রী আংটি বের করল। এরপর আমার দিকে অগ্রসর হল। প্লেটওয়ালা ব্যক্তি আংটিটি নিয়ে সাতবার লোটার পানি দ্বারা ধৌত করল। এরপর সেটি দিয়ে নবী করীম (সাঃ)-এর দুই কাঁধের মাঝখানে মোহর এঁকে দিল। অতঃপর সেটি রেশমে ভাঁজ করে তাতে মেশকের সূতা বেঁধে দিল। অতঃপর সেটি কিছুক্ষণ আপন পাখায় রেখে দিল। (ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: এই ব্যক্তি ছিল জান্নাতের রক্ষী রিষওয়ান।) সে নবী করীম (সাঃ)-এর কানে কিছু কথা বলল, যা আমি বুঝতে পারিনি। অতঃপর সে বলল: হে মোহাম্মদ! আপনাকে সুসংবাদ। প্রত্যেক নবীর জ্ঞান আমি আপনাকে দিয়েছিলাম। আপনি তাদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানবান এবং সর্বাধিক বীরপুরুষ। আপনার কাছে সাফল্যের চাবি রয়েছে। আপনাকে প্রখর ব্যক্তিত্ব ও জাঁকজমক দান করা হয়েছে। হে আল্লাহর খলিফা। যে কেউ আপনার নাম শুনবে, আপনাকে না দেখেই তার অন্তর কেঁপে উঠবে। ইবনে ওয়াহিদ ‘তানভীর’ গ্রন্থে বলেন: এ হাদীসটি অজ্ঞাত। ইবনে সা’দ, হাকেম, বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন: জনৈক ইহুদী মক্কায় বাস করত এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করত। মীলাদের রাত্রিতে সে কোরায়শদের মজলিসে এসে বললঃ হে কোরায়শগণ। আজ রাতে তোমাদের মধ্যে কোন শিশু জন্মগ্রহণ করেছে কি? তারা বলল: আমাদের জানা নেই। সে বলল: মনে রেখ, এ রাতে আখেরী উম্মতের নবী জন্মগ্রহণ করেছেন। তার কাঁধের মাঝখানে চিহ্ন আছে, যাতে কিছু চুল রয়েছে। এই শিশু দু’দিন দুধ পান করবে না। কেননা, কোন জিন তার মুখে অঙ্গুলি রেখেছে। কোরায়শরা বিস্ময় সহকারে মজলিস ত্যাগ করল। আপন আপন গৃহে পৌঁছে তারা গৃহের লোকজনকেও একথা বলল। তারা বললঃ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র সন্তান হয়েছে। তারা তাঁর নাম রেখেছে মোহাম্মদ। অতঃপর কোরায়শরা ইহুদীর কাছে পৌঁছে এ সংবাদ জানিয়ে দিল। সে বলল: আমাকে নিয়ে চল। আমি এই শিশুকে দেখতে চাই। সে মতে তারা ইহুদীকে হযরত আমেনার কাছে নিয়ে গেল এবং শিশুকে দেখাতে বলল। হযরত আমেনা দেখালেন। তারা তাঁর পিঠ খুলে সেখানে একটি তিলের ন্যায় চিহ্ন দেখতে পেল। এটা দেখে ইহুদী সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পর সংজ্ঞা ফিরে এলে কোরায়শরা জিজ্ঞাসা করল। তোমার কি হয়েছিল? সে বলল: বনী-ইসরাঈল থেকে নবুওয়ত খতম হয়ে গেছে। তোমাদের এতে আনশ্চিত হওয়া উচিত। আল্লাহর কসম, সে তোমাদের উপর এমন বিজয় অর্জন করবে যে, তার খবর পূর্ব-পশ্চিম তথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। বায়হাকী ও ইবনে আসাকির আবুল হাকাম তানুষী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কোরায়শদের মধ্যে কোন শিশু ভূমিষ্ঠ হলে তাকে হাঁড়ি দেয়ার জন্যে মহিলাদের হাতে সোপর্দ করা হত। তারা শিশুকে সকাল পর্যন্ত হাঁড়ির নিচে রাখত। সে মতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) ভূমিষ্ঠ হলে আবদুল মুত্তালিব তাঁকে মহিলাদের কাছে সোপর্দ করলেন। সকালে এসে তারা দেখল যে, হাঁড়ি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে এবং রসুলুল্লাহ (সাঃ) উভয় চক্ষু মেলে আকাশ পানে তাকিয়ে আছেন। মহিলারা আবদুল মুত্তালিবের কাছে এসে বলল: আমরা এমন শিশু কখনও দেখিনি। তার উপরে হাঁড়ি ভেঙ্গে গেছে এবং আমরা তাঁকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। আবদুল মুত্তালিব বললেন: তাকে হেফাযত কর। আমি মঙ্গলই আশা করি। সপ্তম দিনে আবদুল মুত্তালিব জন্তু যবেহ করলেন এবং কোরায়শদেরকে দাওয়াত করলেন। আহার শেষে সকলেই জিজ্ঞাসা করল: আবদুল মুত্তালিব। শিশুর কি নাম রেখেছেন? তিনি বললেন: নাম রেখেছি মোহাম্মদ। তারা বলল: পারিবারিক নাম না রাখার কারণ কি? আবদুল মুত্তালিব বললেনঃ আমি চাই যে, আকাশে আল্লাহতায়ালা এবং পৃথিবীতে মানবজাতি তার প্রশংসা করুক। আবূ নয়ীম ও ইবনে আসাকির মুসাইয়িব ইবনে শরীফ থেকে, তিনি মোহাম্মদ ইবনে শরীফ থেকে, তিনি আমর ইবনে শরীফ থেকে, তিনি আপন পিতা থেকে, তিনি আপন দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, মাররুয-যাহরানে দিহা নামক এক সিরীয় সন্ন্যাসী বাস করত। সে ছিল বিজ্ঞ আলেম। অধিকাংশ সময় গির্জার ভিতরেই অবস্থান করতো। মাঝে মাঝে মক্কায় এলে মানুষ তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেত। তখন সে বলতঃ তোমাদের মধ্যে এক শিশু জন্মগ্রহণ করবে। তার সামনে সমগ্র আরব মাথা নত করবে এবং সে অনারবেরও মালিক হয়ে যাবে। এটাই তাঁর আগমনের সময়। যে তাঁর সময় পাবে এবং তাঁর অনুসরণ করবে, সে সফলকাম হবে। আর যে তাঁর বিরোধিতা করবে, সে ব্যর্থ মনোরথ হবে। আল্লাহর কসম, আমি রুটি ও শরাবের দেশ এবং শান্তির জায়গা ছেড়ে এই অভাব-অনটন ও ভয়ভীতির স্থানে তাঁরই অন্বেষণে এসেছি। সউক্ত সন্ন্যাসী মক্কার প্রতিটি নবজাত শিশু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করত এবং বলত : এখনও আসেনি। রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মের সকালে আবদুল মুত্তালিব ‘ঈছা’ সন্ন্যাসীর দ্বারে দাঁড়িয়ে তাকে ডাক দিলেন। সে প্রশ্ন করল কে? উত্তর হল: আমি আবদুল মুত্তালিব। সন্ন্যাসী তাঁর কাছে এসে বলল: সম্ভবতঃ তুমিই তার বাপ। আজ সেই শিশু জন্মগ্রহণ করেছে, যার সম্পর্কে আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, সে সোমবারে জন্মগ্রহণ করবে, নবুওত প্রাপ্ত হবে এবং সোমবারে ওফাত পাবে। তার নক্ষত্র গত সন্ধ্যায় উদিত হয়ে গেছে। এর চিহ্ন এই যে, এখন তার ব্যথা আছে। এই ব্যথা তিনদিন থাকবে। তুমি মুখ বন্ধ রাখবে। কেননা, এতটুকু হিংসা কারও
পৃষ্ঠা:০৮
সাথে করা হয়নি, যা তাঁর সাথে করা হবে এবং এতটুকু শত্রুতা কারও সাথে করা হয়নি, যা তাঁর সাথে করা হবে। আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞাসা করলেন: সে কতটুকু বয়স পাবে? সন্ন্যাসী বলল: কম হোক কিংবা বেশি। তবে সত্তর বছর হবে না; বরং এর কম কোন বেজোড় সংখ্যায় হবে-একষট্টি কিংবা তেষট্টি। তার উম্মতের লোকদেরও এরূপ বয়ঃক্রম হবে। আবু নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জাহেলিয়াত যুগে রাতের বেলায় কোন শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে হাঁড়ির নীচে রেখে দেয়া হত এবং সকাল পর্যন্ত কেউ তাকে দেখতো না। জন্মের পর নবী করীম (সাঃ) কেও হাঁড়ির নীচে রেখে দেয়া হয়। সকালে দেখা গেল, হাঁড়ি দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে আছে এবং তাঁর চক্ষু আকাশের দিকে উত্থিত। এতে সকলেই আশ্চর্যান্বিত হল। এরপর তাঁকে দুধ পান করানোর জন্য বন্-বকরের এক মহিলার হাতে সোপর্দ করা হল। সে তাঁকে দুধ পান করালে তার সংসারে চতুর্দিক থেকে কল্যাণ ও বরকত আসতে লাগল। তাঁর কাছে গুটিকতক ছাগল ছিল। আল্লাহ তাতে বরকত দিলেন এবং ছাগলের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। আবু নয়ীম দাউদ ইবনে আবী হিন্দ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করলে নবুওয়তের নুরে টিলাসমূহ উজ্জ্বল হয়ে যায়, তিনি হাত দিয়ে মাটিতে ভর দেন এবং চক্ষুদ্বয় উন্মুক্ত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যখন তাকে বড় হাঁড়ি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় তখন হাঁড়ি দু’টুকরা হয়ে যায়। ইবনে সা’দ হযরত ইকরিমা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করলে তাঁর জননী তাঁর উপর হাঁড়ি রেখে দেন, যা ভেঙ্গে যায়। তিনি বলেন: আমি যখন তাঁকে দেখলাম, তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় উন্মুক্ত ছিল এবং তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ইবনে আবী হাতেম ইকরিমা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, পবিত্র জন্মের সময় ভূপৃষ্ঠ নূরে উজ্জ্বল হয়ে যায়। ইবলীস বললঃ আজ এমন এক শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে যে আমাদের কাজকারবার পণ্ড করে দিবে। ইবলীসের এক সহচর বললঃ তুমি যাও এবং তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি নষ্ট করে দাও। সেমতে ইবলীস এল কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে পৌঁছল, তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাকে সজোরে লাথি মারলেন। ফলে সে আদনে যেয়ে পতিত হল। যুবায়র ইবনে বাক্কার ও ইবনে আসাকির মারুফ ইবনে খরবৃস থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবলীস সপ্ত আকাশ প্রদক্ষিণ করত। কিন্তু যখন হযরত ঈসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করলেন, তখন তিন আকাশেও প্রবেশাধিকার রহিত হয়ে গেল। এরপর যখন নবী করীম (সাঃ) জন্মগ্রহণ করলেন, তখনও তাঁর জন্যে সাত আকাশের দরজাই বন্ধ করে দেয়া হল। নবী করীম (সাঃ) সোমবার দিন প্রত্যুষে জন্মগ্রহণ করেন। বায়হাকী, আবু নয়ীম, খারায়েতী ও ইবনে আসাকির আবু ইয়ালা ইবনে এমরান বাজালী থেকে, তিনি মখযুম ইবনে সানী থেকে এবং তিনি নিজের পিতা থেকে (যার বয়ঃক্রম ছিল দেড়শ’ বছর) রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর জন্মের রাত্রিতে পারস্য রাজের প্রাসাদে ভূকম্পন হয়। ফলে চৌদ্দটি গম্বুজ ভূমিসাৎ হয়ে যায়। পারস্যের মহা অগ্নিকুণ্ড নির্বাপিত হয়ে যায়, যা এক হাজার বছর ধরে অনির্বাণ ছিল। সাদা হ্রদ শুকিয়ে যায়। ভোর বেলায় পারস্য রাজ আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, এ বিষয়টি উযীরদের কাছে গোপন রাখা ঠিক হবে না। সে মতে তিনি মুকুট পরিধান করে সিংহাসনে বসলেন। সকলকে একত্রিত করে পরিস্থিতি বর্ণনা করলেন। এমনি মুহূর্তে সংবাদ এল যে, অগ্নিকুণ্ড নির্বাপিত হয়ে গেছে। সম্রাট খুবই দুঃখিত হলেন। প্রধান পুরোহিত বললঃ ঈশ্বর সম্রাটকে সালামত রাখুন। আমিও আজ রাতে স্বপ্ন দেখেছি যে, শক্ত উট আরবী ঘোড়াকে টেনে আনছে এবং দজলা পার হয়ে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্রাট জিজ্ঞাসা করলেন: পুরোহিত, এবার কি হবে? সে বললঃ আরবের দিক থেকে কোন বিরাট ঘটনা সংঘঠিত হবে এরপর সম্রাট নো’মান ইবনে মুনধিরকে লিখলেন: কোন বিজ্ঞ ব্যক্তিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি তাকে কিছু প্রশ্ন করব। নো’মান আবদুল মসীহ ইবনে আমর ইবনে হাসসান গাসসানীকে দরবারে পাঠিয়ে দিল। সম্রাট তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি কি জান, আমি তোমাকে কি জিজ্ঞেস করতে চাই? সে বললঃ বাদশাহ সালামত বলুন। সঠিক জওয়াব জানা থাকলে আমি বলে দিব। নতুবা যে জানে, তাঁর ঠিকানা বলে দিব। সম্রাট তাকে সবকিছু খুলে বললেন। আবদুল মসীহ বললঃ আমার মামা সাতীহ্ এ বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞাত আছেন। তিনি সিরিয়ার প্রান্ত দেশে বাস করেন। সম্রাট বললেন: তাকে নিয়ে এস। আমি তাকেই জিজ্ঞাসা করব। আবদুল মসীহ রওয়ানা হয়ে সাতীহের কাছে পৌঁছল। সে তখন মরনোন্মুখ। আবদুল মসীহ্ সালাম করলে সে মাথা তুলল এবং বললঃ আবদুল মসীহ একটি দ্রুতগামী উটে সওয়ার হয়ে সাতীহের কাছে এসেছে, যার মৃত্যু আসন্ন। তোমাকে সাসানীদের সম্রাট প্রেরণ করেছে। কেননা, রাজপ্রাসাদে ভূকম্পন হয়েছে। পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নির্বাপিত হয়ে গেছে। প্রধান পুরোহিত স্বপ্ন দেখেছে যে, শক্ত উট আরবী ঘোড়াসমূহকে টেনে নিচ্ছে এবং দজলা পার হয়ে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। হে আবদুল মসীহ, যখন তেলাওয়াত বেশি হতে থাকে, লাঠি বাহক আত্মপ্রকাশ করে, সামাদাহ্ উপত্যকা পানিতে টগবগ করতে থাকে, সাদা,হ্রদ শুকিয়ে যায় এবং পারস্যের অগ্নিকুণ্ড শীতল হয়ে যায়, তখন
পৃষ্ঠা:০৯
সাতীহের জন্যে সিরিয়া নয়। ব্যস গম্বুজের সম সংখ্যক সম্রাট হবে এবং যা হবার হয়ে যাবে। একথা বলে সাতীহ্ মারা গেল। আবদুল মসীহ ফিরে এসে সম্রাটকে সমস্ত ঘটনা বলল। শুনে সম্রাট বললেনঃ যতদিনে আমাদের চৌদ্দজন সম্রাট হবে, ততদিনে কতকিছু হবে কে জানে। কিন্তু চৌদ্দজনের মধ্যে দশজন সম্রাট তো চার বছরের মধ্যেই অতিক্রান্ত হয়ে গেল। অবশিষ্ট চারজন হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। ইবনে আসাকির বলেনঃ এ হাদীসটি গরীব শ্রেণীভুক্ত। এটা কেবল মখযুম তাঁর পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। আবু আইউব বাজালী এতে একক। ইবনে আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে সাতীহের আলোচনায় একথাই বলেছেন। আবদুল মসীহের আলোচনায় উপরোক্ত সনদে রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করার পর তিনি বলেনঃ এটি মারুফ ইবনে খরবৃষ বিশর ইবনে তায়ম মন্ত্রী থেকেও রেওয়ায়েত করেছেন। আমি বলি, এই সনদে আবদানও কিতাবুছ-ছাহাবায় রেওয়ায়েত করেছেন। ইবনে হজর “আল এছাহাবা” গ্রন্থে একে মুরসাল বলেছেন। খারায়েতী ও ইবনে আসাকির ওরওয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, ওয়ারাকা ইবনে নওফেল, যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল, ওবায়দুল্লাহ ইবনে জাহশ, ওছমান ইবনে হুওয়ায়রিছ প্রমুখ কোরায়শ নেতা এক রাতে এক প্রতিমার কাছে সমবেত হন। তাঁরা দেখলেন যে, প্রতিমাটি উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তাঁরা একে খারাপ মনে করে সোজা করে দিলেন। কিছুক্ষণ পর সেটি আবার সজোরে পড়ে গেল। তাঁরা আবার সোজা করে দিলেন। কিন্তু তৃতীয়বার আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ওছমান ইবনে হুওয়ায়রিছ বললেন: অবশ্যই কিছু একটা ঘটেছে। এটা ছিল নবী করীম (সাঃ)-এর জন্মের রাত্রি। এ স্থলে ওছমান এই কবিতা আবৃতি করেছিলেন: : হে মূর্তি, তোঁর কাছে দূরদূরান্ত থেকে আগত আরব-সরদারগণ রয়েছেন। আর তুই উল্টে পড়ে আছিস। ব্যাপার কি বল। তুই কি খেলা করছিস? আমাদের দ্বারা কোন গোনাহ হয়ে থাকলে আমরা স্বীকার করি এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকি। আর যদি তুই লাঞ্ছিত ও পরাভূত হয়ে মাথা নত করে থাকিস, তবে তুই প্রতিমাদের সরদার ও প্রভু নস।” এরপর তাঁরা প্রতিমাটি পুণরায় খাড়া করে দিলেন। এরপর সেটির ভিতর থেকে আওয়াজ এলঃ এ প্রতিমা ধ্বংস হয়ে গেছে সে শিশুর কারণে, যার নূরে সমগ্র বিশ্ব আলোকময় হয়ে গেছে। তাঁর আগমনে সকল প্রতিমাই ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। রাজ-রাজড়াদের অন্তর তাঁর ভয়ে কেঁপে উঠেছে। পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে গেছে। ফলে পারস্য সম্রাট খুবই মর্মাহত হয়েছেন। অতিন্দ্রীয়বাদীদের কাছ থেকে তাদের জিনেরা উধাও হয়ে গেছ। এখন তাদেরকে কেউ সত্য-মিথ্যা খবর পৌঁছাবে না। হে বনু-কুছাই, পথভ্রষ্টতা পরিত্যাগ কর এবং প্রকৃত সত্যের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নাও। খারায়েতী হেশাম ইবনে ওরওয়া থেকে, তিনি নিজের পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদী আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল ও ওয়ারাকা ইবনে নওফেল বলেছেন আমরা মক্কা থেকে আবরাহার প্রত্যাবর্তন করার পর আবিসনিয়া সম্রাট নাজ্জাশীর কাছে গেলাম। তিনি বললেনঃ হে কোরায়শগণ সত্য বল, তোমাদের মধ্যে এমন কোন শিশু জন্মগ্রহণ করেছে কি, যার বাপ তাকে বলী দান করার ইচ্ছা করেছিল? এরপর লটারীর মাধ্যমে আরও অনেক উট যবেহ করে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল? আমরা বললাম, হাঁ, এরূপ শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল। নাজ্জাশী জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা জান কি যে, সে পরে কি করেছে? আমরা বললামঃ সে আমেনা নাম্নী এক মহিলাকে বিবাহ করেছে এবং তাকে গর্ভবতী রেখে ইন্তেকাল করেছে। সম্রাট আবার প্রশ্ন করলেনঃ তোমরা কি জান, গর্ভের এই শিশু জন্মগ্রহণ করেছে কি না? জবাবে ওয়ারাকা বললেন: আমি এক রাতে এক প্রতিমার কাছে ছিলাম। আমি সেটির ভিতর থেকে এই আওয়াজ শুনেছিঃ নবী পয়দা হয়ে গেছেন। সম্রাটেরা লাঞ্ছিত হয়েছে। গোমরাহী দূর হয়ে গেছে এবং শিরক মিটে গেছে। এরপর প্রতিমাটি উপুড় হয়ে পড়ে গেল। যায়দ বললেনঃ হে বাদশাহ। আমার কাছেও এমনি ধরনের খবর আছে। আমি সেই পবিত্র রাতে স্বপ্নযোগে আবু কুবায়স পাহাড়ে পৌঁছে এক ব্যক্তিকে আকাশ থেকে অবতরণ করতে দেখলাম তার দু’টি সবুজ পাখা ছিল। সে কিছু সময় আবু কুবায়স পাহাড়ে অবস্থান করে মক্কায় এসে বললঃ শয়তান লাঞ্ছিত হয়েছে। মূর্তিপূজা খতম হয়ে গেছে। “আমীন” জন্মগ্রহণ করেছেন। এরপর সে একটি কাপড় খুলে পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে দিল। আমি দেখলাম, কাপড়টি সমগ্র আকাশের নীচে তাঁবুর মত হয়ে গেল। এরপর একটি নূর উদিত হল, যার চাকচিক্যে আমার চক্ষু ঝলসে গেল। এসব দেখে আমি ভীত হয়ে গেলাম। এ গায়েবী আওয়াজকারী আপন পাখা নাড়া দিল এবং কা’বার উপর পতিত হল। এরপর একটি নূর উদিত হলে মক্কার ভূখণ্ড উদ্ভাসিত হয়ে গেল। সে বললঃ ভূপৃষ্ঠ পবিত্র হয়ে গেছে এবং সে তার সজীবতা উদ্গীরণ করেছে। এরপর সে কা’বা গৃহে রক্ষিত প্রতিমাদের প্রতি ইশারা করলে সেগুলো ভূমিসাৎ হয়ে গেল।” নাজ্জাশী বললেনঃ এখন আমার কথা শুন। আমি সে রাতেই আমার শয্যায় নিদ্রিত ছিলাম। স্বপ্নে দেখি হঠাৎ মাটি ভেদ করে একটি গ্রীবা ও মাথা বের হল। সে বললঃ হস্তীবাহিনী ধ্বংস হয়ে গেছে। আবাবীল পাখী তাদেরকে কংকর নিক্ষেপ করে
পৃষ্ঠা:১০
নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। পাপী-অপরাধীদের আশ্রমও খতম হয়ে গেছে। নবী মক্কী, জন্মগ্রহণ করেছেন। এখন যে তাঁর কথা মানবে, সে সফলকাম হবে। আর যে অবাধ্য হবে… এতটুকু বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি চীৎকার করতে চাইলাম; কিন্তু আমার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হল না। আমি পালাতে চাইলাম; কিন্তু দাঁড়াতে পারলাম না। এরপর আমার গৃহের লোকজন আমার কাছে এসে গেল। আমি তাদেরকে বললামঃ হাবশী লোকদেরকে আমার সম্মুখ থেকে সরিয়ে দাও। তাঁর! তাই করল।
নবী করীম (সাঃ) খতনা অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন
তিবরানী, আবূ নয়ীম, খতীব ও ইবনে আসাকির হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন- আমার পরওয়ারদেগার আমাকে এক সম্মান এই দান করেছেন যে, আমি খতনা অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছি। কেউ আমার গুপ্ত অঙ্গ দেখেনি। ইবনে সা’দ ইউনুস ইবনে আতা থেকে, তিনি হাকাম ইবনে আবান থেকে, তিনি ইকরিমা থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) নালকাটা ও খতনা অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। আবদুল মোত্তালেবের কাছে বিষয়টি অভিনব মনে হয়। ফলে তাঁর দৃষ্টিতে নবী করীম (সাঃ)-এর মর্যাদা বেড়ে যায়। তিনি বললেনঃ আমার এই বৎসের বিরাট শান হবে। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। এই রেওয়ায়েতটি বায়হাকী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকিরও বর্ণনা করেছেন। ইবনে আদী ও ইবনে আসাকির আতা থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) নালকাটা ও খতনাকৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন। ইবনে আসাকির হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) খতনাকৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন। হাকেম মুস্তাদরাক গ্রন্থে বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খতনা সংক্রান্ত রেওয়ায়েতগুলো মুতাওয়াতিরেক্স পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ইবনে দুরায়দের ‘আলওয়াশাহ্’ গ্রন্থে আছে, ইবনুল কলবী কা’বে আহবারের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, আমরা আমাদের কিতাবে পাই যে, হযরত আদম (আঃ) ও অন্য বারজন নবী খতনাকৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) হচ্ছেন সর্বশেষ নবী। মাঝখানে রয়েছেন হযরত শীস, ইদরীস, নূহ, লুত, ইউসুফ, মূসা, সোলায়মান, শোয়ায়ব, ইয়াহইয়া, হুদ এবং ছালেহ (আঃ) তিবরানী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির আবু বকরাহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জিবরাঈল (আঃ) যখন নবী করীম (সাঃ)-এর কলব পাক করেন, তখন তাঁর খতনাও করেন।
দোলনায় চাঁদের সাথে কথাবার্তা
বায়হাকী, ছাবুনী, খতীব ও ইবনে আসাকির হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার নবুয়তের এ আলামত দেখে ঈমান এনেছি যে, আপনি চাঁদের সাথে বাক্যালাপ করছিলেন এবং তার দিকে আঙ্গুলে ইশারা করছিলেন। আপনি যেদিকে ইশারা করতেন, চাঁদ সেদিকেই হেলে যেত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ আমি চাঁদের সাথে কথা বলছিলাম এবং চাঁদ আমার সাথে কথা বলছিল। সে আমাকে ক্রন্দনে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। চন্দ্র যখন আল্লাহর আরশের নীচে সেজদা করে, তখন আমি তার তস্বীহ শুনতে পাই। বায়হাকী বলেনঃ এ হাদীসটি কেবল আহমদ ইবনে ইবরাহীম জেলী রেওয়ায়েত করেছেন, যিনি একজন মজহুল (অজ্ঞাত) রাবী। ছাবুনী বলেন : এ হাদীসের সনদ দুর্বল হলেও হাদীসের বাণী মোজেযা অধ্যায়ে হাসান (গ্রহণযোগ্য)।
দোলনায় কথাবার্তা
হাকেম আবুল ফযল ইবনে হজর ‘সায়রুল ওয়াকেদী’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সাঃ) ভূমিষ্ঠ হয়েই কথা বলেন। ইবনে সবা’ ‘আল-খাছায়েছ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ফেরেশতারা তাঁর দোলনা নাড়াচ্ছিল এবং তিনি প্রথমে যে বাক্য বলেন, তা ছিল এই الله اكبر كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيرًا . মআল্লাহ মহান। তাঁর জন্যে অনেক অনেক প্রশংসা।
দুগ্ধপানকালে প্রকাশিত মোজেযা
ইবনে ইসহাক, ইবনে রাহওয়াইহি, আবু ইয়ালা, তিবরানী, বায়হাকী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির আব্দুল্লাহ ইবনে জা’ফর ইবনে আবু তালেব থেকে হযরত হালীমা বিনতে হারেছের উক্তি বর্ণনা করেন যে, হালীমা বলেন, আমি দুর্ভিক্ষের বছর সা’দ ইবনে বকরের কয়েকজন মহিলার সাথে মক্কা পৌঁছলাম। আমি আমার গাধায় সওয়ার হয়ে এলাম। আমার সাথে আমার স্বামী ও একটি শিশু ছিল। আর ছিল একটি বৃদ্ধা উস্ত্রী, সেটি এক ফোটা দুধও দিত না। শিশুকে সঙ্গে নিয়ে সে রাতে আমার বিন্দুমাত্রও ঘুম হল না। কেন না, আমার বুকে দুধ ছিল না, উস্ত্রীও দুধ দিচ্ছিল না। মক্কা পৌছার পর আমার সঙ্গীয় সকল মহিলাকেই মক্কার সেই মহান শিশুটিকে
পৃষ্ঠা ১১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা:১১
গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়া হল। কিন্তু তিনি এতীম শিশু- একথা শুনে কেউ তাঁকে গ্রহণ করতে সম্মত হল না। আমি ছাড়া সকল মহিলাই দুধপান করানোয় জন্যে কোন না কোন শিশু পেয়ে গেল। আমার জন্যে রাসূলে করীম (সাঃ) ছাড়া গ্রহণ করার মতো কোন শিশু ছিল না। এমতাবস্থায় আমি আমার স্বামীকে বললাম, কোন শিশু ছাড়াই খালি হাতে ফিরে যাওয়া আমি পছন্দ করি না। আমি এ এতীম শিশুকেই নিয়ে নেই। স্বামীর সম্মতি পেয়ে আমি তাঁকেই নিয়ে নিলাম। তাঁকে কোলে নিয়ে তাঁবু পর্যন্ত পৌঁছার পূর্বেই আমার বুক দুধে পূর্ণ হয়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর দুধভাই খুব তৃপ্ত হয়ে দুধপান করলেন। এরপর আমার স্বামী আমাদের বুড়ো উষ্ট্রীর ওলান দুধে পরিপূর্ণ দেখতে পেলেন। উষ্ট্রীর দুধ দোহন করে তিনি নিজেও পান করলেন, আমিও পান করলাম। আমরা সকলেই তৃপ্ত হয়ে সুনিদ্রার মধ্যে রাত্রি অতিবাহিত করলাম। আমার স্বামী আনন্দে গদ গদ হয়ে বললেন, হালীমা, তুমি খুবই বরকতময় একটি শিশু গ্রহণ করেছ। দেখ, আজিকার রাত্রি কেমন চমৎকারভাবে অতিবাহিত হয়েছে। মোটকথা, আমরা দেশে ফিরে এলাম। ফেরার পথে আমার গাধী এত দ্রুত হটিছিল যে, কাফেলার কোন গাধা তার মোকাবিলা করতে পারছিল না। আমার সঙ্গিনীরা বলল, হালীমা, এটা কি সেই গাধী, যাতে সওয়ার হয়ে তুমি আমাদের সাথে এসেছিলে? আমি বললাম, হাঁ, সেই গাধীই। তারা বলল, এখন তো এর চমৎকার রং ঢং দেখা যাচ্ছে। এভাবে আমরা বনু সা’দের জনপদে ফিরে এলাম। এর চেয়ে অধিক শুষ্ক কোন জনপদ ছিল না। কিন্তু আমার ছাগলগুলো সেখান থেকে সন্ধ্যায় পেট ভরে ও দুধে পরিপূর্ণ হয়ে ফিরে আসত। মোটকথা, আমরা এবং আমাদের গবাদিপশু মহাসুখে কালাতিপাত করছিলাম। অন্যদের ছাগল এক ফোঁটা’ দুধ দিত না এবং সন্ধ্যায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরে আসত। সকলেই আপন আপন রাখালকে বলত, তোমরা সেই জায়গায় ছাগল চরাও, যেখানে হালীমার ছাগল চরে। ওরা আমার ছাগলের সাথে চরিয়েও যখন সন্ধ্যায় ছাগলপাল ফিরিয়ে আনত তখন সকল ছাগল ক্ষুধার্ত থাকত। তাদের দুধ থাকত না। অথচ আমার ছাগল তৃপ্ত ও দুধে পরিপূর্ণ থাকত। আল্লাহ তায়ালা এমনিভাবে আমাদেরকে বরকত দেখাতে থাকেন। অবশেষে নবী করীম (সাঃ) দু’বছরের হয়ে গেলেন। তিনি এত দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠছিলেন, যা সাধারণতঃ শিশুরা বেড়ে উঠে না। দু’বছর বয়সেই তিনি যথেষ্ট বড় হয়ে গেলেন এবং খাওয়া দাওয়া শুরু করলেন। অতঃপর আমরা তাঁকে তাঁর জননীর কাছে নিয়ে এলাম। তাঁর অনেক বরকত দেখে আমরা তাঁকে নিজেদের কাছে রাখতে আগ্রহী ছিলাম। তাই আমরা তাঁর জননীকে বললাম, আপনি এ শিশুকে আরও এক বছরের জন্যে আমাদের কাছে দিয়ে দেন। আমরা তাঁর মক্কার অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করি। এরপর আমরা খুব পীড়াপীড়ি করলাম। অবশেষে তিনি হাঁ বলে দিলেন। নবী করীম (সাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে দু’তিন মাস অতিবাহিত হলে একদিন তিনি আমাদের বাড়ির পিছনে গবাদিপশু বাঁধার জায়গায় তাঁর দুধভাইয়ের সাথে খেলাধুলা করতে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর দুধ ভাই ফিরে এসে বলল, আমার কোরায়শী ভাইয়ের কাছে সাদা পোষাকধারী দু’ব্যক্তি এসে তাকে শুইয়ে দিল এবং পেট চিরে ফেলল। একথা শুনে আমি এবং তাঁর দুধ পিতা দৌড়ে সেখানে গেলাম। আমরা দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন; কিন্তু মুখমন্ডল বিবর্ণ। তাঁর দুধ পিতা তাঁকে গলায় জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রিয় বৎস! তোমার কি হয়েছে? তিনি বললেন, আমার কাছে দু’জন সাদা পোষাকধারী আগমন করে। তাঁরা আমাকে শুইয়ে দেয় এবং আমার পেট বিদীর্ণ করে সেখান থেকে কিছু বের করে ফেলে দেয়। এরপর পেট যেমন ছিল, তেমনি করে দেয়। তাঁর দুধ পিতা বললেন, আমার আশংকা হয় যে, আমার এই বাছার উপর কোন কিছুর আছর তো হয়ে যায়নি! কাজেই কোন অপ্রিয় ঘটনা ঘটার আগেই আমাদের উচিত তাঁকে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া। সেমতে আমরা তাঁকে নিয়ে তাঁর মাতার কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ব্যাপার কি, তোমরা না তার জন্যে অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষী ছিলে? আমরা বললাম, আমরা তাঁর প্রাণ নাশের অথবা কোন বড় দুর্ঘটনার আশংকা করি। তিনি বললেন, না, এটা হতে পারে না। সত্য কথা বল কি হয়েছে? তাঁর পীড়াপীড়িতে আনরা সমস্ত ঘটনা শুনিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, তোমরা কি তাঁর উপর শয়তানের ভয় করছ? আল্লাহর কসম, শয়তান তাঁর বিরুদ্ধে কোন পথ পেতে পারে না। আমার এই বাছাধনের শানই ভিন্ন। আমি তোমাদেরকে তাঁর একটি ঘটনা শুনাব কি? আমরা বললাম, অবশ্যই শুনান। তিনি বললেন, তাকে পেটে নিয়ে আমি সব সময় নিজকে অত্যন্ত হালকা পেয়েছি। গর্ভাবস্থায় আমি স্বপ্নে দেখেছি, একটি নূরের উদয় হয়েছে। ফলে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ উজ্জ্বল হয়ে গেছে। এরপর তিনি ভূমিষ্ঠ হলেন, তবে এভাবে নয়, যেভাবে শিশুরা ভূমিষ্ঠ হয়। তাঁর হাত মাটিতে ঠেকানো ছিল এবং তিনি আকাশের দিকে মাথা উত্তোলন করে রেখেছিলেন। যাক, তোমরা তাঁকে ছেড়ে যাও। মবায়হাকী ও ইবনে আসাকির মোহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া গোলাবী থেকে, তিনি ইয়াকুব ইবনে জা’ফর ইবনে সোলায়মান থেকে, তিনি আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত হালীমা (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দুধ ছাড়ানো হলে তিনি বললেনঃاللَّهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيرًا وَسُبْحَانَ اللهِ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
পৃষ্ঠা:১২
আল্লাহ অনেক মহান। আল্লাহর অনেক অনেক প্রশংসা। আমি সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করি। যখন তিনি কিছুটা বড় হলেন, তখন অন্য শিশুদেরকে খেলা করতে দেখে নিজে তা থেকে বেঁচে থাকতেন। একদিন আমাকে বললেন, আম্মাজান, আমার ভাইকে দিনের বেলায় দেখি না কেন? আমি বললাম, আমার জীবন তোমার জন্যে উৎসর্গ, আপনার ভাই ছাগল চরাতে চলে যায়। সে সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে। তিনি বললেন কাল থেকে আমাকেও তাঁর সাথে পাঠিয়ে দিবেন। পরদিন থেকে তিনি খুশী খুশী যেতেন এবং খুশী খুশী ফিরে আসতেন। এমনি এক দিনে সকলে বাইরে চলে গেলে দুপুরের সময় আমার এক পুত্র সামুরাহ ভীত-আতংকিত অবস্থায় দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ী এল। তার কপাল ঘর্মাক্ত ছিল। সে কেঁদে কেঁদে বলল, আব্বা, আব্বা, জলদি আমার ভাই মোহাম্মদের কাছে যাও। তাঁর কাছে পৌঁছে তাঁকে মৃত পাবে। আমরা জিজ্ঞেসা করলাম, কি হয়েছে? সে বলল, আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, এমন সময় এক ব্যক্তি এসে মোহাম্মদকে আমাদের মধ্য থেকে ছো মেরে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেল। সেখানে তাঁর বক্ষ বিদারণ করল। এরপর কি হল, তা আমার জানা নেই। একথা শুনে আমি এবং আমার স্বামী দৌড়ে গেলাম। আমরা দেখলাম তিনি পাহাড়ের চূড়ায় বসে আকাশের দিকে দেখছেন এবং মুচকি হাসছেন। আমি তাঁর উপর ঝুঁকে পড়লাম এবং কপাল চুম্বন করে বললাম, আমার জীবন তোমার জন্যে উৎসর্গ। তোমার কি হয়েছে? তিনি বললেন, আম্মাজান, সব ঠিক আছে। আমি দাড়িয়েছিলাম, এমন সময় তিন ব্যক্তি আমার কাছে এল। তাদের একজনের হাতে রুপার একটি পাত্র ছিল। দ্বিতীয় জনের হাতে সবুজ পান্নার প্লেট ছিল, যা বরফে পরিপূর্ণ ছিল। তাঁরা আমাকে ধরে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে আস্তে শুইয়ে দিল। এরপর তাদের একজন নাভি থেকে আমার পেট বিদীর্ণ করল। আমি দেখতে থাকলাম; কিন্তু কিছু অনুভব করতে পারলাম না এবং কোন কষ্টও হয়নি। এরপর সে আপন হাত আমার পেটে ঢুকিয়ে নাড়ীভূড়ি বের করে নিল। এরপর সেগুলো বরফ দিয়ে উত্তমরূপে ধৌত করে পুনঃস্থাপন করল। অতঃপর দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তিকে বলল, সরে এস। আল্লাহ তোমাকে যে আদেশ করেছেন, তা পূর্ণ কর। সেমতে সে আমার কাছে এল এবং আমার পেটে হাত ঢুকিয়ে হৃদপিন্ড বের করে নিল। সেটি বিদীর্ণ করে তার মধ্য থেকে একটি কাল রক্তভর্তি বিন্দু বের করে দূরে নিক্ষেপ করল। সে বলল, হে আল্লাহর হাবীব, এটা শয়তানের অংশ ছিল। এরপর নিজের কাছ থেকে একটি বস্তু দিয়ে সেটি ভরে দিল। অতঃপর তার উপর একটি নূরোজ্জ্বল মোহার এঁটে দিল, যার শীতলতা আমি এখনও শিরায় শিরায় অনুভব করছি। এরপর তৃতীয় ব্যক্তি দণ্ডায়মান হল এবং বলল, তোমরা উভয়ে সরে যাও। তোমরা আল্লাহর আদেশ পূর্ণ করেছ। এরপর সে আমার কাছে এল এবং আমার বুকের ফাটলে নাভি পর্যন্ত হাত বুলিয়ে বলল, তাঁকে তাঁর উম্মতের দশ ব্যক্তির মোকাবিলায় ওজন কর। তাঁরা আমাকে ওজন করলে আমি ভারী হলাম। সে বলল, ছাড়, যদি তোমরা তাঁকে সমগ্র উম্মতের মোকাবিলায় ওজন কর, তবুও তিনি ভারী হবেন। অতঃপর সে আমার হাত ধরে আস্তে দাঁড় করাল। সকলেই আমার উপর ঝুঁকে পড়ল এবং আমার মাথা ও কপাল চুম্বন করল। অতঃপর বলল, হে হাবীবে খোদা। আপনি ভয় করবেন না। যদি আপনি জানতে পারেন যে, আপনার আল্লাহ আপনার কতটুকু মঙ্গল চান, তবে আপনার চক্ষুদ্বয় শীতল হয়ে যাবে। এরপর তাঁরা আমাকে তেমনি উপবিষ্ট রেখে আকাশের দিকে উড়ে গেল। হযরত হালীমা বলেন, আমি শিশু রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিয়ে বনূ সা’দের বস্তীতে এলাম। লোকেরা বলতে লাগল, তাঁকে নিয়ে অতীন্দ্রিয়বাদীর কাছে যাও। সে দেখেশুনে তাঁর চিকিৎসা করবে। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমার কিছু হয়নি। আমার শরীর-মন সুস্থ ও সঠিক রয়েছে। কিন্তু লোকেরা আমাকে বলতেই থাকল যে, তাঁর উপর কোন কিছুর আছর হয়ে গেছে। অবশেষে তাঁরা আমার মতের উপর প্রবল হয়ে গেল এবং আমি তাঁকে জনৈক অতীন্দ্রিয়বাদীর কাছে নিয়ে গেলাম। আমি তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললে সে বলল, তুমি থাম। আমি খোদ বালকের কাছ থেকে শুনে নিচ্ছি। কেন না, সে নিজের ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত। অতঃপর সে শিশু মহানবীকে (সাঃ) লক্ষ্য করে বলল: হে বালক, বলতো তোমার ঘটনা কি? রসূলুল্লাহ (সাঃ) আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা শুনালেন, যা শুনে অতীন্দ্রিয়বাদী একদম লাফিয়ে উঠল এবং ডাকতে আরম্ভ করল, হে আরববাসীগণ। এক মহা অনিষ্ট সন্নিকটে। এ বালক এবং আমাকে এক সাথে হত্যা কর। যদি তোমরা তাকে ছেড়ে দাও এবং সে বড় হয়, তবে বড়দের জ্ঞানবুদ্ধিকে ভ্রষ্ট করে দিবে। তোমাদের ধর্মকে মিথ্যা বলবে। তোমাদেরকে এক অচেনা প্রতিপালকের দিকে আহবান করবে এবং এমন এক ধর্মের দিকে দাওয়াত দিবে, যার সাথে তোমরা পরিচিত নও।” হালীমা বলেন, এসব কথা শুনে আমি তাঁর হাত থেকে নবী করীম (সাঃ)-কে টেনে নিলাম এবং তাকে বললাম তুই-ই উন্মাদ ও বদ্ধ পাগল। যদি আগে জানতাম তুই এমন কথা বলবি, তবে তোর কাছে আমি আমার এই বরকতময় শিশুকে নিয়ে আসতাম না। নিজেকে হত্যা করার জন্যে তুই নিজেই কাউকে ডেকে নে। আমি মোহাম্মদকে হত্যা করব না। এরপর আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিয়ে গৃহে এলাম। পথিমধ্যে বনু সা’দের যে গৃহের কাছ দিয়েই তিনি গমন করতেন, তাঁর তরফ
পৃষ্ঠা:১৩
থেকে মেশকের সুগন্ধি আসত। প্রত্যহ তাঁর কাছে দুজন সাদা ব্যক্তি আসত এবং তাঁর কাপড়ের মধ্যে গা ঢাকা দিত, এরপর আর আত্মপ্রকাশ করত না। লোকেরা বলত, হালীমা, তাঁকে তাঁর দাদার হাতে ফিরিয়ে দাও। সেমতে আমি তাঁকে ফিরিয়ে দিতে দৃঢ় সংকল্প হলাম। এরপর আমি এ আওয়াজ শুনলাম- হে মক্কার কংকরময় ভূমি। তোমাকে মোরারকবাদ। আজিকার দিনে তুমি তোমার নূর, তোমার ধর্ম, তোমার দ্যুতি ও তোমার পূর্ণতা ফিরে পাচ্ছ। তুমি শান্তিময় হয়ে যাও। তুমি কখনও লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে না।’ হযরত হালীমা বলেন, আমি আবদুল মোত্তালিবকে সবকিছু খুলে বললে তিনি বললেন, হালীমা, আমার এ বাছার বিরাট শান হবে। আমি তাঁর সময়কাল পাওয়ার বাসনা রাখি। বায়হাকী যুহরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) আপন পিতামহ আবদুল মোত্তালিবের লালন-পালনে ছিলেন। তিনি তাঁর জন্যে বনু সা’দের এক মহিলাকে দুধ পান করানোর জন্যে মোতায়েন করেন। সে মহিলা তাঁকে নিয়ে ওকাযের বাজারে পৌছলে জনৈক অতীন্দ্রিয়বাদী তাঁকে দেখে বলতে লাগল, হে ওকাযবাসীগণ। এ বালককে হত্যা কর। কেন না, সে বাদশাহ হবে। একথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দুধ মা তাঁকে ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন। এভাবে আল্লাহ তাঁকে রক্ষ করলেন। এরপর রসূলে করীম (সাঃ) ধাত্রীমাতার কাছেই লালিত পালিত ও বড় হন। যখন হাঁটতে শুরু করেন, তখন তাঁর দুধ ভগিনী তাঁকে কোলে নিয়ে বাইরে যেতো। একদিন সেই ভগিনী এসে বলতে লাগল, আম্মাজান, আমি দেখলাম কিছু লোক এসে আমাদের কোরায়শী ভাইকে ধরে তাঁর পেট বিদীর্ণ করে দিল। একথা শুনে দুধ মা দৌড়ে সেখানে গেলেন এবং তাঁকে উপস্থিত দেখতে পেলেন। কিন্তু তাঁর মুখমন্ডল বিবর্ণ ছিল। দুধ মা তাঁকে নিয়ে তাঁর জননী আমেনার কাছে যেয়ে বললেন, আপনার শিশুকে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিন। আমি তাঁর প্রাণ নাশের আশংকা করি। আমেনা বললেন, আল্লাহর কসম, আমার পুত্র সম্পর্কে তোমার আশংকা অমূলক। আমি তো তাঁকে জন্মের সময় দেখেছি যে, তাঁর উভয় হাত মাটিতে ঠেকানো ছিল এবং মস্তক আকাশের দিকে উত্থিত ছিল। এরপর রসূলুল্লাহর (সাঃ) জননী ও পিতামহ তাঁর দুধ ছাড়িয়ে দেন। এরপর তাঁর জননীর ইন্তেকাল হয়ে গেল। তিনি এতীম হয়ে দাদার লালন-পালনে এসে গেলেন। শিশু অবস্থায় তিনি দাদার তাকিয়া এনে তার উপর বসে যেতেন। দাদা বেশ বার্ধক্য বস্থায় উপনীত ছিলেন। একটি বালিকা তাঁকে ধরে তাকিয়ার কাছে নিয়ে আসত। বালিকা নবী করীম (সাঃ)-কে বলত, হে বালক, তোমার দাদার বালিশ থেকে সরে যাও। এতে আবদুল মোত্তালিব বলতেন, আমার বাছাকে তাকিয়া উপরই থাকতে দাও। সে আপাদমস্তক কল্যাণ। এরপর তাঁর দাদাও ওফাত পেয়ে গেলেন এবং তিনি চাচা আবু তালেবের লালন-পালনে এসে গেলেন। যখন তিনি বেশ বড় হয়ে গেলেন, তখন আবু তালেব তাঁকে শামদেশে বাণিজ্য সফরে নিয়ে গেলেন। তায়মা পৌঁছার পর এক ইহুদী আলেম তাঁকে দেখে আবু তালেবকে বলল, এ বালক আপনার কি হয়? আবু তালেব বললেন, আমার ভাতিজা। আলেম বললেন, আপনি কি ওকে ভালবাসেন? আবু তালেব “হাঁ” বললে সে বলল, আল্লাহর কসম, আপনি তাঁকে শামদেশে নিয়ে গেলে ইহুদীরা তাকে হত্যা করবে। কেন না ওরা তাঁর দুশমন। একথা শুনে আবু তালেব রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মক্কায় ফিরিয়ে আনলেন। আবু ইয়ালা, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির শাদ্দাদ ইবনে আউস থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, বনী-আমেরের এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নবুয়তের স্বরূপ কি? তিনি বললেন, আমার নবুয়তের সূচনা এই যে, আমি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দোয়া, ভাই ঈসা (আঃ)-এর সুসংবাদ এবং মা আমেনার প্রথম সন্তান। যখন আমি মাতার গর্ভে স্থিত হই, তখন তিনি তেমনি বোঝা অনুভব করেন, যেমন মহিলারা অনুভব করে। এরপর আমার মাতা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর পেটে নূর আছে। আমার মাতা বলেন, আমি এ নূরের পিছনে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতাম, আর নূর সম্মুখে অগ্রসর হয়ে যেত। অবশেষে এ নূরে পূর্ব ও পশ্চিম আলোকোজ্জ্বল হয়ে গেল। এরপর আমি যখন জন্যগ্রহণ করলাম ও বড় হলাম, তখন কোরায়শদের প্রতিমা ও কাব্যের প্রতি আমার অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি হল। যখন আমি বনী-লায়ছ ইবনে বকরে দুধ পান করতাম, তখন একদিন আমি সঙ্গীদের সাথে গৃহের লোকজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক উপত্যকায় পৌছে গেলাম। আমার কাছে তিন ব্যক্তি এল। তাদের মধ্যে একজনের কাছে বরফভর্তি স্বর্ণের প্লেট ছিল। সে আমাকে সঙ্গীদের মধ্য থেকে ধরে নিল। সঙ্গীরা সকলেই গোত্রের দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আগন্তুকদের একজন আমাকে ধরে আস্তে মাটিতে শুইয়ে দিল। অতঃপর নাভি থেকে বুক পর্যন্ত চিরে দিল। আমি সব কিছু দেখছিলাম; কিন্তু কোন অনুভূতি ছিল না। এরপর সে আমার পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করল এবং সেগুলো বরফ দিয়ে উত্তমরূপে ধৌত করল। অতঃপর সেগুলো পুনরায় যথাস্থানে স্থাপন করল। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তি এগিয়ে এল এবং সঙ্গীকে বলল, সরে যাও। সে তার হাত আমার পেটে ঢুকিয়ে আমার হৃদপিন্ড বের করল। এটি চিরে তার মধ্য থেকে একটি কাল মাংসপিন্ড বের করে ফেলে দিল। অতঃপর হাতের সাহায্যে ডানে বামে কিছু তালাশ করল। আমি দেখলাম তাঁর হাতে নূরের একটি চাকচিক্যময় আংটি রয়েছে। সে সেটি দিয়ে আমার হৃদপিন্ডে মোহর এঁটে দিল। এটা ছিল নবুয়তের নূর ও প্রজ্ঞা। এরপর আমার হৃদপিন্ডটি, যথাস্থানে স্থাপন করল। আমি দীর্ঘকাল পর্যন্ত এ মোহরের শীতলতা অন্তরে অনুভব করেছি।
পৃষ্ঠা:১৪
অনুভব করেছেন এবং পরে সমগ্র সময়ে বোঝা অনুভূত হয়নি। এভাবে উভয় অবস্থায় সাধারণ অভ্যাসের বিপরীত হবে।এরপর তৃতীয় ব্যক্তি তাঁর সঙ্গীকে বলল, সরে যাও। সে আমার বুকের উপর নাভি পর্যন্ত হাত বুলাল। ফলে আল্লাহর হুকুমে কাটা অংশটি সংযুক্ত হয়ে গেল। অতঃপর সে আমার হাত ধরে আস্তে দাঁড় করাল এবং প্রথম ব্যক্তিকে বলল, তাঁকে তাঁর উম্মতের দশ ব্যক্তির মোকাবিলায় ওজন কর। সে ওজন করলে আমি ভারী হলাম। অতঃপর সে বলল, তাঁকে তাঁর উম্মতের একশ জনের মোকাবিলায় ওজন কর। সে তাই করল। এখানেও আমি ভারী হয়ে গেলাম। অগত্যা সে বলল, ছাড়। যদি তোমরা তাঁকে তাঁর সমগ্র উম্মতের মোকাবিলায় ওজন কর, তাহলেও সে ভারী হবে। এরপর তাঁরা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল এবং আমার মাথা ও কপাল চুম্বন করে বলল, হে আল্লাহর হাবীব, আপনি ভয় করবেন না। কেন না, আপনার জন্যে যে কল্যাণের ইচ্ছা করা হয়েছে, তা জানতে পারলে আপনার চক্ষু শীতল হয়ে যাবে। এরপর গোত্রের লোকজন আগমন করলে আমি তাদেরকে সমুদয় বৃত্তান্ত বললাম। কিছু লোকে বলল, এ বালকের উপর আছর হয়েছে। তাকে আমাদের অতীন্দ্রিয়বাদীর কাছে নিয়ে চল। সে দেখে শুনে চিকিৎসা করবে। আমি বললাম, তোমাদের ধারণা সঠিক নয়। আমার কিছুই হয়নি। আমার প্রাণ সুস্থ এবং অন্তর সব ঠিক আছে। আমার দুধ পিতা বললেন, তোমরা দেখতেই পাচ্ছ যে, সে ঠিক ঠিক কথাবার্তা বলছে। আমার মনে হয় আমার বাছাধনের কিছুই হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সকলেই আমাকে অতীন্দ্রিয়বাদীর কাছে নিয়ে গেল এবং আমার ঘটনা শুনাল। সে বলল, তোমরা চুপ থাক। আমি বালকের মুখ থেকেই শুনতে চাই। সে নিজের অবস্থা সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। আমি তাকে সমস্ত ঘটনা বললাম। আমার কথা শুনে সে আমাকে নিজের বুকে চেপে ধরল এবং উচ্চৈঃস্বরে ডাকতে শুরু করল, হে আরববাসীগণ। হে আরববাসীগণ। এ বালককে হত্যা কর এবং আমাকেও হত্যা কর। লাত ও ওযযার কসম, তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে সে বড় হয়ে তোমাদের ধর্ম বদলে দিবে। তোমাদের ও তোমাদের বাপদাদার জ্ঞানবুদ্ধি ভ্রষ্ট করে দিবে। তোমাদের প্রতিটি কথার বিরোধিতা করবে এবং এমন এক ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করবে, যার কথা তোমরা আজ পর্যন্ত শুননি। আমি আমার দুধ মার দিকে ঝুঁকে পড়লাম। তিনি আমাকে তাঁর কোল থেকে বের করে আনলেন এবং তাকে বললেন, তুই একটা বন্ধ পাগল ও নির্বোধ। তুই এরূপ বলবে, তা আগে জানলে কখনও তোর কাছে এ শিশুকে নিয়ে আসতাম না। নিজের হত্যাকারীকে নিজেই ডেকে নে। আমি এই শিশুকে নিহত হতে দিব না। এরপর লোকেরা আমাকে গৃহের লোকজনের কাছে নিয়ে এল। আবু নয়ীম বলেন, এ হাদীসে আছে যে, আমেনা গর্ভাবস্থায় বোঝা অনুভব করেছেন। অন্যান্য হাদীসে আছে যে, তিনি বোঝা অনুভব করেননি। উভয় প্রকার হাদীসের মধ্যে সমন্বয় এভাবে হতে পারে যে, গর্ভের প্রাথমিক পর্যায়ে বোঝা আবু নয়ীম হযরত বুরায়দাহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে আকরাম (সাঃ) বনু সাদ ইবনে বকরে দুধপান করেছেন। তাঁর জননী তাঁর দুধ মাকে বললেন, আমার বাছাধনের প্রতি খেয়াল রাখবে। তাঁর জন্মের সময় আমি দেখেছি যে, আমার শরীর থেকে একটি স্ফুলিঙ্গ উদিত হয়েছে, যার ফলে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ উজ্জ্বল হয়ে গেছে। এ আলোকে আমি সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ দেখতে পেয়েছি। একদিন তাঁর দুধ মা এক অতিন্দ্রীয়বাদীর কাছ দিয়ে গমন করছিলেন। মানুষ তাকে নানাবিধ প্রশ্ন করছিল। হালীমাও কৌতূহল বশতঃ শিশু মুহম্মদকে (সাঃ) নিয়ে সেখানে গেলেন। অতিন্দ্রীয়বাদী তাঁকে দেখে জড়িয়ে ধরল এবং বলল, লোক সকল। একে হত্যা কর, একে হত্যা কর। দুধ মা বলেন, একথা শুনে আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ধরে ফেললাম। ইতিমধ্যে আমাদের গোত্রের লোকজনও এসে গেল। তারা তাঁকে অতীন্দ্রিয়বাদীর কবল থেকে উদ্ধার করল। ইবনে সা’দ, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির ইয়াহইয়া ইবনে এয়াযিদ সা’দী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, বনী-সা’দ ইবনে বকরের দশ জন মহিলা দুগ্ধপোষ্য শিশু গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় আসে। হালীমা ছাড়া সকলেই শিশু পেয়ে যায়। হালীমার জন্যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে পেশ করা হলে তিনি বললেন, এতীম শিশু, তেমন অর্থ-সম্পদও নেই। তাঁর জননী কি-ই বা দিতে পারবেন। কিন্তু হালীমার স্বামী বলল, নিয়ে নাও। সম্ভবতঃ আল্লাহ তায়ালা তাঁর মধ্যে আমাদের জন্যে কল্যাণ রেখেছেন। সেমতে তাঁরা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে গ্রহণ করলেন। তাঁকে বুকে শোয়ানোর সাথে সাথে হালীমার স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ দুধ তিনি এবং তাঁর দুধভাই মিলে পান করলেন। অথচ ইতিপূর্বে তাঁর দুধভাই ক্ষুধার জ্বালায় ঘুমাতে পারত না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মাতা হালীমাকে বললেন, হে দুগ্ধদাত্রী, এ শিশু সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞাসা করে নিয়ো। তাঁর অবশ্যই আলাদা শান হবে। এরপর তাঁর সম্পর্কে তিনি যা যা দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন, সব হালীমাকে শুনালেন। তিনি আরও বললেন, আমাকে এ পর্যন্ত বলা হয়েছে যে, এ শিশুটিকে বনী সা’দ ইবনে বকর এবং এরপর আবু সয়ায়বের লোকজনের মধ্যে দুধপান করাবে। হযরত হালীমা বলেন, আমার স্বামীই আবু সুয়ায়ব। অতঃপর হালীমা আপন গাধীর পিঠে এবং তাঁর স্বামী বৃদ্ধা উন্ত্রীর পিঠে সওয়ার হয়ে গেলেন। তাঁরা সরর উপত্যকায় সঙ্গিনীদের অগ্রে চলে গেলেন। তাদের সওয়ারী মাথা উঁচু করে দ্রুতগতিতে পথ অতিক্রম করছিল। সঙ্গিনীরা বলল, হে হালীমা, তুমি কি করলে? হালীমা বললেন, আমি এক কল্যাণকর ও বরকতময় শিশু গ্রহণ করেছি। এরপর অতিশীঘ্রই মহিলারা আমার প্রতি হিংসা করতে লাগল।
পৃষ্ঠা:১৫
আবু নয়ীম ওয়াহেদী থেকে, তাঁর থেকে আবদুছ ছামাদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে সাদী, তাঁর থেকে তাঁর পিতা, পিতা থেকে দাদা বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, হযরত হালীমার রাখালরা বর্ণনা করেছে যে, হালীমার ছাগলগুলো মাঠে ঘাস খাওয়ার সময় মাথা পর্যন্ত তুলত না। সবুজতা তাদের মুখে এবং বিষ্ঠায়ও দৃষ্টিগোচর হত। অথচ অন্য সব ছাগল বসে থাকত। তারা তৃনখন্ড পর্যন্ত খেতে পেত না এবং সন্ধ্যায় সকালের চেয়ে বেশী ক্ষুধার্ত থাকত। নবী করীম (সাঃ) হযরত হালীমার কাছে প্রথম দফায় দু’বছর অবস্থান করেন। এরপর তাঁর দুধ ছাড়িয়ে দেয়া হয়। যখন তিনি চার বছরের হলেন, তখন হালীমা তাঁকে মাতার কাছে নিয়ে এলেন। তাঁর বরকত ও কল্যাণ দেখে তাঁকে পুনরায় নিয়ে যাওয়ার বাসনা প্রকাশ করলেন। ফেরার পথে সা’দ উপত্যকায় পৌঁছলে আবিসিনিয়ার কিছু লোক তাদের সাথে মিলিত হয়। তাঁরা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে গভীর দৃষ্টিতে দেখল। তাঁর কাঁধে নবুয়তের মোহর এবং চোখের লালিমা দেখে তারা হযরত হালীমাকে জিজ্ঞাসা করল, শিশুটির চোখে কোন রোগ আছে কি? হালীমা বললেন, চোখের এ লালিমা কোন রোগের কারণে নয়; বরং এটা স্থায়ীভাবেই আছে। তারা বলল, আল্লাহর কসম, ইনি নবী হবেন। যুলমাজাসে নামক স্থানে এক ব্যক্তি বাস করত, সে মুখের ভাব দেখে স্বভাব বলে দিত। মানুষ তার কাছে শিশুদেরকে দেখানোর জন্যে নিয়ে যেত। হযরত হালীমাও একদিন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিয়ে গেলে সে তাঁর চোখের লালিমা ও নবুয়তের মোহর দেখে চিৎকার করে বলল, হে আরববাসীগণ, এ শিশুকে হত্যা কর। সে তোমাদের ধর্মকে হত্যা করবে। তোমাদের প্রতিমা ভেঙ্গে দিবে। তোমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। হালীমা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সেখান থেকে নিয়ে এলেন এবং আর কখনও কাউকে দেখাননি। ইবনে সা’দ ও হাসান ইবনে তাররাহ্ যায়দ ইবনে আসলাম থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত হালীমা যখন নবী করীম (সাঃ)-কে গ্রহণ করেন, তখন মাতা আমেনা তাকে বলেন, তুমি একজন বড় মর্যাদাবান শিশু গ্রহণ করেছ। সে যখন আমার গর্ভে ছিল, তখন আমার এমন কোন কষ্ট হয়নি, যা এ সময় মহিলাদের হয়ে থাকে। এরপর ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় এলে আমাকে বলা হয় যে, তুমি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করবে। তাঁর নাম রাখবে আহমদ। সে সারা জাহানের সরদার হবে। এরপর যখন তিনি জন্মগ্রহণ করলেন, তখন তাঁর হাত মাটিতে ঠেকানো ছিল এবং মাথা আকাশের দিকে উত্থিত ছিল। অতঃপর হালীমা স্বামীর কাছে যেয়ে সকল কথা শুনালেন। তিনি এসব কথা শুনে আনন্দিত হলেন। এরপর হালীমা নিজের গাধীর পিঠে সওয়ার হয়ে এবং তাঁর স্বামী দুধে পরিপূর্ণ উস্ত্রীতে সওয়ার হয়ে রওয়ানা হলেন। স্বামী সকাল-বিকাল উষ্ট্রীর দুধ দোহন করতেন। হালীমা বলেন, ইতিপূর্বে আমি আমার শিশুকে দুধ পান করাতে পারতাম না। সে ক্ষুধার কারণে আমাদেরকে নিদ্রা যেতে দিত না। কিন্তু এখন এ শিশু ও তার দুধ ভাই উভয়েই তৃপ্ত হয়ে দুধপান করত এবং ঘুমিয়ে পড়ত। যদি তৃতীয় আর একটি শিশুও থাকত, তবে সে-ও তৃপ্ত হয়ে দুধপান করতে পারত। হযরত হালীমা নবী করীম (সাঃ)-কে নিয়ে হুযায়ল গোত্রের স্বভাব বর্ণনাকারীর কাছে পৌঁছলেন। সে তাঁকে দেখেই চীৎকার করে বলতে লাগল, হে আরব জাতি, এই শিশুকে হত্যা কর। সে তোমাদের ধর্মাবলম্বী লোকদেরকে হত্যা করবে। তোমাদের মূর্তি ভেঙ্গে দিবে। তোমাদের উপর বিজয়ী হবে। একথা শুনে হযরত হালীমা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলেন। ইবনে সাদ ও ইবনে তাররাহ ঈসা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মালেক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, এ বৃদ্ধ স্বভাব বর্ণনাকারী হুযায়ল গোত্র ও তাদের প্রতিমাদেরকে ডেকে বলল, এ শিশু আকাশ থেকে কোন নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। এ কথা বলে সে মানুষকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যাপারে উস্কানি দিতে লাগল। কিন্তু কিছু দিন পরেই সে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ল এবং উন্মন্মাদ হয়ে কাফের অবস্থায় মারা গেল। ইবনে সা’দ ও ইবনে তাররাহ ইসহাক ইবনে আবদুল্লাহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন হযরত আমেনা নবী করীম (সাঃ)-কে দুধপান করানোর জন্যে হালীমা সা’দিয়ার হাতে সোপর্দ করলেন, তখন বললেন, আমার এ শিশুর খুব হেফাযত করবে। এরপর তিনি যা যা দেখেছিলেন, সব হালীমাকে বললেন। কিছুদিন পরে হালীমার কাছে কয়েকজন ইহুদী আগমন করলে তিনি পরীক্ষার ছলে তাদেরকে বললেন, আমার এ পুত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে বল। সে এভাবে গর্ভে অবস্থান করেছে এবং এভাবে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। আমি এই এই দেখেছি। মোটকথা আমেনা যা যা বলেছিলেন, সবই তাদেরকে শুনালেন। সব কথা শুনে ইহুদীরা একে অপরকে বলল, এ শিশুকে হত্যা কর। এরপর তারা হালীমাকে প্রশ্ন করল, সে কি এতীম? হালীমা বললেন, না। এ ইনি হচ্ছেন তার পিতা এবং আমি তার মাতা। ইহুদীরা বলল, সে এতীম হলে আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করতাম। ইবনে সা’দ, আবু নয়ীম, ইবনে আসাকির ও ইবনে তাররাহ আতা ইবনে আবী রাবাহ থেকে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)- থেকে বর্ণনা করেন যে, হালীমা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কোথাও দূরে যেতে দিতেন না। একদিন তাঁর অসাবধানতার সুযোগে রসূলুল্লাহ (সাঃ) আপন ভগিনী শায়মার সাথে দ্বিপ্রহরে গবাদি পশুর দিকে চলে গেলেন। হালীমা তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে পৌঁছে শায়মার সাথে দেখতে পেলেন। তিনি শায়মাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ প্রখর রোদ্রের মধ্যে তাকে। নিয়ে এলে কেন। শায়মা বলল, আম্মাজান, আমার ভাইয়ের শরীরে মোটেই রৌদ্র
পৃষ্ঠা:১৬
লাগেনি। একটি মেঘখন্ড সর্বক্ষণ তাকে ছায়া প্রদান করেছে। তিনি থেমে গেলে মেঘখণ্ডও থেমে যেত। তিনি চললে সে-ও চলতে থাকত। এভাবেই আমরা এখানে পৌঁছে গেছি। হালীমা বললেন, একথা ঠিক? শায়মা বলল, হাঁ, আল্লাহর কসম। ইবনে সা’দ যুহরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হাওয়াযেন গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে আগমন করে। তাদের মধ্যে নবী করীম (সাঃ)-এর দুধ চাচা আবু ছরওয়ানও ছিলেন। তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ। আমি আপনাকে দুগ্ধপান করার সময় দেখেছি। কিন্তু আপনার চেয়ে বেশী কাউকে কল্যাণময় পাইনি। এরপর আপনাকে দুধ ছাড়ার সময় দেখেছি। তখনও আপনার চেয়ে কল্যাণময় কাউকে পাইনি। এরপর আপনাকে নব যুবক দেখেছি। এখনও আপনার চেয়ে কল্যাণকারী কাউকে দেখি না।”ইবনে তাররাহ বর্ণনা করেন- আমি আবূ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মুয়াল্লা ইযদীর গ্রন্থে হযরত হালীমার (রাঃ) এই কবিতা দেখেছি। তিনি এ’কবিতা আবৃত্তি করে নবী করীম (সাঃ)-কে ঘুম পাড়াতেন- : হে রব, তুমি যখন দিয়েছ, তখন তাঁকে অব্যাহত রাখ। তাঁকে উচ্চতার চরম শিখরে নিয়ে যাও এবং উন্নতি দান কর। তাঁর সত্তার মাধ্যমে শত্রুদের সকল মিথ্যাচার নস্যাৎ করে দাও। ইবনে সাবা’ খাছায়েছ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, হযরত হালীমা বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ)-কে ডান স্তন দিলে তিনি দুধ পান করতেন; কিন্তু বাম স্তন দিলে পান করতেন না। এটা ছিল তাঁর ইনছাফ। কেন না, তিনি জানতেন যে, তাঁর একজন দুধ শরীক ভাই আছে।
মোহরে নবুয়ত সম্পর্কে রেওয়ায়েত
বুখারী ও মুসলিম সায়েব ইবনে ইয়াযিদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ)-এর পশ্চাতে দাঁড়ালাম এবং তাঁর কাঁধের মাঝখানে চকোরের ডিম্বের ন্যায় ‘মোহরে-নবুয়ত’ দেখলাম। মুসলিম ও বায়হাকী জাবের ইবনে সামুরাহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন, আমি উভয় কাঁধের মাঝখানে কবুতরের ডিম্বের ন্যায় ‘মোহরে-নবুয়ত’ দেখেছি। তিরমিযীর বর্ণিত ভাষা এরূপ কবুতরের ডিমের ন্যায় লাল ফোঁড়ার মত। মুসলিম রেওয়ায়েত করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে জারজিস বর্ণনা করেছেন- আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উভয় কাঁধের মাঝখানে ‘মোহরে-নবুয়ত’ দেখেছি, যা বাম কাঁধের কিনারে এমন ছিল, যেমন অনেকগুলো তিল একত্রিত হয়ে গেছে। আহমদ, ও বায়হাকী রেওয়ায়েত করেন যে, কুররাহ বর্ণনা করেছেন আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, আমাকে মোহরে নবুয়ত দেখান। তিনি বললেন, হাত ভিতরে ঢুকাও। আমি হাত ঢুকিয়ে দেখলাম ‘মোহরে-নবুয়ত’ কাঁধের উচ্চতায় ডিমের মত ছিল। আহমদ, ইবনে সা’দ ও বায়হাকী আবু রমছা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি তাঁর পিতাঁর সাথে নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে যান। তিনি বলেন, আমি ‘মোহরে-নবুয়ত’ উভয় কাঁধের মাঝখানে একটি ফোঁড়ার ন্যায় দেখেছি। ইবনে সা’দের এক রেওয়ায়েতে ছোট্ট আপেলের মত এবং আহমদের এক রেওয়ায়েতে ‘কবুতরের ডিমের মত’ আছে। বুখারী তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে এবং বায়হাকী রেওয়ায়েত করেন যে, আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন, উভয় কাঁধের মাঝখানে মোহরে-নবুয়ত একটি স্ফীত মাংসখণ্ডের মত ছিল। তিরমিযীর রেওয়ায়েতে আছে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ‘মোহরে-নবুয়ত’ তাঁর পৃষ্ঠদেশে একটি স্ফীত মাংসের মত ছিল। আহমদের রেওয়ায়েতে আছে উভয় কাঁধের মাঝখানে স্ফীত মাংস ছিল। বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হযরত সালমান ফারেসী (রাঃ) বলেন, আমি রসূলে করীম (সাঃ)-এর নিকটে গেলে তিনি গায়ের চাদর সরিয়ে বললেন, দেখ যে আদেশে আমি আদিষ্ট হয়েছি। সেমতে আমি তাঁর উভয় কাঁধের মাঝখানে কবুতরের ডিমের ন্যায় মোহরে নবুয়ত দেখলাম। আহমদ ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হিরাক্লিয়াসের দূত তানূখী বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে গেলে তিনি বললেন, হে তানুখী, দেখ আমি কিসের জন্যে আদিষ্ট হয়েছি। আমি ঘুরে তাঁর পৃষ্ঠদেশে মোহরে নবুয়ত দেখলাম, যা কাঁধের হাড্ডির উপর একটা ক্ষতস্থানের মত ছিল। ইবনে হেশাম বলেন, ক্ষতস্থান বলে সেই চিহ্ন বুঝানো হয়েছে, যা পরে মাংসের উপর ফুলে ওঠে। তিরমিযী ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একটি বৈশিষ্ট্য এ ছিল যে, তাঁর স্কন্ধদেশের মাঝখানে মোহরে-নবুয়ত অঙ্কিত ছিল। তিরমিযীর রেওয়ায়েতে হযরত আবু মূসা (রাঃ)- বলেন, মোহরে-নবুয়ত কাঁধের হাডিডর নীচে একটা ছোট আপেলের মত ছিল। আহমদ, তিরমিযী, হাকেম, আবূ ইয়ালা ও তিবরানী আলবা ইবনে আহমার থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু যায়দ বলেছেন রসূলুল্লাহ (সাঃ)- আমাকে বললেন, কাছে এসে আমার পিঠে হাত বুলাও। আমি নিকটবর্তী হয়ে তাঁর পিঠে হাত বুলালাম এবং অঙ্গুলি মোহরে নবুয়তের উপর রেখে দিলাম।
পৃষ্ঠা:১৭
তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, মোহরে নবুয়ত কেমন ছিল?তিনি বললেন, কাঁধের মধ্যস্থলে কিছু কেশ একত্রিত ছিল। বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হযরত সালমান (রাঃ) বর্ণনা করেন ডান কাঁধের হাডিডর কাছে মোহরে-নবুয়ত ডিমের মত ছিল। এর রঙ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দেহের অনুরূপ ছিল।ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, নবী করীম (সাঃ) নিজের সওয়ারীর উপর আমাকে পশ্চাতে বসিয়ে নিলেন। আমি আমার মুখমন্ডল মোহরে-নবুয়তের উপর ঝুঁকিয়ে নিলাম। সেখান থেকে আমি মেশকের মত সুবাস পেতে থাকলাম।তিবরানী ও ইবনে- আসাকিরের রেওয়ায়েতে আবু যায়দ ইবনে আখতার বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিঠে মোহরে-নবুয়ত ক্ষতস্থানের স্ফীত চিহ্নের মত দেখেছি। এক রেওয়ায়েতে আছে যেমন কেউ নখ দিয়ে চিহ্ন লাগিয়ে দিয়েছে।ইবনে আসাকির ও হাকেমের রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, মোহরে-নবুয়ত রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিঠে গোলাকৃতি গোশতের মত ছিল। এতে গোশত দিয়ে “মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহ” লিখিত ছিল।আবূ নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত সালমান (রাঃ) বলেন, মোহরে নবুয়ত রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঝুঁটির মাঝখানে কবুতরের ডিমের মত ছিল। এর ভিতরেরاللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَمُحَمَّدٌ رَّسُولُ الله বাইরের দিকে লেখা ছিল, توجهُ حَيْثُ شِئْتَ فَيَإِنَّكَ الْمَنْصُورয দিকেইচ্ছা মুখ করুন। কারণ, আপনি সাহায্যপ্রাপ্ত।তিবরানী ও আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে ওব্বাদ ইবনে আমর বর্ণনা করেন,- মোহরে-নবুয়ত রসূলে করীম (সাঃ)-এর বাম কাঁধের কোণে ছাগলের হাঁটুর মত ছিল। এটা দেখা তাঁর কাছে অপ্রিয় ছিল।ইবনে আবী খায়ছামা তাঁর রচিত ইতিহাস গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর এ উক্তি বর্ণনা করেছেন যে, মোহরে-নবুয়ত একটি কাল তিলের মত ছিল, যাতে হলদে রঙের প্রভাব ছিল এবং যার ছুতর্দিকে ঘোড়ার কেশরের মত স্কুল ছিল।আলেমগণ বলেন, ‘মোহরে নবুয়ত’ সম্পর্কে বর্ণনাকারীগণের ভাষায় বিভিন্নতা রয়েছে। এর কারণ এই যে, যে রাবী যে তুলনা বর্ণনায় যেভাবে স্বাচ্ছন্দ অনুভব করেছেন, তিনি তাই বর্ণনা করেছেন। কেউ চকোরের ডিমের মত, কেউ কবুতরের ডিমের মত বলেছেন। কেউ বলেছেন আপেলের মত আবার কেউ গোশতের স্ফীত খড়ের মত বলেছেন। কেউ স্ফীত ক্ষতস্থান বলেছেন আবার কেউ ছাগলের হাঁটুর অনুরূপ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সবগুলোর অর্থ একই; অর্থাৎ স্ফীত মাংস। আর যে রাবী চুলের সমষ্টি বলেছেন, তা একারণে যে, মোহরে কুরতুবী বলেন, ছহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, মোহরে নবুয়ত বাম কাঁধের উপ্য স্ফীত ছিল এবং লাল ছিল। যখন হ্রাস পেত, তখন কবুতরের ডিমের মত এবং যখন বড় হত, তখন হাতের তালুর গর্তের মত হত। সোহায়লী বলেন, খাঁটি কথা এই যে, মোহরে-নবুয়ত রসূলে করীম (সাঃ)-এর বাম ঝুঁটির কিনারে ছিল। কেননা, তিনি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাযতে ছিলেন। এ স্থানটিই শয়তানের প্রবেশ পথ। আলেমগণের এ ব্যাপারে মতভেদ আছে যে, মোহরে নবুয়ত জন্মের সময়ও ছিল, না পরে সংযুক্ত হয়েছে। যাঁরা পরে সংযুক্ত হওয়ার কথা বলেন, তারা শাদ্দাদ ইবনে আওসের রেওয়ায়েতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, যা দুগ্ধপান অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। রেওয়ায়েত সমূহে আরও আছে যে, ওফাতের পর মোহরে নবুয়ত তুলে নেয়া হয়েছিল। ওফাতের বর্ণনায় একথা উল্লেখ করা হবে। মুস্তাদরাকে হাকেমের রেওয়ায়েতে ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহ বলেন, আল্লাহ তায়ালা অন্যান্য নবীগণের হাতে নবুয়তের আলামত সৃষ্টি করে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের নবী (সাঃ)-এর নবুয়তের আলামত তাঁর স্বদ্ধভয়ের মাঝখানে সৃষ্টি করেছেন।
চক্ষ সম্পর্কিত মোজেযা ও বৈশিষ্ট্য
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, مَا زَاغَ الْبَصَرَ وَمَا طَغَى হয়নি এবং দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। (সূরা নজম) ইবনে আদী, বায়হাকী ও ইবনে আসাকির হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা কি মনে কর যে, আমার মুখ এদিকে? আল্লাহর কসম, তোমাদের রুকু সেজদা আমার কাছে গোপন নয়। কেন না, আমি আমার পিঠের পশ্চাতেও দেখি। মুসলিম হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সা) বললেন, লোক সকল। আমি তোমাদের সম্মুখে আছি। আমার পূর্বে রুকু ও • সেজদায় যেয়ো না। কেন না, আমি তোমাদেরকে সম্মুখ থেকেও দেখি এবং পিছন থেকেও দেখি।
পৃষ্ঠা:১৮
আবদুর রাযযাক, হাকেম ও আবূ নয়ীম আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন আমি পিছনেও তেমনি দেখি, যেমন সম্মুখে দেখি। আবু নয়ীম হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, আমি তোমাদেরকে পিঠের পশ্চাৎ থেকেও দেখি। হুমায়দী স্বীয় মসনদে, ইবনে মুনযির স্বীয় তফসীর গ্রন্থে এবং বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, মুজাহিদ কোরআন পাকের নিম্নোক্ত আয়াতের তফসীরে বলেছেন যে, রসুলে করীম (সাঃ) নামাযের পিছনের সারিগুলো তেমনি দেখতেন, যেমন সম্মুখের সারি দেখতেন-الَّذِي بَرَاكَ حينَ تَقُومُ وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ . ওলামায়ে কেরাম বলেন, নবী করীম (সাঃ)-এর পশ্চাতে দেখা আসলে একটি অলৌকিক বাস্তব ঘটনা। এটাও সম্ভব যে, অলৌকিকভাবে এ দেখা চোখের মাধ্যমে হত। কোন বন্ধু সামনে আসা ছাড়াই তিনি দেখে ফেলতেন। কেননা, আহলে সুন্নত আলেমগণের বিশুদ্ধতম মত এই যে, দেখার জন্যে কোন বস্তুর সম্মুখে থাকা জরুরী নয়। এ নীতির অধীনেই আখেরাতে আল্লাহর দীদার হবে। কেউ বলেছেন, নবী করীম (সাঃ)-এর পশ্চাতেও একটি চক্ষু ছিল, যদ্দ্বারা তিনি দেখতেন। আরও বলা হয়েছে যে, তাঁর উভয় কাঁধের মাঝখানে সূচের ছিদ্রের মত দু’টি চক্ষু ছিল। তিনি এ চক্ষুদ্বয় দিয়ে দেখতেন এবং কাপড় ইত্যাদি এ’ দেখার মধ্যে অন্তরায় হত না। তবে এটা একটি বিচ্ছিন্ন অভিমত মাত্র।
পবিত্র মুখ ও থুথু সম্পর্কিত মোজেযা
আহমদ, ইবনে মাজা, বায়হাকী ও আবূ নয়ীম হযরত ওয়ায়েল ইবনে হজর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে পানির বালতি পেশ করা হল। তিনি বালতি থেকে পানি পান করলেন এবং অবশিষ্ট পানি কূপে চেলে দিলেন। (অথবা রাবী বলেছেন, তিনি কূপে কুলী করলেন) ফলে কূপ থেকে মেশকের মত সুগন্ধি বের হতে থাকে।আবু নয়ীম হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) আপন গৃহের কূপে থুথু ফেললেন। ফলে মদীনায় এর চেয়ে মিঠা পানির কোন কূপ আর ছিল না। বায়হাকী ও আবু নয়ীম রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাঁদী রোমিনা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) আশুরার দিনে নিজের এবং হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকে ডেকে তাদের মুখে থুথু দিতেন। এরপর তাদের জননীকে বলতেন। আজ রাত পর্যন্ত ওদেরকে দুধ পান করিয়ো না। কেননা, তার মুখের থুথু তাদের জন্যে যথেষ্ট হয়ে যেত। তিবরানী রেওয়ায়েত করেন যে, ওমায়রা বিনতে মাসউদ ও তাঁর ভগিনীগণ নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে বয়াত হওয়ার জন্যে গেলেন। তাঁরা ছিলেন পাঁচজন। তাঁরা দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গোশত আহার করছেন। তিনি তাদের জন্যে গোশত চিবিয়ে দিলেন, যা সকলেই অল্প অল্প করে খেলেন। এর প্রভাবে তাদের সকলের মুখ থেকে আমৃত্যু কোন দুর্গন্ধ বের হয়নি। তিবরানী আবু ওমামা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জনৈকা কটুভাষিণী মহিলা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে আগমন করল। তিনি তখন গোশত আহার করছিলেন। মহিলা বলল: আমাকে খাওয়াবেন না? তিনি আপন হাত থেকে দিতে চাইলে মহিলা বলল, মুখ থেকে দিন। সেমতে তিনি মুখ থেকে গোশত বের করে মহিলাকে দিলেন। মহিলা তা খেল। এরপর কখনও এ মহিলা সম্পর্কে কটুভাষা ও কুকথার অভিযোগ শোনা যায় নি।বায়হাকী ওমর ইবনে শিবাহ থেকে, তিনি আবু ওবায়দ নহভী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমের ইবনে কুরায়য তার পাঁচ বছর বয়স্ক পুত্র আবদুল্লাহকে নিয়ে রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এলেন। তিনি তার মুখে থুথু দিলেন। এরপর সে কোন পাথরকেও থধ্য দিলে নবী করীম (সাঃ)-এর বরকতে পানি বের হয়ে আসত। বায়হাকী মোহাম্মদ ইবনে ছাবেত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তার পিতা জমিলা বিনতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে যখন তালাক দিয়ে। দেন, তখন মোহাম্মদ তার পেটে ছিল। যখন মোহাম্মদ জন্মগ্রহণ করল, তখন জমিলা কসম খেল যে, সে এই শিশুকে দুধ পান করাবে না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) শিশুর পিতাকে বললেন: শিশুকে নিয়ে আমার কাছে এস। তিনি শিশুকে নিয়ে এলে তিনি তার মুখে থুথু দিলেন এবং বললেনঃ একে নিয়ে যাও। আল্লাহ এর রিযিকদাতা। মোহাম্মদের পিতা বলেন: আমি তিনদিন শিশুকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে ‘আনতে থাকলাম। এরপর এক মহিলা ছাবেত ইবনে কায়মের কথা জিজ্ঞেস করতে করতে এল। আমি বললাম: তুমি কি চাও? মহিলা বলল: আমি আজ স্বপ্নে দেখেছি যে, ছাবেত ইবনে কায়মের শিশুপুত্র মোহাম্মদকে দুধ পান করাচ্ছি। মোহাম্মদের পিতা বললঃ আমিই ছাবেত, আর সে হচ্ছে আমার পুত্র মোহাম্মদ। ইবনে আসাকির আবু জাফর থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, একবার যখন হযরত হাসান (রাঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন, তখন তার দারুণ পানি পিপাসা হয়। নবী করীম (সাঃ) তার জন্যে পানি আনতে বললেন। কিন্তু কোথাও পানি পাওয়া গেল না। অতঃপর তিনি হাসানের মুখে আপন জিহ্বা প্রবেশ করিয়ে দিলেন। হযরত হাসান তা চুষলেন এবং পরিতৃপ্ত হয়ে গেলেন।
পৃষ্ঠা:১৯
তিবরানী ও ইবনে আসাকির হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন। তিনি বলেন: একবার আমরা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সফরে বের হলাম। পথিমধ্যে হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-এর কান্নার আওয়াজ শুনা গেল। তাঁরা তাদের জননীর সঙ্গে ছিলেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) দ্রুত তাদের কাছে গেলেন এবং বললেন: আমার বাছাধনদের কি হয়েছে? হযরত ফাতেমা (রাঃ) বললেনঃ তাঁরা পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) পানি আনতে বললেন, কিন্তু এক ফোঁটা পানিও পাওয়া গেল না। তিনি হযরত ফাতেমা (রাঃ)-কে বললেনঃ তাদের একজনকে আমার কাছে দাও। তিনি পর্দার পিছনে একজনকে দিয়ে দিলেন। নবী করীম (সাঃ) তাঁকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তখনো শিশু চিৎকার করে যাচ্ছিল। এরপর হুযুর (সাঃ) আপন জিহ্বা শিশুর মুখে দিয়ে দিলেন। শিশু চুষতে চুষতে চুপ হয়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয় শিশু তেমনি কান্নাকাটি করছিল। তিনি তাঁকেও নিয়ে গেলেন এবং তাঁর সাথেও তাই করলেন। এভাবে তাঁরা চুপ হয়ে গেলেন এবং কান্নার আওয়াজ আর শোনা গেল না। দারেমী, তিরমিযী (শামায়েলে), বায়হাকী, তিবরানী (আওসাতে) ও ইবনে আসাকির রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনের দু’দাঁতের মাঝখানে ফাঁক ছিল। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন মনে হত যেন এ ফাঁক দিয়ে নূর বের হচ্ছে। তিবরানীর রেওয়ায়েতে আছে যে, আবু কুরছাফা বর্ণনা করেন, আমি আমার মা ও খালা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতে একই সময়ে বয়াত হয়েছি। ফেরার পথে আমার মা ও খালা বলতে লাগলেনঃ আমরা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মত সুশ্রী, সুবেশী ও নম্রভাষী কাউকে দেখিনি। আমরা তাঁর পবিত্র মুখ থেকে নূর বের হতে দেখেছি।
নুরোজ্জ্বল মুখমণ্ডল সম্পর্কিত মোজেযা
ইবনে আসাকির হযরত জাবের (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত কারেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমার কাছে জিবরাঈল (আঃ) এসে বললেন, আল্লাহ আপনাকে সালাম বলেছেন। আরো বলেছেন যে, হে আমার হাবীব, আমি ইউসুফকে আপন কুরসীর নূর দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছি। আর আপনার মুখমণ্ডলকে আমার আরশের নূর প্রদান করেছি। ইবনে আসাকির বলেনঃ এ রেওয়ায়েতের সনদে একজন রাবী অজ্ঞাত এবং হাদীসটি মুনকার। ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন- আমি সকাল বেলায় কাপড় সেলাই করছিলাম। হঠাৎ আমার হাত থেকে সূচ পড়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সেটি পাওয়া গেল না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) আগমন করলে তাঁর মুখমণ্ডলের ঔজ্জ্বল্যে সূচ দৃষ্টিগোচর হয়ে গেল। তাঁকে একথা বললে তিনি বললেনঃ হে হুমায়রা! তার জন্যে আফসোস, তার জন্যে আফসোস, তার জন্যে আফসোস, (তিনবার) যে আমার মুখমণ্ডলের দীদার থেকে বঞ্চিত।
বগল মোবারক
বুখারী ও মুসলিমের রেওয়ায়েতে হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন- আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দোয়ার সময় উভয় হাত এতটুকু উঁচু করতে দেখেছি যে, তাঁর বগল মোবারকের শুভ্রতা দৃষ্টিগোচর হয়ে যেত।ইবনে সা’দ হযরত জাবের (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) যখন সেজদা করতেন, তখন তাঁর বগলের শুভ্রতা দৃষ্টিগোচর হয়ে যেত। ছাহাবায়ে কেরাম বর্ণিত একাধিক হাদীসে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বগলের শুভ্রতা উল্লেখিত হয়েছে। মুহিব তবরী বলেনঃ বগলের শুভ্রতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষের বগলের রং ত্বক থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। কুরতুবীও এমনি রেওয়ায়েত করেছেন। তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বগলে চুলও ছিল না।
কথা বার্তা
আবু আহমদ, ইবনে মান্দাহ, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির হযরত বুরায়দা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) আরয করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি আমাদের চেয়ে শুদ্ধভাষী কেন, অথচ আপনি আমাদের মধ্যেই রয়েছেন- কোথাও যানওনি? তিনি বললেনঃ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে সে ভাষা আয়ত্ত করিয়েছেন। কতক রেওয়ায়েতে এ হাদীসটি বুরায়দা থেকে এ ভাবে আছে যে, তিনি বলেছেন- আমি হযরত ওমর (রাঃ)-কে বলতে শুনলাম।বায়হাকী (শোয়াবুল-ঈমানে), ইবনে আবিদ্দুনিয়া (কিতাবুল-মাতারে), ইবনে আবী হাতেম, খতীব (কিতাবুনুজুমে), ও ইবনে আসাকির মোহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম তায়মী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, লোকেরা বললঃ ইয়া রসূলাল্লাহ! আমরা আপনার চেয়ে অধিক শুদ্ধভাষী কাউকে দেখিনি। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ কোরআন আমার মাতৃভাষা স্পষ্ট আরবীতে অবতীর্ণ হয়েছে। ইবনে আসাকির মোহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান থেকে, তিনি স্বীয় পিতা থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করল أيدالك الرجل امرأته রসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ نعم اذا
পৃষ্ঠা:২০
كان ملفجاملفجا হযরত আবু বকর (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ, এ ব্যক্তি আপনাকে কি বলল? আপনি কি জওয়াব দিলেন? তিনি বললেনঃ সে বলেছে- কেউ কি তার স্ত্রীর সাথে টালবাহানা করতে পারে? আমি বললামঃ হাঁ, যদি সে নিঃস্ব ও সম্বলহীন হয়। হযরত আবূ বকর (রাঃ) বললেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি সমগ্র আরব ঘুরেছি এবং শুদ্ধভাষী লোকদের বাক্যালাপ শুনেছি; কিন্তু আপনার চেয়ে বেশী শুদ্ধভাষী কাউকে পাইনি। রসূলুল্লাহ (সাঃ) ২৭.সেনঃ আমার প্রতিপালক আমাকে আদব শিক্ষা দিয়েছেন এবং আমি বনী সা’দ ইবনে বকরে লালিত হয়েছি। ইবনে সা’দ ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াযিদ সা’দী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধ্যি সুবক্তা। আমি কোরায়শ বংশোদ্ভূত। আমার ভাষা বনী সা’দ ইবনে বকরের ভাষা।তিবরানী হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ রেছেনঃ আমি আরবদের মধ্যে সর্বাধিক সুবক্তা। আমি কোরায়শের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি এবং বনু সা’দে লালিত-পালিত হয়েছি। এমতাবস্থায় আমার ভাষ্য কিরূপে ভুল হতে পারে?
অন্তর মোবারক
আল্লাহ পাক বলেছেন- الم نشرح لك صدرك আমি কি আপনার বক্ষ উন্মোচন করি নিং বায়হাকীর রেওয়ায়েতে আছে যে, ইবরাহীম ইবনে তাহমান সা’দকে উপরোক্ত আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কাতাদাহ থেকে এবং তিনি আনাস (রাঃ থেকে বর্ণনা করলেন যে, রসূলে করীম (সাঃ)-এর পেট বুক থেকে পেটের নিম্নাংশ পর্যন্ত বিদীর্ণ করা হয় এবং তাঁর হৃদপিণ্ড পর্যন্ত বের করে স্বর্ণের প্লেটে ধৌত করে ঈমান ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়। এরপর যথাস্থানে স্থাপন করা হয়। আহমদ ও মুসলিম হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, শিশু রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে একদিন হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করলেন। তিনি তখন অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলাধুলায় রত ছিলেন। জিবরাঈল তাঁকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। অতঃপর বক্ষ বিদীর্ণ করে সেখান থেকে একখণ্ড জমাট রক্ত বের করে বললেনঃ এটা শয়তানের অংশ। এরপর হৃদপিণ্ডকে একটি স্বর্ণের প্লেটে ধৌত করে যথাস্থানে রেখে দিলেন। শিশুরা দৌড়ে তাঁর দুধমার কাছে পল এবং বললঃ মোহাম্মদ খুন হয়ে গেছে। সকলেই পৌছে দেখল তাঁর মুখমণ্ডল বিবর্ণ। হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ আমি নিজে তাঁর বক্ষদেশে সেলাইয়ের চিহ্ন দেখেছি। আহমদ, দারেমী, হাকেম, বায়হাকী, তিবরানী ও আবু নয়ীম ওতবা ইবনে আবদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- আমার দুধ-মা ছিলেন সা’দ ইবনে বকর গোত্রের মহিলা। আমি ও তাঁর পুত্র একদিন পশু পাল চরাতে গেলাম। কিন্তু আমাদের কাছে কোন পাথেয় ছিল না। আমি ভাইকে বললামঃ তুমি যাও এবং আম্মার কাছ থেকে কিছু খাবার নিয়ে এস। ভাই চলে গেল এবং আমি সেখানেই গবাদি পশু পালের মধ্যে রয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমার কাছে বাজের ন্যায় দু’টি সাদা শাখী এল। তারা একে অপরকে বললঃ ইনিই কি তিনি? দ্বিতীয় পাখী বললঃ হাঁ। এরপর উভয়েই আমার দিকে অগ্রসর হল এবং আমাকে ধরে উপুড় করে শুইয়ে দিল। অতঃপর আমার হৃদপিণ্ড বের করল এবং চিরে তার মধ্য থেকে দু’টি কাল রক্তখণ্ড বের করল। একজন অপরজনকে বললঃ আমাকে বরফের পানি এনে দাও। অতঃপর উভয়েই আমার পেট ধৌত করল। অতঃপর বললঃ ঠাণ্ডা পানি আন। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে আমার বক্ষের অভ্যন্তর ভাগ ধৌত করল। অতঃপর বললঃ ছুরি আন। ছুরি আমার ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। অতঃপর একে অপরকে বললঃ এই ফাঁটল সেলাই করে দাও। সে সেলাই করে দিল এবং মোহরে-নবুয়ত লাগিয়ে দিল। অতঃপর একে অপরকে বললঃ তাঁকে এক পাল্লায় রাখ এবং তার উম্মতের এক হাজার ব্যক্তি অপর পাল্লায় রাখ। আমি এ এক হাজারকে নিজের উপরে ভারী দেখলাম এবং আশংকা করতে লাগলাম যে, তাদের কিছু লোক আমার উপর পড়ে যাবে না তো? এরপর তারা উভয়েই বললঃ যদি তাঁকে তাঁর সমগ্র উম্মতের মোকাবিলায়ও ওজন কর, তবুও তিনি ভারী হবেন। তারা উভয়েই আমাকে ছেড়ে চলে গেল এবং আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দুধ মার কাছে পৌছে তাঁকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তাঁকে বললামঃ কোথাও আমার জ্ঞান-বুদ্ধি বিলুপ্ত হয়নি তো? তিনি বললেনঃ আমি তোমাকে আল্লাহর আশ্রয়ে দিচ্ছি। এরপর তিনি আমাকে সওয়ারীতে বসালেন এবং নিজে আমার পিছনে বসলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে আমার জননীর কাছে পৌঁছে বললেনঃ আমি আমার আমানত ও দায়িত্ব পূর্ণ করেছি। অতঃপর তাঁকে সমস্ত ঘটনা বললেন। কিন্তু আমার জননী কিছু মনে করলেন না এবং বললেনঃ আমি নিজে দেখেছি যে, আমার শরীর থেকে একটি নূর উদিত হয়েছে, যার আলোকে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ উজ্জ্বল হয়ে গেছে। বায়হাকী ইয়াহইয়া ইবনে জা’দা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আমার কাছে বড় পাখীর আকারে দু’জন ফেরেশতা এল। তাদের সাথে বরফ ও ঠান্ডা পানি ছিল। তাদের একজন আমার বক্ষ উন্মোচন করল এবং অপরজন চঞ্চুর সাহায্যে তাতে পিচকারী মারল এবং ধৌত করল। (মুরসাল)
পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৩০
পৃষ্ঠা:২১
আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ, ইবনে হাব্বান, হাকেম, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির মুয়ায ইবনে মোহাম্মদ ইবনে মুয়ায ইবনে উবাই ইবনে কা’ব থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি আপন দাদা থেকে এবং তিনি উবাই ইবনে কা’ব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ, আপনার নবুয়তের সূচনা কিরূপে হল?তিনি বললেনঃ আমার বয়স যখন দশ বছর, তখন একদিন জঙ্গলের পথে যাওয়ার সময় আমি আমার মাথার উপর দু’ ব্যক্তিকে দেখলাম। তাদের একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করলঃ ইনিই কি তিনি? দ্বিতীয়জন বললঃ হাঁ। অতঃপর তারা আমাকে ধরে চিৎ করে শুইয়ে দিল এবং আমার পেট চিরে ফেলল। তাদের একজন স্বর্ণের প্লেটে পানি আনল এবং অপরজন আমার পেট ধৌত করল। এরপর একে অপরকে বললঃ তাঁর বুক চিরে ফেল। আমি আমার বুক বিদীর্ণ দেখলাম। কিন্তু কোন কষ্ট অনুভূত হল না। অতঃপর সে বললঃ তাঁর অন্তর চিরে ফেল। আমার অন্তর বিদীর্ণ করা হল। ফেরেশতা বললঃ এর মধ্য থেকে হিংসা বিদ্বেষ বের করে দাও। সে একটি রক্তখণ্ড বের করে ফেলে দিল। ফেরেশতা বললঃ তাঁর অন্তরে নম্রতা ও দয়া দাখিল করে দাও। সে রুপার মত কোন বন্ধু স্থাপন করে দিল। অতঃপর কিছু কণা বের করে তাতে ছিটিয়ে দিল। অতঃপর আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি নেড়ে বললঃ যাও। আমি রওয়ানা হলে আমার অন্তরে ছোটদের প্রতি দয়া এবং বড়দের প্রতি নম্রতা ছিল। আবু নয়ীম বলেনঃ এ রেওয়ায়েতটি মুয়ায আপন বাপদাদা থেকে একাই রেওয়ায়েত করেছেন এবং বয়সের বর্ণনায়ও তিনিএকা।দারেমী, বাধযার, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আবু যর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনার কিরূপে বিশ্বাস হল যে, আপনি নবী? মতিনি বললেনঃ বাতহায়ে মক্কায় আমার কাছে দু’ব্যক্তি এল। তাদের একজন মর্ত্যে ছিল ও অপরজন আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে ঝুলন্ত ছিল। একজন অন্যজনকে প্রশ্ন করলঃ ইনিই কি তিনি? অন্যজন বললঃ হাঁ, ইনিই তিনি। সে বললঃ তাহলে তাকে এক ব্যক্তির মোকাবিলায় ওজন কর। তারা আমাকে এক ব্যক্তির বিপরীতে ওজন করল। আমি ভারী হলাম। সে বললঃ দশজনের মোকাবিলায় ওজন কর। আবার ওজন করা হলে আমি ভারী হলাম। সে বললঃ একশ জনের মোকাবিলায় ওজন কর। আবার ওজন করা হল এবং আমি ভারী হলাম। সে আবার বললঃ এক হাজারের মোকাবিলায় ওজন কর। আবার ওজন করা হলে আমিই ভারী হলাম। এরপর তারা সকলেই পাল্লা থেকে আমার উপর পতিত হতে লাগল। অতঃপর আগন্তুকদ্বয়ের একজন বললঃ তার পেট বিদীর্ণ কর। সে মতে সে আমার পেট বিদীর্ণ করে সেখান থেকে শয়তানের স্পর্শ করার জায়গা এবং একটি রক্তখণ্ড বের করে ফেলে দিল। এরপর সে বললঃ পেট পাত্রের মত ধৌত করে এবং অন্তরকে ভরা জিনিষের মত ধৌত কর। এরপর বললঃ তার পেট সেলাই করে দাও। সে আমার পেট সেলাই করে দিল এবং আমার কাঁধে মোহরে নুবয়ত লাগিয়ে দিল। আজও তা বিদ্যমান আছে। এরপর তারা প্রস্থান করল। আমি এ সকল দৃশ্য সুস্পষ্টরূপে দেখলাম। আবু নয়ীম ইউনুস ইবনে মায়ারা ইবনে জলীস থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আমার কাছে এক ফেরেশতা স্বর্ণের প্লেট নিয়ে হাযির হল। সে আমার পেট চিরে নাড়িভুড়ি বের করে ধৌত করল। এরপর এগুলোর উপর কিছু গুঁড়া ছিটিয়ে বললঃ অন্তর মজবুত ও স্মরণশক্তি সম্পন্ন। দৃষ্টি চক্ষুষ্মান। কর্ণ শ্রবণশক্তি সম্পন্ন। আপনি মোহাম্মদ রসূলুল্লাহ। মানুষ আপনার অনুসরণ করবে এবং আপনার পশ্চাতে সমবেত হবে। আপনার অন্তর সুস্থ, জিহবা সত্যবাদী, নক্স প্রশান্ত, দেহ নিরোগ এবং আপনি সর্বগুণের আধার।দারেমী ও ইবনে আসাকির ইবনে গনম থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এলেন। অতঃপর তার অন্তর বিদীর্ণ করলেন এবং বললেনঃ দৃঢ় অন্তর, শ্রবণকারী কান, চক্ষুষ্মান নেত্র, ইনি মোহাম্মদ রসূলুল্লাহ। মানুষ তাঁর অনুসরণ করবে, পিছনে সমবেত হবে। তাঁর দেহ সুস্থ, জিহ্বা সত্যবাদী এবং মন প্রশান্ত। মুসলিম হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, আমি আমার গৃহে ছিলাম, এমন সময় কেউ এল এবং আমাকে যমযমে নিয়ে গেল। সেখানে আমার বক্ষবিদারণ করে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করল। এরপর ঈমান ও প্রজ্ঞাভর্তি স্বর্ণের প্লেট আনা হল, যা দিয়ে আমার বক্ষ পরিপূর্ণ করা হল। (হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ রসূলে পাক (সাঃ) আমাদেরকে এই বক্ষবিদারণের চিহ্ন দেখাতেন।) এরপর ফেরেশতা আমাকে দুনিয়ার আকাশে নিয়ে গেল। এরপর হযরত আনাস (রাঃ) মে’রাজের হাদীস বর্ণনা করলেন। বায়হাকী বলেনঃ বক্ষবিদারণ একাধিকবার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। একবার দুগ্ধপানের সময়, একবার নবুয়তপ্রাপ্তির সময় এবং একবার মে’রাজ রজনীতে। আমি বলি- দুগ্ধপানের আলোচনায় বক্ষবিদারণ সম্পর্কে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। আরও রেওয়ায়েত নবুয়তপ্রাপ্তি ও মে’রাজের আলোচনায় আসবে। এ সব রেওয়ায়েতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের নিমিত্ত বক্ষবিদারণ তিনবার হয়েছে ধরে নিতে হবে। সুহায়ল, ইবনে ওয়াহিদ ও ইবনে মুনীর বক্ষবিদারণ দু’বার হওয়ার প্রবক্তা। কিন্তু ইবনে হজর বলেন। বক্ষবিদারণ তিনবার হয়েছে। তিনবার করার
পৃষ্ঠা:২২
উদ্দেশ্য পূর্ণতাদান ও পবিত্রকরণ; যেমন এ উদ্দেশ্যেই ওযুর অঙ্গসমূহ তিনবার ধৌত করার বিধান রয়েছে। বক্ষবিদারণ বিশেষ করে তিনবার করা এ জন্যে, যাতে রসুলে করীম (সাঃ) শৈশবকাল অতিবাহিত করার সময় শয়তানের প্রভাব থেকে সংরক্ষিত ও নিষ্পাপ থাকেন, নবুয়ত প্রাপ্তির সময় অন্তর ওহীর জন্যে পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয় এবং মে’রাজের সময় আল্লাহ পাকের সাথে বাক্যালাপের জন্যে প্রস্তুত হয়। বক্ষবিদারণ ও বক্ষ ধৌতকরণ রসূলে করীম (সাঃ)-এরই বৈশিষ্ট্য, না অন্য পয়গাম্বরগণেরও বক্ষ বিদারণ হয়েছে, এ ব্যাপারে আলেমগণের মধ্যে মতভেদ আছে। ইবনুল মুনীর বলেনঃ বক্ষবিদারণ রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এরই একক বৈশিষ্ট্য। এটি এমন এক প্রকার পরীক্ষা, যা হযরত ইসমাঈল (আঃ)কেও দিতে হয়েছে; বরং এটা তার চেয়েও কঠিন এবং এতে ছবর করা আরও দুরূহ। কেননা, বক্ষবিদারণ একটি বাস্তব ঘটনা। এ ঘটনা তখন ঘটে, যখন নবী করীম (সাঃ) এতীম ছিলেন এবং দুগ্ধপানরত অবস্থায় আপন পরিবার পরিজন থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন।
হাই তোলা
বুখারী, ইবনে আবী শায়বা ও ইবনে সা’দ রেওয়ায়েত করেন যে, এয়াযিদ ইবনে আছাম বর্ণনা করেছেন- নবী করীম (সাঃ) কখনও হাই ভোলেন নি। ইবনে আবী শায়বা, সালামাহ ইবনে আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান থেকে বর্ণনা করেন যে, কখনও কোন নবী হাই তোলেন নি।
কর্ণ
তিরমিযী, ইবনে মাজা ও আবু নয়ীম হযরত আবূ যর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ আমি এমন কিছু দেখি, যা তোমরা দেখ না, এমন কিছু শ্রবণ করি, যা তোমরা শ্রবণ কর না। আকাশ বোঝার কারণে চড় চড় করে। তার চড় চড় করাই সঙ্গত। কেননা, আকাশে চার আঙ্গুল পরিমিত জায়গাও এমন নেই, যেখানে কোন একজন ফেরেশতা আল্লাহর সামনে মাথা নত করে রাখেনি। আবু নয়ীম রেওয়ায়েত করেন যে, হাকীম ইবনে হেযাম বর্ণনা করেছেন- রসূলে করীম (সাঃ) একবার ছাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে থাকা অবস্থায় বললেনঃ তোমরা কি শুনতে পাচ্ছ, যা আমি শুনতে পাচ্ছি? ছাহাবায়ে কেরাম আরয করলেনঃ আমরা তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। তিনি বললেনঃ আমি আকাশের চড়চড় শব্দ শুনছি। কোন কোন সময় কোন কোন অংশ থেকে এরূপ শব্দ শোনা যায়। কেননা, তাতে অর্ধহাত পরিমিত জায়গাও এমন নেই, যেখানে কোন একজন ফেরেশতা সেজদারত অথবা দণ্ডায়মান অবস্থায় নেই।
কণ্ঠস্বর
বায়হাকী ও আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত বারা বর্ণনা করেন- রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের উদ্দেশে খোতবা দিলে তাঁর কণ্ঠস্বর পর্দানশীন মহিলারা পর্দার মধ্যে থেকেও শুনতে পায়। আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত বুরায়দা (রাঃ) বর্ণনা করেন- নবী করীম (সাঃ) একদিন নামায পড়ালেন। এরপর ফিরে এলেন এবং এমন আওয়াজ সহকারে ডাক দিলেন, যা পর্দানশীন মহিলারা পর্দার মধ্যে শুনতে পেল। আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে আবু বরযাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন- রসূলুল্লাহ (সাঃ) এসে আমাদের উদ্দেশে খোতবা দিলেন, যা পর্দানশীন মহিলারা পর্দায় বসে বসেও শুনতে পেল। বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, এক জুম্মার দিনে হযরত নবী করীম (সাঃ) মিম্বরে বসলেন এবং মুছল্লীদের উদ্দেশে বললেনঃ বসে যাও। আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা তখন বনী গনমে ছিলেন। তিনি সেখান থেকে এ কণ্ঠস্বর শুনতে পান এবং সেখানেই বসে যান। ইবনে যা’দ ও আবু নয়ীম রেওয়ায়েত করেন যে, আবদুর রহমান ইবনে মুয়ায তায়মী বর্ণনা করেছেন- রসূলুল্লাহ (সাঃ) মিনায় আমাদের উদ্দেশে খোতবা দিলেন। এতে আমাদের কান খুলে গেল। (এক রেওয়ায়েতে আছে আল্লাহ তায়ালা আমাদের কান খুলে দিলেন।) অবশেষে আমরা তাঁর খোতবা আপন গৃহে বসে শুনতে ছিলাম। ইবনে মাজা ও বায়হাকী রেওয়ায়েত করেন যে, উম্মেহানী (রাঃ) বলেছেন- নবী করীম (সাঃ) কা’ বার প্রাঙ্গনে রাতে যে কেরাত পাঠ করতেন, তা আমি আপন গৃহে শুয়েও শুনতে পেতাম।
বুদ্ধিজ্ঞান
আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহ বর্ণনা করেন- আমি একাত্তরটি কিতাব পাঠ করেছি। সবগুলোতেই পাঠ করেছি যে, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে তার লয়প্রাপ্তি পর্যন্ত সকল মানুষকে যে জ্ঞানবুদ্ধি দান করেছেন, তা রসূল আকরাম (সাঃ)-এর জ্ঞানবুদ্ধির তুলনায় এমন, যেমন বিশ্বের বালুকাসমূহের মধ্যে একটি বালুকণা। নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ (সাঃ) সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সর্বাধিক বুদ্ধিমান এবং সর্বাধিক বিচার- বিবেচনাশীল।
ঘর্ম
মুসলিমের রেওয়ায়েতে হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন- নবী করীম (সাঃ) আমাদের গৃহে আগমন করলেন এবং “কায়লুলা” (দ্বিপ্রহরের নিদ্রা) করলেন। তাঁর
পৃষ্ঠা:২৩
পবিত্র শরীর থেকে ঘর্ম প্রবাহিত হতে লাগল। আমার জননী শিশি নিয়ে এলেন এবং ঘর্ম মুছে তাতে ভরতে লাগলেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চোখ খুলে গেল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ উম্মে সুলায়ম, কি করছ? তিনি বললেনঃ এ ঘর্ম সুগন্ধি রূপে আমরা ব্যবহার করি। কেননা, এটা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট সুগন্ধি।মুসলিমের অপর এক রেওয়ায়েতে হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ নবী করীম (সাঃ) উম্মে সুলায়মের কাছে আসতেন এবং কায়লুলা করতেন। তিনি তাঁর জন্যে চামড়ার বিছানা বিছিয়ে দিতেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাতে কায়লুলা করতেন। তাঁর খুব বেশি ঘাম নির্গত হত। উম্মে সুলায়ম এ ঘাম জমা করে আতরের সাথে মিশিয়ে নিতেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ উম্মে সুলায়ম, ঘাম দিয়ে কি কর? তিনি জওয়াব দিলেনঃ আতরের সাথে মিশিয়ে নেই। মোহাম্মদ ইবনে সিরীন থেকে বর্ণিত আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত উম্মে সুলায়ম (রাঃ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার কাছে একটি চামড়ার বিছানায় কায়লুলা করতেন। তাঁর ঘর্ম এলে আমি তা আপন খুশবুতে মিশিয়ে নিতাম। দারেমী, বায়হাকী ও আবূ নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন- রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি কোন পথ দিয়ে গমন করলে প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর ঘামের খোশবু দিয়ে বুঝতে পারত যে, তিনি এ পথ দিয়ে গমন করেছেন কিংবা এভাবে বুঝতে পারত যে, তিনি গমন করলে প্রত্যেক বৃক্ষ ও পাথর তাঁকে সেজদা করত। ইবনে সা’দ ও আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ নবী করীম (সাঃ) আগমন করলে আমরা তাঁর খোশবু দিয়ে তাঁর আগমন বার্তা জানতে পারতাম। বাযযার ও আবূ ইয়ালার রেওয়ায়েতে হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন- রসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনার যে পথ দিয়ে গমন করতেন, সেখান থেকে খোশবু উত্থিত হত এবং মানুষ বলাবলি করত যে, এ পথে রসূলুল্লাহ (সাঃ) গমন করেছেন। দারেমীর রেওয়ায়েতে ইবরাহীম নখয়ী বর্ণনা করেন- রসুলুল্লহ (সাঃ) রাতের বেলায় পাকবদনের খোশবু দ্বারা পরিচিত হতেন। খতীব, ইবনে আসাকির, আবু নয়ীম ও দায়লমী দু’ সনদে ইমাম বুখারী থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন- আমি সূতা কাটছিলাম এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ) জুতা সেলাই করছিলেন। এমন সময় তাঁর কপাল থেকে ঘর্ম প্রবাহিত হতে লাগল। এ ঘর্ম থেকে নূর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। এতে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ কি কারণে হতবুদ্ধি হয়ে গেলে? আমি বললামঃ আপনার কপালে ঘাম দেখা দিল এবং এ ঘাম থেকে নূর বিচ্ছুরিত হল। যদি কবি আবূ কবীর হুযালী আপনাকে দেখত, তবে জানতে পারত যে, তার সৌন্দর্য্য বর্ণনামূলক সব কবিতার প্রতীক আপনিই। সে তার অনবদ্য কবিতায় যখন বলেঃ “সেই চতুর যুবক প্রত্যেক হায়েযের অবশিষ্টাংশ থেকে, দুগ্ধদাত্রীর রোগ থেকে, গর্ভবতীর দুধের অনিষ্ট থেকে এবং সহবাসকারিণী থেকে পবিত্র ও সংরক্ষিত।” “যখন তুমি তাঁর মুখমন্ডলের অনুপম সৌন্দর্য অবলোকন করবে, তখন এমন উজ্জ্বল ও দেদীপ্যমান মনে হবে, যেমন ঘন-কৃষ্ণ মেঘমালার মধ্যে বিদ্যুৎ চমক।” এই কবিতা শুনে রসূলুল্লাহ (সাঃ) হাতে যা ছিল, রেখে দিলেন এবং আমার কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেনঃ হে আয়েশা। আল্লাহ তায়ালা উত্তম প্রতিদান দিন, আমার মনে পড়ে না যে, আমি কখনও এতটুকু আনন্দিত হয়েছি, যতটুকু তোমার কবিতা শুনে হয়েছি।আবূ আলী ছালেহ ইবনে মোহাম্মদ বাগদাদী বলেনঃ আমার জানা নেই যে, আবূ ওবায়দা কখনও হেশাম ইবনে ওরওয়া থেকে কোন হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন। কিন্তু আমার মতে এ হাদীসটি হাসান। কেননা, এটি ইমাম বুখারী রেওয়ায়েত করেছেন। আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মোবারক মুখমন্ডল অত্যন্ত সুশ্রী ছিল এবং রং ছিল উজ্জ্বল। সৌন্দর্য বর্ণনাকারীদের প্রত্যেকেই তাকে চতুর্দশীর চাঁদের সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর ঘর্ম মুখমন্ডলে মোতির ন্যায় ঝলমল করত এবং তা থেকে খাঁটি মেশকের সুবাস আসত। আবু ইয়ালা, তিবরানী ও ইবনে আসাকির হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)- থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে এসে বললঃ ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি আমার কন্যার বিবাহ ঠিক করেছি। আপনি আমাকে সাহায্য করুন। তিনি বললেনঃ আমার কাছে তো কিছু নেই। এক কাজ কর। একটি চওড়া মুখের শিশি ও একটি কাঠি নিয়ে আমার কাছে এস। লোকটি এগুলো নিয়ে এল। রসূলুল্লাহ (সাঃ) আপন উভয় বাহু থেকে ঘাম মুছে শিশিতে ভরতে লাগলেন। শিশি ভরে গেলে তিনি তা লোকটিকে দিয়ে বললেনঃ তোমার কন্যাকে বলবে সে যেন `এ কাঠিটি শিশিতে ভিজিয়ে নেয় এবং সুগন্ধিরূপে ব্যবহার করে। কথিত আছে-সে এ খোশবু ব্যবহার করলে মদীনাবাসীরা তা অনুভব করে। তাই তারা এ গৃহকে খোশবুর গৃহ বলে অভিহিত করে। দারেমীর রেওয়ায়েতে বনী হারীশের এক ব্যক্তি বলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মায়েয ইবনে মালেককে ‘রজম’ তথা প্রস্তর বর্ষণে হত্যা করার আদেশ দেন, তখন আমি আমার পিতার সাথে ছিলাম। তাঁর গায়ে পাথর লাগতেই আমি ভীত বিহ্বল
পৃষ্ঠা:২৪
হয়ে পড়লাম। রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে গলায় জড়িয়ে ধরলেন। ফলে তার বগলের ঘাম আমার উপর মেশকের ন্যায় প্রবাহিত হল। বাযযার রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত মুয়ায ইবনে জবল (রাঃ) বর্ণনা করেন -আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেনঃ কাছে এস। আমি কাছে গেলে তাঁর শরীরের সুঘ্রাণ পেলাম। মেশক ও আম্বরেরও এমন চমৎকার সুঘ্রাণ আমি কখনও পাইনি।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মহান গুণাবলী
বুখারী ও মুসলিম হযরত বারা ইবনে আযেব (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বাধিক সুশ্রী ও সর্বাধিক পূতপবিত্র চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি না অধিক লম্বা ছিলেন, না বেঁটে। বুখারী রেওয়ায়েত করেন- হযরত বারা ইবনে আযেবকে (রাঃ) জিজ্ঞাসা করা হল, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পবিত্র মুখমণ্ডল তরবারির মত ছিল? তিনি বললেনঃ না; বরং তাঁর মুখমণ্ডল চাঁদের মত ছিল। মুসলিম রেওয়ায়েত করেন- হযরত জাবের ইবনে সামুরাহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হলঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) লম্বা মুখাকৃতি বিশিষ্ট ছিলেন? তিনি বললেনঃ না; বরং তাঁর মুখাকৃতি চাঁদের ন্যায় গোলাকার ছিল। দারেমী ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হযরত জাবের (রাঃ) বলেনঃ আমি একবার চাঁদনী রাতে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখছিলাম। তিনি তখন লাল বস্তুজোড়া পরিহিত ছিলেন। আমি কখনও চাঁদের দিকে এবং কখনও রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে তাকাচ্ছিলাম। অবশেষে এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হলাম যে, হুযুর আকরাম (সাঃ) চাঁদ অপেক্ষা অনেক বেশি সুশ্রী, সুন্দর ও আলোকময়।বুখারীর রেওয়ায়েতে কা’ব ইবনে মালেক বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আনন্দিত হতেন, তখন মুখমন্ডল এমন উজ্জ্বল হয়ে যেত, যেন একখন্ড চাঁদ। তাঁর এ অভ্যাস সম্পর্কে আমরা সবিশেষ জ্ঞাত ছিলাম। আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখমণ্ডল এমন ছিল, যেমন চাঁদের গোলাকার বৃত্ত। বায়হাকী আবু ইসহাক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু ইসহাক বলেনঃ জনৈকা হামদানী মহিলা আমাকে জানায় যে, সে রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে হজ্ব করেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর মুখমণ্ডল কেমন ছিল? মহিলা বললঃ মুখমণ্ডল চতুর্দশীর চাঁদের মত ছিল। এমন মুখমণ্ডল আমি না তার পূর্বে দেখেছি, না তাঁর পরে। দারেমী, বায়হাকী, তিবরানী ও আবূ নয়ীমের রেওয়ায়েতে হযরত আবু ওবায়দা (রাঃ) বলেনঃ আমি রবী বিনতে মুয়াভেষকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখাকৃতি বর্ণনা করতে বললাম। তিনি বললেনঃ আমি যখন তাঁকে দেখতাম, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতাম সূর্য উদিত হয়েছে। মুসলিম রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আবূ তোফায়ল (রাঃ)-কে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে বলা হলে তিনি বললেনঃ মুখমণ্ডল শুভ্র ও লাবণ্য মিশ্রিত ছিল। বুখারী ও মুসলিম হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (সাঃ) মাঝারি গড়নের ছিলেন। না খুব লম্বাকৃতি, না বেঁটে। রং ছিল চমকদার। না সম্পূর্ণ গোধূম বর্ণ, না সম্পূর্ণ চুনার মত শুভ্র। চিরুনী করা কেশ। না সম্পূর্ণ জড়ানো; বরং সামান্য কোঁকড়ানো।বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ রসূলুল্লাহর (সাঃ)-এর মুখমণ্ডল শুভ্র লালিমা মিশ্রিত ছিল। ইবনে সা’দ তিরমিযী ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন- আমি রসূলুল্লাহর (সাঃ)- চেয়ে অধিক সুশ্রী ও সুন্দর কাউকে দেখিনি। মনে হত যেমন মুখমণ্ডল থেকে কিরণ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমি তাঁর চেয়ে অধিক দ্রুতগতি সম্পন্নও কাউকে দেখিনি। তিনি যখন হাঁটতেন, তখন মনে হত যেন মাটি পিছনের দিকে সরে যাচ্ছে (অর্থাৎ খুব দ্রুতগতিতে পথ অতিক্রান্ত হচ্ছে) আমরা তাঁর সঙ্গে হাঁটলে যথেষ্ট লাফাতে হত। অথচ তিনি বেশ গাম্ভীর্য সহকারে হাঁটতেন বলে মনে হত। ইবনে সা’দ এবং ইবনে আসাকির কাতাদাহ থেকে, তিনি হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আনাস বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীকে সুশ্রী ও সুকণ্ঠী করে প্রেরণ করেছেন। অবশেষে আমাদের নবী (সাঃ)-কেও সুশ্রী ও সুকণ্ঠী করে প্রেরণ করেছেন। ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত আলী ইবনে আবূ অলেব (রাঃ) বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীকে সুশ্রী, শ্রেষ্ঠ বংশোদ্ভূত ও সুকণ্ঠী করে প্রেরণ করেছেন। আমাদের নবী (সাঃ)ও সুশ্রী, শ্রেষ্ঠ বংশোদ্ভূত এবং সুকণ্ঠী ছিলেন। দারেমীর রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বলেনঃ আমি রসূলে করীম (সাঃ) অপেক্ষা অধিক বীর, অধিক দাতা এবং অধিক উজ্জ্বল মুখমণ্ডল বিশিষ্ট কাউকে দেখিনি। মুসলিমের রেওয়ায়েতে হযরত জাবের ইবনে সামুরাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন- রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখমণ্ডল প্রশস্ত ছিল। তাঁর চোখের শুভ্রতায় লাল সরু ডোরা ছিল।
পৃষ্ঠা:২৫
তিরমিযী ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেন- হয়ূর (সাঃ) না বেশি লম্বা ছিলেন, না বেঁটে। বরং তাঁর গড়ন ছিল মাঝারি। কেশ না সম্পূর্ণ কুঞ্চিত, না সম্পূর্ণ সোজা; বরং সামান্য কোঁকড়া ছিল। তিনি স্কুলদেহী ছিলেন না, গোল মুখমণ্ডলের ছিলেন, বরং মুখমণ্ডল হালকা গোলাকৃতি ছিল। তাঁর রং সাদা লাল মিশ্রিত ছিল। চক্ষুদ্বয় খুব কাল ছিল এবং পলক দীর্ঘ ছিল। তাঁর গ্রন্থির হাড়িভ মোটা ছিল। উভয় কাঁধের মধ্যবর্তী জায়গাও মোটা ও মাংসল ছিল। শরীরে চুল বেশি ছিল না। বক্ষ থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের একটি রেখা ছিল। হাতের তালু ও পদযুগল মাংসল ছিল। তিনি যখন চলতেন, তখন শক্তিসহকারে পা তুলতেন, যেন নিম্নভূমির দিকে যাচ্ছেন। তিনি কারও দিকে মনোযোগ দিলে সমগ্র শরীর সহকারে মনোযোগ দিতেন। তাঁর উভয় ঝুঁটির মধ্যস্থলে মোহরে-নবুয়ত ছিল। হযরত আলী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত আছে যে, হুযুর (সাঃ)-এর চোখের পুতলী ও পদক নম্বর ছিল। বায়কাকী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর ললাট প্রশস্ত পলকযুক্ত ছিল। তায়ালেসী, তিরমিযী ও বায়হাকী হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (সাঃ) না বেঁটে ছিলেন, না অধিক লম্বা। তাঁর দাড়িও বড় ছিল। হাতের তালু ও পদযুগল মাংসল ছিল। গ্রন্থির হাড়িড মোটা ছিল। মুখমণ্ডলে লাল আভা ছিল। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের লম্বা রেখা ছিল। তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে চলতেন; যেন উচ্চভূমি থেকে নিম্নভূমিতে যাচ্ছেন। আমি তাঁর মত কাউকে না তাঁর পূর্বে দেখেছি, না পরে।তায়েলেসী, আহমদ ও বায়হাকী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, জনাব রসূলে করীম (সাঃ)-এর হাতের কাজী দীর্ঘ ছিল। দু’কাষের মাঝখানে দূরত্ব ছিল। চোখের পলক দীর্ঘ ছিল। তিনি বাজারে হৈ চৈ কারী, গালমন্দকারী ও কটুভাষী ছিলেন না। তিনি কারও মুখোমুখি হলে সমগ্র দেহসহকারে মুখোমুখি হতেন এবং যখন ঘুরে যেতেন, তখন সমগ্র দেহ সহকারে ঘুরে যেতেন। বায়হাকী হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর দাড়ি কাল এবং দাঁত অত্যন্ত সুন্দর ছিল। হযরত আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বৃদ্ধ হয়েছিলেন কি? তিনি বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বার্ধক্যের দোষ থেকে মুক্ত রেখেছেন। মাথায় ও দাড়িতে সতের আঠারটি পাকা চুল ছিল। বুখারী ও মুসলিম হযরত বারা ইবনে আযেব (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন। যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) মাঝারি গড়নের ছিলেন। তাঁর ঝুটির মধ্যস্থলে বেশ দূরত্বছিল। মাথার কেশ কানের লতি স্পর্শ করত। আমি তাঁর চেয়ে অধিক সুশ্রী ও সুন্দর আর কাউকে দেখিনি। আহমদ ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে মুহরিশ কা’বী বলেনঃ নবী করীম (সাঃ) জেয়েরানা থেকে রাতের বেলায় ওমরার এহরাম বাঁধেন। আমি তাঁর পিঠের দিকে তাকালাম, যা চাঁদের ফালির মত ঝলমল করছিল। তায়ালেসী, ইবনে সা’দ তিবরানী ও ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত উম্মে হানী (রাঃ) বলেনঃ আমি নবী করীম (সাঃ)-এর পেটের দিকে তাকালে মনে হত যেন উপরে নীচে সাদা কাগজ জড়িয়ে আছে। তিরমিযী ও বায়হাকী হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) যেন রুপায় পড়া ছিলেন। চুল সামান্য বারু ও কোঁকড়া ছিল। পেট ছিল সমতল। কাঁধের হাডিড চওড়া ছিল। যখন হাঁটতেন, পা দৃঢ়ভাবে রাখতেন। যখন কারও দিকে মনোযোগ দিতেন, তখন পূর্ণ শরীর সহকারে মনোযোগ দিতেন। যখন ঘুরতেন, পূর্ণ শরীর সহকারে ঘুরতেন। বুখারী হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর মাথা ও পা বড় ছিল এবং হাতের তালু সমতল ছিল। বুখারী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পা বড় এবং মুখমণ্ডল সুশ্রী ছিল। আমি তাঁর পরে তাঁর মত কাউকে দেখিনি। তিবরানী ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে মায়মুনা বিনতে কারুম বলেনঃ আমি রসুলে করীম (সাঃ)কে দেখেছি। আমি একথা ভুলতে পারি না যে, তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির সাথে সংলগ্ন অঙ্গুলিটি অন্য সকল অজুলি অপেক্ষা বৃহৎ ছিল। বায়হাকী বিল্ আদভিয়ার জনৈক ছাহাবী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেছেন- আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)- কে দেখেছি। তাঁর দেহাবয়ব অত্যন্ত সুন্দর ছিল। প্রশস্ত লাট ছিল। নাক সরু ছিল। ভ্রূ সূক্ষ্ম ছিল। বুক থেকে নাতি পর্যন্ত ডোরার মত চুলের রেখা ছিল। বায়হাকী হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলে করীম (সাঃ) না বেঁটে ছিলেন, না অধিক লম্বা; বরং লম্বার অধিক কাছাকাছি ছিলেন। হাতের তালু ও পা মাংসল ছিল। বুকে চুলের রেখা ছিল। তাঁর ঘর্ম ম্যোতির ন্যায় ঝলমল করত। তিনি ঝুঁকে হাঁটতেন, যেন উচ্চভূমি থেকে নামছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ বায়হাকী হযরত আলী (রাঃ) থেকে বেওয়ায়েত করেন যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) খুব বেশি লম্বা ছিলেন না; বরং মাঝারি গড়নের চেয়ে কিছু উঁচু ছিলেন। যখন অন্য লোকদের সাথে চলতেন, তখন তাদের চেয়ে উঁচু দৃষ্টিগোচর
পৃষ্ঠা:২৬
হতেন। তিনি শুভ্র ছিলেন। মাথা বড় ছিল। উজ্জ্বল মুখমণ্ডল ও হাসি মুখ ছিলেন। পলক লম্বা ছিল। হাতের তালু ও পা মাংসল ছিল। চলার সময় দৃঢ় পদক্ষেপে চলতেন, যেন নীচে নামছেন। মুখমণ্ডলে ঘর্ম মোতির ন্যায় ঝলমল করত। আমি তাঁর মত না তাঁর পূর্বে কাউকে দেখেছি, না তাঁর পরে। মুসলিম হযরত আনাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর রং উজ্জ্বল ছিল। ধর্ম মোতির মত ঝলমল করত। তিনি যখন চলতেন, ঝুঁকে চলতেন। বাযযার ও বায়হাকী হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) সর্বাধিক সুন্দর ছিলেন। গড়ন মাঝারি ছিল। উভয় কাঁধের মাঝখানে ব্যবধান ছিল। কপোল সমতল ছিল। কেশ খুব কাল, চক্ষু কাজল এবং পলক দীর্ঘ ছিল। চলার সময় পূর্ণ পা রাখতেন। পায়ে গর্ত ছিল না। কাঁধ থেকে চাদর সরালে পিঠ মনে হত রুপায় গড়া। হাসলে দাঁত মোতির ন্যায় মনে হত। আমি তাঁর পূর্বে এবং তাঁর পরে তাঁর মত আর কাউকে দেখিনি। বুখারী ও মুসলিমের রেওয়ায়েতে হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি এমন কোন রেশম ও কিংখাব স্পর্শ করিনি, যা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতের তালু অপেক্ষা অধিক কোমল। আমি এমন কোন মেশক ও আম্বরের ঘ্রাণ নেই নি, যার সুগন্ধি হুযুর (সাঃ)-এর শরীরের সুগন্ধি অপেক্ষা অধিক হৃদয়গ্রাহী।মুসলিমের রেওয়ায়েতে জাবের ইবনে সামুরাহ (রাঃ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার গালে হাত বুলিয়েছেন। আমি তাঁর পবিত্র হাতের শীতলতা অনুভব করেছি। আর মনে হয়েছে যেন কোন আতর বিক্রেতার বাক্স থেকে সুগন্ধি আসছে। বায়হাকীর রেওয়ায়েতে এয়াযিদ ইবনে আসওয়াদ বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার হাতে আপন পবিত্র হাত দিয়েছেন। তাঁর হাত বরফের চেয়ে ঠাণ্ডা এবং মেশকের চেয়ে অধিক সুগন্ধিযুক্ত ছিল।তিবরানী মুস্তাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তার পিতা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে যান এবং তাঁর পবিত্র হাত আপন হাতে নেন। তিনি অনুভব করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাত রেশম অপেক্ষা অধিক কোমল এবং বরফের চেয়ে বেশি ঠান্ডা ছিল।আহমদের রেওয়ায়েতে সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেনঃ আমি মক্কায় একবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে দেখতে এলেন এবং আমার কপালে হাত রাখলেন। এছাড়া আমার মুখমণ্ডল, বুক ও পেটেও হাত বুলালেন। আমি আজ পর্যন্ত আমার কলিজায় পবিত্র হাতের শীতলতা অনুভব করি। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মোবারক মুখমণ্ডল লালিমা মিশ্রিত শুভ্র ছিল। অঙ্গুলিসমূহ মাংসল ছিল। তিনি না বেশি লম্বা ছিলেন, না বেঁটে। কেশ সম্পূর্ণ সোজাও ছিল না, সম্পূর্ণ কুঞ্চিত ছিল না। তিনি যখন হাঁটতেন, তখন পিছনে মানুষ লাফিয়ে চলত। সত্য এই যে, তাঁর মত কাউকে দেখা যায়নি। আবূ মূসা মুদায়নী আমদ ইবনে আবদ হাযরামী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখেছি। কিন্তু তাঁর মত না তাঁর আগে, না পরে কাউকে দেখেছি।- ইবনে সা’দের রেওয়ায়েতে আবদুল্লাহ ইবনে বুরায়দা (রাঃ) বলেনঃ রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর পদযুগল সকল মানুষের মধ্যে সুন্দরতম ছিল।ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখমণ্ডল শুভ্র’ লালিমা মিশ্রিত ছিল। তাঁর চক্ষু কাল ছিল। বুকে চুলের সরু রেখা ছিল। নাক পাতলা ও স্ফীত, ছিল। গাল সমতল ছিল। দাড়ি ঘন ছিল। মাথার কেশ কানের লতি স্পর্শ করত। ঘাড় রূপার সোরাহীর মত ছিল। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের রেখা ছিল। এছাড়া পেট’ও বুকে চুল ছিল না। তাঁর ঘাম মুখমণ্ডলে মোতির ন্যায় ঝলমল করত। তাঁর ঘামের গন্ধ মেশকের চেয়েও বেশি সুবাসিত ছিল।ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ নবী করীম (সাঃ) আমাকে এয়ামন প্রেরণ করেন। একদিন আমি জনতার উদ্দেশ্যে যখন খোতবা দিচ্ছিলাম, তখন এক ইহুদী আলেম হাতে কিতাব নিয়ে দণ্ডায়মান ছিল। সে কিতাব দেখে যাচ্ছিল। সে আমাকে বললঃ আবুল কাসেম (সাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনা করুন। আমি বর্ণনা করলাম যে, তিনি না বেশি লম্বা, না বেঁটে। তাঁর চুল না সম্পূর্ণ কোঁকড়া, না সম্পূর্ণ সোজা। তবে হাল্কা কুঞ্চিত ও কাল। মাথা বড়। রং লালিমা মিশ্রিত সাদা। গ্রন্থি বড় বড়। হাতের তালু ও পা মাংসল। বুকে চুলের হালকা রেখা আছে। পলক লম্বা। ভুরু মিলিত এবং ললাট প্রশস্ত। উভয় কাঁধের মাঝখানে দূরত্ব আছে। যখন হাঁটেন, তখন মনে হয় যেন নিচে অবতরণ করছেন। আমি তাঁর মত তার আগেও দেখিনি এবং পরেও দেখিনি।ইহুদী আলেম বললঃ তাঁর চোখে লাল ডোরা আছে। দাড়ি সুন্দর। মুখ সুন্দর। তিনি যখন মনোযোগ দেন, তখন পূর্ণ শরীর দিয়ে মনোযোগী হন। আর যখন ঘুরেন, পূর্ণ শরীরে ঘুরেন। আমি বললামঃ হাঁ, এগুলোও তাঁর গুণাবলী। এরপর ইহুদী আলেম বললঃ আরও একটি বিষয় আছে। আমি বললামঃ কি? সে বললঃ তাঁর মধ্যে ঝুঁকে চলা আছে। আমি বললামঃ এ কথা তো আমি আগেই বলেছি যে, তিনি যখন হাঁটেন, তখন মনে হয় যেন নিচে অবতরণ করছেন। ইহুদী আলেম
পৃষ্ঠা:২৭
বললঃ এ গুণটি আমি আমার বাপদাদার কিতাবে পেয়েছি। কিতাবে আরও উল্লেখিত আছে যে, তিনি আল্লাহর হেরেমে, শান্তির আবাসস্থলে এবং আপন গৃহ থেকে নবুওত লাভ করবেন। এরপর সেই হেরেমের দিকে হিজরত করবেন, যাকে তিনি নিজে হেরেম সাব্যস্ত করবেন। তাঁর সম্মানও আল্লাহর হেরেমের অনুরূপ হবে। তাঁর মদদগার ও আনছার, যাদের কাছে তিনি হিজরত করবেন, তাঁরা আমর ইবনে আমেরের বংশধর হবেন। তাঁরা খর্জুর বাগানের মালিক হবেন। তাদের পূর্বে এই ভূ-ভাগ ইহুদীদের করতলগত থাকবে। হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ আসলে তাই। ইহুদী আলেম বললঃ তা হলে আমি সাক্ষ্য দেই যে, তিনি নবী এবং সমগ্র মানব জাতির জন্যে আল্লাহর রসুল। ইবনে আসাকির হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কিছু সংখ্যক ইহুদী হযরত আলী (রাঃ)-এর কাছে এসে বললঃ আপনার চাচাত ভাইয়ের গুণাবলী বর্ণনা করুন। হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ মোহাম্মদ (সাঃ) না খুব লম্বা ছিলেন, না বেঁটে। তিনি মাঝারি গড়ন থেকে কিছু বেশি ছিলেন। রং ছিল লালিমা মিশ্রিত সাদা। চুল কোঁকড়া ছিল; কিন্তু সম্পূর্ণ কুঞ্চিত ছিল না। মাথার চুল কানের লতি পর্যন্ত ছিল। ললাট প্রশস্ত ছিল। গাল সুস্পষ্ট ছিল। চক্ষু কাল এবং ভূরু মিলিত ছিল। পলক দীর্ঘ এবং নাক উঁচু ছিল। বুকে চুলের সরু রেখা ছিল। দাঁত চমকদার ছিল। দাড়ি ঘন ছিল। গ্রীবা রূপার সোরাহীর মত ছিল। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত কিছু চুল ছিল; যেন কাল মেশকের ডোরা। শরীরে ও বুকে এছাড়া কোন চুল ছিল না। হাতের তালুতে পূর্ণিমার চাঁদের মত বৃত্ত ছিল। নূরের হরফে দু’ছত্র লেখা ছিল। উপরের ছত্রে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং নিচের ছত্রে মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ লিখিত ছিল। ইবনে আসাকির হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওফাতের পর বায়তুল-মোকাদ্দাসের জনৈক ইহুদী আলেম হযরত আলি (রাঃ)-এর কাছে এসে রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনা করতে বলল। হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) না বেশী লম্বা ছিলেন, না বেঁটে; বরং গড়ন মাঝারি ছিল। রং শুভ্র লালিমা মিশ্রিত ছিল। কোঁকড়া চুল কানের লতি পর্যন্ত দীর্ঘ ছিল। বক্ষ প্রশস্ত এবং গাল সমতল ছিল। ভূরু মিলিত এবং চক্ষু কাল ছিল। পলক লম্বা এবং নাক পাতলা ছিল। বুকের উপর চুলের একটি সরু রেখা ছিল। দাঁতের মধ্যে ফাঁক ছিল এবং দাড়ি ঘন ছিল। গ্রীবা রূপার সোরাহীর মত। মুখমণ্ডলে ঘামের ফোঁটা মোতির মত ঝলমল করত। হাতের তালু ও পা মাংসল ছিল। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত ডোরার মত চুলের একটি রেখা ছিল। এছাড়া পেটে ও পিঠে কোন চুল ছিল না। শরীর থেকে মেশকের মত সুগন্ধি বের হত। লোকজনের মধ্যে দণ্ডায়মান হলে সকলের চেয়ে উঁচু মনে হতেন। হাঁটার সময় মনে হত যেন কোন প্রস্তর খণ্ড থেকে অবতরণ করছেন। কারও প্রতি মনোযোগ দিলে পূর্ণ শরীরসহ মনোযোগ দিতেন। চলার সময় মনে হত যেন নিচে নামছেন। এসব কথা শুনে ইহুদী আলেম বললঃ আমি তওরাতে তাই পেয়েছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রসূল। বায়হাকী ও ইবনে আসাকির মুকাতিল ইবনে হাইয়ান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ওহী পাঠালেন- হে ঈসা। আমার আদেশ পালনে রত থাক। শুন এবং আনুগত্য কর। হে পূত, পবিত্র ও পরহেনগার মহিলার পুত্র, আমি তোমাকে পিতা ছাড়া সৃষ্টি করে সমগ্র বিশ্বের জন্যে নিদর্শন করেছি। আমারই এবাদত কর এবং আমারই উপর ভরসা কর। আমি আল্লাহ, চিরঞ্জীব ও চির প্রতিষ্ঠিত। নবী উম্মী আরবীকে সত্য বলে বিশ্বাস কর, যিনি উটওয়ালা ও শিরস্ত্রাণওয়ালা এবং যিনি মুকুটধারী, জুতা ওয়ালা এবং লাঠিওয়ালা। তাঁর মাথার কেশ কোঁকড়া, ললাট প্রশস্ত, ভুরু মিলিত, আয়তলোচন, পলক দীর্ঘ, চক্ষু কাল, নাক উঁচু, গাল সমতল এবং দাড়ি ঘন। মুখমণ্ডলে ঘাম মোতির মত ঝলমল করে। শরীর থেকে মেশকের সুগন্ধি আসে। গ্রীবা রূপার সোরাহীর মত। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত ডোরার মত চুলের একটি রেখা আছে। এছাড়া বুকে ও পেটে কোন চুল নেই। হাতের তালু ও পা মাংসল। মানুষের সাথে আগমন করলে তিনি তাদের চেয়ে উঁচু মনে হন। হাঁটার সময় মনে হয় যেন উচ্চভূমি থেকে নিম্নভূমিতে অবতরণ করছেন। তিনি সামান্য দ্রুত গতিতে চলেন। ইবনে সা’দ, তিরমিযী (শামায়েল), বায়হাকী, তিবরানী, আবু নয়ীম, ইবনে সাকান, ও ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত হাসান (রাঃ) বলেনঃ আমি আমার মামা হিনদ ইবনে আবীহালাকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দেহাবয়ব সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। তিনি হুযুর (সাঃ)-এর দেহাবয়ব অধিক পরিমাণে ও সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করতেন। আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেনঃ রসূলে করীম (সাঃ) আপন সত্তার দিক দিয়েও মহান ছিলেন এবং অপরের দৃষ্টিতেও অত্যন্ত মর্যাদাবান ছিলেন। তাঁর মোবারক মুখমণ্ডল পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝলমল করত। তাঁর গড়ন সম্পূর্ণ মাঝারি গড়নের চেয়ে কিছুটা দীর্ঘ ছিল। কিন্তু বেশি লম্বা গড়নের চেয়ে খাটো ছিলেন। মাথা সমতার পর্যায়ে বড় ছিল। কেশ যৎকিঞ্চিৎ কুঞ্চিত ছিল। মাথার কেশে আপনা আপনি সিথি হয়ে গেলে তিনি সিঁথি করতেন না। নতুবা সিঁথি করতেন। চুল কানের লতি পার হয়ে যেত। তাঁর রঙ অত্যন্ত চমকদার ছিল এবং ললাট প্রশস্ত। তাঁর ভুরু কুঞ্চিত, পাতলা ও ঘন ছিল। কিন্তু উভয় ভূরু মিলিত ছিল না। উভয়ের মাঝখানে একটি শিরা ছিল, যা ক্রোধের সময় স্ফীত হয়ে উঠত। তাঁর নাক কিছুটা উঁচু ছিল। দর্শক তাঁকে উন্নত নাসিকা বিশিষ্ট বলে মনে করত। কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে মনে হত যে, সুন্দরতা ও চাকচিক্যের কারণে উঁচু মনে হয়। নতুবা আসলে বেশি উঁচু নয়
পৃষ্ঠা:২৮
দাড়ি মন, চক্ষু, কাল, গাল সমতল, মুখ প্রশস্ত এবং দাঁত চিকন ও উইল ছিল। সম্মুখের দাঁতগুলোতে ফাঁক ছিল। শুফ থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের একটি রেখা ছিল। গ্রীবা রূপার মত স্বচ্ছ কোন মূর্তির গ্রীবার মত ছিল। তাঁর সমস্ত অঙ্গ ভারসাম্যপূর্ণ ও মাংসল ছিল। দেহ বলিষ্ঠ ছিল এবং পেট ও বুক সমতল ছিল। নাভি ও বুকের মাঝখানে একটি রেখার মত চুলের ডোরা ছিল। এছাড়া বক্ষদেশ চুলমুক্ত ছিল। তবে উভয় বাহু, কাঁধ এবং বুকের উপরি অংশে চুল ছিল। তাঁর কবজি লম্বা এবং হাতের তালু প্রশস্ত ছিল। হাতের তালু ও পা মাংসপূর্ণ ছিল। হাত-পায়ের অঙ্গুলি লম্বা ছিল। পায়ের তলা গভীর এবং পা সমতল ছিল। তাতে পানি থেমে থাকত না; সাথে সাথে গড়িয়ে পড়ত। চলার সময় জোরেসোরে পা তুলতেন এবং সামনের দিকে ঝুঁকে চলতেন। পা আস্তে মাটিতে রাখতেন। তিনি দ্রুতগতিসম্পন্ন ছিলেন। চলার সময় মনে হত যেন নিম্নভূমিতে অবতরণ করছেন। কোন দিকে মনোযোগ দিলে পূর্ণ শরীর ঘুরিয়ে মনোযোগ দিতেন। দৃষ্টি নত থাকত। দৃষ্টি আকাশের তুলনায় মাটির দিকে বেশি থাকত। সাধারণতঃ চোখের কোণ দিয়ে দৃষ্টিপাত করতেন। পথ চলার সময় সাহাবায়ে কেরামকে অগ্রে দিতেন। কারও সাথে সাক্ষাৎ করলে আগে সালাম করতেন।আমি বললামঃ এবার তাঁর কথাবার্তা সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেনঃ হুযুর (সাঃ) অধিকাংশ সময় চিন্তাযুক্ত ও ভাবনায় লিপ্ত থাকতেন। প্রায়ই চুপ থাকতেন। বিনা প্রয়োজনে কথা বলতেন না। কথাবার্তার সূচনা ও সমাপ্তি ঠোঁটের কিনারায় করতেন। সারগর্ভ বাক্যাবলী সহযোগে কথাবার্তা বলতেন। কথাবার্তায় কোন বাড়তি শব্দ থাকত না এবং কমও থাকত না। তিনি প্রফুল্লচিত্ত ছিলেন- কঠোর ছিলেন না। এতটুকু নেয়ামতকেও বিরাট মনে করতেন। কোন বস্তুর দোষ বলতেন না। কোন খাদ্যবস্তুকেই অপছন্দ করতেন না এবং ভারীফও করতেন না। ন্যায়-অন্যায়ের কোন ব্যাপার ঘটলে ন্যায় জয়যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর মানসিক অস্বস্তি দূর হত না। নিজের কোন ব্যাপারেই কখনও নারাজ হতেন না। ইশারা করলে পূর্ণ হাতের তালু দিয়ে ইশারা করতেন। বিস্ময় প্রকাশ করলে হাত উল্টিয়ে নিতেন। কথা বলার সময় ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি বাম হাতের তালুতে রাখতেন। অসন্তুষ্ট হলে মুখ ফিরিয়ে নিতেন এবং মন সংকুচিত হয়ে যেত। আনন্দিত হলে দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে নিতেন। তাঁর হাসি ছিল মুচকি হাসি। মুচকি হাসির সময় দাঁত শিলার মত ঝলমল করত।
মোবারক নামসমূহ
কোন কোন আলেম বলেনঃ নবী করীম (সাঃ)-এর এক হাজার নাম আছে। কিছু কোরআনে বর্ণিত আছে এবং কিছু প্রাচীন কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। বোখারী ও মুসলিমের রেওয়ায়েতে জুবায়র ইবনে মুতয়িম (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- আমার অনেক নাম। আমি মোহাম্মদ। আমি আগমন করবে না। আহমদ এবং আমি মাহী; অর্থাৎ কুফর বিলোপকারী। আমি হাশের; অর্থাৎ আমার পায়ের নিচে হাশরের ময়দান কায়েম হবে। আমি আকীব। আমার পরে কোন নবী আহমদ, তায়ালেমী, ইবনে সা’দ-হাকেম ও বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হযরত জুবায়র ইবনে মুতয়িম (রাঃ) বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি- আমি মোহাম্মদ আমি আহমদ। আমি হাশের। আমি মাহী। আমি হাতেম এবং আমি আকীব।তিবরাণী ও আবু নয়ীম জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ আমি মোহাম্মদ। আমি আহমদ। আমি হাশের এবং আমি মাহী।আহমদ ও মুসলিমের রেওয়ায়েতে হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের একাধিক নাম আমাদেরকে বলেছেন। তন্মধ্যে কিছু আমাদের মনে আছে এবং কিছু ভুলে গেছি। তিনি বলেছেন- আমি মোহাম্মদ। আমি আহমদ। আমি হাশের। আমি নবীয়ে তওবা, নবীয়ে মালহামা এবং নবীয়ে-রহমত।আহমদ, ইবনে আবী শায়বা ও তিরমিযীর রেওয়ায়েতে হযরত হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণনা করেন- মদীনার কোন রাস্তায় রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি বললেনঃ আমি মোহাম্মদ। আমি আহমদ। আমি নবীয়ে-রহমত। আমি নবীয়ে তওবা। আমি হাশের। আমি নবীয়ে মালাহেম; অর্থাৎ ন্যায়ের খাতিরে আমাকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।আবু নয়ীম, ইবনে মরদুওয়াইহি ও দায়লমী হযরত আবু তোফায়ল থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আমার পরওয়ারদেগারের কাছে আমার নাম দশটি মোহাম্মদ, আহমদ, ফাতেহ, হাতেম, আবুল কাসেম, হাশের, আকেব, মাহী, ইয়াসীন ও তোয়াহা। ইবনে মুজাহিদ রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ আমি মোহাম্মদ এবং আমি আহমদ। আমি রসূলে-রহমত। আমি রসূলে-মালহামা। আমি হাশের। আমি জেহাদের জন্যে প্রেরিত হয়েছি- চাষাবাদের জন্যে নয়। ইবনে আদী ও ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ (সঞ্চ) বলেছেনঃ কোরআনে আমার নাম মোহাম্মদ, ইনজীলে আহমদ এবং তওরাতে আহইয়াদ। কারণ, আমি আমার উম্মতকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করব।
পৃষ্ঠা:২৯
আবু নয়ীম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, প্রাচীন কিতাবসমূহে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এসব নাম রয়েছে- আহমদ, মোহামদ, মাহী, মুককী, নবীয়ে-মালাহেম, আহমতায়া, কারকলীতা, ও মামযায়। ইবনে ফারেস হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তওরাতে নবী করীম (সাঃ)-এর নাম এভাবে- আহমদ, মুচকি হাস্যকারী, যোদ্ধা, উষ্ট্রারোহী, পাগড়ি পরিধানকারী, স্বন্ধে তলোয়ারবাহী।আমি বলিঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নামাবলীর ব্যাখ্যায় আমি একটি কিতাব রচনা করেছি। যার মধ্যে কোরআন, হাদীস ও প্রাচীন কিতাবসমূহ থেকে তিনশ’ চল্লিশটি নাম সন্নিবেশিত করা হয়েছে। রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কতক নাম আল্লাহ তায়ালার নাম। কাযী আয়ায বলেনঃ নবী করীম (সাঃ)-এর এক বৈশিষ্ট্য এই যে, আল্লাহ তায়ালা আপন নামাবলীর মধ্য থেকে প্রায় ত্রিশটি নাম রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এরও নাম বলেছেন। সেগুলো এইঃ আকরাম, আমীন, আওয়াল, আখের, বশীর, জাব্বার, হক, খবীর, যুল কুওয়াহ, রউফ, রহীম, শহীদ, শাকুর, ছাদেক, আযীম, আফু, আলেম, আযীয, ফাতেহ, করীম, মুবীন, মুমিন, মোহায়মেন, মুকাদ্দাস, মওলা, ওলী, নূর, হাদী, তোয়াহা, ইয়াসীন। আমি বলিঃ আমাদের সামনে আরও কিছু নাম এসেছে, সেগুলো এইঃ আহাদ, আছদাক, আহসান, আছওয়াদ, আ’লা, আমের, নাহী, বাতেন, বার, বোরহান, হাশের, হাফেয, হাফীয, হাসীব, হাকীম, হালীম, হাইউ, খলীফা, দায়ী, রাফে’ রফীউদ্দারাজাত, সালাম, সাইয়্যিদ, শাকের, ছাবের, ছাহেব, তাইয়্যেব, তাহের, আদল, আলী, গালেব, গফুর, গনী, কায়েস, করীব, মাজেদ, মু’তী, নাসেখ, নাশের, ওয়াফা, হামীম ও নূন।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নাম আল্লাহতায়ালার নাম থেকে উদ্ভূত
হযরত হাসসান ইবনে ছাবেত (রাঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পরিচিতি দান প্রসঙ্গে বলেনঃ তিনি উজ্জ্বলমুখ, মোহরে-নবুয়তের বাহক। আল্লাহর নূর তাঁর উপর ঝলমল করছে। আল্লাহতায়ালা পাঞ্জেগানা আযানে তাঁর সম্মানিত নামকে নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছেন। তাঁর নাম নিজের নাম থেকে উদ্ধৃত করেছেন। সে মতে। আল্লাহ তায়ালার নাম মাহমূদ এবং তিনি মোহাম্মদ। বায়হাকী ও ইবনে আসাকির সুফিয়ান ইবনে ওয়ায়না থেকে এবং তিনি আলী ইবনে যায়েদ ইবনে জাদআন থেকে বর্ণনা করেন যে, সমাবেশের মধ্যে উপরোক্ত কবিতা পাঠ করা হয় এবং একে আরবের উৎকৃষ্টতম কবিতা সাব্যস্ত করা হয়। ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করলেন, তখন আবদুল মোত্তালিব একটি ভেড়া ঘঘেহ। করে তাঁর আকীকা করলেন। অভ্যাগতদের একজন প্রশ্ন করলঃ হে আবুল হারেছ। আপনি এই শিশুর নাম মোহাম্মদ রাখলেন কেন? কোন পারিবারিক নাম রাখলেন না কেন? আবদুল মোত্তালিব বললেনঃ আমি চাই যে, আকাশে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রশংসা করুন এবং পৃথিবীতেও মানুষের কাছে সে প্রশংসিত হোক।
মাতুলালয়ে প্রকাশিত মোজেযা
ইবনে সা’দ ইবনে আব্বাস, যুহরী ও আছেম ইবনে আমর ইবনে কাতাদাহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বয়স যখন ছয় বছর, তখন তাঁর জননী তাকে নিয়ে মদীনায় বনী আদী ইবনে নাজ্জারে গেলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচারিকা উম্মে আয়মানও ছিলেন। আমেনা শিশু নবীজীকে (সাঃ) নিয়ে নাবেগার গৃহে পৌঁছেন এবং সেখানে এক মাস অবস্থান করেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) এই সময়কার অনেক কথা মনে রেখেছিলেন। তিনি এই গৃহের দিকে তাকিয়ে বলতেনঃ আমার মা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। আমি বনী আদীর ক্ষুদ্র জলাশয়টিতে সাঁতার কাটতাম। ইহুদীরা তখন তাঁর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাত। উম্মে আয়মান বলেনঃ আমি এক ইহুদীকে বলতে শুনলামঃ ইনি এই উম্মতের নবী এবং এটা তাঁর হিজরতভূমি। আমি এ কথাটি স্মৃতির মণিকোঠায় সংরক্ষিত রেখেছিলাম। এরপর তাঁর জননী তাঁকে নিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে জননী ইন্তেকাল করেন। আবূ নয়ীম ও ওয়াকেদীর ওস্তাদগণ থেকে এমনিভাবে রেওয়ায়েত করেন। কিন্তু তাঁর রেওয়ায়েতে এই বিষয়বস্তুর উপর অধিক জোর দেয়া হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আমি এক ইহুদীকে আমার দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করতে দেখলাম। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলঃ তোমার নাম কি? আমি বললামঃ আহমদ। এরপর সে আমার পিঠের দিকে দেখে বললঃ সে এই উম্মতের নবী। এরপর আমি মামার কাছে যেয়ে এ কথা বললাম। তিনি আমার জননীকে বললেন। তিনি আমার সম্পর্কে ভীত হলেন এবং আমরা মদীনা থেকে ফিরে এলাম। উম্মে আয়মান বর্ণনা করতেন- একদিন মদীনায় বেশ বেলা হলে দু’ ইহুদী আমার কাছে এল এবং বললঃ আহমদকে একটু বাইরে আন। আমি বাইরে আনলে ওরা কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর একজন বললঃ সে এই উম্মতের নবী এবং এই শহর তাঁর দারুল-হিজরত। এখানে অনেক হত্যাকাণ্ড হবে এবং মানুষ বন্দী হবে। উম্মে আয়মান বলেনঃ আমি এসব কথা আমার স্মৃতিতে সযত্নে সংরক্ষিত রেখেছি।
পৃষ্ঠা:৩০
জননীর মৃত্যুর সময় প্রকাশিত মোজেযা
আবু নয়ীম যুহরী থেকে, তিনি উম্মে সুমাইয়া রিনতে জারহুম থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তাঁর জননী বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জননী হযরত আমেনার অন্তিম রোগশয্যায় উপস্থিত ছিলাম। রসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন পাঁচ-ছয় বছরের বালক ছিলেন এবং জননীর শিয়রে উপবিষ্ট ছিলেন। হযরত আমেনা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ প্রিয় বৎস। আল্লাহ তোমাকে বরকতময় করুন।হে মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের পুত্র। আল্লাহর নেয়ামতরাজির বদৌলতে লুটারীর সময় একশ’ উটের বিনিময়ে তোমার পিতা বেঁচে যান। আমার স্বপ্ন সত্য হলে তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির প্রতি প্রেরিত হবে। তুমি হেরেম ও হেরেমের বাইরে নিরাপত্তা সহকারে আবির্ভূত হবে। তুমি সেই দ্বীন নিয়ে প্রেরিত হবে, যা তোমার পিতা ইবরাহীমের ধর্ম। কেননা, আল্লাহ তোমাকে প্রতিমার পূজা থেকে বিরত রেখেছেন।এরপর বললেনঃ প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। প্রতিটি নতুন বস্তু পুরাতন হবে। প্রত্যেক বৃদ্ধ ধ্বংসশীল। আমিও মরে যাব। আমার স্মৃতি থেকে যাবে যে, আমি একটি কল্যাণ ছেড়ে গেছি এবং একটি পবিত্র সত্তাকে জন্ম দিয়েছি। এরপর আমেনার ইন্তেকাল হয়ে গেলে আমরা জিনদের এই শোকগাঁথা শুনে এবং তা মনে রেখেছি-: আমরা ক্রন্দন করছি যুবতী, সৎকর্মপরায়ণতা, সুন্দরী সতী আমেনার জন্যে। আবদুল্লাহর পত্নী, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জননী, ধীরস্থির, মদীনায় মিম্বরের অধিপতি এখন নিজের কবরে সমাহিত।
মক্কাবাসীদের বৃষ্টির জন্যে দোয়া
ইবনে সা’দ ইবনে আবিদ্দুনিয়া, বায়হাকী, তিবরানী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির মাখরামা ইবনে নওফেল থেকে, তিনি তাঁর জননী রুকায়কা বিনতে ছফী (আবদুল মুত্তালিবের যমজ ভগিনী) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি, বলেনঃ কোরায়শরা কয়েক বছর ধরে অনাবৃষ্টিতে পীড়িত ছিল। ফলে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মানুষ জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে এবং হাড্ডি পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। একদিন আমি নিদ্রিত অবস্থায় উচ্চস্বরে একটি গায়েবী আওয়াজ শুনলাম- হে কোরায়শ সম্প্রদায়। যে নবী তোমাদের মধ্য থেকে প্রেরিত হবেন, তাঁর আবির্ভাবের সময় সন্নিকটে। এখন তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। তোমরা জীবন ও সজীবতার দিকে এগিয়ে এস এবং নিজেদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তিকে তালাশ কর, যে সৎবংশোদ্ভূত ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, কোমল ত্বক ও শুভ্র বর্ণ, পলক ঘন, গাল সমতল, উঁচু নাকবিশিষ্ট, সেনিজের গৌরব নিজে গোপন করে, সে একটি আদর্শ জীবন পদ্ধতির দিকে মানুষকে আহবান করে। সে, তাঁর পুত্র ও পৌত্র এবং প্রত্যেক গোত্র থেকে বাছাই করা ব্যক্তিবর্গ সমবেত হয়ে নিজেদের উপর পানি ঢেলে দিবে, সুগন্ধি মাখবে, রোকন চুম্বন করবে এবং বায়তুল্লাহর মাতাফ তওয়াফ করবে। এরপর আবূ কুবায়স পাহাড়ে আরোহণ করবে। উপরোক্ত ধ্যক্তি যেন কওমের সরদার হয়। এরপর অজস্র ধারায় বৃষ্টিপাত হবে। রুকায়কা বলেনঃ এই স্বপ্ন দেখে আমি ভীত বিহ্বল ও কম্পমান হয়ে উঠে বসলাম। আমি আমার স্বপ্ন শুনালাম এবং মক্কার এক একটি গিরিপথে দন্ডায়মান হলাম। সকলেই আমাকে ‘শাবিয়াতুল-হামদ’ বলে আমার দিকে ধাবিত হল। প্রত্যেক গোত্র থেকে এক ব্যক্তি এসে গেল। তাঁরা সকলেই নিজেদের উপর পানি ঢালল, সুগন্ধি মাখল, রোকন চুম্বন করল এবং বায়তুল্লাহর তওয়াফ করল। অতঃপর আবু কুরায়স পাহাড়ে আরোহণ করে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেল। এরপর আবদুল মোত্তালিব দোয়ার জন্যে দণ্ডায়মান হলেন। তাঁর সঙ্গে রসূলুল্লাহ (সাঃ)ও ছিলেন। তিনি তখন কিশোর বয়সী ছিলেন। আবদুল মোত্তালিব দোয়া করলেনঃহে আল্লাহ। ক্ষুধা মিটিয়ে দাও। কষ্ট দূর কর। তুমি বিজ্ঞ, তোমার কাছেই প্রার্থনা। তোমার এই দাস ও দাসীরা তোমার হেরেমে সমবেত হয়েছে তোমার সামনে অনাবৃষ্টির অভিযোগ করার জন্যে। এতে জন্তু পশুপাল গৃহ পর্যন্ত খতম হয়ে গেছে। হে আলাহ। খুব বৃষ্টি বর্ষণ কর।তাঁদের সে স্থান ত্যাগ করার পূর্বেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেল। প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে নালা ভরে গেল। তখন দু’জন কোরায়শ সরদার আবদুল মোত্তালিবকে মোবারকবাদ জানালেন। এ ঘটনা সম্পর্কে রুকায়কা বললেনঃ যখন জীবন অচল হয়ে গেল এবং বৃষ্টির চিহ্নমাত্র রইল না, তখন ‘শাবিয়াতুল-হামদের’ দোয়ায় আল্লাহ পানি নাযিল করলেন। এতো বৃষ্টি বর্ষিত হল যে, সকল গর্ত ভরে গেল এবং জন্তু-জানোয়ার ও বৃক্ষ সবুজ ও সতেজ হয়ে গেল।
সকল কাজে সাফল্য
বোখারী (স্বীয় ইতিহাস গ্রন্থে) ইবনে সা’দ আবু ইয়ালা, তিবরানী, ইবনে আদী, হাকেম, বায়হাকী, আবু নয়ীম ও ইবনে মানদাহ কুযায়র ইবনে সায়ীদ ইবনে আবীহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তাঁর পিতা বর্ণনা করেন- আমি একবার জাহেলিয়াত যুগে হজ্ব করতে গেলাম। আমি এক ব্যক্তিকে দেখলাম যে, সে বায়তুল্লাহর তওয়াফরত অবস্থায় বলছেঃমোহাম্মদ। আমার উট নিয়ে এসে যাও। হে খোদা। মোহাম্মদকে ফিরিয়ে আন এবং আমার প্রতি রহম কর। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, লোকটি কে? লোকেরা
পৃষ্ঠা ৩১ থেকে ৪৪
পৃষ্ঠা:৩১
বললঃ সে আবদুল মোত্তালিব। তিনি আপন পৌত্রকে উটের অন্বেষণে প্রেরণ করেছেন। তিনি পৌত্রকে যে কাজেই পাঠান, পৌত্র তাতে সফলকাম’ হয়। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল যে, নবী করীম (সাঃ) উট নিয়ে এসে গেছেন। বায়হাকী ও ইবনে আদী বাহস ইবনে হাকীম থেকে, তিনি আপন পিতা থেকে এবং তিনি আপন দাদা মুয়াবিয়া ইবনে হায়দা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, মূর্খতা যুগে তিনি ওমরা করার উদ্দেশ্যে বের হন। তিনি এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, তওয়াফ করছে আর বলে যাচ্ছেঃ মোহাম্মদ। আমার উট নিয়ে চলে এস। হে খোদা! মোহাম্মদকে ফিরিয়ে আন এবং আমার প্রতি রহম কর। আমি বললামঃ লোকটি কে? লোকেরা বললঃ কোরায়শ সরদার আবদুল মোত্তালিব। তাঁর অনেক উট। কিছু উট হারিয়ে গেলেই তিনি পুত্রদেরকে তালাশ করতে পাঠিয়ে দেন। তাঁরা উট তালাশ করে না পেলে তিনি পৌত্রকে উট খুঁজে আনতে পাঠিয়েছেন, যা খুঁজে আনতে পুত্ররা ব্যর্থ হয়েছে। অনেকক্ষণ হয় পৌত্র খোঁজ করতে গেছে। আমি সেখানে থাকতে থাকতেই হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) উট নিয়ে এসে গেলেন।
আবদুল মোত্তালিব নবী করীম (সাঃ)-এর মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন
ইবনে ইসহাক, বায়হাকী ও আবু নয়ীম আব্বাস ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মা’বাদ থেকে এবং তিনি তাঁর পরিবারের একজন থেকে বর্ণনা করেন যে, আবদুল মোত্তালিবের জন্যে কা’বা গৃহের ছায়ায় ফরশ বিছানো হত। তিনি এর উপর বসতেন। তাঁর পুত্রদের মধ্যে কেউ সম্মানের খাতিরে তাঁর আসনে বসত না। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সাঃ) এসে সোজা দাদার আসনে বসে যেতেন। চাচারা তাঁকে সেখান থেকে সরাতে চাইলে দাদা বলতেনঃ আমার বাছাকে থাকতে দাও। এরপর তিনি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিঠে হাত বুলাতেন এবং বলতেনঃ আমার এই বাছাধনের বিরাট মর্যাদা হবে। আবদুল মোত্তালিবের যখন ওফাত হয়, তখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) আট বছরের ছিলেন। আবদুল মোত্তালিব তাঁর সম্পর্কে আবু তালেবকে ওছিয়ত করে যান। আবু নয়ীম আতা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এমনিভাবে রেওয়ায়েত করেছেন। তবে তিনি নিম্নোক্ত কথাগুলোও সংযোজন করেছেন। আমার বাছাকে এই ফরশে বসতে দাও। সে তাঁর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন। আমি আশা করি সে এমন গৌরব অর্জন করবে, যা কোন আরব তাঁর পূর্বেও অর্জন করোন এবং পরেও অর্জন করবে না। ইবনে সা’দ, ইবনে আসাকির ও যুহরী মুজাহিদ ও নাফে ইবনে জুবায়র থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) দাদার বিছানায় বসে যেতেন। তাঁর চাচা তাকে সরাতে চাইলে দাদা বলতেনঃ আমার বাছাকে থাকতে দাও। সে তে ফেরেশতা তুল্য। বনী মুদাল্লাজের কিছু লোক আবদুল মোত্তালিবকে বললঃ এই শিশুর হেফাযত করবেন। কেননা তাঁর মত পা আমরা কারও দেখিনি। আবদুল মোত্তালিব উম্মে আয়মানকে বলতেনঃ হে বরকাহ! এই শিশু থেকে কখনও গাফেল থাকবে না। কেননা, আহলে- কিতাবেয় ধারণা সে এই উম্মতের নবী হবে। আবু নয়ীম ও ওয়াকেদী থেকে এবং তিনি আপন ওস্তাদগণ থেকে বর্ণনা করেস যে, একবার আব্দুল মোত্তালিব হাজারে-আসওয়াদের কাছে উপবিষ্ট ছিলেন। তাঁর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলেন তাঁর বন্ধু নাজরানের এক পাদ্রী। তিনি আবদুল মোত্তালিবকে বললেনঃ ইসমাঈলের (আঃ) বংশধরের মধ্যে যে নবী অবশিষ্ট আছেন, আমরা তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। এই শহর তাঁর জন্মস্থান এবং তাঁর এই এই গুণ। রসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে আগমন করলে পাদ্রী তাঁকে দেখলেন। তাঁর চক্ষু, পৃষ্ঠ ও পা দেখে তিনি বললেন: এ-ই সেই ব্যক্তি। এই বালক আপনার কি হয়? আবদুল মোত্তালিব বললেনঃ আমার পুত্র। পাদ্রী বললেন: না, তাঁর পিতা জীবিত নেই। আবদুল মোত্তালিব বললেনঃ সে আমার পৌত্র। সে যখন মায়ের পেটে ছিল, তখন তার পিতার ইন্তেকাল হয়। পাদ্রী বললঃ ঠিক। এরপর আবদুল মোত্তালিব পুত্রদেরকে বললেনঃ তোমরা তোমাদের ভ্রাতুষ্পুত্রকে হেফাযত করবে। শুনলে তো তার সম্পর্কে কি বলা হচ্ছে? বায়হাকী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির সাকীর ইবনে যারকা ইবনে সায়ফ ইবনে যী ইয়ামন থেকে, তিনি আপন পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর জন্মের দু’বছর পর সায়ফ ইবনে যী ইয়ামন আবিসিনিয়া জয় করে। তাকে মোবারকবাদ জানানোর জন্য কোরায়শদের একটি প্রতিনিধি দল আগমন কবে। তাদের মধ্যে আবদুল মোত্তালিবও ছিলেন। সায়ফ বললঃ হে আবদুল মোত্তালিব। আমি আমার জ্ঞান থেকে তোমাকে একটি গোপন কথা বলছি, যা তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বলতাম না। আমার বিশ্বাস তুমি এই গোপন কথার যথার্থ আমানতদার প্রমাণিত হবে। তুমি একথাটি সর্বদা গোপন রাখবে আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত। আমাদের কাছে ঐশী গ্রন্থের যে জ্ঞানভাণ্ডার রয়েছে, তাতে আমি পাই যে, এক মহাকল্যাণ আত্মপ্রকাশ করবে এবং একটি বিরাট ঘটনা সংঘটিত হবে, যার মধ্যে সমগ্র মানবজাতি এবং তোমার গোত্রের জন্যে, বিশেষতঃ তোমার জন্যে বিরাট গৌরব নিহিত আছে।আবদুল মোত্তালিব প্রশ্ন করলেন। সেটা কি? যীইয়ামন বললেনঃ মক্কার ভূখণ্ডে এক শিশু জন্মগ্রহণ করবে, যার উভয় কাঁধের মাঝখানে একটি তিল থাকবে। সে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্যে ইমাম ও সরদার হবে। এটাই তাঁর জন্মের সময় অথবা সম্ভবতঃ তাঁর জন্ম হয়ে গেছে। তাঁত নাম
পৃষ্ঠা:৩২
হবে মোহাম্মদ। সে পিতৃমাতৃহীন এতিম হবে। তাঁর দাদা ও চাচা তাঁর লালন পালন করবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবুওতের বিকাশ ঘটাবেন। আমাদেরকে করবেন তাঁর সাহায্যকারী। তাঁর বন্ধুরা তাঁর মাধ্যমে ইয্যত ও সম্মান অর্জন করবে এবং তাঁর শত্রুরা লাঞ্ছিত হবে। বন্ধুদের সাহায্যে তিনি দেশ জয় করবেন। তিনি আল্লাহর এবাদত করবেন এবং প্রতিমাসমূহ ভেঙ্গে দিবেন। তাঁর কথা চূড়ান্ত ফয়সালাকারী এবং তাঁর নির্দেশ ন্যায়ভিত্তিক হবে। সৎকাজের আদেশ করবেন এবং তা আনজাম দিবেন। মন্দকে প্রতিহত করবেন এবং খতম করবেন। পর্দাবিশিষ্ট গৃহের কসম, তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর দাদা। তুমি এরূপ কোন বিষয় অনুভব করেছ কি? আবদুল মোত্তালিব বললেনঃ হাঁ জাঁহাপনাহ। আমার এক আদরের পুত্র ছিল। আমি বংশের এক সম্ভ্রান্ত কন্যার সাথে তার বিবাহ দিয়েছিলেন। তার গর্ভ থেকে এক শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। আমি তার নাম রেখেছি মোহাম্মদ। তার পিতামাতা উভয়েই ইন্তেকাল করেছে। আমি এবং তার চাচা তাকে লালন-পালন করি। সায়ফ বললেন: আমিও তাই বলেছি। এই শিশুর হেফাযত করবেন এবং ইহুদীদের শ্যেন দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। কারণ, তাঁরা তাঁর শত্রু। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে সফলতা দিবেন না। যদি আমি না জানতাম যে, তাঁর আবির্ভাবের পূর্বেই মৃত্যু আমাকে খতম করে দিবে, তবে আমি আমার সকল পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে মদীনায় পৌঁছে যেতাম। কারণ, তিনি মদীনায় সফলতা লাভ করবেন। সেখানে তাঁর মদদগার থাকবে এবং সেখানেই তাঁর ইন্তেকাল হবে। আবূ নয়ীম, খারায়েতী ও ইবনে আসাকির ও কলবী থেকে, তিনি আবু ছালেহ থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এমনিভাবে রেওয়ায়েত করেছেন।ওয়াকেদী ও আবু নয়ীম আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব ইবনে মালেক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমার পরিবারের বড়দের মুখ থেকে শুনেছি যে, আবদুল মোত্তালিবের জীবদ্দশায় একবার তাঁরা ওমরার উদ্দেশ্যে গমন করেন। তাদের সঙ্গে তায়মার এক ইহুদীও ছিল। সে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মক্কা, অথবা এয়ামন যাচ্ছিল। সে আবদুল মোত্তালিবকে দেখে বললঃ আমাদের কিতাবে আছে এই ব্যক্তির বংশধর থেকে এক নবী জন্মগ্রহণ করবে। তিনি নিজে এবং তাঁর স্বজাতি আমাদেরকে কওমে-আদের মত ধ্বংস করবে।ইবনে সা’দ আবূ হাসেম থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন এক অতিন্দ্রীয়বাদী মক্কায় আসে। সে রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে আবদুল মোত্তালিবের সঙ্গে দেখে বললঃ হে কোরায়শ পরিবার। এই শিশুকে হত্যা কর। কেননা, সে তোমাদেরকে হত্যা করবে। অতিন্দ্রীয়বাদীর এই সাবধানবাণীর কারণে কোরায়শরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত ভয় করতে থাকে। আবু ইবনে সা’দ আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির আতা ইবনে আবী রাবাহ থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেবের সন্তানরা সকালে চোখে ময়লা মালিন্য নিয়ে ঘুম থেকে উঠত। আর রসূলুল্লাহ (সাঃ) পাক ছাফ ও সজীব অবস্থায় গাত্রোত্থান করতেন। আবু তালেব শিশুদের সামনে খাবারের পাত্র রে দিতেন। শিশুরা হুড়াহুড়ি করে তা থেকে খাদ্য গ্রহণ করত। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সাঃ) হাত গুটিয়ে রাখতেন। তাঁর এই অভ্যাস দেখে আবু তালেব তাঁকে আলাদা খাবার দিতে থাকেন। ইবনে, সা’দ আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির আতা থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস ও মোজাহিদ প্রমুখ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাড়া আবু তালেবের পরিবারবর্গ সম্মিলিতভাবে কিংবা একা একা আহার করত, তখন তাদের পেট ভরত না। কিন্তু যখন রসুলুল্লাহ (সাঃ) সঙ্গে থাকতেন, তখন সকলের পেট ভরে যেত। সে মতে সকাল কিংবা সন্ধ্যায় খাওয়ার সময় হলে আবু তালেব বলতেনঃ খাম, আমার বাছাধন আসুক। এরপর তিনি আগমন করতেন এবং তাদের সাথে আহার করতেন। তখন সকলে পেট ভরে খেয়েও আহার্য বেঁচে যেত। পক্ষান্তরে তিনি শরীক না হলে সকলে ক্ষুধার্ত থাকত। দুধ হলে চাচা প্রথমে তাঁকে পান করাতেন। এরপর সকলেই এই পিয়ালা থেকে পান করত এবং তৃপ্ত হয়ে যেত। এই অবস্থা দেখে আবু তালেব বলতেনঃ তুমি খুবই বরকতময়। আবু নয়ীম ওয়াকেদী থেকে, তিনি মোহাম্মদ ইবনে হাসান ইবনে ওসামা ইবনে যায়েদ থেকে, তিনি আপন পরিবারবর্গ থেকে এবং তাঁরা উম্মে আয়মান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেছেনঃ আমি কখনও রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ক্ষুধা ও পিপাসার কথা বলতে শুনিনি। তিনি সকাল সকাল যমযমের পানি পান করে নিতেন। আমরা নাশতা দিলে বলতেনঃ আমার পেট ভরা আছে। ইবনে সা’দ এ রেওয়ায়েতটি অন্য সনদে বর্ণনা করেছেন, যাতে এ কথাগুলোও সংযোজিত আছে- তিনি ক্ষুধা ও পিপাসার অভিযোগ না শৈশবে করেছেন, না বড় হয়ে। ইবনে সা’দ ইবনে কিবতিয়া থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেবের জন্যে বাতহায় তাকিয়া রাখা হত, যাতে তিনি ঠেস দিয়ে বসতেন। এটা ভাঁজ করা ছিল। রসূলুল্লাহ (সাঃ) এসে সেটা খুলে তাঁর উপর শুয়ে পড়লেন। আবু তালেব এসে বললেনঃ আমার ভাতিজা বেশ আরাম পাচ্ছে। ইবনে সা’দ আমর ইবনে সায়ীদ থেকেও এমনিভাবে রেওয়ায়েত করেছেন।
পৃষ্ঠা:৩৩
তিবরানী আমার থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেব মক্কাবাসীদের জন্যে ভোজের আয়োজন করতেন। নবী করীম (সাঃ) সেখানে এলে ততক্ষণ উপবেশন করতেন না, যতক্ষণ নিচে কোন কিছু বিছিয়ে না দেয়া হত। আবূ তালেব বলতেন। আমার ভাতিজা খুবই সুরুচি সম্পন্ন।
আবু তালেবের সঙ্গে সিরিয়া সফর
ইবনে আবী শায়বা, তিরমিযী, হাকেম, বায়হাকী, আবু নয়ীম ও খারায়েতী (হাওয়াতেক গ্রন্থে) আবু মুসা আশআরী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেব কোরায়শের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সাথে সিরিয়া সফরে রওয়ানা হলেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ)ও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এক সন্নাসীর আস্তানার কাছে পৌঁছে তাঁরা যাত্রা বিরতি করলেন। সন্ন্যাসী তাদের কাছে চলে এল। অথচ এর আগে যখন তাঁরা গমন করতেন, তখন সন্ন্যাসী তাদের কাছে আসত না এবং তাঁদের প্রতি সুক্ষেপও করত না। সে এসে তাঁদের মধ্যে ঘুরাফেরা করতে লাগল। অবশেষে সে এসে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাত ধরে ফেলল। এবং বললঃ সে সাইয়্যিদুল আলামীন, সে রসূলু রাব্বিল আলামীন। এঁকেই আল্লাহ রহমাতুল্লিল আলামীন করে প্রেরণ করেছেন। কোরায়শী প্রবীণরা বললঃ এ কথা তুমি কিরূপে জানতে পারলে? সে বললঃ যখন তোমরা গিরিপথ দিয়ে আসছিলে, তখন সে যে কোন বৃক্ষ ও পাথরের কাছ দিয়ে এসেছে, সকলেই তাকে সিজদা করেছে। বৃক্ষ ও পাথর কেবল নবীকেই সেজদা করে। আমি তাঁকে সেই মোহরে-নবুওয়তের সাহায্যে শনাক্ত করতে পারি, যা তাঁর কাঁধের নবম হাড্ডির নিচে একটি আপেলের আকারে রয়েছে। এরপর সন্ন্যাসী ফিরে গেল এবং সকলের জন্যে খাদ্য তৈরী করে নিয়ে এল। তখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) উট চরাতে গিয়েছিলেন। সন্ন্যাসী বললঃ তাঁকে ডাক। যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) এলেন, তখন একটি মেঘখও তাঁর উপর ছায়া করছিল। সন্ন্যাসী বললঃ দেখ, মেঘখণ্ড তাঁকে কিরূপে ছায়া দিচ্ছে। তাঁর আগমনের পূর্বেই সকলে বৃক্ষের ছায়ায় বসে গিয়েছিল। তিনি এলে বৃক্ষের ছায়া তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ল। সন্ন্যাসী বললঃ দেখ, বৃক্ষের ছায়া তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সন্ন্যাসী তাদের কাছে দাঁড়িয়ে কসম দিয়ে বলতে লাগলঃ তোমরা তাঁকে রোম নিয়ে যেয়ো না। কেননা, রোমকরা তাঁকে চিনে ফেলবে এবং হত্যা করবে। এরপর সন্ন্যাসী সেখান থেকে রওয়ানা হতেই নয়জন রোমককে আসতে দেখল। সে জিজ্ঞাসা করল। কেন এসেছ? তারা বললঃ আমরা সেই নবীর খোঁজে এসেছি, যে এই শহরে প্রকাশ পাবে। তাঁর খোঁজে চতুর্দিকে, লোক পাঠানো হয়েছে। সন্ন্যাসী বললঃ তোমরা কি মনে কর যদি আল্লাহ কোন কাজের ইচ্ছা করেন, তবে মানুষ তা প্রতিহত করতে পারে। তাঁরা বললঃ না। অতঃপর এই রোমকরা সন্ন্যাসীর হাতে বয়াত হয়ে তাঁর কাছেই অবস্থান করল।সন্ন্যাসী কোরায়শদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলঃ তোমাদের মধ্যে এই বালকের ওলী কে? তাঁরা বললেনঃ আবু তালেব। এরপর সন্ন্যাসী তাঁকে বারবার কসম দিয়ে বললঃ এই বালককে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। অগত্যা আবু তালেব তাঁকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলেন। সন্ন্যাসী রসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে পিঠা ও যয়তুনের তৈল উপহার দিল।ইবনে-হজর “আল-এছাবা” গ্রন্থে বলেনঃ এই হাদীসের রেওয়ায়েতকারীগণ নির্ভরযোগ্য। কোন রাবীই “মুনকার” নন। বায়হাকী ইবনে ইসহাক থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেব রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অভিভাবক ছিলেন। তিনি তাঁকে নিয়ে এক কাফেলার সাথে সিরিয়া রওয়ানা হন। কাফেলা বুছরা যেয়ে যাত্রা বিরতি করল। নিকটস্থ একটি গির্জায় বুহায়রা নামক এক সন্ন্যাসী বসবাস করত। সে খৃষ্টানদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তি ছিল। খৃষ্টানদের মধ্যে বংশ পরম্পরায় যে জ্ঞান প্রচলিত ছিল, সে সে সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিল। কোরায়শদের কাফেলা প্রায়ই এ পথে গমন করত; কিন্তু বুহায়রা কারও সাথে কথা বলত না এবং কারও মুখোমুখিও হত না। এবার যখন কোরায়শী কাফেলা তাঁর গির্জার কাছে অবতরণ করল, তখন সে তাঁদের জন্যে একটি ভোজের আয়োজন করল। সে কোন কিছু দেখেছিল। কাফেলার আসার সময় সে গির্জায় বসে লক্ষ্য করছিল যে, কাফেলার উপর একটি সাদা মেঘখণ্ড ছায়া দান করছিল। কাফেলা গির্জার কাছে এসে একটি বৃক্ষের ছায়াতলে বসে গেল। সন্ন্যাসী দেখল যে, মেঘখণ্ড বৃক্ষের উপরে এসে গেছে এবং বৃক্ষের শাখা পল্লব একজন বালকের উপর ঝুঁকে পড়েছে। বালক সেই বৃক্ষ শাখার ছায়ায় বসে গেলেন। বুহায়রা সন্ন্যাসী এসব দেখে গির্জা থেকে অবরণ করল এবং খাদ্য প্রস্তুত করার নির্দেশ দিল। এরপর কাফেলার লোকজনকে বলে পাঠালঃ আমি তোমাদের সকলের জন্যে খাদ্য প্রস্তুত করেছি। আমি চাই তোমরা ছোটবড় সকলেই আমার দাওয়াত গ্রহণ কর। কাফেলার এক ব্যক্তি বললঃ হে বুহায়রা। আজ তোমার আচরণ অভূতপূর্ব। এর আগে তো তুমি কখনও এরূপ করনি। আমরা প্রায়ই তোমার কাছ দিয়ে গমন করেছি। আজ কি হল? বুহায়রা বললঃ তোমার কথা ঠিক। কিন্তু তোমরা মেহমান। আমি তোমাদের আপ্যায়ন করতে চাই। তোমাদের সকলের জন্যে খাদ্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। সে মতে কাফেলার সকলেই সমবেত হল। কিন্তু কম বয়স্ক হওয়ার কারণে রসূলুল্লাহ (সাঃ) উটগুলোর নিকটে বৃক্ষের ছায়ায় বসে রইলেন। বুহায়রা লোকদের প্রতি at দৃষ্টিপাত করে ইন্দিত গুণাবলী কারও মধ্যে দেখতে পেল না। সে বললঃ কোরায়শগণ। আমার ভোজসভায় যেন কেউ অনুপস্থিত না থাকে। তাঁরা বললঃ
পৃষ্ঠা:৩৪
তারা মোহাম্মদ (সাঃ)-এর মধ্যে বিষণ্ণ মনের বিষণ্ণতা দূর হওয়ার মত বিষয়াদি প্রত্যক্ষ করল। তারা দেখল প্রত্যেক শহরের সন্ন্যাসীরা তাঁকে সেজদা করে যাচ্ছে। যুবায়র, তাম্মাম ও ইদরীস এসব বিষয় দেখল; অথচ তারা কুমতলব নিয়ে এসেছিল। বুহায়রা তাদেরকে বুঝালে তারা অনেক তর্ক বিতর্কের পর মেনে নিল। অনুরূপভাবে সে ইহুদীদেরকে বুঝাল এবং আল্লাহর পথে তাদের সাথে জেহাদ করল।তাঁর উপদেশ বিফল হয়নি; বরং উপকারই সিদ্ধ হয়েছে। সে আরও বললঃ আমি তাঁর বিরুদ্ধে হিংসুটেদের ভয় করি। কেননা, তাঁর নাম ঐশী গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত আছে। আবু নয়ীম ওয়াকেদী থেকে এবং তিনি আপন ওস্তাদগণ থেকে এমনিভাবে রেওয়ায়েত করেছেন। এই রেওয়ায়েতে এ কথাগুলোও আছে- বুহায়রা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চোখের লালিমা দেখে জিজ্ঞাসা করলঃ এই লালিমা সব সময় থাকে, না কোন সময় খতমও হয়ে যায়? লোকেরা বললঃ সব সময় থাকে। এরপর সে নিদ্রা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। জবাবে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ আমার চক্ষু নিদ্রিত হয় এবং আমার অন্তর জাগ্রত থাকে। এই রেওয়ায়েতে তোমার এই পুত্র বড় মর্যাদাবান এ কথার পরে এ বাক্যও রয়েছে, আমরা আমাদের কিভাবে এবং বাপদাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান-ভাণ্ডারে তাঁর বিরাট মর্যাদা দেখতে পাই। আমাদের কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। আবু তালেব প্রশ্ন করলেন: কেন অঙ্গীকার নিয়েছে? সে বললঃ আল্লাহ তায়ালা আমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন এবং এই অঙ্গীকার সহকারে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) আগমন করেছেন। ইবনে সা’দ এই রেওয়ায়েত দাউদ ইবনে হুছাইন থেকে এমনিভাবে বর্ণনা করেছেন এবং তাতে এ কথাও রয়েছে যে, তখন নবী করীম (সাঃ)-এর-বয়স ছিল বার বছর। আবু নয়ীম হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেব কোরায়শদের একটি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া সফরে রওয়ানা হন। তিনি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কেও সঙ্গে নিয়ে যান। দ্বিএহরের গরমের সময় বুহায়রা সন্ন্যাসীর নিকটে পৌঁছুলে সে দৃষ্টি তুলে তাকাল। সে দেখল যে, একখণ্ড মেঘ নবী করীম (সাঃ)-কে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে সে খাদ্য প্রস্তুত করাল এবং সকলকে তার বুহায়রা। কেউ অনুপস্থিত নেই একটি বালক ছাড়া, যার বয়স সবার চেয়ে কম। সে উটগুলো দেখাশুনা করতে রয়ে গেছে। বুহায়রা বললঃ না এরূপ করো না। তাকেও ডেকে আন, যাতে সে-ও তোমাদের সাথে শরীক হতে পারে। জনৈক কোরায়শী বললঃ লাত ও ওযযার কসম, এটা খুবই লজ্জার কথা যে, আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মোত্তালিবের পুত্র আমাদের সাথে আহারে শরীক হবে না। এ কথা বলে সে চলে গেল এবং রসূলে করীম (সাঃ)-কে কোলে তুলে নিয়ে এল এবং মজলিসে বসিয়ে দিল। বুহায়রা তাঁকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগল এবং তাঁর শরীরে আলামত তালাশ করতে লাগল। আহার শেষে সকলেই যখন এদিক ওদিক চলে গেল, তখন বুহায়রা তাঁর কাছে এসে বললঃ বৎস। আমি তোমাকে লাত ও ওযযার কসম দিয়ে বলছি- আমি যা জিজ্ঞেস করব, তার সঠিক উত্তর দিবে। রসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ আমাকে লাত ও ওযযার কসম দিয়ে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। কেননা, আল্লাহর কসম, আমি কোন বস্তুকে এতটুকু ঘৃণা করি না, যতটুকু লাত ও ওযযাকে করি। বুহায়রা বললঃ তা হলে আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি যা জিজ্ঞাসা করি, তার জবাব দাও। তিনি বললেনঃ যা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা কর। বুহায়রা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিদ্রা ও অন্যান্য অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করল। তিনি জবাব দিলেন। এসব জবাব বুহায়রার জানা তথ্যাবলীর হুবহু অনুরূপ ছিল। এরপর সে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পৃষ্ঠে উভয় কাঁধের মাঝখানে মোহরে-নবুওয়ত দেখল। এ কাজ সমাপ্ত হলে সে আবু তালেবকে জিজ্ঞাসা করলঃ এই কিশোর তোমার কি হয়? তিনি বললেনঃ সে আমার পুত্র। বুহাররা বললঃ সে তোমার পুত্র নয়। কেননা, তাঁর পিতা এখন জীবিত থাকার কথা নয়। আবু তালেব বললেনঃ সে আমার ভাতিজা। সে বললঃ তাঁর পিতার কি হয়েছে? আবু তালেব বললেনঃ সে যখন মাতৃগর্ভে, তখনই তার পিতার ইন্তেক্লাল হয়ে গেছে। বুহায়রা বললঃ তোমার কথা ঠিক। তুমি তোমার ভাতিজাকে আপন শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যাও এবং তাকে ইহুদীদের কবল থেকে রক্ষা কর। আমি যা জেনেছি, তারা তা জানতে পারলে তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। কারণ, ভবিষ্যতে তোমার এই ভাতিজার বিরাট মর্যাদা হবে। তাই অনতিবিলম্বে তাঁকে দেশে নিয়ে যাও। সেমতে আবু তালেব তাড়াহুড়া করে সিরিয়ার ব্যবসা সমাও করে তাঁকে মক্কায় নিয়ে এলেন। কথিত আছে যুবায়র, তাম্মাম ও ইদরীস নামীয় তিনজন খৃষ্টান সিরিয়া সফরের সময় কিশোর নবীজীর মধ্যে কিছু বিষয় দেখে তাঁর ক্ষতি করার ইচ্ছা করে। কিন্তু বুহায়রা এ কথা বলে তাদেরকে নিরস্ত করে যে, ঐশী গ্রন্থে তাঁর এই এই গুণাবলী উল্লিখিত আছে। তোমরা সকলে মিলে চাইলেও তাঁকে কাবু করতে পারবে না। সকলেই তার এ কথা মেনে নেয় এবং ফিরে চলে যায়। হযরত আবু বকর এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত কবিতা বলেনঃ
পৃষ্ঠা:৩৫
গির্জায় দাওয়াত করল। নবী করীম (সাঃ) গির্জায় প্রবেশ করলে গির্জা স্বর্গীয় আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। এ অবস্থা দেখে বুহায়রা চীৎকার করে বললঃ “সে আল্লাহর নবী। আল্লাহ তাকে আরব থেকে সমগ্র মানব জাতির জন্যে আবির্ভূত করবেন।” ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির আবদুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আকীল থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আবু তালেব নবী করীম (সাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়া সফরে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে এক গির্জাবাসীর কাছে অবতরণ করলে সে জিজ্ঞাসা করলঃ এই বালক তোমার কি হয়? আবু তালেব বললেনঃ আমার পুত্র। সে বললঃ না, তোমার পুত্র নয়। তাঁর পিতার জীবিত থাকার কথা নয়। কেননা, তাঁর মুখমণ্ডল নবীর মুখমণ্ডল এবং তাঁর চক্ষু নবীর চক্ষু অনুরূপ। আবু তালেব জিজ্ঞাসা করলেনঃ নবী কি? সে বললঃ যার উপর সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে ওহী নাযিল করা হয়। সে পৃথিবীর মানুষকে সে সম্পর্কে অবহিত করে। আবু তালেব বললেনঃ ঠিক আছে। সে বললঃ তাকে ইহুদী সম্প্রদায় থেকে হেফাযত করে রাখ। রাবী বলেনঃ আবু তালেব এখান থেকে সম্মুখে অগ্রসর হলেন এবং অন্য এক সন্ন্যাসীর কাছে পৌঁছুলেন। সেও প্রশ্ন করলঃ এই বালক তোমার কে? আবু তালেব বললেনঃ আমার পুত্র।সে বললঃ সে তোমার পুত্র নয়। তাঁর পিতা জীবিত নেই। তাঁর মুখমণ্ডল নবীর মুখমণ্ডল এবং তাঁর চক্ষু নবীর চক্ষু। আবু তালেব বললেনঃ সোবহানাল্লাহ, তুমি ঠিক বলেছ। এরপর আবু তালেব নবী করীম (সাঃ)-কে সম্বোধন করে বললেন, ভাতিজা। শুনলে তো তোমার সম্পর্কে কি বলা হচ্ছে? তিনি বললেনঃ চাচাজান! আল্লাহর কুদরতের তো পারাপার নেই; হতেও পারে। ইবনে সা’দ সায়ীদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবসা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, সন্ন্যাসী হযরত আবু তালেবকে বললঃ আপন ভাতিজাকে এখান থেকে সম্মুখে নিয়ে যাবেন না। কেননা, ইহুদীরা তাঁর শত্রু এবং সে এই উম্মতের নবী ও আরব। ইহুদীরা হিংসা করবে। কারণ, ওরা চায় যে, নবী বনী-ইসরাঈল থেকে হোক। তাই আপন ভাতিজার ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির আবু মেলায থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেব নবী করীম (সাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়া সফরে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে এক জায়গায় অবতরণ করলে জনৈক সন্ন্যাসী তাঁদের কাছে এসে বললঃ তোমাদের মধ্যে একজন সাধু পুরুষ আছেন। এরপর বলল: এই বালকের অভিভাবক কে? আবু তালেব বললেনঃ আমি। সে বেললঃ এই বালকের হেফাযত করবে। তাঁকে সিরিয়ায় নিয়ে যেয়ো না। কেননা, ইহুদীরা তাঁকে দেখে হিংসা করবে। সে মতে আবু তালেব তাঁকে মক্কায় ফিরিয়ে আনলেন। ইবনে মান্দাহ দুর্বল সনদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত আবূ বকর (রাঃ) সিরিয়ার এক বাণিজ্যিক সফরে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল আঠার বছর এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিশ বছর। পথিমধ্যে তাঁরা এক কুল বৃক্ষের কাছে অবতরণ করলেন। তিনি বৃক্ষের ছায়ায় বসে গেলেন এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) বুহায়রা নামক জনৈক সন্ন্যাসীর সাথে কথা বলতে চলে গেলেন। বুহায়রা প্রশ্ন করলঃ বৃক্ষের ছায়ায় কে? তিনি বললেনঃ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মোত্তালিব। বুহায়রা বললঃ আল্লাহর কসম, সে নবী। কেননা, এই কূল বৃক্ষের ছায়ায় হযরত ঈসা (আঃ)-এর পর অদ্যাবধি কেউ বসেনি। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর মনে বিষয়টি বদ্ধমূল হয়ে গেল। সেমতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) নবুওতপ্রাপ্ত হলে হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর অনুসরণ করেন। ইবনে হজর আল-এছাবা গ্রন্থে বলেনঃ এই রেওয়ায়েত বিশুদ্ধ হলে এটা হযরত মআবু তালেবের সঙ্গে সফরের পর রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দ্বিতীয় সফর হবে।
হযরত আবু তালেব তাঁর মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য দোয়া করেন
ইবনে আসাকির স্বীয় ইতিহাস গ্রন্থে জালহামা ইবনে আরকাতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি মক্কায় এলাম। তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। কোরায়শরা বললঃ হে আবু তালেব! উপত্যকায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ। মানুষ ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ করছে। এস, বৃষ্টির দোয়া কর। আবু তালেব বের হলেন। তাঁর সঙ্গে অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত এক বালক ছিল তার উপমা এমন যেন কাল মেঘ সরে গিয়ে রৌদ্র বের হয়ে এসেছে। তাঁর চারপাশে ছোট ছোট শিশুরা ছিল। আবু তালেব তাঁর হাত ধরে কাবার প্রাচীরে ঠেস দিলেন এবং আপন অঙ্গুলি দিয়ে বালককে স্পর্শ করলেন। তখন আকাশে এক খণ্ড মেঘও ছিল না। কিন্তু দেখতে দেখতে চতুর্দিক থেকে মেঘ এসে গেল এবং প্রবল বৃষ্টি বর্ষণ করল। উপত্যকা পানিতে ভরে গেল। নগর ও গ্রাম সবুজ ও সতেজ হয়ে গেল। এ ঘটনা সম্পর্কে হযরত আবু তালেব বলেনঃ তাঁর উজ্জ্বল মুখমণ্ডল দ্বারা মেঘমালাও সিক্ত হয়। তিনি এতীমদের আশ্রয়দুল এবং বিধবাদের রক্ষক। বিপদ মুহূর্তে হেশাম বংশীয়রা তাঁর ওছিলা ধরে এবং তাঁর কাছ থেকে নেয়ামত ও ফযীলত হাছিল করে।
পৃষ্ঠা:৩৬
রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখে আবু তালেবের কাছ থেকে
ইহুদীদের পলায়ন
ইবনে আগুন থেকে বর্ণিত আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে আমর ইবনে সায়ীদ বলেনঃ কয়েকজন ইহুদী আবু তালেবের কাছ থেকে কিছু পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করতে আসে। তখন শিশু নবী করীম (সাঃ) সেখানে এসে পড়েন। ইহুদীরা তাঁকে দেখে সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে গেল। আবু তালেব কাছে বসা এক ব্যক্তিকে বললেনঃ যাও, অমুক অমুক পথে তাদেরকে বাধা দাও। তাদেরকে দেখে হাতে হাত রেখে বলঃ খুব আশ্চর্যের বিষয় দেখেছি। এরপর দেখ তারা কি জওয়াব দেয়। লোকটি গেল এবং ইহুদীদেরকে দেখে তাই করল। ইহুদীরা বললঃ তুমি আর আশ্চর্যের বিষয় কি দেখেছ, আমরা তোমার চেয়েও অধিক আশ্চর্যের বিষয় দেখেছি। আমরা এই মাত্র মোহাম্মদকে মাটির উপর চলতে দেখেছি।
আবু লাহাবের মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়ার সূচনা
ইবনে আসাকির আবুল যিনাদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেব ও আবু লাহাব পরস্পরে মল্ল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। আবু লাহাব আবু তালেবকে ভূতলশায়ী করে বুকের উপর চেপে বসল। নবী করীম (সাঃ) তখনও শিশু ছিলেন। তিনি ছুটে গিয়ে আবূ তালেবকে উঠে বসতে সাহায্য করতে লাগলেন। আবু লাহাবের চুলের ঝুঁটি ধরে সজোরে টান দিলেন। আবু লাহাব বলল: আমিও তোমার চাচা, সেও তোমার চাচা। এরপরও তুমি তার সাহায্য করলে কেন? তিনি বললেন: তিনি আমার কাছে তোমা অপেক্ষা অধিক প্রিয়।আবু লাহাব কথাটি মনে গেঁথে নিল এবং সেদিন থেকেই নবী করীমের সাথে শত্রুতার পথ বেছে নিল।
আবু তালেবের ওফাত
ইবনে সা’দ আবদুল্লাহ ইবনে ছালাবা ইবনে ছগীর ওযরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেবের ওফাতের সময় নিকটবর্তী হলে তিনি সকল পুত্রকে কাছে ডেকে এনে বললেনঃ যে পর্যন্ত মোহাম্মদের অনুসরণ করতে থাকবে, কল্যাণ তোমাদের সঙ্গে থাকবে। তাই তাঁকে অনুসরণ ও সাহায্য করবে। মুসলিম আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি আবু তালেবের কোন উপকার করেছেন কি? তিনি তো আপনার হেফাযত করতেন এবং আপনার জন্যে মানুষের প্রতি ক্রুদ্ধ হতেন। তিনি বললেনঃ হাঁ, তিনি জাহান্নামের কিনারায় আছেন। আমি না থাকলে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকতেন। ইবনে সা’দ বলেন, আমাকে আফফান ইবনে মুসলিম বলেছেন, তার কাছ থেকে ছাবেত বানানী এবং তাঁর কাছ থেকে ইসহাক ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হারেছ বর্ণনা করেছেন যে, আব্বাস (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ ইয়া রসূলুল্লাহ। আপনি আবু তালেবের জন্যে কোন মঙ্গলের আশা রাখেন কি? তিনি বললেনঃ আমি আমার পরওয়ারদেগারের কাছে সকল প্রকার মঙ্গলের আশা রাখি। ইবনে আসাকিরও এটি রেওয়ায়েত করেছেন। ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে আমর ইবনুল আছ (রাঃ) বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি- আবু তালেবের আমার উপর হক আছে, যা আমি শোধ করব। তাম্মাম (ফাওয়ায়েদ গ্রন্থে) এবং ইবনে আসাকির হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- কিয়ামতের দিন আমি আমার পিতামাতা, চাচা আবু তালেব এবং মূর্খতা যুগের এক ভাইয়ের জন্যে সুপারিশ করব। তাম্মাম বলেনঃ এই রেওয়ায়েতে ওলীদ ইবনে সালামাহ মুনকিরে হাদীস। তাই অগ্রহণযোগ্য। খতীব ও ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি- আমি আমার পিতা, চাচা আবু তালেব এবং আমার দুধভাই (সাদিয়া)-এর পুত্রের জন্যে সুপারিশ করব, যাতে তারা পুনরুত্থানের সময় ধূলিকণা হয়ে যায়। খতীব এই রেওয়ায়েতের সনদ সম্পর্কে বলেন যে, এতে খাত্তাব ইবনে আবদুদ্দায়েম ও সুফী দুর্বল। তিনি এয়াহইয়া ইবনে মোবারক ছানআনী থেকে মুনকার রেওয়ায়েতসমূহ বর্ণনা করায় প্রসিদ্ধ। ছানআনী নিজেও মজহুল তথা অপরিচয়।
আবূ তালেবের জন্যে এস্তেগফার করতে নিষেধ করা হয়েছে
ইবনে আসাকির হাসান ইবনে আম্মারাহ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) আবু তালেবের জন্যে দোয়া করার জন্যে তাঁর কবরে যান। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন: مَا كَانَ لِلنَّبِي وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ অর্থাৎ নবী ও মুমিনদের জন্যে শোভনীয় নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্যে এস্তেগফার করবে। সে মতে আবু তালেবের মুশরিক অবস্থায় ইন্তেকাল করার ব্যাপারটি নবী করীম (সাঃ)-এর জন্যে অত্যন্ত অসহনীয় দুঃখের কারণ হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত আয়াতখানি নাযিল করেনঃإِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ
পৃষ্ঠা:৩৭
আপনি যাকে চান হেদায়েতের পথে আনতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ যাকে চান হেদায়েত দান করেন। অর্থাৎ আপনি আবু তালেবকে হেদায়েতের পথে আনতে পারেন না। আল্লাহ যাকে চান; (অর্থাৎ আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে) হেদায়েত দান করেন। মোটকথা, আবু তালেবের বিনিময়ে নবী করীম (সাঃ) আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রাঃ)-কে পেয়েছেন। এ কারণেই আবূ তালেবের ইন্তিকালের পর রসুলুল্লাহ (সাঃ) চাচাদের মধ্যে হযরত আব্বাস (রাঃ)-কে সর্বাধিক ভালবাসতেন।
আবু তালেব কোরায়শদের ধৃষ্টতা প্রতিহত করতেন
ইবনে আসাকির হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেবের ইন্তিকালের পর জনৈক নির্বোধ কোরায়শী নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি মাটি নিক্ষেপ করে। তাঁর এক কন্যা দৌড়ে আসেন এবং ক্রন্দন করতে করতে পবিত্র মুখমণ্ডল থেকে মাটি ছাফ করতে থাকেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) কন্যাকে বললেনঃ ক্রন্দন করো না। আল্লাহ তায়ালা তোমার পিতার হেফাযত করবেন।
মূর্খতাযুগের আচার-আচরণ থেকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হেফাযত
বোখারী ও মুসলিম হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কা’বাগৃহ পুনঃনির্মাণের জন্যে রসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রস্তরখণ্ড বহন করে আনছিলেন। তাঁর পরনে ছিল লুঙ্গি। পিতৃব্য হযরত আব্বাস (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ ভাতিজা! যদি তুমি লুঙ্গি খুলে কাঁধে বেঁধে নাও, তবে পাথরের ঘর্ষণ থেকে তোমার কাঁধ নিরাপদ হয়ে যাবে। পিতৃব্যের কথায় তিনি লুঙ্গি খুলে কাঁধে বেঁধে নিলেন। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সেদিনের পর আর কখনও তাঁকে আবরু উন্মুক্ত অবস্থায় দেখা যায়নি।বুখারী ও মুসলিম জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন বায়তুল্লাহর পুনঃনির্মাণ করা হয়, তখন নবী করীম (সাঃ) ও হযরত আব্বাস (রাঃ) উভয়েই পাথর বহন করে আনছিলেন। হযরত আব্বাস (রাঃ) ভাতিজাকে বললেনঃ তোমার লুঙ্গি কাঁধের উপর রেখে নাও। পাথরের ঘর্ষণ থেকে তোমার হেফাযত হবে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাই করলেন। কিন্তু পরক্ষণেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবং চক্ষুদ্বয় আকাশে নিবদ্ধ হয়ে গেল। এরপর উঠে বললেনঃ আমার লুঙ্গি। এরপর লুঙ্গি নিয়ে পরে নিলেন।বায়হাকী ও আবূ নয়ীম হযরত আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি এবং আমার ভাতিজা কাঁধে পাথর বহন করে আনছিলাম। আমাদের লুঙ্গি পাথরের নিচে ছিল। যখন মানুষের ভিড় হয়ে যেত, তখন আমরালুঙ্গি পরে নিতাম। আমি যাচ্ছিলাম এবং নবী করীম (সাঃ) আমার অগ্রে ছিলেন। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। আমি তাঁকে তালাশ করতে এসে দেখি তিনি আকাশের দিকে অনিমেষ নেত্রে চেয়ে আছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ কি হল? তিনি দাঁড়ালেন এবং লুঙ্গি নিয়ে নিলেন। অতঃপর বললেনঃ আমাকে উলঙ্গ চলাফিরা করতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ আমি এই ঘটনা গোপন করতাম। কারও কাছে বলতাম না এই আশংকায় যে, এ কথা শুনলে মানুষ তাঁকে উন্মাদ বলবে। হাকেম, বায়হাকী ও আবু নয়ীম আবূ তুফায়ল থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কোরায়শরা যখন কা’বা নির্মাণ করে, তখন তারা পার্শ্বর্তী পাহাড় থেকে পাথর আনত। রসূলে করীম (সাঃ)ও পাথর স্থানান্তর করতেন। এই অবস্থায় একবার তার গুপ্তাঙ্গ খুলে যায়। তৎক্ষণাৎ গায়েবী আওয়াজ এল- আপন গুপ্তাঙ্গ আবৃত কর। এটা ছিল প্রথম আওয়াজ, যা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেয়া হয়। এ ঘটনার আগে ও পরে আর কখনও তাঁর গুপ্তাঙ্গ দেখা যায়নি।ইবনে সা’দ ইবনে আদী, হাকেম ও আবু নয়ীম ইকরামার সনদ সহকারে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আবু তালেব যমযম কূপ মেরামত করছিলেন এবং নবী করীম (সাঃ) পাথর বহন করে আনছিলেন। তিনি তখন অল্প বয়স্ক ছিলেন। তিনি নিজের পরনের লুঙ্গির সাহায্যে পাথরের ঘর্ষণ থেকে কাঁধের হেফাযত করলেন। পরক্ষণেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সংজ্ঞা ফিরে এলে আবু তালেব কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেনঃ এক সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি আমার কাছে এসে বললঃ গুপ্তাঙ্গ আবৃত কর। রসূলে করীম (সাঃ) এটা নবুয়তের প্রথম নিদর্শন দেখলেন যে, তাঁকে গুপ্তাঙ্গ আবৃত করতে বলা হল। সেদিন থেকে তাঁর গুপ্তাঙ্গ দেখা যায়নি। ইবনে সা’দ হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ)-এর গুপ্তাঙ্গ দেখিনি। ইবনে রাহওয়াইহি (স্বীয় মসনদে), ইবনে ইসহাক, বাযযার, বায়হাকী আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি নবী করীম (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি- মূর্খতা যুগের পুরুষরা নারীদের সাথে যা যা করার ইচ্ছা করত, দু’টি রাত ছাড়া আমি কখনও সে সবের ইচ্ছা করিনি। কিন্তু এ দু’রাতেও আল্লাহ তায়ালা আমাকে জাহেলিয়াতের কাজকর্ম থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ঘটনা এই যে, আমি আমার পরিবারের ছাগল চরাচ্ছিলাম। এক রাতে আমি আমার সঙ্গীকে বললামঃ আমার ছাগলগুলোর দেখাশুনা কর। আমি মক্কা যাব এবং যুবকরা যেমন কিসসা কাহিনী শুনে, আমিও শুনব। সঙ্গী
পৃষ্ঠা:৩৮
বললঃ ঠিক আছে, যাও। আমি মক্কা এলাম এবং সেখানকার গৃহসমূহের মধ্যে প্রথম গৃহের দিকে এলাম। আমি সেখানে ক্রীড়া কৌতুক ও ঢোল বাজনার শব্দ শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলামঃ এখানে কি হচ্ছে? আমাকে বলা হল যে, অমুক ব্যক্তি অমুক মহিলাকে বিয়ে করেছে। আমি সেখানে দেখার উদ্দেশ্যে বসে পড়লাম। আল্লাহ তায়ালা আমার চোখে নিদ্রা চাপিয়ে দিলেন। আল্লাহর কসম, আমি রৌদ্রের খরতাপে জাগ্রত হলাম। এরপর আমি আমার সঙ্গীর কাছে ফিরে গেলাম। সে জিজ্ঞাসা করলঃ গত রাতে কি করেছ? আমি বললামঃ কিছুই না। এরপর যে পরিস্থিতি দেখেছিলাম, তা বর্ণনা করলাম।দ্বিতীয় রাতেও আমি সঙ্গীকে বললামঃ আমার ছাগলগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবে। আমি কিস্সা-কাহিনী শুনার জন্য মক্কা যাচ্ছি। সে আমার ছাগলের হেফাযত করতে থাকল। আমি মক্কা এলাম এবং প্রথম রাতের অনুরূপ কথাবার্তা শুনলাম। আমি দেখার জন্যে বসে গেলাম। আল্লাহতায়ালা আবার আমাকে ঘুমে অচেতন করে দিলেন। পরদিন রৌদ্রের খরতাপে আমার ঘুম ভাঙ্গল। আমি সঙ্গীর কাছে গেলাম। সে জিজ্ঞাসা করলঃ কি করলে? আমি বললামঃ কিছুই না। এরপর তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলাম। আল্লাহর কসম, এই দু’রাতের পরে আমি কখনও কোন খেলতামাশায় যোগ, দেয়ার ইচ্ছাও করিনি এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহপাক আমাকে নবুওয়তে ভূষিত করলেন। হাফেয ইবনে হজর আসকালানী বলেনঃ এই হাদীসের সনদ হাসান ও মুত্তাছিল এবং এর রাবী নির্ভরযোগ্য। তিরমিযী, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেনঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ। মূর্খতাযুগে নারীদের কোন খেল-তামাশায় আপনি উপস্থিত হয়েছেন কি? তিনি বললেনঃ না। তবে দু’বার এর উপক্রম হয়েছিল। একবার আমি ঘুমিয়ে পড়ি এবং অন্যবার আমার ও তাদের মধ্যে লোকজনের জটলা অন্তরায় হয়েছিল। বোখারী ও মুসলিম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, وَانْذِرُ عَشِيرَ تَكَ الْأَقْرَبِينَ (আপনি আপনার পরিবার পরিজন এবং নিকটতম আত্মীয় বর্গকে সতর্ক করুন) কোরআন পাকের এই আয়াত অবতীর্ণ হলে নবী করীম (সাঃ) কোরায়শদের সকল শাখাকে ডেকে বললেনঃ হে শেরায়শ সম্প্রদায়! আমি যদি বলি যে এই পাহাড়ের পশ্চাতে একটি অশ্বারোহী দল আছে, যারা তোমাদের উপর আক্রমণ করবে, তবে তোমরা আমার কথা কি সত্য বলে বিশ্বাস করবে? সকলে সমস্বরে উত্তর দিলঃ নিঃসন্দেহে আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করব। কারণ, আমরা কখনও আপনাকে মিথ্যা বলতে দেখিনি। সরসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ আমি তোমাদেরকে একটি ভয়ংকর আযাথ সম্পর্কে সতর্ক করছি, যা তোমাদের সামনে রয়েছে।এ কথা শুনে দুষ্টুমতি আবু লাহাব ক্রুদ্ধ হয়ে বললঃ তুমি ধ্বংস হও, এ জন্যেই কি তুমি আমাদেরকে একত্রিত করেছ। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তায়ালা সূরা লাহাব নাফিল করেন। আবু নয়ীম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- আমি যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল সম্পর্কে শুনেছি যে, সে আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারও নামে যবেহকৃত পশুর নিন্দা করত। এ কারণেই আমি এ ধরনের যবেহকৃত পশুর স্বাদ আস্বাদন করিনি। অবশেষে আল্লাহ আমাকে তাঁর রেসালত দ্বারা ভূষিত করেছেন।আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির হযরত আলী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হলঃ আপনি কখনও প্রতিমাদের এবাদত করেছেন কি? তিনি বললেনঃ না। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেনঃ আপনি কখনও মদ্যপান করেছেন কি? তিনি বললেনঃ কখনও পান করিনি। এসব কাজ যে গর্হিত, তা আমি জানতাম; অথচ আমি তখনও পর্যন্ত কিতাব ও ঈমান সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলাম না। সইবনে সা’দ, আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির ইকরামা থেকে এবং তিনি হযরত আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ উম্মে আয়মন বলেছেন- বুয়ালা নামক এক মূর্তির কাছে কোরায়শরা বছরে একবার করে একত্রিত হত। আবূ তালেবও আপন গোত্রসহ এই মূর্তির কাছে জমায়েত হতেন এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে সকলের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্যে তাগিদ দিতেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) অস্বীকার করতেন। এই অস্বীকৃতির কারণে একবার আবু তালেব নারাজ হলেন। তাঁর ফুফীগণও সেদিন তাঁর প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। তারা বললেনঃ আমাদের উপাস্যদের প্রতি তোমার অনীহা দেখে আমাদের ভয় হয়। কোথাও এই উপাস্যরা তোমার কোন ক্ষতি করে বসবে। এরপর তারা পীড়াপীড়ি করতে থাকলে তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন এবং বেশ কিছুদিন পর্যন্ত নিখোঁজ থাকেন। উম্মে আয়মন বলেনঃ এরপর তিনি আবার আমাদের মধ্যে ফিরে এলেন। কিন্তু তখন তিনি অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত ছিলেন। ফুফীরা জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার কি হয়েছে? তিনি বললেনঃ আমি নিজের ব্যাপারে জিনদের আশংকা করি। ফুফীরা বললেনঃ আল্লাহ শয়তানের সাথে তোমাকে জড়িত না করুন। তোমার মধ্যে এমন সদগুণাবলী রয়েছে, যার যোগ্য তুমিই। তুমি কি দেখেছ? রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ আমি যখন এক মূর্তির নিকটবর্তী হলাম, তখন
পৃষ্ঠা:৩৯
এক সাদা পোশাক পরিহিত দীর্ঘদেহী ব্যক্তি আমার নজরে পড়ল। সে আমাকে সজোরে আওয়াজ দিলঃ মোহাম্মদ। এর কাছ থেকে দূরে থাকুন এবং একে স্পর্শ করবেন না। উম্মে আয়মন বলেনঃ এরপর তিনি কখনও কোরায়শদের ধর্মীয় উৎসবাদির ধারে কাছেও যাননি। অবশেষে নবুওয়তপ্রাপ্ত হন।হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আবু নয়ীমের রেওয়ায়েতে রসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন- আমি রোকন ও যমযমের মধ্যস্থলে আধা জাগ্রত ও আধা নিদ্রিত অবস্থায় ছিলাম। হঠাৎ আমার কাছে জিবরাইল ও মিকাইল (আঃ) আগমন করলেন। একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ইনিই কি সেই ব্যক্তি? উত্তর হলঃ হাঁ, ইনিই সেই ব্যক্তি। ইনি খুব ভালমানুষ যদি মূর্তিদেরকে স্পর্শ না করেন। নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ নবুওয়তপ্রাপ্তি পর্যন্ত আমি কখনও প্রতিমাদেরকে স্পর্শ করিনি। আবু নয়ীম ও ইবনে আসাকির আতা ইবনে আবীরুবাহ থেকে এবং তিনি হযরত আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) একদা চাচাত ভাইদের সাথে আসাফ মূর্তির নিকটে দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ বায়তুল্লার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে চলে আসেন। তাঁর চাচাত ভাইরা জিজ্ঞাসা করলঃ তোমার কি হয়েছে? তিনি বললেনঃ আমাকে এই মূর্তির কাছে দাঁড়াতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে।- আবু নয়ীম ও বায়হাকী যায়দ ইবনে হারেছা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, একটি তাম্র নির্মিত মূর্তিকে আসাফ অথবা নায়েলা বলা হত। মুশরিকরা তওয়াফ করার সময় এটি স্পর্শ করত। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বায়তুল্লাহর তওয়াফ করলেন। আমিও তাঁর সাথে তওয়াফ করলাম। আমি যখন মূর্তিটির নিকটে এলাম, তখন সেটি স্পর্শ করলাম। রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে বললেনঃ এটি স্পর্শ করো না। যায়দ বলেনঃ আমি মনে মনে বললাম, কি হয় দেখার জন্যে আবার তওয়াফ করে মূর্তিটি স্পর্শ করব। সে মতে আমি মূর্তিটি স্পর্শ করলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ তোমাকে কি নিষেধ করিনি? আমি আরয করলামঃ সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সম্মান দিয়েছেন এবং আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। আমি ইতিপূর্বে আর কখনও মূর্তির গায়ে স্পর্শ করিনি, ভবিষ্যতেও করবো না। ইমাম আহমদ হযরত ওরওয়া ইবনে যুবায়র (রাঃ) থেকে এবং তিনি হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর এক প্রতিবেশী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন- আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে খাদীজা (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলতে শুনেছি- আল্লাহর কসম, আমি কখনও লাত ও ওযযার এবাদত করিনি। আমি কখনও ওযযার এবাদত করব না। আবু ইয়ালা, ইবনে আদী, বায়হাকী ও ইবনে আসাকির হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবুওত প্রাপ্তির আগে নবী করীম (সাঃ) কোন কোন সময় মুশরিকদের সাথে তাদের সমাবেশে যোগদান করতেন। একবার তিনি শুনলেন যে, তাঁর পিছনে দু’জন ফেরেশতা একে অপরকে বলছে- আমার সাথে চল, যাতে আমরা নবীর পিছনে দণ্ডায়মান হই। সে বললঃ তাঁর নিয়ত যখন মূর্তিকে চুম্বন করার কাছাকাছি, তখন তার পিছনে দণ্ডায়মান হওয়া কিরূপে সম্ভবপর হতে পারে? এরপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনও মুশরিকদের কোন ধর্মীয় সমাবেশে যোগদান করেননি। ইবনে ইসহাক, বায়হাকী ও আবু নয়ীম হযরত জুবায়র ইবনে মুতয়িম থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, মূর্খতা যুগে আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখেছি তিনি স্বগোত্রের মাঝখানে আরাফাতে আপন উটের উপর সওয়ার ছিলেন। এরপর তাঁর কওম তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। আরাফাতে তাঁর অবস্থান আল্লাহর তওফীক দানের কারণেই ছিল। বোখারী ও মুসলিম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, কোরায়শ ও মক্কার কয়েকটি সম্ভ্রান্ত গোত্র মুযদালেফায় অবস্থান করত এবং হেরেমবাসী হওয়ার দাবী করত।হাসান ইবনে সুফিয়ান স্বীয় মসনদে, বগভী মোজাকে এবং মাওয়ারদি আছছাহাবায় রবিয়া ইবনে জরশী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেছেনঃ আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে আরাফাতে ওকুফ (অবস্থান) করতে দেখেছি। তখন আমার বিশ্বাস জন্মে যে, আল্লাহ তায়ালা আপন কৃপায় তাঁকে এর তওফীক ও হেদায়েত দান করেছেন।
যৌবনে কোরায়শরা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ‘আমীন’ বলত
ইয়াকূব ইবনে সুফিয়ান ও বায়হাকী ইবনে শিহাব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যখন কোরায়শরা কা’বা গৃহ নির্মাণ করে এবং রোকনে পৌঁছে, তখন রোকন বহন করার ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ দেখা দেয় যে, কোন গোত্রের লোকেরা এটি বহন করবে। অবশেষে ফয়ছালা হয় যে, যে ব্যক্তি সকলের অগ্রে এখানে আসবে, তাঁকেই সালিস মেনে নেয়া হবে। পরদিন দেখা গেল যে, রসূলে করীম (সাঃ) • সকলের আগে পৌঁছেছেন। তিনি তখন অল্প বয়স্ক ছিলেন। কিন্তু সকলেই তাঁকে সালিস নিযুক্ত করল। তিনি রোকনকে একটি চাদরে স্থাপন করতে বললেন। স্থাপন করা হল। এরপর তিনি প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে সরদার নিলেন এবং তাদেরকে চাদরের প্রান্ত ধরার আদেশ দিলেন। এরপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) রোকন রাখার স্থানে উপরে আরোহণ করলেন। সরদাররা হাজারে আসওয়াদ তাঁর দিকে
পৃষ্ঠা:৪০
তুলে ধরলে তিনি সেটি স্বস্থানে স্থাপন করে দিলেন। তাঁর এই বিজ্ঞজনোচিত কাজে সকলেই সন্তোষ প্রকাশ করল। ওহী নাযিল হওয়ার পূর্বেই সকলেই তাঁকে “আমীন” (বিশ্বস্ত) খেতাবে ভূষিত করেছিল। তারা যখন কোন উট যবেহ করত, তখন তাঁর কাছে দোয়ার আবেদন করত। আবু নয়ীম ও ইবনে সাদ হযরত ইবনে আব্বাস ও মোহাম্মদ ইবনে জুবায়র থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, যেসময় নবী করীম (সাঃ) হাজারে আসওয়াদ স্থাপন করেন, তখন নজদের অধিবাসী এক ব্যক্তি তাঁকে একটি পারর দিতে গেল, যাতে সেটির সাহায্যে হাজারে-আসওয়াদকে অটল করে বসানো যায়। হযরত আব্বাস (রাঃ) নজদীকে পাথর দিতে মানা করলেন এবং নিজে নবী করীম (সাঃ)কে পাথর দিয়েছিলেন। নবী করীম (সাঃ) সেটি দিয়ে হাজারে-আসওয়াদকে অনড় করে স্থাপন করলেন। এতে নজদী লোকটি ক্রুদ্ধ হয়ে বললঃ তাদের জন্যে অবাক লাগে, যারা বুদ্ধি বিবেচনা, সম্ভ্রান্ততা ও স্বাচ্ছন্দ্যে সকলের সেরা হওয়া সত্ত্বেও একজন কমবয়েসী ও কম ধীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির আনুগত্য করে। তাই এই ব্যক্তিকে এমন সম্মানিত ও সরদার করেছে যে, সকলেই যেন তাঁর খাদেম। সাবধান! এই বালক একদিন অগ্রগামী হয়ে যাবে এবং তাদের নেতৃত্বে ভাগ বসাবে। কথিত আছে এই ছদ্মবেশী লোকটি ছিল স্বয়ং ইবলীস।ইবনে সা’দ ও ইবনে আসাকির হযরত দাউদ ইবনে হুছাইন (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম (সাঃ) যৌবনই চরিত্র গুণে সবার উপরে, মেলামিশায় সকলের চেয়ে সম্মানিত, বিশ্বস্ততায় সকলের চেয়ে মহান, কথাবার্তায় সর্বাধিক সত্যবাদী এবং অশ্লীল ও অনর্থক কথাবার্তা থেকে সবার চেয়ে অধিক দূরে অবস্থানকারী ছিলেন। তাঁকে কখনও কারও সাথে কলহবিবাদ করতে দেখা যায়নি। এমন কি, তাঁর স্বজাতি তাঁকে আমীন উপাধিতে ভূষিত করে। আবু নয়ীম মোজাহিদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, তিনি বলেনঃ আমার মণ্ডলাআবদুল্লাহ ইবনে সায়েব বর্ণনা করেছেন, আমি মূর্ণতা যুপে একবার ব্যবসায়ে নবী করীম (সাঃ)-এর শরীক ছিলাম। পরবর্তীকালে আমি যখন মদীনায় এলাম, তখন তিনি বললেনঃ আমাকে চিন? আমি বললামঃ জ্বী হাঁ, আপনি আমার শরীক ছিলেন এবং খুব ভাল শরীক ছিলেন। কোন বিষয়ে ঝগড়াও করেননি এবং সমস্যাও সৃষ্টি করেননি।আবু দাউদ, আবু ইয়ালা ও ইবনে মান্দাহ আল মারেফা গ্রন্থে খারায়েতী মাকারেমুল আখলাক গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবিল হাম্মাদ থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসুলে করীম (সাঃ)-এর নবুওয়তপ্রাপ্তির পূর্বে আমি তাঁর সাথে একটি লেনদেন করেছিলাম। আমার কাছে তাঁর কিছু জিনিস পাওনা ছিল।আমি তাঁর সাথে ওয়াদা করলাম যে, আপনার নির্ধারিত স্থানে আমি সেই জিনিস নিয়ে হাযির হব। ঘটনাক্রমে আমি সেই দিন এবং তার পরের দিন জিনিসটি নিয়ে আসার কথা ভুলে গেলাম। তৃতীয় দিন এসে আমি তাঁকে সেই জায়গায় পেলাম। তিনি বললেনঃ তুমি আমাকে বড্ড কষ্ট দিয়েছ। আমি এ স্থানে তিনদিন ধরে তোমার অপেক্ষা করছি। ইবনে সা’দ রবী ইবনে খায়ছাম ‘থেকে বর্ণনা করেন যে, ইসলামের পূর্বে মূর্খতাযুগে নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে ফয়সালা করানোর জন্যে মোকাদ্দমা আনা হত। হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর পণ্য সামগ্রী নিয়ে সিরিয়া সফর সইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন যে, হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর প্রস্তাব পেয়ে নবী করীম (সাঃ) তাঁর পণ্য-সামগ্রী নিয়ে সিরিয়া সফরে গমন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিল হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর গোলাম মায়সারা। সিরিয়া পৌঁছে তাঁরা এক সন্ন্যাসীর গির্জার নিকটস্থ এক বৃক্ষের ছায়ায় অবতরণ করলেন। সন্ন্যাসী মায়সারাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলঃ এই বৃক্ষের নিচে কে অবস্থান করছে। মায়সারা জওয়াব দিলেনঃ ইনি হেরেমের অধিবাসী একজন কোরায়শী। সন্ন্যাসী বললঃ এই বৃক্ষের নিচে নবী ছাড়া কখনও কেউ অবস্থান করেনি।মায়সারা বর্ণনা করেন- যখন দ্বিপ্রহর হত এবং প্রচণ্ড তাপ অনুভব হত, তখন দু’জন ফেরেশতাকে তাঁর উপর ছায়া করতে দেখতাম। তিনি উটের উপর সফর করছিলেন। তিনি যখন সিরিয়া থেকে হযরত খাদিজার পণ্য সামগ্রী নিয়ে এলেন এবং হযরত খাদিজা (রাঃ) তা বিক্রয় করলেন, তখন দ্বিগুণ মুনাফা হল। মায়সারা হযরত খাদিজাকে সন্ন্যাসীর উক্তি এবং ফেরেশতাদের ছায়া করার কথা শুনালেন। এসব কথা শুনে তাঁর মনে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বিয়ে করার আগ্রহ সৃষ্টি হল। এ রেওয়ায়েতটি ইমাম বায়হাকীও ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন।ইবনে ইসহাক ও ইবনে আসাকির নফীসা বিনতে ইয়ালার ভগিনী থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বয়স যখন পঁচিশ বছর, তখন তিনি মক্কায় আমীন নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর পণ্য-সামগ্রী নিয়ে সিরিয়া গমন করেন। তাঁর সঙ্গে হযরত খাদিজার মায়সারা নামক গোলামও ছিল। তাঁরা উভয়েই বুছরা নামক স্থানে পৌঁছেন এবং একটি ছায়াবিশিষ্ট বৃক্ষের নিচে অবস্থান করেন। তাঁকে দেখে নাসত্ত্বা নামক সন্ন্যাসী বলল। এ বৃক্ষের নিচে কখনও কোন নবী ছাড়া অন্য কেউ অবস্থান করেনি। সএরপর সন্ন্যাসী মায়সারাকে জিজ্ঞাসা করলঃ তাঁর উভয় চোখে লালিমা আছে কি? মায়সারা বললেনঃ হাঁ, লালিমা আছে এবং এই লালিমা কখনও হ্রাস হয় না। সন্ন্যাসী বললঃ ইনিই সম্ভবতঃ প্রতিশ্রুত শেষ নবী। এরপর রসূলুল্লাহ (সাঃ)
পৃষ্ঠা:৪১
ক্রয়-বিক্রয়ে মশগুল হয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি তাঁর সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিল এবং বললঃ লাত ও ওযযার কসম খান।তিনি বললেনঃ আমি কখনও লাত ও ওযযার কসম খাইনি। ঘটনাচক্রে এই প্রতিমান্বয়ের কাছ দিয়ে যেতে হলেও আমি মুখ ফিরিয়ে নেই এবং পথের প্রান্ত ধরে চলে যাই। একথা শুনে লোকটি বললঃ আপনার কথাই সত্য। এরপর সে মায়সারাকে বলল: আল্লাহর কসম, ইনি নবী। তাঁর মর্যাদা ও গুণাবলী আমাদের আলেমগণ কিতাবাদীতে পাঠ করে থাকেন।মায়সারা এসব কথা স্মৃতিতে সংরক্ষিত রাখলেন। অতঃপর যখন তারা সিরিয়া থেকে ফিরে এলেন এবং মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন ছিল দ্বিপ্রহর। তখন হযরত খাদিজা (রাঃ) তাঁর বাড়ীর উপর তলার কক্ষে ছিলেন। তিনি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে উটে সওয়ার দেখলেন। আরও দেখলেন যে, দু’জন ফেরেশতা তাঁর উপর ছায়া করে রেখেছে। তিনি নিকটস্থ সকল মহিলাকে এ দৃশ্য দেখালেন।সকলেই বিশ্বয় প্রকাশ করতে লাগল। খাদিজা (রাঃ) এ ঘটনাটি মায়সারার গোচরীভূত করলে তিনি বললেনঃ আমাদের রওয়ানা হওয়ার সময় থেকেই আমি এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। এরপর মায়সারা হযরত খাদিজা (রাঃ)-কে সন্ন্যাসীর কথা এবং ঝগড়াটে ব্যক্তির কথাবার্তা ও কসম দেয়া সম্পর্কে অবহিত করলেন।
হযরত খাদিজার সাথে বিবাহের সময় যে নিদর্শনের প্রকাশ ঘটে
ইবনে সা’দ সায়ীদ ইবনে জুবায়র ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, মক্কার মহিলাদের মধ্যে রজব মাসে তাদের আনন্দের দিন সম্পর্কে মতভেদ দেখা দিলে সকলেই এক প্রতিমার নিকটে দণ্ডায়মান হয়। হঠাৎ তারা একটি মানবীয় আকৃতি দেখতে পায়। আকৃতিটি আস্তে আস্তে তাদের নিকটে এসে উচ্চঃস্বরে ঘোষণা করলঃ তায়মার মহিলারা! তোমাদের শহরে একজন নবী হবেন। তাঁর নাম হবে আহমদ। তিনি আল্লাহর পয়গাম নিয়ে আবির্ভূত হবেন। অতএব যে নারীর মধ্যে এই নবীর পত্নী হওয়ার যোগ্যতা আছে, সে যেন তাঁর পড়ী হয়ে যায়। একথা শুনে মহিলারা সেই লোকটির প্রতি কংকর ছুড়ে মারল, বিদ্রূপ করল এবং কঠোর আচরণ প্রদর্শন করল। কিন্তু হযরত খাদিজা তাঁর কথায় বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করলেন না।
নবুয়তপ্রাপ্তির সময় যে সকল মোজেযার প্রকাশ ঘটেছে
বোখারী ও মুসলিম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওহীর সূচনা হয় সত্যস্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন, তা ভোরের আলোর মত সত্য হয়ে সামনে এসে যেত। কিছুদিন পরে তাঁর কাছে একান্ত বাস প্রিয় হয়ে যায়। কয়েক দিনের পানাহারের সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে তিনি হেরা গিরি গুহায় নির্জনবাসী হয়ে আল্লাহ তায়ালার এবাদতে মশগুল হয়ে পড়তেন। এরপর হযরত খাদিজার কাছে পুনরায় কিছু খাদ্য সামগ্রী নিয়ে যেতেন। অবশেষে একদিন হঠাৎ ওহী এসে গেল।রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন হেরা গুহাতেই ছিলেন, তখন ফেরেশতা এসে তাঁকে বললঃ পড়ুন। তিনি বললেনঃ আমি পড়ুয়ে নই। হুযুর (সাঃ) বলেনঃ ফেরেশতা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এমন জোরে চাপ দিলেন যে, আমি শক্তিহীন হয়ে গেলাম। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললঃ পড়ুন। আমি বললামঃ আমি পড়ুয়া নই। ফেরেশতা আবার আমাকে ধরে সজোরে চাপ দিল। ফলে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়লাম। পুনরায় ছেড়ে দিয়ে বললঃ পড়ুন। আমি বললামঃ আমি পড়ুয়া নই। তৃতীয়বার ফেরেশতা আবার আমাকে ধরে সজোরে চাপ দিল। আমি অবশ হয়ে গেলাম। এরপর আমাকে ছেড়ে বললঃ اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَى أَقْرأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ الَّذِي عَلَّمَ يَا الْقَلَمِ عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمُ পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে স্থিতিস্থাপক উপাদান থেকে। পড়ুন, আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা আলাক)এরপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) গুহা থেকে ফিরে এলেন। ভীতি ও বিহ্বলতার কারণে তাঁর গ্রীবা ও কাঁধের মাংস কাঁপছিল। তিনি খাদিজার (রাঃ) কাছে পৌঁছে বললেন: আমাকে বস্ত্রাবৃত কর। ভয়ভীতি দূর হয়ে গেলে তিনি খাদিজার (রাঃ) কাছে ঘটনা বর্ণনা করলেন এবং বললেনঃ আমি মৃত্যুর আশংকা করছি। সব শুনে হযরত খাদিজা (রাঃ) আরয করলেন।”কখনই নয়। আল্লাহ আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সাথে সদাচরণ করেন। সত্য কথা বলেন। দুর্বলদের বোঝা বহন করেন। নিঃস্বদেরকে অর্থ সম্পদ দেন। অতিথিদের সেবাযত্ন করেন। বিপদাপদ দূরীকরণে মানুষের সহায়তা করেন।”এরপর হযরত খাদিজা (রাঃ) হুযুর (সাঃ)-কে আপন চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল ওযযার কাছে নিয়ে গেলেন। ওয়ারাকা মূর্খতা যুগে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আরবী ভাষার একজন সুলেখক ছিলেন এবং
পৃষ্ঠা:৪২
সাধ্যানুযায়ী আরবী ভাষায় ইনজীলের তরজমা করতেন। হযরত খাদিজা (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ এই ভাতিজার কথা শুনুন। ওয়ারাকা জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি দেখেছেন। নবী করীম (সাঃ) যা দেখেছিলেন, তা বিবৃত করলেন। ওয়ারাকা শুনে বললেন:ও ইনি তো সেই জিবরাঈল, যাকে মূসা (আঃ)-এর কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। হায়! আমি যদি আজ শক্তসমর্থ ও যুবক হতাম। হায় আমি যদি তখন পর্যন্ত জীবিত থাকতাম, যখন আপনার স্বজাতি আপনাকে এদেশ থেকে বহিষ্কার করবে।রসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রশ্ন করলেনঃ তারা কি আমাকে বহিষ্কার করবে?ওয়ারাকা বললেনঃ জী হাঁ। যে-ই আপনার মত নবুয়ত নিয়ে এসেছেন, তাঁর সাথেই শত্রুতা করা হয়েছে। আমি সেই সময়কাল পেলে আপনার জোরদার সাহায্য করব।এরপর ওয়ারাকা বেশিদিন জীবিত থাকেননি।ইমাম আহমদ ও বায়হাকী যুহরী থেকে, তিনি ওরওয়া থেকে এবং তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে উপরোক্ত রূপ রেওয়ায়েত করেছেন। তবে এতে আরও আছে যে, অতঃপর কিছু দিনের জন্যে ওহী বন্ধ রইল। হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমরা জানতে পারি যে, ওহী বন্ধ হওয়ার কারণে নবী করীম (সাঃ) অত্যন্ত দুঃখিত ও মর্মাহত হন। এমন কি, তিনি বারবার পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার ইচ্ছা করেন। যখনই তিনি এই উদ্দেশ্যে কোন পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করতেন, তখনই জিবরাঈল (আঃ) তাঁর সম্মুখে এসে বলতেনঃ মোহাম্মদ! নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রসূল। এতে তাঁর মনে প্রশান্তি ও স্থিরতা আসত এবং তিনি ফিরে আসতেন। এরপর যখন ওহীর আগমনে আরও বেশী বিলম্ব হত, তখন তিনি আবার সেই ইচ্ছা করতেন এবং জিবরাঈল আত্মপ্রকাশ করে সান্ত্বনা দিতেন।ইবনে হজর আসকালানী বলেনঃ ওহীর সূচনালগ্নে জিবরাঈল (আঃ) কর্তৃক বুকে চেপে ধরা কেবল রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এরই বৈশিষ্ট্য। অন্য কোন পয়গাম্বর সম্পর্কে এরূপ বর্ণিত নেই। এই চেপে ধরার মধ্যে এই রহস্য নিহিত ছিল, যেন রসূলুল্লাহ (সাঃ) অন্য কোন বস্তুর প্রতি সুক্ষেপ না করেন এবং এ বিষয়েই আগ্রহ ও প্রচেষ্টা কেন্দ্রিভূত করেন। এ বিষয়েও হুঁশিয়ার করা উদ্দেশ্যে ছিল যে, যে সকল বিষয় আপনার প্রতি নাযিল করা হবে, তা অত্যন্ত ভারী। এ কথাও বলা হয়েছে যে, মনের কুমন্ত্রণা ও জল্পনা-কল্পনা দূর করার জন্যে চাপ দেয়া হয়েছে। কেননা, অবতীর্ণ বিষয়সমূহ দৈহিক গুণাবলী নয়। সে মতে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শরীরে এ অবস্থা দেখা দেয়ার সাথে সাথে তিনি বুঝে নিলেন যে, এটা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ। বোখারী ও মুসলিম হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত। করেন যে, তিনি বলেন: রসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার ওহী বন্ধ থাকার সময়কাল সম্পর্কে কথা বলছিলেন। আমি তাঁকে বলতে শুনলাম: একবার আমি যখন পথ চলছিলাম, তখন আকাশ থেকে আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকালাম। দেখি কি, সেই ফেরেশতা, যিনি আমার কাছে হেরা গিরিগুহায় এসেছিলেন- আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে একটি জমকালো কুরসীতে উপবিষ্ট আছেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ গৃহে এসে বললামঃ আমাকে বজ্রদ্বারা আবৃত করা, আমাকে বস্ত্রদ্বারা আবৃত কর। সেমতে আমাকে বস্তুাবৃত করা হল। তখন আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করলেন: يَا أَيُّهَا الْمُدَّكِرُ قُمْ فَانْذِرُ وَرَبَّكَ فَكَيْرُ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرُ وَالرُّجْرَ فاهجر হে বস্ত্রাচ্ছাদিত। উঠুন, সতর্কবাণী প্রচার করুন এবং আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। আপনার বস্তু পবিত্র করুন এবং অপবিত্রতা পরিহার করুন। (সুরা মুদ্দাসসির)এরপর ধারাবাহিকভাবে ওহী আসতে থাকে। ইমাম আহমদ, ইয়াকূব ইবনে সুফিয়ান স্ব-স্ব রচনাবলীতে, ইবনে সা’দ ও বায়হাকী শা’বী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (সাঃ) চল্লিশ বছর বয়ঃক্রমকালে নবুয়তে ভূষিত হন এবং তাঁর নবুয়তের সাথে ইসরাফীল (আঃ) তিন বছর পর্যন্ত থাকেন। তখন কোরআন করীম অবতীর্ণ হত না। ইসরাফীল তাঁকে কলেমা ও অন্য কিছু শিক্ষা দিতেন। তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেলে জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নবুওয়তের সঙ্গী হয়ে গেলেন। জিবরাঈল (আঃ)-এর বাচনিক বিশ বছর পর্যন্ত কোরআন নাযিল হতে থাকে। দশ বছর মক্কায় এবং দশ বছর মদীনায়।আবূ নয়ীম হযরত আলী ইবনে হুমায়ুন (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে সর্বপ্রথম সত্য স্বপ্ন আসে। তিনি স্বপ্নে যা দেখতেন, তা হুবহু তেমনিভাবে প্রকাশ পেত। আবূ নয়ীম আলকামা ইবনে কায়স থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, পয়গাম্বরগণকে প্রথমে যে বস্তু দেয়া হতো, তা স্বপ্নে দেয়া হতো। এতে তাঁদের চিত্ত প্রশান্ত হয়ে যেতো। এরপর ওহী অবতরণের পালা শুরু হতো।বায়হাকী ও মুসলিম মুসা ইবনে ওকবা থেকে এবং ইবনে সিহাব যুহরী থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, আমরা জানতে পেরেছি যে, নবী করীম (সাঃ) সর্ব প্রথম যা
পৃষ্ঠা:৪৩
দেখেছিলেন, তা ছিল নিদ্রদিস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি স্বপ্ন। স্বপ্নটি তাঁর জন্যে অসহনীয় হয়। তিনি বিষয়টি হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর গোচরীভূত করেন। তিনি বললেনঃ সুসংবাদ নিন। আল্লাহ আপনার সাথে মঙ্গলজনক আচরণ করবেন এরপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত খাদিজার কাছ থেকে বাইরে চলে গেলেন। এরপর আবার তাঁর কাছে গেলেন এবং বললেনঃ আমি দেখেছি যে, আমার উপর বিদীর্ণ করা হল, অতঃপর ধৌত করে পাক করা হল, অতঃপর পূর্বাবস্থায় করে দেয়া হল। হযরত খাদিজা (রাঃ) বললেনঃ আল্লাহর কসম, এটা কল্যাণ ও মঙ্গল। সুসংবাদ নিন। এরপর জিবরাঈল (আঃ) প্রকাশ্যে আগমন করলেন। হুযুর (সাঃ) তখন মক্কার উপরিভাগে ছিলেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে এমন সম্মানিত আসনে বসালেন, যা আশ্চর্যজনক ছিল।নবী করীম (সাঃ) বলতেনঃ জিবরাঈল আমাকে দুধের ফেনার ন্যায় স্বেত শুভ্র মত ফরশে বসালেন, যাতে মোতি ও ইয়াকৃত জড়ানো ছিল। ফরশে বসানোর পরে জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে নবুওয়তের সুসংবাদ দিলেন। এতে তিনি উদ্দীপিত হলেন। এরপর জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ পড়ুন-اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ …. مَا لَمْ يَعْلَمُরসুলে আকরাম (সাঃ) আপন প্রতিপালকের রেসালত কবুল করে চলে এলেন। পথিমধ্যে প্রতিটি বৃক্ষ ও পাথর তাঁকে সালাম করল। তিনি প্রফুল্ল মুখে ও আনন্দিত মনে পরিবারের মধ্যে ফিরে এলেন। তিনি যে মহান বিষয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল। হযরত খাদিজার (রাঃ) কাছে এসে তিনি বললেন: আমি যে ঘটনাটি স্বপ্নে দেখেছিলাম এবং তোমার কাছে বর্ণনা করেছিলাম, তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। জিবরাঈল (আঃ) প্রকাশ্যে আমার কাছে এসেছেন। আমার প্রতিপালক তাঁকে আমার কাছে প্রেরণ করেছেন। অতঃপর জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে যে পয়গাম এনেছিলেন, হুযুর (সাঃ) তা খাদিজা (রাঃ)-কে শুনালেন। হযরত খাদিজা বললেনঃ সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনার সাথে মঙ্গলজনক আচরণই করবেন। আপনি আল্লাহর পয়গাম কবুল করুন। এটা সত্য। আপনি নিশ্চিতরূপেই আল্লাহর রসূল। এরপর হযরত খাদিজা (রাঃ) গৃহের বাইরে গেলেন এবং ওতবা ইবনে রবিয়া ইবনে আবদে শামসের গোলাম আদাসের কাছে পৌঁছলেন। আদাস নায়নুয়ার অধিবাসী এবং ধর্ম বিশ্বাসে খৃষ্টান ছিল। তিনি আদাসকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি জিবরাঈল সম্পর্কে কিছু জান কি?আদাস বললঃ কুদ্দুসুন কুদ্দুসুন্ জিবরাঈল, মূর্তিপূজারীদের দেশে তাঁর নাম উচ্চারণ করাও অনুচিত। হযরত খাদিজা (রাঃ) বললেনঃ জিবরাঈল সম্পর্কে তুমি যা জান বর্ণনা কর।আদাস বললঃ জিবরাঈল আল্লাহ তায়ালা ও পয়গাম্বরগণের মধ্যে বিশ্বস্ত দূত। তিনি হযরত মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর উযীর। হযরত খাদিজা (রাঃ) তাঁর কাছ থেকে চলে এলেন এবং ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে যেয়ে তাঁকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলেন। ওয়ারাকা বললেনঃনিশ্চয়ই তোমার স্বামী সেই প্রতিক্ষিত নবী, কিতাবধারীরা যাঁর অপেক্ষা করে এবং যার আলোচনা তওরাত ও ইনজীলে পায়।এরপর ওয়ারাকা আল্লাহর কসম খেয়ে বললেনঃ যদি তাঁর নবুওয়তের দাওয়াত প্রকাশ পায় এবং আমি জীবিত থাকি, তবে আল্লাহ তাঁর রসূলের আনুগত্য ও পূর্ণমাত্রায় সাহায্য করার ব্যাপারে অবশ্যই আমার পরীক্ষা নিবেন। এর কিছুদিন পরই ওয়ারাকা ইন্তেকাল করলেন। বায়হাকী ও আবূ নয়ীম হযরত ওরওয়া ইবনে যুবায়র থেকে অনুরূপ রেওয়ায়েত করেছেন। তবে এ রেওয়ায়েতের শুরুতে আরও বলা হয়েছে যে, হুযুর (সাঃ) মক্কায় বসবাসকালে স্বপ্ন দেখলেন যে, এক ব্যক্তি তাঁর গৃহের ছাদের দিকে এল। সে ছাদের এক একটি কড়িকাঠ বের করতে লাগল। অবশেষে সে সমস্ত ছাদ খুলে ফেলল। অতঃপর তাতে রূপার একটি সিঁড়ি লাগিয়ে দিল। সেই সিঁড়ি বেয়ে দু’ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে এল। তিনি বলেনঃ তাদেরকে দেখে আমি চীৎকার করে কাউকে ডেকে সাহায্যের আবেদন করতে চাইলাম; কিন্তু আমাকে কথা বলতে বাধা দেয়া হল। আগন্তুকদ্বয়ের একজন আমার মাথার দিকে ও অন্যজন পার্শ্বে বসে গেল এবং তাদের একজন আপন হাত আমার পার্শ্বে দাখিল করে দু’টি পাজরের হাডিচ বের করে নিল। এরপর সে আমার পেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। আমি তাঁর হাতের শীতলতা অনুভব করছিলাম। সে আমার হৃৎপিণ্ড বের করে নিজের হাতের তালুতে রাখল। সে তার সঙ্গীকে বললঃ এই সাধু পুরুষের হৃদপিণ্ড কি চমৎকার। এরপর সে আমার হৃদপিণ্ড স্বস্থানে রেখে দিল এবং পাঁজরের হাড্ডিও যথাস্থানে স্থাপন করল। এরপর উভয়েই প্রস্থান করল এবং সিঁড়ি তুলে নিল। আমি জাগ্রত হয়ে গৃহের ছাদ পূর্ববৎ দেখতে পেলাম। মরসূলুল্লাহ (সাঃ) এই ঘটনার কথা হযরত খাদিজা (রাঃ)-কে বললে তিনি বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা আপনার মঙ্গল করবেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখান থেকে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেনঃ আমার উদর বিদীর্ণ করতঃ ধৌত করে পবিত্র করা হয়েছে। এরপর পূর্ববৎ করে দেয়া হয়েছে। এরপর এই হাদীসে পূর্বোক্ত ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে এবং অতিরিক্ত আরও বলা হয়েছে যে, জিবরাঈল (আঃ) একটি ঝরণা খনন করে ওযু করলেন। নবী করীম (সাঃ) তাঁকে
পৃষ্ঠা:৪৪
নিরীক্ষণ করছিলেন। জিবরাঈল (আঃ) প্রথমে স্বীয় লজ্জাস্থান ধৌত করলেন। অতঃপর মুখমণ্ডল ও উভয় হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করলেন, মাথা মসেহ করলেন, উভয় পা গিটসহ ধৌত করলেন, অতঃপর বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দু’রাকাত নামায পড়লেন। স্ত্রী করীম (সাঃ)-ও তাঁকে যা যা করতে দেখলেন তাই করলেন।আবূ নয়ীম এই রেওয়ায়েত তৃতীয় আর একটি তরিকায় যুহরীর সনদে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বায়হাকী বলেনঃ এই রেওয়ায়েতে যে উদর বিদীর্ণ করার কথা আছে, এর উদ্দেশ্য শৈশবকালীন উদর বিদীর্ণ করাও হতে পারে অথবা এবার পুনরায় বিদীর্ণ করাও হতে পারে। তৃতীয়বার মে’রাজের সময়ও অনুরূপ বিদীর্ণ করা হয়েছে।ইবনে ইসহাক আবদুল মালেক ইবনে ওবায়দুল্লাহ ইবনে আবু সুফিয়ান ও জনৈক আলেম থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তায়ালা যখন রসূলে করীম (সাঃ)-কে সম্মানে ভূষিত করার ইচ্ছা করলেন এবং নবুওয়তের সূচনা করলেন, তখন তিনি যে কোন বৃক্ষ ও পাথরের কাছ দিয়ে গমন করতেন, সে-ই তাঁকে সালাম করত। তিনি পিছনে ও ডানে-বামে তাকালে বৃক্ষ ও পাথর ছাড়া অন্য কিছু দেখতেন না। বৃক্ষ ও পাথর তাঁকে “আসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ” বলে সালাম করত। নবী করীম (সাঃ) হেরা গিরিগুহায় প্রতি বছর এক মাস এধাদত করার জন্যে গমন করতেন। অবশেষে যখন আল্লাহর ইচ্ছা পূরণ করার মাস এল এবং সেটা ছিল রমযান, তখন রসূলে করীম (সাঃ) পূর্ববৎ সেখানে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর বিশেষ এক রাত্রিতে জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে আগমন করলেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:: জিবরাঈল যখন এলেন, তখন আমি নিদ্রিত ছিলাম। তিনি এসেই বললেনঃ পড়ুন। আমি বললাম, কি পড়ব? জিবরাঈল (আঃ) আমাকে এমন চাপ দিলেন যে, আমি মৃত্যুর আশংকা করতে লাগলাম। এরপর তিনি আলাদা হয়ে গেলেন এবং বললেনঃ পড়ুন। আমি বললামঃ কি পড়ব? এরপর তিনি আমাকে আবার চাপ দিলেন এবং আলাদা হয়ে বললেনঃ পড়ুন। আমি বললামঃ কি পড়ব? তিনি বললেনঃاقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ …….. مَا لَمْ يَعْلَمُ .এরপর তিনি চলে গেলেন এবং আমি জাগ্রত হয়ে গেলাম। তখন আমার অন্তরে আল্লাহর বাণী যেন অংকিত ছিল এবং আমার দৃষ্টিতে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কবি ও উন্মাদের চেয়ে অধিক অপছন্দনীয় কিছুই ছিল না। কবি ও উন্মাদের প্রতি তাকানোও আমার জন্যে সহনীয় ছিল না। আমি মনে মনে বললামঃ তুমি কবিঅথবা উন্মাদ। আমি আরও ভাবলাম, কোরায়শরা যাতে তোমার এই ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করতে না পারে, সে জন্যে আমি এক সুউচ্চ পাহাড়ে যেয়ে আত্মহত্যা করে স্বস্তি লাভ করব। আমি গৃহ থেকে এ উদ্দেশ্যেই বের হলাম। যখন আমি আত্মহত্যার সংকল্প করছিলাম, তখন আকাশ থেকে এই আওয়াজ শুনতে পেলামঃ মোহাম্মদ, আপনি আল্লাহর রসূল। আমি জিবরাঈল। আমি আকাশের দিকে মাথা তুলে দেখলাম জিবরাঈল। একজন সুপুরুষের আকারে বিদ্যমান আছেন। তাঁর উভয় পা আকাশের প্রান্তে রয়েছে। তিনি বলছেনঃ মোহাম্মদ। আপনি আল্লাহর রসূল। আমি জিবরাঈল। তাঁর এই কথা আমাকে পূর্বকৃত সংকল্প থেকে গাফেল করে দিল। আমি স্বস্থানে অনড় হয়ে গেলাম। সম্মুখে অগ্রসর হওয়া এবং পিছনে সরে আসার শক্তি আমার মধ্যে ছিল না। আকাশের যে প্রান্তেই দৃষ্টিপাত করতাম, একই দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হত। আমি দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখতে লাগলাম।অবশেষে দিন শেষ হয়ে এল। এরপর জিবরাঈল চলে গেলেন। আমিও ঘরে ফিরে এলাম। খাদিজার (রাঃ) কাছে এলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ আপনি কোথায় ছিলেন?আমি প্রশ্ন করলাম: আমি কবি না উন্মাদ? হযরত খাদিজা বললেনঃ আমি এ বিষয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তিনি আপনার সাথে এরূপ আচরণ করবেন না। আমি ভালভাবেই জানি যে, আপনি সত্যবাদী, আমানতদার, পবিত্র চরিত্রের অধিকারী। আপনি আত্মীয়দের সাথে সদয় আচরণ করবেন।হুযুর (সাঃ) বলেন। অতঃপর আমি খাদিজাকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলাম। তিনি বললেন: সুসংবাদ নিন! আপনি দৃঢ়পদ থাকুন। আমি আশা করি আপনি এ উম্মতের নবী হবেন। এরপর হযরত খাদিজা (রাঃ) ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন এবং সকল বৃত্তান্ত ঝর্ণনা করলেন। ওয়ারাকা বললেনঃ যদি তুমি আমাকে সত্যবাদী মনে কর, তবে বিশ্বাস কর যে তিনি এই উম্মতের নবী এবং তাঁর কাছে সেই জিবরাঈলই আগমন করেছেন, যিনি মূসা (আঃ)-এর কাছে এসেছিলেন।হযরত খাদিজা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-কে বললেন। যে সত্ত্য আপনার কাছে। আসে বলে আপনি মনে করেন, যখন সে আসে, তখন আমাকে অবগত করতে পারেন কি? তিনি বললেন: হাঁ। হযরত খাদিজা (রাঃ) বললেনঃ এবার যখন সে আসে, আমাকে বলবেন। সে মতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন খাদিজা (রাঃ)-এর কাছে ছিলেন, তখন জিবরাঈল (আঃ) আগমন করলেন। হুযুর (সাঃ) বললেনঃ খাদিজা।। ইনি জিবরাঈল। খাদিজা (রাঃ) প্রশ্ন করলেন: আপনি তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন। তিনি বললেন: নিঃসন্দেহে। খাদিজা (রাঃ) বললেনঃ আপনি আমার ডান দিকে বসুন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে বসলেন। খাদিজা (রাঃ) বললেন: আপনি এখন তাঁকে