দারসে হাদীস (ভলিউম-২) __খঃরঃমমিন
পৃষ্ঠা ১ থেকে ২০
পৃষ্ঠা:০১
অপরাধের প্রকারভেদ
عَنْ عَائِشَةَ (رض) قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الدَّواوِينُ ثَلَاثَةٌ – دِيْوَانُ لَا يَغْفِرُ اللَّهُ الإِشْرَاكَ بِاللهِ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ – – بَعْضُهُمْ وَدِيْوَان مِنْ بَعْضٍ وَدِيْوَانُ لَا يَعْبَاءُ اللَّهُ ظَلْمُ الْعِبَادِ فِي مَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ اللَّهِ فَذَاكَ إِلَى اللهِ – إِنْ شَاءَ عَذِّبَهُ – وَإِنْ شَاءَ تَجَاوَزَ عَنْهُ – (مشكواة – بيهقى) হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ “আমলনামায় লিখিত পাপ তিন প্রকারের হবে।(ক) এক প্রকারের পাপ যা আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না, তা হচ্ছে শিরক। যেমন আল্লাহ (সূরা নিসার ৪৮ নং আয়াতে তাঁর সত্তা, গুণ, অধিকার ও ক্ষমতায়) তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক করার অপরাধ তিনি কখনই ক্ষমা করবেন না।(খ) আমলনামায় লিখিত দ্বিতীয় প্রকার পাপ হচ্ছে-বান্দার হক সম্পর্কিত। জালিমের (অত্যাচারীর) নিকট হতে মজলুমের (অত্যাচারিত) হক আদায় না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা ছাড়বেন না।(গ) আমলনামার তৃতীয় প্রকার পাপ হচ্ছে-বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ক। এগুলো আল্লাহ তা’আলা নিজ দায়িত্বে রেখেছেন। তিনি ইচ্ছে করলে শান্তি ও দিতে পারেন অথবা ইচ্ছে করলে মা’ফও করতে পারেন বলে ঘোষনা করেছেন। (মিশকাত, যাদেরাহ, বায়হাকী
শব্দার্থ: অর্থ তিনি (স্ত্রী) বলেছেন। الدواوين – আমলনামা। ১৬ – তিন )প্রকার)। دیوان – আমলনামা, নথীপত্র। لابن الله – আল্লাহ্ মা’ফ করবেন
পৃষ্ঠা:০২
না। الاشراك بالله – আল্লাহর সাথে শরীক, অংশীদারিত্ব। لايتركة الﷲ আল্লাহ্ ছাড়বেন না। ظلم العباد – বান্দার উপর জুলুম অত্যাচার। بينهم তাদের দু’জনের মধ্যে। يقتص – বুঝে নিবে, পাওনা আদায় করে নিবে। بعضهم من بعض একে অপরের নিকট হতে। ان شاء – যদি তিনি )আল্লাহ) চান। – তাকে আজাব দিবেন। تجاوز – মা’ফ করে দিবেন।
বর্ণনাকারীর (রাবীর) পরিচয়:
‘নবুওয়াতের চতুর্থ বৎসরে পবিত্র মক্কা নগরীতে হযরত আয়েশা (রা) এর জন্ম। পিতার নাম আবু বকর ইবনে আবু কুহাফা (রা)। মায়ের নাম উম্মে রোমান (রা)। নবুওয়্যতের ১০ম বৎসরে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর সাথে তাঁর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহকালে তাঁর বয়স ছিলো ৬ মতান্তরে ৭ বৎসর। হিজরী দ্বিতীয় সনে আয়েশা (রা) কে হজুরে পাক (স) নিজের ঘরে তুলে নেন। তিনি খুব মেধাবী ও বুদ্ধিমতি মহিলা ছিলেন। কারণ তিনি মাত্র ৮/৯ বৎসর নবী করীম (স) এর সাথে সংসার ধর্ম পালন করেন। এ অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হাদীস ফেকাহ্ ও তাফসীরে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। মেয়েদের মধ্যে হযরত আয়েশা (রা) এর চেয়ে বেশী হাদীস আর কেউ বর্ণনা করতে পারেননি। পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু হুরাইরাহ (রা) এর পরই তাঁর স্থান। বড়ো বড়ো সাহাবী পর্যন্ত তাঁর নিকট এসে বিভিন্ন জটিল মাসায়েলের সমাধান জিজ্ঞেসকরতেন।হযরত আয়েশা (রা) এর বয়স যখন ১৭ বৎসর তখন নবী করীম (স) ওফাত পান। হযরত আয়েশা (রা) ৬৭ বৎসর বয়সে ৫৮ হিজরীর ১৭ই রমজান মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তখন আমীর মুয়াবিয়ার শাসনকাল। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ২২১০টি।
হাদীসটির গুরুত্ব:
মানুষ পৃথিবীতে যতো অন্যায় বা পাপের কাজ করে তা আদালতে আখিরাতে তিন শ্রেণীতে ভাগ করে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। প্রথম দু’শ্রেণীর আওতাভূক্ত গুনাহ্ মা’ ফের আশা করা সুদূর পরাহত। তৃতীয় শ্রেণীর গুনাহ্ মার্জনা আল্লাহর মর্জির উপর নির্ভরশীল। তিনি যেমন মাফ করতে পারেন তদ্রুপ শাস্তিও দিতে পারেন। বস্তুতঃ গুণাহগার বা অপরাধীদের জন্য সে দিনটি হবে ভীষণ ঝামেলাপূর্ণ একটি দিন। সে ঝামেলা হ’তে বাঁচার একমাত্র পথ হচ্ছে পৃথিবীতে
পৃষ্ঠা:০৩
আল্লাহ্ প্রদত্ত সীমার মধ্যে থেকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে জীবন যাপন করা। পরকালে মানুষ কি কি কারনে আটকে যাবে তা হাদীসে বিশদভাবে বলে দেয়া হয়েছে। যেনো এখান থেকেই সংশোধন হয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। যে ব্যক্তি এ হাদীসটি সামনে রেখে জীবন যাপন করবে, সে দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় জায়গায়ই সাফল্য লাভ করবে। সত্যি কথা বলতে কি, এ হাদীসের পরামর্শ অনুযায়ী আমল ছাড়া পরকালে সাফল্যের কোন সম্ভাবনাই নেই।
ব্যাখ্যা:
(ক) শিরক্ শব্দের অর্থ শরীক করা। আল্লাহকে স্বীকার করা সত্ত্বেও তাঁর সত্ত্বা, গুণাবলী, অধিকার ও ক্ষমতায় অন্য কোন মানুষ, জ্বিন, ফেরেশতা, ওলী, দরবেশ, নবী, পীর, দেবদেবী, মূর্তি, অগ্নি, পহাড়-পর্বত, চন্দ্র-সূর্য, তারকা- নক্ষত্র ইত্যাদি ব্যক্তি বা বস্তুকে শরীক করার নাম শিরক্। শিরক্ চার প্রকার যথাঃ
(১) শিরক্-বিষ-যাত (অল্লাহর সত্ত্বার সাথে শরীক করা): আল্লাহর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, অথবা তাঁর মাতা-পিতা ইত্যাদি কেউ নেই। কাজেই কাউকে আল্লাহর স্ত্রী, কন্যা অথবা পুত্র বলে বিশ্বাস করা শিরক্।
(২) শিরক্-বিস্-সিফাত (গুণাবলীর সাথে শরীক করা): যেসব গুণ একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট অন্যের মধ্যেও তা আছে বলে বিশ্বাস করা। যেমন আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ গায়েব জানে এ ধারনা করা। অথবা-অন্য কারো সর্বত্র হাজির হওয়া, সবকিছু শোনা, সবাইকে দেখতে পাওয়া ইত্যাদি গুণের অধিকারী মনে করা।
(৩) শিরক্-বিল-হুকুক (অধিকারে শীরক করা): যেমননিয়ামতের শোকরিয়া আদায় করা, উপাসনা করা, নত হওয়া, কিছু প্রার্থনা করা, দয়া চাওয়া ইত্যাদি হকগুলো আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। এসব হকের সাথে অন্য কাউকে শরীক করার নাম শিরক্ -বিল-হকুক।
(৪) শিরক্-বিল-ইখতিয়ার (যে সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট তা অন্যের আছে বলে বিশ্বাস করা): যেমন আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে জীবন মৃত্যুর মালিক, বিপদাপদ দূরকারী, অলৌকিকভাবে সাহায্য অথবা ক্ষতিকারী, সন্তান দানকারী, রিজকের ব্যবস্থাকারী, আইন প্রনয়ণকারী ইত্যাদি মনে করা। (খ) (সম্পূর্ণ ইবাদাতকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ- (১) হক্কুল্লাহ্ বা আল্লাহর হক, (২) হকুলইবাদ বা বান্দার হক। সমস্ত ইবাদতের মধ্যে বান্দার হক সংক্রান্ত ইবাদতই বেশী কেননা সমাজ জীবনে মানুষকে একা রাখা হয়নি
পৃষ্ঠা:০৪
বরং অন্যান্য মানুষের সাথে তাকে অসংখ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যেমন সে কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো পিতা, কারো স্বামী, কারো প্রতিবেশী, কারো শ্রমিক, কারো মালিক, কারো মনিব, কারো শাসক, কারো প্রজা, কারো ক্রেতা, কারো বিক্রেতা ইত্যাদি। তাই বিচারের দিন মানুষ বান্দার হক নষ্ট করার কারনেই বেশী গ্রেফতার হবে। নিচে বান্দার হক সংক্রান্ত কিছু ইবাদতের কথা উল্লেখ করা হলো।
(১) গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা করা যাবেনা।
(২) চোগলখুরী করা যাবেনা।
(৩) দ্বিমুখীপনা (এদিকে এক কথা ওদিকে আরেক কথা। করা যাবেনা।
(৪) কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া যাবেনা।
(৫) কোন ব্যক্তিকে গালি দেয়া যা অভিশাপ দেয়া যাবেনা।
(৬) পরস্পর ঘৃণা বিদ্বেষ পোষণ, দেখা সাক্ষাৎ বর্জন ও সম্পর্কচ্ছেদ করা নিষেধ।
(৭) হিংসা করা যাবেনা।
(৮) পরস্পরের দোষত্রুটি তালাশ করা ও ওঁৎ পেতে কথাশুনা নিষেধ।
(৯) অযথা কোন মুসলমানের প্রতি খারাপ ধারণা করা যাবেনা।
(১০) কোন মুসলমানকে অবজ্ঞা করা যাবেনা।
(১১) কোন মুসলমানের কষ্ট দেখে আনন্দ প্রকাশ করা যাবেনা।
(১২) আইনগতভাবে স্বীকৃত বংশ সম্বন্ধে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা যাবেনা।
(১৩) কোন মানুবের সাথে ধোকা বা প্রতারণা করা নিষেধ।
(১৪) ওয়াদা খেলাফ করা যাবেনা।
(১৫) দান-সদকা করে খোঁটা দেয়া নিষেধ।
(১৬) দুইয়ের অধিক লোক অর্থাৎ তিনজন বা চারজন অথবা তার চেয়ে বেশী লোক একত্রে থাকলে অপরের অনুমতি ব্যাতিরেকে একজনের সাথে কানে কানে কথা বলা অথবা কোন প্রকার গোপন আলাপ করা নিষেধ।
(১৭) শরয়ী কারণ ছাড়া, স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে শিষ্টাচার বা আদব কায়দা শিখানোর জন্য যতোটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত শাস্তি দেয়া নিষেধ।
(১৮) কোন প্রাণীকে আগুনে পুড়িয়ে অথবা অনর্থক মারা নিষেধ।
(১৯) প্রাপক তার পাওনা দাবী করলে টাল বাহানা না করা।
(২০) ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাত করা যাবেনা।
(২১) পরস্ত্রীর সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ করা যাবেনা।
(২২) কোন মুসলমানকে কাফির ফাসিক ইত্যাদি বলা যাবেনা।
(২৩) স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল নামায বা রোযা রাখা যাবেনা।
পৃষ্ঠা:০৫
(২৪) স্বামীর হক
(২৫) স্ত্রীর হক।
(২৬) পিতা মাতার হক।
(২৭) সন্তানেরহক।
(২৮) নিকটাত্মীয়ের হক।
(২৯) প্রতিবেশীর হক।
(৩০) ইয়াতিম, মিসকিন, নিঃস্ব, পথিক, গোলাম চাকরদের হক।
(৩১) ধর্ষণনাকরা। ইত্যাদি।
এগুলো বান্দাহর অসংখ্য হকের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হক। বান্দার হক নষ্ট করলে আল্লাহ্ ততোক্ষণ পর্যন্ত মা’ফ করবেন না যতোক্ষণ পর্যন্ত বান্দা পরস্পর পরস্পরকে মা’ফ না করবে। কেননা আল্লাহ যদি কোন বান্দার হক নষ্টকারীকে মা’ফ করে দেন তবে যার হক নষ্ট করা হলো তার কোন ক্ষতি পূরণ হলো না। তাই আল্লাহ কখনো এ কাজ করবেন না। আল্-কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন, ‘সেদিন (অর্থাৎ বিচারের দিনে। কারো উপর জুলুম করা হবে না।’ হাদীসে বলা হয়েছে কিয়ামতের দিন বান্দার হক নষ্টকারীকে এবং যার হক নষ্ট করা হয়েছে তাদের উভয়কে মুখোমুখী করা হবে। তারপর যার হক নষ্ট করা হয়েছে তাকে একেকটি হকের বিনিময়ে ৭০টি করে নেকী দিতে হবে। আর যদি অতো নেকী না থাকে তবে তার আমল হ’তে ঐ পরিমাণ গুণাহনিতেহবে। প্রশ্ন হতে পারে যে, যাদের হক নষ্ট করা হয়েছে তাদের মধ্যে যারা জীবিত আছে তাদের নিকট হতে মা’ফ নেয়া হয়তো সম্ভব হতে পারে কিন্তু যারা মারা গিয়েছে তাদের নিকট হতে কিভাবে মা’ফ নেয়া যাবে? এর উত্তরে অন্য হাদীসে বলা হয়েছে। মৃত্যু ব্যক্তির নামে দান-সদকা করতে হবে, তার কল্যাণ কামনা নতে হবে। তাহলে আল্লাহ্ সেদিন দু’জনের মধ্যে উত্তম ফায়সালা কট্রেসবেন। (গ) শিরকের বিপরীত যা আছে সবই আল্লাহর হক বা হক্কুল্লাহ। আল্লাহর হকের ব্যাপারে আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ – (البقرة)
“তিনি যাকে ইচ্ছে মা’ফ করে দিবেন এবং যাকে ইচ্ছে শাস্তি দিবেন।” (সুরা বাকারা)
পৃষ্ঠা:০৬
তবে আল্লাহর সন্তোষ্টি অর্জনের চেষ্টা না করে শুধু শুধু মা’ফের আশায় বসে থাকাও একটা পাগলামী ছাড়া কিছু নয়। কেননা নবী করীম (স) বলেনঃ
وَالْعَاجِزُ مَنِ اتَّبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللهِ (ترمذی) —”এবং দুর্বল কাপুরুষ সেই ব্যক্তি যে তার নফসকে খাহেশ ও কামনা বাসনার অনুসারী করে দিয়েছে। অথচ আল্লাহর অনুগ্রহের আশা করে বসে আছে।” তিরমিযি)
শিক্ষাবলী:
(১) শিরক্ মুক্ত জীবন যাপন করতে হবে।
(২) আল্লাহ এবং রাসূল (স) এর উর্ধে কাউকে স্থান দেয়া যাবেনা।
(৩) বান্দার হকের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে অন্যথায় জান্নাতে যাওয়া সুদূর পরাহত।
(৪) ইতোপূর্বে যদি কারো হক নষ্ট করা হয়ে থাকে তবে হাদীসের পরামর্শ অনুযায়ী তা প্রত্যার্পণ করতে হবে আর যদি তা সম্ভবপর না হয় তবে তার জন্য বেশী বেশী দোয়া ও সাদকা করা উচিত।
(৫) ও আল্লাহ তাঁর হকের ব্যাপারে ইচ্ছে করলে মাফ করতে পারেন তবু ও আল্লাহর হকের ব্যাপারে উদাসীন থাকা উচিত নয়।
পৃষ্ঠা:০৭
বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের কর্মধারা
عن أبي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ ثلث مُنْجِيَاتٌ – وثلث مُهْلِكَاتٌ فَأَمَّا الْمُنْجِيَاتُ فَتَقْوَى الله في السر والعلانية وَالْقَوْلُ بِالْحَقِّ فِي الرضى والسخْطِ وَالْقَسْدُ فِي الْغِنَا وَالْفَقْرِ وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ فَهَوَى مُتَّبَعٌ وشَحَّ مُطَاعٌ وَ اعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ وَهِيَ أَشَدُّ هن . —হযরত আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ “তিনটি বস্তু পরিত্রাণকারী এবং তিনটি বস্তু ধ্বংসকারী। পরিত্রাণকারী বস্তুগুলো হচ্ছেঃ (১) প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহকে ভয় করা। (২) সন্তুষ্ট এবং অসন্তুষ্ট সকল অবস্থায় হক কথা বলা। (৩) স্বচ্ছলতা ও দারিদ্রতা উভয় অবস্থায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা। ধ্বংসকারী বস্তুগুলো হচ্ছে: (১) প্রবৃত্তির অনুসারী হওয়া (২) ঐ লোভ লালসা, মানুষ যার দাসে পরিণত হয়। এবং (৩) মানুষ নিজেকে নিজে সম্মানিত মনে করা। আর এ স্বভাবটিই সবচেয়ে খারাপ স্বভাব।’ (বাইহাকী, শোয়াবুল ঈমান)
শব্দার্থ: ১ – তিন। منجيات – মুক্তিদানকারী। مهلكات – ধ্বংসকারী। فتقرى الله – আল্লাহকে ভয় করে। في السير والعلانية – গোপনে এবং والقَوْلُ بِالْحَقِّ الTC – সত্য ভাষণ। في الرضى والسخط – অসন্তুষ্ট সকল অবস্থায়। الفسد মধ্যম পন্থা অবলম্বন। في الغنا والفقر স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল উভয় অবস্থায়। فهری منبع – প্রবৃত্তির দাসত্ব। شع مطاع – লোভ লালসার শিকার। إعجاب المرء ينق – কোন ব্যক্তি নিজেকে নিজে أشد هي সম্মানিত মনে করা। তা। – বেশী খারাপ। – সবগুলোর চেয়ে।
পৃষ্ঠা:০৮
হাদীসটির গুরুত্ব:
যদিও নবী করীম (স) হাদীসটি মুসলিমদেরকে লক্ষ্য করেই বলেছেন, তবুও হাদীসটি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদেরকে চিহ্নিত করার সূত্র হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। কেননা একজন বিশ্বাসী বা মুমিনের ভিতর প্রথমোক্ত গুণ বা বৈশিষ্ট্য তিনটি অবশ্যই থাকে বা থাকতে হবে। তাছাড়া নিম্নোক্ত দোষ তিনটির সাথে উপরোক্ত গুণ তিনটি এমন সাংঘর্ষিক যে, এগুলোর সহাবস্থান হতেই পারেনা। কল্পনাও করা যায়না। আবার যারা নিম্নোক্ত দোষ তিনটির ধারণকারী তারা ওগুলো পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত উপরোক্ত গুণগুলো অর্জন করাও সম্ভব নয়।অর্থাৎ এ হাদীসটি বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের মাঝে বিভেদ রেখা টেনে দিয়েছে। ব্যবহারিক জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
ব্যাখ্যা:
১. হাদীসে তিনটি কাজকে পরিত্রাণকারী বলা হয়েছে। মূলতঃ কাজ তিনটি এমন যা একজন ঈমানদার করতে গেলে তাঁর গোটা জীবনই আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে হয়। সমস্ত ইচ্ছা বাসনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, চিন্তা- গবেষণা, সিদ্ধান্ত-বাস্তবায়ন এগুলো কোনটি আর নিজের ইতিয়ারে থাকেনা। এমনকি পিতামাতা, শিক্ষাগুরু, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, পীর-ফকির কারো কোন হস্তক্ষেপও চলতে পারেনা। কারন উক্ত নির্দেশ কোন এক সময় বা স্থানের সাথে সম্পৃক্ত নয় বরং গোটা জীবন ব্যাপী বিস্তৃত।
১.১ কোন কিছুকে ভয় করার পূর্বশর্ত হচ্ছে তার শক্তি সামর্থ সম্পর্কে পূর্ণ ধা- রণালাভ এবং ক্ষতির পরিমাণ সম্বন্ধে অবহিত থাকা। যেমন একটি শিশু এর অভাবে ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ, বিড়াল ও বাঘকে ভয় না করে নিজের খেলার সাথী মনে করে কিন্তু উক্ত শিশু যখন বাঘ, বিড়াল ও সাপের শক্তি-ক্ষমতা ও ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝতে পারে তখন সে বিড়ালকে বন্ধু মনে করলেও বাঘ ও সাপকে অবশ্যই ভয়ে এড়িয়ে চলতে বাধ্য হয়। তদ্রুপ আল্লাহকে ভয় করার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। এবার দেখা যাক আল্লাহর শক্তি সামর্থ কতটুকু।
(ক) আল্লাহই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তাঃ ইরশাদ হচ্ছে-
يا بها النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
হে মানুষ। তোমরা তোমাদের সেই রবের দাসত্ব স্বীকার করো, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী সকল লোকেরই সৃষ্টিকর্তা। তোমাদের আত্মরক্ষার উপায়
পৃষ্ঠা:০৯
এতে নিহিত আছে। (বাকারা: ২১) সুরা তুরে আল্লাহ্ সমস্ত বিশ্ববাসীকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করেছেন এবং তার সাথে সূক্ষ্ম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছেঃ
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ – أَمْ خَلَقُوا السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ (ج) – —(হে নবী জিজ্ঞেস করুন), এরা কি কোন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া নিজে নিজেই অস্তিত্ব লাভ করেছে? কিংবা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টিকর্তা? অথবা আকাশ ও পৃথিবী সবকিছুই কি এরা সৃষ্টি করেছে? (সুরা তুরঃ ৩৫-৩৬)
الذِي خَلَقَ سبع سموت طباقا (ط) তিনিই স্তরে স্তরে সজ্জিত সপ্ত আকাশ নির্মাণ করেছেন। (সুরা মুলকঃ ২)
الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوكَ فَعَدَلَكَ – فِي أَي صُورَةٍ مَا شَاء رَكْبَكَ . —তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, সুষ্ঠ, সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ করে। এবং যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই তোমাকে সংযোজিত করেছেন। (ইনফিতারঃ ৭-৮) (খ) সমস্ত সৃষ্টিকে প্রতিপালনের দায়িত্বও তাঁর: ইরশাদচ্ছে-
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعُلَمِينَ – —-সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক। (সুরা ফাতেহাঃ ১)
সুরা আ’রাফে বলা হয়েছে:
أَوَلَمْ يَنْظُرُوا فِي مَلَكُوت السموت والأرض – —-তারা কি আসমান ও জমিনের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে না? (আ’রাফঃ ১৮৫)
إن الله هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ . —-নিশ্চয়ই আল্লাহ্, তিনি রিজিকদাতা এবং শক্তিধর ও প্রবল পরাক্রান্ত (যারিয়াতঃ ৫৮)
পৃষ্ঠা:১০
(গ) কেন সৃষ্টি করেছেন? মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا. তোমরা কি মনে করেছো যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি? (মুমিনুনঃ ১১৫) আবার তিনিই তার উত্তরে বলেছেনঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونَ আমি মানুষ আর জ্বিনকে শুধুমাত্র আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। (জারিয়াতঃ ৫৬) অন্যত্র বলেছেনঃ
أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانُ أَنْ يُتْرَكَ سُدى – ــدی মানুষ কি মনে করেছে যে, তাকে এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে? (কিয়ামাহঃ ৩৬) আল্লাহ আরো বলেছেনঃ
أيَحْسَبُ أَن لَّمْ يَرَهُ أَحَدٌ
সে কি মনে করে কেউ তাকে লক্ষ্য রাখছে না? (বালাদঃ ৭)
طوعا وكرها و إِلَيْهِ يُرْجِعُونَ . স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক প্রত্যেককেই আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। (আলে-ইমরানঃ ৮৩) (ঘ) তিনি সব কিছুর নিয়ন্ত্রক ও প্রবল ক্ষমতাধরঃ
وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ – —তিনি তার বান্দাদের উপর প্রবল পরাক্রান্ত। (আনয়ামঃ ৬১)
للهِ مَا فِي السَّمَوتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ আসমান ও জমীনে যা কিছু আছে তার সমস্ত (নিয়ন্ত্রণ) আল্লাহর। (বাকারাঃ ২৮৪)
পৃষ্ঠা:১১
الله الغني وانتم الفقراء . আল্লাহ স্বয়ং সম্পূর্ণ কিন্তু তোমরা (সহ গোটা বিশ্বজাহান)-তার মুখাপেক্ষী। (মুহাম্মদঃ ৩৮)
أينَ مَا تَكُونُوا يَأْتِ بِكُمُ اللهُ جَمِيعًا (ط) إِنَّ اللَّهَ عَلَى
كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ . তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সকলকেই (তাঁর নিকট) একত্রিত করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির উপরই পূর্ণ ক্ষমতাবান। (বাকারাঃ ১৪৮)
إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ . কোন কিছুই তাঁর অগোচরে নয়, চাই-তা আসমানেই হোক অথবা জমিনে। (আলে ইমরানঃ ৫)
له مقاليد السمواتِ وَالْأَرْضِ . আসমান জমিনের (সমস্ত রহস্যের) চাবিকাঠি তাঁর হাতে নিবন্ধ। (শুয়ারাঃ ১২)
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ (ط) – তাঁর কাছেই রয়েছে গায়েবের চাবিকাঠি; যার জ্ঞান তিনি ছাড়া আর কারো নেই। (আনয়ামঃ ৫৯)
سواء مِنْكُمْ مِنْ أَسْرُ الْقَوْلَ وَمَنْ جَهَرَ بِهِ وَمَنْ هُوَ مستخف باليل وسارب بالنهار – لَهُ مُعَقِبَتْ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ (ط) –
তোমাদের মধ্যে কেউ গোপনে কথা বলুক কি উচ্চস্বরে। কেউ রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকুক অথবা দিনের আলোতে চালাফেরা করুক, তার সামনে ও পিছনে আল্লাহর গুপ্তচর নিয়োজিত আছে। যারা আল্লাহর নির্দেশে তাঁর গতিবিধি লক্ষ্য রাখছে। (রা’দ ১০-১১)
إِنْ بَطْشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ . —কাজেই তিনি যেদিন ধরবেন, সেদিন শক্তভাবেই ধরবেন। (বুরুন্জঃ ১২)
পৃষ্ঠা:১২
(ঙ) একদিন তার কাছেই ফিরে যেতে হবে:
طوعاً وكَرْهًا وَ إِلَيْهِ يُرْجِعُونَ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক তার নিকটই সবার ফিরে যেতে হবে। (আলে- ইমরানঃ ৮৩)
مو الذي يبدو الخَلْقَ ثُمَّ يَعِيدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ তিনি যেভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন ঠিক সেভাবেই তার পুনরাবৃত্তি করবেন। এটা তাঁর জন্য খুবই সহজ। (সুরা রুমঃ ২৭)
أنتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاء بَنْهَا তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কি খুব বেশী কঠিন না আসমান সৃষ্টি করা? অথচ তিনি (এতবড়ো জিনিস) সৃষ্টি করেছেন। (নাযিয়াতঃ ২৭) ما خلقنا السموت والأرض وما بينهما إلا بالحق وأجل
مسمى. -আমরা আসমান জমিন এবং তার মধ্যের সব কিছুকে বিচক্ষণতার সাথে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টি করেছি। (আহকাফঃ ৩) শুধুমাত্র এগুলো হাজির করেই ছেড়ে দেয়া হবে না বরং সব কিছুর হিসেব নিকেশ ও বিচার করা হবে।
إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا . –সেদিন চোখ , কান, মন সবকিছুরই হিসেব নেয়া হবে। (বনী ইস্রাঈল: ৩৬)
يوْمَئِذٍ تُعرَضُونَ لا تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ . যেদিন তোমাদেরকে হাজির করা হবে, সেদিন তোমাদের কোন রহস্যই গোপন থাকবে না। (আল হাক্কাহ্ঃ ১৮)
يوم تشهد عليهم السنتهم وأيديهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يعملون. —সেদিন তাদের স্বীয় জিহবা এবং তাদের হাত-পা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষী দিবে। (সুরা নূরঃ ২৪)
পৃষ্ঠা:১৩
فلا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا (ط) وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ من خردل آتَيْنَا بِها .
কারো উপর বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবেনা। যদি একটি সরিষা পরিমাণ আমল ও হয়, তবু তা আমরা উপস্থিত করবো (এবং বিনিময় দিব)। (আম্বিয়াঃ ৪৭) (চ) যারা তাঁর পথে চলতে অস্বীকার করে তাদের প্রতি আল্লাহর চ্যালেঞ্জঃ يمعشر الجن والإنس إن اسْتَطَعْتُمْ أَنْ تَنْفُذُوا من أقطار السموت والأَرْضِ فَانْفُذُوا (ط) لا تَنْفُذُونَ إِلا بسلطان
হে জ্বিন ও মানুষের দল (যদি আমার নিয়ম কানুন তোমাদের ভালো না লাগে তবে) তোমরা আমার আকাশ ও পৃথিবীর সীমানা ছেড়ে যেখানে খুশী সেখানে চলে যাও। কিন্তু তা তোমরা পারবেনা। কেননা সে শক্তি সামর্থ তোমাদের নেই। (আর রাহমানঃ ৩৩) উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা কোন মানুষের অর্জন করা সম্ভব নয়। শুধু মানুষ কেন আমাদের জানা অজানা কোন সৃষ্টির দ্বারা ও তা অর্জন করা অসম্ভব। যেহেতু একথাও প্রমাণ হয়েছে যে, আল্লাহ রাবুল আলামীনের নিকট কোন কিছুই অদৃশ্য ও গোপন নেই, তাই তাঁকে প্রকাশ্যে (জন সম্মুখে) ভয় করার সাথে সাথে গোপনে বা এমন অবস্থায়ও ভয় করতে বলা হয়েছে যেখানে পৃথিবীর কোন প্রাণীর বিচরণ নেই। নিকষ আঁধারে একাকী কোন ধূ-ধূ প্রান্তর কিংবা বিজন বনেও কিছু করা হয়, সব অবস্থাই আল্লাহর নিকট দিবালোকের চেয়েও সুস্পষ্ট। বস্তুতঃ মানুষের নিকট যা গোপনীয় তা আল্লাহর নিকট প্রকাশ্য। সেজন্য হাদীসে বলা হয়েছে, তোমরা যাকে প্রকাশ্য ও গোপনীয় বলো, সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করতে হবে। কেননাঃ, ما يلفظ من قول إلا لديه رقيب عتيد . মানুষের মুখ দিয়ে এমন একটি কথাও বের হয় না, যা তৎক্ষণাৎ রেকর্ড করা না হয়। (ক্বাফ: ১৮)
পৃষ্ঠা:১৪
১.২ আল্লাহ রাবুল আলামীন বলেনঃ يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلاً سَدِيدًا . হে ঈমানদারগণ। আল্লাহকে ভয় করো এবং সর্বদা সত্য ও সরল কথা বলো। (আল আহযাবঃ ৭০) অর্থাৎ সুবিধাবাদী নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। স্বার্থের অনুকূলে হলে সত্য কথা বলা এবং প্রতিকূলে হলে মিথ্যা বলা অথবা কারো হুমকী-ধমকীতে ভয় পেয়ে সত্য গোপন করা, এগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। যারা “অবস্থা বুঝে ব্যাবস্থা গ্রহণ” এর নীতিতে বিশ্বাসী, ইসলাম তাদেরকে মুসলিম বা মুমিন হিসেবে স্বীকার করেনা, তাদেরকে মুনাফিক (কপট, ভন্ড, বহরূপী) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সত্য কথা বললে কে খুশী হবে কে নারাজ হবে তা লক্ষনীয় বিষয় নয়। এমনকি তা যদি নিকটাত্মীয়ের বিরুদ্ধেও যায় তবুও সত্য গোপন করা যাবেনা। ইরশাদ হচ্ছেঃ يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ على أَنْفُسِكُمْ أو الوالدين والأقربين (ج) –
হে ঈমানদারগণ। তোমরা সকলে ন্যায় বিচারে অটল, অবিচল থাকো এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হও। তোমাদের সাক্ষ্য স্বয়ং তোমাদের নিজেদের অথবা তোমাদের পিতামাতা কিংবা নিকটাত্মীয়ের বিপক্ষে যাকনা কেন। (আল্ নিসাঃ ১৩৫)
যেখানে সত্য কথা বলা ঝুকিপূর্ণ সেখানে সত্য কথা বলাটা জিহাদের সমতুল্য (সওয়াব)। নবী করীম (স) বলেছেনঃ أفضلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ عَدْلٍ (أو حَق عِنْدَ سُلطان جائر অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলাটাও একটি উত্তম জিহাদ। (আবুদাউদ, তিরমিযি, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ) অন্যত্র বলা হয়েছেঃ منْ أَرْضَى سُلْطَانًا بِمَا يَسْخَطَ رَبَّهُ خَرَجَ مِنْ دِينِ الله – যে ব্যক্তি কোন শাসককে সন্তুষ্ট করার জন্য এমন কথা বলে, যা তার
পৃষ্ঠা:১৫
প্রতিপালককে নারাজ করে, তবে সে ব্যক্তি দ্বীন থেকে খরিজ হয়ে গিয়েছে।১ ১.৩ অপচয়-অপব্যয় এবং কৃপণতা এ দুটোকে ইসলাম ঘৃণা করে। কারণ অপচয় মানুষকে নৈতিক সীমা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কেননা অপচয়কারী কখনো আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে পারেনা ফলে অবৈধভাবে অর্থ সম্পদ সংগ্রহের প্রচষ্টায় লিপ্ত হয়। পক্ষান্তরে কৃপণতা মানুষের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দেয়। মায়া-মমতা, স্নেহ-প্রীতি, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা ইত্যাদি সুকুমার বৃত্তিগুলোকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলে। তখন একজন কৃপণের নিকট স্ত্রী-সন্তানের আবদার-আবেদনের চেয়েও সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার মোহ অনেক বেশী পরিলক্ষিত হয়। অপব্যায় এবং কৃপণতাকে আল-কুরআনে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ ولا تبذر تبذيرا – إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيْطَين (ط). তোমরা অপব্যয় অপচয় করো না কেননা অপব্যয়কারী (লোকেরা) শয়তানের ভাই। বেনী ইসরাঈলঃ ২৬-২৭) ولا تجعل يدك مغلولة التى عُنْقِكَ وَلَا تَبْسُطُهَا كُلِّ البسط فَتَقْعُدَ مَلُوْماً مُحْسُورًا . তোমরা নিজেদের হাত গলার সাথে বেধে রেখোনা (অর্থাৎ কৃপণতা করোনা), আবার তা একেবারে খোলাও ছেড়ে দিওনা (অর্থাৎ অপব্যয় করোনা।। তাহলে তোমরা তিরষ্কৃত ও অক্ষম হয়ে যাবে। (বনী ইস্রাঈলঃ ২৯)
যে ব্যক্তি মিতব্যয়ী সে ধনী অথবা দরিদ্র যা-ই হোকনা কেন কখনো দূর্ভোগের স্বীকার হয় না এবং কখনো মানসিক পীড়া ভোগ করে না। ২. হাদীসে উল্লেখিত তিনটি দোষকে ধ্বংসকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা এ তিনটি দোষ এমন যা কোন মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হলে সৎপথে চলাতো দূরের কথা ভালো-মন্দের পার্থক্য করার জ্ঞানটুকুও লোপ পায় এবং মানবিক গুণগুলোর পরিবর্তে পশুত্বশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তখন বস্তুবাদী ধ্যাণ-ধারনা ও নিজ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ই তার কাছে মুখ্য বলে গণ্য হয় এবং
পৃষ্ঠা:১৬
বাকী সবকিছুই হয়ে উঠে গৌণ। ফলে সে সত্য সুন্দর ও আলোর পথ হারিয়ে বিভ্রান্তির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। ২.১ প্রবৃত্তির দাসত্ব করার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে এতে আল্লাহর সাথে শিরক করা হয়। কারণ আল্লাহ্ যা বলেছেন তা না করে ইচ্ছেমতো চলা বা প্রবৃত্তির অনুসরণ করার অর্থ হচ্ছে প্রবৃত্তিকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে দেয়া। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নির্দেশে যে কাজ করা হয় না, প্রবৃত্তির প্ররোচনার তার বিপরীত কাজটি সংঘটিত হয় এতে কি আল্লাহর ক্ষমতার চেয়ে প্রবৃত্তির ক্ষমতাকে বড়ো বলে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না? অথচ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনের বহু জায়গায় প্রবৃত্তি ও বাপ দাদার ভ্রান্ত পথ ও নীতিকে অনুস- রণ করতে নিষেধ করেছেন। ২.২ পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবকিছুই মানুষের পরীক্ষার নিমিত্তে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা মানুষের জন্য আকর্ষণীয় বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ زين للنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ والْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ المسومة والأنعام والحرث (1) ذَالِكَ مَتَاعُ الْحَيَوة الدنيا (ج) وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْعَابِ . নারী, সন্তান, স্বর্ণরৌপ্যের স্তূপ, বাছাই করা ঘোড়া (বর্তমানে আধুনিক যানবাহন ও গাড়ী), গৃহপালিত পশু ও কৃষি জমি, এগুলো মানুষের জন্য আকর্ষণীয় আনন্দদায়ক ও লালসার বন্ধু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে এগুলো দুনিয়ার সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র। মূলতঃ এর চেয়েও ভালো আশ্রয়তো আল্লাহর নিকটই আছে। (আলে-ইমরানঃ ১৪) এ আয়াতটিতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে এগুলো চিরন্তনী নয়, ক্ষণস্থায়ী। বরং আল্লাহর নিকট নেক বান্দাদের জন্য যা আছে তা এর চেয়েও মূল্যবান এবং তা চিরস্থায়ী। বর্তমান বস্তুবাদী সভ্যতায় নারী ও সম্পদ এ দুটোকে একমাত্র ভোগের সম্পদই মনে করা হয়। তাই দেখা যায় অবৈধভাবে সম্পদ পুঞ্জিভূত করার প্রচেষ্টার সাথে সাথে বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য কর্লগার্ল, গার্লফেন্ডস, অফিস সহকারিনী, বারবণিতা ইত্যাদি আরো
পৃষ্ঠা:১৭
বিচিত্র নামে মেয়েদেরকে ভোগ করার প্রতিযোগীতা শুরু হয়। এমনি ভাবে চলতে চলতেই একদিন দেখা যায় জীবন প্রদীপের তেল ফুড়িয়ে এসেছে। যমদূত সামনে দন্ডায়মান। তখন চৈতন্যোদয় হয় ঠিকই কিন্তু করার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। একমাত্র হা হুতাশ ছাড়া। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে- নবী করীম (স) বলেছেনঃ لو أن لابنِ آدَمَ وَادِيًا مِنْ ذَهَب أَحَبُّ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَادِيَانِ ولَنْ يُمْلأُ فَاهُ إِلا التَّرَابُ . (লোভ এমন ভয়ঙ্কর জিনিস যে) যদি আদম সন্তানকে একটি পাহাড় স্বর্ণে পরিণত করে দেয়া হয় তবুও সে আরেকটির জন্য লোত করবে। বস্তুতঃ মটি ছাড়া আর কিছুই আদম সন্তানের মুখ ভরাতে পারে না (অর্থাৎ তৃপ্তি দিতে পারেনা)। (বুখারী, মুসলিম) ২.৩ নিজেকে সম্মানিত মনে করার অর্থ হচ্ছে দাম্ভিকতা বা অহংকার। অহংকারের কারণে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হয়। সমাজে বিশৃঙ্খলা, কলহ বিবাদ এগুলোর মূলেও অহংকারবোধ সক্রীয়। একমাত্র আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কোন ব্যক্তির গর্ব অহংকার করা সাজে না এবং তা বৈধও নয়। কেননা হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছেঃ يقول الله تَعَالَى الكبرياء رِدَانِي وَالْعَظْمَةُ إِزارِي فَمَنْ نَازَعَنِي واحدًا مِّنْهُمَا أَدْخَلْتُهُ النَّارَ . মহান আল্লাহ্ বলেনঃ অহংকার হচ্ছে আমার চাদর এবং মাহাত্ম হচ্ছে আমার পাজামা বা পরিধেয়। কাজেই যে ব্যক্তি এর যে কোন একটির দাবী করবে তাকে আমি জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। (মুসলিম) অন্য হাদীসে আছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃ لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ أَحَدٌ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَردل من كبر –
কোন ব্যক্তির অন্তরে যদি একটি সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার থাকে তবে সে জান্নাতে যেতে পারবে না। (মুসলিম) একথা শোনে সাহাবা কেরাম খুব পেরেশান হয়ে গেলেন এবং রাসূলে আকরাম
পৃষ্ঠা:১৮
(স) কে একব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ্। প্রতিটি মানুষই চায় যে, তার কাপড়-চোপড় ও জুতা জোড়া সুন্দর হোক। (এটাও কি অহংকারের পর্যায়ে পড়ে?) তখন আল্লাহর রাসূল (স) বললেনঃ إِنَّ الله جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ – الكبر بطرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ . আল্লাহ্ নিজেও সুন্দর তাই তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। আর অহংকার হচ্ছে সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। (মুসলিম) অহংকারের পরিণতি শুধু পরকালেই ভোগ করতে হবে না তা নয় বরং দুনিয়ায়ও এর মর্মান্তিক পরিণতি ভোগ করতে হবে। রাসূলে আকরাম (স) বলেনঃ من تواضع لله رفعه اللهُ فَهُوَ فِي نَفْسِهِ – صَغِيرٌ وفِي أَعْيُنِ النَّاسِ عَظِيمٌ وَمَنْ تَكَبُرَ وَضَعَهُ اللَّهُ فَهُوَ في أَعْيُنِ النَّاسِ صَغِيرُ وَفِي نَفْسِهِ كَبِيرٌ حَتَّى لهم أهون عليهم من كلب وخنزير – যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অহংকার বর্জন করে (অর্থাৎ নিরহংকারী হয়)। তখন আল্লাহ্ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। সে নিজেকে নিজে ছোট মনে করে অথচ অন্য লোকের দৃষ্টিতে সে মহান। আর যে ব্যক্তি অহংকারী সে লোকদের দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট কিন্তু নিজের নিকট সে বিরাট কিছু। এমন ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত লোকের নিকট ককুর এবং শুয়োরের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে পরিগণিত হয়। (মিশকাত এর হাওলায় এস্তেখাবে হাদীস ১ম খন্ড ১২২ পৃঃ)
পৃষ্ঠা:১৯
দুনিয়া মু’মিনের বন্ধীশালা এবং কাফিরের জান্নাত عن أبي هريرة رض قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ مسلم – – হযরত আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ দুনিয়া মুমিনের বন্দীশালা এবং কাফিরের জান্নাত। (সহীহ আল্ মুসলিম)
শব্দার্থ : جن – বন্দীশালা। হাঁড়- জান্নাত।
হাদীসটির গুরুত্বঃ
পৃথিবী মানুষের কর্মক্ষেত্র। এখানে কে কি ধরনের কর্ম সম্পাদন করবে তা সম্পূর্ণ মানুষের ইচ্ছাধীন। তবে কিছু সীমা পরিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি কেউ এ সীমার ভিতর থেকে যাবতীয় কর্ম পরিচালনা করতে চায় তবে তা যেমন সম্ভব, আবার সীমা লংঘন করে যদি কেউ তার যাবতীয় কর্ম ও তৎপরতা চালিয়ে যায় তাতেও কেউ বাধ সাধবে না। তাই সীমার ভিতর থেকে, না সীমার বাইরে থেকে জীবনের যাবতীয় কর্ম ও তৎপরতা চালানো হবে এর উপর ভিত্তি করে একজন মুমিন ও একজন কাফিরের জীবন দর্শন রচিত হয়। এবং সে জীবন দর্শনের দিকে ইঙ্গিত করেই এ হাদীসের বক্তব্য। সাত্যিকথা বলতে কি, একজন কাফির ও মুমিনের জিন্দেগীর স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে এ হাদীসটিতে। এটি একটি আয়না স্বরূপ। যেনো প্রতিটি মুমিন এ আয়নায় নিজের জীবনের কর্মতৎপরতাকে দেখে নিতে পারে।
ব্যাখ্যা:
বন্দীশালায় কোন ব্যক্তি পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। বন্দী জীবনের প্রতিটি মূহূর্ত কর্তৃপক্ষের আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ আইন লংঘন করার অধিকার কোন বন্দীর নেই। যখন যে হুকুম তাকে দেয়া হয় সে হুকুম মানতে সে বাধ্য। বন্দী কখনো একথা বলতে পারে না যে, আমি এ হুকুম মানবোনা
পৃষ্ঠা:২০
অথবা অমুক অমুক হুকুম মানবো এবং অমুক অমুক হুকুম মানবো না। দুনিয়ার জীবনও মুমিনের জন্য বন্দীশালার অনুরূপ। কারণ এখানে সে পূর্ণ স্বাধীন নয়। মন যা চায় তা সে করতে পারে না। প্রবৃত্তির প্রলোভন যতো প্রবলই হোক না কেন আল্লাহর হুকুমের বিপরীত প্রবৃত্তির কোন হুকুম সে মানতে পারে না। তাই প্রবৃত্তির প্রতিটি হুকুমকে সে যাচাই ও পরখ করে দেখে।পক্ষান্তরে জান্নাতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেখানে কোন কর্ম ও তৎপরতা নিয়ন্ত্রিত নয়। ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করা যায়। জান্নাতীদের কোন ইচ্ছে অপূর্ণ থাকবে না। সর্বত্র সুখ আর সুখ। জান্নাতের আরাম আয়েশ ছেড়ে জান্নাতীগণ কখনো বাইরে যেতে চাবে না। কোটি কোটি বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পরও কোন জান্নাতী হাফিয়ে উঠবেনা।যদিও দুনিয়া কখনো জান্নাতের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। তবুও দুনিয়াকে কাফিরদের জান্নাত বলার অর্থ হচ্ছে কাফিররা দুনিয়াকে জান্নাত মনে করে। তারা তাদের জীবনকে আল্লাহ প্রদত্ত সীমার বাইরে থেকে ভোগ করতে চায়। তারা দুনিয়ার জীবনকে উপভোগ করার সম্ভাব্য সকল পথ অবলম্বন করে থাকে। প্রবৃত্তির হুকুম ও চাহিদা মোতাবেক জীবন যাপন করে। তারা আখিরাতে বিশ্বাসী না হওয়ার কারণে দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর ও উপভোগ্য করার জন্য জীবনপাত করে। অথচ একদিন তাকে এ সুন্দর ও আকর্ষণীয়বসুন্ধরা ছেড়ে রিক্ত হস্তে মুসাফিরের ন্যায় বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে। বন্দীগণ যেমন বন্ধীশালাকে নিজের গৃহ মনে করে না, নিজ গৃহে ফেরার জন্য সর্বনা ব্যকুল থাকে। তদ্রুপ মুমিনগণ পৃথিবীকে স্থায়ী আবাসস্থল মনে করে না। তাই দুনিয়ার জেন্দেগীতে আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের মোহ তার থাকে না। বরং তার মন চিরবসন্ত বিরাজিত নিয়ামত ভরা জান্নাতের জন্যে ব্যাকুল থাকে। এ জন্য সে তা লাভ করার কঠিন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে এবং সমস্ত দুঃখ-মুসিবতকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ لقد خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ
বস্তুতঃ আমরা মানুষকে কাঠোর কষ্ট ও শ্রমের মধ্যে সৃষ্টি করেছি। (বালাদঃ ৮)অর্থাৎ এ দুনিয়া মানুষের জন্য মজা লুঠবার ও সুখের বাঁশরী বাজাবার জায়গা নয় বরং কঠোর শ্রম ও কষ্ট সহিষ্ণের জায়গা।পৃথিবীর যতো আরাম আয়েশ ও সুখ স্বাচ্ছন্দ আছে সমস্ত একত্র করলেও তা
পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৪০
পৃষ্ঠা:২১
আখিরাতের তুলনায় খুবই নগন্য। রাসূলে আকরাম (স) বলেনঃ والله ما الدُّنْيا في الآخرة الا مثل مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ فلْيَنْظُرُ بِمَ يَرْجِعُ . اصْبَعَهُ فِي الْيَمَ আল্লাহর কসম। আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হলো, তোমাদের কোন ব্যক্তি সমুদ্রের মধ্যে তার আঙ্গুল ডুবিয়ে দেখলো যে, তাতে কতো পানি লেগে এসেছে (মুসলিম)। অন্য হাদীসে আছে যে, ‘গোটা পৃথিবীর মূল্যও আল্লাহর নিকট মাছির পালকের তুল্য নয়। তাই এ নগন্য বস্তুর পিছনে যারা প্রাণ পণে ছুটে’ তারা বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যদি পরকালে অনন্ত সুখ সত্তার ও চিরবসন্ত বিরাজীত জান্নাত কেউ পেতে চায় তবে তাকে কঠোর শ্রমের পথই বেছে নিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
শিক্ষাবলী:
১। পৃথিবী আখিরাতের শস্যক্ষেত্র তাই এখানে চাষাবাদ বাদ দিয়ে বসে থাকা চরম বোকামী বৈ আর কিছুই নয়।
২। কেউ যদি পৃথিবীর সাময়িক সুখ সম্ভোগকে জীবনের পরম চাওয়া ও পাওয়া মনে করে তবে তা নিতান্ত বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক।
৩। পৃথিবীতে মানুষকে কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে কিন্তু তা কিছু শর্ত সাপেক্ষে। যেমন পরীক্ষার্থীকে লেখার স্বাধীনতা দেয়া হয় কিছু শর্তের বিনিময়ে।
৪। পৃথিবী মানুষের স্থায়ী নিবাস নয় সাময়িক পরীক্ষাকেন্দ্র মাত্র।
৫। এ পরীক্ষার সফলতা ও ব্যর্থতার মাঝে নিহিত পরবর্তী ফলাফল।
৬। পরকালের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের কারণেই মানুষের কৃতকর্মে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়। ইতিবাচক ও অপরটি নেতিবাচক।
৭। ইতিবাচক পথের শেষ মনজিল জান্নাত এবং নেতিবাচক পথের শেষ মনজিল জাহান্নাম।
পৃষ্ঠা:২২
জান্নাতের প্রতিশ্রুতি
(এক)
من سهل بن سعد قَالَ رَسُولُ الله صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم من يضمن لي ما بين لحييه وما بين رجلَيْهِ أَسْمَنَّ لَهُ الْجَنَّةَ . হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলে আকরাম (স) বলেছেন: যে ব্যক্তি স্বীয় জিহ্বা ও লজ্জাস্থান হিফাযতের জামিন হবে আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হবো। (বুখারী)
(দুই)
عن عبادة بن الصامت أن النبي صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم قَالَ أَضْمَنُوا لِى سَنامِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنُ لَكُمُ الْجَنَّةَ أصدقُوا إِذا حَدَّثْتُمْ وَأَوْفُوا إِذا ومَدْتُمْ وَآدُوا إِذَا اشْتَمِنْتُمْ واحفَظُوا فُرُوجَكُمْ وَغَضُوا أَبْصَارَكُمْ وَكُفُوًا أَيْدِيكُمْ .হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত (রা) কর্তৃক বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : তোমরা যদি তোমাদের পক্ষ হতে ছয়টি বিষয়ে জামিন হও তবে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিন হবো।
(১) যখন তোমরা কথা বলবে, সত্য বলবে।
(২) ওয়াদা করে তা পালন করবে।
(৩) আমানত রাখা হলে তা যথাযথভাবে পরিশোধ করে দিবে।
(৪) নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহ হেফাজত করবে।
(৫) তোমরা তোমাদের দৃষ্টিকে অবনমিত রাখবে। এবং
(৬) নিজেদের হাত দুটোকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
(মুসনাদে আহমাদ, বাইহাকী)
পৃষ্ঠা:২৩
শব্দার্থঃ
مَنْ – যে (ব্যক্তি)। يضمن জামিন হবে। – আমাকে। – যা। بين لحبيه – দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী বস্তু অর্থাৎ জিহ্বা بين رجليه – দু’পায়ের মধ্যবর্তী বস্তু অর্থাৎ যৗনাঙ্গ, লজ্জাস্থান। أضمن – আমি জামিন হবো। – তার জন্য।مِنْ أَنفُسِكُمْ – سنا – তোমাদের মধ্য হতে। – তোমাদের জন্য। أصدقوا – সত্য কথা বলো। এ। যখন। তোমরা কথা বলো। )أوفو – পুরো করো। وعدثم – তোমাদের ওয়াদা। )أدو আদায় করে দাও। اشم – তোমাদের কাছে আমানত রাখা হয়। واحفظ – হেফাজত করো। فروجكم – তোমাদের লজ্জাস্থান। এ অবনমিত রাখ । أبصركم তোমাদের চোখসমূহ। – বিরত রাখ। آیدیكُمْ – তোমাদের হাত।
বর্ণনাকারীর পরিচয়:
প্রথম হাদীসের রাবীঃ নাম-সাহল। ডাকনাম-আবুল আব্বাস, আবু মালেক ও আবু ইয়াহ্ইয়া। পিতার নাম সা’দ ইবনে মালেক। তার পিতা নাম রেখেছিলেন ‘হয়ন’ কিন্তু রাসূলে আকরাম (স) মদীনায় হিজরত করার পর তার নাম পরিবর্তন করে সাহল রাখেন।মহানবী (স) এর হিজরতের পাঁচ বৎসর পূর্বে মদীনার খাযরাজ গোত্রে সাহল ইবনে সা’দ (রা) জন্মগ্রহণ করেন।নবী করীম (স) এর ওফাতের সময় তার বয়স ছিলো ১০ বৎসর, তাই তিনি হুজুরে আকরাম (স) এর সাথে কোন জিহাদে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা) একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। বড়ো বড়ো সাহাবীর ইন্তেকালের পর তিনিই ছিলেন জনসাধারণের লক্ষ্যস্থল। তিনি যদিও বয়সের কারণে জিহাদে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু হাদীস শুনে তা যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ ও মুখস্থ রেখেছিলেন। হযরত উবাই ইবনে কা’ব, আসেম ইবনে আদী ও আমর ইবনে আব্বাস (রা) প্রমুখ ছিলেন তার হাদীস শিক্ষার উস্তাদ।হিজরী ৯১ সনে ৯৬ বৎসর বয়সে নবী করীম (স) এর পবিত্র দরবারের শেষ আলোক বর্তিকাটিও নির্বাপিত হয়ে যায়। হুজুরে আকরাম (স) এর সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষ ইন্তেকালকারী সাহাবী। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি নিজেই বলতেনঃ ‘আমি যদি ইন্তেকাল করি তবে “জ্বালা রাসুলুল্লাহ” বা রাসূল বলেছেন’
পৃষ্ঠা:২৪
একথা বলার আর কেউ থাকবে না।’ হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা) থেকে মোট ১৮৮টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার ২৮টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম স্ব স্ব গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। (দ্বিতীয় হাদীসের রাবী হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত (রা) এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানতে হলে দেখুন ‘দারসে হাদীস-২)
হাদীস দু’টোর সমন্বয়:
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয়-হাদীস দুটোতে পৃথক পৃথক শর্ত বা অতিরিক্ত শর্তারোপ করা হয়েছে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা নয়। বরং দ্বিতীয় হাদীসটি প্রথম হাদীসটির ব্যাখ্যা স্বরূপ। কেননা- দ্বিতীয় হাদীসের ১, ২ ও ৩ নং শর্ত হলো প্রথম হাদীসের ১নং শর্তের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর ৪ ও ৫ নং শর্ত দুটো প্রথম হাদীসের দ্বিতীয় শর্তের সাথে সম্পৃক্ত। এবং ৬নং শর্তটি প্রথম হাদীসের উভয় শর্তের সাথেই সংশ্লিষ্ট।
হাদীসদ্বয়ের গুরুত্ব:
হাত, মুখ ও লজ্জাস্থান। পৃথিবীতে মানুষের এ তিনটি অঙ্গের চেয়ে স্পর্শকাতর এবং বিপজ্জনক আর কোন বস্তু নেই। কেননা যতো প্রকার ক্ষতি ও পাপের কাজ আছে প্রায় সবগুলো সংঘটিত হয় এ তিনটি অঙ্গ দ্বারা। কিন্তু আবার এ তিনটি অঙ্গের মধ্যে মুখ ও লজ্জাস্থান হচ্ছে নেতৃস্থানীয়। একটি সুস্থ ও সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজকে শয়তানের সাম্রাজ্যে পরিণত করতে এগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। কারণ শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য যতো প্রকার অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকে তার মধ্যে এগুলো প্রধান। যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করে জীবন বিলিয়ে দেয়ার চেয়েও কঠিন এ অঙ্গগুলোকে সংযত রাখা। এজন্যই নবী করীম (স) এ অঙ্গগুলোর সংযতকারীকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ব্যাখ্যা:
জিহ্বা একটি মাংসাপিন্ড হলেও এটা মনের বাহক। হৃদয়-মন এর মাধ্যমেই সংবাদ সরবরাহ করে থাকে। এ জিহ্বা আকার-আয়তনে ছোট হলেও এর ক্ষমতা অত্যন্ত বেশী। এ বস্তুটি যেমন একটি মানুষকে অধঃপতনের অতল তলে নিক্ষেপ করতে পারে আবার-সাফল্যের উচ্চ শিখরেও সমাসীন করতে পারে। ঝগড়া-বিবাদ, তিরস্কার, মিথ্যা বলা, শলা-পরামর্শ, তোষামোদী, মুনাফিকী, গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা, খিয়ানত ইত্যাদি পাপকার্যগুলো জিহ্বার দ্বারাই
পৃষ্ঠা:২৫
সংঘটিত হয়। তাই রাসূলে আকরাম (স) বলেছেন:أَنَّهُ لَيَزِلُّ عَنْ لِسَانِهِ أَشَدُّ مِمَّا يَزِلُّ عَنْ قَدَمِهِ নিঃসন্দেহে বান্দার পা পিছলানোর চেয়ে মুখ পিছলানো অধিকতর ক্ষতিকর। (বাইহাকী)অর্থাৎ পা পিছলানো মানে শারীরিক ক্ষতি কিন্তু মুখ পিছলানো মানে দ্বীনি ক্ষতি। তাই- তুলনামূলকভাবে দেখা যায়-শারীরিক ক্ষতির চেয়ে দ্বীনি ক্ষতি মারাত্মক।একবার বিশিষ্ট সাহাবী হযরত উকবাহ ইবনে আমের (রা) হুজুরে পাক (স) এর সাথে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ। মুক্তির উপায় কি?’ উত্তরে নবী করীম (স) বললেনঃأملك عليك لسانك وليسعك بيتك وابك على خطيئتك তুমি নিজের জিহ্বাকে আয়ত্বে রাখো। নিজের ঘরে পড়ে থাকো এবং স্বীয় পাপের জন্য রোদন করো। (তিরমিযি, মুসনাদে আহমদ) অন্য হাদীসে বলা হয়েছে।إذا أصبح ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الأعضاء كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللسان فَتَقُولُ اتَّقِ اللهَ فِينَا فَأَنَّا نَحْنُ بِكَ فَإِن اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا وَإِنْ اعْوَجَجَتْ أَمْوَ جَجْنَا –আদম সন্তান যখন সকালে ঘুম হতে উঠে, তখন) তার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বার নিকট অনুনয়-বিনয় করে বলেঃ আমাদের ব্যাপারে তুমি আল্লাহকে ভয় করো। কেননা আমরা তোমার সাথে জড়িত। তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকবো; আর তুমি বিশ্বাস ভঙ্গ করলে আমরাও বিশ্বাস ভঙ্গ করবো। (তিরমিযি)একবার সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ সাক্বাফী (রা) হুজুরে আকরাম (স) কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ইয়া রাসূলাল্লাহ! যে বস্তুগুলো আপনি আমার জন্য ক্ষতিকর মনে করেন, তার মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিকর বস্তু কোনটি?” তখন নবী করীম (স) স্বীয় জিহ্বা ধরে বললেনঃ ‘এইটি’। (তিরমিযি) অন্যত্র বলা হয়েছে, রাসূলে আকরাম (স) বলেছেনঃ
পৃষ্ঠা:২৬
منْ خَزَنَ لسانه ستر الله عورته . –”যে ব্যক্তি স্বীয় জিহ্বাকে সংযত রাখবে (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ তার দোষ ত্রুটির উপর আবরণ ফেলে দিবেন।” [মিশকাত, আনাস (রা)) মুখ ও যৌনাঙ্গের ব্যাপারে অন্য হাদীসে বলা হয়েছে:اندرون ما أكثر ما يدخل الناس النار الأَجْوَفَانِ الْقَم والفرح —তোমরা কি জানো, কোন জিনিস অধিকাংশ মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে? তা মাত্র দু’টো গহবর একটি মুখ ও অপরটি যৌনাঙ্গ। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ) দৃষ্টিকে অবনমিত এবং লজ্জাস্থানের হেফাজতের তাকিদ দিয়ে সূরা আন-নূরে বলা হয়েছে:قل لِلْمُؤْمِنِينَ يَقضُوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ (1) وقل للمؤمِنتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ ويحفظن فروجهن . হে নবী। মুমিন পুরুষদেরকে বলো, তারা যেনো নিজেদের চোখকে নীচু করে চলে এবং স্বীয় লজ্জাস্থানসমূহকে হিফাজত করে। আর মুমিন স্ত্রী লোকদেরকেও বলো, তারা যেনো নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে রাখে (কুদৃষ্টি থেকে) এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করে। (সূরা আন্- নূরঃ ৩০-৩১) অর্থাৎ নিজেদের মুহরিম আত্মীয় এবং আত্মীয়া ছাড়া আর বাকী সকলের জনই এআদেশপ্রযোজ্য। কেননা ব্যাভিচারের প্রথম সূত্রপাতই হয় দৃষ্টি বিনিময় হতে। তাই যদি প্রথম থেকেই দৃষ্টিকে আয়ত্বে (control) রাখা যায় তবে চরিত্রগত দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা সম্ভব। অন্যত্র এক হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে মহান আল্লাহ বলেনঃمن تركها إن النظر مهم مِنْ سَهُم إِبْلِيسَ مَسْمُوم في قلبم . مضافتي أبدلتُهُ إِيمَانًا يَجِدُ هلاوته. –দৃষ্টিতো ইবলিসের তীরগুলোর মধ্যে একটি তীর। যে ব্যক্তি আমাকে ভয় করে এ দৃষ্টি পরিহার করবে তার বিনিময়ে আমি তাকে এমন ঈমান দিবো, যার স্বাদ ফেঅন্তরে অনুভব করতে পারবে। (তাবারানী)
পৃষ্ঠা:২৭
নবী আকরাম (স) আরো বলেছেনঃما من مُسلِم يَنْظُرُ إلى مُحَاسِنَ امْرَأَةِ ثُمَّ يَفْضُ بصَرَهُ إِلَّا أَخْلَفَ اللهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حَلاوتها .যে কোন মুসলিম ব্যক্তির দৃষ্টি সুসজ্জিত সুন্দরী কোন মহিলার উপর পড়ামাত্র সরিয়ে নিবে, আল্লাহ তার ইবাদাতে স্বাদ ও আনন্দ সৃষ্টি করে দিবেন। (মুসনাে আহমাদ)লজ্জাস্থানের হেফাজত করার অর্থ শুধুমাত্র ব্যভিচার হতে বেঁচে থাকাই নয়- বরং নিজের লজ্জাস্থান অন্যকে দেখানো হতেও বিরত থাকতে হবে। নবী করীম (স) বলেছেনঃلا ينظر الرجل إلى عورة الرجلِ وَلَا تَنْظُرُ المرأة إلىعورة المرأة .কোন পুরুষ যেনো অন্য কোন পুরুষের লজ্জাস্থান না দেখে এবং কোন মহিলাও যেনো অপর কোন মহিলার লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টি না দেয়। (মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ) উপরোক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট বুঝা গেলো যে, রাসূল (স) এর প্রতিশ্রুতি যথার্থ। কেননা উক্ত বিষষগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া জান্নাতে যাবার প্রত্যাশা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পৃষ্ঠা:২৮
প্রসঙ্গঃ তওবা
من أنس بن مالك الأنصاري (رض) خَادِم رَسُولُ اللهِ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسلم : الله أفرح بِشَوبَةٍ عَبْدِهِ مِنْ أَحَدِكُمْسقط على بعيره وقد أصله في أرض فلاة – وفي رِوَايَةٍ لِمُسْلِم : اللهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةٍ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ الَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ على راحلت بأَرْضِ فَلاة – فَانْفَلَنَتْمِنْهُ وَعَلَيْها طعامه وشرابه فأيس مِنْهَا – فَأَتَى شَجَرَةٌ فاضطجع في ظلها – وقد أيس مِنْ رَاحِلَتِهِ فَبَيْنَمَا هُوَ كذالك إذ هو بها قائمة عنده – فأخذ بخطامها فقال من شدة الفرح اللهم أنت عبدي وأنا ربك – أَخْطَاءَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرح.আনসার সাহাবী এবং রাসূলে আকরাম (স) এর খাদেম হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) হতে বর্ণিত। নবী করীম (স) বলেছেনঃ যখন কোন ব্যক্তি (গুনাহ করার পর) আল্লাহর নিকট তওবা করে তখন আল্লাহ এতো খুশী হন, যেমন তোমাদের মধ্যে কারো বাহন বিজন মরু প্রান্তরে হারিয়ে যাবার পর তা ফিরে পাওয়ায় তোমরা খুশী হয়ে থাক। (বুখারী, মুসলিম) মুসলিম শরীফের অন্য এক বর্ণনায় আছে: যখন কোন বান্দাহ আল্লাহর নিকট তওবা করে, তখন আল্লাহ তোমাদের মধ্য হতে ঐ ব্যক্তির চেয়েও বেশী খুশী হন, যে ব্যক্তি পানিবিহীন মরুভূমিতে তার বাহনের উপর ছিলো। অতঃপর বাহনটি পালিয়ে গেলো, যার উপর তার খাদ্য ও পানীয় ছিলো। কিন্তু সে তা ফিরে পাবার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়লো। তখন হঠাৎ সে বাহনটিকে তার নিকট দাঁড়ানো দেখলো। অতঃপর সে ঐ বাহনটির লাগাম ধরে ফেললো এবং আনন্দের আতিশয্যে বলে উঠলোঃ হে আল্লাহ। তুমি আমার বান্দাহ এবং আমি তোমার প্রভু। আনন্দে আত্মহারা হবার কারণে সে ভুল করলো।
পৃষ্ঠা:২৯
শব্দার্থ: তো – সবচেয়ে বেশী খুশী হন (ওলষণরফটধশণ চণথরণণ)। بثوية عبده – তাঁর বান্দার তওবার কারণে। من أحدكم – তোমাদের মধ্যে কেউ। – পড়ে যায়, হারিয়ে যায়। بغيره – তার উট। فذ أضله -যাসে হারিয়ে ছিলো। فی أرض فلاة – দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি।حين – যখন يثوب اليه – তাঁর নিকট তওবা করে, প্রত্যাবর্তন করে।راحلته – তার বাহন। অতঃপর তা পালিয়ে গেলো। এ তার উপর। طعامه وشرابه – তার খাদ্য ও পানীয়। সূত্র- অতঃপর সে নিরাশ হয়ে গেলো। – তা পাওয়ার ব্যাপারে। تى – সে আসলো। شجرة গাছ (এর নিকট)। أضطجع – সে শুয়ে পড়লো। فيظلها – ঐ গাছের ছায়ায়। قائمة عنده – তার নিকট দাঁড়ানো (দেখলো)। ১ ধরলো। بخطامها তার লাগাম। شدة الفرح – আনন্দের আতিশয্যে। اللَّهُم – হে আল্লাহ্। آنت – তুমি। – আমার বান্দা। এ আমি। এ-তোমার প্রভু। সেভুল করলো।
বর্ণনাকারীর (রাবীর) সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
নাম আনাস। ডাকনাম আবু হামজা। পিতার নাম মালেক ইবনে নদর। মায়ের নাম উম্মে সুলায়েম (রা)। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (স) এর খালা। এ হিসেবে হযরত আনাস (রা) ছিলেন নবী করীম (স) এর খালাতো ভাই।
রাসূল (স) যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন তাঁর মা ইসলাম গ্রহণ করেন। এসময় আনাস (রা) এর বয়স মাত্র দশ বৎসর। স্ত্রীর ইসলাম গ্রহণের খবর পেয়ে আনাস (রা) এর পিতা রাগ করে শামদেশে চলে যান এবং সেখানেই ইন্তেকালকরেন। অতঃপর উম্মে সুলায়েম ইসলাম গ্রহণের শর্তে আবু তালহার সাথে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। আনাস (রা) এর বয়স দশ বৎসর পূর্ণ হলে তাঁর মা তাঁকে রাসূলে আকরাম (স)এর খেদমতের জন্য পেশ করেন এবং বলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আপনার এ ছোট খাদেমের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করেন।’ তখন নবী করীম (স) দোয়া করলেনঃ’হে আল্লাহ। আপনি তার সম্পদে ও সন্তানে বরকত দান করুন এবং তাকে
পৃষ্ঠা:৩০
দীর্ঘায়ু ও তার গুণাহসমূহ মাফ করে দিন।’তিনি ইলমে হাদীসে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। ফলে ফিকাহ শাস্ত্রে তিনি অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন। হযরত উমর (রা) এর শাসনামলে তিনি বসরায় মুফতী নিযুক্ত হন।তিনি ১০৩বৎসর জীবিত ছিলেন। হিজরী ৯১ অথবা ৯৩ হিজরীতে বসরায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ১২৮৬টি। ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাঁর বর্ণিত মোট ১৬৮ অথবা ১২৮টি হাদীস সংকলিত করেছেন।
হাদীসটির গুরুত্বঃ
স্বেচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক মানুষ পৃথিবীতে ভুল করে। ভুল করা মানুষের এক অন্যতম স্বভাব। তাছাড়া শয়তান মানুষকে প্রতিনিয়ত ভুল পথে পরিচালিত করতে সচেষ্ট। সাময়িকভাবে হোক অথবা স্থায়ীভাবেই হোক মানুষ শয়তানের ঐ ফাঁদে পা দিবেই। এমনকি, নিজের অজান্তে হলেও মানুষ শয়তানের ঐ পাতানো ফাঁদে পা দেয়, ফলে বিভিন্ন প্রকার অপরাধ ও খোদাদ্রোহীতামূলক ক্রিয়াকান্ডে লিপ্ত হয়। যখন মানুষ নিজের কৃতকর্মের ভুল বুঝতে পারে তখন সে অনুতপ্ত হয় ও অনুশোচনা করে। সে সময় যদি স্রষ্টার পক্ষ থেকে অপরাধ মার্জনার ঘোষণা বা গ্যারান্টি না দেয়া হতো বা না থাকতো, তবে প্রতিটি মানুষই ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য হতো। তাই মানুষ যেনো হতাশ ও নিরাশ হয়ে আরো অধিক বিশৃংখলতায় লিপ্ত হয়ে না পড়ে সেজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রতিটি বান্দার জন্যই তওবা তথা মার্জনার দরজা খোলা রেখেছেন। আর এ মার্জনা ঠেকায় পড়ে দিতে বাধ্য হননি বরং সন্তুষ্টি এবং মহরতের সাথেই দিচ্ছেন। এ হাদীসটি তার বাস্তব সাক্ষী।তাছাড়া প্রতিটি অপরাধী গুনাহগারের জন্য এ হাদীসটি আঁধারে আলোক বর্তিকা স্বরূপ।
ব্যাখ্যা:
তওবা )نوية( শব্দের অর্থ হচ্ছে ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, ইসলামী পরিভাষায় তওবা অর্থঃ নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনা এবং পুনরায় সে কাজ না করার জন্য রাবুল আলামীনের নিকট প্রতিশ্রুতি দেয়া। তওবার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার গুনাহ বা অপরাধ সমূহ মাফ করে দেন এবং তাকে পবিত্র জীবন যাপনের তৌফিক দান করেন।
পৃষ্ঠা:৩১
ইরশাদ হচ্ছেঃإن الله يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ . –নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদেরকে এবং পবিত্র জীবন যাপনকারীদেরকে ভালবাসেন। (বাকারাঃ ২২২)وهُوَ الْغَفُور الودود –আর তিনি হচ্ছেন অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও প্রেমময়। (সূরা বুরুজঃ ১৪)ক্ষমাকরা আল্লাহ্ নিজের জন্য অপরিহার্য করে নিয়েছেন। পৃথিবীতে যতোগুলো কঠিন এবং দুঃসাধ্য কাজ আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কোন অপরাধীকে নিজের মুঠোর ভিতর পেয়ে এবং প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা এবং ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে মা’ফ করে দেয়া। বাস্তবে দেখা যায় একজন সৎলোক সব গুণাবলী অর্জন করতে পারলেও এ গুণটি অর্জন করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ গুণটিকে নিজের উপর অপরিহার্য করে নিয়েছেন এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেনঃورحمتي وسعت كل شيء –এবং আমার রহমত সব কিছুতে পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। (আ’রাফঃ ১৫৬) অন্য বলা হয়েছে:كتب رَبُّكُمْ على نفسه الرحمة (لا) أَنَّهُ مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سوم بجهالة ثم تاب من بعده وأصلح فانه غفور رحيم –তোমার রব রহমত ও দয়া প্রদর্শন নিজের জন্য কর্তব্য হিসেবে স্থির করে নিয়েছেন। তার এ দয়া অনুগ্রহের কারণেই তোমাদের মধ্যে কেউ অজ্ঞতা বশতঃ কোন অন্যায় কাজ করে বসলে, সে যদি তওবা করে এবং সংশোধন হয়ে যায় তবে আল্লাহ তাকে মা’ফ করে দেন। কেননা তিনিতো অত্যন্ত দয়ালু (আনয়ামঃ ৫৪)عن عمر (رض) قَالَ : قَدِمَ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسلم بسبي هوازن فإذا إمرأة من السبي تسعى إِذْ وجدت صبيا في السبي فأخذته فالزقته ببطنها
পৃষ্ঠা:৩২
فأرضعته فقال النبي صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّم أثرون هذه المرأة طارحة ولدها في النَّارِ؟ قُلْنَا والله فَقَالَ اللهُ أَرْحَمُ بِعِباده من هذه يولدهاহযরত উমর (রা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যখন হাওয়াজিন গোেেত্রর বন্দীদেরকে রাসুলে আকরাম (স) এর নিকট উপস্থিত করা হলো। তখন হঠাৎ বন্দীগণের মধ্য হতে একজন স্ত্রীলোককে দৌড়াতে দেখা গেলো, অতঃপর সে একটি শিশুকে পেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো এবং (আদর করে) দুধ খাওয়াতে লাগলো। (এ দৃশ্য দেখে। নবী করীম (স) বললেন: এ স্ত্রীলোকটি তার সন্তানকে কি আগুনে নিক্ষেপ করতে পারে? তোমরা কি বলো? প্রতি উত্তরে আমরা সবাই বললাম, আল্লাহর কসম। তা কখনো (সম্ভব) নয়। তখন মহানবী (স) বললেনঃ ঐ স্ত্রীলোকটির সন্তানের (মহরতের) চেয়েও আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি অধিক স্নেহশীল ও দয়ালু। (বুখারী, মুসলিম।
তওবা কবুলের সময়সীমা:
নবী করীম (স) বলেছেনঃ إِنَّ الله يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسئُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِاالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِئُ اللَّيْلِ حَتَّى تطلع الشمس من مغربها . —আল্লাহ রাতে তাঁর রহমতের হাত প্রসারিত করে রাখেন, যেনো দিনের গুনাহগার তাঁর নিকট তওবা করে এবং দিনের বেলায় হাত প্রসারিত করে রাখেন যেনো রাতের গুনাহগারগণ তওবা করতে পারে। (এভাবে চলতে থাকবে) যতোক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম দিক হতে সূর্যোদয় না হবে (অর্থাৎ কিয়ামত সংঘটিত না হয়)। (মুসলিম) অন্য হাদীসে আছেঃمن تاب قبل أن تطلع الشمس مِنْ مُغْرِبِهَا تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِ . সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবার পূর্ব পর্যন্ত যদি কেউ তওবা করে তবে তার তওবা কবুল করা হবে। অন্যত্র বলা হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেন:
পৃষ্ঠা:৩৩
إن الله عزوجل يقبل توبة الْعَبْدِ مَا لَمْ يُفَرِّيرُ .অবশ্য আল্লাহ তার বান্দার মৃত্যুকষ্ট শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত তওবা কবুল করেন। (তিরমিযি)।উপরোক্ত হাদীস ক’টির আলোকে দু’টো কথা জানা যায়-একঃ আল্লাহ রাবুল আলামীনের স্নেহ, দয়া ও ক্ষমার বিশেষ সুযোগ কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সীমিত। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই এ বিশেষ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হবে।দুইঃ মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার কমপক্ষে এতটুকু সময় বাকী থাকতে তওবা গৃহীত হবে, যেনো অবশিষ্ট সময় ঐ তওবার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র মৌখিকভাবে কিছু শব্দ বা বাক্য বললেই তওবার হক আদায় হয়ে যায় না বরং যে বিষয়ে তওবা করা হলো তা থেকে বাকী জীবনে বিরত থেকে প্রমাণ করতে হবে।
তওবার পদ্ধতিঃ
নবী (স) বলেছেনঃ কোন মুসলমান যদি গুনাহ করার পর (অনুতপ্ত মনে) ওষু করে দু’ রাকায়াত নামায আদায় করে মহান আল্লাহ নিকট (কাকুতি মিনতি করে। ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যই আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। (ইবনে কাসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২১৭ ইসলামীক ফাউন্ডেশন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত।) এছাড়াও হাদীসে কিছু দোয়ার কথাও বলা হয়েছে। যেমনঃ اسْتَغْفِرُ اللهَ رَبِّي مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ . আমি আমার সমস্ত অপরাধ থেকে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থী হচ্ছি। -ইত্যাদি।
তওবা কবুলের শর্তাবলী: মহান আল্লাহর বাণী-
يا يُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلى اللهِ تَوْبَةً نَصُوحًا (ط) হে ঈমানদারগণ। আল্লাহর নিকট তওবা করো-খাঁটি ও সত্যিকার তওবা। (আত্-তাহরীম-৮)উক্ত আয়াতে তওবা )تَوْبَۀ( শব্দের সাথে একটি বিশেষণ- নাস্হা )نصوحًا( যোগ করা হয়েছে। )نصوحًا( নাসূহা শব্দের ঐকান্তিকথা, কল্যাণ কামনা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ইত্যাদি। তওবা শব্দের সাথে যুক্ত হওয়ায়
পৃষ্ঠা:৩৪
এর দু’টো অর্থ হতে পারে-একঃ তওবা এমন খাঁটি ও একনিষ্ঠ হতে হবে, যাতে লোক দেখানো- রিয়াকারী ও মুনাফেকী বা কপটতার বিন্দু বিস্বর্গও না থাকে।দুইঃ ব্যক্তি নিজেই নিজের কল্যাণ কামনা করবে, মঙ্গল চাইবে এবং গুনাহ হতে তওবা করে নিজেই নিজেকে মারাত্মক পরিণতি হতে রক্ষা করবে। অথবা গুনাহ করার কারণে দ্বীন পালনে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, তওবা করে তার মেরামত বা সংশোধন করা (তাফহীমুল কুরআন-সূরা তাহরীম, টীকা-১৯)উবাই ইবনে কা’ব (রা) কে “তওবায়ে নসূহ” সম্পর্কে প্রশ্ন করলে, তিনিবললেনঃ আমি নবী করীম (স) এর নিকট এ প্রশ্নই করেছিলাম। জবাবে রাসূলে আকরাম (স) বলেছেনঃ ‘এর তাৎপর্য হচ্ছে তোমার দ্বারা যখন কোন অপরাধ সংঘটিত হয়ে যায় তখন নিজের গুনাহর দরুণ তুমি লজ্জিত ও অনুতপ্ত হও এবং লজ্জাসহকারে আল্লাহর নিকট মা’ফ চাও।’ (ইবনে আবু হাতিম) হযরত উমর (রা) বলেনঃ “তওবায়ে নসুহ” অর্থ তওবা করার পর সেই গুনাহ পুনরায় করা তো দূরের কথা তা করার ইচ্ছে পর্যন্ত না করা। (ইবনে জারীর) হযরত আলী (রা) বলেছেন- তওবার সাথে ছয়টি বস্তুর সমন্বয় সাধন অত্যাবশ্যক: (
১) যা ঘটে গিয়েছে তার জন্য লজ্জিত হওয়া।
(২) নিজের কর্তব্য কর্মে অবহেলা হলে তা রীতিমত আদায় করা।
(৩) যার হক নষ্ট করা হয়েছে তা তার নিকট ফিরিয়ে দেয়া।
(৪) যাকে কষ্ট দেয়া হয়েছে তার নিকট মাফ চাওয়া।
( ৫) ভবিষ্যতে এ গুনাহর পুনরাবৃত্তি না করার দৃঢ় সংকল্প করা।
( ৬) নিজের সত্ত্বাকে আল্লাহর আনুগত্যে বিগলিত ও নিঃশেষ করা। যেভাবে তুমিতাকে আজ পর্যন্ত না ফরমানীর কাজে অভ্যস্থ বানিয়ে রেখেছো, তাকে আল্লাহর আনুগত্যের তিক্তরস পান করাও। যেমন তুমি আজ পর্যন্ত না-ফরমানীর মিষ্টতার স্বাদ আস্বাদন করাচ্ছিলে। (কাশশাফ, তাহফীমুল কুরআন, মাআরিফুল কুরআন)আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) বলেনঃতওবার ব্যাপারে আরও কয়েকটি বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে- (ক) মূলতঃ তওবা কোন গুনাহের ব্যপারে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়াকেই বলা হয়। অন্যথায় কোন গুনাহকে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর মনে করে অথবা কোন দুর্নাম বা আর্থিক ক্ষতির ভয়ে তা পরিহার করার সংকল্প বা ওয়াদাকে কখনো
পৃষ্ঠা:৩৫
‘তওবা’ বলা যায়না।(খ) যে সময় এ অনুভূতি জাগ্রত হবে যে, সে আল্লাহর না-ফরমানী করেছে তৎক্ষণাৎ তওবা করা কর্তব্য। আর যেভাবেই সম্ভব তার প্রতিবিধান করা উচিত, একাজে টালবাহানা করা উচিত নয়।(গ) তওবা করে বার বার তা ভঙ্গ করা বা তওবাকে একটা কৌশল বা খেলায় পরিণত না করা।(৩) যে ব্যক্তি সাচ্চা দিলে তওবা করেছে এবং সে অপরাধ পুনরায় না করার অঙ্গীকারও করেছে কিন্তু মানবিক দুর্বলতার কারণে তার পুনরাবৃত্তি ঘটে তবে পূর্বের গুনাহটি নতুন হবে না কিন্তু পরবর্তী অপরাধের জন্য অবশ্য তাকে পুনরায় তওবা করতে হবে। আর ভবিষ্যতে সে তওবা ভঙ্গের মতো অপরাধ করবে না বলে শক্ত প্রতিজ্ঞা ও সংকল্প করতে হবে।(চ) পূর্বেকৃত ও তওবাকৃত গুনাহ সমূহের কথা সময় সময় মনে আসলেই তখন নতুন করে তওবা করার প্রয়োজন নেই।কিন্তু তার নফস যদি পূর্বকৃত গুনাহর কথা স্মরণ করে আনন্দ বা পুলক অনুভব করে তবে তার জন্য বার বার তওবা করা কর্তব্য। যেনো গুনাহর স্মৃতি তার জন্য আনন্দের পরিবর্তে লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর তয়ে গুনাহ হতে তওবা করেছে, সে অতীতে কোন এক সময় আল্লাহর না- ফরমানী করেছিলো এ কথা মনে করে কিছুতেই আনন্দ লাভ করতে পারে না। তবুও যদি কেউ আনন্দ পায় তবে মনে করতে হবে যে, আল্লাহর ভয় তার দিলে মজবুত হয়ে বসতে পারেনি। (তাফহীমুল কুরআন, আত্-তাহরীম-ঢাকা-১৯)
বার বার কৃত তওবা:
এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, খেলা-তামাশা ছাড়া অনেকে খালেছভাবে তওবা করে কিন্তু ঈমানের দুর্বলতার কারণে তার উপর অটল থাকতে পারে না, পুনরায় সে কাজ করে ফেলে আবার অনুতাপের আগুনে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয় এবং পুনঃ তওবা করে। এরূপ অবস্থায় বারবারকৃত তওবা কবুল হবে কি? উত্তরঃ গুনাহর চিকিৎসা বা প্রতিকার হচ্ছে তওবা ও সংশোধন। তওবা করার পর মানুষ মানবিক দুর্বলতা অথবা শয়তানের প্রলোভনে পড়ে যতোবারই তা তঙ্গ করুক না কেন, তাকে বার বার তওবা করে তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার চেষ্টা করা উচিত। যেমন কোন ব্যক্তি দুর্গম পার্বত্য পথে চলতে গিয়ে বার বার পিছলে পড়ে যায়। কিন্তু তার গন্তব্যে পৌঁছার একমাত্র উপায় হচ্ছে, যতোবারই সে পিছলে পড়ুক না কেন ততোবারই তাকে উঠে দাঁড়িয়ে পথ চলা অব্যাহত রাখা। যেখানে পিছলে পড়েছে সেখানেই যদি সে পড়ে থাকে তবে আর কোনদিন
পৃষ্ঠা:৩৬
সে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারবে না। তেমনিভাবে নৈতিক উচ্চমার্গে আরোহণকারী ব্যক্তিও যদি প্রতিটি পদঙ্খলনে নিজেকে সামলিয়ে নেয় এবং সত্য পথে দৃঢ়পদ থাকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তবে মহান আল্লাহ তার ঐ সাময়িক পদঙ্খলনের জন্য তাকে পাকড়াও করবেন না এবং তাকে সাফল্য থেকেও বঞ্চিত রাখবেন না।
তওবাকে শক্তিশালী করার এবং তওবা ভঙ্গ রোধ করার একটি কার্যকরী ব্যবস্থা হচ্ছে, নফল নামায, নফল রোযা ও নফল সাদকার সাহায্য গ্রহণ করা। এ বস্তুগুলো গুনাহর কাফফারার সাথে সাথে আল্লাহর রহমতকে মানুষের দিকে আকৃষ্ট করে। এবং অসৎ প্রবণতাগুলোর মোকাবেলা করার জন্য মানুষের আত্মাকে অধিকতর শক্তিশালী করে। (রাসায়েল ও মাসায়েল ২য় খন্ড, পৃ-৩৬৬/৬৬৭)উপরোক্ত আলোচনা ও নিম্নোক্ত আয়াত এবং হাদীস আমাদেরকে আল্লাহ তা’য়ালার অসীম মহত্ত্ব, ধৈর্য্য, ক্ষমা ও স্নেহ পরায়ণতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। এরপর যারা এ সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাদের মতো হতভাগা আর এ পৃথিবীতে কে আছে? ইরশাদ হচ্ছে:ومن يعمل سوء أو يظلم نفسه ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهُ يَجِدِاللهُ غَفُورًا رَّحِيمًا .কেউ কোন খারাপ কাজ করে অথবা নিজের উপর জুলুম করে যদি আল্লাহ তা’আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে সে আল্লাহকে অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু (হিসেবে) পাবে। (সূরা নিসা-১১০)একবার নবী আকরাম (স) মা’য়াজ ইবনে জাবালকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তুমি কি জানো আল্লাহর প্রতি বান্দার দায়িত্ব কি? বান্দার দায়িত্ব হলো আল্লাহর ইবাদাত করা এবং তার সাথে আর কাউকে শরীক না করা।’অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহর দায়িত্ব কি? আল্লাহর দায়িত্ব হচ্ছে বান্দাকে শাস্তি না দেয়া।’ (ইবনে কাসীর ৩য় খন্ড)হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত-রাসূলে আকরাম (স) তাঁর মহাপরাক্রমশালী প্রভু থেকে বর্ণনা করেছেনঃإن الله كتب الْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ ثُمَّ بَيْنَ ذَالِكَ فَمَنْ
পৃষ্ঠা:৩৭
هم بحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلُهَا كَتَبَهَا اللَّهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةٍ فإن هم بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ عِنْدَهُ عَشْرَ حَسَنَاتِ التي سبع مات ضعف إلى أضعاف كَثِيرَةٍ ، وَمَنْ هُمُ بسيئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلُها كَتَبَهَا اللهُ عِنْدَهُ حَسَنَةٌ كَامِلَةً وَإِنْ هُوَ هُمُ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللَّهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً أوْمَحاهَا وَلايَهْلِكُ عَلَى اللهِ إِلا هَالِك .আল্লাহ নেকী ও গুনাহকে লিখে রাখেন। যখন কোন ব্যক্তি নেকী করার নিয়ত করে কিন্তু তা সম্পন্ন করতে পারে না তখনও তার আমলনামায় পূর্ণ একটি নেকী লিখা হয়। আর যদি সে কোন নেকী করার নিয়ত করে এবং তা সম্পাদন করে তবে ঐ নেকী দশ থেকে সাত শ গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয় এমনকি তার চেয়েও বেশী।পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি যদি গুনাহর কাজ করার ইচ্ছে করে কিন্তু তা সম্পন্ন না করে তবে তার আমলনামায় ও একটি পূর্ণ নেকী লিখা হয়। আর যদি সে মন্দ কাজের নিয়ত করে এবং তা করেই ফেলে তবে তার আমলনামায় মাত্র একটি গুনাহ লিখেন। আর যদি সে তওবা করে তবে তাও আমলনামা হতে মুছে দেন। একমাত্র যারা ধ্বংস হওয়ার উপযুক্ত শুধু তারাই আল্লাহর নিকট ধ্বংস হয়ে যাবে। (বুখারী, মুসলিম)
শিক্ষাবলী:
১। তওবা কবুল করা আল্লাহ্ তা’আলার একটি বিশেষ গুণ।
২। বান্দাহ্ অপরাধ করে আল্লাহ্র নিকট তওবা করলে তিনি অত্যন্ত খুশী হন।
৩। কৃত অপরাধের তওবা করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।
৪। আল্লাহ মেহেরবাণী করে মানুষের তওবা কবুল করেন এটা তাঁর বান্দাহর উপর
বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়।
৫। যদি আল্লাহ্ তওবা কবুল না করতেন তবে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য ছিলো।
৬। আল্লাহর নিকট তওবা খালেসভাবে করতে হবে। কোনরূপ কূটিলতা নিয়ে তওবা করলে তা গৃহীত হবে না।
৭। মৃত্যুর এতটুকু পূর্বপর্যন্ত তওবা কবুল হয়, যেনো সে তওবার উপর অটল আছে এ প্রমাণ দেয়া সম্ভব হয়।
৮। মানবিক দূর্বলতার কারণে অপরাধের পূণরাবৃত্তি হলেও বার বার তওবা করতে
হবে। কিন্তু ইচ্ছে করে এমন করা হারাম।
৯। অপরাধ যতো বড়ো এবং বেশী হোক না কেন আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা থেকে
নিরাশ হওয়া যাবেনা। ১০। আল্লাহ্ আমাকে মা’ফ করবেন সর্বদা এ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে।
পৃষ্ঠা:৩৮
অবৈধ উপার্জনের পরিণতি
منْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ (رض) عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لا يَكْسِبُ عَبْدمالَ حَرَامٍ فَيَتَصَدَّقُ مِنْهُ فيقبل منه ولا يُنْفِقُ مِنْهُ فَيُبَاركَ لَهُ فِيهِ وَلَا يتركه خلف ظهره إلا كَانَ زَادَهُ إِلى النَّارِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَمْحُو المية بالسي ، ولكن يمحو السيء بالحسن إن الخبيث لا يمحو الخَبِيثَ – (مشكوة) —”আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেনঃ “কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে কোন মাল উপার্জন করে তা যদি আল্লাহর পথে দান করে তাহলে তার এ দান গ্রহণ করা হয়না। যদি নিজের অথবা পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় করে তবে সেখানেও কোন বরকত হয়না। আর যদি সে সম্পদ রেখে মারা যায় তবে তা জাহান্নামের পাথেয় বা সম্বল হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অন্যায় দিয়ে অন্যায়কে মিটিয়ে দেননা বরং সৎ কাজের দ্বারা পাপাচারকে মিটিয়ে দেন। (তেমনিভাবে) অবশ্যই অপবিত্রতা অপবিত্রতাকে মুছে দিতে পারেনা। (মিশকাত, রাহে আমল।
পৃষ্ঠা:৩৯
শব্দার্থ : ليكسب – উর্পাজন করবে না। বান্দা (এখানে কোন লোকঅর্থে)। مال حرام – হারাম মাল। فيتصدق – অতঃপর ছদকা করবে, দান করবে। – তা হতে। فقلُ- অতঃপর কবুল করা হবে (ট্রেধশণ গমধভণ)। لا يتفق – না খরচ করা হবে (ট্রেবশণ শমধডণ)। فبارك – অতঃপর বরকত দেয়া হবে। ولا يتركه خلف ظهره (STEP – )তবে তা কোন কল্যানে আসবে না।)। – আর যদি রেখে মারা যায় ব্যতীত كَانَ زَادَهُ – তার পথের সম্বল হবে। إلى النار – )যে পথ) জাহান্নামের দিকে (গিয়েছে)। إن الله নিশ্চয়ই আল্লাহ্। لا يحر – মুছে দিবেন না, পরিচ্ছন্ন করবেন না। পাপ, অপরাধ। لكن – কিন্তু। بالسن – পুণ্যের দ্বারা। – নিশ্চয়ই। الخبيث – অপবিত্রতা। –
বর্ণনাকারীর (রাবীর) পরিচয়:
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মুসলমান হন। তিনি আবিসিনিয়া হিজরতকারীদের অন্যতম। নবী করীম (স) এর মদীনায় হিজরত করার খবর পাওয়া মাত্র-তিনি আবিসিনিয়া থেকে মদীনায় চলে আসেন। বাকী জীবন তিনি হজুরে পাক (স) কে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা) বলেন, “আমরা ইয়েমেন থেকে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসউদকে নবী পরিবারের লোক বলে ধারণা করতাম।” হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) এক বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। কুরআন, হাদীস, ফেকাহ্ ইত্যাদি সকল বিষয়েই তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। মদীনায় যে কয়জন সাহাবী ফতোয়া দিতেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কুরআন শিক্ষায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। হজুর (স) বলেন-“কুরআন শরীফ যে ভাবে নাযিল হয়েছে হুবহু সেভাবে যদি কেউ পড়তে চায় সে যেনো আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ এর নিকট যায়।” এই জ্ঞানের বিশাল মহীরুহ হিজরী ৩২ সনে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৮৪৮টি।
হাদীসটির গুরুত্ব:
হারাম উপার্জনের পরিণতি এবং হালাল উপার্জনে উৎসাহিত করার জন্যই মূলতঃ এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। সর্বজনস্বীকৃত একটি কথা আছে ‘হারামের আরাম নেই।” এ হাদীসটি তারই দিক নির্দেশক। হাদীসটিতে হারাম উপার্জনের
পৃষ্ঠা:৪০
অসারতা এবং হারাম পন্থায় উপার্জিত অর্থ যে, কোন কল্যাণেই লাগে না তা স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। ব্যবহারিক জীবনে হাদীসটি আলোক বর্তিকা স্বরূপ।
ব্যাখ্যা:
মানুষ সাধারণত ভোগ, বিলাসিতা, অপচয় ও সঞ্চয়-এই কয়টি প্রক্রিয়ার জন্য অন্যায় ও অবৈধ উপার্জনে উৎসাহিত হয়। তার মধ্যে বিলাসিতা ও অপচয় প্রধান। কারণ যতোটুকু একজন মানুষের অথবা তার পরিবারের মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে গণ্য ততোটুকু মানুষ সাধারণতঃ চেষ্টা ও শ্রমের বিনিময়ে পেতে পারে। হয়তো এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন অনেক মানুষ আছে যারা চেষ্টা শ্রম ও মেধা ঠিকই দিচ্ছে কিন্তু তবুও তাদের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু পূরণ হচ্ছে না। এর জবাব হচ্ছে যারা সমাজের কর্ণধার, ধনসম্পদ ন্যায্যভাবে বন্টনের দায়িত্ব তাদের। তারা যদি ন্যায্যভাবে বন্টনে ব্যর্থ হয় অথবা ইচ্ছেকৃতভাবে অমনোযোগী হয় তবে সে জন্য হয়তো কিছু নাগরিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে। যেমন চাকুরীজীবীদের যদি ন্যায্য বেতন কাঠামো নির্ধারণ না করা হয় তবে তাদের মেধা ও শ্রম দিবার পরও তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তেমনিভাবে কৃষিজীবি সে যদি তার কাঁচামালের অথবা পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পায় তবে সে ও সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এ অবস্থায় করণীয় কাজ তিনটি যথা-ধৈর্য্য, আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা ও যাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের পরিণতিতে এ কৃত্রিম অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তাদেরকে উৎখাত করে সৎলোকদেরকে ক্ষমতায় সমাসীন করা। এ শ্রেণীর লোকদেরকে বাদ দিলেও এ বস্তুবাদী সমাজে এক শ্রেণীর লোকের আবির্ভাব হয়েছে যাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের মতো অর্থ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগীতায় নেমেছে। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এর পিছনে কাজ করছে বিলাসিতা ও অপচয়। কারণ সর্বদা Society বা সমাজের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে এরা সাধু সাজে। যদি বলা হয় এতো কিছু না করলেও তো চলে, উত্তর দিবে আজকাল সমাজে চলতে হলে এগুলো লাগবে, না হলে সেকেলে, ছোটলোক, কমজোর ইত্যাদি বলবে। কিন্তু এ কথাগুলো বলার আগে একবারও ভেবে দেখে না যে, সমাজতো ব্যক্তির সমষ্টি মাত্র। প্রত্যেক ব্যক্তিই যদি নিজে নিজে সংশোধিত হয়ে যায় তবে সমাজ ও সংশোধন হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সমতা। তাহলে কোন সমস্যাই থাকে না। আর যখনই কোন বক্তি আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ
পৃষ্ঠা ৪১ থেকে ৬০
পৃষ্ঠা:৪১
বাড়িয়ে দিবে তখনই অবৈধ ভাবে অর্থোপার্জন ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না। এমনিভাবে ব্যক্তি বা সমাজ এক জঘণ্য পাপের দিকে ধাবিত হয়। নবী করীম (স) বলেছেনঃالحلال أم مِنَ الْحَرَام – (بخاری) يأتي على الناس زمان لا يبالي المرء مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ ‘এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ সম্পদ অর্জনের ব্যাপারে হারাম হালালের পরওয়া করবেনা।’ (বুখারী) অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃطلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة .‘হালাল উপার্জন করাও ফরজ সমূহের পর একটি ফরজ।’ (হাদীসটি মাওঃ আশরাফ আলী থানবী (রহ) খুৎবাতুল আহকামে বর্ণনা করেছেন)। নবী করীম (স) আরো বলেনঃإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُؤْمِنَ الْمُحْترف (ترغيب – طبرانی)“আল্লাহ্ সেই মুসলমানকে ভালবাসেন যে পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা অর্জন করে।” (তারগীব, তাবারানী)হযরত জাবের (রা) নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (স) বলেছেনঃيا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا اللهَ وَاجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ فَإِنَّ نَفْسًا لن تموت حتى تَسْتَوْفِي رِزْقُهَا وَإِنِ ابْطَأَ عَنْهَا فَاتَّقُوا الله وأجملُوا في الطلب خذوا مَا حَلَّ وَدَعُوا مَا حَرُم .(ابن ماجه) “হে মানুষ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো ও তাঁর নাফারমানি থেকে দূরে থাকো। জীবিকার জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করোনা। কোন ব্যক্তি তার জন্য নির্ধারিত সমস্ত রিজিক না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও তা পেতে বিলম্ব হয়। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং জীবিকার জন্য উত্তম পন্থা অবলম্বন করো। হালাল ভাবে জীবিকা অর্জন করো এবং হারামের ধারে কাছেও যেওনা।” (ইবনে মাজাহ)অনেকে মনে করে যে, অবৈধ ভাবে অর্জিত মালের জাকাত দিলে অপরাধ মা’ফ
পৃষ্ঠা:৪২
হয়ে যায়। উল্লেখিত হাদীসটি তাদের এ ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে। কেননা অবৈধ সম্পদের কোন দানই আল্লাহ গ্রহণ করেন না। পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যয় করলে তাতে বরকত হয়না অর্থাৎ হারাম পন্থায় অর্জিত সম্পদ খেয়ে সন্তান জন্ম দিলে তারাও হারামের দোষে দুষ্ট হবে। তাছাড়া হারাম খাদ্য মানুষের হৃদয়কে কঠিন করে দেয়-ফলে আল্লাহর ইবাদাতে মনযোগ থাকেনা। এবং যার খাদ্য, পানীয় এবং পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি হারাম, তার কোন দোয়া ইবাদাত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। রাসূলল্লাহ্ (স) বলেছেন “হারামের দ্বারা গঠিত শরীর জান্নাতে যাবে না।” হারাম উপার্জিত সম্পদ জাহান্নামের পাথেয় হবে অর্থাৎ ভালো কাজ যেমন জান্নাতের পাথেয় বা ভালো কাজের বিনিময়ে জান্নাতে যাওয়া যায় তেমনি ভাবে হারাম কাজ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়।
শিক্ষাবলী:
১। অবৈধভাবে উপার্জন করা হারাম। ২। অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের দান আল্লাহ্র দরবারে গৃহীত হয় না।
৩। অবৈধ সম্পদ জাহান্নামের পাথেয় অর্থাৎ পরিণামে জাহান্নাম।
৪। হালালভাবে সম্পদ উপার্জন করা ফরজ।
৫। মানুষের নির্ধারিত রিজিক সে লাভ করবেই কাজেই রিজিক লাভের ব্যাপারে তাড়াহুড়া ও অবৈধ পন্থায় তা লাভের চেষ্টা করা উচিত নয়।
৬। হারাম সম্পদ দ্বারা পুরিপুষ্ট শরীর জান্নাতে যাবেনা।
পৃষ্ঠা:৪৩
সদকায়ে জারিয়াহ
এক
عن أبي هريرة (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إذا مات الإنسانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَله إلا من ثلاثة من صدقة جارية أو علم ينتفع به أو ولدصالح يدعوا له . –হযরত আবু হুরাইরাহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেনঃ মানুষ যখন মরে যায় তখন তার আমল ও শেষ হয়ে যায়। মাত্র তিন প্রকার আমল অব্যাহত থাকে। (১) সদকায়ে জারিয়া, (২) এমন ইলম যার দ্বারা কল্যাণ সাধিত হয়। এবং (৩) সচ্চরিত্রবান সন্তান, যারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। (মুসলিম)
দুই
عن أبي هُرَيْرَةً (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسلم – إن مما يلحق الْمُؤْمِنَ مِن عمله وحسناته بعد موته علما علمه ونَشْرَه ووَلَدًا صَالِحًا تَرَكَ أَوْ مُصْحَفًا وَرَكَ أَوْ مسجدا بناء أوبيتا لابنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ أَوْ نَهْرًا أَجْرَاء أَوْصَدَقَةً أخرجها من ماله في صحته وحياتِهِ تَلْحَقُ مِنْ مَوتِه .
১. ইসলামের পরিভাষায় ‘আমল’ বলা হয় ঐ সমস্ত কাজকে যার বিনিময়ে আল্লাহ সাওয়াব অথবা শান্তি দিবেন। তবে মু’মিনের জীবনের প্রত্যেকটি কাজই আমল হিসাবে পরিগন্য লেখকহযরত আবু হুরাইরা (রা) কর্তৃক বর্ণিত। রাসূলে আকরাম (স) বলেছেনঃমৃত্যুর পরও মুমিন ব্যক্তি কিছু নেকী অবিচ্ছিন্নভাবে পেতে থাকবে।
(১) যে ব্যক্তি লোকদেরকে দ্বীনের শিক্ষা দিয়েছে এবং দ্বীনের শিক্ষা প্রচার করেছে তার শিখানো লোক যতোদিন পর্যন্ত দুনিয়াতে নেক কাজ করতে থাকবে ততোদিন পর্যন্ত সেও সওয়াব পেতে থাকবে।
পৃষ্ঠা:৪৪
(২) নেক সন্তান, যতোদিন নেক কাজ করতে থাকবে ততোদিন পিত সে সওয়াব পেতে থাকবে। অথবা-
(৩) যে মসজিদ অথবা মাদ্রাসায় কুরআন ওয়াকফ করে দিয়েছে। অথবা
(৪) যে ব্যক্তি মসজিদ তৈরী করে দিয়েছে। অথবা-
(৫) যে মুসাফির বা পর্যটকদের জন্য সরাই খানা তৈরী করে দিয়েছে।
অথবা-
(৬) খাল কাটিয়ে দিয়েছে। অথবা-(৭) জীবনে সে অন্য কোন (জনকল্যাণ মূলক) নেক কাজ করেছে এবং তাতে নিজ সম্পদ হতে খরচ করেছে যতোদিন পর্যন্ত লোক ঐ সমস্ত বস্তু থেকে উপকৃত হবে ততোদিন পর্যন্ত সে (দাতা) ব্যক্তি সওয়াব পেতে থাকবে। (ইবনে মাজাহ, ইবনে খুজাইমাহ, তারগীব) শব্দার্থ: টি। যখন। এ – মরে যায়। انسان – মানুষ। । – বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার থেকে। তার আমল। ينتفع – কল্যানকর। يدمر ১ – তার জন্য দোয়া করে। إن নিশ্চয়ই। যা হ5ে( يلحق المؤمن – মুমিন ব্যক্তি পেতে থাকে। عمله حسناته তার নেক আমল (এর সওয়াব)।بعد موت – তার মৃত্যুর পর। এ দ্বীনি জ্ঞান।- যা সে শিখিয়েছে।ولداً ص نشره – তার উপর তারা তারা যত আমল করবে। – সৎসন্তান।ترک – তাকে ছেড়ে গেলো। ঐ অথবা। এ কুরআন শরীফ। তৈরী করেছে। بینا لابن السبيل সরাইখানা। نهرا নদী। أجره – তার বিনিময়। এحبا তার জীবনে।
বর্ণনাকারীর (রাবীর) পরিচয়:
আবু হুরাইরা (রা) মুসলিম জাহানে অতি পরিচিত একটি নাম। তিনি দাওস গোত্রের সন্তান বলে আদ্-দাওসী বলা হতো, হিজরী সপ্তম বৎসরে মুহাররম মাসে তিনি মদীনায় আগমন করেন। ইতোপূর্বে বিখ্যাত সাহাবী তুফাইল ইবনে আমর আদ্-দাওসীর হাতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম পূর্ব নাম ছিলো ‘আবদে শামস’ বা ‘অরুণ দাস’। রাসূলে আকরাম (স) সে নাম পরিবর্তন করে’ আবদুর রহমান’ রাখেন।আবু হুরাইরা তাঁর লকব বা উপাধী। একদিন নবী করীম (স) দেখেন তার জামার আস্তিনের মধ্যে একটি বিড়ালের বাচ্চা খেলা করছে। একবার আস্তিনের
পৃষ্ঠা:৪৫
ভিতর প্রবেশ করে আবার বাইরে বের হয়। এ ঘটনা দেখে রাসূল (স) কৌতুক করে ডাকলেন ‘হে আবু হুরাইরা। (অর্থাৎ হে ছোট বিড়ালের পিতা!। ব্যাস, সেদিন হতেই তিনি আবু হুরাইরা নামে পরিচিত হলেন। মাত্র সাড়ে তিন বৎসরের মতো তিনি নবী আকরাম (স) এর সাহচর্য পান। সর্বদা মসজিদে নববীতে পড়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন ‘আহলে ছুফ্ফাদে’র একজন। হযরত আবু হুরাইরা (রা) কর্তৃক সর্বাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (স) থেকে এতো বেশী হাদীস বর্ণনার ব্যাপারটি অনেকে সন্দেহের চোখে দেখতো। তাই তিনি বলেন ‘তোমরা হয়তো মনে করেছো আমি খুব বেশী হাদীস বর্ণনা করি। আমি ছিলাম রিক্তহস্ত দরিদ্র। পেটে পাথর বেঁধে সর্বদা রাসূলে আকরাম (স) এর সাহচর্যে কাটাতাম। আর মুহাজিররা ব্যস্ত থাকতো ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে এবং আনসারগণ ব্যস্ত থাকতো ধন সম্পদ রক্ষণা বেক্ষণে।’চরম দারিদ্র ও দূরাবস্থার মধ্যে আবু হুরাইরা (রা) কে বেশী দিন থাকতে হয়নি। নবী করীম (স) এর ওফাতের পর চতুর্দিক হতে প্রবাহমান গতিতে গণিমাতের মাল মুসলমানদের হাতে আসতে থাকে। তখন হযরত আবু হুরাইরা (রা) বাড়ী, ভূ-সম্পতি, স্ত্রী ও সন্তান সব কিছুর অধিকারী হন।হযরত আবু হুরাইরা (রা) ছিলেন জ্ঞান সমুদ্রের অথৈ জল। আল্লাহর রাসূল (স) নিজেই বলেছেনঃ ‘আবু হুরাইরা জ্ঞানের আধার।’ (বুখারী)। জ্ঞানের এ চলন্ত বিশ্বকোষ হিজরী ৫৯ সনে ৭৮ বৎসর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৫৩৭৪টি।
হাদীসন্বয়ের সমন্বয়:
বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় যে, উপরে দুটো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বর্ণনা কৃত হাদীস একত্রিত করা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা নয়। আসলে এক নম্বর হাদীসের ব্যাখ্যা স্বরূপ দ্বিতীয় হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। কেননা দু’নম্বর হাদীসের ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭নং শর্ত গুলো এক নম্বর হাদীসের প্রথম শর্তের ব্যাখ্যা মাত্র। কাজেই হাদীস দুটোতে স্ববিরোধিতা বা কোন দ্বন্দ্ব নেই।
হাদীসটির গুরুত্ব:
মানুষ মৃত্যুর পর তার ভালো অথবা মন্দ কোন কাজ করার যোগ্যতাই থাকে না। তখন সে তার সারা জীবনের সংগৃহীত আমলের নিকট চলে যায়। তবে এমন কিছু কাজ আছে যার সওয়াব তার মৃত্যুর পরও অব্যহত থাকে। যাকে আলোচ্য হাদীসে সদকায়ে জারিয়া বলা হয়েছে।
পৃষ্ঠা:৪৬
কাজেই পরকাল বিশ্বাসী প্রতিটি বুদ্ধিমান লোকেরই উচিৎ হাদীসের পরামর্শ অনুযায়ী মৃত্যুর পূর্বে এমন কিছু কাজ করে যাওয়া যার প্রতিফল মৃত্যুর পরও অব্যহত থাকে। এ দৃষ্টিকোন থেকে হাদীসন্বয় প্রতিটি মুসলিমের জীবনেই গুরুত্বেরদাবীদার।
ব্যাখ্যা:
হাদীসে উল্লেখিত তিন ধরণের কাজই সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত তবু কেন পৃথক পৃথক উল্লেখ করা হলো? এ প্রশ্নটি অনেকের মনে আসতে পারে। এর উত্তর হচ্ছে-তিনটি তিন ধরণের কাজ তাই পৃথক পৃথক করে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন প্রথমটি সম্পাদন করা হয় সম্পদের দ্বারা। দ্বিতীয়টি শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়। আর তৃতীয় বিষয়টি একটু জটিল। কারণ সৎ-সন্তান এটা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দান। তবে চেষ্টা করতে হবে যেনো স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই দ্বীনি ইলমের শিক্ষায় শিক্ষিত হয় এবং আদর্শ ও সচ্চরিত্রবান হয়ে গড়ে উঠে।আলোচ্য হাদীসে ‘সুসন্তান যারা তার জন্য দোয়া করবে’ বাক্যটি দ্বারা নবী করীম (স) দুটো বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যথাঃ
(১) পিতার কর্তব্যঃ সন্তানকে দ্বীনি ইলম শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং সচ্চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যথায় এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে সন্তানের পথ ভ্রষ্টতার জন্য আদালতে আখিরাতে জবাবদিহি করতে হবে।
(২) সন্তানের কর্তব্যঃ পিতামাতা জীবিত থাকাবস্থায় তাদের সেবা যত্ন করতে হবে। আর এ সেবা যত্বের মাধ্যমেই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। বরং মৃত্যুর পরও পিতা-মাতার কল্যাণের জন্য দোয়া করতে হবে। কেননা অন্য হাদীসে আছে পিতামাতার জন্য দোয়ার উল্লেখ ছাড়া কোন দোয়াই আল্লাহর নিকট কবুল হয় না। হাদীসে উল্লেখিত কাজগুলো ছাড়াও আরো অনেক সদকায়ে জারিয়ার কাজ আছে যেমন পথের ধারে গাছ লাগানো, কোন এতিমকে লালন পালন করে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া ইত্যাদি। বস্তুতঃ প্রতিটি জনকল্যাণ বা সমাজ কল্যাণ মূলক কাজই সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত।এখন প্রশ্ন হতে পারে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াবতো মৃত ব্যক্তি পেয়ে থাকে কিন্তু যদি অপর কোন জীবিত ব্যক্তি মৃত ব্যক্তিকে সওয়াব পাঠায় তবে সম্ভব কিনা?বিপুল সংখ্যাক হাদীসের বর্ণনা হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মৃত লোকদের জন্য সওয়াব পাঠানো সম্ভব কেবল সম্ভবই নয়, সবধরণের ইবাদাত ও নেক
পৃষ্ঠা:৪৭
আমলেরই সওয়াব পাঠানো যায়। সেজন্য বিশেষ ধরণের কোন ইবাদাত হওয়া জরুরী নয় বা জরুরী হওয়ার কোন শর্তও নেই। কিন্তু এ প্রসঙ্গে চারটি কথা খুব ভালোভাবে বুঝে নেয়া প্রয়োজন।একঃ কেবলমাত্র সেই আমলের সওয়াবই মৃত ব্যক্তির নামে পাঠানো যাবে যা খালেছ ভাবে আল্লাহর জন্য এবং শরীয়তের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী করা হবে। অন্যথায় গাইরুল্লাহর জন্য অথবা শরীয়তের নিয়ম-নীতি বিরোধী যে আমল করা হবে, তার জন্য স্বয়ং আমলকারীই কোনরূপ সওয়াব পাবেনা কাজেই তা অন্যের জন্য পাঠানোর কোন প্রশ্নই উঠেনা।দুইঃ যে সব লোক আল্লাহর নিকট ‘নেক লোক’ হিসেবে মেহমান হয়ে আছে, তাদের জন্যতো সওয়াবের উপঢৌকন অবশ্যই পৌঁছবে এবং তারা তা পাবে। কিন্তু যারা সেখানে পাপী অপরাধীরূপে হাজতে বন্দী হয়ে আছে, তাদের নিকট কোন সওয়াব পৌঁছবে বলে আশা করা যায় না। আল্লাহর মেহমানগণ হাদীয়া তোহফা পেতে পারে; কিন্তু আল্লাহর অপরাধীগণ হাদীয়া তোহফা পাবে, তার কোন আশা নেই। তাদের জন্য যদি কেউ ভুল ধারণার বশে কিছু সওয়াব পাঠায় তবে তা বিনষ্ট হয়ে যাবে না সত্যি, কিন্তু অপরাধী তা পাবেনা বরং আমলকারীর নিকটই তা ফিরে আসবে বা তার আমলনামায়ই লিখিত হবে। যেমন মনি অর্ডার প্রাপক না পেলে প্রেরক তা ফিরে পায়।তিনঃ সওয়াব পৌঁছানো যায়। সম্ভব। কিন্তু আজাব বা গুণাহ্ পৌঁছানো সম্ভব নয়। অর্থাৎ কেউ নেক কাজ করে সওয়াব বখশিশ করলে তা সেই লোক পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে কিন্তু কেউ গুণাহ্ করে তার শাস্তি বা ফলাফল ভোগ কারো জন্য পাঠালে তা ঐ ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছবে না।চারঃ নেক আমলের ধারা দু’টি। প্রথম ধারাটি হচ্ছে ঐ সব সৎকাজ, যা আমলকারীর নিজের রুহ-আত্মা ও চরিত্রের উপর প্রতিফলিত হয়। এবং সেজন্য আল্লাহর নিকট প্রতিফল পাওয়ার অধিকারী হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সে সব নেক কাজ যার বিনিময় আল্লাহ্ তাকে পুরষ্কার স্বরূপ দিবেন। প্রথম ধারাটির সওয়াব পাঠানো যায়না তবে দ্বিতীয় ধারাটির সওয়াব পাঠানো যায়। তার উদাহরণ হচ্ছে, এক ব্যক্তি শরীর চর্চা-ব্যায়াম ইত্যাদি করে কুস্তিতে দক্ষতা লাভের চেষ্টা করে, ফলে যে দক্ষতা ও যোগ্যতা সৃষ্টি হয় তা তার নিজের সম্পদ। এটা হস্তান্তর করা যায় না। এখন যদি সে কোন দপ্তরে চাকুরী করে এবং কুস্তিগীর হিসেবে তার বেতন ধার্য হয় তবে তাও সে নিজেই পাবে কিন্তু তার কর্মদক্ষতা দেখে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে যে সব উপহার উপঢৌকন দিবে, তা সে তার পিতা মাতা অথবা অন্য কোন অত্মীয়ের নিকট পাঠানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে পারে এবং
পৃষ্ঠা:৪৮
তা তার পরিবর্তে ঐ ব্যক্তির নিকট পৌঁছানো যেতে পারে। সৎ কাজের অবস্থাও ঠিক তদ্রুপ। যে সব আমলে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ আছে তা অন্য কাউকে দেয়া যায় না, তবে ঐ কাজের জন্য যে সওয়াব কারো নামে লিখার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করা যায়। ঈছালে জাযা (শুভ কর্মফল) বলা হয় না, ঈছালে সওয়াব বা পৌঁছানো বলা হয়। নির্দিষ্ট তা অন্য এজন্য এটাকে প্রাপ্য সওয়াব উপরোক্ত আলোচনার মূল কথা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিকে অবশ্যই নেককার হতে হবে। অন্যথায় তার নিকট পাঠানো সওয়াব তাকে বড়ো ধরণের কোন কল্যাণই দিতে পারবে না। কিন্তু সে যদি নেককার হয়ে থাকে তবে অতিরিক্ত সওয়াব তার মর্যাদাকে আরো বাড়িয়ে দিবে।
পৃষ্ঠা:৪৯
রমযানের রোজা ও লাইলাতুল কদর
عن أبي هريرة (رض) عن النبي صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ منْ صَامَ رَمَضانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَنْ قَام ليلة القدر إيمانًا واحْتِسَابًا غُفِرَله ما تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ . –আবু হুরাইরা (রা) হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূলে আকরাম (স) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও আল্লাহর নিকট সওয়াবের আশায় রমযানের রোজা রাখবে, তাঁর অতীতের গুণাহ মাফ করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি কদর রাত্রিতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদাতে অতিবাহিত করবে তারও অতীতের গুণাহ মা’ফ করে দেয়া হবে। (বুখারী) শব্দার্থঃ من صام – যে রোজা রাখলো। সওয়াবের আশায়। – তাকে মা’ফ করে দেয়া হয়। তার গুনাহ্ সমূহ। من قام – যে দাঁড়ায় )এখানে, যে ব্যক্তি জাগ্রত অবস্থায় কাটায়।( القَدْرِ কদরের রাত্র।
বর্ণনাকারীর পরিচয়:
(দারসে হাদীস ১ম খন্ড ও অত্র পুস্তকের ৭নং হাদীস দ্রষ্টব্যঃ)
ঐতিহাসিকপটভূমি:
মুসলমানগণ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের দ্বিতীয় বৎসরে রমযানের রোজা ফরজ করা হয়, নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে-فمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشهر فليصمه . ‘যে লোক এ মাসটি পাবে, সে যেনো অবশ্যই এ মাসের রোজা পালন করে।’ (বাকারাঃ ১৮৫)ك تب عليكم الصيام كما كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ —.’তোমাদের উপর রোজা ফরজ করে দেয়া হলো। যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী
পৃষ্ঠা:৫০
(উম্মত) গণের উপরও ফরজ করা হয়েছিলো।’ (বাকারাঃ ১৮৩) হিজরতের পর প্রথম এক বৎসর শুধু ইসলামী আকিদা বিশ্বাস-আল্লাহ্ ও রাসূলের হুকুম পালনে দৃঢ় ও অপরিসীম নিষ্ঠাবান হিসেবে গড়ে তোলার ট্রেনিং দেয়া হয়। যখন দেখা গেলো এ প্রাথমিক ট্রেনিং তারা সফলতার সাথে সমাপন করলো। তখনই রোজার মতো কষ্টসাধ্য ফরজ পালনের নির্দেশ দেয়া হলো।রোজা এমন একটি ইবাদাত যার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ভাবধারা জাগ্রত হয় এবং আল্লাহর সাথে বান্দার গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। যা অন্য কোন ইবাদাতের মাধ্য- মে লাভ করা সম্ভব নয়। এজন্যই পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের উপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিলো। তবে তার সংখ্যা ও ধরণ কিছুটা ভিন্ন ছিলো।ইসলামের অধিকাংশ নির্দেশ ও বিধানের ন্যায় রোজাও ধারাবাহিক ভাবে ফরজ করা হয়। প্রথম দিকে মুসলমানদেরকে প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোজা রাখার উপদেশ দেয়া হয়েছিলো কিন্তু তখন রোজা ফরজ করা হয়নি। তারপর দ্বিতীয় হিজরীর রমযান মাসে রোজা ফরজ করা হয়। তবুও এতটুকু অবকাশ রাখা হয়েছিলো যে, রোজা রাখার সামর্থ থাকা সত্ত্বে ও যারা রোজা রাখবে না তারা প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। পরে এ বিধান রহিত করে শুধু পথিক, বৃদ্ধ, স্তন্য দানকারিনী ইত্যাদি মা’জুর লোকদেরকে অবকাশ দেয়া হয়।
হাদীসটির গুরুত্ব:
এ হাদীসে এমন একটি মাস এবং রাত সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, যা গুরুত্ব ও কল্যাণের দিক দিয়ে অতুলনীয়। কেননা বহু ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ঘটনা এ মাসে ঘটেছে। তাছাড়া এ মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং এমন একটি রাত এ মাসের মধ্যে আছে, যা এক হাজার মাসের চেয়েও মর্যাদার দিক দিয়ে উত্তম। উম্মতে মুহাম্মদী হায়াতের দিকে ছোট হ’লেও যাতে ইবাদাতের দিকে ছোট না হয় এজন্যই মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এর আরও একটি কারণ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহকে দিয়ে আল্লাহ যা করাতে চান তা করতে হলে নৈতিক মানের উৎকর্ষের প্রয়োজন। এ উৎকর্ষতা একমাত্র রোজার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। এ কারনেই এ হাদীসে রোজার জন্য এতো গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ব্যাখ্যাঃ
রমযান নামকরণের তাৎপর্য: রমযান )رمضان( টি رمض ধাতু
পৃষ্ঠা:৫১
হ’তে নির্গত। অর্থ দহন হওয়া, জ্বলা, ভগ্ন হওয়া ইত্যদি মাসকে রমযান নামকরণে বেশ ক’টি কারণ বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে প্রধান কয়েকটি মতামত উল্লেখ করা হলো। একদল বলেনঃ ‘রোজা রাখার দরুন ক্ষুধা তৃষ্ণায় রোজাদারের পেট জ্বলতে থাকে, এজন্য এ মাসকে রমযান বলা হয়।’ অন্য একদলের মতেঃ ‘এ মাসে যে সমস্ত নেক আমল করা হয় তা সমস্ত গুণাহকে ভূষ্মিভূত করে দেয়, এজন্যই রমযান নামকরণ করা হয়েছে।’অপর দলের মতেঃ ‘এ মাসকে রমযান বলা হয় এই কারণে যে, এ মাসে লোকদের মন মগজ ওয়াজ-নসীহত ও পরকাল চিন্তার দরুন বিশেষ ভাবে উত্তাপ গ্রহণ করে থাকে, যেমন সূর্যতাপে বালু রাশি ও প্রস্তর সমূহ উত্তপ্ত হয়ে থাকে।'(ইমাম কুরতুবী, তাঁর বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর “আল্ জামেউল আহকামুল কুরআন নামক গ্রন্থে উপরোক্ত মত সমূহ বর্ণনা করেছেন।)রমযান মাসের মাহাত্ম্যঃ আল-কুরআনে এ মাসের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে দু’টো কথা বলা হয়েছেঃشهر رمضانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ . ‘রমযান এমন একটি মাস, যে মাসে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ (বাকারা: ১৮৫)ليلة القدر خير من ألف شهر . ‘(এ মাসেই আছে) কদর রাত্রি, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’ (সূরা কদরঃ ২)
এ মাসের মর্যাদা শুধুমাত্র রমযান হওয়ার কারণেই নয় বরং এ মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে উপরোক্ত দু’টি কারণে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আগত এবং অনাগত প্রতিটি মানুষের জন্যই জীবন বিধান বা পথ নির্দেশক। এ গ্রন্থটিই আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র পথ। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে গ্রন্থটি এতো মর্যাদাবান, সে গ্রন্থের অবতীর্ণের কারণেই এ মাসের মর্যাদা আরো এক ধাপ বেড়ে গিয়েছে। তাছাড়া এ মাসেই সহীফা সহ বেশ কিছু আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃنزلت صحف إبراهيم أول ليلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ وَأَنْزِلَتِ
পৃষ্ঠা:৫২
التوراة السبت ومضين والانجيل الثلاث عشرة والقرآن الأربع مشرين‘হযরত ইব্রাহিমের সহীফা সমূহ রমযান মাসের প্রথম রাত্রিতে নাযিল হয়েছে। তওরাত কিতাব রমযানের ছয় তারিখে, ইন্জিল তের তারিখে এবং আল- কুরআন রমযানের চব্বিশ তারিখে নাযিল করা হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিবরানী)উপরোক্ত আলোচনা হতে একথা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, এ মাসের মর্যাদা বৃদ্ধির তিনটি কারণ এমন যা অন্য কোন মাসে অনুপস্থিত। যথা-
(ক) এ মাসে রোজা হওয়ার কারণে অন্য মাসের চেয়ে মর্যাদা বেড়ে গিয়েছে।
(খ) রমযানে আল-কুরআন সহ বেশ কিছু আসমানী গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে।
(গ) এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাস বা ত্রিশ হাজার রাত ও ত্রিশ হাজার দিনের সমষ্টির চেয়েও উত্তম।ঈমান (র) ও ইহতিসাবান () এর তাৎপর্য: প্রথম শব্দটির অর্থ নিয়ত এবং দ্বিতীয় শব্দটির অর্থ দৃঢ় সংকল্প। অর্থাৎ রোজা রাখতে হবে ঈমানের সাথে, এই বিশ্বাসের সাথে যে, রোজা আল্লাহ তাআলাই ফরজ করেছেন এবং মুসলমান হিসেবে এটা আমার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের অন্তর্ভূক্ত।দ্বিতীয় শব্দটির তাৎপর্য হচ্ছে- এর রোজা রাখতে হবে একান্তভাবে আল্লাহর সন্তোষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে। লোক দেখানোর জন্য নয় এবং রাখতে হবে এ আশায় যে, এজন্য আল্লাহ তাআলার নিকট হতে বিশেষ সওয়াব ও প্রতিফল পাওয়া যাবে। উপরন্ত এজন্য মনে দূরন্ত ইচ্ছা-বাসনা ও কামনা থাকতে হবে। রোজা রাখার প্রতি একবিন্দু অনীহা ও বিরক্তিভাব থাকতে পারবে না, একে একটি দূরহ বোঝা মনে করা যাবে না; রোজা রাখা যতোই কষ্টকর হোক না কেন। বরং রোজার দিন দীর্ঘ হলে ও রোজা থাকতে কষ্ট অনুভূত হলে, আল্লাহর নিকট হতে আরো বেশী সওয়াব পাওয়ার কারণ মনে করতে হবে। বস্তুত এ ধরনের মন ও মানসিকতার সাথে রোজা রাখলে তার বিনিময়ে অতীতের যাবতীয় গুণাহ্ মা’ফ হয়ে যাবে। (হাদীস শরীফ ২য় খন্ড-৩৪৬ পৃষ্ঠা) রমযানের নফল অন্য মাসের ফরজ ইবাদাতের সমান মর্যাদাঃনবী করীম (স) বলেছেনঃوَقِيامَ لَيْلَتِ تطومًا من تقرب فِيهِ بِخَصْلَةٍ مِنَ الْخَيْرِ كَانَ
পৃষ্ঠা:৫৩
كمن أدى فريضة فيما سواء ومَنْ أَنَّى فَرِيضَةً فِيهِ كَانَ كَمَنْ أدى سَبْعِينَ فَرِيضَةً فيما سواه . —’যে ব্যক্তি এ মাসের রাতে আল্লাহর সন্তোষ্টি ও তাঁর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ফরজ নয় এমন কোন ইবাদাত অর্থাৎ সুন্নত বা নফল আদায় করবে, তাকে অন্য সময়ের ফরজ ইবাদাতের সমান সওয়াব দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ ইবাদাত করবে তাকে অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজ ইবাদাতের সমান সওয়াব দেয়া হবে।’ (বায়হাকী, শোয়াবুল ঈমান) উক্ত হাদীসের আলোকে বাহ্যতঃ বুঝা যায়, মাসের কারণেই ইবাদাতে সওয়াবের তারতম্য হয় কিন্তু গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝা যায় তা ঠিক নয়। কেননা ইবাদাত যে সময়েই করা হোক না কেন তার বাহ্যিক রূপতো সর্ববস্থায় একই থাকে। তবে সওয়াবের তারতম্যের কারণ হচ্ছে আভ্যন্তরীণ মনের অবস্থার প্রেক্ষিতে। রমযানে ইবাদাতের সওয়াব এতো বেশী দেয়ার নিগূঢ় তত্ত্ব হচ্ছে, এ মাসে মুমিনের মন-দিল নরম থাকে। প্রতি মুহূর্তে ভুল-ত্রুটি হ’তে বাঁচার জন্য থাকে সতর্ক দৃষ্টি। তবুও যদি দুর্ঘটনাক্রমে কোন ত্রুটি- বিচ্যুতি ঘটে যায় সাথে সাথে তারা তওবা ইস্তিগফারের মাধ্যমে সংশোধন হয়ে যায়, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আল্লাহর দরবারে রোনাজারী করে। এভাবেই সে তাকওয়া-পরহেজগারীর শীর্ষে অবস্থান করে এবং তার মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় আধ্যাত্মিক ভাবধারা জাগ্রত হয়, ফলে প্রতিটি ইবাদাতই আল্লাহভীতি ও আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সম্পন্ন করে; এজন্য ইবাদাতে গুনগত পার্থক্য সৃষ্টি হয়, যার কারণে আল্লাহ্ রাবুল আলামীন তার সওয়াবের মাত্রাও বাড়িয়ে দেন। (এ ব্যাপারে আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ) রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসঃ হাদীসে আছে “রমযানের প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের এবং শেষ দশক ইকুম মিনান্নার বা জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি দান।” এ হাদীসটির তাৎপর্য হচ্ছে, রমযানের বরকত ও কল্যাণ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। যে সমস্ত লোক রোজার পূর্ণ হক আদায় করে রোজা থাকবে এবং অতীতের ভুলত্রুটি সংশোধনের প্রচেষ্টা অব- ্যহত রাখবে তাদের জন্য আল্লাহ অবারিত রহমত বর্ষণ অব্যহত রাখবেন। বান্দার প্রচেষ্টা রহমতের সম্মিলিত ধারায় বান্দাকে মাগফিরাতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। তখন আল্লাহ্ ঐ বান্দাকে মা’ফ করে মুত্তাকিদের অন্তর্ভূক্ত করে নেন। শুধু তাই নয় শেষ দশকে আল্লাহ্ তাদেরকে জাহান্নাম হ’তে মুক্তি দেন। অর্থাৎ বান্দা এমন কিছু কাজ করেছিলো যা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যেতো,
পৃষ্ঠা:৫৪
সেই অপরাধগুলো মা’ফ করে জাহান্নামের দপ্তর হতে তার নাম কেটে জান্নাতের দপ্তরে লিপিবদ্ধ করে দেন। এ অবস্থা চলাকালিন সময়েই আসে লাইলাতুল কদর। এ রাতের উসিলায় বান্দাকে আরও উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করেন। তারাবীহর মাসঃ নবী করীম (স) বলেছেনঃمن قام رمضانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ ذَنْبِع . ‘যে ব্যক্তি রমযান মাসের রাত্রিতে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে নামায আদায় করবে। তার পূর্বের যাবতীয় গুণাহ্ মা’ফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারী, মুসলিম) হাদীসে উল্লেখিত কিয়াম শব্দটির অর্থঃ তারাবীহর নামায। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁর বুখারী শরীফের ভাষ্য গ্রন্থ ‘উমদাদুল কারী’তে বলেনঃ ‘তারাবীহ্ প্রতি চার রাকায়াত নামাযের নাম। এর আসল অর্থ হচ্ছে বসে বিশ্রাম নেয়া বা বিশ্রাব দেয়া।’ তারাবীহর সওয়াব ও মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলে করীম (স) বলেনঃإن الله تعالى فرض صيام رمضانَ عَلَيْكُمْ وَسَنَنْتُ لَكُمْ قيامه فمن صامه وقامه إيمانا واحْتِسَابًا خَرَجَ مِنْ ذُنُوبِ كيوم ولدته أمه . –’নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা রমযানের রোজা তোমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন আর আমি তোমাদের জন্য সুন্নাত হিসেবে চালু করেছি রমযান মাস ব্যাপী আল্লাহর ইবাদাতে দাঁড়ানো (অর্থাৎ তারাবীহ নামায)। কাজেই যে লোক রমযানে রোজা রাখবে এবং আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে (তারাবীহর মাধ্যমে। ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে। সে তার গুণাহ্ সমূহ হতে এমন ভাবে নিষ্কৃতি পাবে, যেনো সদ্য তার মায়ের পেটে থেকে ভূমিষ্ট হলো।’ (নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ)ইতিকাফের মাসঃ ইতিকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থঃ কোন জিনিসকে বাধ্যতামূলক ধরে রাখা। কোন জিনিসের উপর নিজেকে শক্তভাবে আটকিয়ে রাখা। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে কোন ব্যক্তির বিশেষ ধরণের অবস্থান অবস্থিতি গ্রহণ।আত্ম-শুদ্ধি, আত্মার পবিত্রতা অর্জন, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ এবং আল্লাহর নৈকট্য
পৃষ্ঠা:৫৫
লাতই ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্য। রমযানের শেষ দশকের ই’তিকাফে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম একটি মর্যাদাবান রাতের সন্ধানও ই’তিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য। এ ই’তিকাফ রমযান মাসে করতে হয়। আয়েশা (রা) বলেনঃأن النبي صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرُ من رَمَضَانَ حَتَّى قَبَضَهُ اللهُ .‘নবী করীম (স) আমরণ রমযানের শেষ দশদিন ই’তিকাফ করতেন।’ (তিরমিযি)। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক বৃদ্ধির মাসঃ রমযানে মানুষের অন্তর পরিচ্ছন্ন ও আল্লাহমুখী থাকে বিধায় সর্বদাই বান্দা তাঁর প্রভুর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির তৎপরতায় লিপ্ত থাকে। অন্য মাসে হাজারো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মনকে ঐরূপ আল্লাহমুখী বানানো সম্ভব হয়না। চরিত্র সংশোধনের মাসঃ রমযানে একজন রোজাদার আপ্রাণ চেষ্টা করে তার চরিত্র সংশোধনের জন্য। তার ভিতর অন্য সময় যে সমস্ত খারাপী বাসা বেধেছিলো তা বর্জন করতে সচেষ্ট থাকে। এভাবেই একজন লোক পবিত্র রমযানের উছিলায় সংশোধিত হয়। আর যখন চরিত্র সংশোধিত হয়েই যায় তখন আর তা সহজে নষ্ট হয় না। তাই দেখা যায় চরিত্র সংশোধনের মোক্ষম সময় ও সুযোগ হচ্ছে এই রমযান মাস। পারস্পরিক সহনশীলতা বৃদ্ধির মাসঃ ধনীরা কোনদিন ক্ষুধা দারিদ্রতায় কষ্ট পায়না, তাই ক্ষুধার জ্বালা যে কতো তীব্র, অসহনীয় তা তারা ধারণাও করতে পারেনা। রোজার মাধ্যমে ধনীরা ক্ষুধা তৃষ্ণার কিছুটা পীড়ন অনুভব করতে পারে। তখন তারা বুঝতে পারে, যে ভাইয়েরা প্রতিদিন অনাহারে অর্ধাহারে থাকে তাদের জীবন কতোটা দুর্বিসহ। তাই তাদের অজান্তেই ঐ সমস্ত অসহায় দরিদ্র মানুষের দিকে তাদের সহানুভূতি, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ পায়। রোজা ছাড়া আর অন্য কোন ভাবেই এ অনুভূতি সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। ইসলামের প্রথম জিহাদের মাসঃ ইসলামের প্রথম জিহাদ অর্থাৎ হক ও বাতিলের চূড়ান্ত সংঘর্ষ এই রমযান মাসের ১৭ তারিখেই বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিলো। এবং ইসলাম একটি দৃর্জেয় অপরাজিত শক্তি হিসেবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
পৃষ্ঠা:৫৬
রমযান সবরের মাসঃ এ মাস সবরের মাস। সবর শব্দটি লোভ এর বিপরীত অর্থবোধক। সবর অবলম্বন না করলে কোন রোজাদারই রোজা রাখতে সক্ষম হতো না। দীর্ঘ একটি মাস দিনের বেলা ক্ষুধা তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হয়ে যায়। নাগালের মধ্যে হাজারো হালাল দ্রব্য, সাময়িকভাবে তার জন্য হারাম হয়ে যায়। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায় কিন্তু ফ্রিজের মধ্যে ঠান্ডা পানীয়, ইচ্ছে করলেই পান করা যায়। তবু একজন রোজাদার পান না করে সবরের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। বাকী এগার মাস যেনো বান্দা এ শিক্ষাকে কার্যকরী করতে পারে সেই ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে রমযান মাসে। হাতের কাছে হারাম সম্পদ যতো সহজ লভ্যই হোক না কেন, তা থেকে নির্লোভ থাকাই হচ্ছে সবরের বাস্তবঅনুশীলন।এ মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। নবী করীম (স) বলেছেনঃأول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن . –’রমযানের প্রথম রাতে শয়তান ও দুষ্ট জ্বিনগুলোকে শিকল দিয়ে বেধে ফেলা হয়।’ (তিরমিযি, নাসায়ী, বাইহাকী)অর্থাৎ শয়তান রোজাদারকে ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করতে পারেনা। দেখা যায় অনেক লোক অন্য সময়ে বড়ো বড়ো গুণাহ্ করলেও রমযান মাস এলে তারা ঐ সমস্ত গুণাহর কাজ বাদ দিয়ে আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে যায়। এ কাজ শুধু মাত্র শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্ত থাকার ফলেই সম্ভব হয়। এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, শয়তান ও দুষ্ট জ্বিনকে যদি আটক করে রাখা হয় তবে সমাজে এ মাসে পাপের কাজ সংঘঠিত হয় কি করে? এর কয়েকটি উত্তরহতে পারে। যেমনঃ (১) রমযানে শয়তানের তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হয় ঠিকই কিন্তু বাকী এগার মাসে মানুষের মন-মস্তিষ্কে ও রক্তে মাংসে ধোঁকা প্রতারণা, প্রভাব প্রলোভন, অন্যায় অসৎ কাজের যে বীজমিলে মিশে একাকার হয়ে যায় তারই ধারাবাহিকফল স্বরূপ কিছু কিছু সংঘটিত হয়।(২) অথবা এর উত্তর হচ্ছে শয়তানকে আবদ্ধ রাখা রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ রোজাদারকে শয়তান রমযানে প্ররোচনার মাধ্যমে বিপথগামী করতে পারেনা। তার চেষ্টা অব্যহত রাখলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।(৩) রমযানে অবারিত রহমত বর্ষণের কারণে এবং সাধারণ ক্ষমার সুযোগের কারণে ১৬তানের প্ররোচনা সাফল্যমন্ডিত হতে পারেনা। তাই শয়তান তার
পৃষ্ঠা:৫৭
প্রতারণা অনেকটা মূলতবী রাখে। একথাটিই হাদীসে অন্যভাবে বলা হয়েছে।
(৪) অথবা এর তাৎপর্য হচ্ছে বড়ো গুলোকে ঠিকই আবদ্ধ রাখা হয় কিন্তু শয়তানের চেলা চামুন্ডারা তাদের গুরুর কাজগুলো অব্যাহত রাখে।
(৫) অথবা সব শয়তানকে যদি বন্দী করে রাখাও হয় তবুওতো মানুষের অন্তরে কুপ্রবৃত্তি বা নফসে আমারা সক্রিয় থাকে। তাই পাপাচার সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয় না। (আল্লাহই সর্বজ্ঞ) রোজাদারকে রাইয়্যান নামক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে:রাইয়্যান ریان- অর্থ সদা প্রবাহমান ঝণা ধারা। عطشان ۹۵ ريان শব্দেরর বিপরীত শব্দ। عطشان আতানু অর্থ তৃষ্ণার্ত, অত্যাধিক পিপাসার্ত। মানুষের নিকট খাদ্যের কষ্টের চেয়ে বড়ো কষ্ট হচ্ছে পিপাসার কষ্ট। আর রোজাদারগণই এ কষ্ট ভোগ করে সবচেয়ে বেশী। তাই রোজাদারের কষ্টের স্বীকৃতি ও প্রতিফল স্বরূপ জান্নাতের একটি দরজার নাম রাখা হইয়াছে রাইয়্যান ریان। হাদসীসে আছে, কিয়ামতের দিন রোজাদারদেরকে এ দরজা থেকে ডেকে ডেকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। যখন সব রোজাদার প্রবেশ করবে তখন সেই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। কোন দিন আর সে দরজা খোলা হবে না এবং কাউকে আর সেখানে দিয়ে প্রবেশ করানোও হবেনা। অতঃপর তাদেরকে পান করানো হবে। ইমাম নাসায়ী ও ইবনে খুজাইমা কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃمن دخل شرب ومن شرب لا يظماء أبدا –’যে লোকই সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, সেই পান করবে। আর যে পান করবে সে কখনো আর পিপাসার্ত হবেনা।’রোজা কিয়ামতের দিন শাফায়াত করবেঃ নবী করীম (স) বলেছেনঃالصيام والقرآن يشفعانِ الْعَبْدِ يَقُولُ الصِّيَامُ إِنِّي منعته الطعام والشهوات بالنهار فَشَفَعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ القرآن منعته النوم باليل مشقَّعْنِي فِيهِ فَيُشَفَعَانِ . —”রোজা ও কুরআন রোজাদার বান্দার জন্য শাফায়াত করবে। রোজা বলবেঃ ‘হে
পৃষ্ঠা:৫৮
আল্লাহ্। আমিই এ লোকগুলোকে রোজার দিনে পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তুমি এর জন্য আমার শাফায়াত কবুল করো।’ আর কুরআন বলবেঃ ‘হে আল্লাহ। আমিই তাকে রাত্রিকালে নিদ্রামগ্ন হতে বাধা দিয়েছি। কাজেই তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করো।’ অতঃপর এ দুটি বস্তুর শাফায়াত কবুল করা হবে।” (বাইহাকী শোয়াবুল ঈমান।যেদিন নবী রাসূলগণ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট শাফায়াত করার সাহস পাবে না সেদিন এ দু’টো বস্তুর শাফায়াত লাভ যে কতো বড়ো সৌভাগ্যের ব্যাপার তা পার্থিব জীবনে অনুধাবন করতে না পারলেও সেদিন এ সত্যটি অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখদিবে।১রোজা শরীরের জাকাতঃ রাসূলে আকরাম (স) ইরশাদ করেছেনঃلكل شيئ زكاة وزكاة الْجَسدِ الصوم .‘প্রত্যেকটি বস্তুই পবিত্র করার জন্য জাকাত। আর শরীরের জাকাত হচ্ছে রোজা।’ (ইবনে মাজা)আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার আলোকে সমস্ত মুসলিম ও অমুসলিম ডাক্তার এ ব্যাপারে একমত যে ইসলামী পদ্ধতিতে রোজা স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর এবং বহু জটিল ব্যাধি হ’তে মুক্তিদানকারী।তাছাড়া আমরা অনেক সময় নিজেদের অজান্তে কিছু কিছু হারাম রিজিক ভক্ষণ করি, ফলে হারামের দ্বারা শরীরের পুষ্টি সাধিত হয়। যেহেতু হারামের দ্বারা গঠিত শরীর জান্নাতে যাবেনা, তাই রোজার মাধ্যমে শরীরের হারাম অংশটুকু জ্বালিয়ে ভূষ্মিভূত করে দেয়া হয়। যেনো জান্নাতী শরীরে লেশমাত্র খাদ না থাকে (এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন)।রোজার দ্বারা গুণাহ মা’ফ হওয়াঃ উল্লেখিত হাদীস দ্বারা প্রমাণ হয় যে, রোজার দ্বারা গুণাহ্ মা’ফ হয়। কিন্তু সমস্ত হাদীস বিশারদগণ এ ব্যাপারে একমত যে, রোজার দ্বারা হক্কুল্লাহ সংক্রান্ত সগীরা গুণাহ্ মা’ফ হয়। তবে হ্যাঁ যদি তওবা করা হয় তবে কবীরা গুণাহ্ ও মা’ফ হয়।
পৃষ্ঠা:৫৯
লাইলাতুল কদর
লাইলাতুল কদর বা কদর রাত্রির সংজ্ঞা বিভিন্ন মনিষী বিভিন্ন ভাবে দিয়েছেন। নিম্নে প্রধান কয়েকটি সংজ্ঞা দেয়া হলো।বুখারী শরীফের ভাষ্যকার আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (র) বলেনঃ’লাইলাতুল কদর এমন এক রাত্রিকে বুঝায়, যে রত্রিতে যাবতীয় ব্যাপারে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়; তার চূড়ান্তরূপদান করা হয় এবং এক বৎসরের জন্য আল্লাহ্ তা’আলা এ রাত্রে সকল বিধান ও মর্যাদার ফায়সালা করে দেন।’ আবু বকর আল্-অর রাক (র) বলেনঃ’এ রাতের নাম লাইলাতুল কদর রাখা হয়েছে এজন্যে যে, যে লোক মূলত মান-মর্যাদা সম্পন্ন নয় সে যদি এ রাতকে যথাযথভাবে গ্রহণ করে ও রাত জেগে আল্লাহর ইবাদাত করে, তবে সে ব্যাক্তি সম্মান ও মর্যাদাবান হয়ে যাবে। এজন্য এ রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়।’ আবার কিছু মনিষীর অভিমত হচ্ছেঃ “কদর (১) শব্দের অর্থ হচ্ছে নির্ধারণ করা। যেহেতু এ রাত আল্লাহ্ তা’আলা বান্দার আগত বৎসরের আয়-ব্যয়, সুখ-দুঃখ, ব্যাথা-বেদনা, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে একটি বাজেট ঘোষণা করেন, সেজন্য একে লাইলাতুল কদর বা ভাগ্য নির্ধারণী রাত বলা হয়।” তাদের দলিল হচ্ছে সূরা দুখানের এ আয়াতটিঃفِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ . —’এটা সেই রাত, যে রাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে বিজ্ঞসূচক ফায়সালা আমাদের নির্দেশে প্রকাশ হয়ে থাকে।’ (দুখানঃ ৪)কিন্তু ইমাম জুহুরীসহ একদল বলেনঃ “কাদর অর্থ মাহাত্ম, মর্যাদা, সম্মান ও সম্ভ্রম অর্থাৎ এটা অতি মাহাত্ম্যপূর্ণ, মর্যাদাশালী ও সম্মানিত রাত।” তাদের দলিল হচ্ছেঃليلة القَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ কদরের রাত হাজার মাস হতেও অধিক উত্তম ও কল্যাণময়। (সূরা কাদরঃ ৩) কদরের রাত কোনটিঃ অধিকাংশ মনিষীর দৃষ্টিতে কদর রাত রমযান মাসের কোন একটি রাত। অবশ্য কেউ কেউ শা’বান মাসের ১৫ই তারিখ ও বলেছেন। তবে প্রথম কথাই সঠিক মনে হয়। কারণ আল্লাহর বাণীঃ
পৃষ্ঠা:৬০
شهر رمضان الذي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُوَّانُ .রমযান মাসটি এমন, যে রাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। (বাকারা-১৮৫) অন্যত্র বলা হয়েছেঃإنا أنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ .
আমি এ কুরমানকে কদরের রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি। (সুরা কাদর-১)উপরোক্ত আয়াত দু’টো একত্র করে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, কদর রমযান মাসেরই কোন একটি রাত। কারণ প্রথম আয়াত হ’তে স্পষ্ট যে আল-কুরআন সর্ব প্রথম রমযানে অবতীর্ণ হয়েছে। এখন যদি দ্বিতীয় আয়াতে বর্ণিত কদর রমযান ছাড়া অন্য রাত ধরা হয় তবে স্বয়ং কুরআনের আয়াতদ্বয়ের মধ্যেই স্বন্ধ সৃষ্টি হয়। এজন্যই কদরের রাত রমযানে হওয়ার ব্যাপারে বিতর্ক কম। তবে রমযানের কোন রাতটি কদরের রাত এ ব্যাপারে প্রায় চল্লিশটি বিভিন্ন উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। তার মধ্যে নিম্নোক্ত মতামত গুলো প্রাধান্য লাভ করেছে। (১) লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমযানের ২৭তম রাত। এ মতের অনুসারী হযরত উমর (রা), হুযাইফা (রা), উবাই ইবনে কা’ব (রা) প্রমুখ সাহাবাগণ, এ ব্যাপারে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ী, ইবনে হারান, ইবনে আবু শাইবা প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ স্ব-স্ব গ্রন্থে সংকলন করেছেন।(২) অন্য একদল সাহাবী ও তাবেয়ীনদের মত হচ্ছে, লাইলাতুল কদর ২৭তম কিংবা ২৯তম রাত্রি। এ ব্যাপারে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, তায়ালিসী প্রভৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। (৩) অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ীন ও মুহাদ্দেসীনদের নিকট লাইলাতুল কদরহচ্ছে রমযানের শেষ দশকের যে কোন বেজোড় রাত। যথা ২১তম, ২৩তম, ২৫তম ২৭তম, ২৯তম অথবা সর্ব শেষ রাত্রি। এ অভিমত পোষন কারী, হযরত আবুবকর, উসমান, আলী, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, উবাদা ইবনে সামেত (রা) ও হযরত আয়েশা (রা) প্রমুখ সাহাবা কেরাম। যাহোক উপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, কদরের রাতকে আল্লাহ্ রাবুল আলামীন নির্দিষ্ট করে দেননি। কেন দেননি তা আল্লাহই ভালো জানেন। হ’তে পারে আল্লাহ্ চান কদর রাত্রির মাহাত্ম হতে অংশ লাভের ঐকান্তিক আগ্রহের কারণে লোকেরা বেশী বেশী রাত ইবাদাত-বন্দেগীতে
পৃষ্ঠা ৬১ থেকে ৮০
পৃষ্ঠা:৬১
অতিবাহিত করুক এবং কেবল নির্দিষ্ট একটি রাত্রির ইবাদাত বন্দেগীকে যথেষ্ট মনে না করুক। একারণে কদরের রাতকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। অথবা কোন বস্তু সহজলভ্য হলে অনেক ক্ষেত্রে তার গুরুত্বও মর্যাদা লোপ পায়। তাই যেহেতু এ রাত অত্যন্ত মর্যাদাবান ও মূল্যবান তাই এর রাতের আগ্রহ যেনো কেউ হারিয়ে না ফেলে এ জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। অথবা এজন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি যে, প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে এ রাতটি আসে না। এক এক বছর এক এক তারিখে আসে।একটি প্রশ্নঃ পৃথিবীর সকল অংশে একই সাথে রাত হয়না, তবে নির্দিষ্ট তারিখে পৃথিবীর সকল জায়গায় একই সাথে কদর হয় কি করে? উত্তরঃ যেমন আমরা প্রায়ই দিন বলতে দিন রাতের সমষ্টি ২৪ ঘন্টাকে বুঝি। ধরুণ কেউ বললো বশির পাঁচদিন যাবৎ এখানে আসে না। একথার তাৎপর্য এই নয় যে, পাঁচটি দিন দিনে বশির এখানে আসেনা। কিন্তু রাতে এসেছে। বরং বক্তা একথাই বুঝাতে চান যে পাঁচদিন রাত এবং দিনের কখনোই বশির আসেনি। এমন কি শ্রোতারও বুঝতে কষ্ট হয়না। তেমনি ভাবে আরবী ভাষায় প্রায়ই রাত বলতে দিন রাত্রির সমষ্টি বুঝায়-কাজেই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পৃথিবীর সকল অংশেই রাত আসে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, তাই পৃথিবীর সকল জায়গায় একই তারিখে কদর হওয়ায় শংশয়ের কোন কারণ নেই। কদর রাত্রি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম হওয়ার তাৎপর্য: হাজার মাসেরচেয়ে উত্তম বলতে গনা-বাছা ৮৩ বৎসর ৪ মাস বুঝায় না। কেননা আরবী ভাষায় হাজার বসতে বহু বিপুল সংখ্যা বুঝায়। বাংলা ভাষায় ও এরকম ব্যবহার আছে যেমন অনেকে বলে “হাজার লোকের মাঝে আমি তাকে কোথায় খুঁজবো?” আয়াতটির তাৎপর্য হচ্ছে আল্লাহর অনুগত ও সন্তোষ লাভেচ্ছু ব্যক্তিগণ একটি রাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের দূরত্ব এতো সহজে অতিক্রম করতে পারে, যা অন্য সময় অতিক্রম করতে হলে হাজার হাজার মাসে তা সম্ভব না ও হতে পরে। সত্যি কথা বলতে কি, এই একটি রাতে কল্যাণ ও মঙ্গলের এতো বড়ো একটি ঘটনা ঘটে যায়, যা মানবেতিহাসের সুদীর্ঘ কালে অন্য কখনো এরূপ ঘটেনি বা ঘটবেনা। শুধুমাত্র এরাতেই ঘটা সম্ভব।কদরের রাতে ফেরেশতাদের অবতরণ: মহান আল্লাহর বাণীঃتنزل المليكة والروح فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ (ج) مِنْ كُلِّ أَمْرٍ .
পৃষ্ঠা:৬২
سلم (قشف) هي حَتَّى مطلع الفجر .ফেরেশতা ও রুহ জিব্রাইল (আ) এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়। সে রাত পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার, ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। (সুরা আল কাদর ৪-৫) হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃإِذا كَانَ ليلة القدر نزل جبرائيل عَلَيْهِ السَّلَامُ فِي كُبُكْبَةٍ مِّنَ الْمَلَئِكَةِ يُصَلُّونَ عَلَى كُلِّ عَبْدٍ قَائِرٍ أَوْقَاعِدِ يَذْكُرُ اللَّهَ عَزَّوَجَلُ –যখন কদরের রাত আসে, তখন জিব্রাইল (আ) ফেরেশতাদের বাহিনী সহ অব- তীর্ণ হন এবং দাঁড়িয়ে অথবা বসে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকা প্রত্যেক বান্দার জন্য রহমতের দোয়া করেন। (বায়হাকী, শোয়াবুল ঈমান) অর্থাৎ এ রাতে কোনরূপ খারাবীর স্থান হতে পারেনা। কেননা আল্লাহ তায়ালার সকল ফায়সালাই মানবতার কল্যাণের জন্যেই হয়ে থাকে। এ রাতে কোন অন্যায় প্রার্থিত হয়না। এমনকি কোন জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার ফায়সালা হলেও তা অবশ্যই গোটা মানব জাতির কল্যানের জন্যেই হয়ে থাকে, অকল্যা-ণের জন্য নয়। (তাফহীমুল কুরআন ১৯শ’ খন্ড-১৯১ পৃঃ)
এ রাতের আরো কতিপয় বৈশিষ্ট্য:
(১) এ রাতে কুরআনুল করীম অবতীর্ণ করা হয়েছে। (সূরা কদর) ফেরেশতাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (মাজাহেরে হক)
(২) এ রাতে (৩) কদর রাতেই জান্নাতে বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে। (ঐ)
(৪) এ রাতে আদম (আ) এর মৌল সমূহ একত্রিত করা হয়। (দুররে মানছুর। (৫) এ কদর রাতে বণী ইস্রাঈলের তওবা কবুল করা হয়। (ঐ)
(৬) এ রাতে হযরত ঈসা (আ) কে আসমানে তুলে নেয়া হয়।
(বয়ানুলকুরআন-ঐ)
(৭) এ রাতে তওবা কবুল করা হয় (দূররে মানছুর।
(৮) কদরের রাতে আসমানের দরজাগুলো খোলা থাকে।
(৯) এ রাতে আকাশের তারকারাজি শয়তানকে মারার জন্য কাছে পায়না। (ঐ) (১০) এ রাতে সমুদ্রের পানি মিষ্টি হয়। যেমন উবাদা ইবনে আবু লুবা (রা) বলেনঃ আমি রমযানের ২৭ তারিখে সমুদ্রের পানির স্বাদ আস্বাদন করে দেখেছি তা মিষ্টি ছিলো। আবার আইউব ইবনে খালেদ (রা) বলেনঃ আমার গোসলের প্রয়োজন হওয়ার সাগরের পানি দিয়ে গোসল করি। দেখলাম পানি সত্যিই মিষ্টি। আর এ রাতটি ছিলো রমযানের ২৩ তারিখ। (ইবনে কাসীর)
পৃষ্ঠা:৬৩
(১১) আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ এ রাতে লওহে মাহফুজ থেকে রিজিক, বৃষ্টি, জীবন, মৃত্যু এমনকি হাজীদের সংখ্যা পর্যন্ত নকল করে ফেরেশতাদের দিয়ে দেয়া হয়। (রুহুল মায়ানী)
(১২) এ রাতে হযরত হিব্রাইল (আ) সব ধরণের ভালো এবং উত্তম কাজ নিয়ে অবতীর্ণ হন। (সূরা কদর)
(১৩) এ রাতে ফেরেশতাগণ মুমিনদেরকে সালাম করেন এবং তাদের কল্যাণ কামনা করেন। (বয়ানুল কুরআন)
(১৪) এ রাতে ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে ইবাদাত করলে পূর্বের সমস্ত গুণাহ মা’ফ করে দেয়া হয়। (বুখারী)
(১৫) এ রাতে অগণিত ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়। (আবু দাউদ)
(১৬) এ রাতে কোন বিদায়াত সংঘটিত হয়না নির্জলা ইবাদাতই শুধুমাত্র সংঘটিত হয়।
(১৭) এ রাত সম্পূর্ণ পবিত্র ও এমন উজ্জ্বল হয়, যেনো চাঁদনী রাত। এ রাতে মনে স্বস্তি ও মন স্থির থাকে এবং এ রাত নাতিশীতোষ্ণ হয়। (হাদীস)
(১৮) কদর রাত আরামপ্রদ, ঠান্ডা, গরম মুক্ত থাকে। সে প্রাতে অরুন রবি হাল্কা আলোক রশ্মিতে লাল রঙে ছড়িয়ে পড়ে। (আবু দাউদ)
এছাড়াও আরো বহু বৈশিষ্ট্যর কথা হাদীসে বলা হয়েছে। (ইকরা ডাইজেস্টের হাওয়ালায় সোনার বাংলা ২২শে রমযান ১৪১২ হিজরী সংখ্যা) লাইলাতুল কদরের সন্ধানে নবী পরিবারঃ হযরত যয়নাব বিনতে সালমা (রা) বর্ণনা করেনঃلم يكن النبي صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا بَقِي مِنْ رَمَضَانَ عشرة أيام بدع أحدًا مِنْ أَهْلِهِ يَطِيقُ الْقِيَامَ الأ أقامه . রমযানের শেষ দশকে নবী করীম (স) তাঁর ঘরের লোকদের মধ্যে রাত জেগে ইবাদাত করতে পারে-এমন কাউকে ঘুমাতে দিতেন না বরং প্রত্যেককেই জাগ্রত থেকে ইবাদত করার জন্য প্রস্তুত করতেন। (উমদাদুল কারী) তিরমিযি শরীফে বর্ণিত হয়েছেঃأن النبي صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُوقِظُ أَهْلَهُ فِي الْعَشْرِ الأواخر من رمضان – নবী করীম (স) রমযান মাসের শেষ দশকে তাঁর ঘরের লোকজনকে ইবাদাত ও
পৃষ্ঠা:৬৪
নামাযের জন্য জাগিয়ে দিতেন।হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেনঃكَانَ رَسُولُ الله صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِالأواخر مالا يجتهد في غيرها .রাসূলে আকরাম (স) রমযান মাসের শেষ দশকে ইবাদাত বন্দেগীর কাজে এতোই কষ্ট স্বীকার করতেন, যা অন্য কোন সময়ে করতেন না। (মুসলিম, তিরমিযি)এখানে প্রশ্ন হতে পারে, তিনিতো শেষ দশকে ই’তিকাফে থাকতেন, তবে কেমন করে ঘরের লোকদেরকে আগিয়ে দিতেন?এর জবাবে বলা যায়, তাঁর সাথে যারা ই’তিকাফে থাকতেন তাদেরকে জাগাতেন এবং তাঁর হজরার যে দরজা মসজিদের দিকে ছিলো তিনি সে দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরের লোকদেরকে ডেকে উঠিয়ে দিতেন।বস্তুতঃ রাসূলে করীম (স) নিজে এবং তাঁর পরিবারের প্রতিটি লোক এ রাতটিকে পাবার জন্য ব্যাকুল থাকতেন। যে কারণে রমযানের শেষ দশকের সবগুলো রাত তারা ইবাদাতের মাধ্যমে জেগে কাটাতেন। যেনো কোন ক্রমেই বরকতপূর্ণ রাতটি হারিয়ে না যায়। এজন্য সকল মুসলমানের উচিত নবী পরিবারের অনুসরণ ও অনুকরণ।
পৃষ্ঠা:৬৫
ইসলামী নামের তাৎপর্য
من أبي الدرداء (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسلم تدعون يوم القيامة بأسماء أبَائِكُمْ فَاحْسِنُوا أَسْمَاءَ كُمْ . —হযরত আবু দারদা (রা) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ কিয়ামতের দিন তোমাদেকে তোমাদের ও তোমাদের পিতার নাম ধরে ডাকা হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের ভালো নাম রাখবে। (আহমাদ, আবু দাউদ) শব্দার্থ : تدعون – তোমাদেরকে ডাকা হবে। يوم القيامة – কিয়ামতের দিনে। بأسماء – নাম ধরে। آبانكُمْ তোমাদেররূপিতা। فاحسنوا – অতএব সুন্দর কর। أسماءكُمْ তোমাদের নামকে।
বর্ণনাকারীর (রাবীর) পরিচয়:
নাম উমাইর ইবনে আমের। মতান্তরে আমের। আবু দারদা কুনিয়াত। আনসার সাহাবী। মদীনার খাজরাজ গোত্রের লোক। তিনি কুরআন, সুন্নাহ্ ও ফেকাহয় গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সাহাবাগণের মধ্যে যারা ফকীহ্ হিসেবে বিশেষ ভাবে পরিচিত ছিলেন হযরত আবু দারদা (রা) ছিলেন তাদের অন্যতম। এজন্য তাঁকে হাকীমুল উম্মাত বা উম্মতের চিকিৎসক বলা হতো। উহুদ যুদ্ধের পরবর্তী সকল যুদ্ধেই তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন।তিনি খুব সাদাসিদা জীবন যাপন করতেন। ধন-ঐশ্বর্যের লোভ তাঁর ছিলোনা। নিম্নোক্ত ঘটনাটি তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি নিজেই বলেনঃ”রাসূলুল্লাহ্ (স) নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় আমি ব্যবসা করতাম। আমি মুসলমান হওয়ার পর ব্যবসা ও ইবাদাত একত্রে করার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু পারলামনা। ব্যবসা ছেড়ে দিলাম। কারণ মাওলার সাথে সম্মিলিত হবার আশায় আমি মৃত্যুকে ভালবাসি। আল্লাহর দিকে রুজু হওয়ার জন্য দারিদ্রকে ভালবাসি। গুনাহ্ মা’ফের জন্য রোগকে ভালবাসি।”ইসলামের এ মহান সৈনিক হিজরী ৩১ অথবা ৩২ মতান্তরে ৩৪ সনে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ১৭৯টি।
পৃষ্ঠা:৬৬
হাদীসটির গুরুত্ব:
প্রত্যেক মুসলমানের এমন একটি নাম থাকা উচিত, যে নাম দ্বারা তাকে মুস- লমান হিসেবে বুঝা যায়। মূলতঃ নামের মাধ্যমে ব্যক্তির সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়। কোন ব্যক্তি মুসলমান না অমুসলমান তা নামেই প্রকাশ পায়। নামই মানুষের ধর্ম ও কৃষ্টির পরিচয় বহন করে। তাই নাম রাখার পূর্বে নামটি ইসলাম সম্মত কিনা এবং সুন্দর অর্থপূর্ণ কিনা এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত প্রয়োজন। এজন্যেই অত্র হাদীসটির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা ছোট্ট একটি উপদেশের মধ্যে গোটা ইসলামী তামাদ্দুনের মূল ভিত্তি নিহিত।
ব্যাখ্যা:
আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের চেয়ে সুন্দর আকার-আকৃতির সৃষ্টিই আর পৃথিবীতে নেই। আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেনঃلقَدْ خَلَقْنَا الإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقويم . —নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সুন্দর আকার-আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি। (ত্বীনঃ ৪) যেহেতু একমাত্র মানুষই হচ্ছে মহান আল্লাহর উত্তম সৃষ্টি, তাই তার নামও হওয়া উচিত সুন্দর-অর্থপূর্ণ ও আদর্শ। মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলে যেমন ইসলামী নাম গ্রহণ করা অপরিহার্য তদ্রুপ কোন ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হলে তার আগের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী নাম রাখা কর্তব্য। মুসলমানের পরিচয়ের জন্য এটা একটি শর্ত এবং ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য। বর্তমান সমাজে নাম রাখার ব্যাপারে অনেক মুসলমানকে পাশ্চাতের অনুকরণ করতে দেখা যায়। এতে ইসলামী আদর্শকে ছোট করে দেখা হচ্ছে এবং আস্তে আস্তে বিজাতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার গোলামীর জিঞ্জিরে নিজেদেরকে আষ্টে পৃষ্ঠে বেধে নেয়া হচ্ছে। অথচ নবী করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃمَنْ تَشَبُهَا بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ . যে বক্তি যে জাতির সাথে সামঞ্জস্য রাখে এবং তাদের ধ্যাণ-ধারণা ও আকীদার অনুকরণ করে সে তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। (আবু দাউদ) কিছু লোক আছে যারা নিজেদের কৃষ্টি সভ্যতায় তথা ইসলামী সংস্কৃতিতে সন্তুষ্ট নয়। তারা ইসলামী সভ্যতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সেতুবন্ধন চায়। এজন্যে তারা ইসলামী নাম সমূহকে আধুনিকতার ছাঁচে ফেলে বিকৃত করে ঢেকে থাকে।
পৃষ্ঠা:৬৭
যেমনঃ- আহমাদ কে আহমেদ, ‘রাহমান’কে রেহমান, ‘মাহবুব’কে মেহবুব ইত্যাদি। এ ধরণের আরও অনেক বিকৃত নাম রয়েছে। মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন, যেনো কোন ক্রমেই কারো নামের বিকৃতি ঘটানো না হয়। আল্লাহ বলেনঃولا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلا تَنَابَزُوا بِالألقاب (ط) بنس الاسم الفسوق بعد الايمان (ج) – –তোমরা নিজেদের মধ্যে দোষানুসন্ধান অথবা পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করোনা এবং ইসলাম গ্রহণের পর কাউকেও বিকৃত নামে অথবা খারাপ উপাধী দ্বারা ডেকো না। কারণ এটা নিতান্তই অশোভন, নিকৃষ্ট ও নিন্দনীয় কাজ। (হুজুরাতঃ ১১) এমন নাম রাখাও ঠিক নয় যার অর্থ আল্লাহ্ ছাড়া অপরের দাস বা গোলাম হওয়া বুঝায়, যেমন-গোলাম রাসূল, গোলাম নবী, বন্দে আলী, বখশে আলী, ইমাম বখশ্ ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (স) বলেনঃلا يقولن أحدُكُمْ عَبْدِي وَامَتِي كُلُّكُمْ عَبِيدُ اللَّهِ وَكُلَّ نِسَائِكُمْ إِمَاءُ اللهِ . —-তোমার কেউ আল্লাহর দাস ব্যতীত একে অপরকে অন্য কারো দাস-দাসী বলে ডেকো না। তোমরা প্রত্যেকেই আল্লাহর দাস এবং তোমাদের প্রত্যেক স্ত্রীলোকই আল্লাহর দাসী। (মুসলিম)অনেক সময় দেখা যায় ভালো নামকেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বিকৃত করে ডাকা হয়। এভাবে বিকৃতির ফলে মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর নবী রাসূলগণের নামও বিকৃতি হতে রেহাই পায়না। যেমনঃ সাত্তারকে সাত্তাইর্যা ইব্রাহিমকে ইব্রাহিম্যা, ইদ্রিসকে ইদ্রিছ্যা ইত্যাদি। আমরা একবারও চিন্তা করে দেখিনা আল্লাহ যেখানে একজন সাধারণ মানুষের নামকে বিকৃত করে ডাকাকে নিন্দনীয় বলেছেন। সেখানে স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাম সমূহকে বিকৃত করে ডাকা কতো বড়ো অপরাধ। হোক না সেটা মানুষের নামের সাথে সম্পৃক্ত। আবার এমন ধরণের হাজারো নাম আছে যার কোন ভাল অর্থ নেই। যেমন কালু মিয়া, ধলা মিয়া, ছন্দু মিয়া ইত্যাদি। এ ধরনের নাম রাখাও অন্যায়। অর্থহীন নামে ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় কেননা তাতে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা
পৃষ্ঠা:৬৮
সৃষ্টির সেরা জীব, এ তাৎপর্য নষ্ট হয়। অথচ ইসলামে সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নামের অভাব নেই।রাসূলুল্লাহ (স) অনেক সময় ঐসব সাহাবীদের নাম পরিবর্তন করে সুন্দর অর্থবোধক ইসলামী নাম রেখে দিতেন, যাদের পূর্বের নাম কুৎসীত ও শিরকযুক্ত ছিলো। যেমন হযরত আবু হুরাইরা (রা) কে আবদুর রহমান নাম রেখে দেন। তার ইসলামপূর্ব নাম ছিলো আবদে শামস-অরুণ দাস-। আশারায়ে মুবাশারাদের অন্যতম আবদুর রহমান বিন আওফ (রা) এর নাম নবী করীম (স) রাখেন। পূর্বনাম ছিলো আবদে আমর অথবা আব্দুল কা’য়াবা। মেয়েদের মধ্যেও অনেকের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন যেমন-যুর’আ, জোয়াইরিয়াহ, জমীলা, জয়নাব। তাদের পূর্ব নামছিলো যথাক্রমে আহরাম, বাররাহ, আছিয়া ও বারাহ।সাহাবীগণ (রা) তাদের এবং তাদের সন্তানদের আবদুল্লাহ অথবা আবদুর রহমান নাম বেশী রাখতেন। কেননা নবী করীম (স) বলেছেনঃتسموا بأسماء الأنبياء وأحب الأَسْمَاء إِلى اللهِ عَبْدُ اللهِ وعبد الرحمن .‘তোমরা নবীদের নামে নিজেদের।ও সন্তানদের। নাম রাখবে। আল্লাহ্ তা’আলার নিকট নাম সমূহের মধ্যে উত্তম নাম হচ্ছে আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান।’ (আবুদাউদ)
শিক্ষাবলী:
১। পুরুষ হোক বা স্ত্রী হোক, ছেলে অথবা মেয়ে যেই হোক না কেন প্রত্যেকেরই সুন্দর ইসলামী নাম রাখতে হবে।
২। মানুষকে যেমন আশরাফুল মাখলুকাত করে সৃষ্টি করা হয়েছে তেমনি তার নামও মর্যাদাপূর্ন হতে হবে।
৩। বিদেশী ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ-অনুকরণ করা যাবে না। সামান্য একটি নামের ব্যাপারেই হোক না কেন।
৪। কাউকে বিকৃত নামে অথবা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে ঢাকা যাবেনা।
পৃষ্ঠা:৬৯
৫। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাস বা গোলাম সম্বোধন করে নাম রাখা যাবে না।
৬। অসুন্দর এবং আপত্তিকর নাম যদি রাখা হয়ে থাকে তবে পরিবর্তন করে
সুন্দর ইসলামী অর্থবোধক নাম রাখা প্রয়োজন।
৭। নবীদের নামের অনুকরণে নাম রাখা এবং আল্লাহর সিফাতি নামের সাথে সংযোগ করে নাম রাখা উত্তম।
মৃতব্যক্তি সম্পর্কে ফেরেশতা এবং জীবিতদের কথাবার্তা
عن أبي هريرة (رض) يبلغ به قَالَ إِذَامَاتُ الْمَيْتُ قَالَتِ المليكة ما قدم وقال بنوا ادم ما خلف .(رواه البيهقي في شعب الايمان ) হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলে আকরাম (স) বলেছেন: কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করেন, সে কি পাঠিয়েছে (আখিরাতের জন্য), এবং মানুষ জিজ্ঞেস করে, সে কি রেখে গিয়েছে (উত্তরাধিকারীদের জন্য)। (বাইহাকীঃ শোয়াবুল ঈমান। শব্দার্থঃ بلغ به – একথা (আমার কাছে) পৌঁছুছে। ট – যখন। مات الميث – কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর। ১৬ – বলাবলী করে। উনি – ফেরেশতাগণ )বহুবচনে, একবচনে এ)। ماقدم – কি পাঠিয়েছে? قال بنوا ادم মানুষ জিজ্ঞেস করে। – কি রেখে গিয়েছে?
বর্ণনাকারীর পরিচয়:
আবু হুরাইরা তাঁর উপনাম। নাম আবদুর রহমান। পিতার নাম ছখর এবং মায়ের নাম মাইমুনা। তাঁর পূর্ব পুরুষ কারো নাম দাউস থাকায় তাদের গোত্রের সবাই নিজেদের নামের সাথে দাওসী শব্দটি ব্যবহার করতো। প্রখ্যাত সাহাবী৫। তিরমিযি।
পৃষ্ঠা:৭০
হযরত তুফাইল ইবনে আমর আদ্দাওসীর হাতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম পূর্ব নাম ছিলো আবদে শামস্ বা ‘অরুন দাস’। রাসূলুল্লাহ্ (স) তাঁর নাম রাখেন আবদুর রহমান। আবু হুরাইরা নামকরণের তাৎপর্য সক্রান্ত একটি হাদীস তিরমিযি শরীফের টীকায় ইবনে আবদীল বার উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেছেন: একবার আমার আস্তিনের ভিতর একটি বিড়ালছানা রেখে নবী করীম (স) এর দরবারে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন? ওটা কি? আমি বললামঃ বিড়াল ছানা। তখন তিনি (কৌতুক করে) বললেন: ইয়া আবা হুরাইরা। (অর্থ- হে ছোট বিড়ালের পিতা)। এ ঘটনার পর থেকে তিনি আবু হুরাইরা নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান। তিনি ছিলেন ‘আহলে ছুফ্ফাদের’ একজন। ঘর-সংসার ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সর্বক্ষণ মহানবী (স) এর খেদমতে পড়ে থাকতেন। শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ্ (স) কোথাও পাঠালে বা কোন দায়িত্ব দিলে তিনি তৎক্ষণাৎ তা পালন করতেন। তিনি মাত্র সাড়ে তিন (৩৫০) বৎসরের মতো সময় নবী করীম (স) এর সান্নিধ্য পান। এ সময়ের মধ্যেই তিনি যে হাদীস মুখস্ত করেছিলেন তা আর কোন সাহাবীই পারেননি। আল্লাহর রাসূল (স) নিজেই বলেছেনঃ ‘আবুহুরাইরা জ্ঞানের আধার’। তিনি হিজরী ৫ম সনে ৭৮ বৎসর বয়সে মদীনার জুল হুলাইফা নামক স্থানে নিজবাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাকী নামক কবর স্থানে দাফন করা হয়েছে। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৫,৩৭৪টি। তার মধ্যে বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্যের হাদীস ৩২৫টি। তাছাড়া ইমাম বুখারী এককভাবে ১৩টি এবং ইমাম মুসলিম ১৯০টি হাদীস স্ব-স্ব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটির গুরুত্ব:
উল্লেখিত হাদীসটি মানুষের জীবন দর্শনের অন্যতম ভিত্তি। কেননা এ হাদীসে একদিকে যেমন পৃথিবীর প্রয়োজনীয় বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, অপর দিকে আখিরাতের পাথেয় সম্পর্কেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দুনিয়া ছাড়া আখিরাত হয়না আবার আখিরাতকে বাদ দিয়ে দুনিয়ার পিছনে লেগে যাওয়াও অত্যন্ত গর্হিত কাজ। সত্যি কথা বলতে কি, প্রতিটি মানুষের জীবনেই এ হাদীসটির দাবী ও শিক্ষা অত্যন্ত মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ।
পৃষ্ঠা:৭১
ব্যাখ্যা:
এ হাদীসটিতে দুটো কথা বলা হয়েছে। একটি দুনিয়ার সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে দুনিয়াবাসী তথা মানুষের মূল্যায়ন এবং অপরটি আখিরাতের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে ফেরেশতাদের কথপোকথন ও মূল্যায়ন। দুনিয়াবাসীর কথাবার্তায় প্রমাণিত হয় যে, দুনিয়ার জীবনে চলার জন্য ধন সম্পদ যেমন প্রতিটি মানুষের জন্য জরুরী, তেমনিভাবে কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সন্তানদের জন্যও তা জরুরী। এজন্যই সন্তান বা তার ওয়ারিশগণ মৃতদেহ কবরে রেখে আসার পরক্ষণেই তার গুপ্তধনের সন্ধান ও মাল সম্পদের হিসেব নিকেশ শুরু করে দেয়। কোথায় তার আলমারীর চাবি, কোথায় তার ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার কাগজপত্র, কোথায় তার জায়গা জমির দলিল প্রমাণ ইত্যাদি নিয়ে অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ এগুলো দুনিয়ার জীবনে অতি প্রয়োজনীয় বিধায় এর মোহ ও প্রায় অপ্রতিরোধ্য। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন:الهُكُمُ التَّكَاثُرُ – حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرِ .‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মৃত্যুকাল পর্যন্ত মোহাবিষ্ট করে রাখে।’ (সূরা তাকাসুরঃ ১-২) আবার সাধারণ মানুষও কোন মানুষকে তার ধন সম্পদ ও সন্তান সন্তুতি দিয়ে মূল্যায়ন করে থাকে। যদি কোন লোক সৎভাবে জীবন যাপন করে হয়তো পার্থিব কোন কিছু করতে পারলোনা তখন সে ঐ লোকদের দৃষ্টিতে বোকা, অকর্মণ্য, অপদার্থ ইত্যাদি। পক্ষান্তরে যদি কোন ব্যক্তি বৈধ অবৈধের তোয়াক্কা না করে এবং বিভিন্ন পন্থায় মানুষের ধন সম্পদ আত্মসাত করে বিত্তের বিশাল স্তুপ গড়ে তুললো, তখন সে তাদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বুদ্ধিমান। যেহেতু পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বস্তুগত তাই তারা কোন মানুষের মৃত্যু সংবাদ শোনামাত্রই তার সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসেব নিকেশ শুরু করে দেয়। অন্যদিকে তাকে কবরে রেখে আসা মাত্র আল্লাহর মনোনীত ফেরেশতাদ্বয় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দেয় যে, সে দুনিয়ায় কিভাবে জীবন যাপন করছে? সম্পদ আয় করছে কিভাবে? তা ব্যয় করেছে কিভাবে? পরকালের জন্য সে কতটুকু পাথের নিয়ে এসেছে? ইত্যাদি। তাছাড়া কোন মানুষের মৃত্যু হওয়ার পর অন্যান্য ফেরেশতাগণও তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ফেরেশতাদের কথাবার্তা বা আলাপ আলোচনায়ও একথা প্রমাণিত হয় যে, অবশ্যই আখিরাতের সফরের জন্য পাথেয় প্রয়োজন। আর যদি সে পাথেয় যথেষ্ট না হয় তবে তার
পৃষ্ঠা:৭২
জন্য সমূহ বিপদ অপেক্ষমান। এ ব্যাপারে রাসূল (স) সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেনঃفَافْعَلُوا فَإِنَّكُمُ اليوم في دار العمل ولا حساب وانْتُمْ غَدًافي دار الآخرة والأعمل .তোমরা আ’মল করতে থাকো, কেননা বর্তমানে তোমরা কর্মস্থলে অবস্থান করছো, এখানে হিসেব নেয়া হবে না। আগামীকাল তোমরা আখিরাতের জীবনে প্রবেশ করবে। সেখানে আমল করার কিছুই থাকবে না। (বাইহাকী: শোয়াবুল ঈমান) একবার এক ব্যক্তি রাসূল (স) এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন আমল বাতলে দিন যা আমল করলে আল্লাহ্ এবং মানুষ আমাকে ভালোবাসবে। নবী করীম (স) বললেনঃازهد في الدُّنْيَا يُحِبُّكَ اللهُ وَأَزْهَدُ فِي مَا عِنْدَ النَّاسِ
يحبك الناس .‘আখিরাতকে দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দাও, আল্লাহ্ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের নিকট যা আছে তার থেকে তুমি নির্লিপ্ত হও, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।’ (তিরমিযি, ইবনে মাজা। সত্যিকথা বলতে কি, যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা কখনো দুনিয়ায় কি পেলো বা না পেলো সে হিসেব করেনা। বা এজন্য কোন আফসোস এবং অনুতাপও তাদের থাকেনা তারা সর্বক্ষণ আখিরাতের সাফল্য ও ব্যর্থতার চিন্তায় মশগুল থাকে। এবং তাদের যাবতীয় তৎপরতা আখিরাতকে সামনে রেখেই আবর্তিত হয়।একদিন একব্যক্তি হযরত আবু যার গিফারী (রা) এর নিকট এলো। সে তাঁর ঘরের চারদিকে তাকিয়ে উল্লেখযোগ্য কোন সামগ্রী দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো: আবু যার, আপনার ঘরের জিনিসপত্র কোথায়? তিনি সহাস্যে উত্তর দিলেন: আখিরাতে আমার একটি বাড়ী আছে। আমার সব উৎকৃষ্ট সামগ্রী সেখানেই পাঠিয়ে দেই। (আসহাবে রাসূলের জীবন কথা- ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৫। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বুঝা যায় যে, আলোচ্য হাদীসটি প্রতিটি মানুষের জীবন দর্শনের অন্যতম ভিত্তি। কারণ এ হাদীসটি চিন্তাশীলদেরকে পাল্টিয়ে দিতে পারে তার চিন্তার গতি।
পৃষ্ঠা:৭৩
শিক্ষাবলী:
১। দুনিয়ার জীবনে চলার জন্য যেমন ধন সম্পদ জরুরী তেমনিভাবে আখিরাতের জন্য পুণ্য বা নেকী ও অত্যন্ত জরুরী।
২। দুনিয়া, আখিরাতের পুন্য সঞ্চয়ের একমাত্র ক্ষেত্র।
৩। দুনিয়ার জীবন নশ্বর এবং আখিরাতের জীবন অবিনশ্বর।
৪। ধন সম্পদের প্রাচুর্য মানুষকে পরকাল সম্পর্কে উদাসীন করে তুলে।
৫। দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতকে প্রাধান্য দিতে না পারলে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব নয়।
৬। বস্তুবাদী একজন লোক সে দুনিয়ার সাফল্য ও ব্যর্থতাকেই চূড়ান্ত মনে করে। পক্ষান্তরে একজন দীনদার লোক আখিরাতের সাফল্য ও ব্যর্থটাকেই চূড়ান্ত মনে করে।
দুনিয়া প্রীতি ও দীর্ঘায়ু কামনা
(এক)
عن أبي هريرة رض عن النبي صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قال لا يزال قلب الكبير – شايا في اثنين في حب الدنيا وطول الأمل – (متفق عليه) .হযরত আবু হুরাইরা (রা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন: বুড়ো মানুষের হৃদয়ে দুটো জিনিস থাকে, (১) দুনিয়ার মহরত (২) সুদীর্ঘ (জীবন। কামনা। (বুখারী, মুসলিম)
পৃষ্ঠা:৭৪
(দুই)
من أنس (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يهرمُ ابْنُ أَدَمَ وَيَشِبُ فِيهِ اثْنَانِ الْحَرْصَ عَلَى الْمَالِ وَالْحَرْصُ على العمر – (متفق عليه)আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স) বলেছেন: আদম সন্তান বুড়ো হয় বটে কিন্তু তার মধ্যে দুটো জিনিস বুড়ো হয় না। (১) সম্পদের লোড (২) দীর্ঘ জীবনের আকাংখা। (বুখারী, মুসলিম।
(এক)
শব্দার্থ : يُزَالُ – শেষ হয় না, বলবৎ থাকে। হৃদয়ে। شنابًا في اثنين – দুটো জিনিস। فِی حُبُّ الدُّنْيَا الأمل – দীর্ঘ আশা। – বুড়ো মানুষের দুনিয়া প্রীতি। طول
(দুই)
০১৩- অধিক বয়স্ক হয়ে যাওয়া, বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে উপনীত হওয়া। این انم – আদম সন্তান। يشب – বৃদ্ধি পেয়ে যৌবন প্রাপ্ত হয়। الحرس – লাভالمال – সম্পদ। عمر – বয়স।
বর্ণনাকারী পরিচয়ঃ
হযরত আনাস (রা)ঃ নাম আনাস। পিতা মালেক এবং মা উম্মে সুলাইমা।১ উপাধি’ খাদিমু রাসূলিল্লাহ্’। উপনাম আবু উমাইয়া, আবু উমামা ইত্যাদি।রাসূলুল্লাহ (স) যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখন হযরত আনাস (রা) এর বয়স মাত্র দশ বৎসর। এ সময় তাঁর মা ইসলাম গ্রহণ করেন। স্ত্রীর ইসলাম গ্রহণে অসন্তুষ্ট হয়ে আনাস (রা) এর পিতা সিরিয়া চলে যায় এবং সেখানেই সে ইন্তেকাল করে। আনাস (রা) এর পিতার ইস্তেকালের পর তাঁর মা আবু তালহাকে ইসলাম গ্রহণের শর্তে বিয়ে করেন। ফলে আনাস (রা) এর প্রতিপালনের ভার আবু তালহা (রা) এর উপর অর্পিত হয়। যাহোক স্বামী স্ত্রী দুজন পরামর্শ করে বালক আনাস (রা) কে নবী করীম (স) এর খেদমতের জন্য
পৃষ্ঠা:৭৫
তাঁর নিকট পেশ করলে তিনি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ ১০ বৎসর পর্যন্ত নবী করীম (স) এর খেদমতের সুযোগ পান।বয়সের সল্পতার কারণে তিনি বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। পরবর্তীতে খায়বার যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। তিনি কুরআন, হাদীস, ও ফিকাহয় সমান পারদর্শীতা অর্জন করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা) এর খিলাফত কালে তাঁকে প্রথমে বাহরাইনের কালেক্টর এবং পরবর্তীতে সেখানকার গভর্ণর নিয়োগ করেন। হযরত উমর (রা) তাঁকে বসরার প্রধান বিচারপতি ও মুফতি হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেন। বসরার জামে মসজিদ ছিলো তার হাদীস শিক্ষাদান ও প্রচারের কেন্দ্র। সেখানে মক্কা, মদীনা, বসরা, কুফা এবং সিরিয়ার বহু ছাত্র তাঁর নিকট হাদীস শিক্ষার(১) উম্মে সুলাইম (রা) মহানবী (স)-এর খালা ছিলেন। এ হিসেবে হযরত আনাস (রা) ছিলেন মহানবী (স)-এর খালাতো ভাই।জন্য একত্রিত হতো।তিনি ইমাম বদরুদ্দিন আইনীর মতে ৬৩ বৎসর বয়সে ৪১ অথবা ৪৪ অথবা ৪৫ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে তিনি ৯১ বা ৯৩ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৯৭ হতে ১০৭ বৎসরের মধ্যে। তিনি মোট ১,২৮৬ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে বুখারী ও মুস- লিম একত্রে ১৬৮টি এবং পৃথকভাবে বুখারী ৮৩টি এবং মুসলিম ৯১টি হাদীস বর্ণনাকরেছেন।
হাদীস দুটোর সমন্বয়:
১নং হাদীসে দীর্ঘ কামনা ও দুনিয়ার মহব্রতের কথা বলা হয়েছে। ২নং হাদীসে বুড়ো মানুষের সম্পদ ও (দীর্ঘ) জীবন লাভের আকাংখার কথা বলা হয়েছে। আপাতঃ দৃষ্টিতে দুটো হাদীসের বক্তব্য দু’রকম মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে উভয় হাদীসে বর্ণিত বিষয় এক ও অভিন্ন। দুনিয়ার মহব্বত ও মালের মহরত মূলতঃ একই কথার দ্বিবিধ প্রয়োগ মাত্র। আবার দীর্ঘ জীবন ও দীর্ঘ কামনা একই তাৎপর্য বহন করে। কাজেই হাদীস দুটোর মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই।
হাদীস দুটোর গুরুত্ব:
যে দুটো বস্তু মানুষকে বিপর্যয়ে ফেলে এবং সর্বনাশের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দেয়। সে সম্পর্কে সতর্ক করে তার প্রতিকারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে আলোচ্য হাদীস
পৃষ্ঠা:৭৬
দুটোতে। কেননা একজন মু’মিনের জীবনে এ দোষ দুটো বল্লাহীনভাবে মাথ- চোরা দিয়ে উঠতে পারেনা। কারণ মুমিন ব্যক্তি সর্বদা তার আশা আকাংখা বা প্রবৃত্তিকে বুদ্ধির অধীনে রাখে এবং বুদ্ধিকে কুরআন সুন্নাহর নিয়ন্ত্রণে রাখেন। সত্যি কথা বলতে কি, নদী বা সমুদ্রে যান চলাচলের জন্য যেমন মাঝে মাঝে আলোক ওস্ত স্থাপন করা হয়, তদ্রুপ এ হাদীস দুটো আখিরাতের পথের পথিকের জন্য আলোক স্তম্ভের মতোই গুরুত্ব বহন করে।
ব্যাখ্যাঃ
হাদীসের বর্ণিত দোষ দুটোকে বুড়ো মানুষের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এতে অবশ্য একথা প্রমাণিত হয় না যে, এগুলো যুবকদের জন্য বা যারা এখনো বাধ্যক্যে পৌঁছেনি তাদের জন্য দোষের নয়। বরং এজন্যই বুড়োদের কথা বলা হয়েছে, কারণ যখন মানুষ বুড়ো হয়ে যায় তখন সে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে হতাশ হয়ে যাওয়ার কথা। দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে সারাক্ষণ পরকাল ও মৃত্যু চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু এ দুটোর যে প্রবল মোহ, অদম্য কামনা, তা থেকে যেহেতু বুড়ো মানুষ পর্যন্ত নিরাপদ নয়; কাজেই যারা এখনো বার্ধক্যে পৌঁছেনি তাদের নিরাপদের তো কোন প্রশ্নই উঠেনা। তাই প্রতিটি মানুষের কর্তব্য এ দুটো ফিতনা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃإن لكلِّ أُمَّةٍ فِتْنَةٌ وَفِتْنَةٌ أُمَّتِي الْمَالُপ্রত্যেক উম্মতের জন্যই ফিতনা (পরীক্ষা) আছে, আর আমার উম্মতের ফিতনা (পরীক্ষা) হচ্ছে ধন সম্পদ। (তিরমিযি)। অন্য হাদীসে তিনি আরো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন:فوالله الفقر أخشى عَلَيْكُمْ وَلَكِنْ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَط علَيْكُمُ الدُّنْيا كما بسطت على مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَتَنَا فَسُوهَاكَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُهْلِكُكُمْ كَمَا أَهْلَكْتُهُمْ . —’আল্লাহর কসম। আমি তোমাদের জন্য দারিদ্রতার ভয় করিনা। বরং আমি ভয় পাচ্ছি, দুনিয়া তোমাদের জন্য প্রশস্ত করে দেয়া হবে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য দেয়া হয়েছিলো। তোমরা তার প্রতিযোগীতায় এমনভাবে
পৃষ্ঠা:৭৭
নিয়োজিত হবে যেভাবে তারা তার প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত হয়েছিলো। পরিণতিতে তা তোমাদেরকে ধংস করে দিবে। যেমনিভাবে তোমাদের। পূর্ববর্তীদেরকে ধংস করে দেয়া হয়েছিলো।’ বুখারী, মুসলিম।মানুষ যখন নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে দুনিয়ার উপায় উপকরনের পিছনে লেগে যায় তখন শয়তানও তাকে পরিপূর্ণভাবে বিপথগামী করে ধংসের ষোলকলা পূর্ণ করতে চায়। মানুষ যখন নীতি নৈতিককতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রবৃত্তির দাসত্ব করা শুরু করে দেয় তখন তার আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। এ কথার সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ রাবুল আলামীন দিচ্ছেন। ইরশাদ হচ্ছে:واتبع هواه فمثله كمثل الكلب إن تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يلهث —যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির দাসত্ব করে, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুকুরের ন্যায়। তুমি তাকে আক্রমন করলেও (লালসার) জিহবা বের করবে এবং তাকে ছেড়ে দিলেও জিহবা বের করবে। (সূরা আরাফ: ১৭৫)
অন্যত্র বলা হয়েছে:قد أفلح من رَكَهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسْهَا . —’সে অবশ্য কৃতকার্য যে নিজের নফস্ বা প্রবৃত্তিকে পবিত্র করে নিলো; আর অকৃতকার্য সেই, যে নফসের ভালো প্রবণতাকে দাবিয়ে রাখলো।’ (সূরা আশ্ শামসঃ ৯-১০)দীর্ঘ আশা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নবী করীম (স) বলেছেন:وأما طول الأمل فينسي الآخرة . —’সুদীর্ঘ আশা মানুষকে আখিরাতের কথা ভুলিয়ে দেয়।’ (বাইহাকী) দীর্ঘ আশা পোষণ করা অনুচিত কিন্তু নেক কাজের জন্য দীর্ঘ আশা করা দোষনীয় নয়, বরং তাতে সওয়াবও আছে। হাদীসের বক্তব্য শুধুমাত্র যারা বৈষয়িক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দীর্ঘ আশা পোষণ করে তাদের জন্য। আল্লাহ্ আমাদেরকে যেনো এ দোষ থেকে পরহেজ করার তৌফিক দেন।
পৃষ্ঠা:৭৮
শিক্ষাবলী:
১। হাদীসে বুড়োদেরকে লক্ষ্য করে বললেও এখানে সমস্ত মানুষকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে।
২। ধন সম্পদের লোভ ও দীর্ঘ আশা মানুষকে আখিরাতের কথা ভুলিয়ে দেয়।
৩। মানুষ যদি নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দেয়, তবে তার আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকেনা।
৪। নফস্ বা প্রবৃত্তিকে যদি কুরআন সুন্নাহর আলোকে পরিচালনা করা যায় তবে আখিরাতের সফলতা অবশ্যম্ভাবী।
পৃষ্ঠা:৭৯
দারসে হাদিস চতুর্থ খন্ড
ইবাদাতের সঠিক পদ্ধতি
عن أنس رضي الله تَعَالَى عَنْهُ قَالَ جَاءَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ إِلَى أزواج النبي صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا أَخْبِرُوا بِهَا كَأَنَّهُمْ تَقَالُوهَا، فَقَالُوا أين نحن من النبي صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَدْ غَفَرَ اللهُ مَا تقدم مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ فَقَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَأَصَلَّى اللَّيْلَ أبدا وقال الآخر أنا أصوم النهار أبدا الا أفطر وقال الآخر أنا أَعْتَزِلُ النِّسَاء فَلا أتزوج أبدًا فَجَاءَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسلم إليهِمْ فَقَالَ أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا ؟ أَمَا وَ اللَّهِ إِنِّي لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ وَلكِنِّي أَصُومُ وَأَفْطِرُ وَأَصَلَّى وَارقدوَاتَزَوْجُ النِّسَاء فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنى.(متفق عليه) —হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেছেন, একবার নবী করীম (সা)-এর ইবাদাত সম্পর্কে জানার জন্য তিন ব্যক্তি উন্মুল মুমিনীনদের কাছে উপস্থিত হলো। নবী করীম (সা)-এর ইবাদাত সম্পর্কে যখন তাদেরকে জানানো হলো তারা সে ইবাদাতকে অপ্রতুল মনে করলো এবং বললো, কোথায় রাসূল (সা) এবং কোথায় আমরা, তাঁর সাথে আমাদের কি কোন তুলনা হতে পারে? আল্লাহ স্বয়ং তাঁর আগের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তাদের একজন বললো, আমি সারা রাত নামাজে কাটাবো। দ্বিতীয় ব্যক্তি বললো, আমি সারা বছর রোযা রাখবো, কখনো তা ভঙ্গ করবো না। এবার তৃতীয় ব্যক্তি বললো, আমি কখনো বিয়ে করবো না এবং স্ত্রীর সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকবো। এমন সময় নবী করীম
পৃষ্ঠা:৮০
(সা) উপস্থিত হয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি এই কথা বলেছো? সাবধান! আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, আমি তোমাদের মধ্যে। আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করি এবং বেশী তাকওয়া অবলম্বন করি। তবু আমি কোন কোন দিন রোযা রাখি আবার তা ভঙ্গও করি। আবার কখনও (রাতে) নামায পড়ি আবার কখনও (রাতে) ঘুমাই। আর আমি বিয়ে শাদী করে ঘর সংসারও করছি। (এগুলো আমার সুন্নাত) সুতরাং যে আমার সুন্নাতের (পদ্ধতির) অনুসরণ করবে না সে আমার দলভুক্ত নয়। (বুখারী, মুসলিম)
শব্দার্থ
جاء ثلاثة رهط তিন ব্যক্তি এলো। إلى أزواج النبي নবী করীম )সা)- এর স্ত্রীদের নিকট يسئلون তারা জিজ্ঞেস করলো عن عبادة النبي নবী করীম (সা)-এর ইবাদত সম্পর্কে। যখন أخبروبها তাদেরকে সে সম্পর্কে বলা হলো। كَأَنَّهُمْ تَقَالُوها তাদের কাছে তা অপ্রতুল মনে হলো। فقالوا অতঃপর তারা বললো।- أين نحن কোথায় আমরা। من النبي নবী করীম (সা) থেকে। قد غفر الله আল্লাহ তাঁকে মা’ফ করে দিয়েছেন। ا تقدم من ذنبه وما تأخرর পূর্বের ও পরের যাবতীয় গুনাহ্। فقال أحدهم তাদের একজন বললো। أما أَنَا فَأَصلي الليل أبدًا আমি সর্বদা সারারাত নামাযে কাটাবো। قال الآخر অপর জন if the genita Rate t أنا أصوم النهار أبدا 2011 রোযা থাকবো। أ أقطر। তবে শুধু ইফতার করবো। أنا أعتزل النساء আমি নারীর সংস্রব বর্জন করবো এবং কখনো বিয়ে করবো না। فجاء النَّبِي (صلعم) إِلَيْهِمْ এমন সময় নবী করীম (সা) তাদের মাঝে তাশরীফ আনলেন। أنْتُمُ الذين قُلْتُمْ তোমরা তো তারাই যারা কথাবার্তা বলছিলে : كذا وكذا এই এই ৩ সাবধান والله আল্লাহর শপথ।
পৃষ্ঠা ৮১ থেকে ১০০
পৃষ্ঠা:৮১
إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ আমি তোমাদের চেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করি। وآتْقاكُمْ এবং বেশী তাকওয়া অবলম্বন করি। । তবু আমি। أصوم রোযা থাকি। -أفطر রোযা ভঙ্গ করি। أصلى আমি নামায পড়ি। أرقد বিশ্রাম করি। أتزوج النساء আমি বিয়ে করেছি এবং স্ত্রীর সান্নিধ্যে যাই। فمن অতঃপর যে ব্যক্তি। رغب মুখ ফিরিয়ে নেবে। عن سنتی আমার সুন্নাত থেকে। فليس منی সে আমার দলভুক্ত নয়।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
নাম আনাস। পিতা মালেক এবং মা উম্মে সুলাইম। উপাধী ‘খাদিমু রাসূলিল্লাহ্’। উপনাম আবু উমাইয়া, আবু উমামা ইত্যাদি।রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখন হযরত আনাস (রা)-এর বয়স মাত্র দশ বছর। এ সময় তাঁর মা (উম্মে সুলাইম) ইসলাম গ্রহণ করেন। স্ত্রীর ইসলাম গ্রহণে অসন্তুষ্ট হয়ে আনাস (রা)-এর পিতা সিরিয়া চলে যায় এবং সেখানেই সে ইন্তিকাল করে। আনাস (রা)-এর পিতার ইন্তিকালের পর তাঁর মা আবু তালহাকে ইসলাম গ্রহণের শর্তে বিয়ে করেন। ফলে আনাস (রা)-এর প্রতিপালন ভার আবু তালহা (রা)-এর উপর অর্পিত হয়। যাহোক স্বামী স্ত্রী দু’জন পরামর্শ করে বালক আনাস (রা)-কে নবী করীম (সা)-এর খেদমতের জন্য তাঁর নিকট পেশ করলে তিনি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ ১০ বৎসর পর্যন্ত নবী করীম (সা)-এর খেদমতের সুযোগ পান।বয়সের স্বল্পতার কারণে তিনি বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। পরবর্তীতে খায়বার যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি সক্রীয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি কুরআন, হাদীস ও ফিকহায় সমান পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকালে তাঁকে প্রথমে বাহরাইনের কালেক্টর এবং পরবর্তীতে সেখানকার গভর্ণর নিয়োগ করেন। হযরত উমর (রা) তাকে বসরার প্রধান বিচারপতি ও মুফতী হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেন। বসরার জামে মসজিদ ছিলো তার হাদীস শিক্ষাদান ও প্রচারের কেন্দ্র।
পৃষ্ঠা:৮২
তিনি ৯১ অথবা ৯৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো ৯৭ হতে ১০৭ বৎসরের মধ্যে।তিনি মোট ১,২৮৬টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে মুত্তাফিকুন আলাইহি ১৬৮টি। পৃথকভাবে বুখারী ৮৩টি এবং মুসলিম ৯১টি বর্ণনা করেছেন।
পটভূমি
নবী করীম (সা)-এর সাহাবাগণ সর্বদা পরকালের মুক্তি ও সাফল্যের জন্য ব্যাকুল থাকতেন। তাঁরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা) এর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। শুধু তাই নয়, এতো কিছু করার পরও তাদের কেউ কেউ আশ্বস্ত হতে না পেরে গোপনে নবী পরিবারের খোঁজখবর নিতেন যাতে নবী করীম (সা)-এর কোন আমলই বাদ না যায়। কিন্তু নবী পরিবারের অনুসন্ধান করে যে তথ্য তারা পেয়েছিলেন তাকে পরকালের সাফল্যের জন্য যথেষ্ট মনে না করে উপরিউক্ত আলোচনা করতে থাকেন। ইত্যবসরে হযরত জিব্রাইল (আ) কর্তৃক খবর পেয়ে অথবা মসজিদে নববীতে বসে থাকাবস্থায় তাদের কথোপকথন শোনে নবী করীম (সা) তাদের সামনে এসে এ হাদীসটি বর্ণনা করেন।
গুরুত্ব
কষ্ট করে জীবনপাতের নাম ইবাদাত নয়। তা এ হাদীসে সুন্দরভাবে বলে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ্ যা নির্দেশ করেছেন এবং এবং রাসূল (সা) যা করে দেখিয়েছেন, করতে বলেছেন বা অনুমোদন দিয়েছেন তার অতিরিক্ত কোন কিছু করার নামও ইবাদত নয়। ইসলাম কোন ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেনা এবং কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কোন বোঝা চাপিয়ে দেয়াও পছন্দ করেনা। সব কিছুতে ভারসাম্য বজায় রাখাই হচ্ছে ইসলামের নির্দেশ। সত্যি কথা বলতে কি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকালিন মুক্তি নিহিত। উল্লেখিত হাদীসটিতে এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই দেয়া হয়েছে।
পৃষ্ঠা:৮৩
ব্যাখ্যা
নামায ও রোযা গুরুত্বপূর্ণ দু’টো ইবাদাত। তাই বলে শরীর ও স্ত্রীর হক বাদ দিয়ে এগুলো অব্যাহতভাবে পালন করার নাম ইবাদাত নয়। একবার নবী করীম (সা) হযরত জয়নব (রা)-এর কামরার মাঝামাঝি একটি রশি টানানো দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি জন্য টানানো হয়েছে? কোন এক বেগম উত্তর দিলেন, এটা জয়নব টানিয়েছে। সে রাতে নামায পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং ঘুম পায় তখন এ রশি ধরে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে। একথা শুনে রাসূলে আকরাম (সা) বললেন, এভাবে ইবাদত করা ঠিক নয়। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে নেবে তারপর জেগে ইবাদাত করবে। আবার নামায পড়া অথবা রোযা রাখাটা যেমন ইবাদাত ঠিক তেমনি বিয়ে করে ঘর-সংসার করাও ইবাদাত। একবার সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা স্ত্রীর মাধ্যমে যৌনতৃপ্তি লাভ করি। এতে কি কোন সওয়াব হবে? নবী করীম (সা) উত্তর দিলেন, তুমি যদি অবৈধভাবে যৌনতৃপ্তি লাভ করতে তবে তো গুনাহ্ হতো। তাহলে বৈধ ভাবে তা করবে সওয়াব হবে না কেন? অবশ্যই সওয়াব হবে। কাজেই দেখা যাচ্ছে একজন মুসলিম সে তার জীবনে যতো রকম কাজ-ই করুক না কেন সবগুলোই তার ইবাদাত। অবশ্য যদি সেগুলো আল্লাহ্ ও রাসূল (সা) কর্তৃক নির্দেশিত পদ্ধতিতে করা হয়। নইলে তা ইবাদাত হতে পারে না।-চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, লেন-দেন, দেখাশুনা, চাকরী, ব্যবসা, কথা বলা, ঘুমানো প্রভৃতি কাজগুলো অনেকে দুনিয়াদারীর কাজ মনে করে থাকে, কিন্তু এগুলো তখনই দুনিয়াদারী বলে পরিগণিত হয় যখন তা ইসলামের বিধান অনুযায়ী করা হয় তখন তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়ে যায়। এমন কি প্রস্রাব-পায়খানা করা, জামা কাপড় পরা, মাথার চুল আঁচড়ানো, জুতা মোজা পরা এগুলোও ইবাদাতের মধ্যে শামিল হয়ে যাবে। কেবলমাত্র নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত এরূপ কয়েকটি অনুষ্ঠানের নাম ইবাদাত নয়। মুসলমানের পুরো জিন্দেগী আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান মতে পরিচালনার নাম ইবাদাত। ইমাম গাযযালী (রহ) বলেছেন-
পৃষ্ঠা:৮৪
অনেক শ্রমজীবী লোক প্রকৃত তাৎপর্য না বুঝে আফসোস করে বলে- ‘হায়। সারা জীবন শুধু খেটেই গেলাম, আল্লাহর নাম নেবার অবসরটুকু পেলাম না।’ তাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহর সৃষ্ট জীবের (অর্থাৎ পরিবার, পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের) সেবা হিসেবে ইবাদাতের নিয়তে পরিশ্রম করা, নফল নামায ও তাসবীহ তিলাওয়াতের চেয়ে শতগুণে উত্তম। (তাবলীগে দীন ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ১০৯) একটি কথা মনে রাখা দরকার, রাসূল (সা) সারাজীবনের কর্মতৎপরতা, নির্দেশ ও অনুমোদনের মাধ্যমে দ্বীনের যে নিখুঁত ছবি এঁকে গিয়েছেন, একমাত্র তাই আমাদের সুন্নাত বা অনুকরণ ও অনুসরনীয়। তা থেকে কিছু বাদ দেয়ার অধিকার যেমন কারো নেই। তেমনিভাবে তার সাথে কিছু সংযোগ করার অধিকারও নেই। কেউ যদি মনে করে, নিজের উপর কাঠিন্য আরোপ করে অথবা বেশী কষ্ট সহ্য করে ইবাদাত করলে সওয়াব বেশী হবে তাহলে সে যেমন ভুল করবে, ঠিক তেমনিভাবে কেউ যদি ঘরসংসার বাদ দিয়ে লোকালয় ছেড়ে জঙ্গলে কিংবা অন্য কোন বিজন জায়গায় গিয়ে ইবাদাত করাকে উত্তম মনে করে, সেও ভুল করবে। এটিকে ইসলাম বৈরাগ্যবাদ বলে নিন্দা করেছে। হযরত ইসা (আ)-এর একজন উম্মত দুনিয়ার যাবতীয় কাজ-কারবার ছেড়ে হুজরা, জঙ্গল ও পর্বত গুহায় আশ্রয় নিয়ে সারাক্ষণ আল্লাহর জিকির ও ধ্যানে মশগুল থাকতো। তার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ্ উন্মতে মুহাম্মদীকে সাবধান করে বলেছেন:ورهبانية ابتدعوها مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاء رِضْوانِ اللهِفما رعوها حق رعايتها. (الحديد (۲۷) এ দরবেশী বা বৈরাগ্যবাদী জীবন তাদের মনগড়া। আমি তাদের জন্য তা ফরয করিনি। কিন্তু তারা সীমালংঘন করে ফেলেছে। (সূরা আল হাদীদ: ২৭) নবী করীম (সা) বলেছেন-لا رَهْبَانِيَّة في الإسلام —ইসলামে কোন বৈরাগ্যবাদ নেই। তিনি অন্যত্র বলেছেন- আমার উম্মতের বৈরাগ্যবাদ হচ্ছে জিহাদ।
পৃষ্ঠা:৮৫
শিক্ষাবলী
১. নবী করীম (সা.) ইবাদতের যে পদ্ধতি শিখিয়েছেন তা বাদ দিয়ে অন্য কোন পদ্ধতিতে ইবাদাত করার নাম ইবাদাত নয়।
২. যে সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহ সুযোগ বা অবকাশ দিয়েছেন তা গ্রহণ না করে নিজেদের উপর কাঠিন্য চাপিয়ে নেয়া গর্হিত কাজ।
৩. ইসলামের মধ্যে সামান্য কম অথবা বেশী করার অধিকার কারো নেই।
৪. গোটা জীবনে প্রতিটি কর্ম তৎপরতারই ইবাদাতের অন্তর্ভূক্ত যদি তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সম্পাদন করা হয়।
৫. ইসলামী জীবনে বৈরাগ্যবাদের কোন অবকাশ নেই।
৬. মানুষের উপর আল্লাহর যেমন হক রয়েছে, তদ্রুপ মানুষের উপরই মানুষের হক আছে। এমনকি নিজের শরীরের উপরও হক রয়েছে। প্রত্যেক প্রকার হক আদায় করাটাও অন্যতম একটি ইবাদাত।
৭. যে সমস্ত কাজ শুধুমাত্র রাসূলে আকরাম (সা)-এর জন্যে নির্দিষ্ট ছিলো সেসব কাজের ব্যাপারে রাসূল (সা.)-কে আদর্শ মনোনীত করা হয়নি বরং আদর্শ মনোনীত করা হয়েছে শুধু সেসব কাজ ও আমলের ব্যাপারে যা প্রত্যেক উম্মতের করা সম্ভব। কাজেই এ অজুহাত পেশ করারও কোন সুযোগ নেই, এ কাজ তো রাসুলের (সা) দ্বারা সম্ভব, আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
৮. রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে পূর্ণ অনুসরণ করাই মুক্তির একমাত্র পথ, এর কোন বিকল্প নেই।
পৃষ্ঠা:৮৬
মুসলিম জাতির পতনের কারণ
عن ثوبان رضى اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُوشِكُ الأُمم أن تَدَاعَى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الأكلة إلى قصعتها، فَقَالَ قَائِلٌ وَمِنْ قِلَّةٍ نَحْنُ يَوْمِيد ؟ قَالَ بَلْ انتم يومئذ كثير ولكنكُمْ غُثاء كغثاء السَّيْلِ وَلْيَنْزِعَنَّ اللَّهُ مِنْ صدور عدوكم المهبة مِنكُمْ وَليَقْذِفَنَّ فِي قُلُوبِكُمُ الْوَهْنَ. قال قائل يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا الْوَهْنُ؟ قَالَ حُبُّ الدُّنْيَاوكراهية الموت. (ابوداؤد) —হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অচিরেই আমার উন্মতের মধ্যে এমন একটি সময় আসবে, যখন দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি তাদের দিকে এমনভাবে ধাবিত হবে, যেমন কোন ক্ষুধার্ত খাদ্যের দিকে ধাবিত হয়। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, সেদিন কি অমারা সংখ্যায় খুবই কম থাকবো? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সেদিন তোমরা সংখ্যায় অনেক বেশী থাকবে কিন্তু তোমরা হবে বন্যার পানির ফেনার মত। আল্লাহ শত্রুর অন্তর থেকে তোমাদের ব্যাপারে ভীতি দূর করে দেবেন এবং তোমাদের মনে তাদের ভয় ঢুকিয়ে দেবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল। তখন আমাদের মনে ভীতি ও দুর্বলতা দেখা দেয়ার কারণ কি? হুজুর (সা.) বললেন, তোমরা সেদিন দুনিয়াকে ভালোবাসবে এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করবে। (আবু দাউদ)
শব্দার্থ
بوشك الأمم অচিরেই (আমার) উম্মত। آن যে। تدعى عليكُمْ ধাবিত হবে তোমাদের দিকে। كما تداعی যেমন ধাবিত হয়। ২০≤ম্বা
পৃষ্ঠা:৮৭
ক্ষুধার্ত। إلى قصفته তার খাদ্যের দিকে। فقال فائل অত:পর এক ব্যক্তি বললো। من فئة সংখ্যায় অল্প হওয়া। نحن আমরা। يومئذ -لত্র তিনি বললেন। بَلْ বরং। اَنْتُمْতোমরা كثير বেশী لكنكُمْ কিন্তু তোম- তোমরা। غُشَاء ফেলা। كَفُثَاء السَّيْل বন্যার পানির ফেনার মতো। لينز عن الله আল্লাহ ছিনিয়ে নেবেন। من صدور অন্তর হতে। عدوكم তোমাদের শত্রুদের। المهابة ভয় – منكُمْ তোমাদের থেকে। – الوهن অবশ্যই ঢুকিয়ে দেয়া হবে। في قلوبكم তোমাদের অন্তরে। – آلوهن আতংক – مالوهن আতংকের কারণ কি?- حب الدنيا দুনিয়ার মহব্বত। كرا هية الموت মৃত্যুকে অপছন্দ করা।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
নাম সাওবান। কুনিয়াত বা ডাক নাম আবু আবদুল্লাহ। পিতার নাম নাজদাহ্। ইয়েমেনের প্রসিদ্ধ হিময়ার গোত্রের সন্তান। কোন কারণে তিনি দাসে পরিণত হন। রাসূলে কারীম (সা.) তাকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন। তখন তিনি সাওবান (রা.)-কে বললেন, তুমি ইচ্ছে করলে দেশে চলে যেতে পারো অথবা আমার সাথে থাকতো পারো। যদি আমার সাথে থাকো তবে তুমি আমার পরিবারের সদস্য বলে গণ্য হবে। অতপর হযরত সাওবান (রা.) নবী করীম (সা)-এর কাছে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।হযরত সাওবান (রা.) ছিলেন রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিশেষ খাদেম। সর্বাবস্থায় তিনি তাঁর মঙ্গল লাভের সুযোগ পেতেন। এজন্য তিনি উলুমে নববী বা হাদীস সম্পর্কিত জ্ঞানে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। রাসূল (সা.)-এর উপর তাঁর অগাধ ভক্তি শ্রদ্ধা ছিলো। একবার এক ইহুদী নবী করীম (সা)-কে লক্ষ্য করে বললো, আস্সালামু আলাইকা ইয়া মুহাম্মদ। একথা শুনে সাওবান (রা) এমন জোরে লোকটিকে ধাক্কা দিলেন, বেচারা পড়তে পড়তে কোন রকমে টাল সামলালো। পরে সে তাঁর রাগের কারণ জানতে চাইলে, তিনি বললেন, তুমি কেন ইয়া রাসূলাল্লাহ্ না বলে ইয়া মুহাম্মদ বললে? লোকটি বললো, আমি তো
পৃষ্ঠা:৮৮
তাঁকে তাঁর খান্দানী নামে সম্বোধন করেছি। তার কথায় রাসূল (সা) ও সায় দিলেন। তখন তিনি শান্ত হলেন।রাসূলে আকরাম (সা) এর ইন্তিকালের পর তিনি সিরিয়ার রামলায় চলে যান এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। খলিফা উমর (রা)-এর সাথে মিশর অভিযানে শরীক হন। তারপর তিনি রামলা ছেড়ে হিমসে বসতি স্থাপন করেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) এর শাসনামলে ৫৪ হিজরীতে হিমসে ইন্তিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ১২৭ টি।
হাদীসটির গুরুত্ব
আল্লাহর রাসূল (সা) অনেক সময় অনেক বিষয়ে ভবিষ্যত বাণী করেছেন। আলোচ্য এ হাদীসটি তার মধ্যে একটি। এ হাদীসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন-وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ (المنافقون). —সমস্ত ইজ্জত সম্মান একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের জন্য। সূরা আন মুনাফিকুন: ৮) ( কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে দেখা যায় প্রথম দুটো কথা সঠিক হলেও তৃতীয় কথাটি অনেকাংশে সঠিক মনে হয় না। এর কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তরই নিহিত আছে আলোচ্য হাদীসটিতে। এর্থাৎ যতোক্ষণ কোন রোগের কারণ নির্ণয় না করা যায় ততোক্ষণ সুষ্ঠু চিকিৎসা করা আদৌ সম্ভব নয়। তেমনিভাবে অধঃপতিত এ জাতির অধঃপতনের মূল কারণ কি এবং তার প্রতিকারই বা কি সে সম্পর্কে প্রায় দেড় হাজার বৎসর পূর্বেই রাসূলে আকরাম (সা) বলে দিয়েছেন। শুধুমাত্র কারণ নির্ণয় করে চুপচাপ বসে থাকলেই যেমন রোগ আরোগ্য হয় না তেমনিভাবে হাদীসে উল্লেখিত কারণ জেনে নিলেই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ব্যাপারটি তেমনও নয়। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন:إنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ (ط)
পৃষ্ঠা:৮৯
আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততোক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতোক্ষণ তারা তা পরিবর্তনের চেষ্টা না করে। -(সূরা রা’দঃ ১১)সত্যিকথা বলতে কি, বর্তমানে নিগৃহিত মুসলমানদের কাছে এ হাদীসটির গুরুত্ব অপরিসীম। এতে নিহিত আছে মুক্তির সোনালী দিগন্ত।
ব্যাখ্যা
পৃথিবীতে বসবাসরত বিরাট এক জাতির নাম মুসলিম। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশের মালিক। ইচ্ছে করলে বিশ্ব অর্থনীতিকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবু দূর্ভাগ্যক্রমে তারা আজ অবহেলিত, লাঞ্ছিত। কোন কোন জায়গায় সংখ্যা লঘিষ্টদের হাতে মার খাচ্ছে। আবার কোথাও তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত হুমকীর সম্মুখীন। যেমন- বার্মা, বসনিয়া, হারজেগোভিনা, ফিলিস্তিন ইত্যাদি। আফগানিস্তান, কাশ্মীর, আলজেরিরা প্রভৃতি জায়গায় সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়েও আজ তারা দিশেহারা, কিন্তু কেন? তার প্রধান কারণ, মুসলমানদের অনৈক্য ও দুনিয়া প্রীতি। বর্তমান পৃথিবীতে মুসলমানগণ কোন মুসলমানকে ইমাম (নেতা) না বানিয়ে ইমাম বানিয়েছে ইহুদী খৃষ্টান গোষ্ঠীকে। একটি বিশেষ প্রাণীর সামনে খাদ্য দিলে যেমন সে তার বন্ধুকেও শত্রু মনে করে তদ্রুপ আজ মুসলমানগণও বুঝতে পারছেনা কে বন্ধু আর কে শত্রু? মুসলমানগণ ইহুদী খৃষ্টানদের দয়া ও অনুকম্পায় নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সবকিছু ভুলে চরিত্র পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে বসেছে।পরকালীন চিন্তা চেতনার জায়গায় এখন বস্তুবাদী চিন্তাই প্রাধান্য পাচ্ছে। নম্বর দুনিয়ার চাকিচিক্যে তারা বিমুগ্ধ। ফলে যা হবার তা-ই হচ্ছে।একদিন যে মুসলমানের নাম শুনে অমুসলিমরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতো। আজ তারাই উল্টো মুসলমনাদের ভয় দেখাচ্ছে। কারণ তারা পরকালকে ভুলে গেছে। ফলে তা পাবার জন্য সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে জিহাদ ফী সাবিল্লিাহ তা থেকেও তারা গাফেল রয়েছে। অথচ আল্লাহর পথে জিহাদ ছাড়া কোন মুসলমান মুসলমান-ই থাকতে পারে না। এজন্যই আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ও তার সঙ্গী সাথীরা, নামায পড়ে, রোযা রেখে, যাকাত আদায় করেও মুনাফিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাদের একমাত্র দোষ ও দুর্বলতা ছিলো, তারা জিহাদের সময় বিভিন্ন অজুহাত পেশ করতো এব জিহাদ থেকে দূরে থাকতো। মৃত্যুকে তারা সর্বাধিক ভয় পেতো। এমনকি যারা খাঁটি মুসলমান, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ
পৃষ্ঠা:৯০
করেছিলেন এমন তিনজন সাহাবী মানবিক দুর্বলতার কারণে শুধুমাত্র একটি জিদে অংশগ্রহণ না করে তারাও ভীষণ শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাদের একজন হচ্ছেন হযরত কা’ব ইবনে মালিক (রা)। তিনিনিজের ঘটনা নিজেই বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন-আমি তাবুকের যুদ্ধের আগে কখনো এতো শক্তি সামর্থের অধিকারী ছিলাম না। তখন আমার কাছে দুটো উট ছিলো। এর আগে আমি কখনো দুটো উট একত্রিত করতে পারিনি।নবী করীম (সা)-এর অভ্যাস ছিলো, তিনি যখন কোন জিহাদে যাবার ইচ্ছে করতেন, তখন তা না বলে বরং বিপরীত মুখী খবরাখবর নিতেন। কিন্তু তাবুকের যুদ্ধ গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমের সময় সংঘটিত হয়েছিলো। সফর ছিলো দূরের। তাছাড়া শত্রুপক্ষ ছিলো প্রবল পরাক্রান্ত। তাই তিনি মুসলমানদের যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য খোলাখুলি নির্দেশ দিলেন। ফলে সর্বাধিক লোক রাসূল (সা)-এর সাথে জিহাদে যোগদান করেন। লোক এতো বেশী ছিলো তখন ইচ্ছে করলে কেউ পালিয়েও যেতে পারতো। এদিকে বাগানের ফল সম্পূর্ণ পেকে গিয়েছিলো। আমি সকালেই সফরের প্রস্তুতি নিতে ইচ্ছে করলাম কিন্তু সন্ধ্যে হয়ে গেলো তবু আমি প্রস্তুত হতে পারলাম না। ভাবলাম, এখন আমি স্বচ্ছল যখন ইচ্ছে তখনই প্রস্তুত হতে পারবো।ইতোমধ্যে রাসূলে আকরাম (সা) তাঁর সার্থীদের নিয়েও রওয়ানা হয়ে গেলেন। আমি তখনও অপ্রস্তুত। আমার খেয়াল হলো, দু’একদিনের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে হুজুর (সা)-এর সাথে গিয়ে মিলিত হবো। এমনিভাবে সময় বয়ে চললো, এমনকি নবী আকরাম (সা)-এর যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যাবার সময়ও ঘনিয়ে এলা। কিন্তু আমার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হলো না। তখন আমি মদীনার চুতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে কতিপয় দূর্বল অক্ষম লোক ও মুনাফিকদের ছাড়া আর কাউকে দেখলাম না।নবী করীম (সা) তাবুকে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলেন, কা’বকে তো দেখছিনা, কারণ কি? জনৈক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্। তাঁর ধন-সম্পদ তাকে বাধা দিয়েছে। হযরত মুয়ায (রা) বললেন, আপনি ভুল বললেন। আমি যতোটুকু জানি তিনি ভালো লোক। কিন্তু রাসুল (স) সম্পূর্ণ নীরব রইলেন। ভালো মন্দ কিছু বললেন না। কদিন পর মুসলমানগণ মদীনায় ফিরে এলেন। তাতে আমার মনে বিষাদের কালো ছায়া পড়লো। আমি ভীষণ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম, এবার কোন একটি ওজর দেখিয়ে বেঁচে যাবো; পরে না হয় নবী
পৃষ্ঠা:৯১
করীম (সা)-এর নিকট ক্ষমা চেয়ে নেবো। এ সম্পর্কে আমার পরিবারের কয়েকজন বুদ্ধিমান লোকের সাথে পরামর্শও করলাম। কিন্তু যখন তাঁর আগমন সংবাদ পেলাম তখন সিদ্ধান্ত নিলাম সত্য ছাড়া আর কিছুই বলবো না। কেননা সত্য ছাড়া নাজাত নেই।রাসূল (সা)-এর অভ্যাস ছিলো, সফর হতে ফিরে তিনি মসজিদে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেন। দু’রাকায়াত ‘তাহ্ইয়াতুল মাসজিদ’ নামায পড়তেন এবং লোকজনের সাথে সাক্ষাতের জন্য কিছুক্ষণ বসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি মসজিদে প্রবেশ করে (নামায পড়ে) বসলেন। মুনাফিকরা নানা প্রকারের মিথ্যা ওজর পেশ করে শপথ করতে লাগলো। তিনি তাদের বাহ্যিক ওজর গ্রহণ করে আভ্যন্তরীণ ব্যাপার আল্লাহর নিকট সোপর্দ করলেন। ইত্যবসরে আমি সেখানে প্রবেশ করে রাসূল কারীম (সা)-কে সালাম করলাম। কিন্তু তিনি আমাকে দেখে মুদু হেসে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল। আপিনি কি আমার উপর নারাজ হয়েছেন? আল্লাহ্র কসম! আমি মুনাফিক হয়ে যাইনি কিংবা আমার ঈমানের মধ্যে কোন ত্রুটিও আসেনি। তিনি বললেন, কাছে এসো। আমি তাঁর কাছে গিয়ে বসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো উট কিনে রেখেছিলে, কিন্তু তোমাকে কিসে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রাখলো? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি দুনিয়ার কোন বাদশাহ্র নিকট জবাব দিহি করতাম তবে এমন মিথ্যে ওজর পেশ করতাম, তার ক্রোধ দমন হয়ে যেতো। আমি জানি, আজ যদি মিথ্যে ওজর পেশ করে আপনাকে সন্তুষ্ট করতে চাই তবে আল্লাহ্ তা’আলা আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন। তবু ভরসা আছে, আল্লাহ্ আপনার ক্রোধ প্রশমিত করে দেবেন। আল্লাহর কসম! আমার কোন ওজর ছিলো না এবং বর্তমানের ন্যায় কখনও আমি এতো স্বচ্ছলও ছিলাম না। তিনি বললেন, যাও আল্লাহ্ এর মীমাংসা করবেন। আমি বাড়ীতে প্রত্যাবর্তনের পর বাড়ীর অনেকে আমাকে এই বলে ভর্ৎসনা করলে, তুমিতো এর আগে কোন পাপ করোনি আজ যদি একটি মিথ্যে ওজর দেখিয়ে মা’ফ চেয়ে নিতে তবে রাসূল (সা) এর মা’ফই তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যেতো। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মতো আর কারো কি এরূপ হয়েছে? তারা বললো- আরো দুজনের এমন হয়েছে। তারা হলেন হিলাল ইবনে উমাইয়া
পৃষ্ঠা:৯২
এবং মারারা ইবনে রবিয়া। হুজুরে পাক (সা) আমাদের তিন জনের সাথে কথা বলতে মুসলমানদের নিষেধ করে দিলেন। তারা সকলে আমাদের সাথে কথাবার্তা বলা এবং সহযোগিতা প্রদান বন্ধ করে দিলেন। পৃথিবী সহসা আমাদের সামনে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। বিস্তীর্ণ হওয়ার পরও তা আমাদের কাছে সংকীর্ণ হয়ে উঠলো। সমস্ত জনপদ আমার কাছে অপরিচিত মনে হতে লাগলো। আমার পেরেশানীর মূল কারণ ছিলো এমতাবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয় তবে রাসূল (সা) আমার জানায পড়বেন না, আর আল্লাহ্ না করুন রাসূল (সা) যদি ইন্তিকাল করেন, তবে চিরতরে আমার এ অবস্থা রয়ে যাবে। লোকেরা আমার সাথে কথাও বলবে না বা আমার জানাযাও পড়বে না। আমার সাথীদ্বয় ঘরে বসে রইলেন। আমি তাদের চেয়ে শক্তিশালী হওয়ায়, রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতাম, হাটেবাজারে যেতাম এবং জামায়াতের সাথে নামায আদায় করতাম। আমি নবী করীম (সা)-এর মজলিসে গিয়ে বসতাম এবং সালাম করতাম। আর লক্ষ্য করতাম নবী করীম (সা) আমার সালামের জবাবে ঠোঁট নাড়াচ্ছেন কিনা। ফরয নামাযের পর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে নামায পড়তাম এবং তিনি আমাকে দেখছেন কী না তা আড়নয়নে দেখতাম।যখন আমি নামায আরম্ভ করতাম তখন তিনি আমার দিকে তাকাতেন, আবার আমি তাকালেই তিনি মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতেন।এরূপ অস্বস্তিকর পরিবেশে সময় বয়ে চললো। একদিন আমি আবু কাতাদা (রা)-এর দেয়ালের উপর আরোহণ করলাম। সম্পর্কে তিনি আমার চাচাতো ভাই। তার সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতাও ছিলো। আমি দেয়ালে উঠে সালাম দিলাম কিন্তু তিনি সালামের কোন উত্তর দিলেন না। আমি তাকে কসম দিয়ে বললাম, আপনি কি বিশ্বাস করেন না, আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি আমার ভক্তি ও মহব্বত আছে? তিনি কোন জবাব দিলেন না। দ্বিতীয়বার কসম দিয়ে বললাম। এবারও তিনি চুপ করে রইলেন। তৃতীয়বার কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। একথা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম।একদিন আমি মদীনার বাজারে যাচ্ছিলাম। জনৈক খ্রীষ্টান সিরিয়া থেকে মদীনায় বাণিজ্য করতে এসেছিলো। আমি তাকে বলতে শুনলাম, কাব ইবনে মালিকের ঠিকানাটা কেউ আমাকে দিতে পারো? লোকজন ইঙ্গিতে আমাকে দেখিয়ে দিলো। সে আমার কাছে এসে গাসসান গোত্রের শাসনকর্তার তরফ থেকে আমাকে একটি
পৃষ্ঠা:৯৩
পত্র দিলো, তাতে লিখা ছিলো, ‘আমি জানতে পারলাম, আপনার দলপতি আপনার প্রতি অবিচার করেছেন। আল্লাহ্ যেনো আপনাকে সেখানে না রাখেন এবং আপনাকে ধ্বংস না করেন। আপনি আমার কাছে চলে আসুন। সার্বিক সাহায্য করবো।’ পত্র পড়ে আমি “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়লাম। আমার মনে হলো আমি অধঃপতনের অতল তলে তলিয়ে গেছি যার ফলে একজন কাফির পর্যন্ত আমাকে পথ ভ্রষ্ট করতে সাহস পাচ্ছে। আমার কাছেতা বিপজ্জনক মনে হলো। উনুন জালিয়ে চিঠিখানা পুড়ে ফেলাম। অতঃপর এতোদূর গড়িয়েছে, একজন কাফির সেও আমাকে দলে ভিড়াবার সাহস করছে। এভাবে চল্লিশ দিন কেটে গেলো। রাসূল (সা) এর দূতের মারফত সংবাদ এলো আমার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে। ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলে বলা হলো, আপনি তারথেকে পৃথক থাকবেন। আমার সাথীদ্বয়ের কাছেও একই নিদেশ পৌঁছলো। আমি আমার স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ি চলে যেতে বললাম এবং তাকে আরো বললাম, এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত তুমি সেখানে থাকবে। হিলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী এসে নবী করীম (সা) কে বললেন, আমার স্বামী অত্যন্ত বৃদ্ধ তার সেবা-যত্নের আর কেউ নেই। আমি না থাকলে তিনি ধ্বংস হয়ে যাবেন। রাসূল (সা) বললেন, এতে দোষ নেই কিন্তু সহবাসের অনুমতি নেই। মহিলা বললেন, সেদিকে তাঁর কোন আগ্রহ নেই। যেদিন থেকে এ দূর্ঘটনা ঘটেছে সেদিন থেকে শুধু কেঁদেই তাঁর দিন কাটে। লোকজন আমাকে বললো, আপনি হিলালের ন্যায় বিবির খেদমত পাবার অনুমতির চেষ্টা করেন। পেয়ে যেতে পারেন। আমি বললাম, হিলাল বৃদ্ধ লোক আর আামি যুবক। সুতরাং এ চেষ্টা আমি করতে পারবো না। এভাবে আমার আরো দশদিন কেটে গেলো। আমি আমার ঘরের ছাদে ফজর নামাযের পর বিষন্ন মনে বসে আছি। পৃথিবী খুব সংকীর্ণ এবং জীবন অত্যন্ত ভারী মনে হচ্ছিলো। এমন সময় সাল’আ পাহাড়ের শিখর হতে এক ব্যক্তি উচ্চস্বরে আওয়াজ দিলো, হে কা’ব! আপনার জন্য সুসংবাদ। আওয়াজ শুনে তৎক্ষনাৎ আমি সিজদায় পড়ে গেলাম এবং খুশীতে কেঁদে ফেললাম।কিছুক্ষণ পর অশ্বারোহী আমার কাছে পৌঁছে গেলো। আমি যে কাপড়টি পরা ছিলাম তা খুলে সংবাদাতাকে দিয়ে দিলাম। সেই কাপড় ছাড়া আমার আর কোন কাপড় ছিলো না। আমি অন্যের কাছ থেকে একটি কাপড় ধার করে পরে নবী করীম (সা)-এর খিদমতে হাজির হলাম। আমার সাথীদ্বয়ের নিকটও সুসংবাদ সহ
পৃষ্ঠা:৯৪
লোক প্রেরিত হয়েছিলো। আমি সেখানে হাজির হওয়া মারা সকলে সুসংবাদ প্রদানের জন্য দৌড়ে আসলো। সর্বপ্রথম আবু তালহা এগিয়ে এসে আমাকে মুবারকবাদ দিলেন এবং আমার সাথে মুসাফাহা করলেন। আমি এ আনন্দের কথা কোনদিন ভুলতে পারবো না। রাসূল (সা)-এর চেহারায় ঔজ্জ্বল্য প্রতিভাত হলো। খুশীর সময় তাঁর চেহারা চাঁদের মত উজ্জ্বল দেখাতো। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার তওবা পূর্ণ করার নিয়তে সমস্ত সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেবো। কারণ ওগুলো আমার বিপদের মূল কারণ। তিনি বললে, এতে তুমি অভাবগ্রস্থ হয়ে যাবে। কিছু অংশ রেখে দাও। আমি বললাম, এতো উত্তম উপদেশ। খাইবারের যুদ্ধে আমি যা পেয়েছি তা নিজের জন্য রেখে দিলাম। সত্য আমাকে নাজাত দিয়েছে। এজন্য আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, কখনো সত্য ছাড়া মিথ্যে বলবো না। (দুররে মনসুর, তাফহীম, ইসলাম ও সামরিক জীবন) উপরোক্ত আলোচনা থেকে জানা গেলো, শুধুমাত্র একটি জিহাদে যোগাদান না করার কারণে কতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে হয়েছে। যদিও তার পেছনে মৃত্যুভয় ছিলো না, অলসতা কাজ করেছে মাত্র। আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার নিমিত্তে জিহাদ না করার পারিণতি কখনো কল্যাণকর হতে পারে না। আলোচ্য হাদীসে শুধুমাত্র দুনিয়ার একটি শান্তির কথা বলা হয়েছে। আখিরাতের শাস্তিতো রয়েই গেছে। হাদীসে পরোক্ষভাবে বলে দেয়া হয়েছে, এমতাবস্থায় যদি মুসলমানগণ মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে জিহাদে লিপ্ত হতে পারে তবে হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। সাথে পরকালের নাজাত।
শিক্ষাবলী
১. দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির একমাত্র রাস্তা হচ্ছে ‘জিহাদ ফী সাবিল্লিাহ্”।
২. আল্লাহ্ মুসলিমদের সম্মানিত করেছেন ঠিকই কিন্তু তারা মৃত্যুভয়ে জিহাদ পরিত্যাগের কারণে তাদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হচ্ছে।
৩. মুনাফিক গোষ্ঠী নামায পড়ে, রোযা রেখে এবং যাকাত আদায় করেও মুসলিম হতে পারেনি। শুধুমাত্র জিহাদ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কারণে।
৪. নেতা বা আমীরের কাছে মিথ্যে ওজুহাত পেশে করে তাদেরকে খুশী করা গেলেও আল্লাহর কাছে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
পৃষ্ঠা:৯৫
৫. আল্লাহ ও রাসূলের পথ থেকে দূরে সরে গেলেই অমুসলিমগণ তাদের উপর প্রাধান্য লাভের চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
৬. ভুল করলে তওবা করতে হবে এবং সেইসাথে কিছু আর্থিক কুরবানীও দেয়া উচিত।
৭. আল্লাহর বিধান লংঘনের শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জায়গায়ই পাবে।
৮. দিল (হৃদয়) খালি থাকে না, সেখানে সাহস না থাকলে ভয় এসে স্থান করে নেয়।
৯. আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা বা বিজয়ী রাখার প্রচেষ্টা (বা জিহাদ) ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের ক্ষতি ও ধ্বংস অনিবার্য।
পৃষ্ঠা:৯৬
ঈমানদারদের জন্য কঠিন সময়
এক
عن أبي هريرة (رض) قال قال رسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسلم بادِرُوا بِالأَعْمَالِ فِتَنا كَقَطْعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا وَيُمْسِي مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًايبيع دينه بعرض من الدُّنْيَا – (مسلم) —হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা নেক আমলের দিকে দ্রুত অগ্রসর হও ঘুটঘুটে অন্ধকার (ভয়াল) রাত্রি সদৃশ ফিতনায় নিমজ্জিত হওয়ার আগে। যখন কোন ব্যক্তি ভোরে ঈমানদার হিসেবে উঠবে কিন্তু সন্ধা অতিবাহিত করবে কুফুরী অবস্থায়। আবার মুমিন হিসেবে সন্ধ্যা অতিক্রম করলেও ভোরে উঠবে কাফির হিসেবে। সে পার্থিব সামান্য সম্পদের বিনিময়ে নিজের দ্বীন ও ঈমানকে বিক্রি করে দেবে। (সহীহ আল মুসলিম)
দুই
عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يتقارب الزمان ويقبض العلم وتظهرُ الْفِتَنُ وَ يُلْقَى الشح ويكثر الهرج – قالوا وما الهرج ؟ قَالَ الْقَتْلُ – (متفق عليه) হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সময় সংকীর্ণ হয়ে যাবে। ইলম তুলে নেয়া হবে। ফিত্না ফ্যাসাদ বৃদ্ধি পাবে। কৃপণতা প্রাধান্য পাবে এবং ‘হারজ’ অধিক মাত্রায় বেড়ে যাবে। লোকজন জিজ্ঞেস করলো- ‘হারজ’ কী? তিনি বললেন, হত্যা।-(সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ আল মুসলিম)
পৃষ্ঠা:৯৭
শব্দার্থ
এক
بادروا -পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হও, দ্রুত পূণ্য সঞ্চয় কর- بالأعمال আমল, কাজ, পরকালের পাথেয়। ফিতনা, বিপর্যয়, পরীক্ষা। كَقِطَع অংশের মতো। اَلليْلُ الْعَظْلِمُ অন্ধকার রাত। يُصبح -ভোরের সময় অতিবাহিত করা। يمسي সন্ধ্যা বেলা অতিবাহিত করা। يبيع সে বিক্রি করে। بينه তার স্বীন। بعرض من الدُّنْيَا নিয়ার সম্পদের বিনিময়ে।
দুই
يتقارب সংকীর্ণ হয়ে যাবে, নিকটে এসে যাবে। الزمان সময়, কাল। يُقبض العلم ইলম তুলে নেয়া হবে। ظهر -ফিতনা ফ্যাসাদ। يُلقى ঢেলে দেয়া হবে। পাবে। الهرج – হারজ। 201 – الْقَتْلُ হত্যা। প্রকাশ পাবে। الفئن কৃপণতা كُثر বৃদ্ধি
বর্ণনাকারীর পরিচয়
(দারসে হাদীস-২ এর ৯নং হাদীস, দারসে হাদীস ৩ এর ৭নং হাদীস দ্রষ্টব্য)
হাদীস দুটোর সমন্বয়
দুটো হাদীসেই ঈমানদেরদের জন্য এক কঠিন মুহূর্তের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। সে সময়টি হচ্ছে যখন ফিতনা ও কুফুরী প্রাধান্য বিস্তার করবে। প্রথম হাদীসে ঐ সময়কে অন্ধকার রাতের বিভিষিকার সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় হাদীসে ফিতনা ও কুফুরীর কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আলোচ্য হাদীস দুটো একটি আরেকটির সম্পূরক।
হাদীসদ্বয়ের গুরুত্ব
অন্ধকার রাতে যেমন সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তারচেয়েও বেশী কঠিন সমস্যার সৃষ্টি হয় রাস্তার বিপদাপদ এড়িয়ে পথ চলা।
পৃষ্ঠা:৯৮
কিন্তু রাস্তা যদি পরিচিত হয় এবং পথচলার জন্য আলোর ব্যবস্থা থাকে তবে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। আমরা সবাই অখিরাতের যাত্রী। পৃথিবী নামক পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি আখিরাতের দিকে। লক্ষ্যপানে পৌঁছতে গেলে অনেক বিপর্যয় ও পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। সেই বিপর্যয় ও পরীক্ষায় যেনো আমরা ব্যর্থ ও অকৃতকার্য হয়ে না যাই সেজন্য আলোচ্য হাদীসন্বয়ে কয়েকটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতর্ক করা হয়েছে। এ হাদীস দুটো তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বের দাবী রাখে, যারা পরকালকে বিশ্বাস করে এবং নিজেদেরকে ঈমানদার মনে করে।
ব্যাখ্যা
প্রথম হাদীসে এমন এক ভয়াবহ অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যা আক্ষরিক অর্থেই ফিতনা, অর্থাৎ পরিবেশ পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ অবস্থার দিকে ধাবিত হবে, যখন কুফুরীর সমস্ত উপায় উপকরণ সহজতর হয়ে নাগালের মধ্যে থাকবে। পক্ষান্তরে সৎকাজ করার মতো পরিবেশ পরিস্থিতির অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে মানুষের ঈমানের মান পূর্ণতায় পৌঁছবে না। তাই তারা ঈমান ও কুফুরের দোলায় দুদুল্যমান থাকবে। সকালে ঈমানের পক্ষে কোন কাজ করলে সে বিকেল এমন কাজে লিপ্ত হবে যা তাকে কুফুরীর স্তরে পৌঁছে দেবে। আবার বিকেলে ভালো কাজ করে ঘুমুতে যাবে কিন্তু সকালে কুফুরী কাজে জড়িত হয়ে উঠবে। হাদীসে উল্লেখিত সময় বর্তমানে শুরু হয়ে গেছে। যেমন একজন মুমিন মসজিদে নামায পড়ে বের হলো, তখনই তার সামনে দিয়ে লাস্যময়ী তন্বী তরুনীর দল অর্ধউলঙ্গ হয়ে ছন্দ তুলে অতিক্রম করলো। তখন ঐ নামাযীর মনের মাঠে শয়তান কল্পনার ঘোড়া দৌড়ায়। আবার একজন রোযাদার রোযা রেখে কোন এক জরুরী কাজ সম্পাদনের জন্য কোনো সরকারী অফিসে গেলো। কিন্তু সেখানে ঘুষ দেয়া ছাড়া তার কাজ করতে পারলোনা। একজন ঈমানদার তার ঈমান রক্ষা করে চলার অনুকুল কোন পরিবেশ নেই এরকম হাজারো উদাহরণ দেয়া পারে। দ্বিতীয় হাদীসে বলা হয়েছে হত্যা ও ফিতনা ফ্যাসাদ বেড়ে যাবে। কৃপণতা বেড়ে যাবার কথাও হাদীসে বলা হয়েছে। কৃপণতা মানুষকে লোভী করে তোলে এবং তার সুকুমার বৃত্তিগুলো নষ্ট করে দেয়। সে আত্মকেন্দ্রীক হয়ে যায়। তার দ্বারা দেশ ও জাতির কোন কল্যাণ হয় না। সত্যি কথা বলতে কি, কোন কৃপণ ব্যক্তির দ্বারাঁ
পৃষ্ঠা:৯৯
ইসলামের খেদমত হওয়া তো দূরর কথা তার মুসলমান থাকাটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ একজন প্রকৃত মুসলিমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে আল্লাহর পথে তথা ইসলামের জন্য যে কোন সময় যে কোন পরিমাণে মাল ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হয়। না। যখন কোন জাতি ধ্বংস অথবা পরাধীনতার যার প্রান্তে উপনীত হয় তখন তাদেরমধ্যে ঐক্য অবশিষ্ট থাকে না। পরস্পর ভালোবাসা ও সহমর্মিতা দূর হয়ে যায়। একে অপরকে তুচ্ছ করণে হত্যা করে। রাসূল আকরাম (সা) বলেছেন,وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لا تَذْهَبُ الدُّنْيَا حَتَّى يَأْتِي عَلَى النَّاسِ ييم لا يدرى الْقَاتِلُ وَلا الْمَقْتُولُ نِيمَ قُتِلَ فَقِيلَ كَيْفَ يَكُونُذَالِكَ قَالَ الْهَرْجُ الْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ فِي النَّارِ – —সেই মহান সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ। সে পর্যন্ত পৃথিবী নিঃশেষ হবে না, যে পর্যন্ত না মানুষের উপর এমন দিন আসবে হত্যাকারী বলতে পারবেনা, সে কেন হত্যা করেছে এবং নিহত ব্যক্তিও জানতে পারবেনা তাকে কেন হত্যা করা হয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো, তা কি করে সম্ভব? তিনি বললেন, ফিনার কারণে। হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামী।১ (মুসলিম) ইলম উঠিয়ে নেয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নবী করীম (সা) বলেছেন,إن الله لا يقبض العلم انتزاعًا يَنْتَزِعُه مِنَ الْعِبَادِ – ولكن يقبض العلم بموت العلماء حتى إذا لَمْ يَبْقَ عَالِمُ اتَّخَذَ النَّاسُ رُوسًا جَهَالَا فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عَلْمٍ فَضَلُّوا وَأَصَلُّوا আল্লাহ মানুষের অন্তর থেকে কখনো ইল্মকে ছিনিয়ে নেবেন না, কিন্তু আলিমগণের মৃত্যুতে ইলম উঠে যাবে। এমন কি যখন কোন আলিম জীবিত থাকবে না তখন মানুষ অজ্ঞ লোকদের নেতা মনোনীত করবে। তারা জিজ্ঞেসিত
পৃষ্ঠা:১০০
হয়ে না জেনে ফতোয়া দেবে, ফলে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে। (বুখারী, মুসলিম)আলোচ্য হাদীসে আরো বলা হয়েছে, মানুষ দুনিয়ার নগণ্য স্বার্থে দ্বীনকে বিকিয়ে দেবে। অর্থাৎ যে ধরনের কাজ করলে ইসলাম থেকে দূরে সরে যেতে হয় বা ইসলাম তার বিপরীত কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে কিন্তু তারা নশ্বর দুনিয়ার নগদ লাভের আশায় অখিরাতকে ভুলে যাবে এবং অবৈধ কাজে লিপ্ত হবে। মানুষ দুনিয়াদারীতে এমনভাবে লিপ্ত হয়ে যাবেন, প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেও তারা তৃপ্তি বা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারবে না। তাদের ভোগের লালসা ক্রমে বেড়েই যাবে। এমতাবস্থায় তারা মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড়াবে। তখন তাদের দীর্ঘ জীবনটাকে অত্যন্ত স্বল্প সময় মনে হবে।
শিক্ষাবলী
১. সর্বদা ঈমানের সাথে থাকার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
২. কৃপণতা এবং পার্থিব প্রলোভন ত্যাগ করতে হবে।
৩. পরিবেশ যত প্রতিকুলই হোক না কেন আল্লাহর পথে অনড় থেকে যাবতীয় ফিতনা ফ্যাসাদের মুকাবেলা করতে হবে।
পৃষ্ঠা ১০১ থেকে ১২০
পৃষ্ঠা:১০১
পূণ্য অর্জনের সহজ ফর্মূলা
عن أبي قلابة أَنَّ نَاسًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسلم قدمو يثنون على صاحب لهُمْ خَيْرًا – قَالُوا : مَا رَأَيْنَا مثل فلان هَذَا قَط مَا كَانَ فِي مَسِيرِ الأَكَانَ فِي قِراءة ولا نزلنا في منزل الأكانَ في صلاة – قَالَ : فَمَنْ كَانَ يَكْفِيهِ ضيعته حتى ذكر ومن كان يعلف جمله أو دابته – قَالُوا :نَحْنُ – قَالَ : فَكُلُّكُمْ خَيْرٌ مِّنْهُ – (ابو داؤد)হযরত আবু কিলাবা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা)-এর কয়েকজন সাহাবী একবার তাঁর কাছে এসে তাদের এক সঙ্গীর প্রশংসা করতে শুরু করেন। তাঁরা বললেন, আমরা আমাদের অমুক সাথীর মতো আর কাউকে দেখিনি। সফরকালে সর্বদা কুরআন তিলাওয়াত করেন এবং আমরা কোথাও অবস্থান করলে, রাহন দেখে অবতরণ করতে না করতেই তিনি নফল নামাযে দাঁড়িয়ে যান। নবী করীম (সা) বললেন, তাহলে তার মালপত্র রক্ষা করে কে এবং উটকে খাওয়ায় কে? তারা বললেন, আমরা সকলে তার মালপত্র রক্ষা করি, তার উটকে খেতে দেই। একথা শোনে তিনি বললেন, তাহলে তোমরা সবাই তার থেকে উত্তম। (আবু দাউদ, তারগীব ওয়াতারহীব, যাদেরাহ)
শব্দার্থ
أن نَاسًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ নবী করীম (সা)-এর সাহাবীদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি (সাহাবী)। قدموا তাঁরা এলেন, আগে আসলেন। يثنون তাঁরা প্রশংসা করলেন। على صاحب لهم خيرا – তাদের মধ্যে উত্তম এক
পৃষ্ঠা:১০২
সাথী। ما رأينا আমরা দেখিনি مثل فلان অমুকের মতো। ১- قطএরূপ কখনো। ماكان في ميسر- এমন কোন সফর ছিলো।। وَلَا نَزَلْنَا فِي مَنْزِل parum fertains area – كان في قراءة – আমরা এমন কোথাও যাত্রা বিরতি করতাম না। الأكان في صلاة যেখানে সে নামায না পড়তো। فمن তাহলে কে? كان يقفيه ضبعته তার মালসম্পদ রক্ষা করে। حَتّى ذكر যতোক্ষণ পর্যন্ত সে জিকির করে। من كانَ بَعْلِفُ جَمَلَهِ وَذَا بَتَهِ কে তার উট ও বাহন কে দেখা শুনা করে? তাঁরা বললেন। نحن আমরা (দেখাশুনা করি)। لَّكُمْ خيرতাহলে তোমাদের সবাই উত্তম। তার থেকে।
হাদীসটির গুরুত্ব
গোটা জীবন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা)-এর কথামতো পরিচালনা করার নাম ইবাদাত। গুরুত্বের দিক বিবেচনা করে সেই ইবাদাতকে কয়েকটি ভগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব, নফল, হারাম ইত্যাদি। যদি একই সাথে একাধিক কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজন দেখা দেয় তবে গুরুত্বের ক্রমানুসারে তা সম্পাদন করা উচিত। এমন যেনো না হয় অল্প গুরুত্বের একটি কাজ করতে গিয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ বাদ পড়ে যায়। তাছাড়া গুরুত্ব অনুসারে কাজ করলে তার ফলাফলও যথেষ্ট ভালো এবং আশারুরূপ হয় এবং আল্লাহ্ তা’আলার রহমত ও রকতের সাথে তা শেষ হয়। এ হাদীসটিতে ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্যাখ্যা
কুরআন তিলাওয়াত ও নফল নামায নিঃসন্দেহে প্রথম শ্রেনীর নফল ইবাদাত! কিন্তু নফল ইবাদাত যতো উন্নত ও বেশী হোক না কেন তা ফরযের তুলা হতে পারেনা। সফরে নিজের মালামাল হেফাজত করা এবং বাহনের যত্ন নেয়া
পৃষ্ঠা:১০৩
ওয়াজিব। তাছাড়া পশুপাখীর সাথে ভালো ব্যবহার করা ফরয। কাজেই দেখা যাচ্ছে একাজগুলো বাদ দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত ও নামায কোন ক্রমেই শ্রেষ্ঠ নয়। যদিও তা সর্বোত্তম নফল ইবাদাত। যে সমস্ত কাজ ইজতিমায়ী বা সকলের সাথে সংশ্লিষ্ঠ সে সমস্ত কাজ সম্মিলিত ভাবে করাটাও একটি উত্তম ইবাদাত। এ কাজগুলো যারা আনজাম দিয়েছে তারা কুরআন তিলাওয়াত ও নফল নামায আদায়কারীর চেয়েও বেশী পূণ্যের অধিকারী হয়েছে। এ শিক্ষার ফলে কোন সাহাবীই আর (পরবর্তীতে) এর ব্যতিক্রম করতেন না! হযরত আনাস (রা) বলেছেন-
كُنَّا إِذَا أَنْزَلْنَا مَنْزِلاً لا تُسبح حتى نحل الرحال – —-আমরা সফরে গিয়ে যখন কোনস্থানে অবস্থান করতাম, তখন বাহনের উপর থেকে মালামাল না নামিয়ে তাসবীহ তাইলীলও নামাযে লিপ্ত হতাম না। (আবু সাইস) উপরোক্ত আলোচনা হতে বুঝা গেলো, যে কোন ধরনের ইবাদাতই হোক, তা তার গুরুত্ব অনুযায়ী সম্পাদন করাই হচ্ছে পূণ্য অর্জনের সহজতর পথ। মন ও মানসকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। যদি সেভাবে আমাদের মন মানসকে গড়ে ভুলতে পারি তবে সৎলোক, ভালোলোক, বুজর্গ ব্যক্তি ইত্যাদি বিশেষণগুলো সত্যিকার অর্থে প্রয়োগ করতে পারবো অন্যথায় তার অপপ্রয়োগ ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে- এক ব্যক্তি বড়ো জুব্বা পড়েন, মুখে দাঁড়ি আছে, মাথায় টুপি পড়েন, পাগড়ী বেঁধে নামায পড়েন, ইশরাক আওয়াবীন চাশত্ সহ কোন নফল নামাযই বাদ দেননা। কিন্তু তার ফরয ও ওয়াজিব সম্পর্কে সুপষ্ট ধারণা নেই। আরেক ব্যক্তি সাধারণ পোশাক পড়েন (যেমন সার্ট, ছোট পা াবী ইত্যাদি), মুখে দাঁড়ি নেই, নিয়মিত মাথায় টুপি পরেন না, নামাযে পাগড়ী ব্যবহার করেননা, একমাত্র ফরয ওয়াজিব ছাড়া আর কোন ইবাদাতের প্রতি মনোযোগী নন। এ দু’ব্যক্তির মধ্যে কেউই পরিপূর্ণ আমলদার নয় তবু তুলনামূলকভাবে দ্বিতীয় ব্যক্তি উত্তম। সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি যে উভয় প্রকার আমলের সমন্বয় সাধন করে আমল করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা প্রথমোক্ত ব্যক্তিদেরকেই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সৎলোক, বুজুর্গ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করে থাকি। আবার অজ্ঞতার কারণে ইবাদতের মান ও ধরণ নির্ণয়ে আমরা ব্যর্থ হই। অন্য
পৃষ্ঠা:১০৪
কথায় বলা যায় আমরা ইবাদতের গুরুত্বের তুলনা করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি। যেমন অনেক লোক আছেন যারা তাহাজ্জুত নামায থেকে শুরু করে কোন নফল ইবাদাত বাদ দেন না কিন্তু নিজের স্ত্রী ছেলে মেয়ে নামায পড়ে না, পর্দা করে না, ইসলামের সীমার মধ্য থেকে জিন্দেগী যাপন করেনা, তার জন্য কোন পেরে শানী বা মাথাব্যথা নেই। একটি বার তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহর নিকট হাত তুলে দোয়া করার প্রয়োজনও অনুভব করেনা। অথচ তাদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করা ফরয। আবার দূর্ঘটনাক্রমে তাহাজ্জত, ইশরাক অথবা আওয়াবীন কিংবা অন্য কোন নফল ইবাদাত ছুটে গেলে আফসোস ও অনুতাপের শেষ থাকেনা। আবার সেই একই ব্যক্তি ভোট প্রদানের সময় একজন অসৎ বা দুশ্চরিত্রের পক্ষে ভোট দানে বিবেক তাকে বাধা দেয় না। অথচ অসৎ লোককে ভোট প্রদান হারাম। আবার কিছু লোককে পরকালে নাজাতের জন্য নফল ইবাদাতের উপর যতোটুকু জোর দিতে দেখা যায়, বাতিলকে উৎখাত করে আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েমের বেলায় ততোটুকু জোর দিতে দেখা যায় না। অথচ আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েমের চেষ্টা করা ফরযে আইন। সমস্ত নবী রাসুলদের আল্লাহ্ এ দায়িত্ব দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। একজন মদখোর সে মদকে ঘৃণা করে না কিন্তু তাকে যদি জোর করে প্রস্রাব অথবা পায়খানা খাওয়ানো হয় তবে সে ঘৃণায় সাথে সাথে বমি করে দেবে। অথচ মদ ও প্রস্রাব পায়খানা ইসলামের দৃষ্টিতে একই রকম হারাম। এরকম আরো হাজারো ক্ষেত্র আছে যেখানে আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হই। এর মূল কারণ হচ্ছে জ্ঞানের বা জানার অভাব। ইসলামকে পরিপূর্ণ ও সঠিকভাবে না জানার পরিণতি। যেমন পরকালের মুক্তির আশায় এমন কিছু কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা, যার বিনিময়ে আল্লাহ্ মুক্তির আশ্বাস দেননি। পক্ষান্তরে যে সমস্ত কাজ বা আমলের বিনিময়ে পরকালের মুক্তি নিশ্চিত, সেগুলো সম্পর্কে উদাসীন থাকা। আলোচ্য হাদীসে সেই মূলনীতিই বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে মানুষ মান ও গুরুত্ব বুঝে ইবাদাতে মত্ত হতে পারে এবং সহজে ও অল্প পরিশ্রমে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারে। তাই বলে ইসলামে নফল ও মুস্তাহাব আমলেরও গুরুত্ব কম নয়। কারণ তা হচ্ছে পরকালিন মুক্তির জন্য সহায়ক জিনিস। একথা অন্য হাদীসেও বলা হয়েছে, সেদিন ফরয আমলের ঘার্তি দেখা দিলে নফল দিয়ে তা পূরণ করা হবে। তবে ফরযকে কম গুরুত্ব দিয়ে অথবা
পৃষ্ঠা:১০৫
নফলকে ফরযতুল্য গুরুত্ব দিয়ে পালন করা ঠিক নয়। একদিন রাসূল (সা) জয়নাব (রা) এর ঘরে একটি রশি টানানো দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এখানে রশি কেন? কোন এক বেগম উত্তর দিলেন, রাতে জয়নাব নামায পড়েন। যখন নামায পড়তে পড়তে ঘুম আসতে চায় তখন তিনি রশি ধরে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করেন।” একথা শুনে তিনি এতো কষ্ট করে নফল নামায আদায়ে নিরুৎসাহিত করলেন।ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। কাজেই প্রতিটি কাজে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই ইসলামের আদর্শ।আলোচ্য হাদীস হতে আরেকটি বিষয় স্পষ্টভাবে জানা যায়, তা হচ্ছে নফল ইবাদাতের চেয়েও খিদমতে খালক’ বা সৃষ্টির সেবা করা উত্তম। কেননা রাসূল (সা) তাদেরকে উত্তম বলেছেন, যারা নামাযরত ব্যক্তির মাল সামানা ও বাহন হিফাজত করেছেন।
পৃষ্ঠা:১০৬
যাকে হিদায়াত দেয়া হয় ইসলামের জন্য তার অন্তর খুলে যায়
عَنْ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ تَالاً رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَمَن يرد الله أن يهديه يشرح صدره للإسلام — فَقَالَ رَسُولُ الله صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ النُّورَ إِذَا دَخَلَ الصُّدْرَ انْفَسَحَ فقيل يا رسول الله هل لتلك من علم يُعْرَفُ بِهِ قَالَ نَعَمُ النَّجَا في من دار الغُرُورِ والأنابة إلى دار الخلود والاستعداد للموتقَبْلَ نُزُوله – —-হযরত আবদুল্লাহ মাসউদ (রা) বর্ণনা করেছেন, (একবার) রাসূলুল্লাহ্ (সা) তিলাওয়াত করলেন-فَمَنْ يُرِدِ اللهُ أَنْ يَهْدِ به يشرح صدره للإسلام –(আল্লাহ যাকে হিদায়াত দিতে চান, তার বুক ইসলামের জন্য খুলে দেন।) তারপর বললেন, নূর অন্তরে প্রবেশ করলে তা প্রশস্ত হয়ে যায়। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! তার কি কোন আলামত আছে, যা দিয়ে তার পরিচয় লাভ করা যায়? তিনি বললেন, হাঁ, অস্থায়ী দুনিয়ার মোহাচ্ছন্ন গৃহের প্রতি বিমূখতা ও আখিরাতের চিরস্থায়ী গৃহের প্রতি আসক্তি এবং মৃতুর পূর্বেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। (বাইহাকী ও শুআবুল ঈমান)
শব্দার্থ
১- তিলাওয়াত করলেন। নিশ্চয়ই। أنور – নূর, আলোক, আধ্যাত্মিক শক্তি। (১- যখন। دخل – প্রবেশ করে। الصدر বুক : انفسح তা প্রাপ্ত
পৃষ্ঠা:১০৭
হয়ে যায়। فقيل অতঃপর বলা হলো। هل لتلك من علم তার কি কোন আলামত আছে? يعرف به – যার দ্বারা চেনা যায়। ট্র- তিনি বললেন। تجافي الله نعم | – বিমুখতা, উদাসীনতা। থেকে در الغرور ধোঁকা বা মোহের গৃহ (অর্থাৎ দুনিয়া)। – আসক্তি, মোহدار الخلود চিরস্থায়ী ঘর (অর্থাৎ জান্নাত)। الأستعداد প্রস্তুতি গ্রহণ করা। للموت قبل نزوله – মৃত্যু আসার পূর্বে।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
নাম আবদুল্লাহ্। পিতার নাম মাসউদ। মায়ের নাম উন্মু আব্দ। কৈশোরে তিনি উকবা ইবনে আবু মইতের ছাগল ও মেষ চড়াতেন। একদিন ছাগল চড়ানোর সময় দেখতে পেলেন সাম্য সুন্দর চেহারার দু’জন লোক তাঁর দিকে এগিয়ে, আসছে, চেহারায় আত্মমর্যাদার ছাপ। তারা কাছে এসে সালাম দিয়ে বললেন, বৎস। এ ছাগলগুলো থেকে আমাদের একটু দুধ দুইয়ে দাও। আমরা পিপাসানিবারণ করি। তিনি বললেন, আমি তা পারবো না। কারণ ছাগলগুলো আমা নয়। আমি এগুলোর রাখাল ও আমানতদার মাত্র। লোক দু’জন কথা শোনে অসন্তুষ্ট না হয়ে বরং খুশী হয়ে বললেন, ঠিক আছে বাপু। আমাদের এমন একটি ছাগী দেখিয়ে দাও, যা এখনো বাচ্চা দেয়নি। তিনি একটি ছাগীর দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিলেন। তখন প্রথম লোকটি গিয়ে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে ওলান মলতে লাগলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তা দুধে ভরে উঠলো। তা দোহন করে তাঁরা পান করলেন এবং কিশোর আবদুল্লাহকেও পান করালেন। অতঃপর বললেন, চুপসে যাও। অমনি তা পূর্বরূপ ধারণ করলো। এ ঘটনার ব্যক্তিদ্বয় হচ্ছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও হযরত আবু বকর (রা)। এর কিছুদিন পরই তিনি নবী করীম (সা) এর নিকট গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর খিদমতে নিয়োজিত থাকেন। তিনি হুজুরে পাক (সা) কে সর্বদা ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। আবু মুসা আশয়ারী (রা) বলেন, ‘আমরা ইয়েমেন থেকে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসউদকে নবী পরিবারের লোক বলে মনে করতাম।’ তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলিম। কুরআন, হাদীস, ফিকহ ইত্যাদি সকল বিষয়-ই সমান পারদর্শী ছিলেন। মদীনায় যে কজন সাহাবী ফতোয়া দিতেন
পৃষ্ঠা:১০৮
তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কুরআন শিক্ষায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। নবী করীম (সা) বলেছেন, ‘কুরআন শরীফ যেভাবে নাযিল হয়েছে হুবুহু সেভাবে যদি কেউ পড়তে চায় সে যেনো আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের নিকট যায়।’ জ্ঞানের এ বিশাল মহীরুহ হিজরী ৩২/৩৩ সনে ৮/৯ ই রমযান মদীনায় ইন্তিকাল করেন। হযরত উসমান (রা) তাঁর নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। এবং তাঁর অন্তিম ওসীয়ত অনুসারে জান্নাতুল বাকীতে উসমান ইবনে মাজউন (রা) এর কবরের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৮৪৮ টি। বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্যের হাদীস ৬৪টি। তাছাড়া এককভাবে বুখারীতে ১২৫ টি এবং মুসলিমে ৩৫টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হাদীসটির গুরুত্ব
দ্বীনের সঠিক জ্ঞান সকল কল্যাণের উৎস। যে ব্যক্তি এ অমূল্য সম্পদ লাভ করবে সে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনেই কল্যাণ লাভ করবে। কারণ সে এ জ্ঞানের দ্বারা যেমন নিজে উপকৃত হবে, নিজের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলবে তেমনিভাবে আল্লাহর বান্দাদের জীবনও সুন্দর করে গড়ে তুলার চেষ্টা করবে। তবে শর্ত হচ্ছে আল্লাহ্ অপাত্রে কিছু দান করেন না। পৃথিবীতে আল্লাহ যতো প্রকার নিয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছে দীনি জ্ঞান বা ইল্ল্ম। কাজেই এ মহামূল্যবান বন্ধু সুপাত্র ছাড়া আল্লাহ্ রাখেন না। আর যাকে আল্লাহ্ সুপাত্র হিসেবে বাছাই করে নেন তার চেয়ে কোন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি নেই। আলোচ্য হাদীসটিতে এ কথাগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। বস্তুত প্রতিটি মুমিনের জন্যই হাদীসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাখ্যা
বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত মুয়াবিয়া (রা) কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন-من يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقَهُهُ فِي الدِّينِ – “আল্লাহ্ যার বিশেষ কল্যাণ চান তাকে তিনি দ্বীনের সঠিক জ্ঞন বা ইলম দান করেন।”
পৃষ্ঠা:১০৯
আল কুরআনে বলা হয়েছে ইসলামের জন্য তার অন্তর খুলে দেয়া হয়, হাদীসদ্বয়ে বলা হয়েছে দ্বীন বা নূরের জন্য বুককে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এ তিনটি শব্দে প্রকৃতপক্ষে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। কারণ ইসলাম অনুশীলনের পদ্ধতিকে দ্বীন বলা হয়েছে এবং ইসলামকে নূর বা আলো বলা হয়েছে।’আল্লাহ যাকে চান তার বুক ইসলামের জন্য খুলে দেন। একথার তাৎপর্য এই নয় যে, আল্লাহ্ না চাইলে কেউ হিদায়েত পাবে না। আর যদি কেউ হিদায়েত না পায় তবে তার জন্য তাকে দায়ী করাও যাবে না। বরং একথার তাৎপর্য হচ্ছে বান্দা শুধু চেষ্টা করবে এবং তার সে প্রচেষ্টা পূর্ণতার দ্বারে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহ্ত্র। কাজেই যদি কেউ হিদায়েতের পথে চলতে ইচ্ছুক না হয় তবে তাকে জোর করে হিদায়াত করা আল্লাহ্র দায়িত্ব নয়। তাকে সে পথে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়াই আল্লাহর বিধান। তেমনিভাবে যারা হিদায়েতের পথে চলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদেরকে জোর করে বিপথগামী করাও আল্লাহ্র কাজ নয়। বরং তাদেরকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলার জন্য সুযোগ প্রদান করা আল্লাহর একটি বিধান। কারণ যদি কোন ব্যক্তির প্রচেষ্টা ও লক্ষ্য হতে তাকে জোর করে ফিরিয়ে দেয়া হয় তবে তাকে তার স্বাধীনতার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে না। যেহেতু আল্লাহ্ পৃথিবীতে মানুষকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্বাধীনতা দিয়েছেন তাই তিনি তাদের সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না। যেমন কোন শিক্ষক পরীক্ষায় ভুল উত্তর দিচ্ছে এমন কোন ছাত্র-ছাত্রীকেও বাধা দেন না। কারণ একটিই, যদি তাকে বাধাই দেয়া হয় তবে তার পরীক্ষা গ্রহণ অর্থহীন হয়ে যায়। হাদীসের দ্বিতীয় অংশে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বলে দেয়া হয়েছে। কোন ব্যক্তি ইসলামের উপর কিংবা হিদায়েতের উপর আছে কি-না তা যাচাইয়ের জন্য এ তিনটি পয়েন্টই যথেষ্ট। ১। নম্বর পৃথিবীর প্রতি বিমুখতা, অর্থাৎ দুনিয়ার কোন ভোগ বিলাস বা আরাম আয়েশের স্রোতে সে ভেসে যাবে না। যতোটুকু তার দুনিয়ার জীবনে চলার জন্য এবং আখিরাতের সফলতার জন্য প্রয়োজন শুধুমাত্র ততোটুকুই সে অর্জনের চেষ্টা করবে।الأسلام نُورٌ وَالْكُفْرُو ظلمة –
২। তার একমাত্র লক্ষ্য হবে আখিরাতের চিরন্তন সুখ শান্তি, অর্থাৎ আখিরাতে সফলতা লাভের জন্য যত উপায় উপকরণ পৃথিবীতে আছে সেগুলোকে সে
পৃষ্ঠা:১১০
পুরোপুরি কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে। আখিরাতের কল্যাণ ছাড়া সব কিছুই তার কাছে অর্থহীন মনে হবে। আখিরাতের মহব্বত ও তার সফলতার চিন্তা প্রতিমূহূর্তে ঐ ব্যক্তির মন মগজ আচ্ছন্ন করে রাখবে।
৩। মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবে, অর্থাৎ যেহেতু দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে একমাত্র মৃত্যুই বাধা সেহেতু সেই বাধাকে অতিক্রম করে আখিরাতে প্রবেশ করার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত উন্মুখ হয়ে বসে থাকবে। তাছাড়া মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত করা আমলই যখন পরকালের একমাত্র পাথেয় তাই সে মৃত্যু আসার পূর্বেই সেই পথেয় সংগ্রহে মশগুল হয়ে যাবে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের অর্থ হচ্ছে-
ক. অন্যায় অপরাধ থেকে দূরে থাকা।
খ. আল্লাহর সীমা লংঘন না করা।
গ. সর্বাবস্থায় আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা। এবং
ঘ. নিজের ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য বেশী বেশী তওবা ও ইস্তিগফার করা।
শিক্ষাবলী
১. দ্বীনের সঠিক জ্ঞান সকল কল্যাণের উৎস। ২. পৃথিবীতে আল্লাহর যতো নিয়ামত আছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছে হিদায়াত বা দ্বীনি ইল্ম লাত করা। ৩. ঈমান বা ইসলামের পথে আছে কিনা তা পরিমাপ করার মাপকাঠি তিনটি। যথা-
(ক) নশ্বর পৃথিবীর মোহ ত্যাগ করা। (খ) আখিরাতের চিরন্তন সুখ শান্তি লাভের ব্যকুলতা। এবং (গ) মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা।
পৃষ্ঠা:১১১
রাসূল (সা)-এর নিকট প্রিয়তম ব্যক্তি
عن أبي ثعلبة رضى اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وسلم – قال : إِن أَحَبُّكُمْ إلى وأقربكُم منى يوم القيامة أَحَاسِنُكُمْ أَخْلَاقًا وَإِنْ أبغضكُم إلى وابعدكُمْ مِنِّى مَساونَكُمْأخلاق الثرثارُونَ الْمُتَشدِّقُونَ الْمُتَفَيهقون –আবু সালাবা (রা) থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি আমার কাছে বেশী প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন আমার কাছাকাছি থাকবে যে চরিত্রবান। আর তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আমার কাছে অপ্রিয় ও আমার থেকে অনেক দূরে, যে অসচ্চরিত্র, বাচাল, বিদ্রূপকারী এবং অহংকারী। -(বাইহাকী)
শব্দার্থ
ان- নিশ্চয়ই। أحبكم – তোমাদের মধ্যে বেশী প্রিয়। لٰی। – আমারর নিকট।أفريكم- তোমাদের মধ্যে অধিকতর নিকটবর্তী। আমার থেকে।يوم القيامة কিয়ামতের দিন। أحاسكُمْ তোমাদের মধ্যে উত্তম। أخلاقًا – চরিত্রবান। أبفضكُمْ তোমাদের মধ্যে অপ্রিয়। أبعدكم الثرثارون profit – مساونكم أخلاقا | 28 Coraline fe বাচাল | المتشدقون বিদ্রূপকারী। المتفيهقون- অহংকারী।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
হযরত আবু হুরাইরা (রা)-র মতো হযরত আবু সা’লাবা আসল নামের চেয়ে কুনিয়াত নামেই অত্যাধিক পরিচিত। তাঁর প্রকৃত নামের ব্যাপারে মতানৈক্য । আছে। ঐতিহাসিকগণ তাঁর নাম যারছুম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হুদাইবিয়ার সন্ধিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি
পৃষ্ঠা:১১২
কোন জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন কিনা সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া। যায়না। তবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে খায়বর বিজয়ের গনিমতের মাল প্রদান করেছিলেন। এ থেকে বুঝা যায় তিনি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর নবী করীম (সা) তাঁকে নিজ গোত্রে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জীবদ্দশায়ই তাঁর গোত্র ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেন। তিনি অত্যন্ত মুখলেস এবং আবিদ ছিলেন। একদিন গভীর রাতে তিনি নামায আদায়ে মগ্ন ছিলেন। এমন সময় তাঁর পুত্র স্বপ্নে দেখেন, তাঁর পিতা ইন্তিকাল করেছেন। তিনি ঘুম থেকে ধড়পড়িয়ে উঠে পিতাকে ডাক দিলেন। প্রথম ডাকে সাড়া পাওয়া গেলো কিন্তু পরবর্তী ডাকে আর সাড়া পাওয়া গেলোনা। তখন তাঁর কাছে গিয়ে দেখা গেলো তিনি সিজদাবনত অবস্থায় মহান বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। তাঁর থেকে সর্বমোট ৪০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ৩টি ইমাম বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন এবং ১টি হাদীস ইমাম মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটির গুরুত্ব
আল্লাহর রাসূল (সা) ছিলেন পরিপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী, সদাচারী ও সৎলোক। তাই তিনি চরিত্রবান ও সৎলোককেই ভালোবেসেছেন। আর তার চেয়ে বেশী সৌভাগ্য আর কার হতে পারে যাকে স্বয়ং রাসূল (সা) পছন্দ করেন এবং ভালোবাসেন? পক্ষান্তরে তার চেয়ে আর কে বেশী হতভাগ্য, যাকে রাসূল (সা) ঘৃণা করেন এবং অপছন্দ করেন? আল্লাহ এবং রাসূলের কৃপাদৃষ্টি লাভে যারা ব্যর্থ তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। কেননা আল্লাহ্র কৃপা এবং রাসূল (সা) এর সুপারিশ ছাড়া কিয়ামতে মা’ফ পাওয়ার আর কোন রাস্তা আছে কি? না, নেই। তাই যে সমস্ত কাজ করলে আল্লাহ্ এবং রাসূল (সা) খুশী হন এবং আল্লাহ ও রাসূলের (সা) স্নেহভাজন হওয়া যায়। ঠিক সেই কাজ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু তাই নয়, যে গুনটি রাসূল (সা) অর্জন করতে বলেছেন, যদি কেউ তা অর্জন করে তবে সে দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের কাছেও সম্মানের অধিকারী হবে এবং ফেরেশতাদের কাছেও সে সম্মানিত বলে গণ্য হবে। অন্য এক হাদীসে আছে- ‘মহান আল্লাহ্ জিব্রাঈলকে ডেকে বলেন, অমুক বান্দা আমাকে ভালোবাসে এবং
পৃষ্ঠা:১১৩
আমিও তাকে ভালোবাসি তাই আসমানবাসীকে জানিয়ে দাও তারাও যেন তাকে ভালোবাসে।’বস্তুত এ হাদীসটি ঐ সমস্ত লোকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সা) ভালোবাসা অর্জনের জন্য সর্বদা ব্যকুল থাকেন।
ব্যাখ্যা
একজন ঈমানদারকে আল্লাহ্ যে সমস্ত নিয়ামত দিয়ে থাকেন তারমধ্যে অন্যতম নিয়ামত হচ্ছে উত্তম চরিত্র। কেননা ঈমানের মান তখনই পূর্ণতায় পৌঁছে যখন সে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়। রাসূল (সা) বলেছেন-أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيْمَانًا أَحْسَنَهُمْ خَلْقًا –মুমিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী সেই ব্যক্তি যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী। (আবু দাউদ, দারিমী) অর্থাৎ ঈমান ও সচ্চরিত্র (আখলাক) একটি অপরটির পরিপূরক। আখলাক বা সচ্চরিত্র ছাড়া যেমন ঈমানের পূর্ণতা আসেনা তদ্রুপ ঈমান ছাড়া চরিত্রবান হওয়াও সম্ভব নয়।একবার সাহাবা কিরাম (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন-يَا رَسُولُ اللهِ مَا خَيْرُ مَا أَعْطَى الأَنْسَانُ ؟ قَالَ: الْخَلْقُ الْحَسَنُ –হে আল্লাহর রাসূল। মানুষকে যা দান করা হয়েছে তার মধ্যে উত্তম কিং রাসূল (সা) বললেন, সচ্চরিত্র। (বাইহাকী, শরহে সুন্নাহ) আর এ উত্তম বস্তুটিকে পূর্ণতা দানের জন্যই রাসুল (সা)-এর আগমন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন-بعثت لاتمم حسن الأخلاق –চরিত্রের সৌন্দর্যকে নিখুঁত ও পরিপূর্ণ করার জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে। (মুরারা) আল্লাহ্র রাসূল (সা)-এর উত্তম চরিত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা) বর্ণনা করেছেন- ‘আল্লাহর রাসূল (সা) কখনো কোন খাদিমকে প্রহার করেননি, কোন স্ত্রীলোকের
পৃষ্ঠা:১১৪
উপর হাত উঠাননি, জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ ছাড়া তিনি নিজের হাত দিয়ে কাউকে মারেননি। আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘন করা হলে আল্লাহর ওয়াস্তে তার শান্তি প্রদান করা ছাড়া তিনি কখনো কোন নির্যাতনের প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। দুটো কাজের মধ্যে একটি বাছাই করার অধিকার দেয়া হলে তিনি সহজটি বেছে নিতেন। গুনাহর কাজ তার ব্যাতিক্রম ছিলো। তিনি তা থেকে অনেক দূরে থাকতেন।’ (মুসলিম, আহামদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা) কাজেই দেখা যাচ্ছে, যে দায়িত্ব দিয়ে রাসূল (সা)-কে পাঠানো হয়েছে সেই দায়িত্ব যদি কেউ পুরোপুরি পালন করে তবে তাকে ছাড়া আর কাকে আল্লাহর রাসূল (সা) ভালোবাসবেন? একমাত্র তিনিই হতে পারেন রাসূল (সা)-এর প্রিয়তম। পক্ষান্তরে অসচ্চরিত্র, বদমেজাজী, বাচাল ও অহংকারী ব্যক্তি ইসলামের শ্বাশ্বত শিক্ষাকে উপেক্ষা করে ইসলাম থেকে অনেক দূরে চলে যায়। আর যে ব্যক্তি ইসলাম ও ঈমান থেকে দুরে অবস্থান করে সে অবশ্যই আল্লাহ ও রাসূল থেকে দূরে। আল্লাহ ও রাসূল থেকে দূরে অবস্থান করে এবং রাসূলে (সা) অপ্রিয় হয়ে কোন ব্যক্তিই পরিত্রাণের আশা করতে পারেনা। হয় সচ্চরিত্রবান হবার চেষ্টা করতে হবে, না হয় আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রিয়ভাজন হয়ে জান্নাতে যাবার আশা ত্যাগ করতে হবে। এছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই।
শিক্ষাবলী
১. আখলাক বা সচ্চরিত্র ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই উত্তম চরিত্রের অধিকারী না হলে পূর্ণ মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। ২. উত্তম চরিত্র হচ্ছে আল্লাহ্ প্রদত্ত একটি অতি উত্তম নিয়ামত। আর এ নিয়ামত আল্লাহ্ অপাত্রে দান করেন না। ৩. উত্তম চরিত্র বলতে কি বুঝায় তার সংজ্ঞা, ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে নবী করীম (সা) বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন এবং নিজের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন। ৪. আল্লাহ ও রাসূল (সা) এর সন্তুষ্টি অর্জন করার পূর্বশর্ত হচ্ছে সচ্চরিত্রবান হওয়া।
পৃষ্ঠা:১১৫
মুসলিম উম্মাহ্র প্রথম কল্যাণ ও বিপর্যয়
عن عمرو بن شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدهُ أَنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أول صلاح هذه الأُمَّةِ الْيَقِينُ وَالزَّهْدُ وَأَوَّلفسادها الْبَخْلُ والأمل –আ’মর বিন শু’আইব (রা) তাঁর পিতা এবং তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা) বলেছেন, এ উম্মতের প্রথম কল্যাণ হচ্ছে ইয়াকীন ও যুহুদ এবং তাদের প্রথম বিপর্যয় হচ্ছে কৃপণতা ও আশা আকাংখা। (বাইহাকীঃ পৃ’আবুল ঈমান)।
শব্দার্থ
عن হতে। أبيه -তার পিতা। جده أول প্রথম। صلاح কল্যাণ। তাঁর। তাঁর দাদা। তিনি বলেছেন। – اليقين 136761 – هذه الأمة প্রত্যয়, ইয়াকীন। لزهد। যুহুদ, দুনিয়ার প্রতি মোহমুক্ত। فساده – -তার বিপর্যয়, তার ফাসাদ। البحلُ – কৃপণতالأمل ا কামনা-বাসনা। আশা-আকাংখা,
হাদীসটির গুরুত্ব
আলোচ্য হাদীসটিতে সমস্ত কল্যাণের (ইহকালীন এবং পরকালীন) মূল বা ভিত্তি বলা হয়েছে দুটো জিনিসকে। এ দু’টো জিনিস ছাড়া দুনিয়ায় যদিওবা কোন উন্নতি করা সম্ভব হয় তবে আখিরাতের কোন কল্যাণ লাভ করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। বিষয় দু’টো এমন যা একটির সাথে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্য কথায় বলা যায় সমস্ত কল্যাণের চাবিকাঠি হচ্ছে এ দু’টো বন্ধু। এ দু’টো ছাড়া কল্যাণ নামক প্রাসাদের দ্বারই খোলা সম্ভব নয়। আবার মানুষের বিপর্যয়
পৃষ্ঠা:১১৬
সৃষ্টির মূলেও দু’টো বন্ধু ক্রিয়াশীল তা হচ্ছে কৃপণতা ও আকাংখা। এ দু’টো বন্ধু সমস্ত বিপর্যয়ের মূল ফটক। এ ফটক দিয়েই বাধভাঙ্গা প্লাবনের ন্যায় বিপর্যয় নেমে আসে। তাই প্রতিটি ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার সে কিসের দরজা খুলে দেবে কল্যাণের না বিপর্যয়ের? এই দৃষ্টিকোণ থেকে এ হাদীসটির গুরুত্ব কোন ব্যক্তিই অস্বীকার করতে পারেনা।
ব্যাখ্যা
মূল হাদীসে পরস্পর বিরোধী মোট ৪টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। আর চারটে বিষয়ই ব্যাখ্যার দাবী রাখে তাই চারটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা হচ্ছে। ক. ইয়াকীনঃ يقين )ইয়াকীন) শব্দের অর্থ হচ্ছে দৃঢ়প্রত্যয়। ایمان – )ঈমান( বা বিশ্বাসের গাঢ়তম পর্যায়কে ইয়াকীন বলা হয়। নবী করীম (সা) অনেক দু’আর মধ্যে ইয়াকীন শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন- اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَلْكَ إِيمَانًا دائما يباشر قلبي ويقينا صادقا حتَّى أَعْلَمُ إِنَّهُ لا يُصيبني الا ما كتبت لي – “যে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি (এমন) ঈমানের জন্য যা সর্বদা আমার অন্তরকে প্রফল্পতা দান করে। এবং এমন সত্য ইয়াকীন দান করো যাতে আমি বুঝতে পারি তুমি আমার ভাগ্যলিপিতে যা লিখেছে তাছাড়া কোন কিছু আমার উপর আরোপিত হবে না। ঈমানের (বিশ্বাস) চেয়ে ইয়াকীনের (দৃঢ় প্রত্যয়ের) শিকড় আরো অনেক গভীরে। হাল্কা ঝাঁকুনিতে ঈমান নড়বড়ে হতে পারে কিন্তু প্রবল ঘূর্ণিবায়ুতেও ইয়াকীনের মূলৎপাটন সম্ভব নয়। কুফরকে যদি পানি কল্পনা করা হয় এবং ঈমান ও ইয়াকীনকে যথাক্রমে দুধ ও মাখন মনে করা হয়। তবে পার্থকটা বুঝা সহজ হবে। দুধ সর্বদা পানির সাথে মিশে যায়, বিশেষ প্রক্রিয়া ছাড়া তা আলাদা করা যায় না। কিন্তু সেই দুধ থেকে যখন মাখন বের করা হয় তখন তা কোন ভাবেই পানির সাথে মেশানো যায় না। যেমনিভাবে দুধ থেকে মাখন বের করা হয় ঠিক তেমনিভাবে ঈমান বা বিশ্বাসের ভেতর থেকে ইয়াকীনকে পৃথক করতে হবে। তবেই কৃষ্ণর থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হতে পারে। অন্যথায় ঈমান যে কোন
পৃষ্ঠা:১১৭
মুহুর্তে কুফরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে। যদি ঈমান ইয়াকীনে রূপ না নেয় তবে তা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে। একজন তীরন্দাজ তার দলের লোকদের মাথায় টুপি রেখে দূর থেকে তীর নিক্ষেপ করে তাদের টুপিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনা কোন হাটে বা শহরে প্রদর্শন করা হচ্ছে। বহুলোক এ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এবার তীরন্দাজ দর্শকদের মধ্য থেকে একজনকে এসে রেঞ্জের মধ্যে টুপি পরে দাঁড়াতে বললেন। অভয় দিলেন, একমাত্র টুপী ছাড়া তীর তার একটি চুলও স্পর্শ করবে না। কিন্তু কোন দর্শকই তার আহ্বানে সাড়া দিলো না। এর কারণ কি? তীরন্দাজ এ কাজ পারবেনা, তারা কি তাই মনে করেছে? তাদের বিশ্বাস জন্মেছিলো, তীরন্দাজের দ্বারা একাজ করা সম্ভব। তবু তাদের বিশ্বাসের গহনে এ আশংকা লুকিয়ে ছিলো, যদি দূর্ঘটনা ঘটে যায়, তীর যদি সামান্য একটু নিচ দিয়ে গিয়ে মাথায় আঘাত করে? এরূপ ধারণা থেকে প্রতীয়মান হয়, আসলে তীরন্দাজের উপর তাদের বিশ্বাস ছিলো কিন্তু ইয়াকীন ছিলো না। হাদীসে বর্ণিত ইয়াকীন বলতে আল্লাহ্, ফেরেশতা, জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর, পুলসিরাত, তাকদীর, আল্লাহর ক্ষমতা, সমস্ত সৃষ্টির অক্ষমতা বা মুখাপেক্ষীতা ইত্যাদি বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা বুঝানো হয়েছে। এ সমস্ত বস্তুর উপর দৃঢ় প্রত্যয়ই হচ্ছে ইসলামের ভিত্তি সমূহের মধ্যে প্রধান ভিত্তি। খ. যুহুদ যুহুদ বলতে বুঝায় দুনিয়ার প্রতি নির্লিপ্ততা, দুনিয়ার মোহ মুক্তি। ইয়াকীনের বলিষ্ঠতার কারণে ঈমানদারদের মধ্যে যুহুদ সৃষ্টি হয়। অন্যকথায় ইয়াকীন ছাড়া যুহুদ সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ একজন যাহেদ দুনিয়ার জীবন ও প্রাচুর্যকে অস্থায়ী মনে করেন। এটা শুধু আখিরাতের উপর ইয়াকীনের কারণে। আখিরাতের চিত্র মনের মুকুরে প্রতিফলিত থাকার কারণেই সেই কল্যাণ লাভের জন্য দুনিয়ার সর্বোচ্চ ত্যাগ ও কুরবানীকে তারা কষ্ট মনে করেন না। তাই দেখা যাচ্ছে ঈমান ইয়াকীনের সাথে, ইয়াকীন যুহুদের সাথে এবং যুহুদ কল্যাণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর মধ্যে কোনটিকে পৃথক করে দেখার অবকাশ নেই। গ. কৃপণতাঃ কৃপণ সর্বদা আত্মকেন্দ্রিক হয়। ধন-দৌলত কুক্ষিগত করা ছাড়া তার জীবনে অন্য কোন লক্ষ্য নেই। দেশ, জাতি বা সমাজের জন্য তার কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। সমাজ কল্যাণ মূলক কোন কাজ করতে সে রাজী নয়।
পৃষ্ঠা:১১৮
এমনকি যে কাজে তার ধন-দৌলত উপার্জনে বিঘ্ন ঘটে তাই তার কাছে অপছন্দনীয়। সে সম্পদ অর্জনের জন্য যে কোন ধরনের ঘৃণ্য তৎপরতা অবলম্বন করতে দ্বিধা করেনা। এজন্য কৃপণ ব্যক্তিদের অনেক সময় বড়ো ধরনের খেসারত দিতে হয়। তারা দুনিয়ার মানুষের কাছে যেমন ঘৃণার পাত্র তদ্রুপ আল্লাহ্ ও রাসূলের নিকটও তারা অভিশপ্ত। ঘ. আশা আকাংখাঃ সমুদ্র যেমন অকুল-অসীম, আশা ঠিক তেমনি অসীম। আশা আকাংখা নেই এমন কোন মানুষ পৃথিবীতে নেই। তবে সেই আশা কারো পরিমাণে বেশী আবার কারো পরিমাণে কম। এজন্য হাদীসে বলা হয়েছে- ‘মানুষ বুড়ো হলেও দুটো জিনিস তার মধ্যে কখনও বুড়ো হয় না। একটি দুনিয়ার মহব্বত এবং অপরটি দীর্ঘ আশা আকাংখা।’ (বুখারী)
তাই দেখা যায় মানুষের যখন মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়, তখনও সে বাঁচার জন্য কম চেষ্টা করে না। বাঁচার আশায় সে সন্তানদের তাকিদ দিতে থাকে, ভালো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবার জন্য কিছু সম্পদ নষ্ট করে হলেও ভালো চিকিৎসা করবার জন্য। এমন কোন মানুষের মৃত্যু হয় না যার কোন আশা আকাংখ্য অবশিষ্ট থাকে না। প্রতিটি মানুষের জীবনেই মৃত্যু এমন এক সময় এসে হাজির হয় যখন তার বহু আশা আকাংখ্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আরেকটি দিক হচ্ছে মানুষ যতো বেশী আশা করে সে তা পাওয়ার জন্য সেই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য ততো মরিয়া হয়ে উঠে। তখন তার সামনে একটি মাত্র উদ্দেশ্য বা টার্গেট থাকে, আশাকে বাস্তবায়ন। এজন্য সে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে যায় এবং বিভিন্ন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। চরম বিপর্যয় ঘটে তার আখিরাতের জীবনে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের ভেবে দেখা উচিত, সে কোন জীবনকে পছন্দ করবে? কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে পথ চলবে? কল্যাণের না বিপর্যয়ের?
পৃষ্ঠা:১১৯
প্রকৃত ইল্ম
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرُو رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ و سلم العلم ثلاث اية محكمة أَوْ سُنَّةً قَائِمَةٌ أو فريضةً عَادِل وَمَا كَانَ سوى ذلك فَهُوَ فَضْلُ – –আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ইলম তিন প্রকার- (১) প্রকাশ্য আয়াত (২) প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত এবং (৩) ন্যায়ানুগ ফরয কাজ। এছাড়া আর সবই অতিরিক্ত। আবু দাউদ, দারেমী।
শব্দার্থ
قال-তিনি বলেছেন। العلم- ইলম। জ্ঞান। ثلاث তিনি (প্রকার( :ية – محكمة সুস্পষ্ট আয়াত। أو অথবা سنة قائمة প্রতিষ্ঠিত সুন্নত। فريضة عادل – ন্যায়ানুগ ফরয। ماكان যা আছে سوى- ছাড়া | ذلك ঐগুলো। فَهُوَ فَضل – যেগুলো অতিরিক্ত।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
নাম আব্দুল্লাহ্। কুনিয়াত আবু মুহাম্মদ, আবু আবদির রহমান। পিতা প্রখ্যাত সেনা নায়ক ও কুটনীতিবিদ হযরত আমর ইবনুল আ’স (রা)। মাতা রীতা বিনিতু মুনাব্বিহ। আবদুল্লাহ্ (রা) এর ইসলাম পূর্ব নাম ছিলো আল আ’স (পাপী, অবাধ্য)। একটি জানাযা অনুষ্ঠানে রাসূল (সা) তাঁর নাম জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তর দিলেন, আল আ’স। শোনে রাসূল (সা) বললেন, না, আজ থেকে তোমার নাম হবে আবদুল্লাহ্। সেদিন থেকেই তিনি আবদুল্লাহ্ নামে পরিচিত হলেন। হযরত আবদুল্লাহ্ (রা) দুনিয়ার প্রতি অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন। পুত্রের সংসার বিরাগী অবস্থা দেখে পিতা হযরত আমার ইবনুস আস রাসূল (সা)-এর নিকট প্রায়ই অভিযোগ করতেন। একদিন রাসূল (সা) আবদুল্লাহর হাত ধরে
পৃষ্ঠা:১২০
পিতার হাতে দিয়ে বললেন, তোমাকে আমি যা বলি তাই কর, তুমি তোমার পিতার অনুসরণ করো। এরপর তিনি কখনও আর পিতার অবাধ্য হননি। এমন কি পিতার নির্দেশে সিফফিনের যুদ্ধে তিনি মুয়াবিয়ার পক্ষে যোগদান করেছিলেন কিন্তু তা ছিলো তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে, শুধুমাত্র পিতার পীড়াপীড়িতে।হযরত আবদুল্লাহ্ (রা) গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। আরবী ভাষা ছাড়া তিনি হিব্রু ভাষাও জানতেন। ফলে কুরআন এবং তওরাত উভয় গ্রন্থই তিনি অধ্যয়ন করেছেন। তিনি যেখানেই যেতেন তার চারপাশে জ্ঞান পিপাসুদের বিশাল সমাবেশ ঘটতো। বহুদূর দূরান্ত থেকে মানুষ তার দারসে অংশগ্রহণ করতো। তিনি হিজরী ৬৫ সনে মিসরের ফুসতাত নগরীতে ৭২ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ৭০০। তার মধ্যে ১৭টি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্যের হাদীস। পৃথকভাবে ইমাম বুখারী ৮টি এবং মুসলিম ২০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটির গুরুত্ব
যে জ্ঞান দিয়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে যোগসূত্র রচিত হয় ইসলামী পরিভাষায় তাকে ইল্ল্ম বলে। সৃষ্টি কী? তার উদ্দেশ্য কী? আবার তার পরিণতিই বা কী? সকল সৃষ্ট বস্তুর স্রষ্টা কি একজন, না একাধিক? স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে যোগসূত্র কী? এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর মাত্র দুটো উৎসের মাধ্যমে অবগত হওয়া যায়। একটি কুরআন এবং অপরটি হাদীস। এছাড়া আর যতো উৎস আছে সেগুলো উপরোক্ত প্রশ্নের সমাধান দিতে ব্যর্থ। এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে আলচ্য হাদীসটিতে।
ব্যাখ্যা
১. আল কুরআনের আয়াতসমূহ দু’ভাগে বিভক্ত। যথা- ক. মুহকাম বা সুস্পষ্ট আয়াত। খ. মুতাশাবিহ বা অস্পষ্ট (রূপক) আয়াত। মহান আল্লাহ্ বলেন-
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ ايت محكمت هُنَّ أُمُّ الكتب و أخر متشبهت ط তিনিই তো ইলাহ যিনি তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। এতে
পৃষ্ঠা ১২১ থেকে ১৪০
পৃষ্ঠা:১২১
দু’ধরনের আয়াত আছে। আয়াতে মুহকামাত, যা কিতাবের মূল ভিত্তি, অপরটি আয়াতে মুতাশাবিহাত। (সূরা আলে ইমরানঃ ৭)মুহকাম বা সুস্পষ্ট আয়াতকে কুরআনের মূল ভিত্তি বলা হয়েছে। কারণ যে উদ্দেশ্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, এসব আয়াত থেকে সে উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে। এসব আয়াতের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক নীতিসমূহ বর্ণিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। যে ব্যক্তি সত্যানুসন্ধানী এবং সঠিক পথ নির্দেশের জন্য কুরআনের দিকে দৃষ্টিপাত করে, এসমস্ত আয়াতই তাকে সঠিক পথ বাতলে।আর মুতাশাবিহাত এমন আয়াতকে বলা হয়, যার অর্থ থাকে প্রচ্ছন্ন। সাধারণের জ্ঞান ও বুঝের বাইরে। অতীন্দ্রিয় এমনকিছু বিষয় ও বন্ধু আছে যা মানুষ জানা বুঝা দূরের কথা তা কল্পনা করার শক্তিটুকুও নেই। সেসব বস্তুর ধারণা দেয়ার জন্য মানুষের বোধগম্য এর চেয়ে সহজ কোন ভাষা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। তাই মানুষের ধারণাকে কাছাকাছি নেয়ার জন্য এ ধরনের ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড়ো কথা হলো পরকালের মুক্তি ও সঠিক পথের ধারণা লাভের বেলায় এসব আয়াত কোন অন্তরায় নয়। মুহকাম বা সুস্পষ্ট আয়াতগুলোর আলোকে যদি কোন ব্যক্তি চলতে পারে তবে পরকালের মুক্তির জন্য তাই যথেষ্ট। মানুষের একমাত্র লক্ষ্য যদি পরকালের মুক্তি হয় এবং সে মুক্তির Gide line যদি মুহকাম আয়াতের মাধ্যমেই পেয়ে যায় তাহলে মুতাশাবিহাত আয়াত নিয়ে বাড়াবাড়ির আর কি প্রয়োজন।২. প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত বলতে বুঝায় যেসব কাজ রাসূল (সা) নিজে করেছেন, কিংবা করতে বলেছেন অথবা তাঁর সামনে সাহাবাগণ করতেন এবং তিনি তা মৌনভাবে সমর্থন করতেন। তবে শর্ত হচ্ছে- এ সমস্ত কথা বা কাজ অবশ্যই সহীহ্ সূত্রে আমাদের পৌঁছতে হবে। রাসূলের সুন্নাত (অনুসৃত পথ) কে সুন্নাত হিসেবে মানা এবং রাসূল হিসেবে তাঁকে অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরয। এমন কিছু হাদীস আছে যার নির্দেশ অনুসরণ করা ফরয। আবার এমন কিছু হাদীস আছে যার নির্দেশ মানা ওয়াজিব কিংবা সুন্নাত। যে সমস্ত হাদীসের নির্দেশ আমাদের জন্য সুন্নাত সেসব হাদীস যে হযরত মুহাম্মদ (সা) নবী হিসেবে আমাদেরকে বলে গেছেন কিংবা করে গেছেন অথবা অনুমোদন করেছেন একথা স্বীকার করা ফরয। আল কুরআনের নিন্মোক্ত আয়াতগুলোই উপরোক্ত কথার সত্যতা প্রমাণ করে। ইরশাদ হচ্ছে-ما أَنَا كُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا تَهِكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا –
পৃষ্ঠা:১২২
রাসূল তোমাদেরকে যে নির্দেশ দেন তা গ্রহণ করো এবং যা পরিহার করতে বলেন তা থেকে তোমরা বিরত থাকো। (সূরা আল হাশরঃ ৭)أطيعوا الله وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُون – – RICE তোমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করো, তবেই তোমরা রহমত প্রাপ্ত হবে। (সূরা আলে ইমরান: ১৩২) আরেক জায়গায় রাসূলের আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্যের স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-من يطع الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ الله – যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করলো, মূলত সে আল্লাহর আনুগত্য করলো। (সূরা আন নিসাঃ ৮০) যে সকল ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ দিয়েছেন। সেসব ব্যাপারে কোন ব্যক্তি যদি সে নির্দেশ না মেনে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করে তবে সে ইসলামের বাইরে চলে যাবে। ইরশাদ হচ্ছে-وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنِ وَلا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهَ وَرَسُولَهُ أَمْرًا أَنْ يكُونَ لَهُمُ الخيرةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولُهُ فَقَدْ ضَلَّصلا لا مبينا . –আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে তার পরিবর্তে ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মহিলার নেই। আর যে আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে অমান্য করলো সে তো সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হলো। (সূরা আল আহযাবঃ ৩৭) অবশ্য এ ধরণের লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তারা মৌখিক ভাবে আল্লাহ্ ও রাসূলের স্বীকৃতি দিলেও কার্যত তারা বিভ্রান্তিতে লিপ্ত। মহান আল্লাহ্ বলেন-وَإِذا دعوا إلى الله وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمُ بَيْنَكُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِّنْهُمْمعرضون . যখন তাদের যাবতীয় ফায়সালা আল্লাহ্ ও রাসূলের নির্দেশ মুতাবেক করার জন্য আহবান করা হয় তখন একদল তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। (সূরা আন নূর : ৪৮)
পৃষ্ঠা:১২৩
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বুঝা যায়, আহকামে শরীয়াহ্ জানার জন্য রাসূলের মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সাহাবা কিরাম প্রত্যেকেই তাঁর আদেশ ও নিষেধের সীমারেখা ঠিক রেখে চলাকে অপরিহার্য মনে করতেন। নবী করীম (সা) বলেছেন-كُل أمني يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إلا من أبي – قَالُوا يَارَسُولَ اللَّهِ ومن أبي؟ قال من أطاعني دخل الجنة ومن عصاني فقد أبي
আমার সকল উম্মতই জান্নাতে যাবে কেবলমাত্র তারা ছাড়া যারা আমাকে অস্বীকার করেছে। সাহাবা কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে কে? রাসূল (সা) বললেন, যে আমার আনুগত্য করলো সে জান্নাতে প্রবেশ করলো, আর যে আমার আনুগত্য করলো না সে আমাকে অস্বীকার করলো। (বুখারী, হাকিম)৩. ন্যায়নানুগ ফরয কাজ বলতে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যে সব কাজকে অপরিহার্য ও অবশ্য করণীয় হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন সেগুলোকে বুঝায়। কুরআনের মাধ্যমে যেমন ফরয কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তেমনিভাবে হাদীসের মাধ্যমেও কিছু ফরয কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন বিবাহিত পুরুষ কিংবা মহিলা ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার বিধান। সুন্নাতে রাসূলের মাধ্যমে এ বিধান আমাদের জন্য ফরয করা হয়েছে। মিরাসের অংশ বন্টনের সময় কতিপয় ওয়ারিশের অংশ প্রদান ইত্যাদি বিধানগুলো হাদীসের মাধ্যমেই ফরয করা হয়েছে।হাদীসে উল্লেখিত এ তিন পর্যায়ের জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি নর-নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। কেননা পরকালের মুক্তির সাথে এ তিন ধরনের জ্ঞানই সম্পৃক্ত। তাছাড়া আর যত জ্ঞান বা ইলম আছে তা ফরয বা অপরিহার্য নয় নফল বা অতিরিক্ত। যেমন-চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহ যাবতীয় জ্ঞান।
পৃষ্ঠা:১২৪
কোন মুমিন একই ভুল দু’বার করেনা
عن أبي هريرةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَلا يُلدَعُ الْمُؤْمِنُ مِنْ جُحْرٍ وَاحد مرتين – (متفق عليه)আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কোন মুমিন একই গর্তে দু’বার পা দেয়না। (বুখারী, মুসলিম)
শব্দার্থ
لايلد পা দেয়না, দংশিত হয়না। من হতে। واحد ك جحر একবার, প্রথমবার। مرتين দু’বার, দ্বিতীয় বার।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
আবু হুরাইরা মুসলিম জাহানে অতি পরিচিত একটি নাম। ৭ম হিজরীর মোহররম মাসে তিনি মদীনায় আগমন করেন। ইতোপূর্বে প্রখ্যাত সাহাবী তুফাইল ইবনে আমর আদ্ দাওসীর হাতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম পূর্ব নাম ছিলো ‘আবদে শামস’ বা অরুণদাস। রাসূলের আকরাম (সা) সেই নাম পরিবর্তন করে আবদুর রহমান রাখেন। আবু হুরাইরা তাঁর লকব বা উপাধি। তিনি এ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। মাত্র সাড়ে তিন বৎসর তিনি নবী করীম (সা)-এর সাহচর্য পান। এ অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে পরিমাণ হাদীস মুখস্ত করেছিলেন তা আর কোন সাহাবীই পারেননি। আবু হুরাইরা (রা) ছিলেন জ্ঞান সমুদ্রের অথৈ জল। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আবু হুরাইরা জ্ঞানের আধার।’ (বুখারী) জ্ঞানের এ চলন্ত বিশ্বকোষ হিজরী ৫৯ সনে ৭৮ বৎসর বয়সে এ নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট-
পৃষ্ঠা:১২৫
৫৩৭৪টি। যুখারী ও মুসলিম যৌথ ভাবে ৩২৫ টি এবং বুখারী এককভাবে ৭৯টি মুসলিম এককভবে ৭৩টি হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটির গুরুত্ব
মানুষ যখন কোন কাজ করে তখন তার উচিত অতীতের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যতের ফলাফলের চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করা। অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ঝটপট কোন কাজ করে পরে অনুশোচনা করার চেয়ে পূর্বেই ভালোভাবে বা বারবার চিন্তা করে কাজ করাটাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। তাছাড়া অতীত ইতিহাস ও অভিজ্ঞতাকে সামনে। রেখে কাজ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে এ হাদীসটিতে। অতীতকে যারা ভুলে যায়, যারা অতীত থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না তারা প্রতিটি পদেই হোচট খায়। পরিণামে অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হয়। এজন্যই হাদীসে ভেবে চিন্তে কাজ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পরামর্শটা যদিও অল্প কটি কথায়, সংক্ষেপে, তবু এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
ব্যাখ্যা
মুমিনগণ সর্বদা সাবাধানী হয়ে থাকে। তারা হুট করেই কোন কাজ করে না। ভেবেচিন্তে করে। তাছাড়া একবার কোন ধোকা বা প্রতারণার শিকার হলে দ্বিতীয়বার আর সে ঐরূপ ধোকা ও প্রতারণার শিকার হয় না। অন্যকথায়, কোন ঈমানদার ব্যক্তি একই ভুল দু’বার করে না। এখানে একটি কথা ভালো করে বুঝা দরকার, মুমিন ব্যক্তি কখনো ভুল করেনা বা ভুল করতে পারে না এরূপ বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, ভুল কোন ঈমানদার ব্যক্তি না বুঝে অথবা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে করতে পারে। কিন্তু যখন সে তার ভুল বুঝতে পারে তখন প্রতিকারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এ ভুলটি তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে সঞ্চিত থাকে, ফলে সে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যত পথ নির্দেশ পেয়ে যায়। এ কথাগুলো রাসূলুল্লাহ্ (সা) সুন্দরভাবে বলে দিয়েছেন এভাবে-لا حليم إلا ذو عشرة ولا حكيم الأذو تجربة – হোঁচট না খেয়ে কেউ বীর হতে পারে না, আর অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়া কেউ বিজ্ঞ হতে পারে না। (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত)।
পৃষ্ঠা:১২৬
আবার একজন ঈমানদার ধোকাবাজ বা প্রতারক হতে পারে না। সরলভাবে জীবন যাপন করে থাকে। নবী করীম (সা) বলেছেন: – إِنْ أَهْلُ الْجَنَّة بله “অবশ্যই জান্নাতীগণ সহজসরল প্রকৃতির হয়ে থাকে।” এ ধরণের লোকদের যদিও বর্তমান সমাজে বোকা বলে আখ্যায়িত করা হয় কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে সবচেয়ে বেশী বুদ্ধিমান মনে করেন। সত্যিকথা বলতে কি, যে বন্ধু নশ্বর, অস্থায়ী তা পাবার জন্য যে সর্বাত্মক চেষ্টা করে তার চেয়ে সেই বেশী বুদ্ধিমান, যে অবিনশ্বর স্থায়ী বস্তুসমূহ লাভ করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। যে সমস্ত বাধা অথবা যে সমস্ত ভুলের কারণে কল্যাণকর ও চিরস্থায়ী বস্তুসমূহ বা জান্নাত হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে তারা কখনো সেপথ মাড়ায় না। যদি দূর্ঘটনা বশত সেরূপ কোন কাজ সংটিত হয়ে যায় তৎক্ষনাৎ তা সংশোধন করে নেয়। এটি হচ্ছে ঈমানদারের অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষাবলী
১. ঈমানদারগণ একই ভুল বার বার করেনা।
২. কোন কাজ করার আগে চিন্তা ভাবনা করে কাজ করা উচিত।
৩. ভুল করা মানুষের স্বভাব, তাই বলে বার বার একই ভুল করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
৪. ঈমানদারগণ সরল সোজা প্রকৃতির হলেও তারা বোকা নয়।
৫. জ্ঞানীগণ যেখানে ঠেকেন সেখানেই শিখেন।
পৃষ্ঠা:১২৭
পিতা-মাতার অধিকার
عن أبي أمامة أنْ رَجُلاً قَالَ يَارَسُولَ اللَّهِ مَا حَقَّ الْوَالِدَيْنِ على ولدهما ؟ قَالَ هُمَا جَنَّتُكَ وَنَارَكَ –আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করীম (সা) কে জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সন্তানের উপর মা বাপের কতটুকু অধিকার আছে? তিনি উত্তর দিলেন, তারা তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। (ইবনে মাজা, মিশকাত)
শব্দার্থ
ما- কি। حق – অধিকার, হক। الوالدين পিতা মাতা। على উপর। ولدهما তাদের দুজনের সন্তানের। – তারা দুজন। جنتك তোমরা জান্নাত। نارك- তোমার জাহান্নাম।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
নাম সুদ্দী। কুনিয়াত আবু উমামা। তিনি বাহিলী নামেও পরিচিত। তাঁর পূর্বপুরুষ মায়ান ইবনে মালেকের স্ত্রীর নাম ছিলো বাহেলাহ্। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরেরা তাদের মা বাহেলার দিকে সম্বন্ধ করে বাহেলী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
আবু উমামা (রা) হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি সর্বপ্রথম হুদাইবিয়ার সন্ধি অভিযানে শরীক হোন এবং বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। অতঃপর তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) স্বগোত্রে ইসলাম প্রচারে দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। তাঁর প্রচেষ্টায় এক পর্যায়ে গোত্রের সকল লোক ইসলাম গ্রহণ করে। হাদীসের প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি স্বীয় জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। হাদীসের এক বিশাল ভান্ডার তাঁর করায়ত্বে ছিলো। ইসলামের জন্য উৎসর্গকৃত এ প্রাণ হিজরী ৮৬ সনে সিরিয়ায় ইন্তিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ২৫০টি। ৫টি বুখারী এবং ৩টি মুসলিম শরীফে স্থান পেয়েছে।
পৃষ্ঠা:১২৮
হাদীসটির গুরুত্ব
আল্লাহর উপর ঈমান আনার সাথে সাথে হক্কুল ইবাদ সংক্রান্ত মানুষের উপর প্রথম যে দায়িত্ব বর্তায় তা হচ্ছে মা বাপের হক। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের ফরমান হচ্ছে-وقضى رَبُّكَ أَنْ لا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا طَ إِمَّا يَبْلُغُنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا ، وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنْالرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيني صغيرًا *
তোমার প্রভুর নির্দেশ, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো ইবাদাত করতে পারবে না। পিতা-মাতার সাথে সুন্দর ব্যবহার করবে। তাদের কোন একজন অথবা উভয়েই যদি তোমাদের সামনে বুড়ো হয়ে যায় তবে তাদেরকে উহ্ শব্দটি পর্যন্ত বলবে না এবং তাদেরকে ধমকের স্বরে অথবা ভর্ৎসনা করে কোন কথার জবাব দেবে না। বরং তাদের সাথে আদব ও সম্মানের সাথে কথা বলবে। নরম ও বিনীতভাবে তাদের সামনে অবনত হয়ে থাকবে এবং তাদের জন্য এ দোয়া করতে থাকবে, হে প্রভু! তুমি তাদের উপর (এ অবসহায় জীবনে) রহম করো যেমনি ভাবে ছোটকালে আমাদেরকে স্নেহ বাৎসল্যে প্রতিপালন করেছেন।
(সূরা আসরাঃ ২৩-২৪) এ আয়াতের মাধ্যমে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেমন-
১. মুমিনের উপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে পিতা-মাতার হক আদায় করা।
২. পিতা-মাতা বুড়ো হয়ে গেলে তাদের মেজাজ কিছুটা রুক্ষ ও খিটখিটে হয়ে যায় কাজেই তাদের কথায় কোনরূপ প্রতিউত্তর না দেয়া বা কোন দুঃখভোগ না করা।
৩. পিতা-মাতার মর্যাদার প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখা উচিত। কাজেই তাদের মর্যাদাবোধে লাগে এরকম কোন আচরণ করা ঠিক নয়।
৪. তাদের সাথে আচরণে বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করতে হবে।
৫. পিতামাতাকে অসহায় ও দুর্বল পেয়ে নিজের শৈশবের অবস্থাকে স্মরণ করতে হবে। তখন তো তারা অত্যন্ত স্নেহ ও ধৈর্যের সাথে প্রতিপালন করেছে।
পৃষ্ঠা:১২৯
এ আয়াতে পিতামাতার অধিকারের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তুলে ধর। হয়েছে, সেই সাথে হাদীসে রাসূলেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সর্তক করা হয়েছে। আলোচ্য হাদীসটি তার অন্যতম। এখানে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, তারা তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। দেখা যাচ্ছে অল্প কথার ছোট্ট এ হাদীসটিতে আমাদের জন্য মেসেজ রয়েছে।
ব্যাখ্যা
সন্তানের উপর পিতা-মাতার ১১টি হক বা অধিকার আছে। এর কোন একটি হক বা অধিকার লংঘন করা সন্তানের জন্য হারাম। নিচে তা সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হলো।১. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: মানুষ পৃথিবীতে একান্ত অসহায় ও পরনির্ভরশীল হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। তখন পিতা-মাতাই থাকে তার একমাত্র আশ্রয় ও ভরসার স্থল। তাদের কাছে না চাইতেই তারা খেদমত, সহযোগিতা ও প্রতিপালন করে থাকেন। এমনকি যখন তারা সন্তান প্রতিপালন করেন তখন তাদের ঐ মুহূর্তে পার্থিব কোন স্বার্থও থাকে না। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার ত্যাগ হচ্ছে সর্বোচ্চ ত্যাগ। অনেক মানুষ বুড়ো বয়সে শয্যাশায়ী হয়ে ভোগে মারা যায়। দেখা যায় তার সেবা-শশ্রুষা করতে করতে স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েরা বিরক্তি প্রকাশ করে। মাল সম্পদ না দিলে বা না থাকলে তাকে কেউ সেবাটুকুও করতে চায় না বরং নানা রকম তিরস্কার করে। কখনও কখনও তাদরকে মারধরও করা হয়। কিন্তু পিতা-মাতা ছোট বেলায় তো আরো অনেক বেশী কষ্ট করে প্রতিপালন করেন। কই, তারাতো কখনো বিরক্ত বোধ করেন না। তারাতো কখনো তিরস্কার বা কটুবাক্য বলেন না। এমন দরদী বন্ধু, অভিভাবক তার কি কখনো অমর্যাদা করা যায়? তার সাথে কি অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করা কোন বিবেকমান মানুষের শোভা পায়? নিশ্চয়ই নয়।২. সন্তুষ্ট চিত্ততা: রাসূলে আকরাম (সা) বলেছেন-رضا اللهِ فِي رِضَا الْوَالِدِ وَسُخْطُ اللَّهِ فِي سُخْطِ الْوَالِدِপিতার সন্তুষ্টিই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টিই আল্লাহর অসন্তুষ্টি।
(তিরমিযি, ইবনে হিব্বান, হাকিম) অর্থ্যাৎ পিতা মাতার কোন অধিকারকে অস্বীকার করে বা পাশ কাটিয়ে আল্লাহর
পৃষ্ঠা:১৩০
সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব নয়। আর যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা না যায় তবে আল্লাহর গজব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াও সম্ভব নয়। ৩. আবেগ অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ: ভালোবাসা বা স্নেহের কারণে মানুষের মনে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। আর এ আকর্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার আবেগ প্রকাশের মাধ্যমে। যেহেতু পিতা মাতা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র তাই তাদের প্রতি সন্তানের আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। আর এ আবেগের কারণে যদি মাত্র একবারও পিতামাতার দিকে কেউ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তবে তাও বিরাট কল্যাণ বয়ে আনে। নবী করীম (সা) বলেছেন-ما مِنْ وَلَد مار ينظر إلى والديه نظرَةَ رَحْمَةِ الأَكَتَبَ اللَّهُ لَهُ بكُلِّ نَظرَةٍ مَجْةٍ مَبْرُورَةٍ قَالُوا إِنْ نَظَرَ كُلَّ يَوْمٍ مِئَةَ مَرَّةٍ قَالَنعم والله أكبر و أطيب – যে সুসন্তানই পিতামাতার প্রতি আবেগ ভালোবাসার দৃষ্টিতে একবার তাকাবে। তার বিনিময়ে আল্লাহ তাকে একটি কবুলকৃত হাজ্জের সওয়াব দান করবেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, (ইয়া রাসূলাল্লাহ!) যদি কেউ প্রতিদিন একশ’বার করে তাকায়? তিনি বললেন, হাঁ, যদি কেউ একশ’বার তাকায় তবুও। আল্লাহ (তোমাদের ধারনার চেয়ে) অনেক বড়ো এবং সর্বাধিক পবিত্র। (মুসলিম)
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-وَقَضَى رَبُّكَ أَنْ لا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَنا . –তোমার প্রভু ফায়সালা করে দিয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কারো ইবাদাত করা যাবেনা এবং পিতা মাতার সাথে ইহসান করতে হবে। (সূরা আসরা: ২৩) এখানে একটি কথা ভালোভাবে বুঝে নেয়া উচিত, উল্লেখিত আয়াতে ইহসানের কথা বলা হয়েছে। আদল ও ইহসান ইসলামের দুটো পরিভাষা। আদল অর্থ কেউ কোন উপকার করলে বিনিময়ে তার ততোটুকু উপকার করা। একটি ক্রিয়ার সমান প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের নাম আদল। এর সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে ইনসাফ। পক্ষান্তরে ইহ্সান বলা হয় কারো কোন উপকার অথবা দানের বিনিময় তার চেয়েও বেশী উপকার করা বা প্রতিদান দেয়া। যেমন ধরুন- আপনি একটি রিক্সা ঠিক করলেন আপনাকে গুলিস্তান নিয়ে যাবে, ভাড়া ১০ টাকা। আপনি গুলিস্তান
পৃষ্ঠা:১৩১
গিয়ে মনে করলেন বেচারা প্রখর রোদে আপনাকে পরিশ্রম করে এতদূর নিয়ে এসেছে তাই তাকে দুটো টাকা বেশী দেয়া উচিত এবং তা দিলেনও। আপনি যদি তাকে ১০ টাকা দিয়ে দেন তা হবে আদল। কারণ সে আপনার নিকট ১০ টাকাই পাওনা, বেশী পাওয়ার কোন অধিকার তার নেই। কারণ সে তো আগে আপনার সাথে চুক্তি করে নিয়েছে। আর যদি আপনি তাকে ১০ টাকা বলেও ১২টাকা দিয়ে দেন তবে তা হবে ইহসান। কাজেই দেখা যায় তখনই ইহসান করা সম্ভব যখন তার পিছনে আন্তরিকতা থাকে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনও পিতামাতার সাথে আদলের কথা না বলে ইহসানের কথা বলেছেন। যেন পিতামাতাকে ইহসানের সাথে খেদমত করা হয়।রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন- رَغمَ أَنْفُه ثُمَّ رَغمَ اَنْفُه ثُمَّ رَغمَ أنْفُه قَبْلَ مَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قال من أدرك والديه عند الكبر أوْ أَحَدٌ هُمَا ثُمَّ لَمْ يَدْخُلِ الجنة – –সে অপমানিত হোক, পুনরায় অপমানিত হোক, আবারো অপমানিত হোক। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। সে কে? তিনি উত্তর দিলেন, যে ব্যক্তি নিজের পিতামাতা উভয়কে বৃদ্ধ অবস্থায় পেলো অথবা কোন একজনকে পেলো, কিন্তু তাদের খেদমত করে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলেনা।
৫. সুন্দর আচরণঃ ইরশাদ হচ্ছে- وصا حِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا . এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করতে থাকো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন- من سره أن يمد له فِي عُمُرِهِ وَيُزَادُ لَهُ فِي رِزْقِهِ فَلْيَبَرُّ وَالِدِيهِ وليصل رحمه – —যদি কেউ নিজের হায়াত বৃদ্ধি ও প্রচুর রিযিক কামনা করে তাহলে সে যেনো তার পিতা-মাতার সাথে সদাচারণ এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। (মুসনাদে আহমদ)
পৃষ্ঠা:১৩২
অন্য হাদীসে আছে, নবী করীম (সা) বলেছেন- مَنْ يَرُ وَالِدَيْهِ طُوبَى لَهُ زَادَ اللَّهُ فِي عُمُرِهِ – —-যে ব্যক্তি পিতা মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করলো তার জন্য সুসংবাদ হচ্ছে, আল্লাহ্ তাকে হায়াত বাড়িয়ে দেবেন। (তারগীব ওয়া তারহীব) এতো হলো মুসলিম পিতা-মাতার ব্যপারে কথা। কিন্তু পিতামাতা যদি অমুসলিম, কাফির, মুশরিকও হয় তবু তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। আবুবকর (রা) তনয়া আসমা (রা) বলেন- রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা এসেছেন কিন্তু তিনি ইসলামের উপর নাখোশ। আমি কি তার সাথে আত্মীয় সুলভ আচরণ করবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ মায়ের সাথে আত্মীয় সুলভ আচরণ করো। (বুখারী) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ্ (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশী প্রিয়? তিনি বললেন, যে নামায সময় মতো পড়া হয়। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এরপর কোন কাজ বেশী প্রিয়? তিনি বললেন, পিতামাতার সাথে সুন্দর আচরণ। আবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, আল্লাহ রাস্তায় জিহাদ করা।(বুখারী মুসলিম) ৬. আদব ও সম্মান: একবার হযরত আবু হুরাইরা (রা) দু’জন লোককে দেখে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তি তোমার কে? সে বললো, ইনি আমার শ্রদ্ধেয় পিতা। তখন তিনি বললেন, দেখো, কখনও তুমি তাঁর নাম ধরে ডেকোনা। কখনও তাঁর আগে আগে চলবেনা, কোন মজলিসে গেলে তার আগে বসার চেষ্টা করবে না। (আদাবুল মুফরাদ) এক ব্যক্তি সুদূর ইয়েমেন থেকে রাসূল (সা)-এর দরবারে এলেন এ নিয়তে যে, তিনি রাসূলে আকরাম (সা)-এর কাছে থেকে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন জিহাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়েমেনে তোমার কেউ আছে কি? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আমার পিতামাতা আছেন। তিনি বললেন, তারা কি তোমাকে অনুমতি দিয়েছে? তিনি বললেন, না। তখন রাসূল (সা) বললেন, ঠিক আছে তুমি ফিরে যাও এবং উভয়ের থেকে অনুমতি
পৃষ্ঠা:১৩৩
নিয়ে এসো। যদি তারা অনুমতি দেয় তবে এসে জিহাদে অংশগ্রহণ কোরো নইলে তাদের কাছে থেকে সেবা শশ্রুষা করতে থাকো। (আবু দাউদ)উপরের হাদীস দুটোকে সামনে রেখে চিন্তা করলেই বুঝা যায় পিতামাতার সাথে সম্মান প্রদর্শন করাকতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ কাজ।৭. আনুগত্য : এক ব্যক্তি হযরত আবু দারদা (রা) এর কাছে এসে আরজ করলো, আমার পিতা অত্যন্ত পীড়াপীড়ি করে আমাকে বিয়ে করিয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি আমার স্ত্রীকে তালাক দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। শোনে হযরত আবু দারদা (রা) বললেন, ভাই, আমি আপনাকে পিতামাতার নাফরমানী করতেও বলিনা, আবার একথাও বলিনা যে, নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিন। হ্যাঁ আপনি যদি চান তবেরাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে যেকথা শুনেছি তা বলে দিতে পারি।আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, পিতা জান্নাতের অতি উত্তম দরজা। তোমরা যদি চাও তবে নিজের জন্য তা সুরক্ষিত করে নাও, অথবা উপেক্ষা করো। (ইবনে হিসান)নবী করীম (সা) বলেছেন,من أصبة مطيعا لله في والديه أصبح بابانِ مَفْتُوحَانِ مِنَ الْجَنَّةِ وَإِنْ كَانَ وَاحِدًا فَوَاحِدًا وَمَنْ أَمْسَى عَاصِيًّا لِلَّهِ فِي والديه أصبع له بَابَانِ مَفْتُوحَانِ مِنَ النَّارِ وَ إِنْ كَانَ وَاحِدًا فواحداً قَالَ رَجُلٌ وَإِنْ ظَلَمَةً قَالَ وَإِنْ ظَلَعَاهُ وَإِنْ ظَلَمَهُ وَإِنْأظلماه -যে ব্যক্তি পিতা-মাতা সম্পর্কে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান মেনে সকাল করবে সে জান্নাতের দুটো দরজা খোলা অবস্থায়ই যেনো সকাল করলো। আর যদি তাদের দু’জনের কোন একজন থাকে তবে জান্নাতের একটি দরজা খোলা অবস্থায় সকাল করলো।আর যে ব্যক্তি পিতা-মাতা সংক্রান্ত বিধিবিধান লংঘন করা অবস্থায় সকাল করলো সে যেনো জাহান্নামের দুটো দরজা খোলা অবস্থায় সকাল করলো। যদি তাদের দুজনের কোন একজন থাকে তবে জাহান্নামের একটি দরজা খোলা
পৃষ্ঠা:১৩৪
অবস্থায় সকাল করলো। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তার সাথে বাড়াবাড়ি করে, তবু? তিনি বললে, যদি বাড়াবাড়ি করে তবু, যদি বাড়াবাড়ি করে তবু, যদি বাড়াবাড়ি করে তবু। (মিশকাত)
৮. আর্থিক সহায়তা: স্ত্রী, পুত্র, কন্যার জন্য যেভাবে অর্থ ব্যয় করা সওয়াবের কাজ তেমনিভাবে পিতামাতার জন্য অর্থ ব্যয় করাও অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। পিতামাতাকে আর্থিক সহযোগিতা না করে সম্পদ জমানো ঠিক নয়। অনেকে পিতামাতার সাথে আচার আচরণ ভালো করলেও অর্থ ব্যয়ের সময় কার্পণ্য প্রদর্শন করে থাকেন এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তাঁরা যদি অভাবগ্রস্থ বা অর্থিক অস্বচ্ছল হোন তবে জোর করেও সন্তানের কাছ থেকে তা আদায় করতে পারেন।একবার এক ব্যক্তি নবী করীম (সা)-এর কাছে এসে অভিযোগ করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার পিতা ইচ্ছে হলেই আমার থেকে জোর করে অর্থ-সম্পদ নিয়ে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেই ব্যক্তির পিতাকে ডাকলেন। লাঠি ভর দিয়ে এক দুর্বল বৃদ্ধ এসে হাজির হলেন। তিনি বৃদ্ধকে অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। বৃদ্ধ বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! যখন এ অত্যন্ত দুর্বল ও অসহায় ছিলো তখন আমি শক্তি সম্পন্ন ছিলাম, সে ছিলো কপর্দকশূণ্য আর আমি ছিলাম বিত্তশালী, তখন আমি কখনও তাকে আমার সম্পদ নেয়ায় বাধা দেইনি। আজ আমি দুর্বল আর সে সুঠাম ও শক্তিশালী। আমি কপর্দকশূন্য এবং সে বিত্তশালী। এখন সে নিজের সম্পদ আমাকে দেয়না। একথা শোনে দয়াল নবী কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, তুমি এবং তোমার সম্পদ পিতার, তুমি এবং তোমার সম্পদ পিতার।
৯. অবাধ্য, না হওয়াঃ সবচেয়ে বড়ো গুনাহ হচ্ছে শিরক্। আর শিরকের পর বড়ো শুনাহ হচ্ছে পিতামাতার অবাধ্য হওয়া। আবু বাকরা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন-الا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكُبَائِرِ ثَلاثًا قُلْنَا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ : الأشراك بالله وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَكَانَ مُتَّكِنَّا فَجَلَسَ فَقَالَ : أَلَا وقَوْلُ الزُّورِ وَشَهَادَةُ الزُّوْرِ فَمَازَالَ يُكَبِّرُهَا حَتَّى قَلْنَا لَيْتَهُسكت –
পৃষ্ঠা:১৩৫
আমি কি তোমাদেরকে তিনটি বড়ো ও জঘন্যতম গুনাহ্ সম্পর্কে অবহিত করাবো না? আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই তা করবেন। তিনি বললেন, আল্লাহ্র সাথে শরীক করা এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়া। তিনি ঠেস দিয়ে বসা ছিলেন, সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, খুব ভালো করে শুনে নাও, মিথ্যে কথা বলা এবং মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়া। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আহা! তিনি যদি চুপ মেরে যেতেন।-(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি)।শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রে তাদের অবাধ্য হওয়া যায়। তাছাড়া তাদের অবাধ্য হওয়া জায়েয নয়। তা হচ্ছে-وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَاযদি পিতামাতা তোমাদেরকে আমার সাথে কাউকে অংশীদার বানানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করে, যে সম্পর্কে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই, তবে অবশ্যই (সেক্ষেত্রে)তাদের আনুগত্য পরিহার করে চলবে। (সূরা লুকমানঃ ১৫) অর্থাৎ যে সব ক্ষেত্রে আল্লাহ্র নাফরমানী মূলক কাজের নির্দেশ দেয়া হবে সে সবক্ষেত্রে তা না মানা ফরয।এছাড়া সকল ক্ষেত্রেই তাদের আনুগত্য করতে হবে। যদি না করা হয় তবে শুনুন নবী করীম (সা) এর ঘোষণা-كُلُّ الذُّنُوبِ يُؤَخِّرُ اللَّهُ مِنْهَا مَا شَاء إِلى يَوْمِ الْقِيَامَةِ إِلَّا عُقُوقالْوَالِدِينِ فَإِنَّ اللهَ يُعَجِّله بِصَاحِبِهِ فِي الْحَيَوةِ قَبْلَ الْمَمَاتِ – আল্লাহ্ যে সব গুনাহর শাস্তি প্রদান করতে চান তা কিয়ামতের দিন পর্যন্তবিলম্বিত করেন। কিন্তু পিতামাতার না ফরমানির শান্তি মৃত্যুর পূর্বে জীবিতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে প্রদান করেন। (হাকিম)১০. মহব্বত ও ভালোবাসা: পিতামাতা যেমন ছোটকালে অত্যন্ত স্নেহ ও মহব্বতের সাথে প্রতিপালন করে থাকেন তদ্রুপ আজীবন তাদের সাথে মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে “পিতামাতাও তো মানুষ, তারাও মানবীয় দুর্বলতা থেকে পবিত্র নয়। তাদের মধ্যেও ঘৃণা, ভালোবাসা, ক্রোধ, প্রতিশোধস্পৃহা সহ অন্যান্য দুর্বলতা বিদ্যামান। মানবীয় দূর্বলতার কারণে কোন সময় তারাও এমন কথা বলে বসতে পারেন অথবা এমন আচরণ করে
পৃষ্ঠা:১৩৬
ফেলতে পারেন যা তাদের থেকে আশা করা যায় না। এতে উত্তেজিত হওয়া যাবেনা। তাদের অধিকার সম্পর্কে চোখ বুজে থাকা যাবে না। পিতামাতা এমনব্যক্তিত্ব যারা সন্তানের লালন পালন ও আরাম আয়েশের জন্য নিজের সমগ্রজীবন বিলিয়ে দেন। তারা যে ধরনের আচরণই করুন না কেন, তাদের সম্পর্কেকিছু বলা শোভনীয় নয়। তাদেরকে গালমন্দ করা এবং তাদের সকল ইহসানভুলে যাওয়াও উচিত নয়।” (মাতাপিতা ও সন্তানের অধিকার-আল্লামা ইউসুফ ইসলাহী)হযরত উসমান (রা)-এর শাসনামলে একবার খেজুরের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিলো। একদিন লোকজন দেখলো, হযরত উসামা ইবনে যায়িদ (রা) খেজুরের গাছ কেটে তার থেকে মাথি বের করছেন। লোকজন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, জনাব! এ আক্রার বাজারে আপনি খেজুর গাছটি কেটে ফেললেন? আজকালতো খেজুরগাছ অত্যন্ত মূলবান সম্পদ। তিনি উত্তর দিলেন, ভাইসব! আমার মা আমাকে খেজুর গাছের মাথির ফরমায়েশ দিয়েছেন। মায়ের ফরমায়েশ কি কখনো অবজ্ঞা করা যায়? (প্রগুক্ত- পৃ-৩২)।১১. তাদের মৃত্যুর পর ৪টি কাজ করণীয়: আবু উসাইদ (রা) বর্ণনা করেছেন, আমরা নবী করীম (সা)-এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। একব্যক্তি প্রশ্ন করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পিতামাতার মৃত্যুর পরও কি এমন কোন উপায় আছে যাতে আমি তাদের সাথে সুন্দর আচরণ অব্যাহত রাখতে পারি? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ হ্যাঁ, চারটি উপায় আছে। (১) পিতামাতার জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করা, (২) তাদের কৃত ওয়াদা ও ওসিয়তসমূহ পূরণ করা, (৩) পিতার বন্ধু ও মাতার বান্ধবীদের সাথে সদাচারণ করা এবং (৪) পিতামাতা সম্পর্কিত আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা। (আদাবুল মুফরাদ)।উপরের আলোচনা থেকে একথা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হলো, পিতামাতার সাথে ভালো আচার আচরণ করা অন্যান্য ইবাদাতের মতো একটি ইবাদাত মাত্রই নয় বরং এ হচ্ছে সমস্ত ইবাদাতের মা। রাসূলে আকরাম (সা) যথার্থই বলেছেন- ‘তারা তোমাদের জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’
শিক্ষাবলী
১. আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের নিয়ামত সমূহের মধ্যে পিতামাতা হচ্ছে অন্যতম নিয়ামত। কাজেই যে ব্যক্তি এ নিয়ামতের অবজ্ঞা করলো সে যেনো স্বয়ং আল্লাহকেই অবজ্ঞা করলো।
পৃষ্ঠা:১৩৭
২. পিতা-মাতার সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির উপরই নির্ভর করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টি। আর আল্লাহর যদি অসন্তুষ্ট হন তার পরিণাম ভয়াবহ।
৩. পিতামাতার সাথে সদাচারণ এবং তাদের খেদমত করা জিহাদের চেয়েও বেশী মর্যাদা সম্পন্ন কাজ।
৪. পিতামাতার সন্তুষ্টি হচ্ছে জান্নাতের গ্যারান্টি।
৫. পিতামাতার খেদমত করার সুযোগ পাওয়া মানে জান্নাতের পথে চলার পথ সুগম হওয়া।
৬. হাজ্জ ও উমরা আর্থিক ও শারিরীক ইবাদাত এবং তা কষ্টসাধ্য। তাছাড়া এ ইবাদাত করা সবার তওফিক হয়না, কিন্তু পিতামাতার খেদমতের বদৌলতে আল্লাহ্ সেই মর্যাদায় তাকে অধিষ্ঠিত করেন।
৭. পিতামাতার সম্মান প্রদর্শন করলে পরিবর্তীতে তারা যখন পিতামাতার স্থান দখল করবে তখন তাদেরকেও সম্মান করা হবে।
৮. পিতামাতার খেদমতে বালা মুসিবত দূর হয়ে যায় এবং হায়াত বৃদ্ধি পায়।
৯. পিতামাতার আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন করলে আল্লাহ্ রুজি রোজগারে বরকত দেন।
১০. পিতামাতার কারণে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করা যায়, গুনাহ্ মা’ফ হয় এবং জান্নাত নসীব হয়।
পৃষ্ঠা:১৩৮
লজ্জা ইসলামের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য
এক
عَنْ زَيْدِ بْنِ طَلْحَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّلِكُلِّ دِينِ خُلُقًا وَخَلْقُ الإِسْلامِ الْحَيَاء – যায়িদ বিন তালহা (রা) থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, প্রত্যেক দিনের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর ইসলামের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লজ্জাশীলতা।ইমাম মালিক এটিকে মুরসাল হিসেবে এবং ইবনে মাজা ও বাইহাকী যথাক্রমে হযরত আনাস (রা) ও হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন।
দুই
عن ابن عمر (رض) أَنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّالحياء والأيْمَانَ قُرنَاء جَمِيعًا فَإِذَا رَفَعَ أَحَدُهُمَا رَفع الآخر – আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- লজ্জা ও ঈমান একত্রে থাকে। তাদের একটিকে উঠিয়ে নিলে অপরটিকেও উঠিয়ে নেয়া হয়। (বাইহাকীঃ শু’আবুল ঈমান)ان- নিশ্চয়ই | كل ديعن। প্রত্যেক দীনের। – প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, চরিত্র। خُلق الأسلام – ইসলামের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। الحياء قُرنَاء جميعًا একত্রে থাকে। ত্রি- অতঃপর যখন। رفع উঠিয়ে নেয়া হয়। أحدهما- তাদের একটিকে। رفع الأخر অপরটিও উঠিয়ে নেয়া হয়।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হযরত আবদুল্লাহ্ (রা) ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা)-এর ছেলে এবং নবী করীম (সা)-এর সাহাবী।
পৃষ্ঠা:১৩৯
নবুয়াতের দ্বিতীয় বৎসরে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। পিতার মতো উঁচু স্তরের একজন আলিম ও বুজর্গ। তাছাড়া রাসূল প্রেম, সুন্নাহর অনুসরণ, আল্লাহভীতি, জিহাদ ও ইবাদাতের প্রতি উৎসাহ, বদান্যতা ও আত্মত্যাগ, অল্পেতুষ্টি ইত্যাদি ছিলো তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইবনে উমর (রা) প্রথম স্তরের একজন হাফিজে হাদীসে ছিলেন। তাছাড়া তাফসীর ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে ছিলো তাঁর অগাধ পান্ডিত্য। মর্যাদা ও পূর্ণতার এমন স্তরে তিনি সমাসীন ছিলেন, যা ছিলো অনেকের ঈর্ষার বন্ধু। হযরত আবু হুজাইফা (রা) বলতেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর ওফাতের পর প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু উমর এবং তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর কোন পরিবর্তন ঘটেনি। আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা)-এর খাদেম হযরত নাফে তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন, এ যুগে যদি ইবনে উমর বেঁচে থাকতেন, তাহলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তার কঠোরতা দেখে তোমরা বলতে- লোকটি পাগল।হিজরী ৭০ অথবা ৭৩ সনে ৮০ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন।তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সর্বমোট ১৬৩০টি তার মধ্যে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্যের হাদীস ১৭০টি। তাছাড়া ইমাম বুখারী এককভাবে ৮১টি এবং ইমাম মুসলিম ৩১টি হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন।
হাদীস দুটোর গুরুত্ব
লজ্জা ঈমানের পরিপূরক একটি বন্ধু। লজ্জা ছাড়া ঈমানকে পরিপূর্ণ করা সম্ভব নয়। আবার ঈমান ছাড়া লজ্জা সৃষ্টি হয় না। অন্যকথায় বলা যায়, যার মধ্যে লজ্জাশীলতা সবচেয়ে বেশী তার ঈমান ততো দৃঢ় মজবুত। ঈমানকে পরিপূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়া বা কাংখিত মানে উপনীতি করার জন্য লজ্জার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য যে, লজ্জা একমাত্র আল্লাহকেই করতে হবে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে লজ্জা করা নিষ্প্রয়োজন। শুধু নিষ্প্রেয়োজনই নয় তা এক ধরনের ভন্ডামীও বটে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে হাদীস দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাখ্যা
যে সত্তার ক্ষমতা, বৈশিষ্ট্য ও গুনাবলীর উপর ঈমান এনে একজন ব্যক্তি মুমিন হয়। প্রতিটি মুহূর্তে সেই সত্তাকেই হাজির নাজির জেনে তাঁর নিষিদ্ধ কথা, কাজ
পৃষ্ঠা:১৪০
ও পথ থেকে বিরত থাকার নাম লজ্জাশীলতা। একবার রাসূলুল্লাহ্ (সা) উপস্থিত শ্রোতামন্ডলীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা আল্লাহকে লজ্জা করো।’ শ্রোতামন্ডলী উত্তর দিলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্হামদুলিল্লাহ্, আমরা আল্লাহকে লজ্জা করছি।’ তখন তিনি বললেন-ليس ذلك ولكن الاستحياء مِنَ اللهِ حَقَّ الْحَيَاءُ أَنَّ تَحْفَظ الرأس وما وعى وَالْبَطْن وما حوى وَتَذْكُرَ الْمَوْتَ وَالْبَلى وَمَنْ أَرَادُ الآخِرَةَ تَرَكَ زِينَةَ الدُّنْيَا وَآثَارَ الْآخِرَةَ – فَمَنْ فَعَلَذلك فقد استحيا مِنَ اللهِ حَقَّ الْحَيَاء এটি (আসল লজ্জা) নয়, সত্যিকার লজ্জা হচ্ছে তুমি তোমার মন মগজে উত্থিত সমুদয় চিন্তা চেতনার হিফাযত করবে। কি খাদ্য দিয়ে পেট ভরেছো, তার দিকে দৃষ্টি রাখবে। মৃত্যু, মৃত্যু যন্ত্রণা এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা স্মরণ করবে। যে ব্যক্তি আখিরাতের সুখের আশায় পার্থিব জীবনের আরাম আয়েশ ও চাকচিক্য বিসর্জন দিয়ে সর্বদা আখিরাতকেই প্রাধান্য দেয়। যে এসব কাজ করে প্রকৃপক্ষে সেই আল্লাহকে লজ্জা করে। -(তিরমিযি)উপরোক্ত হাদীসে এতো পরিচ্ছন্ন ও সুন্দরভাবে লজ্জার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, এরপর আর কোন ব্যাখার প্রয়োজনই পড়েনা। পূর্ববর্তী জামানার আসমানী কিতাবে মানুষকে লজ্জা সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার ভাষা ছিলো- ‘যদি তোমার লজ্জাই না থাকে তবে তুমি যা খুশি তাই করতে পারো।’ (বুখারী)
অর্থাৎ যখন কোন ব্যক্তি (দল বা জাতি) ঈমান হারিয়ে ফেলে তখন তার সাথে সে লজ্জাও হারিয়ে ফেলে। এমতাবস্থায় শয়তান তার বন্ধু হয়। শয়তান যার বন্ধু হয় হেন কাজ নেই যা সে করতে পারেনা। পরিণামে তার ধ্বংস অনিবার্য। পক্ষান্তরে লজ্জা মানুষকে অন্যায় ও কুকর্ম থেকে বিরত রাখে, যার পরিণতি তার জন্য কল্যাণকরই হয়ে থাকে। নবী করীম (সা) বলেছেন-الْحَيَاءُ لَا يَأْتِي الأَبخَيْرٍ – –লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসেনা। (বুখারী, মুসলিম
পৃষ্ঠা ১৪১ থেকে ১৬০
পৃষ্ঠা:১৪১
সত্যি কথা বলতে কি, লজ্জা এবং ঈমান এ দুটো বন্ধু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের প্রদত্ত বিশেষ নিয়ামত সমূহের অন্যতম। এ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে চলে যাওয়া। আর আল্লাহর রহমত থেকে দূরে চলে যাওয়া মানে ধ্বংস অনিবার্য।
শিক্ষাবলী
১. লজ্জা ঈমানের পরিপূরক ২. ঈমান হচ্ছে লজ্জার উৎপত্তিস্থল ৩. একমাত্র আল্লাহকেই লজ্জা করতে হবে ৪. চিন্তা চেতনার পরিশুদ্ধি, উপার্জনে পরিচ্ছন্নতা, দুনিয়ার মোহ ত্যাগ এবং সর্বদা আখিরাত বা আল্লাহকে সামনে রেখে জীবন যাপন করার নাম লজ্জা ৫. লজ্জার গুরুত্ব পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবেও ছিলো ৬. লজ্জা কল্যাণের বাহক এবং লজ্জাহীনতা অকল্যাণের বাহক।
পৃষ্ঠা:১৪২
বিয়ে: একটি নৈতিক বন্ধন
এক
عنْ ابْنِ مَسْعُودٍ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وسلم يا معشر الشباب من استطاع مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوج فَإِنَّه أغضُ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِبِالصُّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وَجَاء –ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ের সামর্থ রাখে, তাদের বিয়ে করা উচিত। কেননা বিয়ে দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণকারী এবং যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ নেই, সে যেনো রোযা রাখে কারণ রোযা হবে তার ঢাল স্বরূপ। (বুখারী, মুসলিম)
দুই
عَنْ عَائِشَةُ (رض) قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ النِّكَاحُ مِنْ سُنَّتِي فَمَنْ لَّمْ يَعْمَلْ بِسُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي হযরত আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেন, বিয়ে করা আমার সুন্নাত (আদর্শ ও স্থায়ী নীতি), যে ব্যক্তি আমার এ সুন্নাত অনুযায়ী আমল করে না সে আমার দলভুক্ত নয়। (ইবনে মাজা)
শব্দার্থ
এক
يا معشر الشباب যুব সমাজ। مَنْ যে। اسْتَطَاعَ – সামর্থ রাখে। منكُمْ তোমাদের মধ্যে। اَلْبَاءَة – বিয়ের। فليتزوج যেনো সে বিয়ে করে ৩- অতঃপর নিশ্চয় তা। أغض للبصر দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণকারী।
পৃষ্ঠা:১৪৩
أحصن للفرج- লজ্জাস্থানকে সংরক্ষিত রাখে। لم يستطع – )যে) সক্ষম হবে না। فعليه بالصوم তার উচিত রোযা রাখা। – নিশ্চয়ই তা তার জন্য। وجاء ঢাল স্বরূপ।
দুই
الَتْও তিনি (মহিলা) বলেছেন। اَنْكَاحُ বিয়ে। من سنتى – আমার সুন্নাত (আদর্শ ও স্থায়ী নীতি। لم يعمل- যে আমল করবে না। بسنتی আমার সুন্নাত (কে( فليس منی সে আমার দলভুক্ত নয়।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ: ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থায় যে কজনমুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) তাদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের দিক থেকে তিনি ৬ষ্ঠ মুসলিম। তাঁর পিতার নাম মাউদ আর মায়ের নাম উম্মে আবদ। তাঁকে ইবনে উম্মে আবদও বলা হয়। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন মক্কা নগরীতে নবী করীম (সা) ছাড়া আর কেউ উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করার সাহস পেতেন না। ইবনে মাসউদ (রা) মক্কার প্রথম মুসলমান যিনি কুরাইশদের পক্ষ থেকে মারাত্মক বিপদের আশংকা সত্ত্বেও উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। অবশ্য এজন্য তাকে কঠোর নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে তাঁকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে। হয়েছে। অতঃপর রাসূলে করীম (সা)-এর মদীনায় হিজরতের পর তিনি মদীনায় চলে আসেন। ইবনে মাসউদ (রা) সর্বদা ছায়ার মতো রাসূল (সা)-কে অনুসরণ করতেন এবং তাঁর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন। আবু মুসা আশয়ারী (রা) বলেন, ‘আমরা ইয়েমেন থেকে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসউদকে নবী পরিবারের লোক বলে মনে করতাম।’আবদুল্লাহ্ ইবনে মাউদ (রা) একজন বিজ্ঞ আলিম ছিলেন। তিনি কুরআন হাদীস, ফিকাহ্ ইত্যাদি সব বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। মদীনায় যে ক’জন সাহাবী ফতোয়া দিতেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কুরআন শিক্ষায় তিনি বিশেষ
পৃষ্ঠা:১৪৪
পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। নবী করীম (সা) বলেছেন, ‘কুরআন শরীফ যেভাবে নাযিল হয়েছে হুবহু সেভাবে যদি কেউ পড়তে চায় সে যেন আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের কাছে যায়।’জ্ঞানের এ বিশাল মহীরুহ হিজরী ৩২ অথবা ৩৩সনের ৮ অথবা ৯ই রমযান মদীনায় ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬০ বৎসর কিংবা তারচেয়ে সামান্য বেশী। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখা মোট ৮৪৮টি। ৬৪টি হাদীস ইমাম বুখারী ও মুসলিম সম্মিলিতভাবে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী এককভাবে ২১৫টি এবং ইমাম মুসলিম ৩৫টি হাদীস বর্ণনা করেছেন।
ব্যাখ্যা
বিয়ের গুরুত্ব: মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই যে যৌন মিলনের স্পৃহাবিদ্যমান, তা পরিপূরণ ও চরিতার্থের সুষ্ঠ ব্যবস্থা কল্পে বিয়ে করে সুষ্ট জীবন যাপন করা বয়স্ক (সক্ষম) স্ত্রী পুরুষের জন্য কতর্ব্য। এতে যেমন সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন সম্ভব তেমনিভাবে যৌন মিলনের অদম্য ও অনিবার্য স্পৃহাও সঠিকভাবে এবং পূর্ণ শৃংখলা ও নির্ভেজাল পরিতৃপ্তির সাথে পূরণ হতে পারে। ইসলামে নারী পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র বৈধ উপায়ই হচ্ছে বিয়ে। এটি নবী রাসূলদের সুন্নাত (আদর্শ ও স্থায়ী নীতি)। নবী করীম (সা) বলেছেন-أَرْبَعُ مِنْ سُنَنِ الْمُرْسَلِينَ التَّعْطرُ وَالنِّكَاحُ وَالسَّوَاكَ وَالْخِتَانُ চারটি কাজ নবী রাসূলদের সুন্নাতের মধ্যে গণ্য, ১. সুগন্ধি ব্যবহার করা। ২. বিয়ে করা। ৩. মিসওয়াক করা। এবং ৪. খাতনা করানো। (আহমদ, তিরমিযি)হযরত আনাস (রা) বলেছেন-كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْمُرُنَا بِالْبَاءَةِ وَيَنْهَى عَنِ
التَّيَتْلِ نَهْيَا شَدِيدًا – -1 নবী করীম (সা) আমাদেরকে বিয়ে করতে নির্দেশ দিতেন। আর অবিবাহিত নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করা থেকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিষেধ করতেন। -(মুসনাদে আহমদ)
পৃষ্ঠা:১৪৫
বিয়ের উদ্দেশ্য: পৃথিবীতে কোন কাজই উদ্দেশ্য ছাড়া সম্পাদিত হয় না। চাই তা পার্থিব উদ্দেশ্য হোক অথবা পরকালিন। তদ্রূপ বিয়েরও কিছু উদ্দেশ্য আছে। নিচে তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১. ঈমান ও চরিত্রের সংরক্ষণঃ মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন- و أُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ
مُسَافِحِينَ – —এ সমস্ত মুহাররম স্ত্রীলোক ছাড়া অন্য সব মেয়েদের বিয়ে করা তোমাদের জন্য বৈধ। কেননা তোমরা তাদেরকে তোমাদের ধনসম্পদের বিনিময়ে গ্রহণ করবে এবং লাগামহীন অবাধ যৌনচর্চা থেকে বিরত থেকে নিজেদের চরিত্রকে অজেয় দূর্গের মতো সুরক্ষিত রাখবে। (সূরা নিসাঃ ২৪)
এ আয়াতে বিয়েকে حصن বা দূর্গ বলা হয়েছে। কারণ দূর্গ যেমন মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা তেমনিভাবে বিয়েও মানুষের নৈতিক চরিত্রের একমাত্র রক্ষাকবচ। আল্লামা রাগিব ইস্পাহানী আল মুফরাদাতে লিখেছেন-ی سمى النكاح حصنا لكونه حصنا لذويه عن تعاطى القبيح ‘বিয়েকে দূর্গ বলা হয়েছে কারণ তা স্বামী স্ত্রীকে সকল প্রকার নৈতিকতা বিরোধী ও যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে দূর্গবাসীদের মতোই বাঁচিয়ে রাখে।’
নবী করীম (সা) বলেছেন-من أراد أن يلقى الله طاهرا مظهرًا فَلْيَتَزَوجِ الْحَرَائِر – যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন পাক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন চরিত্র নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার বাসনা রাখে, তার কর্তব্য হচ্ছে স্বাধীন মহিলাকে বিয়ে করা। (ইবনে মাজা)
২. যৌন সম্ভোগের বৈধ অনুমতি: মানুষ পৃথিবীতে যতোদিন বেঁচে থাকে ততোদিনই তার খাদ্য ও পানীয়ের প্রয়োজন হয়। এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক দাবী। তেমনি প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি মানব মানবীর যৌন চাহিদা পূরণ করার বাসনা বা তা চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা, প্রকৃতিগত বিধানের ই অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে অস্বীকার
পৃষ্ঠা:১৪৬
করা মূলত স্রষ্টার বিধানকে অস্বীকার করার নামান্তর। আল্লাহর গোটা সৃষ্টির মধ্যে যাদেরকে আমরা জীব বলি তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই এ যৌন চাহিদা বিদ্যমান। অবশ্য আল্লাহর নির্ধারিত বিধান (System) এর বাইরে এর চর্চা করার কোন ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে মানুষের সে স্বাধীনতা আছে। তাই তারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তা সমাধানের চেষ্টা করে, ফলে সমাজ ও নৈতিক জীবনে দেখা দেয় বিশৃংলা, অবক্ষয়। এজন্যই মহান আল্লাহ্ সকল পদ্ধতিকে অবৈধ ঘোষণা করে কেবল মাত্র একটি পদ্ধতিকে বৈধ ঘোষণা করেছেন। সে পদ্ধতির নাম বিয়ে।৩. অবৈধ প্রেম ও উচ্ছৃঙ্খলতার নির্মূলঃ মানুষের চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। যতো পায় ততো চায়। ধন সম্পদ সংগ্রহের মতো তারা যৌনস্পৃহাও লাগামহীনভাবে পূরণ করতে চায়, তাই তারা কলগার্ল, বারবণিতা, অফিস সেক্রেটারী, পি,এ, বান্ধবী, প্রেমিকা ইত্যাদি কত চটকদার শব্দের সৃষ্টি করেছে। ইসলাম এ ধরনের যৌন উচ্ছৃঙ্খলতাকে নির্মূল করার লক্ষ্যে একাধিক বিয়ের অনুমতি দিয়েছে, তবু এগুলো বরদাশত করেনি। ৪. মানবিক তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভের উপায়ঃ ইরশাদ হচ্ছে-و من ايته أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا – –এবং আল্লাহ্র এক বড়ো নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই জুড়ি গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যেনো তোমরা সে জুড়ির কাছ থেকে মানসিক তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করতে পারো। (সূরা রুম: ২১) হযরত হাওয়া ও হযরত আদম (আ) এর যখন প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন আদম (সা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? তিনি বললেন-حوا – خلقني الله لتسكن إلى واسكن اليك – আমি হাওয়া, আমাকে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন এ উদ্দেশ্যে যে, তুমি আমার নিকট পরিতৃপ্তি, শান্তি ও স্বস্তি লাভ করবে, আর আমি পরিতৃপ্তি ও শান্তি লাভ করবো তোমার কাছ থেকে। (উমদাতুল কারী, ৫ম খন্ড ১২৫ পৃ) এখানে পরিতৃপ্তি ও শাস্তি বলতে যৌন উত্তেজনায় পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তিকে বুঝানো হয়েছে।
পৃষ্ঠা:১৪৭
৫. সন্তান লাভ করা: স্বামী স্ত্রীর যৌন মিলনের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সন্তান লাভ করা। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন- فَلْتَنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوْ مَا كَتَبَ اللهُ لَكُمْ . এখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হও এবং আল্লাহ্ তোমাদের জন্য যা কিছু নির্ধারিত করে দিয়েছেন তোমরা তা লাভ করার চেষ্টা করো। (সূরা বাকারাঃ ১৮৭)
অন্যত্র বলা হয়েছে – نِسَاءُ كُمْ حَرْثَ لَكُمْ স্ত্রীরা তোমাদের ক্ষেত স্বরূপ (সূরা বাকারাঃ ২২৩) নবী করীম (সা) বলেছেন- تزوجوا الْوَلَوْدَ تَنَا سَلُوا فَإِنِّي مُبَاهِ بِكُمُ الأمم يَوْمَ الْقِيَامَةَ – যে সব মেয়ে অধিক সন্তান প্রসব করে তোমরা তাদেরকে বিয়ে করো এবং বংশ বাড়াও। কারণ কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্যতা নিয়ে অন্যান্য নবীর উম্মতের তুলনায় গর্ব করবো। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩য় খন্ড-২৮৬ পৃ) কাদেরকে বিয়ে বৈধ নয়?
৮টি সূত্রের ভিত্তিতে ইসলাম মহিলাদেরকে বিয়ে করা হারাম ঘোষণা করেছে। যথা:
১. নসব বা জন্মসূত্রঃ নসব বা জন্মসূত্রে মোট ৭ প্রকার মহিলাদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ। তারা হচ্ছে মা, কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইয়ের মেয়ে ও বোনের মেয়ে।
২. মুসাহির বা বৈবাহিক সম্পর্ক: বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে কতিপয় মহিলাকে বিয়ে করা হারাম। যেমন- স্ত্রীর মা, পিতার স্ত্রী, পুত্র বধু, স্ত্রীর (অন্য স্বামীর ঔরসজাত) কন্যা।
৩. রিযায়াত বা দুধপানের সম্পর্ক: রিযায়াত বা দুধপানের কারণে কতিপয় মহিলাকে বিয়ে করা হারাম। যেমন দুধমা, দুধবোন ইত্যাদি।
৪. দুই মুহরিমকে একত্রে বিয়ে করা: এমন দু’জনকে একত্রে বিয়ে করা হারাম। যাদের একজনকে পুরুষ কল্পনা করলে তারা পরস্পর পরস্পরের জন্য হারাম হয়ে যায়। যেমন- ফুফু ভাইঝিকে একত্রে বিয়ে করা ইত্যাদি।
পৃষ্ঠা:১৪৮
৫. অন্যের হক থাকার কারণে: এমন স্ত্রীলোককেও বিয়ে করা হারাম যার উপর
অন্য পুরুষের হক আছে। যেমন- ইদ্দত পালনকারী মহিলা, অপরের বিবাহধীনে থাকা মহিলা ইত্যাদি।
৬. অগ্নিপূজক ও পুত্তলিক মহিলা: যতোক্ষন পর্যন্ত কোন অগ্নিপূজক অথবা
পুত্তলিক মহিলা ঈমান না আনবে ততোক্ষণ কোন মুসলিম তাদেরকে বিয়ে করতে পারবে না। আবার কোন মনিব তার দাসকে মুক্ত না করে বিয়ে করতে পারে না।
৭. তানাফী বা পরস্পর বিপরীত হওয়া: সামাজিক অবস্থানে যদি পরস্পরবিপরীত মেরুতে অবস্থান করে তবে তাদেরকেও বিয়ে করা হারাম। যেমন কোন মনিব ক্রীতদাসীকে মুক্ত না করে বিয়ে করতে পারে না। আবার কোন মনিব তার দাসকে মুক্ত না করে বিয়ে করতে পারে।
৮. ব্যভিচারের কারণে: যে স্ত্রীলোকের সাথে ব্যভিচার করা হয়েছে তার মা এবং কন্যাকে বিয়ে করা হারাম। কোন ব্যভিচারী মহিলাকে শাস্তি প্রদানের পরও কোন সৎ চরিত্রের লোক তাকে বিয়ে করতে পারবে না। নবী করীম (সা) বলেছেন- ازانية لا ينكحها الأذان أو مشرك . ব্যভিচারী কোন মহিলাকে ব্যভিচারী কোন পুরুষ অথবা মুশরিক ছাড়া কেউ বিয়ে করবে না। (মুসনাদে আহমদ) বিয়ের প্রস্তাব: ইসলামের উপস্থাপিত পারিবারিক বিধানে বিয়ের প্রস্তাব প্রথমে বরপক্ষ অথবা কনে পক্ষের যে কোন একজন উত্থাপন করতে পারে। এতে লজ্জা শরম বা মান-অপমানের কোন কারণ নেই। তাছাড়া বর অথবা কনে নিজেও নিজের বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে একজনের প্রস্তাব বিবেচনাধীন থাকাবস্থায় অন্য কারো প্রস্তাব পাঠানো ঠিক নয়। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- لا يَخْطُبُ الرَّجُلُ على خطبة أخيه حتى ينكح أو يترك – —-কেউ তার ভাইয়ের পাঠানো প্রস্তাবের উপর নতুন প্রস্তাব পাঠাবে না। যতোক্ষণ না সে বিয়ে করে অথবা তা প্রত্যাহার করে। (বুখারী)বিয়ের পূর্বে কনে দেখাঃ দাম্পত্য জীবন যাতে সুন্দর ও সুখের হয়, সেজন্য বিয়ের পূর্বেই দেখে শুনে মনের মতো একজন পাত্রী পছন্দ করার সুযোগ ইসলাম দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-
পৃষ্ঠা:১৪৯
فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ “তোমরা মেয়েদের থেকে (দেখে শুনে) যাকে পছন্দ তাকেই বিয়ে করো।” মুগিরা ইবনে শুবা (রা) তাঁর নিজের বিয়ে প্রসঙ্গে রাসূলে কারীম (সা)-এর সাথে আলাপ করলে, তিনি বললেন- فَانْظُرْ إِلَيْهَا فَإِنَّهُ أَخْرَى أَنْ يُو دَمَ بَيْنَكُمْ – —তবে কনেকে দেখে নাও। কারণ তাকে বিয়ের পূর্বে দেখে নিলে তোমাদের মধ্যে স্থায়ী ভালোবাসার সূত্রপাত হবে। (তিরমিযি) বিয়ের সময় বর কনেকে সাজানো ও তাদের গায়ে হলুদ মাখা: বিয়ের সময় বর কনেকে সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদ এবং অলংকারদি দিয়ে সাজানো এবং তাদের গায়ে হলুদ দেয়া ইসলামী শরীয়াতে সম্পূর্ণ জায়েয। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) একদিন নবী করীম (সা)-এর কাছে এলেন, তাঁর গায়ে হলুদের চিহ্ন লাগানো ছিলো। তিনি তার কারণ জিজ্ঞেস করলে আবদুর রহমান (রা) জানালেন, তিনি আনসার বংশের এক মহিলাকে বিয়ে করছেন (এবং এ বিয়েতে লাগানো হলুদের রঙই তার গায়ে লেগে আছে।) (বুখারী) নবী করীম (সা) এ ঘটনা শুনে তাকে (হলুদের জন্য) অপছন্দও করেননি অথবা তিরস্কারও করেননি। দেন মোহরঃ দেন মোহর হচ্ছে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ ভোগের বিনিময়ে স্ত্রীকে কিছু পরিমাণ মাল সম্পদ প্রদানের নাম। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-
فَمَا اسْتَتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَاتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً . তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে যে যৌন স্বাদ গ্রহণ করো, তার বিনিময় তাদের (মোহর)-কে ফরয মনে করে আদায় করো। (সূরা নিসাঃ ২৪) দেন মোহর সংক্রান্ত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল আরাবী বলেছেন, “এসব আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, মোহর দেয়া সকল বিয়েতে সকল অবস্থায়ই ফরয। এমনকি বিয়ের সময় যদি ধার্য করা নাও হয় তবু সে স্ত্রীর সাথে যৌন মিলনের সাথে সাথে মোহর প্রদান ফরয হয়ে যাবে। নবী করীম (সা) বলেছেন- (আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃ-৩৯৭)
পৃষ্ঠা:১৫০
أيُّما رجل أَصْدَقَ امْرَأَةً صَدَاقًا وَاللَّهُ يَعْلَمُ أَنَّهُ لَا يَزِيدُ آدَمَهُ إِلَيْهَا فَغَرَّهَا بِالله وَاسْتَحلَّ فَرَجَهَا بِالْبَاطِلِ لَقَى اللَّهَ يَوْمَ يَلْقَاهُوهو زان —–যে লোক তার স্ত্রীর জন্য কোন (পরিমাণ) মোহর ধার্য করবে, কিন্তু আল্লাহ জানেন, তা আদায় করার ইচ্ছে তার নেই। ফলে সে আল্লাহর নামে নিজ স্ত্রীকে প্রতারিত করলো এবং অন্যায়ভাবে ও বাতিল পন্থায় নিজ স্ত্রীর যৌনাঙ্গ নিজের জন্য হালাল মনে করে ভোগ করলো, সে লোক আল্লাহর সাথে ব্যভিচারী হিসেবে সাক্ষাৎ করবে। (মুসনাদে আহমদ) বিয়ের অনুষ্ঠানঃ বিয়ে একটি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান। কাজেই বিয়ের খবর সমাজের লোকদেরকে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যেনো তারা নৈতিক সমর্থন দেবার সুযোগ পায়। এজন্য গোপন বিয়েকে ইসলাম অনুৎসাহিত করেছে। যদিও তা ইসলামের পদ্ধতিতেই হোক না কেন। নবী করীম (সা)
বলেছেন-أَعْلِنُوا هَذَا النكاح واجْعَلُوهُ فِي الْمَسَاجِدِ وَضَرِبُوا عَلَيْهِ بِا الدفوف – —এ বিয়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার করো এবং (সাধারণত) এর অনুষ্ঠান মসজিদে সম্পন্ন করো। আর এ সময় দফ বাজাও। বুখারী শরীফের ভাষ্যকার আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেন- اتَّفَقَ الْعُلَمَاء عَلَى جَوَازِ اللَّهُوَ فِي وَلِيمَةَ النِّكَاحِ كَضَرْبِ الدُّفْ وشبهه وخصت الْوَلِيمَةُ بذلك لِيُظهر النِّكَاحَ وَيُنْتَشَرَ فَيَثْبَتُ حقوقه وحرمته বিয়ে অনুষ্ঠানে দফ বা অনুরূপ কোন বাদ্য বাজানো জায়েয হওয়া সম্পর্কে সমস্ত
পৃষ্ঠা:১৫১
উলামায়ে কিরাম একমত। আর বিয়ে অনুষ্ঠানের সাথে এগুলোর যোগের কারণ হচ্ছে, এতে বিয়ের কথা প্রচার হবে ও এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে বিয়ে সংক্রান্ত যাবতীয় অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। (উমদাতুলকারী খন্ড-২০ পৃষ্ঠা- ১৫০)নবী করীম (সা) কর্তৃক দেয়া পরামর্শ আমাদের জন্য ফরয বা ওয়াজিব নয়। তবু এর যথেষ্ট তাৎপর্য ও প্রয়োজন আছে। তবে অশ্লীল নাচ গানের আসর জমানো কিংবা বাড়ির যুবক যুবতীদের সীমা লংঘকারী আনন্দ উল্লাস এবং যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধিকারী কোন অনুষ্ঠান কিছুতেই সমর্থন যোগ্য নয়।ওয়ালীমা বা বিবাহভোজ: ওয়ালীমা )وليمة( শব্দের অর্থ হচ্ছে একত্রিত করা। যেহেতু বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয় স্বজন ও পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের একত্রিত করা হয় সেজন্য আরবীতে একে ওয়ালীমা বলা হয়। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন- الْوَلِيمَةُ حَقٌّ وَسُنَّةً فَمَنْ دُعِي وَلَمْ يَجِبُ فَقَدْ عَصَ – ওয়ালীমা বা বিবাহভোজ হচ্ছে একটা অধিকারের ব্যাপার, ইসলামের স্থায়ী নীতি। কাজেই যাকে এ অনুষ্ঠানে শরীক হওয়ার দাওয়াত দেয়া হবে, সে যদি উপস্থিত না হয়, তাহণে সে নাফরমানী করলো। (তাবারানী) মআবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা)-কে বিয়ের পর রাসূলে কারীম (সা) বললেন- بارك اللهُ لَكَ أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ —আল্লাহ্ একাজে তোামকে বরকত দিন। এখন তুমি একটি বকরী দিয়ে হলেও ওয়ালীমা (প্রীতিভোজ) করো। (বুখারী, মুসলিম) ইমাম বায়হাকী বলেছেন- لا أَعْلَمُ أَنَّهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَرَكَ الْوَلِيمَةَ. রাসূলে কারীম (সা) বিয়ের পর ওয়ালীমা করেননি, এ ঘটনা আমার জানা নেই। (বলুগুল মারামের ভাষ্যগ্রন্থ সুবুলুস সালাম খন্ড-৩, পৃ-১৫৩) নবী করীম (সা) আরো বলেছেন- ششَرُّ الطَّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ تُدْعَى لَهَا الْأَغْنِيَاءُ وَتُتْرَكَ الفقراء –
পৃষ্ঠা:১৫২
সেই ওয়ালীমা হচ্ছে নিকৃষ্ট, যেখানে কেবলমাত্র ধনীদেরকে দাওয়াত করা হয় এবং গরবীদের বাদ দেয়া হয়। (বুখারী, মুসলিম) বর কনেকে উপহার দেয়া: বিয়ের সময় কনেকে বা বরকে কিছু উপহার দেয়া ইসলামী শরীয়াতে সম্পূর্ণ বৈধ। শুধু বৈধই নয়- সুন্নাতও। তবে শর্ত হচ্ছে কন্যার পিতা তার তওফিক অনুযায়ী খুশীমনে যা প্রদান করবে তার চেয়ে বেশী নেয়া বা দাবী করা যাবেনা। যদি কেউ করে তবে তা অভিশপ্ত যৌতুকের পর্যায়ে গন্য হবে। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, কন্যার গুনাবলী ও রূপ যৌবনে আকৃষ্ট হয়েই বিয়ে করা হয়। কোন ধন সম্পদের লোভে তাকে বিয়ে করা বৈধ নয়। কাজেই যারা এ অবৈধ কাজকে বৈধ বলে মনে করে তারা ইসলামের সীমার মধ্যে থাকতে পারেনা। বিয়ের পর প্রকাশিত ত্রুটির কারণে বিয়ে প্রত্যাহার: বিয়ের পর যদি স্বামী
নিশ্চিতভাবে জানতে পারে, স্ত্রী শারিরীক বা মানসিক জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত যা সহজে ভাল হবার নয়। তখন সে বিয়ে প্রত্যাহার করতে পারে। ইসলাম তাকে এ অধিকার দিয়েছে। চিরদিনের জন্য এক দূর্বহ বোঝা তার বহন করতে হবে এমন কোন কথা ইসলাম বলেনা। তবে প্রথম অবস্থায়ই তা করা বাঞ্ছনীয়। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে- إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَزَوَّجَ امْرَأَةً مِنْ بَنِي غفَارٍ – فَلَمَّا دَخَلَ عَلَيْها فوضع ثوبه وقَعَدَ عَلَى الْفِرَاشِ أَبصر بكشحها بِيَاضًا فَانْحَازَ عَنِ الْفِرَاشِ ثُمَّ قَالَ خُذِى عَلَيْكَ نِيَابَكَ وَلَمْ يَأْخُذُ بِمَا أَتَاهَا شَيْئًا – (مسند احمد) —একবার নবী করীম (স) বনী গিফার গোত্রের এক মহিলাকে বিয়ে করে ফুল শয্যার সময় যখন তার কাছে উপস্থিত হলেন এবং তার কাপড় উত্তোলন করে শয্যার উপর বসলেন, তখন তিনি মহিলার পাঁজরে শ্বেত রোগ দেখতে পেলেন। সাথে সাথে তিনি শয্যা থেকে উঠে গেলেন এবং বললেন, ‘তোমার কাপড় সামলাও।’ অতঃপর তিনি তার থেকে নিজের দেয়া কিছু গ্রহণ করলেন না। এ পর্যায়ে আলী (রা) ও অন্যান্য সাহাবা থেকে যে কথাটি বলা হয়েছে। তা হচ্ছে-
পৃষ্ঠা:১৫৩
لا تُرَدُّ النِّسَاء الأ بأربعة عيوب الْجُنُونَ وَالْجَزَامُ وَالْبَرْضِ وَالدَّاءُ فِي الْفَرْج – চারটি কারণে বিয়ে প্রত্যাহার করা যেতে পারে। যথা- ১. পাগলামী ২. কুষ্ঠ রোগ ৩. স্বেত রোগ ৪. যৌনাঙ্গের কোন রোগ। (নাইলুল আওতার)। এ আইন স্ত্রীদের বেলায় যেমন প্রযোজ্য তেমন পুরুষদের বেলায়ও প্রযোজ্য।ইসলাম মানুষের নৈতিক ও সামাজিক জীবনে বিপ্লব সৃষ্টির লক্ষ্যে যে সব বিধি বিধান জারী করেছে। তার মেধ্য বিয়ে হচ্ছে অন্যতম। কেননা বিয়ের মাধ্যমেই নৈতিক ও সামাজিক জীবনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে তা আদর্শ ইসলামী সমাজের রূপ নেয়। এজন্য ইসলাম বিয়ের এতো গুরুত্ব দিয়েছে।
পৃষ্ঠা:১৫৪
ইসলামের দৃষ্টিতে কন্যা সন্তান প্রতিপালন
عن نبيط بن شريط قال سمعت رسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِذا ولد للرَّجُلِ ابْنَةُ بَعَثَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ مَلَئِكَةٌ يقُولُونَ السَّلامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْبَيْتِ يَكْتَنفُوْنَهَا اللهُ بأجنحتهم ويمسحون بأيديهم عَلَى رَأْسِهَا وَيَقُولُونَ ضَعِيفَةً خَرَجَتْ مِنْ ضَعِيفَةِ الْقَيِّمُ عَلَيْهَا مُعَانُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةَ (المعجم الصغير للطبراني) নাবীত ইবনে শুরাইত (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি, যখন কোন ব্যক্তির কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সেখানে আল্লাহ্ (একদল) ফেরেশতা পাঠান। তারা বলে, হে ঘরের অধিবাসীগণ। তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তারা কন্যা সন্তানটিকে ডানার ছায়ায় ঢেকে নেয় আর -তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে এবং বলে, একটি অবলা জীবন থেকে আরেকটি অবলা জীবন ভূমিষ্ট হয়েছে। এর তত্ত্বাবধায়নকারী কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হবে। (মু’জামুস সগীর, তাবারানী)।
শব্দার্থ
سمعت – আমি শুনেছি : يَقُوْلُ তিনি বলেছেন।১। যখন। ঐ জন্মগ্রহণ করে। للرجل ابنۀ – কোন ব্যক্তির কন্যা সন্তান। بث الله আল্লাহ্ পাঠান। عز وجل – মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ নামের সাথে সম্পৃক্ত করে বলা হয়।) – ফেরেশতাগণ। একবচনে। – – يقُلُون – তারা বলে। السّلامُ عَلَيْكُمْ – তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। يَا أَهْلَ الْبَيْتِ ঘরের অধিবাসীগণ ! يكتنفونها তারা তাকে ঢেকে নেয়।بأجنحتهم -তারা তাদের ডানা দিয়ে। يمسحون بأيديهم على رأسها – তারা মাথায় হাত
পৃষ্ঠা:১৫৫
বুলিয়ে দেয়। ضعيفة – দূর্বল, অবলা। خرجت-বের হয়েছে। من- হতে। القيم – বলবত থাকবে, অব্যাহত থাকবে। عليه তার উপর। معانঅনুগ্রহ, সাহায্য | إلى يوم القيامة- কিয়ামত পর্যন্ত।
হাদীস এর পটভূমি
প্রাক ইসলামিক যুগে বিভিন্ন দেশে সন্তান হত্যার প্রচলন ছিলো। তারমধ্যে আরব, রোম ও ভারতে এর প্রচলন ছিলো বেশী। প্রকাশ্যে সন্তানদের হত্যা করা হতো। এর কোন বিধি নিষেধ ও বিচার আচার ছিলোনা। তিনটি কারণে তারা সন্তানদের হত্যা করতো।
১. একদল লোক মনে করতো সন্তান হত্যা করে দেবদেবীকে খুশী করতে পারলে ইত্কালিন ও পরকালিন কল্যাণ লাভ করতে পারবে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা একে ধর্মীয় কাজ মনে করে সন্তান হত্যা করতো।
২. কিছু লোক মনে করতো বেশী সন্তান হলে তারা তাদের রুটি রুজিতে অংশীদার হয়ে যাবে ফলে নিজেরা অভাব অনটনে পতিত হবে। এভয়ে বা অর্থনৈতিক কারণে তারা সন্তান হত্যা করতো। এর প্রতিবাদ করে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন- ولا تَقْتُلُوا أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ امْلاقَ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَ إِيَّاكُمْ দারিদ্রতার ভয়ে নিজেদের সন্তানকে হত্যা করো না। আমরা যেভবে তোমাদের রিযিক দেই তেমনিভাবে তাদেরও রিযিক দেবো। (সূরা বনী ইস্রাঈল: ৩১) ৩. তৃতীয় দল ছিলো আরো নিষ্ঠুর ও নির্মম। তারা কন্যা সন্তানকে অপমান ও অমর্যাদার প্রতীক মনে করতো, কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে লজ্জায় তাদের মাথা হেট হয়ে যেতো। মুখ হয়ে যেতো কালো। তখন তারা এ অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য তাদেরকে জীবন্তাবস্থায় মাটিতে পুঁতে ফেলতো। তাদের এ অবস্থার কথা মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আল কুরআনে নিম্নোক্তভাবে তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হচ্ছে- و إِذا بشر أحدهم بالأثنى ظل وجهه مسودًا وَهُوَ كَظِيمٌ
পৃষ্ঠা:১৫৬
يتورى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوْءٍ مَا بُشِّرَ بِهِ (ط) أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُوَن أم بدسه في التراب – যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তান জন্মের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কালো বিবর্ণ হয়ে যায়। তখন সে শুধু ক্রোধের রক্ত পান করে এবং লোকদের থেকে পালিয়ে বেড়ায় এই ভেবে যে, এ খবরের পর লোকদেরকে সে কিভাবে মুখ দেখাবে? সে চিন্তা করে, এতো অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করে কন্যাকে রেখে দেবে না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? (সুরা নাহল: ৫৭-৫৮)তারা যে কত নীচ এবং হীন ছিলো তার দুটো উদাহরণ নিচে দেয়া হলো। একবার এক সাহাবী তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নবী করীম (সা) কে এমন এক ঘটনা শুনালেন, যা শোনে তিনি অস্থির হয়ে গেলেন।বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার এক কন্যা ছিলো। সে আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতো। যখন আমি তাকে ডাকতাম, সে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসতেন। একদিন আমি তাকে ডাকলাম, সে খুশীতে ডগমগ হয়ে দৌড়ে চলে এলো। আমি তাকে নিয়ে পথ চলতে লাগলাম। আমি আগে আগে চললাম এবং সে আমার পিছু পিছু দৌড়ে আসতে লাগলো। আমার বাড়ী থেকে একটু দূরে একটি পরিত্যাক্ত কূপ ছিলা, আমি সেখানে গিয়ে থেমে গেলাম। মেয়েটিও আমার কাছে এসে থামলো। এরপর আমি তার হাত ধরে উঠিয়ে সেই কূপে ফেলে দিলাম। নিষ্পাপ মেয়ে কূপের ভেতর চিৎকার করতে লাগলো এবং অত্যন্ত দরদমাখা কণ্ঠে আমাকে আব্বু! আব্বু!! বলে ডাকতে লাগলো। ইয়া রাসূলুল্লাহ্। সে ডাকই ছিলো তার জীবনের শেষ আওয়াজ। এ ঘটনা শোনে দয়াল নবী কাঁদতে লাগলেন এবং তাঁর চোখের পানিতে দাঁড়ি মোবারক ভিজে যেতে লাগলো। (দারেমী)দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে বনী তামিম গোত্রের। এ গোত্রের সর্দার কায়েস বিন আসেম (রা) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তিনি তাঁর নিষ্পাপ শিশুকন্যাকে স্বহস্তে দাফন করার হৃদয় বিদারক ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! একবার আমি সফরে থাকাবস্থায় আমার এক কন্যা সন্তান জন্ম নিলো। অবশ্য আমি বাড়ী থাকলে তার আওয়াজ পাওয়া মাত্রই তাকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতাম। যা হোক তার মা তাকে কয়েকদিন যেনতেন ভাবে প্রতিপালন করলো।
পৃষ্ঠা:১৫৭
কয়েকদিনের মধ্যেই মায়ের মমতা প্রচন্ড রূপ ধারণ করলো। তখন সে আমায় ভয়ে তার কন্যাটিকে খালার নিকট পাঠিয়ে দিলো। তার ধারণা ছিলো সেখানে মেয়ে বড়ো হয়ে যখন বাড়ী ফিরবে তখন দেখে পিতার মনেও দয়ার উদ্রেগ হবে। আমি সফর থেকে যখন ফিরলাম তখন আমাকে জানানো হলো, একটি মৃত শিশু জন্ম নিয়েছিলো। তখনকার মতো ঘটনার এখানেই যবনিকাপাত হলো। এদিকে মেয়েটি তার খালার আদর যত্নে বেশ বড়ো হয়ে গেল। একদিন আমি কোন প্রয়োজনে সফরে গেলাম। মেয়ের মা মনে করলো, পিতা যখন বাড়ীতে নেই তখন মেয়েটিকে আমার কাছে এনে রাখলে ক্ষতি কি, এই ভেবে সে তাকে বাড়ী নিয়ে এলো। দূর্ভাগ্য আমিও তখন বাড়ী ফিরে এলাম। দেখলাম এক অনিন্দ্য সুন্দর শিশুকন্যা আমার বাড়ীর আঙ্গিনায় দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করছে। আমার অন্তরেও ভালোবাসা উথলে উঠলো। স্ত্রী ও ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো যে, সুপ্ত পিতৃস্নেহ জেগে উঠেছে এবং রক্তের প্রভাব রঙ নিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, নেকবখত্। মেয়েটি কার? অত্যন্ত সুন্দর মেয়েতো?একথা শোনে স্ত্রী সব ঘটনা বললো। আমিও বিনা দ্বিধায় মেয়েটিকে গলায় জড়িয়ে ধরলাম। মা তাকে বললো, এ তোমার আব্বু। মেয়ে আমাকে জাপটে ধরলো। পিতৃস্নেহ পেয়ে সে এতোটা আহলাদিত হয়ে ছিলো যে, সে আমাকে আব্বু! আব্বু!! বলে মুখে মুখ লাগাতো। কোথাও থেকে এলে আব্বু বলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরতো। এতে আমি অনাবিল শান্তি অনুভব করতাম। এভাবে দিন যেতে লাগলো এবং আমিও মাঝে মাঝে চিন্তামগ্ন হয়ে যেতাম, এর কারণে আমাকে শ্বশুর হতে হবে, আমার কন্যা কারো বৌ বা স্ত্রী হবে। আমি মানুষের কাছে মুখ দেখবো কিভাবে? আমার ইজ্জতও ধূলোয় মিশে যাবে। অবশেষে মর্যাদাবোধ প্রবলভাবে মাথাচারা দিয়ে উঠলো এবং বিজয়ী হলো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যে করেই হোক এ অবমাননাকর বন্ধু দাফন করেই ছাড়বো।একদিন স্ত্রীকে বললাম ওকে সাজিয়ে দাও, ওকে নিয়ে আমি দাওয়াতে যাবো। আমার স্ত্রী তাকে গোসল করিয়ে পরিষ্কার কাপড় চোপড় পরিয়ে তেলপানি দিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে তৈরী করে দিলো। ছোট্ট মেয়েটি পিতার সাথে বেড়াতে যাবে এজন্য তার আর আনন্দ ধরে না। আমি তাকে নিয়ে এক নির্জন জঙ্গলের দিকে রওয়ানা দিলাম। অবলা এ কন্যাটি মনের আনন্দে নাচতে নাচতে আমার সাথে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমার পাষাণ মনে একই ভাবনা, কত তাড়াতাড়ি এ লজ্জার
পৃষ্ঠা:১৫৮
পুটলীটিকে মাটিতে পুঁতে ফেলা যায়। তারতো কিছু জানা ছিলো না, নিষ্পাপ শিশুটি কখনো আমার হাত ধরে আবার কখনো আমার আগে আগে দৌড়ে পথ চলতে লাগলো। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কতো কথা বলতে লাগলো। অবশেষে আমি এক জায়গায় গিয়ে থামলাম। থেমে সেখানে গর্ত খুঁড়া শুরু করলাম। সে দেখেতো পেরশান। হাজারো প্রশ্ন আব্বু এখানে গর্ত খুঁড়ছো কেন? কি করবে? ইত্যাদি। সেতো জানতো না, তার নিষ্ঠুর পিতা তার জন্য কবর খুড়ছে, যেখানে তাকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিয়ে যাবে। গর্ত খুঁড়ার সময় যখন আমার পা ও কাপড়ের উপর মাটি পড়ছিলো ছোট মেয়েটি তার কোমল হাতে সেই মাটি ঝেড়ে দিচ্ছিলো আর বলছিলো- আব্বু তোমার কাপড় ময়লা হচ্ছে। আমি গর্ত খুঁড়া শেষ করে পবিত্র ও নিষ্পাপ হাসিখুশি মেয়েটিকে ধরে গর্তে ফেলে দিলাম এবং খুব দ্রুত মাটি চাপা দিতে লাগলাম। কন্যাটি আর্ত চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো- আব্বু আমার! তুমি একি করছো? আমিতো কোন দোষ করিনি, আমাকে মাটি চাঁপা দিচ্ছো কেন? কিন্তু কে শুনে কার কথা, আমি অন্ধ এবং বধিরের ন্যায় আমার কাজ করেই গেলাম। এ ঘটনা শুনে নবী করীম (সা) এবং উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। এ ছিল সেই সমাজের নিত্য দিনের ঘটনা। একমাত্র ইসলাম তাদের এ পাপপুরি থেকে ফিরিয়ে এনে দিয়েছে শ্বাশত সত্য ও সুন্দর পথের সন্ধান। বাঁচিয়েছে শতকোটি অবলা নারীর জীবন। দিয়েছে প্রতিটি নারীকে পুরুষের সমান অধিকার। সমাজে তাদেরকে মহিয়সী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
হাদিসটির গুরুত্ব
নারীজাতি বা কন্যা অপয়া বা লাঞ্ছনার কারণ নয়। বরং তারাই সৌভাগ্য ও শান্তির দূত। তাদের উসিলায় জান্নাতে যাবার পথ সহজ ও সুগম হয়। বলা যেতে পারে এক সুবর্ণ সুযোগ ঐসব লোকদের জন্য, যারা কন্যা সন্তানের জনক বা জননী। তাছাড়া এক কন্যার কারণে গোটা ঘর বা বাড়ীর সাথে আল্লাহর রহমতের ধারা অবিচ্ছিন্ন ভাবে জারী হয়ে যায়। কাজেই যারা এ ধারাকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা হতভাগা ছাড়া আর কিছুই নয়। পুরুষরা যেমন- আল্লাহর এক পরিকল্পিত সৃষ্টি তেমনিভাবে নারী জাতিও আল্লাহর এক পরিকল্পিত সৃষ্টি। এরা আগাছা পরগাছার মত পৃথিবীতে আসেনি। মানব সমাজে আল্লাহ্ নারী পুরুষের
পৃষ্ঠা:১৫৯
মধ্যে এমনভাবে ভারসাম্য স্থাপন করেছেন যে, একজন ছাড়া আরেকজন অসম্পূর্ণ ও অচল। একে অপরের পরিপুরক। যাকে ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ তাকে তো আর অবজ্ঞা করা যায় না। যেহেতু ইসলামের লক্ষ্য একটি সুখী সমৃদ্ধ ও আদর্শ সমাজ কায়েম করা। তাই উভয়কেই সমাজের একজন হিসাবে সমমর্যাদা প্রদান করেছে। বস্তুতঃ এ হাদিসটি আদর্শ ও সুখী সমৃদ্ধ সমাজ কায়েম এবং সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে।
ব্যাখ্যা
কন্যা সন্তান অথবা পুত্রসন্তান কেউ নিজের ও পছন্দ মতো বানিয়ে নিতে পারে না। এটা আল্লাহর দান। কিন্তু নব্য জাহেলিয়াতের এ সমাজে পুত্র সন্তানের জন্মের খবর যে আবেগ ও উচ্ছ্বাসের সাথে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবকে দেয়া হয়। অবশ্য সেইভাবে কোন কন্যা সন্তান জন্মের খবর কাউকে প্রদান করা হয় না। আবার শ্রোতার নিকট থেকেও তেমন উষ্ণতা বা উচ্ছ্বাস পাওয়া যায় না, যেমন উষ্ণতা ঔউচ্ছ্বাস পাওয়া যায় পুত্র সন্তানের খবর প্রদানের পর। মহান আল্লাহ্ বলেন- يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ تَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ تَشَاءُ الذُّكُورَ أو يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَا إِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيره তিনি যা চান তাই সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছে কন্যা দান করেন, যাকে ইচ্ছে পুত্র দেন। আবার যাকে ইচ্ছে পুত্রকন্যা মিলিয়ে দেন, আবার যাকে ইচ্ছে বন্ধ্যা বানিয়ে রাখেন। নিঃসন্দেহে তিনি পরম প্রজ্ঞাময় ও নিরংকুশ ক্ষমতায় অধিকারী। (সূরা আশশুরা : ৪৯-৫০)।এ আয়াতে একটি কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে মহান আল্লাহর একটি গুনের উল্লেখ, আর সে গুনটি হচ্ছে علیم বা পরম প্রজ্ঞাময়। কারণ একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো এ প্রজ্ঞা বা জ্ঞান নেই, তার জন্য শুধু কন্যা সন্তানই কল্যাণকর হবে, না পুত্র সন্তান কল্যাণকর হবে। অনেক পরিবারে দেখা যায় শুধু কন্যা আর কন্যা তাদের কোন পুত্র সন্তান নেই তবুও সে পরিবারে
পৃষ্ঠা:১৬০
আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বন্যা প্রবাহিত হয়। পক্ষান্তরে কোন গৃহে দেখা যায় শুধু পুত্র সন্তান একটি কন্যা সন্তানও নেই। সেখানে পুত্র সন্তান শাস্তির পরিবর্তে অশান্তির সয়লার বইয়ে দিচ্ছে। এমনও দেখা যায়, একাধারে কয়েকজন পুত্র সন্তান জন্ম নেবার পর মা সারাক্ষণ একটি কন্যা সন্তানের জন্য দোয়া করেছে, কিন্তু যখনই তাকে আল্লাহ্ কন্যা সন্তান দান করেছে, তখনই তা তাদের সর্বানাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে মা আপেক্ষ করে বলে, হায়রে পোড়া কপাল। জন্মের সময়ই যদি এ হতভাগী মরে যেতো তবে কতইনা ভালো হতো। এজন্যই আল্লাহ্র ফায়সালার উপর অসন্তষ্টু না হয়ে বরং একে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা অথবা কল্যাণকর ফায়সালা হিসেবে মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা)-এর কাছে এক ব্যক্তি বসেছিলো। লোকটির কয়েকটি মেয়ে ছিলো। সে আক্ষেপ করে বললো! হায়! এসব মেয়ে যদি মরে যেতো তাহলে ভালো হতো। ইবনে উমর (রা) কথাটি শোনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন এবং ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি তাদের রিযিক দাও?” রাসূলে আকরাম (সা) বলেছেন- لا تَكْرَهُو الْبَنَاتِ فَإِنِّي أَبُو الْبَنَاتِ কন্যাদেরকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করোনা, আমি স্বয়ং কন্যাদের পিতা। (কানযুল উম্মাল) তিনি আরো বলেছেন- مَنْ عَالَ جَارِينَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ كَهَاتَيْنِ وَضَمَّ أَصَابِعه – যে ব্যক্তি দুটো কন্যা সন্তান প্রতিপালন করলো। এমনকি তারা দুজন বালেগ হয়ে (স্বামীর ঘরে) গেলো। কিয়ামতের দিন ঐ কন্যাদয়ের পিতা এবং আমি দু’আঙ্গুলের মতো একসাথে থাকবো। একথা বলে তিনি আঙ্গুল দু’টো মিলিয়ে দেখালেন। (সহীহ্ আল মুসলিম)। অন্য হাদীসে আছে- له ثَلَاثُ بَنَاتِ بُرُويْهِنَّ وَيَكْفِيهِنَّ وَيَرْهُمُهُنَّ فَقَدْ وَجَب مَنْ كَانَ
পৃষ্ঠা ১৬১ থেকে ১৬২
পৃষ্ঠা:১৬১
لَهُ الْجَنَّةُ البَتْهُ فَقَالَ رَجُلٌ مِّنْ بَعْضِ الْقَوْمِ وَثِنْتَيْنِ يَا رَسُولُ اللهِ ؟ قَالَ وَ ثِنَتَيْنِ – যে ব্যক্তির তিনটি মেয়ে এবং সেই তিন মেয়েকে নিজের অভিভাবকত্বে রেখেছে এবং তাদের প্রয়োজনাবলী পূরণ করেছে ও তাদের প্রতি স্নেহশীল, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে। কোন গোত্রের এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি মেয়ে দু’জন হয়। তিনি উত্তর দিলেন- দু’জন হলেও (জান্নাত ওয়াজিব)। (আদাবুল মুফরাদ) আয়িশা (রা) বর্ণনা করেছেন, এক মহিলা আমার কাছে এসে কিছু চাইলো, সাথে তার দু’টো মেয়ে ছিলো। আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া আর কিছুই ছিলোনা। আমি খেজুরটি তাকে খেতে দিলাম। সে না খেয়ে তা দু’ভাগ করে দু’কন্যাকে দিলেন। তারপর সে উঠে চলে গেলো। নবী করীম (সা) ঘরে এলে আমি তাঁকে ঘটনাটি বললাম। শোনে তিনি বললেন, যাকে কন্যা সন্তান দিয়ে পরীক্ষা করা হয় (অর্থাৎ যার কন্যা সন্তান হয়) এবং সে যদি তাদের সাথে ভালো ও সুন্দর আচরণ করে, এ কন্যারা তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য ঢাল স্বরূপ কাজ করবে। পুত্র ও কন্যার মধ্যে পার্থক্য না করাঃ আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা) বলেছেন-
مَنْ كَانَتْ لَهُ أُنثى فَلَمْ يَندُهَا وَلَمْ يُهِنَّهَا وَلَمْ يُؤْثِرُ وَلَدَهُ عَلَيْهَا يعني الذِّكُورَ أَدْخَلَهُ اللَّهُ الْجَنَّةَ – যার মেয়ে হলো এবং সে তাকে (জাহেলী যুগের মতো) জীবিত দাফন করলোনা, তাকে অবহেলা করলো না এবং ছেলেদেরকে মেয়ের উপর প্রাধান্য দিলোনা, তাকে আল্লাহ্ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (আবু দাউদ)। অসহায় কন্যার ব্যয়ভারঃ অনেক সময় মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পর সে তার স্বামীর বাড়ী থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়। যেমন- স্বামী মারা গেলো, অথবা তাকে স্বামী তালাক দিলো কিংবা এমন মেয়ে যে আদৌ বিয়ের যোগ্য নয়, এ ধরনের মেয়েদের ব্যয়ভার নির্বাহ করা অভিভাবকের জন্য উত্তম সদকা।
পৃষ্ঠা:১৬২
রাসুলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন- الا أَدُلُّكُمْ عَلى أفضل الصدقَةِ ابْنَتَكَ مَرْدُ وَدَةً إِلَيْكَ لَيْسَ لَهَا كاسب غيرك – –আমি কি তোমাদেরকে উত্তম সদকার কথা বলে দেবো না? তাহলো তোমাদের সেই কন্যা যাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তোমরা ছাড়া তাকে উপার্জন করে খাওয়াবার আর কোউ নেই। (ইবনে মাজা)কাজেই দেখা যাচ্ছে দূর্বল কন্যার অভিভাবক বানিয়ে আল্লাহ্ কাউকে ধ্বংস করেননা বরং এটা বান্দার উপর আল্লাহর এক বিরাট ইহসান। যে জান্নাতকে আল্লাহ কঠিন ক্লেশ ও বিপদ সংকুল পথ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন শুধুমাত্র কন্যার পিতা মাতা হওয়ার কারণে সেই জান্নাতের পথ তাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। তাছাড়া নবী করীম (সা) এর সাথী হওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি, একমাত্র কন্যা সন্তান প্রতি পালনের বিনিময়ে কিয়ামতের দিন নবী করীম (সা) এর সাহচর্য লাভ করার সৌভাগ্য হবে। এ সুযোগটি কি একেবারে তুচ্ছ মনে করা কোন মুমিনের জন্য শোভনীয়? নিশ্চয়ই নয়। তাছাড়া এটাও আল্লাহর কুদরতের বাইরে নয়, এক দূর্বল কন্যা সন্তান (শুধু তার নিজের রিযিকই নিয়ে আসে না, বরং) সে তার নিজের ভাগ্যের বদৌলতে অভিভাবকদের অবস্থাও ফিরিয়ে দিতে পারে
শিক্ষাবলী
১. কন্যা সন্তান দূভাগ্যের কারণ নয় বরং সৌভাগ্যের চাবিকাঠি।
২. কন্যা সন্তানের কারণে আল্লাহর রহমতের ধারা অবিচ্ছিন্ন থাকে।
৩. জান্নতে যাওয়া এবং নবী করীম (সা) এর সাহচর্য লাভ করা কন্যা সন্তান
প্রতিপালনের কারণে সহজতর হয়।
৪. আল্লাহ্ কাউকে শুধু ছেলে, আবার কাউকে শুধু মেয়ে, অথবা কাউকে ছেলে মেয়ে মিলিয়ে দিয়ে কিংবা কাউকে কোন সন্তান না দিয়ে পরীক্ষা করেন।
৫. কন্যাকে অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা গুনাহর কাজ।
৬. কন্যা সন্তান জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য ঢাল স্বরূপ।
৭. কন্যাদের উপর পুত্রদেরকে প্রধান্য দেয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এমনকি তা
কুফুরীর দিকেও নিয়ে যেতে পারে।
৮. স্বামী পরিত্যাক্ত অথবা বিধবা কন্যাদের প্রতিপালন করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।
৯. কন্যাদের সৌভাগ্যের কারণে অনেক অভিভাকদের আর্থিক অবস্থাও উন্নতি হতে পারে।